কাকন রেজা
গণমাধ্যমও ভিসানীতির আওতায় আসতে পারে, এমন কথার পর যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসকে জবাবদিহির আওতায় এনেছেন বাংলাদেশের সম্পাদক পরিষদ। পিটার ডি হাস তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। সম্পাদক পরিষদের সভাপতি মাহ্ফুজ আনামের একটা চিঠিই বাধ্য করেছে দূতাবাসকে তার ব্যাখ্যা দিতে। অর্থাৎ সম্পাদক পরিষদ আমেরিকাকেও কাবু করতে পারে। শুধু পারে না এক জায়গায়। সেখানে গেলেই অনেকের দু’হাত জোড় হয়ে যায় কৃতজ্ঞতা আর ‘শ্রদ্ধা’য়। সকল জবাবদিহির বিষয়টি গুবলেট হয়ে যায় শুধু নিজ রাষ্ট্রব্যবস্থার কাছে। অর্থাৎ নিশ্চিত এই রাষ্ট্রব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রব্যবস্থার চেয়েও শক্তিশালী, যে ব্যবস্থায় রাষ্ট্র এবং ব্যবস্থা মিলে একাকার হয়ে যায়। কোনটা রাষ্ট্র আর কোনটা ব্যবস্থা তা পৃথক করার শক্তি হারায় বিহ্বল মগজ।
যাকগে, আসি ভয়েস অব আমেরিকার (ভোয়া) আলাপে। সাংবাদিক হিসেবে ভোয়ার শতরূপা বড়ুয়ার তুলনা হয় না। শতরূপার মানে হলো শত রূপধারী, নামটা মূলত এমন ডাবল স্ট্যান্ডার্ডের জন্য সমার্থক। তিনি আকারে-ইঙ্গিতে, যে ইঙ্গিত খুব ধোঁয়াশাময়ও নয়, প্রমাণ করতে প্রয়াস করেছেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি, বলতে পারেন এর মধ্যে ভিসানীতিও রয়েছে, তা সঠিক নয়।
অবশ্য একটা পক্ষ বলতে পারেন, এটাই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। ভয়েস অব আমেরিকা সেই স্বাধীনতারই নজির রাখছে। অবশ্য এটা ঠিক, আমেরিকায় বসেই আমেরিকা মুর্দাবাদ বলা যায়, কেউ কিছু বলে না। সেখানে বসে তাদের বিরুদ্ধে উল্টো ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা যায়, তাতেও কেউ কিছু বলে না। এটাকেও অনেকে গণতন্ত্রের চর্চা বলেন। কিন্তু তারাই আবার দেশের ক্ষেত্রে বলেন উল্টোটা। আমেরিকার চর্চা পুতিনের বন্ধুরাষ্ট্রে করতে গেলে বাধে মহাবিপত্তি। নানা আইনের মারপ্যাঁচে পড়তে হয়। আইন নিয়ে প্রতিবাদ হলে, নতুন বোতলে পুরোনো মদ ঢালা হয়, কার্যকারণের তেমন কোনো হেরফের না ঘটিয়েই।
এখন আসি গণমাধ্যমের স্বাধীনতার আলাপে। এর আগে গণমাধ্যমের কাজটা কী এককথায় বলে নিই। গণমাধ্যমের প্রধানতম কাজ হচ্ছে ‘না’ বলা। সেটা হোক অন্যায়, দুর্নীতি বা দুঃশাসন, সেই ‘না’ তার বিরুদ্ধে। অবশ্য এখানেও ব্যতিক্রম আছে। গণমাধ্যমের কৌশলগত আচরণ এই ব্যতিক্রমের মধ্যে। কৌশলগত আচরণ হলো, গণমাধ্যমের সাহায্যে রাজনীতির প্রচার চালানো। অর্থাৎ দলীয় মুখপত্র। একে ঠিক গণমাধ্যম বলা যায় না, কারণ এর কাজ মানুষকে দলের নীতির প্রতি ‘প্রলুব্ধ’ করা। ‘প্রলুব্ধ’ শব্দটার মানে লোভ দেখানো, কিছু কিছু স্থানের ক্ষেত্রে এই শব্দটা উপযুক্ত। এখানে চাণক্যের কথায় আসি। তার সাম, দাম, দণ্ড ও বধের আলাপের প্রথম ও দ্বিতীয় অংশ এই শব্দটার সঙ্গে যুক্ত। বোঝানো এবং দাম দেওয়ার চেষ্টা করা। গণমাধ্যমের নামে দলীয় মুখপত্রগুলো ঠিক এই কাজটাই করে এবং তা কর্তৃত্ববাদী দেশগুলোতে। এসব কারণে রাজনৈতিক মাধ্যমকে ঠিক গণমাধ্যমের কাতারে ফেলা যায় না। তবু জোর করে কাতারবদ্ধ করা হয়। হোক, কিন্তু সেই রাজনৈতিক মাধ্যম যখন তাদের প্রচার ছেড়ে প্রচারণায় নেমে পড়ে, তখনই বাধে ঝামেলটা। প্রচার আর প্রচারণার মৌলিক পার্থক্যটুকু আমাদের অনেক গণমাধ্যমকর্মীই জানেন না। যেমন জানেন না সংবাদ ও খবরের আচরণগত পার্থক্যটুকু। প্রচার হলো দলীয় বা কোনো আদর্শ প্রচার। প্রচারণা হলো দলীয় বা কোনো ব্যাপারে সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং বানানো বিষয় প্রচার করা, যাকে সোজা কথায় গুজব বলা যায়। ভদ্র ইংরেজিতে বলা হয় প্রোপাগান্ডা। অতএব প্রোপাগান্ডিস্ট আর গণমাধ্যমবেত্তা এক জিনিস নয়।
আবার পিটার ডি হাসের প্রসঙ্গে আসি। তার বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছেন বাংলাদেশের বেশ কিছু নাগরিক। গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় আঘাত আসে এমন ব্যাপারে প্রতিবাদ জানানোটা ‘বেত্তা’দের জন্য অবশ্য জায়েজ। কিন্তু প্রোপাগান্ডিস্টদের ক্ষেত্রে নাজায়েজ।
ভারতের মোদিবিরোধী ‘ইন্ডিয়া জোট’ ২৪ জনেরও অধিক টিভি সঞ্চালককে বয়কট করেছে। কারণ এসব সঞ্চালকের শারীরিক ভাষা, শব্দ প্রয়োগ, প্রশ্নের ধরন সবই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কোনো না কোনোভাবে বিরোধী পক্ষকে বেকায়দায় ফেলাই হলো তাদের কাজ। অর্থাৎ এরা প্রোপাগান্ডার উপকরণ তৈরি করতে গণমাধ্যমকে ব্যবহার করতে চায়। ইন্ডিয়ার মতো বৃহৎ গণতন্ত্রের একটি দেশে যখন বিরোধী দল গণমাধ্যমের সঞ্চালকদের বয়কটের একটা সিদ্ধান্ত নেয়, তখন কিন্তু গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে না, যেমন আমাদের দেশে উঠেছে দুটি টেলিভিশনকে বিরোধী পক্ষ বয়কট করার প্রশ্নে। গণমাধ্যম প্রচারমাধ্যম হয়ে ওঠা পর্যন্ত মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু তা যখন প্রচারণার সঙ্গে যুক্ত হয় তখন তার আচরণ আর গণমাধ্যমের সঙ্গে যায় না এবং তাকে গণমাধ্যম হিসেবে মেনে নেওয়াও মূর্খতা। গণমাধ্যমের মূল চরিত্রটাই তাতে কলুষিত হয়। রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভের কাজ কোনো পক্ষকে বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দেওয়া নয় কিংবা কিম বা লুকাশেঙ্কোর মতো দুঃশাসককে টিকিয়ে রাখা নয়। উত্তর কোরিয়ার মাধ্যমকে গণমাধ্যম বলা হবে খোদ গণমাধ্যমকে অপমানের শামিল।
সুতরাং মাধ্যমের সঙ্গে ‘গণ’ যুক্ত করতে হলে ‘না’ বলা এবং লেখাটা আয়ত্ত করতে হবে। মেরুদণ্ড সোজা রাখতে হবে। মেরুদণ্ডটা সোজা রাখাই গণমাধ্যম ও সংশ্লিষ্টদের প্রধানতম কাজ। না হলে শঙ্খঘোষের কবিতার মতো সারা জীবন ‘হামাগুড়ি’ দিয়ে মেরুদণ্ডখানা খুঁজে যেতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
গণমাধ্যমও ভিসানীতির আওতায় আসতে পারে, এমন কথার পর যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসকে জবাবদিহির আওতায় এনেছেন বাংলাদেশের সম্পাদক পরিষদ। পিটার ডি হাস তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। সম্পাদক পরিষদের সভাপতি মাহ্ফুজ আনামের একটা চিঠিই বাধ্য করেছে দূতাবাসকে তার ব্যাখ্যা দিতে। অর্থাৎ সম্পাদক পরিষদ আমেরিকাকেও কাবু করতে পারে। শুধু পারে না এক জায়গায়। সেখানে গেলেই অনেকের দু’হাত জোড় হয়ে যায় কৃতজ্ঞতা আর ‘শ্রদ্ধা’য়। সকল জবাবদিহির বিষয়টি গুবলেট হয়ে যায় শুধু নিজ রাষ্ট্রব্যবস্থার কাছে। অর্থাৎ নিশ্চিত এই রাষ্ট্রব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রব্যবস্থার চেয়েও শক্তিশালী, যে ব্যবস্থায় রাষ্ট্র এবং ব্যবস্থা মিলে একাকার হয়ে যায়। কোনটা রাষ্ট্র আর কোনটা ব্যবস্থা তা পৃথক করার শক্তি হারায় বিহ্বল মগজ।
যাকগে, আসি ভয়েস অব আমেরিকার (ভোয়া) আলাপে। সাংবাদিক হিসেবে ভোয়ার শতরূপা বড়ুয়ার তুলনা হয় না। শতরূপার মানে হলো শত রূপধারী, নামটা মূলত এমন ডাবল স্ট্যান্ডার্ডের জন্য সমার্থক। তিনি আকারে-ইঙ্গিতে, যে ইঙ্গিত খুব ধোঁয়াশাময়ও নয়, প্রমাণ করতে প্রয়াস করেছেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি, বলতে পারেন এর মধ্যে ভিসানীতিও রয়েছে, তা সঠিক নয়।
অবশ্য একটা পক্ষ বলতে পারেন, এটাই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। ভয়েস অব আমেরিকা সেই স্বাধীনতারই নজির রাখছে। অবশ্য এটা ঠিক, আমেরিকায় বসেই আমেরিকা মুর্দাবাদ বলা যায়, কেউ কিছু বলে না। সেখানে বসে তাদের বিরুদ্ধে উল্টো ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা যায়, তাতেও কেউ কিছু বলে না। এটাকেও অনেকে গণতন্ত্রের চর্চা বলেন। কিন্তু তারাই আবার দেশের ক্ষেত্রে বলেন উল্টোটা। আমেরিকার চর্চা পুতিনের বন্ধুরাষ্ট্রে করতে গেলে বাধে মহাবিপত্তি। নানা আইনের মারপ্যাঁচে পড়তে হয়। আইন নিয়ে প্রতিবাদ হলে, নতুন বোতলে পুরোনো মদ ঢালা হয়, কার্যকারণের তেমন কোনো হেরফের না ঘটিয়েই।
এখন আসি গণমাধ্যমের স্বাধীনতার আলাপে। এর আগে গণমাধ্যমের কাজটা কী এককথায় বলে নিই। গণমাধ্যমের প্রধানতম কাজ হচ্ছে ‘না’ বলা। সেটা হোক অন্যায়, দুর্নীতি বা দুঃশাসন, সেই ‘না’ তার বিরুদ্ধে। অবশ্য এখানেও ব্যতিক্রম আছে। গণমাধ্যমের কৌশলগত আচরণ এই ব্যতিক্রমের মধ্যে। কৌশলগত আচরণ হলো, গণমাধ্যমের সাহায্যে রাজনীতির প্রচার চালানো। অর্থাৎ দলীয় মুখপত্র। একে ঠিক গণমাধ্যম বলা যায় না, কারণ এর কাজ মানুষকে দলের নীতির প্রতি ‘প্রলুব্ধ’ করা। ‘প্রলুব্ধ’ শব্দটার মানে লোভ দেখানো, কিছু কিছু স্থানের ক্ষেত্রে এই শব্দটা উপযুক্ত। এখানে চাণক্যের কথায় আসি। তার সাম, দাম, দণ্ড ও বধের আলাপের প্রথম ও দ্বিতীয় অংশ এই শব্দটার সঙ্গে যুক্ত। বোঝানো এবং দাম দেওয়ার চেষ্টা করা। গণমাধ্যমের নামে দলীয় মুখপত্রগুলো ঠিক এই কাজটাই করে এবং তা কর্তৃত্ববাদী দেশগুলোতে। এসব কারণে রাজনৈতিক মাধ্যমকে ঠিক গণমাধ্যমের কাতারে ফেলা যায় না। তবু জোর করে কাতারবদ্ধ করা হয়। হোক, কিন্তু সেই রাজনৈতিক মাধ্যম যখন তাদের প্রচার ছেড়ে প্রচারণায় নেমে পড়ে, তখনই বাধে ঝামেলটা। প্রচার আর প্রচারণার মৌলিক পার্থক্যটুকু আমাদের অনেক গণমাধ্যমকর্মীই জানেন না। যেমন জানেন না সংবাদ ও খবরের আচরণগত পার্থক্যটুকু। প্রচার হলো দলীয় বা কোনো আদর্শ প্রচার। প্রচারণা হলো দলীয় বা কোনো ব্যাপারে সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং বানানো বিষয় প্রচার করা, যাকে সোজা কথায় গুজব বলা যায়। ভদ্র ইংরেজিতে বলা হয় প্রোপাগান্ডা। অতএব প্রোপাগান্ডিস্ট আর গণমাধ্যমবেত্তা এক জিনিস নয়।
আবার পিটার ডি হাসের প্রসঙ্গে আসি। তার বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছেন বাংলাদেশের বেশ কিছু নাগরিক। গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় আঘাত আসে এমন ব্যাপারে প্রতিবাদ জানানোটা ‘বেত্তা’দের জন্য অবশ্য জায়েজ। কিন্তু প্রোপাগান্ডিস্টদের ক্ষেত্রে নাজায়েজ।
ভারতের মোদিবিরোধী ‘ইন্ডিয়া জোট’ ২৪ জনেরও অধিক টিভি সঞ্চালককে বয়কট করেছে। কারণ এসব সঞ্চালকের শারীরিক ভাষা, শব্দ প্রয়োগ, প্রশ্নের ধরন সবই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কোনো না কোনোভাবে বিরোধী পক্ষকে বেকায়দায় ফেলাই হলো তাদের কাজ। অর্থাৎ এরা প্রোপাগান্ডার উপকরণ তৈরি করতে গণমাধ্যমকে ব্যবহার করতে চায়। ইন্ডিয়ার মতো বৃহৎ গণতন্ত্রের একটি দেশে যখন বিরোধী দল গণমাধ্যমের সঞ্চালকদের বয়কটের একটা সিদ্ধান্ত নেয়, তখন কিন্তু গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে না, যেমন আমাদের দেশে উঠেছে দুটি টেলিভিশনকে বিরোধী পক্ষ বয়কট করার প্রশ্নে। গণমাধ্যম প্রচারমাধ্যম হয়ে ওঠা পর্যন্ত মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু তা যখন প্রচারণার সঙ্গে যুক্ত হয় তখন তার আচরণ আর গণমাধ্যমের সঙ্গে যায় না এবং তাকে গণমাধ্যম হিসেবে মেনে নেওয়াও মূর্খতা। গণমাধ্যমের মূল চরিত্রটাই তাতে কলুষিত হয়। রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভের কাজ কোনো পক্ষকে বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দেওয়া নয় কিংবা কিম বা লুকাশেঙ্কোর মতো দুঃশাসককে টিকিয়ে রাখা নয়। উত্তর কোরিয়ার মাধ্যমকে গণমাধ্যম বলা হবে খোদ গণমাধ্যমকে অপমানের শামিল।
সুতরাং মাধ্যমের সঙ্গে ‘গণ’ যুক্ত করতে হলে ‘না’ বলা এবং লেখাটা আয়ত্ত করতে হবে। মেরুদণ্ড সোজা রাখতে হবে। মেরুদণ্ডটা সোজা রাখাই গণমাধ্যম ও সংশ্লিষ্টদের প্রধানতম কাজ। না হলে শঙ্খঘোষের কবিতার মতো সারা জীবন ‘হামাগুড়ি’ দিয়ে মেরুদণ্ডখানা খুঁজে যেতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট