এবিএম সালেহ উদ্দীন
জাতিসংঘ বিশ্বের সর্বরাষ্ট্র ও সর্বজাতির কল্যাণমূলক একটি সর্ববৃহৎ সংগঠন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৫ সালে পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য ৫১টি রাষ্ট্র মিলে জাতিসংঘ সনদ স্বাক্ষর করার মাধ্যমে ঐকমত্যের ভিত্তিতে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সঙ্গে আগেকার ‘লিগ অব নেশন্স’ বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। তার পর থেকে জাতিসংঘের সদস্যসংখ্যা বেড়ে বর্তমানে ১৯৩।
প্রতিষ্ঠার সময় জাতিসংঘের প্রধান লক্ষ্যসমূহ কী হবে তা নির্ধারণ করা হয়। সেই লক্ষ্যসমূহের মধ্যে আছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আইন, নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক অগ্রগতি এবং মানবাধিকার বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করা। এ ছাড়া কোনো রাষ্ট্রপুঞ্জের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের হুমকি কিংবা এক দেশ অন্য দেশের আগ্রাসন ও মানববিধ্বংসী কর্মকাণ্ডসহ বিভিন্ন রকম অরাজকতা নিরসনের জন্য নানাবিধ সমঝোতার কাজেও সহায়তা করার অঙ্গীকার রয়েছে। মোটকথা, জাতিসংঘের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে, পৃথিবীর রাষ্ট্রপুঞ্জের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশের জনগণের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা। সকল রাষ্ট্র ও জাতির মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠা, স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের সুপারিশ ও চাপ সৃষ্টি করা। আর্তমানবতার কল্যাণে নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানো। এ ছাড়া পৃথিবীর রাষ্ট্রপুঞ্জের ইন্ধনে অথবা সরাসরিভাবে কোনো দেশ যদি আক্রান্ত হয় এবং অন্য কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র ও ভূখণ্ডে আগ্রাসন চালায়, এক দেশ আরেক দেশের মধ্যে অন্যায়ভাবে যুদ্ধ করে, সে রকম আগ্রাসী রাষ্ট্রের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ এবং যুদ্ধ বন্ধের জন্য চাপ প্রয়োগ করার ক্ষেত্রেও জাতিসংঘের বিশেষ নীতিমালা রয়েছে। এ ছাড়া জাতিসংঘের নীতিমালা-বহির্ভূত কোনো রাষ্ট্র কর্তৃক পারমাণবিক মারণাস্ত্র তৈরি ও সেসব মারণাস্ত্রের অপপ্রয়োগ করার ক্ষেত্রেও রয়েছে কঠোর বিধিনিষেধ। যদিও দুর্ভাগ্যজনকভাবে পৃথিবীর কোনো কোনো শক্তিধর রাষ্ট্র এবং অনেক স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রপুঞ্জের অবৈধ মারণাস্ত্রের ব্যবহার অবলীলায় চলতে থাকে।
প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের বার্ষিক সাধারণ পরিষদের সভা হয়ে থাকে। সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রসমূহ তাতে অংশগ্রহণ করেন। প্রতিটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানগণ পর্বে পর্বে সেসব অধিবেশনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নিজস্ব মতামত, দাবিদাওয়া ও প্রস্তাবনা পেশ করেন।
অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যোগদানের উদ্দেশ্যে সরকারি সফরে নিউইয়র্কে এসেছেন।
গত তিন বছরে করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) আক্রমণে সমগ্র বিশ্ব লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। কোভিড-১৯ এর জের কাটতে না কাটতেই ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনর তিক্ত প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতির ওপর পড়েছে। প্যান্ডামিক সংকটে স্থবির হয়ে যাওয়ার ফলে সমগ্র বিশ্বের অর্থনীতির অবস্থা টলটলায়মান। বিশ্বব্যাপী উৎপাদন ও উন্নয়নের চাকা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দাভাব অর্থনৈতিক সংকটে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন, তা পরিমাণ, নিরূপণ করা অসম্ভব। এ অবস্থায় জাতিসংঘে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সম্মিলিত যোগদান এবং অধিবেশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
একই কারণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সফরের গুরুত্বও কম নয়। তিনি হয়তো বরাবরের মতো একগুচ্ছ প্রস্তাবনা নিয়ে ভাষণ দেবেন। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন স্বার্থসাধনের জন্য আন্তর্জাতিক ক্ষেত্র ও বিশ্বব্যাংক থেকে কী কী সুযোগ-সুবিধা আদায় করা যায়, সেসব বিষয় নিয়েই সর্বাধিক গুরুত্ব থাকবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।
ইতিহাস সাক্ষী, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার পর ১৯৪৫ সালে পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রপুঞ্জের মাঝে শান্তি ও স্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। জাতিসংঘের বয়স যখন পঁচিশের উপান্তে, তখন বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলছিল এবং পরবর্তীতে দেশ স্বাধীন হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে ঢাকাসহ অন্যান্য জেলা শহরে বিভীষিকাময় ধ্বংসযজ্ঞ ও বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এ অবস্থায় স্বাধীনতাসংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। তৎকালীন পাকিস্তানি ইয়াহিয়া সরকারের লেলিয়ে দেওয়া বাহিনী দ্বারা বাংলাদেশের গণহত্যা চালানো হয় এবং বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় ও ক্ষোভ প্রকাশিত হয়।
অথচ সে সময় বিশ্বের অন্যতম গণতান্ত্রিক দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমর্থন না দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে এবং পাকিস্তানের পক্ষে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। শুধু তা-ই নয়, জাতিসংঘে বাংলাদেশের পক্ষে ভোট দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমর্থন দিতে অনেক গড়িমসি করেন এবং মিত্রদেশগুলোকে সমর্থন দিতে বারণ করেন।
ইতিহাস সাক্ষী, ওয়াটার কেলেঙ্কারির ঘটনাও বহুবিধ কারণে নিক্সন ইমপিচমেন্টের ধকলে পড়ে যান এবং একপর্যায়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। কিন্তু আমেরিকান জনগণ ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কঠিন সময়ে বাংলাদেশের যুদ্ধপীড়িত আর্তমানবতার সাহায্যার্থে ফান্ড রাইজিংয়ের জন্য বিশ্ববিখ্যাত সংগীতশিল্পী আমেরিকান নাগরিক জর্জ হ্যারিসনের উদ্যোগে বব ডিলানও তাদের পুরো দল নিয়ে নিউইয়র্কে বিরাট কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয়। উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠতম সেতার বাদক রবি শংকর, আলী আকবর খান, আল্লারাখাসহ মিউজিশিয়ানের অংশগ্রহণ নিউইয়র্কের ‘ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে’ স্মরণকালের দর্শক সমাবেশ ঘটেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রাণের ভয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের এক কোটি মানুষের সাহায্যের ক্ষেত্রে ব্যাপক সাড়া জুগিয়েছিল এবং ওই ফান্ড রেইজিং অনুষ্ঠান শতভাগ সফল হয়েছিল।
বলা বাহুল্য, সেদিনের (১৯৭১) উপচে পড়া লাখো দর্শকের অনুরোধে জর্জ হ্যারিসন, বব ডিলান ও তাদের পুরো টিমকে দুটি কনসার্ট করতে হয়েছিল। সেই ফান্ড রেইজিংয়ের নেতৃত্বে ছিলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ও হিতাকাক্সক্ষী জর্জ হ্যারিসন।
বলা বাহুল্য, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতিসংঘ সদস্যপদ লাভের আবেদন করলে যেসব রাষ্ট্র ভেটো প্রদান করে, তাদের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ব্রিটেন অন্যতম। কিন্তু সবকিছুকে উতরে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে।
সদস্যপদ লাভের আট দিনের মাথায় বঙ্গবন্ধু নিউইয়র্কে আসেন এবং ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে একটি দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ দেন। বাংলা ভাষায় প্রদত্ত তাঁর ভাষণটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ ও বিশ্লেষণধর্মী। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অধিকারবঞ্চিত, নির্যাতিত, নিষ্পেষিত মানুষের ন্যায়সংগত অধিকার প্রতিষ্ঠা ও বিশ্বশান্তি, ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার বলিষ্ঠ উচ্চারণ ও সাহসী পদক্ষেপ এবং গুরুত্বপূর্ণ।
বলা বাহল্য, ৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঢাকা থেকে সরকারের সফরসঙ্গী হিসেবে বেশি লোক আসেনি। পররাষ্ট্রবিষয়ক এবং সরকারের কতিপয় নীতিনির্ধারক ছাড়া বেশি লোকের দরকারও ছিল না। জেনারেল জিয়াউর রহমানের সময়েও জাতিসংঘ অধিবেশনে অংশগ্রহণকালে সফরসঙ্গী বেশি থাকত না। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে, জেনারেল এরশাদের শাসনামলে জাতিসংঘে যোগদান উপলক্ষে রাষ্ট্রপ্রধানের সফরসঙ্গী ক্রমাগত বাড়তে থাকে এবং প্রতিবছরই চলতে থাকে বিরাট বহরের কায়-কারবার! বর্তমানে সেই সংখ্যা অভাবনীয়ভাবে বেড়ে গেছে।
বাংলাদেশ বহুমাত্রিক রাজনৈতিক দর্শনের ওপর ভিত্তি করে প্রজাতন্ত্রের সকল জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারে এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসনদ নিয়েই জন্মগ্রহণ করেছিল। দেশের এবং জনগণের স্বার্থকে সবার ওপর গুরুত্ব দিয়েই রাজনীতি ও মানবাধিকার, অর্থনীতি এবং রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম হওয়ার কথা। সেটি অতীতে এবং বর্তমানে সামগ্রিকভাবে রক্ষা করা হয়নি বরং অনেকাংশে লঙ্ঘিত হয়েছে। বহুবার দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশ ক্ষুণ্ন হয়েছে এবং স্বাধীন নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার সুষ্ঠু নিয়ম লঙ্ঘিত হয়েছে। যদিও সব সরকারই উন্নয়ন ও জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলে। উন্নয়নের জোয়ারের কথা বলে। কিন্তু সেটিই যে রাষ্ট্রতন্ত্রের মূল ভিত্তি, সে কথা তারা ভুলে গিয়ে শুধু নিজেরা কী কী ভালো করছেন, তার ওপরই ফোকাস করেন। তবু স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত বহু চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে বর্তমান বাংলাদেশ অনেক ধাপ এগিয়েছে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নধারায় চলছে।
কিন্তু বর্তমানে রাজনীতির অবস্থা কী? শিক্ষিত বিচক্ষণ দেশপ্রেমিক দূরদর্শী সুশীল সমাজ রাজনীতিবিমুখ। রাজনৈতিক দলসমূহ তাদের কর্মসূচিতে দেশ ও জনকল্যাণে কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারছে? রাষ্ট্রপুঞ্জের ক্ষমতার পালাবদলের রাজনীতিতে সুশীল জনদরদি কল্যাণকামী রাজনীতিকের পরিবর্তে বখাটে রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন ঘটে চলছে। তা রোখার ক্ষমতা কারও নেই। বরং আশঙ্কাজনকভাবে দেশময় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পাশাপাশি স্বজন পোষণ এবং তোষণনীতি বল্গাহীনভাবে বেড়েছে! ফলে ভোগস্পৃহার পাশাপাশি ব্যাপক দুর্নীতি রাষ্ট্রপুঞ্জ ও প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে।
তিক্ত হলেও সত্য, প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীদের মধ্যে অনেকেই জাতিসংঘের অধিবেশনসমূহে যোগদানের জন্য আসেন। তাদের অনেকে অধিবেশনসমূহে যোগদান না করে আত্মীয়স্বজন কিংবা বন্ধুদের বিনোদনসঙ্গী হয়ে থাকেন (!) বলে জনশ্রুতি আছে। শুধু তা-ই নয়, অনুষ্ঠানসূচিতে রাষ্ট্রের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ের ওপর অভিবাসীদের প্রতিনিধির সমন্বয়ে যেসব সভা-সেমিনার ও প্যানেল ডিসকাশন হয়, সেখানেও অনেককেই পাওয়া যায় না। এটি দুঃখজনক।
এমন নজির অন্যান্য দেশের সরকারি সফরসূচিতে এমন বাহুল্য ও অবিবেচনাপ্রসূত ব্যবস্থাপনা নেই। যারা আসেন, তারা দিবারাত্রি নিজের দেশের সমৃদ্ধির স্বার্থে অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কূটনীতিক কার্যক্রম নিয়েই ব্যস্ত থাকেন।
তবে সুখের বিষয়, বর্তমান বাংলাদেশ বিশ্বের একটি সর্বালোচিত উন্নয়নমুখী রাষ্ট্র। অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনার দেউলিয়াত্বে মুদ্রাস্ফীতির হ্রাস এবং অর্থনীতি কোন দিকে যাচ্ছে (?), সে ব্যাপারে রাষ্ট্রপুঞ্জের আরও গতিশীল কার্যক্রম থাকা দরকার। উদাহরণ অনেক আছে। ব্যাংকগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ গ্রহণ করে সংঘবদ্ধ কুচক্রী দল সেসব টাকা পরিশোধ না করার হাজার হাজার উদাহরণ আছে। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি ডলার হ্যাক হয়ে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এবং সংশ্লিষ্টদের সে জন্য কোনো জবাবদিহির আওতায় আনা যায় না। হাজার হাজার কোটি টাকা বহির্বিশ্বে অবৈধভাবে পাচার হয়ে যায় (!), তাদের বিচার করা হয় না। দেশের বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা ও সুবিচার নিতেও অনেকের বেদনাদায়ক পাহাড়সম কষ্টবোধ ও প্রশ্ন রয়েছে। দেশের কোটি মানুষের বেকারত্ব দূরীকরণে সরকারের সঠিক পদক্ষেপ এবং উদারতার প্রয়োজন। বিজ্ঞান, টেকনোলজি ও আইটি সেক্টরকে উন্নতভাবে প্রতিষ্ঠা এবং সর্বব্যাপী বেগবান করার ক্ষেত্রেও সরকারের ঔদাসীন্য প্রশ্নাতীত। সেদিকে গিয়ে কলেবর বাড়াতে চাই না।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন-প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা প্রবাসীদের অবদান বেশি। এটি অবশ্যই সরকারের মনে রাখতে হবে। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের শ্রমিকদের প্রতি আন্তরিক ও উদার দৃষ্টি রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে সর্বজনস্বীকৃত দিক হচ্ছে, প্রবাসে অবস্থানরত রেমিট্যান্সের ওপর বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরে এবং বাংলাদেশ সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে। প্রবাসীরা মাতৃভূমিকে হৃদয়ে লালন করেই তারা নিজেদের পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধায় উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, বাংলাদেশে প্রবাসীরাই বেশি হয়রানি ও নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হন। দুষ্টচক্রের পাল্লায় তাদের অর্থসম্পদ ও সর্বস্ব হারান। প্রবাসীদের কষ্টার্জিত সম্পদের ওপর স্থানীয় মোড়লদের লোলুপ দৃষ্টি পড়ে যায়।
মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত প্রবাসীদের দুর্ভোগ শুরু হয় ঢাকা বিমানবন্দর থেকেই। কাস্টমসের কর্মকর্তাদের অবহেলায় (কঠিন পরিশ্রমী) প্রবাসীরা বিমানবন্দরে সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হন। দেশে ফিরে আসার পর স্থানীয় মাস্তান-মোড়ল এবং সন্ত্রাসীর কবলে অনেকের জীবনও বিপন্ন হওয়ার নজির আছে।
নিজ মাতৃভূমি থেকে সম্পদ বিক্রির মাধ্যমে বিদেশে চাকরি নিয়ে যাওয়ার পরও দেশের সম্মানিত শ্রমিকবৃন্দ প্রতারণার শিকার হন অথবা চাকরি ও সর্বস্ব হারিয়ে দেশে ফেরত আসতে বাধ্য হন। এ অবস্থায় সীমাহীন সমস্যা ও সংকটের মধ্য দিয়ে তাদের সংসার চলে। সরকার চাইলে সেই নাগরিকদের সুদমুক্ত ঋণ অথবা স্বল্প সুদের বিনিময়ে দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোয় ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করে তাদের সাহায্য করতে পারে। সংশ্লিষ্ট পরিবারের সন্তানদের শিক্ষার ক্ষেত্রে এবং মেধাবী ছাত্রদের উচ্চশিক্ষার্থে বহির্বিশ্বে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারে। আইটি সেক্টরকে সমৃদ্ধ করে উপযুক্ত লাখ লাখ শিক্ষিত যুবককে ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে বেকারত্ব দূরীকরণ ও বিদেশে প্রেরণের ব্যবস্থা করতে পারে।
বলা বাহুল্য, প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে বাংলাদেশ এখনো অনেক পিছিয়ে। বর্তমান সরকারের সময় ভারতের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সখ্য এবং প্রচার তা করা হয় যে, ভারতই বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে এবং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ভারত সহযোগিতা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা আমাদের এক কোটি মানুষকে আশ্রয় দান করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত ভারত বাংলাদেশ থেকে তার ব্যবসা-বাণিজ্য সমৃদ্ধির বিরাট সুযোগ নিচ্ছে। এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের নীরবতার ব্যাপারে তারা খুব একটা মাথা ঘামান না।
কয়েক বছর ধরে ঢাকা-নিউইয়র্ক রুটে বিমান নেই। বিমান কর্মকর্তাদের একচেটিয়া দুর্নীতি ও চুরির ফলে বছরের পর বছর উপর্যুপরি ভর্তুকি ও লোকসানের ফলে সরকার নিউইয়র্কের বিমান চলাচল বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়। অথচ আমেরিকায় অবস্থানরত বৃহৎ সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশি প্রতিনিয়ত অন্যান্য এয়ারলাইন্সের মাধ্যমে ঢাকায় যাতায়াত করেন এবং সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইন্সসমূহ বিপুল পরিমাণ লাভ করে। বিমান সংস্থা তথা সরকার প্রবাসীদের থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থলাভ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
দুঃখজনক হলেও সত্যি, পৃথিবীর সব এয়ারলাইন্স লাভবান হলেও দুর্নীতি ও চুরির কারণেই মূলত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স কখনো লাভের মুখ দেখেনি! সরকার বিমানের সে সময়কার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের চুরির বিষয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত করলেই সঠিক রেজাল্ট পেতে পারে।
আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশের অনেক সাফল্য ও সম্ভাবনার সঙ্গে সমগ্র দেশব্যাপী করোনাভাইরাসে অর্থনীতি সংকটাপন্ন। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও অনেক প্রাণহানি ঘটেছে। অগণিত মানুষ চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুর মুখোমুখি। দেশের অর্থনৈতিক কঠিন অবস্থার মধ্যে যেখানে সরকারকে হিমশিম খেতে হচ্ছে, সেখানে কতিপয় চোর-বাটপার, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার কবলে পুরো দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখনো হাজার হাজার কোটি টাকা অবলীলায় বিদেশে পাচার হচ্ছে! আমাদের প্রত্যাশা, সরকার সেসব চোরাকারবারিকে আইনের আওতায় এনে বিচারের মাধ্যমে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একদিকে বঙ্গবন্ধুর কন্যা এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। এটা আমাদের যেমন আনন্দিত ও পুলকিত করে, তেমনি তার সরকারের সময় জনজীবনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত, দুর্নীতি এবং অন্যান্য ক্ষতিকর হওয়ার খবরে আমরা ব্যথিত ও মর্মাহত হই। শুনেছি, তিনি প্রবাসীদের কল্যাণার্থে খুবই আন্তরিক। দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে উপরিউক্ত সমস্যাবলির প্রতি দৃষ্টি দিয়ে তিনিও প্রবাসীদের সুখ-দুঃখের সঙ্গী হতে পারেন। কেননা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার আন্তরিকতা এবং বুদ্ধিসচেতন নিষ্ঠাবোধ প্রশংসনীয়।
বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ অনেক সমস্যা রয়েছে। জাতিসংঘের অধিবেশনে সেসব সমস্যা নিয়ে সরকারি প্রস্তাবনা তুলে ধরার দায়িত্ব তো সরকারের। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা সেটি সাজিয়ে দেন। এখানে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কিছু করার নেই। তারা শুধু দুঃখের কথাগুলোই বলতে পারেন। বাংলাদেশে দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীর একটি মানবধর্মী সন্তোষজনক সমাধান হোকÑসেটি সবার কাম্য। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সাহায্য এবং মিয়ানমারের স্বৈরতন্ত্রী পৈশাচিক সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার এবং কঠোর ব্যবস্থার দাবি বিশ্বের সকল মানবতাবাদী মানুষের। জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগদানকারী রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের মতামত ও ন্যায্য দাবিগুলোর একটা সুরাহা সকলের কাম্য।
লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের কঠিন দিনগুলোর কথা কারও বিস্মৃত হওয়ার নয়। সরকার যদি জনগণের হয়, তাহলে জনগণও সরকারের আসল অংশ এবং আসল প্রাণ। সে জন্য দেশে রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনাকে জোরালো করে তুলতে হবে।
আশা করি, সরকার জনগণের অধিকারের বিষয়ে সকল প্রকার বৈষম্য দূর করে সবার নাগরিক অধিকারের ব্যাপারে সচেষ্ট থাকবে এবং দেশে সুশীল রাজনীতির শান্তির জন্য অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে সহযোগিতা করবে। আমরা দৃঢ়ভাবে আশা করি, সেসব দিকের প্রতি লক্ষ্য রেখে দেশ, মাটি ও মাতৃকাকে সবাই ভালোবাসেন। আর প্রবাসীরা নিজের দেশ, মাটি ও মাতৃভূমিকে কী পরিমাণ ভালোবাসেন তা অতুলনীয় এবং তাদের দেশপ্রেম ও ভালোবাসার তুলনা করা সম্ভব নয়। সারা পৃথিবীর উন্নয়নধারার সঙ্গে বাংলাদেশ আরও উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে, তা-ই সকলের প্রত্যাশা। প্রধানমন্ত্রীকে নিউইয়র্কে সুস্বাগত।
লেখক : কবি ও কলামিস্ট
জাতিসংঘ বিশ্বের সর্বরাষ্ট্র ও সর্বজাতির কল্যাণমূলক একটি সর্ববৃহৎ সংগঠন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৫ সালে পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য ৫১টি রাষ্ট্র মিলে জাতিসংঘ সনদ স্বাক্ষর করার মাধ্যমে ঐকমত্যের ভিত্তিতে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সঙ্গে আগেকার ‘লিগ অব নেশন্স’ বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। তার পর থেকে জাতিসংঘের সদস্যসংখ্যা বেড়ে বর্তমানে ১৯৩।
প্রতিষ্ঠার সময় জাতিসংঘের প্রধান লক্ষ্যসমূহ কী হবে তা নির্ধারণ করা হয়। সেই লক্ষ্যসমূহের মধ্যে আছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আইন, নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক অগ্রগতি এবং মানবাধিকার বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করা। এ ছাড়া কোনো রাষ্ট্রপুঞ্জের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের হুমকি কিংবা এক দেশ অন্য দেশের আগ্রাসন ও মানববিধ্বংসী কর্মকাণ্ডসহ বিভিন্ন রকম অরাজকতা নিরসনের জন্য নানাবিধ সমঝোতার কাজেও সহায়তা করার অঙ্গীকার রয়েছে। মোটকথা, জাতিসংঘের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে, পৃথিবীর রাষ্ট্রপুঞ্জের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশের জনগণের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা। সকল রাষ্ট্র ও জাতির মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠা, স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের সুপারিশ ও চাপ সৃষ্টি করা। আর্তমানবতার কল্যাণে নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানো। এ ছাড়া পৃথিবীর রাষ্ট্রপুঞ্জের ইন্ধনে অথবা সরাসরিভাবে কোনো দেশ যদি আক্রান্ত হয় এবং অন্য কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র ও ভূখণ্ডে আগ্রাসন চালায়, এক দেশ আরেক দেশের মধ্যে অন্যায়ভাবে যুদ্ধ করে, সে রকম আগ্রাসী রাষ্ট্রের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ এবং যুদ্ধ বন্ধের জন্য চাপ প্রয়োগ করার ক্ষেত্রেও জাতিসংঘের বিশেষ নীতিমালা রয়েছে। এ ছাড়া জাতিসংঘের নীতিমালা-বহির্ভূত কোনো রাষ্ট্র কর্তৃক পারমাণবিক মারণাস্ত্র তৈরি ও সেসব মারণাস্ত্রের অপপ্রয়োগ করার ক্ষেত্রেও রয়েছে কঠোর বিধিনিষেধ। যদিও দুর্ভাগ্যজনকভাবে পৃথিবীর কোনো কোনো শক্তিধর রাষ্ট্র এবং অনেক স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রপুঞ্জের অবৈধ মারণাস্ত্রের ব্যবহার অবলীলায় চলতে থাকে।
প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের বার্ষিক সাধারণ পরিষদের সভা হয়ে থাকে। সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রসমূহ তাতে অংশগ্রহণ করেন। প্রতিটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানগণ পর্বে পর্বে সেসব অধিবেশনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নিজস্ব মতামত, দাবিদাওয়া ও প্রস্তাবনা পেশ করেন।
অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যোগদানের উদ্দেশ্যে সরকারি সফরে নিউইয়র্কে এসেছেন।
গত তিন বছরে করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) আক্রমণে সমগ্র বিশ্ব লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। কোভিড-১৯ এর জের কাটতে না কাটতেই ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনর তিক্ত প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতির ওপর পড়েছে। প্যান্ডামিক সংকটে স্থবির হয়ে যাওয়ার ফলে সমগ্র বিশ্বের অর্থনীতির অবস্থা টলটলায়মান। বিশ্বব্যাপী উৎপাদন ও উন্নয়নের চাকা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দাভাব অর্থনৈতিক সংকটে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন, তা পরিমাণ, নিরূপণ করা অসম্ভব। এ অবস্থায় জাতিসংঘে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সম্মিলিত যোগদান এবং অধিবেশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
একই কারণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সফরের গুরুত্বও কম নয়। তিনি হয়তো বরাবরের মতো একগুচ্ছ প্রস্তাবনা নিয়ে ভাষণ দেবেন। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন স্বার্থসাধনের জন্য আন্তর্জাতিক ক্ষেত্র ও বিশ্বব্যাংক থেকে কী কী সুযোগ-সুবিধা আদায় করা যায়, সেসব বিষয় নিয়েই সর্বাধিক গুরুত্ব থাকবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।
ইতিহাস সাক্ষী, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার পর ১৯৪৫ সালে পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রপুঞ্জের মাঝে শান্তি ও স্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। জাতিসংঘের বয়স যখন পঁচিশের উপান্তে, তখন বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলছিল এবং পরবর্তীতে দেশ স্বাধীন হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে ঢাকাসহ অন্যান্য জেলা শহরে বিভীষিকাময় ধ্বংসযজ্ঞ ও বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এ অবস্থায় স্বাধীনতাসংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। তৎকালীন পাকিস্তানি ইয়াহিয়া সরকারের লেলিয়ে দেওয়া বাহিনী দ্বারা বাংলাদেশের গণহত্যা চালানো হয় এবং বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় ও ক্ষোভ প্রকাশিত হয়।
অথচ সে সময় বিশ্বের অন্যতম গণতান্ত্রিক দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমর্থন না দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে এবং পাকিস্তানের পক্ষে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। শুধু তা-ই নয়, জাতিসংঘে বাংলাদেশের পক্ষে ভোট দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমর্থন দিতে অনেক গড়িমসি করেন এবং মিত্রদেশগুলোকে সমর্থন দিতে বারণ করেন।
ইতিহাস সাক্ষী, ওয়াটার কেলেঙ্কারির ঘটনাও বহুবিধ কারণে নিক্সন ইমপিচমেন্টের ধকলে পড়ে যান এবং একপর্যায়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। কিন্তু আমেরিকান জনগণ ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কঠিন সময়ে বাংলাদেশের যুদ্ধপীড়িত আর্তমানবতার সাহায্যার্থে ফান্ড রাইজিংয়ের জন্য বিশ্ববিখ্যাত সংগীতশিল্পী আমেরিকান নাগরিক জর্জ হ্যারিসনের উদ্যোগে বব ডিলানও তাদের পুরো দল নিয়ে নিউইয়র্কে বিরাট কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয়। উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠতম সেতার বাদক রবি শংকর, আলী আকবর খান, আল্লারাখাসহ মিউজিশিয়ানের অংশগ্রহণ নিউইয়র্কের ‘ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে’ স্মরণকালের দর্শক সমাবেশ ঘটেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রাণের ভয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের এক কোটি মানুষের সাহায্যের ক্ষেত্রে ব্যাপক সাড়া জুগিয়েছিল এবং ওই ফান্ড রেইজিং অনুষ্ঠান শতভাগ সফল হয়েছিল।
বলা বাহুল্য, সেদিনের (১৯৭১) উপচে পড়া লাখো দর্শকের অনুরোধে জর্জ হ্যারিসন, বব ডিলান ও তাদের পুরো টিমকে দুটি কনসার্ট করতে হয়েছিল। সেই ফান্ড রেইজিংয়ের নেতৃত্বে ছিলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ও হিতাকাক্সক্ষী জর্জ হ্যারিসন।
বলা বাহুল্য, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতিসংঘ সদস্যপদ লাভের আবেদন করলে যেসব রাষ্ট্র ভেটো প্রদান করে, তাদের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ব্রিটেন অন্যতম। কিন্তু সবকিছুকে উতরে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে।
সদস্যপদ লাভের আট দিনের মাথায় বঙ্গবন্ধু নিউইয়র্কে আসেন এবং ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে একটি দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ দেন। বাংলা ভাষায় প্রদত্ত তাঁর ভাষণটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ ও বিশ্লেষণধর্মী। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অধিকারবঞ্চিত, নির্যাতিত, নিষ্পেষিত মানুষের ন্যায়সংগত অধিকার প্রতিষ্ঠা ও বিশ্বশান্তি, ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার বলিষ্ঠ উচ্চারণ ও সাহসী পদক্ষেপ এবং গুরুত্বপূর্ণ।
বলা বাহল্য, ৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঢাকা থেকে সরকারের সফরসঙ্গী হিসেবে বেশি লোক আসেনি। পররাষ্ট্রবিষয়ক এবং সরকারের কতিপয় নীতিনির্ধারক ছাড়া বেশি লোকের দরকারও ছিল না। জেনারেল জিয়াউর রহমানের সময়েও জাতিসংঘ অধিবেশনে অংশগ্রহণকালে সফরসঙ্গী বেশি থাকত না। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে, জেনারেল এরশাদের শাসনামলে জাতিসংঘে যোগদান উপলক্ষে রাষ্ট্রপ্রধানের সফরসঙ্গী ক্রমাগত বাড়তে থাকে এবং প্রতিবছরই চলতে থাকে বিরাট বহরের কায়-কারবার! বর্তমানে সেই সংখ্যা অভাবনীয়ভাবে বেড়ে গেছে।
বাংলাদেশ বহুমাত্রিক রাজনৈতিক দর্শনের ওপর ভিত্তি করে প্রজাতন্ত্রের সকল জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারে এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসনদ নিয়েই জন্মগ্রহণ করেছিল। দেশের এবং জনগণের স্বার্থকে সবার ওপর গুরুত্ব দিয়েই রাজনীতি ও মানবাধিকার, অর্থনীতি এবং রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম হওয়ার কথা। সেটি অতীতে এবং বর্তমানে সামগ্রিকভাবে রক্ষা করা হয়নি বরং অনেকাংশে লঙ্ঘিত হয়েছে। বহুবার দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশ ক্ষুণ্ন হয়েছে এবং স্বাধীন নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার সুষ্ঠু নিয়ম লঙ্ঘিত হয়েছে। যদিও সব সরকারই উন্নয়ন ও জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলে। উন্নয়নের জোয়ারের কথা বলে। কিন্তু সেটিই যে রাষ্ট্রতন্ত্রের মূল ভিত্তি, সে কথা তারা ভুলে গিয়ে শুধু নিজেরা কী কী ভালো করছেন, তার ওপরই ফোকাস করেন। তবু স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত বহু চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে বর্তমান বাংলাদেশ অনেক ধাপ এগিয়েছে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নধারায় চলছে।
কিন্তু বর্তমানে রাজনীতির অবস্থা কী? শিক্ষিত বিচক্ষণ দেশপ্রেমিক দূরদর্শী সুশীল সমাজ রাজনীতিবিমুখ। রাজনৈতিক দলসমূহ তাদের কর্মসূচিতে দেশ ও জনকল্যাণে কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারছে? রাষ্ট্রপুঞ্জের ক্ষমতার পালাবদলের রাজনীতিতে সুশীল জনদরদি কল্যাণকামী রাজনীতিকের পরিবর্তে বখাটে রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন ঘটে চলছে। তা রোখার ক্ষমতা কারও নেই। বরং আশঙ্কাজনকভাবে দেশময় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পাশাপাশি স্বজন পোষণ এবং তোষণনীতি বল্গাহীনভাবে বেড়েছে! ফলে ভোগস্পৃহার পাশাপাশি ব্যাপক দুর্নীতি রাষ্ট্রপুঞ্জ ও প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে।
তিক্ত হলেও সত্য, প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীদের মধ্যে অনেকেই জাতিসংঘের অধিবেশনসমূহে যোগদানের জন্য আসেন। তাদের অনেকে অধিবেশনসমূহে যোগদান না করে আত্মীয়স্বজন কিংবা বন্ধুদের বিনোদনসঙ্গী হয়ে থাকেন (!) বলে জনশ্রুতি আছে। শুধু তা-ই নয়, অনুষ্ঠানসূচিতে রাষ্ট্রের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ের ওপর অভিবাসীদের প্রতিনিধির সমন্বয়ে যেসব সভা-সেমিনার ও প্যানেল ডিসকাশন হয়, সেখানেও অনেককেই পাওয়া যায় না। এটি দুঃখজনক।
এমন নজির অন্যান্য দেশের সরকারি সফরসূচিতে এমন বাহুল্য ও অবিবেচনাপ্রসূত ব্যবস্থাপনা নেই। যারা আসেন, তারা দিবারাত্রি নিজের দেশের সমৃদ্ধির স্বার্থে অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কূটনীতিক কার্যক্রম নিয়েই ব্যস্ত থাকেন।
তবে সুখের বিষয়, বর্তমান বাংলাদেশ বিশ্বের একটি সর্বালোচিত উন্নয়নমুখী রাষ্ট্র। অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনার দেউলিয়াত্বে মুদ্রাস্ফীতির হ্রাস এবং অর্থনীতি কোন দিকে যাচ্ছে (?), সে ব্যাপারে রাষ্ট্রপুঞ্জের আরও গতিশীল কার্যক্রম থাকা দরকার। উদাহরণ অনেক আছে। ব্যাংকগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ গ্রহণ করে সংঘবদ্ধ কুচক্রী দল সেসব টাকা পরিশোধ না করার হাজার হাজার উদাহরণ আছে। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি ডলার হ্যাক হয়ে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এবং সংশ্লিষ্টদের সে জন্য কোনো জবাবদিহির আওতায় আনা যায় না। হাজার হাজার কোটি টাকা বহির্বিশ্বে অবৈধভাবে পাচার হয়ে যায় (!), তাদের বিচার করা হয় না। দেশের বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা ও সুবিচার নিতেও অনেকের বেদনাদায়ক পাহাড়সম কষ্টবোধ ও প্রশ্ন রয়েছে। দেশের কোটি মানুষের বেকারত্ব দূরীকরণে সরকারের সঠিক পদক্ষেপ এবং উদারতার প্রয়োজন। বিজ্ঞান, টেকনোলজি ও আইটি সেক্টরকে উন্নতভাবে প্রতিষ্ঠা এবং সর্বব্যাপী বেগবান করার ক্ষেত্রেও সরকারের ঔদাসীন্য প্রশ্নাতীত। সেদিকে গিয়ে কলেবর বাড়াতে চাই না।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন-প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা প্রবাসীদের অবদান বেশি। এটি অবশ্যই সরকারের মনে রাখতে হবে। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের শ্রমিকদের প্রতি আন্তরিক ও উদার দৃষ্টি রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে সর্বজনস্বীকৃত দিক হচ্ছে, প্রবাসে অবস্থানরত রেমিট্যান্সের ওপর বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরে এবং বাংলাদেশ সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে। প্রবাসীরা মাতৃভূমিকে হৃদয়ে লালন করেই তারা নিজেদের পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধায় উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, বাংলাদেশে প্রবাসীরাই বেশি হয়রানি ও নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হন। দুষ্টচক্রের পাল্লায় তাদের অর্থসম্পদ ও সর্বস্ব হারান। প্রবাসীদের কষ্টার্জিত সম্পদের ওপর স্থানীয় মোড়লদের লোলুপ দৃষ্টি পড়ে যায়।
মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত প্রবাসীদের দুর্ভোগ শুরু হয় ঢাকা বিমানবন্দর থেকেই। কাস্টমসের কর্মকর্তাদের অবহেলায় (কঠিন পরিশ্রমী) প্রবাসীরা বিমানবন্দরে সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হন। দেশে ফিরে আসার পর স্থানীয় মাস্তান-মোড়ল এবং সন্ত্রাসীর কবলে অনেকের জীবনও বিপন্ন হওয়ার নজির আছে।
নিজ মাতৃভূমি থেকে সম্পদ বিক্রির মাধ্যমে বিদেশে চাকরি নিয়ে যাওয়ার পরও দেশের সম্মানিত শ্রমিকবৃন্দ প্রতারণার শিকার হন অথবা চাকরি ও সর্বস্ব হারিয়ে দেশে ফেরত আসতে বাধ্য হন। এ অবস্থায় সীমাহীন সমস্যা ও সংকটের মধ্য দিয়ে তাদের সংসার চলে। সরকার চাইলে সেই নাগরিকদের সুদমুক্ত ঋণ অথবা স্বল্প সুদের বিনিময়ে দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোয় ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করে তাদের সাহায্য করতে পারে। সংশ্লিষ্ট পরিবারের সন্তানদের শিক্ষার ক্ষেত্রে এবং মেধাবী ছাত্রদের উচ্চশিক্ষার্থে বহির্বিশ্বে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারে। আইটি সেক্টরকে সমৃদ্ধ করে উপযুক্ত লাখ লাখ শিক্ষিত যুবককে ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে বেকারত্ব দূরীকরণ ও বিদেশে প্রেরণের ব্যবস্থা করতে পারে।
বলা বাহুল্য, প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে বাংলাদেশ এখনো অনেক পিছিয়ে। বর্তমান সরকারের সময় ভারতের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সখ্য এবং প্রচার তা করা হয় যে, ভারতই বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে এবং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ভারত সহযোগিতা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা আমাদের এক কোটি মানুষকে আশ্রয় দান করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত ভারত বাংলাদেশ থেকে তার ব্যবসা-বাণিজ্য সমৃদ্ধির বিরাট সুযোগ নিচ্ছে। এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের নীরবতার ব্যাপারে তারা খুব একটা মাথা ঘামান না।
কয়েক বছর ধরে ঢাকা-নিউইয়র্ক রুটে বিমান নেই। বিমান কর্মকর্তাদের একচেটিয়া দুর্নীতি ও চুরির ফলে বছরের পর বছর উপর্যুপরি ভর্তুকি ও লোকসানের ফলে সরকার নিউইয়র্কের বিমান চলাচল বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়। অথচ আমেরিকায় অবস্থানরত বৃহৎ সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশি প্রতিনিয়ত অন্যান্য এয়ারলাইন্সের মাধ্যমে ঢাকায় যাতায়াত করেন এবং সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইন্সসমূহ বিপুল পরিমাণ লাভ করে। বিমান সংস্থা তথা সরকার প্রবাসীদের থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থলাভ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
দুঃখজনক হলেও সত্যি, পৃথিবীর সব এয়ারলাইন্স লাভবান হলেও দুর্নীতি ও চুরির কারণেই মূলত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স কখনো লাভের মুখ দেখেনি! সরকার বিমানের সে সময়কার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের চুরির বিষয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত করলেই সঠিক রেজাল্ট পেতে পারে।
আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশের অনেক সাফল্য ও সম্ভাবনার সঙ্গে সমগ্র দেশব্যাপী করোনাভাইরাসে অর্থনীতি সংকটাপন্ন। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও অনেক প্রাণহানি ঘটেছে। অগণিত মানুষ চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুর মুখোমুখি। দেশের অর্থনৈতিক কঠিন অবস্থার মধ্যে যেখানে সরকারকে হিমশিম খেতে হচ্ছে, সেখানে কতিপয় চোর-বাটপার, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার কবলে পুরো দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখনো হাজার হাজার কোটি টাকা অবলীলায় বিদেশে পাচার হচ্ছে! আমাদের প্রত্যাশা, সরকার সেসব চোরাকারবারিকে আইনের আওতায় এনে বিচারের মাধ্যমে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একদিকে বঙ্গবন্ধুর কন্যা এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। এটা আমাদের যেমন আনন্দিত ও পুলকিত করে, তেমনি তার সরকারের সময় জনজীবনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত, দুর্নীতি এবং অন্যান্য ক্ষতিকর হওয়ার খবরে আমরা ব্যথিত ও মর্মাহত হই। শুনেছি, তিনি প্রবাসীদের কল্যাণার্থে খুবই আন্তরিক। দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে উপরিউক্ত সমস্যাবলির প্রতি দৃষ্টি দিয়ে তিনিও প্রবাসীদের সুখ-দুঃখের সঙ্গী হতে পারেন। কেননা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার আন্তরিকতা এবং বুদ্ধিসচেতন নিষ্ঠাবোধ প্রশংসনীয়।
বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ অনেক সমস্যা রয়েছে। জাতিসংঘের অধিবেশনে সেসব সমস্যা নিয়ে সরকারি প্রস্তাবনা তুলে ধরার দায়িত্ব তো সরকারের। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা সেটি সাজিয়ে দেন। এখানে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কিছু করার নেই। তারা শুধু দুঃখের কথাগুলোই বলতে পারেন। বাংলাদেশে দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীর একটি মানবধর্মী সন্তোষজনক সমাধান হোকÑসেটি সবার কাম্য। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সাহায্য এবং মিয়ানমারের স্বৈরতন্ত্রী পৈশাচিক সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার এবং কঠোর ব্যবস্থার দাবি বিশ্বের সকল মানবতাবাদী মানুষের। জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগদানকারী রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের মতামত ও ন্যায্য দাবিগুলোর একটা সুরাহা সকলের কাম্য।
লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের কঠিন দিনগুলোর কথা কারও বিস্মৃত হওয়ার নয়। সরকার যদি জনগণের হয়, তাহলে জনগণও সরকারের আসল অংশ এবং আসল প্রাণ। সে জন্য দেশে রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনাকে জোরালো করে তুলতে হবে।
আশা করি, সরকার জনগণের অধিকারের বিষয়ে সকল প্রকার বৈষম্য দূর করে সবার নাগরিক অধিকারের ব্যাপারে সচেষ্ট থাকবে এবং দেশে সুশীল রাজনীতির শান্তির জন্য অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে সহযোগিতা করবে। আমরা দৃঢ়ভাবে আশা করি, সেসব দিকের প্রতি লক্ষ্য রেখে দেশ, মাটি ও মাতৃকাকে সবাই ভালোবাসেন। আর প্রবাসীরা নিজের দেশ, মাটি ও মাতৃভূমিকে কী পরিমাণ ভালোবাসেন তা অতুলনীয় এবং তাদের দেশপ্রেম ও ভালোবাসার তুলনা করা সম্ভব নয়। সারা পৃথিবীর উন্নয়নধারার সঙ্গে বাংলাদেশ আরও উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে, তা-ই সকলের প্রত্যাশা। প্রধানমন্ত্রীকে নিউইয়র্কে সুস্বাগত।
লেখক : কবি ও কলামিস্ট