‘টাকা-পে’: বাংলাদেশ পাচ্ছে নিজস্ব কার্ড

প্রকাশ : ০১ নভেম্বর ২০২৩, ০৯:৪৫ , অনলাইন ভার্সন
আন্তর্জাতিক কার্ডের ওপর নির্ভরতা কমাতে এবং বিদেশি মুদ্রা সাশ্রয়ে ‘টাকা-পে’ কার্ড চালুর মাধ্যমে নিজস্ব কার্ড যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে বালাদেশ। ডেবিট কার্ড দিয়ে শুরু করে পরবর্তীতে ক্রেডিট ও আন্তর্জাতিক কার্ড তৈরির লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ধারাবাহিকতায় আগামী ডিসেম্বরে ‘টাকা-পে’ কার্ডের মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে ডুয়ল কারেন্সি বা দ্বৈত মুদ্রা ব্যবহারের সুযোগ তৈরি হতে যাচ্ছে।

‘টাকা-পে’ কার্ড উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। ভার্চুয়ালি এই অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তারা।

‘টাকা পে’ কার্ড এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রথম লেনদেন করবে রাষ্ট্রায়ত্ব সোনালী ব্যাংক, সিটি ব্যাংক ও ব্র্যাক ব্যাংক পিএলসি।

ব্যাংক খাতের নানা চ্যালেঞ্জ নিয়ে সোমবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ ব্যাংকে বিভিন্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। সেখানে অংশ নেওয়া ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান সেলিম আরএফ হোসেন বলেন, ‘টাকা-পে’ কার্ড চালুর সবশেষ প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে বৈঠকে।

‘টাকা-পে’ কার্ডের মত ভারতের রয়েছে ‘রুপি কার্ড’। একইভাবে শ্রীলঙ্কার ‘লঙ্কা-পে’, পাকিস্তানের ‘পাক-পে’, এবং মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরবের ‘মাদা-কার্ড’ নামে নিজস্ব কার্ড রয়েছে। এবার ‘টাকা-পে’ চালুর মধ্য দিয়ে সেই তালিকায় যুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশও।

টাকা-পে কার্ড হল এক ধরনের ডেবিট কার্ড। এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ব্যাংক ইস্যু করতে পারবে। নিয়ন্ত্রণ থাকবে বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে। এই কার্ডের মাধ্যম প্রচলিত কার্ড (ভিসা, মাস্টার) এর মত লেনদেন করতে পারবেন গ্রাহকরা।

বর্তমানে ক্রেডিট কার্ড দিয়ে বাংলাদেশি নাগরিকরা সবচেয়ে বেশি বিদেশি মুদ্রা খরচ করছে প্রতিবেশী দেশ ভারতে। আগামী ডিসেম্বরে ডুয়ল কারেন্সি বা দ্বৈত ‍মুদ্রা ব্যবহারের সুবিধা যুক্ত হলে ‘টাকা-পে’ কার্ডের মাধ্যমে ভারতীয় মুদ্রা রুপিও ব্যবহার করতে পারবেন বাংলাদেশিরা।

দ্বিপক্ষীয় লেনদেন চালু করতে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক ইন্ডিয়া প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর মাধ্যমে টাকা ও রুপি বিনিময় করতে ‘টাকা পে’ কার্ড ‘ডুয়ল কারেন্সি কার্ড’-এ পরিণত হবে।

ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড

ব্যাংক হিসাবে থাকা আমানতের বিপরীতে যে কার্ড ব্যবহার করা হয় তা ডেবিট কার্ড। আর একটি সীমা বেঁধে দিয়ে ব্যাংক যে পরিমাণ ধার নেওয়ার সুযোগ দিয়ে কার্ড ইস্যু করে, সেটি হল ক্রেডিট কার্ড। গ্রাহকের ব্যাংক হিসাবে অর্থ না থাকলেও গ্রাহকরা ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ খরচ করতে পারেন।

ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে খরচ হওয়া অর্থ ৪০-৪৫ দিনের মধ্যে ব্যাংকে পরিশোধ করতে হয় বিনা সুদে। এরপর বকেয়া থাকা অর্থের ওপর সুদ যোগ করে ব্যাংকগুলো।

নগদ টাকা বহনের চেয়ে নিরাপদ ও লেনদেন সহজ হওয়ায় কার্ড ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে মানুষ। দেশে ৪৩টি ব্যাংক ক্রেডিট ও ডেবিট কার্ড ইস্যু করছে। এছাড়া একটি ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানও ক্রেডিট কার্ড দিচ্ছে। সব মিলিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের ইস্যু করা কার্ডের সংখ্যা ৩ কোটি ২৭ লাখের বেশি।

দেশে যতগুলো কার্ড ব্যবহার হচ্ছে তার সবগুলোই বিদেশি কোম্পানির তৈরি। একটি নির্দিষ্ট ফির বিপরীতে ব্যাংকগুলো এই কার্ড সেবা দিয়ে আসছে। এতে এক ব্যাংকের ইস্যু করা কার্ড অন্য ব্যাংকের এটিএম বুথে লেনদেন করতে বাড়তি খরচ দিতে হয়। এছাড়া বছর শেষে গ্রাহককে ১৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত কার্ড ব্যবহারের ফি দিতে হয় ব্যাংকগুলোকে। তার সঙ্গে রযেছে ১৫ শতাংশ ভ্যাট।

এর বাইরে প্রি-পেইড কার্ড রয়েছে, যার ব্যবহার একেবারেই কম। গ্রাহকদের কাছ থেকে ব্যাংকের নেওয়া ফির একটি অংশ পায় কার্ড মালিক বিদেশি মালিকানা প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে বিদেশি মুদ্রা চলে যায়।

কিন্তু ‘টাকা-পে’ কার্ড পরিচালিত হবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচ বাংলাদেশ (এনপিএসবি) এর মাধ্যমে। ফলে এই কার্ড যে কোনো এটিএম বুথে সহজে লেনদেন করা যাবে। সেক্ষেত্রে দ্রুত ও নির্বিঘ্নে লেনদেন করা যাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছে, এই কার্ডের মাধ্যমে প্রচলিত কার্ডের চেয়ে খরচ অন্তত ৫-৬ শতাংশ কম হবে। তবে আসলে কী প্রভাব পড়ল তার ‘টাকা-পে’ কার্ড চালু হলেই বোঝা যাবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক।

প্রথম দিকে ৮ ব্যাংক

‘টাকা-পে’ কার্ড চালুতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি মিলিয়ে আটটি ব্যাংক। কার্ড ব্যবহারে গ্রাহক সংখ্যায় এগিয়ে থাকা রাষ্ট্রায়ত্ব সোনালি ব্যাংক, বেসরকারি খাতের ব্র্যাক ব্যাংক, দি সিটি ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক (ইবিএল), ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি), ডাচ-বাংলা ব্যাংক ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক প্রথম দিকে ‘টাকা-পে’ কার্ড ইস্যু করার সুযোগ পাচ্ছে।

পরবর্তীতে অন্যান্য ব্যাংকগুলোও চাইলে এই কার্ড ইস্যু করতে পারবে। আর বাংলাদেশের জাতীয় ডেবিট কার্ড প্রস্তুতে কারিগরি বিষয় দেখভালে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে প্যারিসভিত্তিক পরামর্শক ‘ফিম’কে।

সবশেষ প্রস্তুতি ও সাম্প্রতিক ব্যাংকিং চ্যালেঞ্জের নানা দিক নিয়ে সোমবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ ব্যাংকে বিভিন্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।

বৈঠকে অংশ নেওয়া ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও এবিবি চেয়ারম্যান সেলিম আরএফ হোসেন বলেন, “কিছু কনফিডেনশিয়াল বিষয় ছিল আলোচনায়, যা এখন পাবলিক (প্রকাশ করা) করা যাবে না। কয়েকটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা কথা বলেছেন নিজস্ব বিষয় নিয়ে। আর আগামী ১ নভেম্বর টাকা-পে কার্ড উদ্বোধন হতে যাচ্ছে তার সর্বশেষ প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।”

ভারতের সঙ্গে লেনদেন

‘টাকা-পে’ কার্ডের মাধ্যমে ডিসেম্বরে ভারতের সঙ্গে দ্বৈত ‍মুদ্রা ব্যবহারের সুযোগ তৈরি হবে। তখন উভয় মুদ্রা ব্যবহারের সুযোগ পাবেন বাংলাদেশি ও ভারতীয়রা। দ্বিপাক্ষিক লেনদেন চালু করতে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক ইন্ডিয়া প্রস্তুতি নিচ্ছে।

বাংলাদেশি নাগরিকরা ভারতে গিয়ে এই কার্ডে সব রকমের লেনদেন করতে পারবেন। আলাদাভাবে বিদেশি মুদ্রা, ডলার বা রুপি বহনের প্রয়োজন পড়বে না।

গত জুলাই মাসে নিজস্ব ডেবিট কার্ড চালুর ঘোষণা দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। সেপ্টেম্বরে ‘টাকা-পে’ কার্ড চালুর সিদ্ধান্ত থাকলেও তা পিছিয়ে নভেম্বরে চালু করা হচ্ছে।

কার্ডে ৪১ হাজার কোটি টাকা লেনদেন

বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সব ধরনের কার্ডের মাধ্যমে লেনদেনের পরিমাণ বেড়েই চলছে। গত অগাস্টে কার্ডের মাধ্যমে মোট লেনদেন হয় ৪১ হাজার কোটি টাকার বেশি। এক বছর আগে যা ছিল ৩৬ হাজার ৭৮৭ কোটি ৭৬ লাখ টাকার।

গত অগাস্টে কার্ডে স্থানীয় মুদ্রা টাকায় লেনদেন হয় ৪০ হাজার ৩২৬ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। আর বিদেশি মুদ্রায় লেনদেন হয় ৬৫৮ কোটি ২৮ লাখ টাকা। কার্ডে মোট লেনদেনের ৯৮ দশমিক ৩৯ শতাংশই হয়েছে দেশের ভেতরে।

বর্তমানে ভিসা, মাস্টার কার্ড, এমেক্স, ডিনারস, কিউ ক্যাশ, জেসিবি ইউনিয়ন পে’র মত ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড সেবা রয়েছে। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক লেনদেন সুবিধা সম্পন্ন হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহারে এসব কার্ডের গ্রাহক সংখ্যা বাড়ছে দিন দিন।

নিজস্ব কার্ড ব্যবহার বাড়লে কার্ডভিত্তিক লেনদেনে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভরতা কমে আসবে বাংলাদেশের। সাশ্রয় হবে বিদেশি মুদ্রা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, গত অগাস্টে শুধু ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন হয় ৩৮ হাজার ১৬৫ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। দেশের ভেতরে তখন ক্রেডিট কার্ডে লেনদেন হয় ২ হাজার ৪৩৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা। বেশি লেনদেন হয়েছে ভিসা কার্ডে। এই কার্ডের মাধ্যমে মোট লেনদেনের ৭২ দশমিক ৬৬ শতাংশ সম্পন্ন হয় অগাস্টে।

এরপর মাস্টার কার্ডে ১৭ শতাংশ, এমেক্স ১০ শতাংশ, ডিনারস শূন্য দশমিক ১৩ শতাংশ, কিউ ক্যাশ প্রপ্রিটারি শূন্য দশমিক ০৪ শতাংশ, জেসিবি শূন্য দশমিক ০৪ শতাংশ ও ইউনিয়ন পে শূন্য দশমিক ০১ শতাংশ।

অন্যদিকে গত অগাস্টে বাংলাদেশের নাগরিকরা বিদেশে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন করেছে ৪১৭ কোটি ৯০ লাখ টাকা। ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে দেশের বাইরে গিয়ে খরচের মধ্যে বেশি হয়েছে ভারতে। তখন ভারতে খরচ হয়েছে ১৭ দশমিক ৬২ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রে ১৬ দশমিক ৩২ শতাংশ আর ৯ শতাংশ খরচ হয়েছে থাইল্যান্ডে।

বাংলাদেশের নিজস্ব কার্ড ব্যবহার চালু হলে বহুজাতিক আর্থিক সেবা দেওয়ার মত একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি হবে বলে মনে করেন বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান।

তিনি বলেন, “কার্ড সেবায় গ্রাহকদের কাছ থেকে যে হারে চার্জ ও ফি নেওয়া হচ্ছে তা ‘টাকা-পে’ কার্ডে কম হবে। আর আমাদের লেনদেন নিরাপত্তার বিষয়টিও জোড়ালো হবে। কার্ডে লেনদেন সংক্রান্ত কোনো দাবি দ্রুত নিষ্পত্তি যাবে। আইনি পদক্ষেপের প্রয়োজন দেখা দিলে বাংলাদেশের আদালতে বিচারিক প্রক্রিয়া সহজ হবে।’’

কোনো সমস্য দেখা দিলে বাংলাদেশ ব্যাংক দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারবে বলে জানান তিনি।

অপরদিকে কার্ডভিত্তিক লেনদেনে বাংলাদেশের স্বতন্ত্র পরিচয়ও উঠে আসবে বলে মনে করেন ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আরএফ হোসেন।

ঠিকানা/এসআর

 
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: +880  1338-950041