মফিজুল হুসাইন
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খান এবং পরিচালক নাসির উদ্দিন এলানকে বিশেষ আদালত ২০১৩ সালের হেফাজতের ঘটনা নিয়ে দুই বছর করে সাজা দেওয়ার প্রেক্ষাপটে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন দূতাবাস এবং ৭২টি মানবাধিকার সংগঠন যেভাবে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তা আপনার জন্য মোটেই ভালো সংবাদ নয়। বিশেষ করে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের জিএসপি-সুবিধা বাতিলের হুমকিটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ইউরোপিয়ান ও আমেরিকানরা যদি বাংলাদেশের রফতানির ওপর শুল্ক বা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তাহলে আমাদের গার্মেন্টস শিল্প হুমকির মধ্যে পড়বে, যেখানে লাখ লাখ নারীশ্রমিক কাজ করে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকে। গার্মেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের মালিকেরা ইতিমধ্যেই তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়ে সরকারকে বিষয়টি বিবেচনার অনুরোধ করেছে। অথচ আপনার পররাষ্ট্র বিভাগ বিষয়টি দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে কোনো কিছু মানার বাধ্যবাধকতা নেই বলে বিবৃতি দিয়েছে। পররাষ্ট্র দফতর কি মনে করে, এটা ইউরোপিয়ানদের কথার কথা, বাস্তবে কিছুই করবে না?
নাকি আপনাকে খুশি করার জন্য এই অবস্থান নিয়েছে? বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য যে ১৭ কোটি মানুষের দেশে কোনো ভালো-মন্দ বিবেচনায় না নিয়ে শুধু একজন মানুষের হাতে সব চাবিকাঠি দিয়ে বসে আছে। আপনার দল বলছে শেখ হাসিনা ছাড়া কে কী বলল কেয়ার করি না, আবার বিরোধীরা বলছে শেখ হাসিনা থাকলে কিছুই হবে না। এখন এই এক দফার প্রধানমন্ত্রীকে নৈতিকতার স্থান থেকে বিবেচনায় নিতে হবে কোথায় কী করলে দেশের মঙ্গল হবে। তাকে আরও বিবেচনায় নিতে হবে, তার নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও পশ্চিমারা কেন একই কথা বারবার বলেই যাচ্ছে, তিনি না মানলে তারা কী ব্যবস্থা নিতে পারে, আমাদের অর্থনীতি, আমাদের মানবাধিকার, চীন/ভারত কতটুকু সহায়ক, অভ্যন্তরীণ রাজনীতির চাপ, তৃতীয় শক্তির উত্থান এবং আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ।
একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ হিসেবে আপনি অবশ্যই বুঝতে পারেন কেন তারা এতবার প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও আপনার প্রতিশ্রুতিকে বিশ্বাস করছে না। পশ্চিমারা, বিশেষ করে আমেরিকানদের ভূরাজনীতি নিয়ে মনে যা-ই থাকুক, তারা স্পষ্টতই একটি নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চাচ্ছে। তারা মনে করে, ক্ষমতাসীনরা তাদের এমপিত্ব বজায় রেখে, অনুগত বিচার বিভাগ, নিপীড়নমূলক আইন, অনুগত প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন, নিরাপত্তা বাহিনী এবং অঢেল অর্থ ব্যবহার করার সামর্থ্যরে সঙ্গে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে লাখ লাখ মামলা নিয়ে নির্বাচন করলে কোনোভাবেই নির্বাচনের মাঠ সমতল হবে না। ২০ সেপ্টেম্বর দৈনিক মানবজমিন বিশ্বস্ত সূত্রের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নেই বিধায় নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইউরোপিয়ানদের এই সিদ্ধান্তে পরিষ্কার হলো আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন একই ধারণা পোষণ করে যে বাংলাদেশে নিরপেক্ষ নির্বাচন হওয়ার মতো পরিবেশ নেই। ওদিকে অস্ট্রেলিয়ার বিরোধী দলের গ্রিন পার্টির নেতা পার্লামেন্টে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও পরবর্তী নির্বাচন সুষ্ঠু পরিবেশে সৃষ্টি করার জন্য বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। এখন সমগ্র পশ্চিমা জগৎ একটি নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য এতটাই সোচ্চার যে আপনার হাতে অপশন খুব কম। আপনি ব্যর্থ হলে তারা অতীতের নিষেধাজ্ঞা ও ভিসানীতির পাশাপাশি নতুন করে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, দল বা সরকার এবং দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে, যা আপনার পরিবার, সরকার এবং দেশের জন্য অবমাননাকর তো বটেই, দেশের লাখ লাখ শ্রমজীবী মানুষের জীবনে নেমে আসবে অবর্ণনীয় দুর্দশা।
আপনার প্রধান ভরসাস্থল ছিল ভারত। কিন্তু তারা তাদের বৃহত্তর স্বার্থে বাংলাদেশের স্বার্থকে উপেক্ষা করে নীরব ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। তাদের বৃহত্তর স্বার্থ আমেরিকা, যেখানে তারা বছরে ১৫৭ বিলিয়ন ডলার রফতানি করে আর বাংলাদেশে করে ১৪ বিলিয়ন। সম্প্রতি ওয়াশিংটন সফরে নরেন্দ্র মোদি কম্পিউটার চিপস উৎপাদন এবং টেকনোলজি বিনিময়-সংক্রান্ত অত্যন্ত লাভ ও আকর্ষণীয় একটি যৌথ প্রকল্পে স্বাক্ষর করে, যার মূল লক্ষ্য চীনের একচ্ছত্র আধিপত্য খর্ব করা। তা ছাড়া আমেরিকার মতো পরাশক্তি যখন বাংলাদেশে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন করানোর জন্য বদ্ধপরিকর, সেখানে দ্বিমত পোষণ করা তারা সমীচীন মনে করে না। তারা তাদের জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টিও বিবেচনায় রেখেছে। চীন তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিবেশী শত্রু এবং যদি কখনো চীনের সঙ্গে সমরাস্ত্রের সংঘাত বাধে, তাহলে আমেরিকার সাহায্যই তারা চাইবে এবং নেবে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ জিরো। তা ছাড়া বাংলাদেশে ২০০৮, ১৪ ও ১৮ সালের নির্বাচনে আপনাকে সাহায্য ও সহযোগিতা করে একটি কর্তৃত্ববাদী সরকার প্রতিষ্ঠার দায়ভার তাদের নিতে বা শুনতে হচ্ছে। তাদের অপর দুই পাশে নিউক্লিয়ার অস্ত্রধারী দুটি দেশ চীন ও পাকিস্তান, যাদের সরকার ও জনগণ, উভয়েই ভারতকে ঘৃণা করে। সেখানে বাংলাদেশের জনগণও ভারতকে ঘৃণা করুক, সেটা ভারত চাইবে না। আর আপনার সরকার যে জনসম্পৃক্তহীন, সেটা তারা ভালোভাবেই জানে। তা ছাড়া ঢাকা-বেইজিংয়ের বেশ মাখামাখি দিল্লি ভালো চোখে দেখে না।
আমেরিকা বাংলাদেশে যা-ই করুক, চীন সরাসরি চ্যালেঞ্জ দিতে আসবে না। তারা আপনার সরকারকে ঋণ দিয়েছে এবং নৈতিক সমর্থন দিচ্ছে কিন্তু তাতে আপনার রাজনৈতিক কোনো উপকার হচ্ছে না। আর পশ্চিমাদের সঙ্গে বাণিজ্যের ব্যত্যয় ঘটলে চীন সে স্থান পূরণ করতে সক্ষম নয়।
নিরপেক্ষ অর্থনীতিবিদ ও প্রিন্ট মাধ্যমগুলো প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের অর্থনীতির নেতিবাচক খবর দিচ্ছে। ডলার সংকট থেকে শুরু করে আমদানি-রফতানি, ব্যাংকগুলোর বেহাল অবস্থা, বাজারে আগুন-এককথায় অর্থনীতিতে হলুদ বাতি জ্বলছে। আর পশ্চিমারা কিছু করলে লাল বাতি জ্বলতে সময় লাগবে না।
অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আপনি অনেকটা মিত্রহীন। ইনু, মেনন, দিলীপ বড়ুয়া ও মাইজভান্ডারী ছাড়া বড় কেউ নেই। অবশ্য আপনার সরকার গোপনে কেনাবেচা শুরু করেছে। শমসের মবিন চৌধুরী ও তৈমূর আলম খন্দকারকে দিয়ে মৃত তৃণমূল বিএনপিকে সবল করার চেষ্টা চলছে। যে কমিউনিস্ট পার্টি সারা জীবন আপনাদের পাশে থেকেছে, তারাও এখন আপনার অধীনে নির্বাচনব্যবস্থার অবসান চাচ্ছে। জাতীয় পার্টিও বিরোধী দলের মতোই কথা বলছে। জামায়াতকে সম্ভবত আর আটকে রাখা যাবে না আর বিএনপি তো মাঠে আছেই। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ দাবিকে আর অবজ্ঞা করা উচিত হবে কি না, সেটা আপনার পুনর্বিবেচনা করা উচিত।
আর যদি আপনার বিবেচনা দলীয় স্বার্থের অনুকূলে হয় অর্থাৎ আমেরিকা বা ইউরোপিয়ানরা কে কী করল বা বলল, কারা নির্বাচনে এল বা না এল, কত পারসেন্ট ভোট পড়ল বা না পড়লÑএসবের তোয়াক্কা না করে ২০১৪ সালের মতো এগিয়ে যান, তাহলে দেশ এক অনিশ্চয়তায় চলে যাবে। রাস্তায় সংঘর্ষ, হানাহানি, হতাহত চলতে থাকলে ২০০৬ সালের মতো দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী অংশ হস্তক্ষেপ করার আশঙ্কা অমূলক নয়। সেই পরিস্থিতি আওয়ামী লীগের অনুকূলে থাকবে, মনে করার কারণ নেই। গণদাবির প্রেক্ষাপটে হয়তো সব মানবাধিকার লঙ্ঘনের, ব্যাংক লুটের বা দুর্নীতির হিসাব দিতে হতে পারে। আর পশ্চিমারাও যে বসে থাকবে, সেটা মনে করার কারণ নেই। আমেরিকানরা যদি কম্বোডিয়ান বা এল সালভাদরের রাষ্ট্রপ্রধানদের মতো নিষেধাজ্ঞা দেয়, সেটা কতটুকু অবমাননাকর হবে, সেটা আপনি বিবেচনায় নিতে পারেন।
আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ বা ইতিহাসে আপনার স্থানের বিষয়টি নিয়ে আপনার আরও একটু ভাবা উচিত। আজ দলে আসল ও হাইব্রিড আওয়ামী লীগার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আপনি সঠিক সময়ে সঠিক তথ্য পান কি না সে প্রশ্ন অনেকেই করে। কেন আজ অনুগত মিডিয়ার চেয়ে গুটিকয়েক ইউটিউবার বেশি জনপ্রিয়, কেন বিশ্বের সবচেয় পুরোনো সংবাদমাধ্যম ফ্রান্সের এএফপি অনুসন্ধানী রিপোর্ট করে যে সরকারি মদদে বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ব্যবহার করে ভুয়া লেখকেরা সরকারি গুণকীর্তন লেখে। আওয়ামী লীগের এই দৈন্য কি অপমানজনক নয়? কেন ভারতের নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত পিটিআই লেখে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একদল ধনকুবের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে আছেন, যারা তাকে ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এবং এখন আরও টাকা খরচ করছে, যাতে আবারও ক্ষমতায় থাকতে পারে এবং আরও টাকা কামাতে পারে। বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ তো ছিল গণমানুষের দল। এই অভিযোগগুলো মিথ্যা নয় এবং বর্তমানে আওয়ামী লীগ প্রকৃতপক্ষেই জনসম্পৃক্ততাহীন। এখন যদি জনসম্পৃক্তহীন আওয়ামী লীগকে আন্তর্জাতিক এবং অভ্যন্তরীণ চাপে ক্ষমতা ছাড়তে হয়, তাহলে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের কারও দলের নেতৃত্বে এসে টিকে থাকা দুরূহ হয়ে যাবে। আর আপনার পরিবারের কেউ নেতৃত্বে না থাকতে পারলে দল ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। সেই দন্তহীন আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর।
বাংলাদেশে দ্বিদলীয় ও সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য এবং ভবিষ্যতে জিয়া, এরশাদ বা মইনুদ্দিনের মতো সামরিক শাসকেরা বা গণতান্ত্রিক লেবাসে (আওয়ামী লীগ যা করেছে) যদি কেউ ক্ষমতা আঁকড়ে রাখে, সে সময় আওয়ামী লীগেরই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হবে। সুতরাং দলের ভবিষ্যৎ নিয়েও আপনাকে সচেষ্ট হতে হবে। সন্দেহ নেই, সামগ্রিক পরিবেশ আপনার অনুকূলে নেই। তাই বলে কারও জীবনই থেমে থাকবে না। ক্ষমতা ছাড়লে যে বিষয়গুলো নিয়ে আপনার প্রতি অভিযোগ আনা হতে পারে, আপনি আগে থেকেই সেসবের দিকে নজর দিন। যেসব মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে অভিযোগ আছে, আপনি সেসব তদন্ত করার জন্য একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন করার ঘোষণা দিন এবং যেসব অফিসারের বিরুদ্ধে আমেরিকা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তাদেরকে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত অবসর দিন। বেগম জিয়ার মামলা প্রত্যাহার করে বিএনপিকে আস্থায় নিন। আপনি বা আপনার দল স্বীকার করুক বা না করুক, বিএনপি একটা ফ্যাক্টর। সর্বদলীয় একটা সভা ডেকে সংবিধানের আলোকে বা সামান্য সংশোধন করে হলেও নিরপেক্ষ নির্বাচনের একটা উপায় বের করুন। এর বিকল্প শুধু হানাহানি, ধ্বংস আর অন্ধকার। -নিউইয়র্ক
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খান এবং পরিচালক নাসির উদ্দিন এলানকে বিশেষ আদালত ২০১৩ সালের হেফাজতের ঘটনা নিয়ে দুই বছর করে সাজা দেওয়ার প্রেক্ষাপটে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন দূতাবাস এবং ৭২টি মানবাধিকার সংগঠন যেভাবে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তা আপনার জন্য মোটেই ভালো সংবাদ নয়। বিশেষ করে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের জিএসপি-সুবিধা বাতিলের হুমকিটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ইউরোপিয়ান ও আমেরিকানরা যদি বাংলাদেশের রফতানির ওপর শুল্ক বা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তাহলে আমাদের গার্মেন্টস শিল্প হুমকির মধ্যে পড়বে, যেখানে লাখ লাখ নারীশ্রমিক কাজ করে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকে। গার্মেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের মালিকেরা ইতিমধ্যেই তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়ে সরকারকে বিষয়টি বিবেচনার অনুরোধ করেছে। অথচ আপনার পররাষ্ট্র বিভাগ বিষয়টি দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে কোনো কিছু মানার বাধ্যবাধকতা নেই বলে বিবৃতি দিয়েছে। পররাষ্ট্র দফতর কি মনে করে, এটা ইউরোপিয়ানদের কথার কথা, বাস্তবে কিছুই করবে না?
নাকি আপনাকে খুশি করার জন্য এই অবস্থান নিয়েছে? বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য যে ১৭ কোটি মানুষের দেশে কোনো ভালো-মন্দ বিবেচনায় না নিয়ে শুধু একজন মানুষের হাতে সব চাবিকাঠি দিয়ে বসে আছে। আপনার দল বলছে শেখ হাসিনা ছাড়া কে কী বলল কেয়ার করি না, আবার বিরোধীরা বলছে শেখ হাসিনা থাকলে কিছুই হবে না। এখন এই এক দফার প্রধানমন্ত্রীকে নৈতিকতার স্থান থেকে বিবেচনায় নিতে হবে কোথায় কী করলে দেশের মঙ্গল হবে। তাকে আরও বিবেচনায় নিতে হবে, তার নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও পশ্চিমারা কেন একই কথা বারবার বলেই যাচ্ছে, তিনি না মানলে তারা কী ব্যবস্থা নিতে পারে, আমাদের অর্থনীতি, আমাদের মানবাধিকার, চীন/ভারত কতটুকু সহায়ক, অভ্যন্তরীণ রাজনীতির চাপ, তৃতীয় শক্তির উত্থান এবং আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ।
একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ হিসেবে আপনি অবশ্যই বুঝতে পারেন কেন তারা এতবার প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও আপনার প্রতিশ্রুতিকে বিশ্বাস করছে না। পশ্চিমারা, বিশেষ করে আমেরিকানদের ভূরাজনীতি নিয়ে মনে যা-ই থাকুক, তারা স্পষ্টতই একটি নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চাচ্ছে। তারা মনে করে, ক্ষমতাসীনরা তাদের এমপিত্ব বজায় রেখে, অনুগত বিচার বিভাগ, নিপীড়নমূলক আইন, অনুগত প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন, নিরাপত্তা বাহিনী এবং অঢেল অর্থ ব্যবহার করার সামর্থ্যরে সঙ্গে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে লাখ লাখ মামলা নিয়ে নির্বাচন করলে কোনোভাবেই নির্বাচনের মাঠ সমতল হবে না। ২০ সেপ্টেম্বর দৈনিক মানবজমিন বিশ্বস্ত সূত্রের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নেই বিধায় নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইউরোপিয়ানদের এই সিদ্ধান্তে পরিষ্কার হলো আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন একই ধারণা পোষণ করে যে বাংলাদেশে নিরপেক্ষ নির্বাচন হওয়ার মতো পরিবেশ নেই। ওদিকে অস্ট্রেলিয়ার বিরোধী দলের গ্রিন পার্টির নেতা পার্লামেন্টে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও পরবর্তী নির্বাচন সুষ্ঠু পরিবেশে সৃষ্টি করার জন্য বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। এখন সমগ্র পশ্চিমা জগৎ একটি নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য এতটাই সোচ্চার যে আপনার হাতে অপশন খুব কম। আপনি ব্যর্থ হলে তারা অতীতের নিষেধাজ্ঞা ও ভিসানীতির পাশাপাশি নতুন করে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, দল বা সরকার এবং দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে, যা আপনার পরিবার, সরকার এবং দেশের জন্য অবমাননাকর তো বটেই, দেশের লাখ লাখ শ্রমজীবী মানুষের জীবনে নেমে আসবে অবর্ণনীয় দুর্দশা।
আপনার প্রধান ভরসাস্থল ছিল ভারত। কিন্তু তারা তাদের বৃহত্তর স্বার্থে বাংলাদেশের স্বার্থকে উপেক্ষা করে নীরব ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। তাদের বৃহত্তর স্বার্থ আমেরিকা, যেখানে তারা বছরে ১৫৭ বিলিয়ন ডলার রফতানি করে আর বাংলাদেশে করে ১৪ বিলিয়ন। সম্প্রতি ওয়াশিংটন সফরে নরেন্দ্র মোদি কম্পিউটার চিপস উৎপাদন এবং টেকনোলজি বিনিময়-সংক্রান্ত অত্যন্ত লাভ ও আকর্ষণীয় একটি যৌথ প্রকল্পে স্বাক্ষর করে, যার মূল লক্ষ্য চীনের একচ্ছত্র আধিপত্য খর্ব করা। তা ছাড়া আমেরিকার মতো পরাশক্তি যখন বাংলাদেশে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন করানোর জন্য বদ্ধপরিকর, সেখানে দ্বিমত পোষণ করা তারা সমীচীন মনে করে না। তারা তাদের জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টিও বিবেচনায় রেখেছে। চীন তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিবেশী শত্রু এবং যদি কখনো চীনের সঙ্গে সমরাস্ত্রের সংঘাত বাধে, তাহলে আমেরিকার সাহায্যই তারা চাইবে এবং নেবে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ জিরো। তা ছাড়া বাংলাদেশে ২০০৮, ১৪ ও ১৮ সালের নির্বাচনে আপনাকে সাহায্য ও সহযোগিতা করে একটি কর্তৃত্ববাদী সরকার প্রতিষ্ঠার দায়ভার তাদের নিতে বা শুনতে হচ্ছে। তাদের অপর দুই পাশে নিউক্লিয়ার অস্ত্রধারী দুটি দেশ চীন ও পাকিস্তান, যাদের সরকার ও জনগণ, উভয়েই ভারতকে ঘৃণা করে। সেখানে বাংলাদেশের জনগণও ভারতকে ঘৃণা করুক, সেটা ভারত চাইবে না। আর আপনার সরকার যে জনসম্পৃক্তহীন, সেটা তারা ভালোভাবেই জানে। তা ছাড়া ঢাকা-বেইজিংয়ের বেশ মাখামাখি দিল্লি ভালো চোখে দেখে না।
আমেরিকা বাংলাদেশে যা-ই করুক, চীন সরাসরি চ্যালেঞ্জ দিতে আসবে না। তারা আপনার সরকারকে ঋণ দিয়েছে এবং নৈতিক সমর্থন দিচ্ছে কিন্তু তাতে আপনার রাজনৈতিক কোনো উপকার হচ্ছে না। আর পশ্চিমাদের সঙ্গে বাণিজ্যের ব্যত্যয় ঘটলে চীন সে স্থান পূরণ করতে সক্ষম নয়।
নিরপেক্ষ অর্থনীতিবিদ ও প্রিন্ট মাধ্যমগুলো প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের অর্থনীতির নেতিবাচক খবর দিচ্ছে। ডলার সংকট থেকে শুরু করে আমদানি-রফতানি, ব্যাংকগুলোর বেহাল অবস্থা, বাজারে আগুন-এককথায় অর্থনীতিতে হলুদ বাতি জ্বলছে। আর পশ্চিমারা কিছু করলে লাল বাতি জ্বলতে সময় লাগবে না।
অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আপনি অনেকটা মিত্রহীন। ইনু, মেনন, দিলীপ বড়ুয়া ও মাইজভান্ডারী ছাড়া বড় কেউ নেই। অবশ্য আপনার সরকার গোপনে কেনাবেচা শুরু করেছে। শমসের মবিন চৌধুরী ও তৈমূর আলম খন্দকারকে দিয়ে মৃত তৃণমূল বিএনপিকে সবল করার চেষ্টা চলছে। যে কমিউনিস্ট পার্টি সারা জীবন আপনাদের পাশে থেকেছে, তারাও এখন আপনার অধীনে নির্বাচনব্যবস্থার অবসান চাচ্ছে। জাতীয় পার্টিও বিরোধী দলের মতোই কথা বলছে। জামায়াতকে সম্ভবত আর আটকে রাখা যাবে না আর বিএনপি তো মাঠে আছেই। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ দাবিকে আর অবজ্ঞা করা উচিত হবে কি না, সেটা আপনার পুনর্বিবেচনা করা উচিত।
আর যদি আপনার বিবেচনা দলীয় স্বার্থের অনুকূলে হয় অর্থাৎ আমেরিকা বা ইউরোপিয়ানরা কে কী করল বা বলল, কারা নির্বাচনে এল বা না এল, কত পারসেন্ট ভোট পড়ল বা না পড়লÑএসবের তোয়াক্কা না করে ২০১৪ সালের মতো এগিয়ে যান, তাহলে দেশ এক অনিশ্চয়তায় চলে যাবে। রাস্তায় সংঘর্ষ, হানাহানি, হতাহত চলতে থাকলে ২০০৬ সালের মতো দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী অংশ হস্তক্ষেপ করার আশঙ্কা অমূলক নয়। সেই পরিস্থিতি আওয়ামী লীগের অনুকূলে থাকবে, মনে করার কারণ নেই। গণদাবির প্রেক্ষাপটে হয়তো সব মানবাধিকার লঙ্ঘনের, ব্যাংক লুটের বা দুর্নীতির হিসাব দিতে হতে পারে। আর পশ্চিমারাও যে বসে থাকবে, সেটা মনে করার কারণ নেই। আমেরিকানরা যদি কম্বোডিয়ান বা এল সালভাদরের রাষ্ট্রপ্রধানদের মতো নিষেধাজ্ঞা দেয়, সেটা কতটুকু অবমাননাকর হবে, সেটা আপনি বিবেচনায় নিতে পারেন।
আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ বা ইতিহাসে আপনার স্থানের বিষয়টি নিয়ে আপনার আরও একটু ভাবা উচিত। আজ দলে আসল ও হাইব্রিড আওয়ামী লীগার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আপনি সঠিক সময়ে সঠিক তথ্য পান কি না সে প্রশ্ন অনেকেই করে। কেন আজ অনুগত মিডিয়ার চেয়ে গুটিকয়েক ইউটিউবার বেশি জনপ্রিয়, কেন বিশ্বের সবচেয় পুরোনো সংবাদমাধ্যম ফ্রান্সের এএফপি অনুসন্ধানী রিপোর্ট করে যে সরকারি মদদে বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ব্যবহার করে ভুয়া লেখকেরা সরকারি গুণকীর্তন লেখে। আওয়ামী লীগের এই দৈন্য কি অপমানজনক নয়? কেন ভারতের নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত পিটিআই লেখে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একদল ধনকুবের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে আছেন, যারা তাকে ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এবং এখন আরও টাকা খরচ করছে, যাতে আবারও ক্ষমতায় থাকতে পারে এবং আরও টাকা কামাতে পারে। বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ তো ছিল গণমানুষের দল। এই অভিযোগগুলো মিথ্যা নয় এবং বর্তমানে আওয়ামী লীগ প্রকৃতপক্ষেই জনসম্পৃক্ততাহীন। এখন যদি জনসম্পৃক্তহীন আওয়ামী লীগকে আন্তর্জাতিক এবং অভ্যন্তরীণ চাপে ক্ষমতা ছাড়তে হয়, তাহলে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের কারও দলের নেতৃত্বে এসে টিকে থাকা দুরূহ হয়ে যাবে। আর আপনার পরিবারের কেউ নেতৃত্বে না থাকতে পারলে দল ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। সেই দন্তহীন আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর।
বাংলাদেশে দ্বিদলীয় ও সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য এবং ভবিষ্যতে জিয়া, এরশাদ বা মইনুদ্দিনের মতো সামরিক শাসকেরা বা গণতান্ত্রিক লেবাসে (আওয়ামী লীগ যা করেছে) যদি কেউ ক্ষমতা আঁকড়ে রাখে, সে সময় আওয়ামী লীগেরই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হবে। সুতরাং দলের ভবিষ্যৎ নিয়েও আপনাকে সচেষ্ট হতে হবে। সন্দেহ নেই, সামগ্রিক পরিবেশ আপনার অনুকূলে নেই। তাই বলে কারও জীবনই থেমে থাকবে না। ক্ষমতা ছাড়লে যে বিষয়গুলো নিয়ে আপনার প্রতি অভিযোগ আনা হতে পারে, আপনি আগে থেকেই সেসবের দিকে নজর দিন। যেসব মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে অভিযোগ আছে, আপনি সেসব তদন্ত করার জন্য একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন করার ঘোষণা দিন এবং যেসব অফিসারের বিরুদ্ধে আমেরিকা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তাদেরকে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত অবসর দিন। বেগম জিয়ার মামলা প্রত্যাহার করে বিএনপিকে আস্থায় নিন। আপনি বা আপনার দল স্বীকার করুক বা না করুক, বিএনপি একটা ফ্যাক্টর। সর্বদলীয় একটা সভা ডেকে সংবিধানের আলোকে বা সামান্য সংশোধন করে হলেও নিরপেক্ষ নির্বাচনের একটা উপায় বের করুন। এর বিকল্প শুধু হানাহানি, ধ্বংস আর অন্ধকার। -নিউইয়র্ক