কবির মৃত্যু নেই

প্রকাশ : ০২ নভেম্বর ২০২৩, ১২:২৮ , অনলাইন ভার্সন
আমিনুর রশীদ পিন্টু


‘জীবন মরণের অবিরাম সংগ্রাম চলছিল এতোদিন। ছিলো শ্বাসকষ্ট আর অনিদ্রা। তারপর এক সময়ে রুদ্ধ হলো সবকিছু। চিরনিদ্রায় অভিভূত হলেন কবি। প্রার্থণা-প্রতীক্ষা এতো যে প্রত্যাশা- সবই ব্যর্থ। সেই মৃত্যু স্তব্ধতার বুক চিড়ে ঘোষিত হলো এক মর্মান্তিক সত্য- কবি আর বেঁচে নেই। ঘড়ির কাঁটার তখন এগারোটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট। আর দিনটি ছিলো ১৯৫৪ খ্রীষ্টাব্দের ২২শে অক্টোবর।’
বাংলা সাহিত্যের ‘শুদ্ধতম কবি’ হিসেবে অভিহিত কবি জীবনানন্দ দাশের কথাই বলছি। কী ছিলো তার মনে। আনমনে পথ চলছিলেন- কী ভাবছিলেন? কবির যাত্রা ছিলো সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে এক বিদর্ভ নগরে। স্বপ্নে লালিত রূপসী কন্যা ‘বনলতা সেনের’ আহ্বান কী তাঁকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল ট্রাম লাইনের পথে? ট্রামচালক তার জবানীতে বললেন- ‘এতো যে হুঁইশেল দিলাম, এতো যে ডাকলাম- বাবু সরে যান, সরে যান- কিন্তু তিনি থামলেন না।’

কবির তিরোধানে মনে হয় সেই সময়ের কাব্য-পিপাসুরা তাঁর রচিত অন্তিম পদাবলীগুলিই আওড়ালেন-
‘শোনা গেলো লাশকাটা ঘরে/ নিয়ে গেছে তারে কাল হাতে ফাগুনের রাতের আঁধারে- যখন গিয়াছে ডুবিয়া/ পঞ্চমীর চাঁদ, মরিবার হলো তার সাধ।’
প্রশ্ন আরো থেকে যায়। অবিরাম সাধ কেনো কবির মনে সারাক্ষণই উঁকিঝুঁকি দিয়ে যাচ্ছে? সুন্দরের সাধনাই তো একজন কবির সৃষ্টির প্রেরণা। বিশেষত জীবনানন্দ দাশ বাংলার যে অপরূপ রূপ এঁকেছেনÑ যেখানে মূর্ত হয়ে উঠেছে কলমী শাক থেকে বাংলার মধুরূপী ঘাস। ধানসিড়ি নদীতে যিনি দেখেন হেমন্তের ধূসর গোধূলী আর দোয়েল-শ্যামার ডাক- ছিন্ন সঞ্জনার মতো বাজে পায়ে পায়ে তার। তিনি কোনো মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে যাবেন??

অবধারিত মানুষের জীবনাবসান। এই সেই বিধির বিধান, যাকে খণ্ডানোর কোন বিকল্প নেই। তাই তো বিশ্বকবি নিয়ত গেয়েছেন- ‘মরিতে চাহি না আমি এই সুন্দও ভূবনে’। অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে পৃথিবীর অনেক কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী এইভাবে অন্তিম জীবনের কথাই ভেবেছেন- এড়িয়ে গেছেন বেঁচে থাকার আনন্দ।

উত্তরটি খুঁজতে গিয়ে চিকিৎসক, বিজ্ঞানী এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের একই মত- সৃষ্টি শৈলীর সংস্পর্শে যাঁরাই এসেছেন- তাঁদের মাঝে একটা মানসিক ব্যাধি অন্তরালে বসবাস করে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে যাকে বলা হয়ে থাকে DEPRESSION- অর্থাৎ মানসিক ভারসাম্যহীনতা। সাধারণত জীবনের ব্যর্থতা, দুশ্চিন্তা, অর্থাভাব, যশের অভাব অথবা পারিবারিক কারণেই এই মানসিক ব্যাধির সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু শিল্পীর কাজ হলো- এই বিশ্ব চরাচরে যে রসধারা, যে সুরের খেলা এবং সৃষ্টির লীলাখেলা- তাকে আনন্দধ্বনি বাজিয়ে মানুষের অন্তরে পৌঁছে দেয়া। 

পৌঁছে দিয়েই কী যাত্রা শেষ হয়ে যায়? এই প্রশ্নের উত্তর কারো জানা নেই। হয়তো কর্মজীবনটি শেষ হয়ে গেলো। কিন্তু সৃষ্টির সাধনায় জীবনের যে সময়টুকু ভবিষ্যতের জন্য রেখে যান- সেটার আয়ু আরো দীর্ঘায়িত। এই প্রসঙ্গে এবারের নোবেল বিজয়ী কবি জন ফসের (Jon Fosse) বক্তব্য হলো- ‘সৃষ্টিকর্তা মানুষ সৃষ্টি করেছেন এবং অবধারিত সত্য যে- তাঁর কাছে ফিরে যেতে হবে। সময়ের আবর্তনে দেহটি ক্ষয়ে যাবে, ধীরে ধীরে নির্জীব হয়ে যাবে এবং মরণ দিয়ে তার শেষ পরিণতি। কিন্তু জীবনের জ্যোতিটি রয়ে যাবে (Spirit)। এই জ্যোতি হচ্ছে দেহ এবং আত্মার মিলন। এই অদৃশ্য শক্তিই সৃষ্টির প্রেরণাকে উজ্জীবিত করে রাখে। জ্যোতির্ময় করে রাখে বাকি সময়টা- অর্থাৎ সৃষ্টিশীল মানুষ সেটাই রেখে যান ভবিষ্যতের জন্য।’ এই যে সুন্দরের সাধনার বিনিময়- তাকেই আগলে রাখেন উৎসাহী শ্রোতা এবং পাঠকেরা। সুন্দর সৃষ্টিসমূহ তাই এক অমরত্বের দাবিদার। কেননা কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের অমর সৃষ্টিমালা, সুন্দরের সাধনার দুয়ারটি খুলে দেয়। নতুন পথের সন্ধান দেন তাঁরা। এবং এইভাবেই শিল্পের নিরীখে আরেকটি মহাকর্মের শুরু। কিন্তু বিজ্ঞান বলে অন্য কথা। বলেন শিল্পীদের এবং বিজ্ঞানীদের যন্ত্রণার কথা। নতুন নতুন সৃষ্টির নেশায় তাঁদের মস্তিষ্ক থাকে সদাচঞ্চল। এই চঞ্চলতাকে চিকিৎসার ভাষায় বলা হয়-  Neuro Disorder, অর্থাৎ মস্তিষ্কের বৈকল্য। কিন্তু এর অর্থ নয় যে, আত্মহননের পথটি বেছে নিতে হবে।

কিন্তু বাস্তবে তাই হয়েছে। শিল্পী ভ্যান গগ্, কবি সিলভিয়া প্লাথ, এ্যান সেক্সটন, রাশিয়ার কবি ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কী এবং আরো অনেকেই এই পথে জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। আমেরিকান লেখক আর্নেস্ট হোমিংওয়ে বলতেন- ‘লেখালেখির ব্যাপারটাও একটা যুদ্ধ। যারা যুদ্ধে যায়- তারা বীর। লড়াই তাদের ধর্ম।’ বিশ্ববিখ্যাত লেখক হেমিংওয়ে একদিন নিজেই বিদায় নিলেন নিজের রাইফেলের গুলিতে।

কিন্তু জীবনানন্দ দাশ কী আদতেই আত্মহত্যা করেছিলেন- তার সঠিক উত্তর আজও পাওয়া যায়নি। এটা সত্য, তিনি ছিলেন নির্জনতার কবি। নিজেকে সবসময়ই জনসাধারণের কাছ থেকে আড়াল করে রেখেছিলেন। কবি শামসুর রাহমান নিজেও স্মৃতিচারণ করেছেন কবির সঙ্গে সাক্ষাতের পর এইভাবে- ‘কথাবার্তয় বিব্রত, প্রায় সারাক্ষণ অতল লাজুকতায় নিমজ্জিত, সব রকমের কোলাহল থেকে সর্বদা পলায়নপর এই অসামান্য শিল্পী মানুষটির দিকে বিস্ময়ে তাকিয়েছিলাম অনেকক্ষণ। এবং এও এক আশ্চর্য্য ঘটনা যে, যিনি কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনের ত্রিসীমানায় ঘেঁষেননি- কিন্তু তাঁর কবিতার পংক্তিমালা আমাদের প্রেরণা জুগিয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে।’ তাই বলছিলাম, কবিরা আবেগপ্রবণ, স্পর্শকাতর এবং মানসিক ভারসাম্যহীনতায় ভুগলেও- কবি ও কবিতার মৃত্যু নেই। এবং শিল্প সৃষ্টির এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার জন্য নিরলস সৃজনশীল কাজের কোনো বিকল্প নেই।
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: +880  1338-950041