হারের গৌরব

প্রকাশ : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৫:৪৮ , অনলাইন ভার্সন
এস এম মোজাম্মেল হক

প্রতিটা বিষয় যাচাইয়ের বাহ্যিক ও অন্তর্নিহিত দুটি নির্ণায়ক বিদ্যমান। বাহ্যিক অবস্থাটি দৃশ্যমান হলেও অন্তর্নিহিত অবস্থাটি সব সময় দৃশ্যমান হয় না। কেবল যেসব পক্ষের সঙ্গে বিষয়টি নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত, তারাই বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারেন, বাকিরা অনুমানে কিছুটা উপলব্ধি করতে পারলেও পুরোপুরি ওয়াকিবহাল হওয়া সম্ভব নয়। তাই হারকে প্রকৃত হার বা জিতকে প্রকৃত জিত বলার অবকাশ নেই। যিনি হারেন তিনি তার দক্ষতা জানেন; যার সঙ্গে হারেন, সেও তার মানে জানে। 

যুদ্ধক্ষেত্রে সম্মুখে এগিয়ে যাওয়াকেই জয় ভাবার কারণ নেই। কখনো কখনো জেতার জন্য এক পা পিছিয়ে দু’পা এগোতে হয়। সুতরাং এক পা পেছানোকে কখনো হার বলা যায় না, বরং এটা জেতার কৌশল। তার পরও কথা থাকে, হারের জন্য প্রস্তুত না থাকলেও কখনো বিভিন্ন কারণে হারতে হয়, তবে সে কারণ যদি যুক্তিসংগত না হয়, তাহলে সে হারে অগৌরবের কিছু নেই। বরং পরবর্তী পর্যায়ে জেতার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার সময় ও সুযোগ উভয়ই অর্জনের যথেষ্ট সময় পাওয়া যায়। ফলে অধিকতর প্রস্তুত হয়ে বিজয়ের সুযোগ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। এ কারণেই হেরে গিয়ে হাল ছেড়ে দিতে নেই, বরং বহুগুণ উদ্যম নিয়ে চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হয়। যার ফলে সে নিজেকে এমন যোগ্য স্থানে উন্নীত করতে সক্ষম হয়, বর্তমানে যার সঙ্গে হেরেছে, ভবিষ্যতে তারা তার ধারেকাছেও পৌঁছাতে পারে না। এ ক্ষেত্রে দৃঢ় মনোবল এবং ঐকান্তিক প্রচেষ্টা সফলতার মূল চালিকাশক্তি।

প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা মূলত হার-জিত নির্ধারণের জন্য। কোনো বিষয়ে প্রায় সমান দক্ষ লোকজন যখন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে, তাদের মধ্যে পর্যায়ক্রমে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় স্থান দখল করে নিজ নিজ দক্ষতার স্বাক্ষর রাখেন তার মানে এই নয় যে তিনি বা তারাই এ ব্যাপারে সর্বাধিক দক্ষ বা যোগ্য। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায়, একই ধরনের ইভেন্টে সময়ান্তে যোগদান করে উত্তীর্ণ ব্যক্তিবর্গ পূর্বের অবস্থান ধরে রাখতে ব্যর্থ হন এ ক্ষেত্রে কর্মকুশলতার দিক থেকে তাকে ছোট ভাবার কোনো কারণ নেই। 

অনেকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে অতি দক্ষ হলেও তা প্রমাণের জন্য উৎসাহ বোধ করেন না। এতে তার দক্ষতা বা মর্যাদা কোনো অংশে কমে না। তার পরও সামাজিক বা প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির ব্যাপার বলতে তো কথা থেকেই যায়। তবে বর্তমানে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি নিরপেক্ষতা হারানোর কারণে এবং প্রদানকারী ও প্রাপকের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেকটা প্রভাবিত হওয়ার ফলে সাদা চোখেই সাধারণ লোকের নিকট তা অনেকটা স্পষ্ট। যখন যোগ্যতার বিচার কোনো কারণে অসম্পূর্ণ হওয়ার ফলে যোগ্য ব্যক্তি প্রাপ্য সম্মান পেতে ব্যর্থ হন এবং তার এ ব্যর্থতা যখন কর্তৃপক্ষ উপলব্ধি করে আর তা তাদের অবয়বে ফুটে ওঠে, এমন চিত্র হারের গৌরব হিসেবেই বিবেচ্য। তবু যাদের এ ব্যাপারে দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন, তাদের সচেতনতাই প্রতিকার প্রতিবিধানের জন্য খুবই আবশ্যক। অন্যথায় সমাজ থেকে যোগ্য ও হিতৈষী লোকজন হারিয়ে যাবে।

হারের কারণে কখনো হাল ছেড়ে দেওয়া যুক্তিসংগত কাজ নয়, বরং হারের কারণ নির্ণয় করে তা দূর করে নিজেকে অধিকতর যোগ্য করে তোলার মাধ্যমে হারকে হার মানানোর মাধ্যমেই নিজের যোগ্যতা প্রমাণের চেষ্টা করাই যুক্তিযুক্ত পদক্ষেপ। তা না করে যারা হারের কারণে নিজেকে গুটিয়ে নেয়, তারা সারা জীবন হারতেই থাকে। এ ক্ষেত্রে বাংলার একটি প্রবাদ অতি গুরুত্বপূর্ণ : ‘পারিব না এ কথাটি বলিও না আর, একবার না পারিলে দেখ শতবার।’ প্রবাদটি সত্যিই প্রেরণাদায়ক। যারা প্রবাদটির বক্তব্য ধারণ করে নিজেকে যোগ্য করে তোলার প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন, তারা ঠিকই একসময় হারকে হার মানাতে সক্ষম হন। হারের বিভিন্ন কারণের মধ্যে যোগ্যতার ঘাটতি যেমন একটি কারণ, পক্ষান্তরে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অনেক সময় পক্ষপাতিত্বের কারণে নিরুপায় হয়ে হারকে বরণ করে নিতে হয়। সে ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীর কিছু করার না থাকলেও দর্শক-শ্রোতাদের মনে তা ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, যা ভুক্তগোগীকে জেতার চেয়েও অধিকতর গৌরবান্বিত করে। সমাজের বিভিন্ন স্তরে যার উদাহরণ ভুরি ভুরি।

জগতে আহার-বিহারের জন্য প্রয়োজন অর্থ আর সে অর্থ উপার্জনের জন্য প্রয়োজন কর্ম। প্রতিটা কর্মের জন্যই দক্ষতা প্রয়োজন, যার কোনোটি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নির্ভর এবং কোনোটি হাতে-কলমে শেখার বিষয়। মজুরিনির্ভর কাজের বেশির ভাগই হাতে-কলমে শিখতে হয়, যার জন্য খুব বেশি শিক্ষা ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয় না। পক্ষান্তরে বেতন-নির্ভর কর্মের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়। উন্নয়নশীল দেশসমূহে পদের শ্রেণিভেদে কমশিক্ষিত থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত লোকজনের প্রয়োজন হয়। অপরপক্ষে উন্নত দেশসমূহে উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন হয়। তবে সবচেয়ে বড় কথা, এসব উন্নত দেশে কর্মসংস্থানের জন্য এখানকার প্রচলিত ভাষা জানা খুবই জরুরি। 

এখানে ভাষা বোঝা ও বলতে না পারার কারণে অন্যান্য দেশ থেকে আগত অনেক উচ্চশিক্ষিত লোকও তাদের কাক্সিক্ষত কর্মে নিয়োজিত হতে পারছেন না। ফলে অল্প বেতনে অড জব বা নিম্ন পর্যায়ের কাজকর্মে নিয়োজিত হতে বাধ্য হচ্ছেন। তবে অনেকেই প্রথমে স্বল্পকালীন সময়ে নিম্ন আয়ের কাজ করলেও দ্রুত প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ লাভ করে উচ্চ আয়ের কাজে আত্মনিয়োগ করতে সক্ষম হচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে ঐকান্তিক ইচ্ছা ও মনোবল খুবই সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এখানে অনেক উঁচু পদে কাজ করা বা রাষ্ট্রীয় নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পূর্বে অনেকেই কম মজুরিতে কাজ করেছেন, তবে তারা তাদের রিজুমিতে তা উল্লেখ করতে কখনো লজ্জাবোধ করেন না। কারণ এসব দেশের কালচারই এমন। 

অভিবাসী দেশ হওয়ার কারণে বহু দেশ থেকে বিভিন্ন বয়সের লোকজন আসার ফলে অপেক্ষাকৃত কম বয়সীদের এখানে স্কুল-কলেজে পড়ার সুবাদে আলাদা ভাষা শেখার প্রয়োজন হয় না এবং নির্দিষ্ট বয়স থেকে অর্থ উপার্জনকারী কাজের অনুমতি থাকায় পড়ালেখার পাশাপাশি কর্মে আত্মনিয়োগ করে অর্থ উপার্জনসহ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে কাক্সিক্ষত কর্মে আত্মনিয়োগের পূর্বেই বিভিন্ন পর্যায়ের প্রশিক্ষণ লাভ হয়ে থাকে। ফলে মূল কর্মে নিয়োগলাভের পরে তারা খুব স্বাচ্ছন্দ্যে দায়িত্ব পালনে ব্রতী হন। 

এখানে উল্লেখ্য, প্রথম জীবনের কষ্টসাধ্য শ্রম ও তার যথাযথ মূল্যায়ন থেকে বঞ্চিত হলেও পরবর্তী সময়ে স্বাচ্ছন্দ্যময় অবস্থায় পূর্ববর্তীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে তারা ঠিকই লজ্জায় ম্রিয়মাণ হন। এটাই হারের বড় গৌরব। পক্ষান্তরে মূল্যায়নের দিক থেকে জীবনের প্রথম অধ্যায়কে হার বিবেচনা করলেও তখন যে প্রশিক্ষণ লাভ হয়, তাতে পরবর্তী জীবনে মূল কাজের সময়টা অত্যন্ত স্বাচ্ছন্দ্যে কাটে। সুতরাং জীবনের অল্প সময়ের হার পরবর্তী জীবনে বয়ে আনে গর্বিত গৌরব।

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও গবেষক।
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: +880  1338-950041