লিটু আনাম
আমরা সবাই কমবেশি ভ্রমণপিয়াসী। ভ্রমণপিয়াসীদের আবার দুই গ্রুপ। কারও পছন্দ পাহাড় আবার কারও পছন্দ সমুদ্র। আমিও ঘুরতে পছন্দ করি জেনে অনেকেই এই প্রশ্ন করেন, আমাকে কিসে টানে? পাহাড় নাকি সমুদ্র? আমি সোজাসাপটা বলে দিই পাহাড়। কিন্তু এমন কিছু অভিজ্ঞতা আছে, যা এসব পাহাড় সমুদ্রের পার্থক্যকে ছাপিয়ে যায়। তেমনই একটি হলো আটলান্টিকের মাঝে গিয়ে তিমি দেখার অভিজ্ঞতা।
প্রবাসী আমেরিকান বাঙালিদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক গ্রুপ রয়েছে, যেখানে প্রায়ই অনেকে জানতে চান এক দিনের জন্য নিউইয়র্কের কাছাকাছি কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায়। অনেকে অনেক পরামর্শ দিয়ে থাকেন। হাইকিং, স্কাই ডাইভিং কিংবা রাফটিং আবার সকলের জন্য না। বুকে সাহস, মনে বল, অদম্য ইচ্ছা, সুস্থ শরীর না হলে আর এগুলো সম্ভবও নয়। কিন্তু পরিবার-পরিজন নিয়ে সুন্দর একটি দিন কাটানোর জন্য কোথায় যাওয়া যায়? নিউইয়র্কের আশপাশে যত পার্ক, সমুদ্র কিংবা পাহাড় আছে, কমবেশি সব দেখা হয়ে গেছে। আর ঘুরেফিরে সবই যেন এক। তবে পরিবার, সন্তানকে যদি নতুন কোনো অভিজ্ঞতা উপহার দিতে চান, আপনার জন্য তো বটেই, তাহলে পুরো এক দিনের ছুটিতে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণী তিমি দেখে আসুন। কথা দিচ্ছি, যদি আপনি এর আগে তিমি না দেখে থাকেন, তাহলে এমন অভিজ্ঞতা আপনার জীবনে আসেনি কিংবা এলেও দিনটি হবে অন্যতম। বাচ্চাদের জন্য হবে চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা।
১৯৫০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে তিমি দর্শন পর্যটনের একটি বড় অংশ হয়ে ওঠে। তখন নাবিকদের উদ্যোগে ক্যালিফোর্নিয়ার সান দিয়াগোতে প্রথমে এক ডলার খরচে গভীর সমুদ্রে গিয়ে তিমি দেখার ব্যবস্থা চালু হয়েছিল। এখন তো এটি শত শত কোটি ডলারের ব্যবসা। এই তিমি দর্শন এখন আমেরিকার পূর্ব ও পশ্চিমের রাজ্যগুলোর পর্যটনের বড় অংশ। বোস্টন, নিউ হ্যাম্পশায়ারসহ নানা জায়গায় তিমি দর্শনের জন্য বিভিন্ন সংস্থা গড়ে উঠেছে। এমনকি ম্যাসাচুসেটসের প্রভিন্সটাউন পর্যটন শহর হিসেবে গড়ে উঠেছে এই তিমি দর্শনে পর্যটকদের আনাগোনা থেকেই। এখান থেকে স্বল্প দূরত্বের আরেকটি দ্বীপ নাউটিকাটে তিমির পূর্ণাঙ্গ একটি জাদুঘর আছে। সেখানে কয়েক দশক আগে শিকার করা একটি বিশাল তিমির কঙ্কাল প্রদর্শনীর জন্য সাজিয়ে রাখা আছে। না আমি জাদুঘর দেখিনি। জাদুঘর নাম শুনলেই লন্ডন মিউজিয়ামের কথা মনে পড়ে, যেটা পুরো দুনিয়া লুটপাট করে সাজানো হয়েছে। বেশির ভাগই আমাদের পূর্বপুরুষের মানে ভারতবর্ষ থেকে লুট করে আনা।
আগেই বলেছি, তিমি দেখতে চাইলে আপনাকে পুরো দিনটাই ধার্য করতে হবে। নিউইয়র্ক থেকে প্রায় ২৫০ মাইল দুরে ম্যাসাচুসেট স্টেটের কেপ কড শহরের গড়ে উঠেছে তিমি দেখাকে কেন্দ্র করে বিশাল পর্যটনকেন্দ্র। এখানে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান রয়েছে। গুগলে রিভিউ দেখে সময় মিলিয়ে আগে থেকেই অনলাইনে টিকিট কেটে যথাসময়ে যেতে হবে। সাধারণত প্রতিদিন দুটি ক্রুজ ট্রিপ থাকে। প্রথমটি সকাল নয়টা থেকে সাড়ে নয়টার দিকে, অন্যটি বেলা আড়াইটা থেকে তিনটার দিকে। নিউইয়র্ক থেকে চার ঘণ্টা ড্রাইভ করে সকালের ট্রিপ ধরা সম্ভব নয়। তাই আমি বিকেলের টিকিট কাটলাম। টিকিট ৭৫ ডলার করে। অনলাইনে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করে হাইয়ানিজ হোয়েল ওয়াচিং ক্রুজ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে গিয়ে টিকিট করলাম আমাদের তিনজনের। সঙ্গে দুজন বন্ধু জুটে গিয়েছিল। একা একা এতটা পথ ড্রাইভ করা বোরিং হয়ে যাবে। আর আমিও দলবল নিয়ে ঘুরতেই পছন্দ করি। ছাত্ররাজনীতি করার সময়ের দলবল নিয়ে শোডাউন দেওয়ার অভ্যাস রয়ে গেছে মনে হয়।
নিউইয়র্ক সিটি থেকে বের হয়ে আই ৯৫ ধরে ৬০ মাইল, তারপর আই ১৯৫ ধরে ১০০ মাইল যাওয়ার পর বাকিটা পথ নির্ভর করবে ট্রাফিকের ওপর। লোকাল কিংবা হাইওয়ে ধরে সময়ের ঠিক দুই মিনিট আগে আমরা পৌঁছালাম। ট্রাফিকের কারণে পাঁচ ঘণ্টা লেগে গেল। ঘাটে পৌঁছে আমরা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। এত দিনের প্ল্যান দুই মিনিটেই ভেস্তে যেতে বসেছিল। ঘাটের সঙ্গেই পার্কিং সুবিধা রয়েছে তাদের, যদিও সেটা ফ্রি নয়। আমরা পার্ক করেই সোজা দৌড়ে ক্রুজে উঠে পড়লাম। বাকিটা আমার জীবনের সেরা মুহূর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম।
সাধারণত মে মাসের মাঝামাঝি থেকে তিমি দেখার মৌসুম শুরু হয় কেপ কডে এবং শেষ হয় অক্টোবরের শেষে। এই সময়ের মধ্যে রৌদ্র ঝলমল পরিষ্কার আবহাওয়ার যেকোনো দিনই তিমি দেখার জন্য ভালো সময়। এখানে আপনি দেখতে পাবেন যঁসঢ়নধপশ যিধষবং, ভরহনধপশ যিধষবং, ঢ়রষড়ঃ যিধষবং, সরহশব যিধষবং, ধহফ ৎরমযঃ যিধষবং. ভাগ্য ভালো হলে সামুদ্রিক ডলফিন কিংবা শিল মাছের দেখাও পেতে পারেন। না, আমার ভাগ্য এতটা ভালো কোনোকালেই ছিল না। ঘাট থেকে ৩০-৪৫ মিনিট লাগে আটলান্টিকের মাঝে যেতে, যেখানে তিমির দেখা পাওয়া যায়। প্রতিনিয়ত নাবিক মাইকে সবকিছুর বর্ণনা করছিল। তিমিরা সাধারণত দল বেঁধে চলতেই এখানে দেখা যায়। প্রথম তিমির দেখা পেতে আমাদের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হলো না। হঠাৎ নাবিক চিৎকার করে বলে উঠল ডান দিকে দেখতে। আমরা দেখলাম পানির ফোয়ারার মতো কিছু। তিমি যখন নিঃশ্বাস ছাড়ে, তখন সে তার মাথার ওপরের দুই ছিদ্র দিয়ে পানি ফোয়ারার মতো করে ছুড়ে দেয়, যা ৩০ ফুট পর্যন্ত উপরে ওঠে। ওর মাথার ওপরের এই ছিদ্র এত বড় যে, একটি ডলফিন সেখানে প্রবেশ করতে পারবে অনায়াসে। তার পরই বিশাল আকৃতির তিমির পিঠের অংশ ভেসে উঠল। এর পরপরই ক্রুজের অন্য পাশে দুটি তিমি একসঙ্গে তাদের ডানায় বাড়ি দিচ্ছে। আমাদের শিপ যত গভীরে যেতে লাগল, তিমির সংখ্যা তত বাড়তে লাগল। একবার আমাদের জাহাজের খুব কাছে একটি তিমি লেজ বাড়ি দিয়ে হারিয়ে গেল।
আমার কাছে মনে হলো তিমিগুলো বুঝতে পেরেছে যে আমরা মেহমান এসেছি তাদের সঙ্গে দেখা করতে। তারাও আমাদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছে কোনোটা পানির ফোয়ারা দিয়ে, কোনোটা ডানা ঝাপটা দিয়ে আবার কোনোটা লেজ তুলে। একটা তিমি তো দীর্ঘ সময় আমাদের সঙ্গে ভেসে রইল। আশ্চর্যের বিষয় হলো প্রতিটি তিমির আবার মানুষের মতো নাম আছে। যখন যে তিমি আমাদের হ্যালো বলতে এল, নাবিক তার নাম বলতে লাগল। আমি এতটাই উপভোগ করছিলাম সময়টা যে নামগুলো মনে রাখতে পারিনি। বিষয়টা অনেকটা আমাদের সুন্দরবনের হরিণের মতো। আমি যখন সুন্দরবন ভ্রমণে গিয়েছিলাম, তখন বন বিভাগের লোকেরা আমাদের বসিয়ে শাবানা, ববিতা, জসীম বলে ডাকতে লাগল।
কিছুক্ষণ পর দেখি কয়েকটি হরিণ এসে হাজির। তখন বন বিভাগের লোক পরিচয় করিয়ে দিল এটা শাবানা, এটা ববিতা, এমন অনেক নায়ক-নায়িকার নামে নাম। এভাবে কখন যে এক ঘণ্টা কেটে গেল, কেউ টের পেলাম না। হঠাৎ দেখি নাবিক ক্রুজ উল্টো দিকে ঘুরিয়েছে। আর বলছে যে এখন আমরা ফিরে যাব। সবাই তিমিদের বিদায় জানাই। আমরা সবাই চিৎকার করে তিমিদের বিদায় জানালাম। এই এক ঘণ্টায় আমরা ১৫-২০টা তিমি দেখেছি। এত কাছ থেকে তিমি দেখার এমন সৌভাগ্য কজনের হয়!
ক্রুজ ছাড়ার পর থেকে দুই ঘণ্টা পর আবার ঘাটে ফিরে এলাম ঠিক পাঁচটায়। তারপর একরাশ ভালো লাগা এবং মুগ্ধতা নিয়ে আবার গাড়ি স্টার্ট দিলাম। রাত ১১টায় আমরা নিউইয়র্কে ফিরলাম। আমি কেপ কড থেকে এসেছি মাসখানেক হলো কিন্তু সবকিছু যেন আজও চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। কেউ যদি একটি নিরাপদ, ঝুঁকিমুক্ত এবং রোমাঞ্চকর এক দিনের কোনো পরামর্শ চান, তাদের জন্য আমার প্রথম পরামর্শ ম্যাসাচুসেটসের কেপ কডে তিমি দেখে আসুন।
আমরা সবাই কমবেশি ভ্রমণপিয়াসী। ভ্রমণপিয়াসীদের আবার দুই গ্রুপ। কারও পছন্দ পাহাড় আবার কারও পছন্দ সমুদ্র। আমিও ঘুরতে পছন্দ করি জেনে অনেকেই এই প্রশ্ন করেন, আমাকে কিসে টানে? পাহাড় নাকি সমুদ্র? আমি সোজাসাপটা বলে দিই পাহাড়। কিন্তু এমন কিছু অভিজ্ঞতা আছে, যা এসব পাহাড় সমুদ্রের পার্থক্যকে ছাপিয়ে যায়। তেমনই একটি হলো আটলান্টিকের মাঝে গিয়ে তিমি দেখার অভিজ্ঞতা।
প্রবাসী আমেরিকান বাঙালিদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক গ্রুপ রয়েছে, যেখানে প্রায়ই অনেকে জানতে চান এক দিনের জন্য নিউইয়র্কের কাছাকাছি কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায়। অনেকে অনেক পরামর্শ দিয়ে থাকেন। হাইকিং, স্কাই ডাইভিং কিংবা রাফটিং আবার সকলের জন্য না। বুকে সাহস, মনে বল, অদম্য ইচ্ছা, সুস্থ শরীর না হলে আর এগুলো সম্ভবও নয়। কিন্তু পরিবার-পরিজন নিয়ে সুন্দর একটি দিন কাটানোর জন্য কোথায় যাওয়া যায়? নিউইয়র্কের আশপাশে যত পার্ক, সমুদ্র কিংবা পাহাড় আছে, কমবেশি সব দেখা হয়ে গেছে। আর ঘুরেফিরে সবই যেন এক। তবে পরিবার, সন্তানকে যদি নতুন কোনো অভিজ্ঞতা উপহার দিতে চান, আপনার জন্য তো বটেই, তাহলে পুরো এক দিনের ছুটিতে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণী তিমি দেখে আসুন। কথা দিচ্ছি, যদি আপনি এর আগে তিমি না দেখে থাকেন, তাহলে এমন অভিজ্ঞতা আপনার জীবনে আসেনি কিংবা এলেও দিনটি হবে অন্যতম। বাচ্চাদের জন্য হবে চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা।
১৯৫০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে তিমি দর্শন পর্যটনের একটি বড় অংশ হয়ে ওঠে। তখন নাবিকদের উদ্যোগে ক্যালিফোর্নিয়ার সান দিয়াগোতে প্রথমে এক ডলার খরচে গভীর সমুদ্রে গিয়ে তিমি দেখার ব্যবস্থা চালু হয়েছিল। এখন তো এটি শত শত কোটি ডলারের ব্যবসা। এই তিমি দর্শন এখন আমেরিকার পূর্ব ও পশ্চিমের রাজ্যগুলোর পর্যটনের বড় অংশ। বোস্টন, নিউ হ্যাম্পশায়ারসহ নানা জায়গায় তিমি দর্শনের জন্য বিভিন্ন সংস্থা গড়ে উঠেছে। এমনকি ম্যাসাচুসেটসের প্রভিন্সটাউন পর্যটন শহর হিসেবে গড়ে উঠেছে এই তিমি দর্শনে পর্যটকদের আনাগোনা থেকেই। এখান থেকে স্বল্প দূরত্বের আরেকটি দ্বীপ নাউটিকাটে তিমির পূর্ণাঙ্গ একটি জাদুঘর আছে। সেখানে কয়েক দশক আগে শিকার করা একটি বিশাল তিমির কঙ্কাল প্রদর্শনীর জন্য সাজিয়ে রাখা আছে। না আমি জাদুঘর দেখিনি। জাদুঘর নাম শুনলেই লন্ডন মিউজিয়ামের কথা মনে পড়ে, যেটা পুরো দুনিয়া লুটপাট করে সাজানো হয়েছে। বেশির ভাগই আমাদের পূর্বপুরুষের মানে ভারতবর্ষ থেকে লুট করে আনা।
আগেই বলেছি, তিমি দেখতে চাইলে আপনাকে পুরো দিনটাই ধার্য করতে হবে। নিউইয়র্ক থেকে প্রায় ২৫০ মাইল দুরে ম্যাসাচুসেট স্টেটের কেপ কড শহরের গড়ে উঠেছে তিমি দেখাকে কেন্দ্র করে বিশাল পর্যটনকেন্দ্র। এখানে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান রয়েছে। গুগলে রিভিউ দেখে সময় মিলিয়ে আগে থেকেই অনলাইনে টিকিট কেটে যথাসময়ে যেতে হবে। সাধারণত প্রতিদিন দুটি ক্রুজ ট্রিপ থাকে। প্রথমটি সকাল নয়টা থেকে সাড়ে নয়টার দিকে, অন্যটি বেলা আড়াইটা থেকে তিনটার দিকে। নিউইয়র্ক থেকে চার ঘণ্টা ড্রাইভ করে সকালের ট্রিপ ধরা সম্ভব নয়। তাই আমি বিকেলের টিকিট কাটলাম। টিকিট ৭৫ ডলার করে। অনলাইনে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করে হাইয়ানিজ হোয়েল ওয়াচিং ক্রুজ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে গিয়ে টিকিট করলাম আমাদের তিনজনের। সঙ্গে দুজন বন্ধু জুটে গিয়েছিল। একা একা এতটা পথ ড্রাইভ করা বোরিং হয়ে যাবে। আর আমিও দলবল নিয়ে ঘুরতেই পছন্দ করি। ছাত্ররাজনীতি করার সময়ের দলবল নিয়ে শোডাউন দেওয়ার অভ্যাস রয়ে গেছে মনে হয়।
নিউইয়র্ক সিটি থেকে বের হয়ে আই ৯৫ ধরে ৬০ মাইল, তারপর আই ১৯৫ ধরে ১০০ মাইল যাওয়ার পর বাকিটা পথ নির্ভর করবে ট্রাফিকের ওপর। লোকাল কিংবা হাইওয়ে ধরে সময়ের ঠিক দুই মিনিট আগে আমরা পৌঁছালাম। ট্রাফিকের কারণে পাঁচ ঘণ্টা লেগে গেল। ঘাটে পৌঁছে আমরা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। এত দিনের প্ল্যান দুই মিনিটেই ভেস্তে যেতে বসেছিল। ঘাটের সঙ্গেই পার্কিং সুবিধা রয়েছে তাদের, যদিও সেটা ফ্রি নয়। আমরা পার্ক করেই সোজা দৌড়ে ক্রুজে উঠে পড়লাম। বাকিটা আমার জীবনের সেরা মুহূর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম।
সাধারণত মে মাসের মাঝামাঝি থেকে তিমি দেখার মৌসুম শুরু হয় কেপ কডে এবং শেষ হয় অক্টোবরের শেষে। এই সময়ের মধ্যে রৌদ্র ঝলমল পরিষ্কার আবহাওয়ার যেকোনো দিনই তিমি দেখার জন্য ভালো সময়। এখানে আপনি দেখতে পাবেন যঁসঢ়নধপশ যিধষবং, ভরহনধপশ যিধষবং, ঢ়রষড়ঃ যিধষবং, সরহশব যিধষবং, ধহফ ৎরমযঃ যিধষবং. ভাগ্য ভালো হলে সামুদ্রিক ডলফিন কিংবা শিল মাছের দেখাও পেতে পারেন। না, আমার ভাগ্য এতটা ভালো কোনোকালেই ছিল না। ঘাট থেকে ৩০-৪৫ মিনিট লাগে আটলান্টিকের মাঝে যেতে, যেখানে তিমির দেখা পাওয়া যায়। প্রতিনিয়ত নাবিক মাইকে সবকিছুর বর্ণনা করছিল। তিমিরা সাধারণত দল বেঁধে চলতেই এখানে দেখা যায়। প্রথম তিমির দেখা পেতে আমাদের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হলো না। হঠাৎ নাবিক চিৎকার করে বলে উঠল ডান দিকে দেখতে। আমরা দেখলাম পানির ফোয়ারার মতো কিছু। তিমি যখন নিঃশ্বাস ছাড়ে, তখন সে তার মাথার ওপরের দুই ছিদ্র দিয়ে পানি ফোয়ারার মতো করে ছুড়ে দেয়, যা ৩০ ফুট পর্যন্ত উপরে ওঠে। ওর মাথার ওপরের এই ছিদ্র এত বড় যে, একটি ডলফিন সেখানে প্রবেশ করতে পারবে অনায়াসে। তার পরই বিশাল আকৃতির তিমির পিঠের অংশ ভেসে উঠল। এর পরপরই ক্রুজের অন্য পাশে দুটি তিমি একসঙ্গে তাদের ডানায় বাড়ি দিচ্ছে। আমাদের শিপ যত গভীরে যেতে লাগল, তিমির সংখ্যা তত বাড়তে লাগল। একবার আমাদের জাহাজের খুব কাছে একটি তিমি লেজ বাড়ি দিয়ে হারিয়ে গেল।
আমার কাছে মনে হলো তিমিগুলো বুঝতে পেরেছে যে আমরা মেহমান এসেছি তাদের সঙ্গে দেখা করতে। তারাও আমাদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছে কোনোটা পানির ফোয়ারা দিয়ে, কোনোটা ডানা ঝাপটা দিয়ে আবার কোনোটা লেজ তুলে। একটা তিমি তো দীর্ঘ সময় আমাদের সঙ্গে ভেসে রইল। আশ্চর্যের বিষয় হলো প্রতিটি তিমির আবার মানুষের মতো নাম আছে। যখন যে তিমি আমাদের হ্যালো বলতে এল, নাবিক তার নাম বলতে লাগল। আমি এতটাই উপভোগ করছিলাম সময়টা যে নামগুলো মনে রাখতে পারিনি। বিষয়টা অনেকটা আমাদের সুন্দরবনের হরিণের মতো। আমি যখন সুন্দরবন ভ্রমণে গিয়েছিলাম, তখন বন বিভাগের লোকেরা আমাদের বসিয়ে শাবানা, ববিতা, জসীম বলে ডাকতে লাগল।
কিছুক্ষণ পর দেখি কয়েকটি হরিণ এসে হাজির। তখন বন বিভাগের লোক পরিচয় করিয়ে দিল এটা শাবানা, এটা ববিতা, এমন অনেক নায়ক-নায়িকার নামে নাম। এভাবে কখন যে এক ঘণ্টা কেটে গেল, কেউ টের পেলাম না। হঠাৎ দেখি নাবিক ক্রুজ উল্টো দিকে ঘুরিয়েছে। আর বলছে যে এখন আমরা ফিরে যাব। সবাই তিমিদের বিদায় জানাই। আমরা সবাই চিৎকার করে তিমিদের বিদায় জানালাম। এই এক ঘণ্টায় আমরা ১৫-২০টা তিমি দেখেছি। এত কাছ থেকে তিমি দেখার এমন সৌভাগ্য কজনের হয়!
ক্রুজ ছাড়ার পর থেকে দুই ঘণ্টা পর আবার ঘাটে ফিরে এলাম ঠিক পাঁচটায়। তারপর একরাশ ভালো লাগা এবং মুগ্ধতা নিয়ে আবার গাড়ি স্টার্ট দিলাম। রাত ১১টায় আমরা নিউইয়র্কে ফিরলাম। আমি কেপ কড থেকে এসেছি মাসখানেক হলো কিন্তু সবকিছু যেন আজও চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। কেউ যদি একটি নিরাপদ, ঝুঁকিমুক্ত এবং রোমাঞ্চকর এক দিনের কোনো পরামর্শ চান, তাদের জন্য আমার প্রথম পরামর্শ ম্যাসাচুসেটসের কেপ কডে তিমি দেখে আসুন।