বাহারুল আলম
মে মাসের প্রথম দিকে আমার পুত্র সাকিব ও কন্যা শাফিনাজ এবং পুত্রবধূ এমি জানাল, তারা লেবার ডে উইক অ্যান্ডকে সামনে রেখে ১ সেপ্টেম্বর ৪ দিনের জন্য আইসল্যান্ড বেড়াতে যাবে। এই সফরে আমাকে ও আমার স্ত্রীকেও তারা সঙ্গে নেবে। অসুস্থতার কারণে ২০১৭ সালের পর থেকে আমি কোনো সফরে যেতে আর তেমন উৎসাহ বোধ করি না। সে কারণে আমি সফরে যেতে অনিচ্ছা প্রকাশ করলে, তারা কিছুতেই সেটা মেনে নিতে রাজি হলো না। তাদের এক কথা আমাকে যেতেই হবে। প্রয়োজনে সেখানে আমার ব্যবহারের জন্য একটি ছোট হুইল চেয়ার নিয়ে যাওয়া হবে। আমার স্ত্রী অবশ্য সফরের কথা শুনে বেশ পুলকিত হলো, যদিও সে-ও খুব একটা সুস্থ সেটা বলার উপায় নেই। বছর তিন আগে তার হার্টে ওপেন ডাবল বাইপাস সার্জারি হয়। এ কারণে তার শারীরিক সক্ষমতাও বহুলাংশে হ্রাস পায়, যদিও হাঁটাচলায় তার তেমন কোনো সমস্যা নেই। পরিকল্পনা মাফিক তারা কিছুদিনের মধ্যে আইসল্যান্ড যাওয়ার প্রয়োজনীয় যাবতীয় কাজ, যেমন প্লেনের টিকিট করে ফেললো। আমরা যাচ্ছি দেখে আমাদের কয়েকজন আত্মীয় আইসল্যান্ড সফরে আমাদের সহযাত্রী হতে ইচ্ছা প্রকাশ করলো। এই আত্মীয়রা হলেনÑ আমার শ্যালিকা কামরুন্নাহার বহ্নি, তার স্বামী সৈয়দ মুজাফফর, তাদের কিশোরী কন্যা আয়েশা দোলা, শ্যালক নেসার আহমদ ও তাঁর স্ত্রী নিলুফার। তারা যেতে আগ্রহ প্রকাশ করায় আমাদেরও খুব ভালো লাগলো। তাদের জন্য রইল অশেষ ধন্যবাদ। সব মিলিয়ে আমরা ১০ জন একসঙ্গে পাচ্ছি ভেবে খুবই আনন্দিত বোধ করলাম। মনে হলো আমরা যেন দূরের কোনো দেশে পিকনিক করতে যাচ্ছি।
আইসল্যান্ড উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের মধ্যবর্তী একটি দ্বীপ দেশ। এ দেশটিকে ঘিরে আছে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগর এবং আর্কটিক সাগর। দেশটির আয়তন প্রায় ৩৯ হাজার বর্গমাইল এবং লোকসংখ্যা প্রায় ৪ লাখ। মূলত তারা নরওয়েজিয়ান, কেল্টিক ও আইরিশ জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। তারা আইসল্যান্ডিক ভাষায় কথা বলে যদিও ইংরেজি জানা মানুষের সংখ্যাও কম নয়। শ্বেতাঙ্গ ছাড়া অন্য জাতি গোষ্ঠীর মানুষের বসতি এ দেশে নেই বললেই চলে।
জনসংখ্যার বিচারে ইউরোপ মহাদেশের সবচেয়ে কম ঘন বসতিপূর্ণ এই দেশ। এ দেশের মুদ্রার নাম ক্রোনার। এক মার্কিন ডলার সমান ১৩৪ ক্রোনার। কেনাবেচার অধিকাংশ হয় ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে।
আইসল্যান্ড বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পর্যটকপ্রিয় দেশ। প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক পর্যটক এ দেশে বেড়াতে আসেন। স্বভাবতই পর্যটন খাত থেকে অর্জিত আয় এ দেশের অর্থনীতিতে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
আইসল্যান্ড যাত্রার নির্ধারিত দিন ১ সেপ্টেম্বর আইসল্যান্ড এয়ারের রাত ১১টার ফ্লাইট ধরার জন্য আমরা সবাই রাত ৯টার মধ্যে নিউইয়র্কের জেএফকে বিমানবন্দরের ৭ নম্বর টার্মিনালে পৌঁছাই। সেখানে গিয়ে বোর্ডিং পাস সংগ্রহের পর প্রয়োজনীয় সিকিউরিটি ও কাস্টমস চেকিং শেষ করে রাত ১০টা ৩০ মিনিটে আমরা প্লেনে গিয়ে যার যার আসনে বসি। কিছুক্ষণ পর ঘোষণা আসে, আইসল্যান্ড পৌঁছাতে ৪ ঘণ্টার মতো সময় লাগবে। এ সময় আমরা সবাই ইনফ্লাইট এন্টারটেনমেন্ট স্ক্রিনে নানা ধরনের চলচ্চিত্র দেখা শুরু করলাম। প্লেন আকাশে উড়ার ঘণ্টা দেড়েক পর বিমানের কয়েকজন কর্মী খাবারের ট্রলি নিয়ে এলেন। নন-অ্যালকহলিক বেভারেজ বা কোমল পানীয় ছাড়াও অন্য সব খাবার কিনে খেতে হয়। কিছুক্ষণ পূর্বে বাসা থেকে ভোজনপর্ব সেরে আসায় আমরা সবাই ফ্রি আইটেম যেমন চা, কফি এবং কোমল পানীয় চেয়ে নিয়ে খেলাম। পুরো প্লেন যাত্রায় এ রকমভাবে দুবার খাবার দেয়া হয়। সে রাতে আটলান্টিক মহাসাগরে ঝড়-বৃষ্টি থাকায় প্লেনকে বেশ কয়েকবার প্রচণ্ড ঝাঁকুনির মধ্যে পড়তে হয়। যা অনেক যাত্রীর মধ্যে কিছুটা আতঙ্কের সৃষ্টি করে।
যা হোক, সর্বশক্তিমান আল্লাহর অশেষ রহমতে কোনো অঘটন ছাড়াই প্লেন যথাসময়ে আইসল্যান্ডের কেফলাভিক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে।
আইসল্যান্ডের ঠাণ্ডা আবহাওয়া সম্পর্কে আগে থেকে ধারণা থাকায় আমাদের সবার গায়ে গরম কাপড় পড়া ছিল। বিমানের বাইরে সে সময় বৃষ্টির সাথে ঝড়ো হাওয়া বইছিল। আইসল্যান্ডের এ সময়টা সামার হলেও এখানে সামারের উষ্ণতা বলতে যা বোঝায়, সেটা তেমন নেই। আইসল্যান্ড নামের সঙ্গে মিল রেখে সেখানকার আবহাওয়া সারা বছরই বেশ শীতল থাকে। সামারে তাপমাত্রা ২৫ থেকে ৭০ ডিগ্রির মধ্যে উঠানামা করে। তা ছাড়া বৃষ্টির সঙ্গে ঝড়ো হাওয়া অনেকটা প্রত্যাহিক ঘটনা। আমাদের সফরের প্রতিটি দিনেই রোদ বৃষ্টির লুকোচুরি চলে, যা সফরের আনন্দকে কিছুটা হলেও মøান করে দেয়।
বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে আগে থেকে ভাড়া করা দু’টি গাড়ি নিয়ে যার যার হোটেলের উদ্দেশে রওনা হই। আমাদের দুটি পরিবার লাইসুডালু এলাকার কাস্ট গেস্ট হাউজ (Kast Guest House) এবং আর একটি পরিবার নিকটবর্তী ল্যাংগা হল্ট (Langa Holt) গেস্ট হাউজে ওঠে। একই গেস্ট হাউজে সবার জন্য কক্ষ না পাওয়ায় এ ব্যবস্থা করতে হয়। আগেই বলেছি আইসল্যান্ড একটি বিপুল পর্যটন প্রিয় দেশ। সে কারণে এখানকার হোটেল গেস্ট হাউজগুলো সারা বছর পর্যটকে ঠাসা থাকে। শহর এবং শহরের বাইরে যেসব বাড়িঘর দেখা যায়, তার অধিকাংশই হোটেল, গেস্ট হাউজ এবং Air BNB ইঘই হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এখানে রাত্রি যাপনের পরদিন আমরা সকালে চেক আউট করে আমাদের নতুন আস্তানা ভিক শহরের হোটেল মিরডাল এবং ব্ল্যাক সি রিসোর্টে (Black Sea Resort) সফরের বাকি দিনগুলো কাটাতে চলে আসি। গেস্ট হাউজে প্রাতঃরাশ সারার সময় পরিচয় হয় ড্যারেন নামের একজন কৃষ্ণাঙ্গ ভদ্রলোকের সঙ্গে। কথা প্রসঙ্গে তিনি জানালেন ১৯৯৬ সালে আমেরিকার টেক্সাস থেকে এখানে বেড়াতে আসেন। আইসল্যান্ডের এক তরুণীর সঙ্গে প্রেম থেকে পরিণয় এবং পরে সন্তানের বাবা হলে তিনি এখানেই থেকে যান। তিনি গেস্ট হাউজটির মালিক। অপর একজন বেলিজিয়ানের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, তারা ফরাসি ও ডাচ ভাষায় কথা বলেন। এবং তাদের নিজস্ব কোনো ভাষা নেই। এটা বলে তিনি হেসে বলেন, ভাষার দিক দিয়ে তারা খুবই দরিদ্র।
নতুন গন্তব্যে আসার পথে আমরা জকুলসার্লন (Jokulsarlon) এলাকায় ডায়মন্ড বিচ, গিজার, জলপ্রপাত দেখাতে যাই। ডায়মন্ড বিচে সমুদ্র থেকে তীরে ভেসে আসা সুবৃহৎ তুষারস্তু (Iceberg) পরিদর্শন করি। অনেকে হিমশীতল তুষার স্তূপ ছুঁয়ে দেখেন। কাছেই এমফিয়িাস রাইডে (উভচর যান) একটি বৃহদায়ক হৃদে নীলাভ রঙের বিরাট বিরাট Iceberg দেখতে যাই। হৃদটির (Lagoon) সৌন্দর্য ছিল অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। এরপর যাই গ্রোকার (Grokkur) এলাকার গিজার দেখতে। গিজার হলো এমন কিছু খোলা ভুগর্ভস্থ বড় গর্ত (Geological Formation) যেখান থেকে কিছুক্ষণ পরপর গরম পানির লহমা প্রবলবেগে উপরে উঠে ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণত প্রতি ১০ মিনিট অন্তর অন্তর এটা ঘটে থাকে।
Hydrogeological কোনো Condition এর কারণে এটা হয় বলে শুনেছি। আইসল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েলোস্টোন পার্ক ছাড়া বিশ্বের খুব কম জায়গায় গিজার রয়েছে। ডায়মন্ড বিচ ও এর সন্নিহিত এলাকায় Glacier ও Iceberg দেখা শেষ করে আমরা আরও দু-একটি দর্শনীয় স্থান দেখে যার যার হোটেলে ফিরে আসি। ফেরার আগে নিকটবর্তী সী বিচে গিয়ে পাহাড়ের উপর থেকে আটলান্টিক মহাসাগরে সূর্যাস্তের দৃশ্য উপভোগ করি। তা ছাড়া পথে পাহাড় থেকে নেমে আসা অসংখ্য ঝর্ণাধারা এবং রোদ-বৃষ্টির পরিবেশে সৃষ্ট বর্ণিল রংধনু দেখা হয়। আইসল্যান্ড সফরের শেষ দিনে বিমানবন্দরে যাওয়ার আগে আমরা রাইনোসফারা ব্ল্যাক স্যান্ড বিচ (Black sand Beach) দেখতে যাই। এই বিচের বালি নিকষ কালো। এ সময় সমুদ্রে বিশাল গর্জন করে বিপুল উচ্চতার ঢেউ তীরে এসে আছড়েপড়ছিল। সেটাও ছিল এক সুন্দর দৃশ্য। ঢেউয়ের আগমনে অনেককেই ভয় পেয়ে দৌড়াদৌড়ি করে তীর থেকে সরে যেতে দেখেছি। একজনকে দেখলাম ভয় পেয়ে পড়ে যেতে এবং আরেকজনে হাতের ব্যাগ ঢেউয়ে ভেসে সমুদ্রের গভীরে চলে গেল (Drifted to deeper sea)। বিচ থেকে বেরিয়ে আমরা আমাদের গন্তব্যের পানে ছুটলাম। পথে মাঠে অসংখ্য ঘোড়া ও ভেড়া চড়তে দেখে পাড়ি থামিয়ে আমাদের কয়েকজন মাঠে গিয়ে কিছু ঘোড়া আর ভেড়ার শরীরে হাত বুলিয়ে আদর করে দিলো। পথে রাজধানী রেকিয়াভিকের মেসিন সিফুড রেস্তোরাঁয় (Messin Seafood Restaurant) লাঞ্চ সেরে নিলাম। মেনু ছিল Creamy Shrimp Soup, Fillet Of Cod, Arctic char ও কেক। আইসল্যান্ডে অবস্থানকালে সব খাবারই ছিল অত্যন্ত উপাদেয়। তরুণ বয়সে অধ্যাপক আবদুল হাইয়ের লেখা ভ্রমণ কাহিনী বিলেতে সাড়ে সাত শত দিন পড়েছিলাম যেখানে একটি লাইন ছিল ‘বিলেত দেশটা মাটির’। সব দেশই মাটির। তবে আইসল্যান্ড হলো আগ্নেয়গিরি থেকে বহু বছর ধরে উদ্গত লাভা মিশ্রিত কালো পাথুরে মাটির একটি দেশ।
আইসল্যান্ড প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর একটি দেশ। ভিক্টোরিয়া এলিসগোটি, আইসল্যান্ডের এক তরুণীর নাম। সে চার বছর আগে পড়াশোনার জন্য জার্মানির বার্লিন যায়। খাদ্য ও রন্ধন শিল্পে তার বিপুল আগ্রহের কারণে সে সেখানে একটি রেস্তোরাঁ খোলে, যা বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। মেয়েটি বর্তমানে বার্লিনের একজন অন্যতম সেরা শেফ হিসেবে পরিচিত। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল আইসল্যান্ডের কোন জিনিসটাকে সে মিস করে। তার ঝটপট উত্তর Nature অর্থাৎ প্রকৃতি। আইসল্যান্ড সফরের সুখানুভূতি আমাদের বহুদিন মনে থাকবে।
লেখক : কলামিস্ট।
মে মাসের প্রথম দিকে আমার পুত্র সাকিব ও কন্যা শাফিনাজ এবং পুত্রবধূ এমি জানাল, তারা লেবার ডে উইক অ্যান্ডকে সামনে রেখে ১ সেপ্টেম্বর ৪ দিনের জন্য আইসল্যান্ড বেড়াতে যাবে। এই সফরে আমাকে ও আমার স্ত্রীকেও তারা সঙ্গে নেবে। অসুস্থতার কারণে ২০১৭ সালের পর থেকে আমি কোনো সফরে যেতে আর তেমন উৎসাহ বোধ করি না। সে কারণে আমি সফরে যেতে অনিচ্ছা প্রকাশ করলে, তারা কিছুতেই সেটা মেনে নিতে রাজি হলো না। তাদের এক কথা আমাকে যেতেই হবে। প্রয়োজনে সেখানে আমার ব্যবহারের জন্য একটি ছোট হুইল চেয়ার নিয়ে যাওয়া হবে। আমার স্ত্রী অবশ্য সফরের কথা শুনে বেশ পুলকিত হলো, যদিও সে-ও খুব একটা সুস্থ সেটা বলার উপায় নেই। বছর তিন আগে তার হার্টে ওপেন ডাবল বাইপাস সার্জারি হয়। এ কারণে তার শারীরিক সক্ষমতাও বহুলাংশে হ্রাস পায়, যদিও হাঁটাচলায় তার তেমন কোনো সমস্যা নেই। পরিকল্পনা মাফিক তারা কিছুদিনের মধ্যে আইসল্যান্ড যাওয়ার প্রয়োজনীয় যাবতীয় কাজ, যেমন প্লেনের টিকিট করে ফেললো। আমরা যাচ্ছি দেখে আমাদের কয়েকজন আত্মীয় আইসল্যান্ড সফরে আমাদের সহযাত্রী হতে ইচ্ছা প্রকাশ করলো। এই আত্মীয়রা হলেনÑ আমার শ্যালিকা কামরুন্নাহার বহ্নি, তার স্বামী সৈয়দ মুজাফফর, তাদের কিশোরী কন্যা আয়েশা দোলা, শ্যালক নেসার আহমদ ও তাঁর স্ত্রী নিলুফার। তারা যেতে আগ্রহ প্রকাশ করায় আমাদেরও খুব ভালো লাগলো। তাদের জন্য রইল অশেষ ধন্যবাদ। সব মিলিয়ে আমরা ১০ জন একসঙ্গে পাচ্ছি ভেবে খুবই আনন্দিত বোধ করলাম। মনে হলো আমরা যেন দূরের কোনো দেশে পিকনিক করতে যাচ্ছি।
আইসল্যান্ড উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের মধ্যবর্তী একটি দ্বীপ দেশ। এ দেশটিকে ঘিরে আছে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগর এবং আর্কটিক সাগর। দেশটির আয়তন প্রায় ৩৯ হাজার বর্গমাইল এবং লোকসংখ্যা প্রায় ৪ লাখ। মূলত তারা নরওয়েজিয়ান, কেল্টিক ও আইরিশ জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। তারা আইসল্যান্ডিক ভাষায় কথা বলে যদিও ইংরেজি জানা মানুষের সংখ্যাও কম নয়। শ্বেতাঙ্গ ছাড়া অন্য জাতি গোষ্ঠীর মানুষের বসতি এ দেশে নেই বললেই চলে।
জনসংখ্যার বিচারে ইউরোপ মহাদেশের সবচেয়ে কম ঘন বসতিপূর্ণ এই দেশ। এ দেশের মুদ্রার নাম ক্রোনার। এক মার্কিন ডলার সমান ১৩৪ ক্রোনার। কেনাবেচার অধিকাংশ হয় ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে।
আইসল্যান্ড বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পর্যটকপ্রিয় দেশ। প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক পর্যটক এ দেশে বেড়াতে আসেন। স্বভাবতই পর্যটন খাত থেকে অর্জিত আয় এ দেশের অর্থনীতিতে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
আইসল্যান্ড যাত্রার নির্ধারিত দিন ১ সেপ্টেম্বর আইসল্যান্ড এয়ারের রাত ১১টার ফ্লাইট ধরার জন্য আমরা সবাই রাত ৯টার মধ্যে নিউইয়র্কের জেএফকে বিমানবন্দরের ৭ নম্বর টার্মিনালে পৌঁছাই। সেখানে গিয়ে বোর্ডিং পাস সংগ্রহের পর প্রয়োজনীয় সিকিউরিটি ও কাস্টমস চেকিং শেষ করে রাত ১০টা ৩০ মিনিটে আমরা প্লেনে গিয়ে যার যার আসনে বসি। কিছুক্ষণ পর ঘোষণা আসে, আইসল্যান্ড পৌঁছাতে ৪ ঘণ্টার মতো সময় লাগবে। এ সময় আমরা সবাই ইনফ্লাইট এন্টারটেনমেন্ট স্ক্রিনে নানা ধরনের চলচ্চিত্র দেখা শুরু করলাম। প্লেন আকাশে উড়ার ঘণ্টা দেড়েক পর বিমানের কয়েকজন কর্মী খাবারের ট্রলি নিয়ে এলেন। নন-অ্যালকহলিক বেভারেজ বা কোমল পানীয় ছাড়াও অন্য সব খাবার কিনে খেতে হয়। কিছুক্ষণ পূর্বে বাসা থেকে ভোজনপর্ব সেরে আসায় আমরা সবাই ফ্রি আইটেম যেমন চা, কফি এবং কোমল পানীয় চেয়ে নিয়ে খেলাম। পুরো প্লেন যাত্রায় এ রকমভাবে দুবার খাবার দেয়া হয়। সে রাতে আটলান্টিক মহাসাগরে ঝড়-বৃষ্টি থাকায় প্লেনকে বেশ কয়েকবার প্রচণ্ড ঝাঁকুনির মধ্যে পড়তে হয়। যা অনেক যাত্রীর মধ্যে কিছুটা আতঙ্কের সৃষ্টি করে।
যা হোক, সর্বশক্তিমান আল্লাহর অশেষ রহমতে কোনো অঘটন ছাড়াই প্লেন যথাসময়ে আইসল্যান্ডের কেফলাভিক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে।
আইসল্যান্ডের ঠাণ্ডা আবহাওয়া সম্পর্কে আগে থেকে ধারণা থাকায় আমাদের সবার গায়ে গরম কাপড় পড়া ছিল। বিমানের বাইরে সে সময় বৃষ্টির সাথে ঝড়ো হাওয়া বইছিল। আইসল্যান্ডের এ সময়টা সামার হলেও এখানে সামারের উষ্ণতা বলতে যা বোঝায়, সেটা তেমন নেই। আইসল্যান্ড নামের সঙ্গে মিল রেখে সেখানকার আবহাওয়া সারা বছরই বেশ শীতল থাকে। সামারে তাপমাত্রা ২৫ থেকে ৭০ ডিগ্রির মধ্যে উঠানামা করে। তা ছাড়া বৃষ্টির সঙ্গে ঝড়ো হাওয়া অনেকটা প্রত্যাহিক ঘটনা। আমাদের সফরের প্রতিটি দিনেই রোদ বৃষ্টির লুকোচুরি চলে, যা সফরের আনন্দকে কিছুটা হলেও মøান করে দেয়।
বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে আগে থেকে ভাড়া করা দু’টি গাড়ি নিয়ে যার যার হোটেলের উদ্দেশে রওনা হই। আমাদের দুটি পরিবার লাইসুডালু এলাকার কাস্ট গেস্ট হাউজ (Kast Guest House) এবং আর একটি পরিবার নিকটবর্তী ল্যাংগা হল্ট (Langa Holt) গেস্ট হাউজে ওঠে। একই গেস্ট হাউজে সবার জন্য কক্ষ না পাওয়ায় এ ব্যবস্থা করতে হয়। আগেই বলেছি আইসল্যান্ড একটি বিপুল পর্যটন প্রিয় দেশ। সে কারণে এখানকার হোটেল গেস্ট হাউজগুলো সারা বছর পর্যটকে ঠাসা থাকে। শহর এবং শহরের বাইরে যেসব বাড়িঘর দেখা যায়, তার অধিকাংশই হোটেল, গেস্ট হাউজ এবং Air BNB ইঘই হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এখানে রাত্রি যাপনের পরদিন আমরা সকালে চেক আউট করে আমাদের নতুন আস্তানা ভিক শহরের হোটেল মিরডাল এবং ব্ল্যাক সি রিসোর্টে (Black Sea Resort) সফরের বাকি দিনগুলো কাটাতে চলে আসি। গেস্ট হাউজে প্রাতঃরাশ সারার সময় পরিচয় হয় ড্যারেন নামের একজন কৃষ্ণাঙ্গ ভদ্রলোকের সঙ্গে। কথা প্রসঙ্গে তিনি জানালেন ১৯৯৬ সালে আমেরিকার টেক্সাস থেকে এখানে বেড়াতে আসেন। আইসল্যান্ডের এক তরুণীর সঙ্গে প্রেম থেকে পরিণয় এবং পরে সন্তানের বাবা হলে তিনি এখানেই থেকে যান। তিনি গেস্ট হাউজটির মালিক। অপর একজন বেলিজিয়ানের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, তারা ফরাসি ও ডাচ ভাষায় কথা বলেন। এবং তাদের নিজস্ব কোনো ভাষা নেই। এটা বলে তিনি হেসে বলেন, ভাষার দিক দিয়ে তারা খুবই দরিদ্র।
নতুন গন্তব্যে আসার পথে আমরা জকুলসার্লন (Jokulsarlon) এলাকায় ডায়মন্ড বিচ, গিজার, জলপ্রপাত দেখাতে যাই। ডায়মন্ড বিচে সমুদ্র থেকে তীরে ভেসে আসা সুবৃহৎ তুষারস্তু (Iceberg) পরিদর্শন করি। অনেকে হিমশীতল তুষার স্তূপ ছুঁয়ে দেখেন। কাছেই এমফিয়িাস রাইডে (উভচর যান) একটি বৃহদায়ক হৃদে নীলাভ রঙের বিরাট বিরাট Iceberg দেখতে যাই। হৃদটির (Lagoon) সৌন্দর্য ছিল অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। এরপর যাই গ্রোকার (Grokkur) এলাকার গিজার দেখতে। গিজার হলো এমন কিছু খোলা ভুগর্ভস্থ বড় গর্ত (Geological Formation) যেখান থেকে কিছুক্ষণ পরপর গরম পানির লহমা প্রবলবেগে উপরে উঠে ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণত প্রতি ১০ মিনিট অন্তর অন্তর এটা ঘটে থাকে।
Hydrogeological কোনো Condition এর কারণে এটা হয় বলে শুনেছি। আইসল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েলোস্টোন পার্ক ছাড়া বিশ্বের খুব কম জায়গায় গিজার রয়েছে। ডায়মন্ড বিচ ও এর সন্নিহিত এলাকায় Glacier ও Iceberg দেখা শেষ করে আমরা আরও দু-একটি দর্শনীয় স্থান দেখে যার যার হোটেলে ফিরে আসি। ফেরার আগে নিকটবর্তী সী বিচে গিয়ে পাহাড়ের উপর থেকে আটলান্টিক মহাসাগরে সূর্যাস্তের দৃশ্য উপভোগ করি। তা ছাড়া পথে পাহাড় থেকে নেমে আসা অসংখ্য ঝর্ণাধারা এবং রোদ-বৃষ্টির পরিবেশে সৃষ্ট বর্ণিল রংধনু দেখা হয়। আইসল্যান্ড সফরের শেষ দিনে বিমানবন্দরে যাওয়ার আগে আমরা রাইনোসফারা ব্ল্যাক স্যান্ড বিচ (Black sand Beach) দেখতে যাই। এই বিচের বালি নিকষ কালো। এ সময় সমুদ্রে বিশাল গর্জন করে বিপুল উচ্চতার ঢেউ তীরে এসে আছড়েপড়ছিল। সেটাও ছিল এক সুন্দর দৃশ্য। ঢেউয়ের আগমনে অনেককেই ভয় পেয়ে দৌড়াদৌড়ি করে তীর থেকে সরে যেতে দেখেছি। একজনকে দেখলাম ভয় পেয়ে পড়ে যেতে এবং আরেকজনে হাতের ব্যাগ ঢেউয়ে ভেসে সমুদ্রের গভীরে চলে গেল (Drifted to deeper sea)। বিচ থেকে বেরিয়ে আমরা আমাদের গন্তব্যের পানে ছুটলাম। পথে মাঠে অসংখ্য ঘোড়া ও ভেড়া চড়তে দেখে পাড়ি থামিয়ে আমাদের কয়েকজন মাঠে গিয়ে কিছু ঘোড়া আর ভেড়ার শরীরে হাত বুলিয়ে আদর করে দিলো। পথে রাজধানী রেকিয়াভিকের মেসিন সিফুড রেস্তোরাঁয় (Messin Seafood Restaurant) লাঞ্চ সেরে নিলাম। মেনু ছিল Creamy Shrimp Soup, Fillet Of Cod, Arctic char ও কেক। আইসল্যান্ডে অবস্থানকালে সব খাবারই ছিল অত্যন্ত উপাদেয়। তরুণ বয়সে অধ্যাপক আবদুল হাইয়ের লেখা ভ্রমণ কাহিনী বিলেতে সাড়ে সাত শত দিন পড়েছিলাম যেখানে একটি লাইন ছিল ‘বিলেত দেশটা মাটির’। সব দেশই মাটির। তবে আইসল্যান্ড হলো আগ্নেয়গিরি থেকে বহু বছর ধরে উদ্গত লাভা মিশ্রিত কালো পাথুরে মাটির একটি দেশ।
আইসল্যান্ড প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর একটি দেশ। ভিক্টোরিয়া এলিসগোটি, আইসল্যান্ডের এক তরুণীর নাম। সে চার বছর আগে পড়াশোনার জন্য জার্মানির বার্লিন যায়। খাদ্য ও রন্ধন শিল্পে তার বিপুল আগ্রহের কারণে সে সেখানে একটি রেস্তোরাঁ খোলে, যা বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। মেয়েটি বর্তমানে বার্লিনের একজন অন্যতম সেরা শেফ হিসেবে পরিচিত। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল আইসল্যান্ডের কোন জিনিসটাকে সে মিস করে। তার ঝটপট উত্তর Nature অর্থাৎ প্রকৃতি। আইসল্যান্ড সফরের সুখানুভূতি আমাদের বহুদিন মনে থাকবে।
লেখক : কলামিস্ট।