আমিনুর রশীদ পিন্টু
‘কবির মৃত্যু আছে। কবিব্যক্তিত্ব এবং তাঁর সৃষ্টির মৃত্যু কিন্তু নেই। যতোদিন সুধা ও সৌন্দর্য্যরে জগৎ আছে, ততোদিন থাকিবেন নজরুল। নয়ন সম্মুখে না থাকিলেও তিনি থাকিবেন আমাদের নয়নের মাঝে।’ দৈনিক ইত্তেফাক : সম্পাদকীয়/৩০ আগস্ট, ১৯৭৬
সময়টা ১৯৯০। নজরুল সঙ্গীতের বিশিষ্ট শিল্পী প্রয়াত ফিরোজা বেগম এসেছিলেন নিউজার্সিতে। এসেছিলেন উত্তর আমেরিকার প্রথম নজরুল সম্মেলনে প্রধান অতিথি হয়ে। একান্ত আলাপচারিতার কবি প্রসঙ্গে কিছু আলোচনা করি। কিন্তু প্রশ্ন করি। এক সময়ে ছলছল চোখে বললেন- ‘ভাবতে খুব কষ্ট হয়, যে কবির গান গেয়ে আমরা আজ অর্থ উপার্জন করছি- সেই বাংলার বুলবুল যুগস্রষ্টা কবি নজরুল একদিন দারুণ অর্থাভাবে দিন কাটিযেছেন। দূর্বিসহ ছিল কবির শেষ জীবন।’
এমনি স্মৃতিচারণ করেছেন কিংবদন্তী সঙ্গীতশিল্প গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। একবার কবির বড় ছেলে কাজী সব্যসাচীর অনুরোধে তিনি কবিকে দেখতে এসেছিলেন। সন্ধ্যা সেদিন দেখেছিলেন নজরুলের অসাধাণ দুটি চোখ- যা ছিল একদিন তেজস্বীয়তায় ভরপুর- আজ তা নির্লিপ্ত। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় লিখেছেন- ‘আমি শুধু ভাবছিলাম, ঈশ্বর মানুষটাকে কেন এমন করে দিলেন? যিনি অসহায় ও দুর্বল মানুষের মনের কথা আমাদের শুনিয়েছেন, যাঁর তেজোদীপ্ত ভাষা প্রতি মুহূর্তে আমাদের ভাবায়- আজ তিনি বাক্হীন, কতো অসহায়?
কেনো এই অসহায়ত্ব? কবির জীবনে সহসা এমন কী ঘটে গেলো- যার ফলে নেমে এলো এই দুর্যোগ? এই বিষয় নিয়ে অনেকে লিখেছেন। তাঁদের সুচিন্তিত মতামত দিয়েছেন। কবি নজরুলের অসুস্থতা নিয়ে Clinical Analysis অর্থাৎ রোগনির্ণয় বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রথিতযশা চিকিৎসক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইউসুফ আলী।
নজরুলের অসুস্থতা এবং চিকিৎসা প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন- ‘কবির রোগটা ছিল Alzheimer’s Disease। আলজাইসার রোগের বাংলা পরিভাষা নেই। কেউ বলছেন এটা এক ধরনের ‘চিত্তভ্রংশ’। স্মৃতিশক্তি, বাক্শক্তি, চিন্তাশক্তি, বুদ্ধিশক্তি ও মননশক্তি লোপ পাওয়াই এ রোগের বৈশিষ্ট্য।
উল্লেখ্য যে, বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ব্রেন ও নার্ভাস সিস্টেমের (মস্তিষ্ক ও স্নায়ু) এই রোগটি চিকিৎসকদের কাছে অজানাই ছিল। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে এই রোগটির প্রথম বর্ণনা দেন এক জার্মান চিকিৎসক। নাম তার Dr. Alois Alzheimer। একজন রোগীর কেনো স্মৃতিশক্তি লোপ পাচ্ছে- সেই গবেষণার ফল এই নামকরণটি। অর্থাৎ স্মৃতিভ্রংশকেই ‘আলজাইমার’ রোগ বলে চিহ্নিত করা হয়। এই রোগের ফলে মেধা, চিন্তা, বুদ্ধি-বিবেচনা ও আবেগ ইত্যাদি গুণাবলী লোপ পায়। চিত্তের অধিকাংশ উৎকর্ষ লোপ পায় বলে একে বলা হয়ে থাকে- ‘চিত্তভ্রংশ’ (Dementia)। সাধারণ পৌঢ়ত্বের শেষে অথবা বার্ধ্যক্যের শুরুতে এই রোগটি ধরা পড়ে।
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী স্নায়ুবিদরা এই রোগের নিরাময় নিয়ে গবেষণা করেছেন। প্রতিদিনই নতুন নতুন ওষুধ আবিষ্কৃত হচ্ছে। কিন্তু কবি নজরুলের মাত্র ৪৩ বছর বয়সে রোগক্রান্ত হওয়াটা একটু ভেবে দেখার বিষয়। আদরের পুত্র বুলবুলের মৃত্যু ও পত্নী প্রমীলা দেবীর পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হওয়াটাও কবিকে অত্যন্ত দুর্দশাগ্রস্ত করে তুলেছিল। প্রকারান্তরে একটা হতাশারও জন্ম নিয়েছিল। তদুপরি তিনি ঝুঁকে পরলেন সাধনার পথে। যে পথটি সবার জন্য নয়। এই কারণগুলি কবির স্নায়ুশক্তি ও মেধাকে পর্যুদস্ত করার জন্য যথেষ্ট ছিল।
এর বাইরেও আরো একটি বিষয় খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। সেটা হচ্ছে স্ট্রোক (Stroke)। কবি দৈহিকভাবে অত্যন্ত মজবুত ছিলেন। বিখ্যাত শল্য চিকিৎসক ড. রাসেল ব্রেন ভিয়েনায় কবিকে পরীক্ষা করে বলেছিলেন- মেধা এবং সৃষ্টিশক্তি লোপ পাওয়া ছাড়া কবির আর কোনো জড়তা নেই। কিন্তু অলক্ষ্যে একটি ঘটনা কী ঘটে গেছে? সেই আলোচনা দিয়েই এই প্রবন্ধের ইতি টানবো।
পেশায় আমি ফার্মাসিস্ট। সবাই জানেন, উত্তর আমেরিকাতে যারা Medical Profession-এর সাথে জড়িত, তাদের Continue Education খুব প্রযোজন। অর্থাৎ সেবাধর্মের পাশাপাশি আরো কিছু বিদ্যা-শিক্ষা জানতে হবে। এমনি একটা সেমিনারে জানলাম- ‘যদি মস্তিষ্কে অতীতের কোনো আঘাত বা Clot থাকে, তবে সেখান থেকেও আলজাইমার হতে পারে। Clot মানে হলো- রক্ত জমে থাকা। অনেক সময়ে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ থেকেও এই Clot হতে পারে। ডাক্তারি মতে এটাকে বলা হয়ে থাকে C.V.A. (Cerebral Vascular Accident)। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের চিকিৎসা যথা সময়ে না হলে, এটা রক্ত চলাচলে বাধা স্বরূপ হয়ে দাঁড়ায় পরবর্তীকালে। যাকে বলা হয় Stroke।
স্মরণ করিয়ে দিই- কবি নজরুল তখন ঢাকায়। স্বনামধন্য লেখক ও কবি বুদ্ধদেব বসুর স্ত্রী প্রতিভা বসুকে গান শিখিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন কবি নজরুল। (অবশ্য প্রতিভা বসু তখনো বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হননি।) রাত হয়েছিল অনেক। পথে একদল যুবক তাঁকে ঘিরে ফেলে এবং মাথায় আঘাত করে। যদিও সেদিন মল্লযুদ্ধে কবির জয় হয়েছিল, কিন্তু মাথার আঘাতটা ছিল অত্যন্ত তীব্র। কিন্তু কবি নজরুলের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ ছিল না। মাথাব্যথা নিয়ে কোনো ডাক্তারের পরামর্শ নেননি। তাছাড়া কবি ছিলেন চিরাচরিত খামখেয়ালী। অবশ্য সেই সময়ে CAT Scan বা MRI ইত্যাদি রোগ নির্ণয়ের কোন উপাদানও ছিল না। এই আঘাতটিই কী পরবর্তীকালে Stroke-এ রূপান্তরিত হয়েছিল? সেটা গবেষণার বিষয়।
কিন্তু সেমিনারে যে ডাক্তার সাহেব এসেছিলেন, তিনি দৃঢ়মত পোষণ করলেন- ‘হতে পারে’। সুতরাং আলজাইমার শুধু বার্ধক্যজনিত রোগ নয়। এর সাথে প্রাসঙ্গিক আরো কিছু বিষয় রয়ে গেছে।
এই থিউরির সাথে আপনারা সহমত নাও হতে পারেন। তবে একটা বিষয় সত্য- তিনি ছিলেন একজন যথার্থ প্রতিভাবান কবি। ছিলেন পরিশ্রমী শিল্পী। কবিতার ভাষায়- একজন কবি পাথর ভেঙে ভেঙে শিল্পময় একটি ছন্দ আর সুরের মোহাবেশ সৃষ্টি করেন। এখানে অন্তরের পাশাপাশি মস্তিষ্কেরও ব্যবহার রযেছে প্রচুর। কিন্তু যখন মানসিক দুর্যোগ দেখা দেয়, তখন কঠিন ও নিষ্ঠু বাস্তবতার সংগ্রামে এই প্রতিভাশক্তি ধীরে ধীরে ম্লান হতে থাকে। চিকিৎসা-বিজ্ঞান তা-ই বলে।
কবির জীবনে যে কষ্ট, যে ব্যথা, সেটা তিনি আড়াল করে রেখেছিলেন ঠিকই, কিন্তু একদিন সেটা রূপ নেয় দারুণ ট্র্যাজেডিতে। থাকে উৎরে যাবার ক্ষমতা তাঁর ছিল না। তবুও বলি- কবি নজরুল সৃষ্টিময়তায় একজন অবিশ্বাস্য যোদ্ধা এবং নাবিক। শেষ পর্যন্ত তীরে ভীড়তে পারেননি, কিন্তু আকাশ, বাতাস ও সাগরকে মন্দ্রিত করেছেন ‘জাগো অনশন বন্দী’ আর ‘কান্ডারী হুঁশিয়ার’ এই গান গেয়ে। দিয়েছেন অবারিত ভালোবাসা এবং ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন- ‘যেদিন আমি হারিয়ে যাবো বুঝবে সেদিন বুঝবে?’
যুগস্রষ্টা কবি নজরুল সেখানেই বিজয়ী বীর সর্বকালের এবং সর্বযুগের। তিনি কোথাও নীরব হয়ে যাননি। তিনি মানবতার কবি। মানবধর্মে দীক্ষিত যিনি- তিনি সর্বকালের, তিনি সর্বযুগের।
‘কবির মৃত্যু আছে। কবিব্যক্তিত্ব এবং তাঁর সৃষ্টির মৃত্যু কিন্তু নেই। যতোদিন সুধা ও সৌন্দর্য্যরে জগৎ আছে, ততোদিন থাকিবেন নজরুল। নয়ন সম্মুখে না থাকিলেও তিনি থাকিবেন আমাদের নয়নের মাঝে।’ দৈনিক ইত্তেফাক : সম্পাদকীয়/৩০ আগস্ট, ১৯৭৬
সময়টা ১৯৯০। নজরুল সঙ্গীতের বিশিষ্ট শিল্পী প্রয়াত ফিরোজা বেগম এসেছিলেন নিউজার্সিতে। এসেছিলেন উত্তর আমেরিকার প্রথম নজরুল সম্মেলনে প্রধান অতিথি হয়ে। একান্ত আলাপচারিতার কবি প্রসঙ্গে কিছু আলোচনা করি। কিন্তু প্রশ্ন করি। এক সময়ে ছলছল চোখে বললেন- ‘ভাবতে খুব কষ্ট হয়, যে কবির গান গেয়ে আমরা আজ অর্থ উপার্জন করছি- সেই বাংলার বুলবুল যুগস্রষ্টা কবি নজরুল একদিন দারুণ অর্থাভাবে দিন কাটিযেছেন। দূর্বিসহ ছিল কবির শেষ জীবন।’
এমনি স্মৃতিচারণ করেছেন কিংবদন্তী সঙ্গীতশিল্প গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। একবার কবির বড় ছেলে কাজী সব্যসাচীর অনুরোধে তিনি কবিকে দেখতে এসেছিলেন। সন্ধ্যা সেদিন দেখেছিলেন নজরুলের অসাধাণ দুটি চোখ- যা ছিল একদিন তেজস্বীয়তায় ভরপুর- আজ তা নির্লিপ্ত। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় লিখেছেন- ‘আমি শুধু ভাবছিলাম, ঈশ্বর মানুষটাকে কেন এমন করে দিলেন? যিনি অসহায় ও দুর্বল মানুষের মনের কথা আমাদের শুনিয়েছেন, যাঁর তেজোদীপ্ত ভাষা প্রতি মুহূর্তে আমাদের ভাবায়- আজ তিনি বাক্হীন, কতো অসহায়?
কেনো এই অসহায়ত্ব? কবির জীবনে সহসা এমন কী ঘটে গেলো- যার ফলে নেমে এলো এই দুর্যোগ? এই বিষয় নিয়ে অনেকে লিখেছেন। তাঁদের সুচিন্তিত মতামত দিয়েছেন। কবি নজরুলের অসুস্থতা নিয়ে Clinical Analysis অর্থাৎ রোগনির্ণয় বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রথিতযশা চিকিৎসক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইউসুফ আলী।
নজরুলের অসুস্থতা এবং চিকিৎসা প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন- ‘কবির রোগটা ছিল Alzheimer’s Disease। আলজাইসার রোগের বাংলা পরিভাষা নেই। কেউ বলছেন এটা এক ধরনের ‘চিত্তভ্রংশ’। স্মৃতিশক্তি, বাক্শক্তি, চিন্তাশক্তি, বুদ্ধিশক্তি ও মননশক্তি লোপ পাওয়াই এ রোগের বৈশিষ্ট্য।
উল্লেখ্য যে, বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ব্রেন ও নার্ভাস সিস্টেমের (মস্তিষ্ক ও স্নায়ু) এই রোগটি চিকিৎসকদের কাছে অজানাই ছিল। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে এই রোগটির প্রথম বর্ণনা দেন এক জার্মান চিকিৎসক। নাম তার Dr. Alois Alzheimer। একজন রোগীর কেনো স্মৃতিশক্তি লোপ পাচ্ছে- সেই গবেষণার ফল এই নামকরণটি। অর্থাৎ স্মৃতিভ্রংশকেই ‘আলজাইমার’ রোগ বলে চিহ্নিত করা হয়। এই রোগের ফলে মেধা, চিন্তা, বুদ্ধি-বিবেচনা ও আবেগ ইত্যাদি গুণাবলী লোপ পায়। চিত্তের অধিকাংশ উৎকর্ষ লোপ পায় বলে একে বলা হয়ে থাকে- ‘চিত্তভ্রংশ’ (Dementia)। সাধারণ পৌঢ়ত্বের শেষে অথবা বার্ধ্যক্যের শুরুতে এই রোগটি ধরা পড়ে।
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী স্নায়ুবিদরা এই রোগের নিরাময় নিয়ে গবেষণা করেছেন। প্রতিদিনই নতুন নতুন ওষুধ আবিষ্কৃত হচ্ছে। কিন্তু কবি নজরুলের মাত্র ৪৩ বছর বয়সে রোগক্রান্ত হওয়াটা একটু ভেবে দেখার বিষয়। আদরের পুত্র বুলবুলের মৃত্যু ও পত্নী প্রমীলা দেবীর পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হওয়াটাও কবিকে অত্যন্ত দুর্দশাগ্রস্ত করে তুলেছিল। প্রকারান্তরে একটা হতাশারও জন্ম নিয়েছিল। তদুপরি তিনি ঝুঁকে পরলেন সাধনার পথে। যে পথটি সবার জন্য নয়। এই কারণগুলি কবির স্নায়ুশক্তি ও মেধাকে পর্যুদস্ত করার জন্য যথেষ্ট ছিল।
এর বাইরেও আরো একটি বিষয় খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। সেটা হচ্ছে স্ট্রোক (Stroke)। কবি দৈহিকভাবে অত্যন্ত মজবুত ছিলেন। বিখ্যাত শল্য চিকিৎসক ড. রাসেল ব্রেন ভিয়েনায় কবিকে পরীক্ষা করে বলেছিলেন- মেধা এবং সৃষ্টিশক্তি লোপ পাওয়া ছাড়া কবির আর কোনো জড়তা নেই। কিন্তু অলক্ষ্যে একটি ঘটনা কী ঘটে গেছে? সেই আলোচনা দিয়েই এই প্রবন্ধের ইতি টানবো।
পেশায় আমি ফার্মাসিস্ট। সবাই জানেন, উত্তর আমেরিকাতে যারা Medical Profession-এর সাথে জড়িত, তাদের Continue Education খুব প্রযোজন। অর্থাৎ সেবাধর্মের পাশাপাশি আরো কিছু বিদ্যা-শিক্ষা জানতে হবে। এমনি একটা সেমিনারে জানলাম- ‘যদি মস্তিষ্কে অতীতের কোনো আঘাত বা Clot থাকে, তবে সেখান থেকেও আলজাইমার হতে পারে। Clot মানে হলো- রক্ত জমে থাকা। অনেক সময়ে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ থেকেও এই Clot হতে পারে। ডাক্তারি মতে এটাকে বলা হয়ে থাকে C.V.A. (Cerebral Vascular Accident)। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের চিকিৎসা যথা সময়ে না হলে, এটা রক্ত চলাচলে বাধা স্বরূপ হয়ে দাঁড়ায় পরবর্তীকালে। যাকে বলা হয় Stroke।
স্মরণ করিয়ে দিই- কবি নজরুল তখন ঢাকায়। স্বনামধন্য লেখক ও কবি বুদ্ধদেব বসুর স্ত্রী প্রতিভা বসুকে গান শিখিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন কবি নজরুল। (অবশ্য প্রতিভা বসু তখনো বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হননি।) রাত হয়েছিল অনেক। পথে একদল যুবক তাঁকে ঘিরে ফেলে এবং মাথায় আঘাত করে। যদিও সেদিন মল্লযুদ্ধে কবির জয় হয়েছিল, কিন্তু মাথার আঘাতটা ছিল অত্যন্ত তীব্র। কিন্তু কবি নজরুলের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ ছিল না। মাথাব্যথা নিয়ে কোনো ডাক্তারের পরামর্শ নেননি। তাছাড়া কবি ছিলেন চিরাচরিত খামখেয়ালী। অবশ্য সেই সময়ে CAT Scan বা MRI ইত্যাদি রোগ নির্ণয়ের কোন উপাদানও ছিল না। এই আঘাতটিই কী পরবর্তীকালে Stroke-এ রূপান্তরিত হয়েছিল? সেটা গবেষণার বিষয়।
কিন্তু সেমিনারে যে ডাক্তার সাহেব এসেছিলেন, তিনি দৃঢ়মত পোষণ করলেন- ‘হতে পারে’। সুতরাং আলজাইমার শুধু বার্ধক্যজনিত রোগ নয়। এর সাথে প্রাসঙ্গিক আরো কিছু বিষয় রয়ে গেছে।
এই থিউরির সাথে আপনারা সহমত নাও হতে পারেন। তবে একটা বিষয় সত্য- তিনি ছিলেন একজন যথার্থ প্রতিভাবান কবি। ছিলেন পরিশ্রমী শিল্পী। কবিতার ভাষায়- একজন কবি পাথর ভেঙে ভেঙে শিল্পময় একটি ছন্দ আর সুরের মোহাবেশ সৃষ্টি করেন। এখানে অন্তরের পাশাপাশি মস্তিষ্কেরও ব্যবহার রযেছে প্রচুর। কিন্তু যখন মানসিক দুর্যোগ দেখা দেয়, তখন কঠিন ও নিষ্ঠু বাস্তবতার সংগ্রামে এই প্রতিভাশক্তি ধীরে ধীরে ম্লান হতে থাকে। চিকিৎসা-বিজ্ঞান তা-ই বলে।
কবির জীবনে যে কষ্ট, যে ব্যথা, সেটা তিনি আড়াল করে রেখেছিলেন ঠিকই, কিন্তু একদিন সেটা রূপ নেয় দারুণ ট্র্যাজেডিতে। থাকে উৎরে যাবার ক্ষমতা তাঁর ছিল না। তবুও বলি- কবি নজরুল সৃষ্টিময়তায় একজন অবিশ্বাস্য যোদ্ধা এবং নাবিক। শেষ পর্যন্ত তীরে ভীড়তে পারেননি, কিন্তু আকাশ, বাতাস ও সাগরকে মন্দ্রিত করেছেন ‘জাগো অনশন বন্দী’ আর ‘কান্ডারী হুঁশিয়ার’ এই গান গেয়ে। দিয়েছেন অবারিত ভালোবাসা এবং ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন- ‘যেদিন আমি হারিয়ে যাবো বুঝবে সেদিন বুঝবে?’
যুগস্রষ্টা কবি নজরুল সেখানেই বিজয়ী বীর সর্বকালের এবং সর্বযুগের। তিনি কোথাও নীরব হয়ে যাননি। তিনি মানবতার কবি। মানবধর্মে দীক্ষিত যিনি- তিনি সর্বকালের, তিনি সর্বযুগের।