ড. রফিকুল ইসলাম
মন হলো প্রাণীর জ্ঞানমন্দির, যেখান থেকে উৎপন্ন হয় সচেতনতা, ইন্দ্রিয়ানুভূতি, চিন্তাভাবনা, বিচারবুদ্ধি ও স্মৃতিশক্তি। দর্শন, ধর্ম, মনস্তত্ত্ব ও বুদ্ধিবিজ্ঞানে মন সম্পর্কীয় কৌতূহল রয়েছে, সকল ক্ষেত্রেই স্ব স্ব ধারণা অনুযায়ী মনের বৈশিষ্ট্য নিরূপিত হয়েছে। তবে সকল ক্ষেত্রেই কতগুলো অমীমাংসিত প্রশ্ন লুকিয়ে আছে। এর মধ্যে অতি সাধারণটি হলো, মন কি জাগতিক মস্তিষ্কের কার্যক্রম নাকি আলাদা কোনো অস্তিত্ব, যা মস্তিষ্কের সমন্বয়ে কাজ করে? আবার অনেক সময় বলা হয়ে থাকে ‘মন-শরীর বৈকল্য’, যা থেকে পরিষ্কার প্রতীয়মান হয়, মন ও শরীর দুটি আলাদা অস্তিত্ব; যারা একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। শরীরের সঙ্গে মনের সম্পর্ক যা-ই হোক না কেন, এ কথা সকলেই স্বীকার করে, প্রাণীর মন হলো সেই সত্ত্বা, যার রয়েছে আধ্যাত্মীয় বা অন্তর্মুখী সতর্কতা ও পারিপার্শ্বিকতার প্রতি অনুভূতিপ্রবণতা। এর আরও রয়েছে চিন্তাশক্তি ও আবেগপ্রবণতা।
অনেক মনস্তাত্ত্বিকের মতে, বুদ্ধিদীপ্ত কার্যকারিতাই মনের সংগঠক, বিশেষ করে বিচারবুদ্ধি ও স্মৃতিশক্তি। আবেগ, ভালোবাসা, ভয়, সাহস, আনন্দ ইত্যাদি সবই প্রাণীর মনের মৌলিক বৈশিষ্ট্য। অনেকে মনে করেন, মন হলো প্রাণীর চিন্তাশক্তি, যা রক্ষিত ও উদ্ভূত হয় আমাদের মস্তিষ্ক থেকে। কেউ মনকে দেখে না, মন সম্পর্কে সম্যক কোনো জ্ঞান কারোরই নেই, শুধু মনে করে প্রাণীর অন্তর বা মন বলে কিছু আছে, যা শুধু অনুভব বা উপলব্ধি দিয়ে ধারণা করা হয়। বিভিন্ন প্রাণীর মন বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে বলেই সবার ধারণা; যেমন কারও মন কঠিন আবার কারও মন নরম। মনের এই বৈশিষ্ট্যগুলো বুঝতে হয় শুধু অনুভবের দ্বারা।
তবে মন যে মানুষকে তাড়িয়ে বেড়ায়, তা প্রভাত রবির মতোই পরিষ্কার। আমরা লক্ষ করলেই বুঝতে পারব, বিভিন্ন মানুষের মনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। মনের বৈশিষ্ট্যগুলোকে কোনো সাধারণ ছকে ফেলা যায় না; তবে বিভিন্ন প্রজাতির মনের বিভিন্ন রকম মানসিক বৈশিষ্ট্য, যেমন মানুষের মনের কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। এর মধ্যে রয়েছে আবেগ, ভালোবাসা, বুদ্ধি, ভাবপ্রবণতা, চিন্তাশক্তি, ভয়, কাঠিন্য ইতাদি।
স্নায়ুবিজ্ঞান বলছে, মনের ভৌত কাঠামো হলো স্নায়ুতন্ত্র। স্নায়ুবিজ্ঞানীরা খুঁজে দেখছেন কীভাবে জৈব স্নায়ুতন্ত্র মন তৈরি করে এবং ভৌতভাবে পরস্পর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করে মানসিক কার্যক্রম, যেমন রিফ্লেক্স, বিভিন্ন সংবেদনশীলতার একত্রীকরণ (multisensory integration), মোটর সমন্বয় (motor coordination), আবেগ তৈরি, শিক্ষা গ্রহণ, স্মৃতিশক্তি তৈরি ইত্যাদি পরিচালনা করে।
এ সবই বিজ্ঞানের গবেষণাধীন। এসব বিষয়ে বিজ্ঞান অনেক দূর এগিয়ে গেলেও প্রতি পদেই স্তম্ভিত হয়ে ভাবছে কী করে এসব সম্ভব হচ্ছে। বিজ্ঞানকে ভাবিয়ে তুলেছে, কী করে কিছু জৈব কোষের মধ্যে প্রাণীর স্বকীয়তা, আবেগ, উদ্যম বা ইচ্ছাশক্তি কাজ করছে। হতে পারে সেসব কোষ বিশেষভাবে নির্মিত, তবু তাদের সম্মিলিত কার্যক্রমের মাধ্যমে কীভাবে প্রাণীর মধ্যে এসব বিষয় অনুভূত হয়, তা বিজ্ঞানকে ভাবিয়ে তুলছে। প্রাণীর, বিশেষ করে মানুষের মস্তিষ্ক কীভাবে চিন্তাভাবনা করে, তা বিজ্ঞানের কাছেও বিস্ময়।
মন ও মস্তিষ্কের সম্পর্ক
পশুর ক্ষেত্রে মস্তিষ্ক কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের কেন্দ্র ও চিন্তাশক্তির আধার। অধিকাংশ প্রাণীরই মগজ মাথার মধ্যে করোটি দ্বারা আবৃত থাকে এবং তার মধ্যে কিছু সংবেদনশীল অঙ্গ, যেমন শ্রবণেন্দ্রিয়, দৃষ্টিকেন্দ্র, সাম্য বজায় রাখা, স্বাদ গ্রহণ, ঘ্রাণেন্দ্রিয় ইত্যাদি সংযুক্ত থাকে। অধিকাংশ মেরুদণ্ডী প্রাণীরই মগজ রয়েছে। এর মধ্যে মানুষের মগজ খুবই জটিল। তাতে প্রায় ৮৬ বিলিয়ন নিউরন থাকে এবং প্রতিটি কম করে হলেও ১০ হাজার অন্যান্য নিউরনের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই মানুষের ধারণা, মস্তিষ্ক ও মানবমনের মধ্যে একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে, যাকে মন-শরীর সমস্যা (mind-body problem) বলা হয়।
যখন থেকে মানুষের মনে উন্নত চিন্তার অভ্যুদয় ঘটে, তখন থেকেই মানুষ মনের অস্তিত্ব অনুভব করতে থাকে এবং ক্রমান্বয়ে মানুষ মস্তিষ্কের প্রভাব বুঝতে শুরু করে। তার পর থেকেই শুরু হয় মন-মস্তিষ্কের দ্বৈত প্রতিক্রিয়া। মানুষ দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে ভাসতে থাকে-মন না মস্তিষ্ক মানুষের পরিচালক? এই প্রশ্ন দর্শন, বিজ্ঞান এমনকি সকল ভাবুকের সামনে এক মহা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। দ্বৈত নীতি বা মন ও জড় পদার্থ মতবাদ অনুযায়ী মন হলো প্রাণীর স্বাধীন সত্ত্বা; তার ওপর মস্তিষ্কের কোনো প্রভাব নেই। জড়বাদ অনুযায়ী, মন স্নায়ুতন্ত্রের মতোই আরেকটা সক্রিয় পদ্ধতি। আদর্শবাদ বা ভাববাদ অনুযায়ী মনই মানুষের চিন্তাশক্তির পরিচালক।
ইতিহাস থেকে দেখা যায়, অনেক দার্শনিক মনে করতেন, মস্তিষ্ক কর্তৃক চিন্তাশক্তির অভ্যুদয় ধারণার অতীত। মস্তিষ্কের পেশিকলা থেকে চিন্তার উদ্ভব দুরূহ ব্যাপার। দার্শনিক ডেসকার্টিস (Descartes) মন ও মস্তিষ্ক সম্পর্কে অনেক গবেষণায় দেখতে পেয়েছেন, প্রতিবর্তী বা রিফ্লেক্স ক্রিয়া অর্থাৎ দৃশ্য ঘটনার ওপর প্রতিক্রিয়া ও সাধারণ আচরণকে মস্তিষ্ক কোষের যান্ত্রিক ক্রিয়ার দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় কিন্তু তিনি এটা বিশ্বাস করতেন না, জটিল চিন্তাভাবনা ও ভাষা সৃষ্টি অর্থাৎ আবেগ-অনুভূতিকে কথায় প্রকাশ মস্তিষ্ক পেশিকলার পক্ষে সম্ভব। তবে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা যায়, মন যদি প্রাণীর আলাদা কোনো সত্ত্বা হয়ে থাকে, তবে তার সঙ্গে মস্তিষ্কের গভীর যোগসূত্র রয়েছে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, ট্রম্যাটিক ব্রেন ইনজুরি (traumatic brain injury) ও সাইকো অ্যাকটিভ ড্রাগ মস্তিষ্কের মাধ্যমে মনের ওপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। দার্শনিক প্যাট্রিসিয়া মনে করেন, মস্তিষ্কে এই ওষুধের ক্রিয়া মনের ওপর যে প্রভাব ফেলে, তাতেই বোঝা যায়, মন ও মস্তিষ্ক একসূত্রে গাঁথা। এই কৌতূহল শুধু দার্শনিকদের মনেই নয়, তা বিজ্ঞানীদের মনেও দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসছে।
মানুষের মনে দীর্ঘ দিন ধরে একটা প্রশ্ন প্রচলিত হয়ে আসছে, তা হলো ‘intellect’ বা বুদ্ধিমত্তা মানবদেহের কোন অঙ্গ থেকে উত্থিত হয়। কেউ কেউ মনে করেন, তা মানুষের হৃৎপিণ্ড থেকে তৈরি হয়, আবার কেউ কেউ বলেন বুদ্ধিমত্তা মানুষের মস্তিষ্ক থেকেই উত্থিত হয়। বিজ্ঞানের প্রত্যুষকালে দার্শনিকদের মধ্যেও এই বিভেদ ছিল। বিখ্যাত দার্শনিক প্লেটো মনে করতেন, মানুষের বুদ্ধিমত্তা তার মস্তিষ্কের কাজ, কিন্তু তার শিষ্য অ্যারিস্টটল মনে করতেন, হৃৎপিণ্ডই বুদ্ধিমত্তার আধার। তিনি আরও বললেন, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস ও বাতাসের সহযোগিতায় মানুষ কথা বলে থাকে। সময়ের দীর্ঘ ব্যবধানে বিজ্ঞান যখন অনেকটা পথ এগিয়ে এসেছে, তখন বিজ্ঞানী গ্যালেন (Galen) পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণ করে বললেন, মানুষের বুদ্ধিমত্তায় মস্তিষ্কের গভীর প্রভাব রয়েছে। তিনি বললেন, শব্দ উৎপাদনের জন্য পরিপূর্ণ মস্তিষ্কের প্রয়োজন। বিজ্ঞান এই ধারণার মধ্যেই বহুদিন স্থিতিশীল ছিল।
নতুন বিজ্ঞানীদের অনেকেই অ্যারিস্টটলের ধারণাকে ব্যঙ্গ করেছিলেন এ জন্য যে, বিজ্ঞানীরা নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করেন, মানুষের মস্তিষ্কই শরীরের সকল কাজের পরিচালক। ফলে আধুনিক বিজ্ঞানীদের কাছে বৃদ্ধ অ্যারিস্টটল হাস্যস্পদ হয়েই রইলেন। আধুনিক বিজ্ঞানীদের ধারণামতে, হৃৎপিণ্ড প্রাণিদেহে রক্ত সঞ্চালনকারী এক টুকরো মাংসপিণ্ড, যা অনবরত পাম্প করে শরীরের সকল অঙ্গে রক্ত সংবহন স্বাভাবিক রাখে। মানুষের মনের ওপর তার কোনো প্রভাব নেই।
অতি অধুনা আশ্চর্যজনকভাবে বিজ্ঞানীরা অনুধাবন করতে শুরু করেছেন, অ্যারিস্টটল সম্পূর্ণরূপে ভুল ছিলেন না। বিজ্ঞানীরাও মনে করতে শুরু করেছেন, হৃৎপিণ্ড শুধু রক্ত সঞ্চালনকারী অঙ্গ নয়, এর নিজস্ব স্নায়ুতন্ত্র রয়েছে এবং তা প্রায় ৪০ হাজার নিউরন দিয়ে গঠিত। এই নিউরনগুলো শরীরের অন্যন্য অঙ্গের তুলনায় কিছুটা আলাদা ও বিভিন্ন উপায়ে ও বিস্তৃতভাবে সংযুক্ত এবং তারা সংবেদনশীলতার পাশাপাশি মস্তিষ্ক কর্তৃক ও বিভিন্ন গ্ল্যান্ড থেকে ক্ষরিত নানা প্রকার রাসায়নিক পদার্থকে শনাক্ত করতে সক্ষম; আগত হরমোন ও নানাবিদ রাসায়নিক পদার্থের মধ্যে তার প্রয়োজনীয় অংশটুকু চিনে নিতে সক্ষম। তারা স্বাধীনভাবে তাদের নিজ দক্ষতায় কাজ করে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, হৃৎপিণ্ডের খুদে মস্তিষ্ক রয়েছে, যে কারণে তার প্রতিস্থাপন করা যায়। কারণ সাধারণত শরীরের অন্যান্য অঙ্গে কাটা পড়া স্নায়ু পুনঃসংযুক্ত হয় না।
বৈদ্যুতিক পালসের মাধ্যমে হৃৎপিণ্ডের পাম্পিং ক্রিয়া সচল রাখা ছাড়াও এই স্নায়ুতন্ত্রের বহুবিধ কাজ রয়েছে। সম্ভবত সে কারণেই কোনো প্রাণী অজ্ঞান হলেও তার হৃৎপিণ্ড সম্পূর্ণ সচল থাকে। তা ছাড়া আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা লক্ষ করেছেন, হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপনে রোগীর মধ্যে সক্রিয়তার অনেক পরিবর্তন আসে। আরও দেখা গেছে, রোগীর মধ্যে হৃৎপিণ্ডদাতার কিছু বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, মস্তিষ্ক ও হৃৎপিণ্ড সমন্বিতভাবে কাজ করে। হৃৎপিণ্ড যদি সম্পূর্ণই মস্তিষ্কের নির্দেশে কাজ করত, তবে সমন্বয় বা বোঝাপড়ার প্রয়োজন হতো না। শুধু মস্তিষ্কের নির্দেশ মেনে চলত।
অনেক সময় দেখা গেছে, আক্রান্ত হৃৎপিণ্ডের কার্যপ্রণালিতে নানাবিধ পরিবর্তনের ফলে মস্তিষ্ক তার সঙ্গে মানিয়ে তার নিজের কাজ পরিচালনা করে, বিশেষ করে মেধা ও সচেতনতার ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন আসে। মানুষের মেধার উন্নয়ন আজও বিজ্ঞানের কাছে এক বিস্ময়। বিজ্ঞান বুঝতে পারছে, গুণিতকভাবে মানুষের মেধার উন্নয়ন হচ্ছে। তা মস্তিষ্কের কোনো অংশ এই উন্নয়নকাজ সাধন করছে এবং তা কোথায় স্থায়িত্ব লাভ করছে, তা-ও আজ বিজ্ঞানের কাছে প্রশ্নবোধক।
বিজ্ঞান বলছে, মানুষের মস্তিষ্কের সম্মুখভাগ বা টেম্পোরাল লোব চিন্তাভাবনার কাজ করে আর সেরেব্রাম এই টেম্পোরাল লোবের সহায়তায় আবেগ নিয়ন্ত্রণ, স্মৃতিধারণ এবং চিন্তাশক্তি নামক জটিল বিষয়কে নিয়ন্ত্রণ করে। মস্তিষ্কের এই দুটি অঞ্চলের ক্ষমতা কতটুকু, তার উত্তর বিজ্ঞানের কাছে নেই। অতি নিম্ন প্রাণী থেকে ক্রমান্বয়ে এর উত্তরণ ঘটতে ঘটতে মানুষ পর্যন্ত এসে যে মাত্রা পেয়েছে, তার গড় নিয়ে যদি বিজ্ঞান কোনো হিসাব করতে চায়, তবে তা বিস্ময়করভাবে বিজ্ঞানীদের অবাক করবে। মানুষের বেলায় এই লেখচিত্রের আকৃতি যা হবে তাকে কোনো ক্রমিক উত্তরণ বলা চলে না। এবার প্রশ্ন হলো মানুষের বেলায় মেধার উন্নয়ন বিভিন্নজনের মধ্যে বিভিন্ন কেন? নিউরনের গঠন ও আকৃতিতে তো তেমন কোনো পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। তবে এই বৈষম্য ও মেধা বিকাশের ব্যাখ্যা কোথায়? এসব প্রশ্ন এখনো বিজ্ঞানের কাছে প্রশ্ন হয়েই আছে।
প্রাণীর মস্তিষ্ক নিয়ে আজকের বিজ্ঞানও গোলকধাঁধায় পড়ে আছে। কগনেটিভ সায়েন্স (Cognitive science) নামে বিজ্ঞানের এক বিশেষ শাখাই তৈরি হয়েছে, যার কাজ হলো প্রাণীর মনে চিন্তাভাবনা তৈরির বিষয়টি খতিয়ে দেখা। কীভাবে প্রাণীর মনে চিন্তাভাবনা সৃষ্টি হয়, কীভাবে প্রাণী তথা মানুষ নতুন নতুন চিন্তার মাধ্যমে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করে, সাধারণ স্নায়ুকোষ কীভাবে উজ্জীবিত হয়ে মস্তিষ্কে এই চেতনার সৃষ্টি করে-এসবই বিজ্ঞানের কাছে বিস্ময়কর ব্যাপার। বিজ্ঞানীরা নানা গবেষণার মাধ্যমে এসব বিষয় সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করছেন।
বিজ্ঞানীরা গভীরভাবে ভাবছেন, কী করে মানুষের মেধার পরিস্ফুটন ঘটে এবং তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়; কীভাবে মানুষের মনে ভাষার উৎপত্তি হয়, আবার কী করেই-বা কোনো বিষয় বা চিন্তিত ভাবনা স্মৃতি হয়ে মস্তিষ্কে জমা থাকে; এসবই বিজ্ঞানীদের কাছে নিষ্কলুষভাবে পরিষ্কার নয়। যদিও বিজ্ঞান বলছে, এসব কাজ সেরেব্রাম ফ্রন্টাল লোবের সহায়তায় করে থাকে, তবু সর্বগ্রাহ্য ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারছে না যে কীভাবে এ কাজগুলো সমাধা হচ্ছে। তারা শুধু ফলাফলটাকেই তুলে ধরছে।
প্রাণীর ভাষাজ্ঞান এক জটিল বিষয়। প্রাণী, বিশেষত মানুষ তার শিশু অবস্থায় পরিবেশ থেকে শ্রুত শব্দগুলো তার মস্তিষ্কের স্মৃতিকোষে সঞ্চিত করতে থাকে এবং তা তার নিজের মুখ দিয়ে বলতে শুরু করে। পরিবেশ থেকে শ্রুত শব্দগুলো তার মস্তিষ্কের স্মৃতিকোষে যাওয়া থেকে শুরু করে মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসা কথাগুলো অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়ায় সংঘটিত হয়। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি কীভাবে ঘটে, তা আজকের বিজ্ঞানের কাছেও পরীক্ষিতভাবে প্রমাণিত নয়; তবু বিজ্ঞান মনে করে, এই প্রক্রিয়াটি ঘটে থাকে মানুষের স্নায়ুকোষের কার্যকারিতার মাধ্যমে।
যৌক্তিকভাবে এটাই বলা যায়, শিশুটি তার শ্রবণেন্দ্রিয় দিয়ে যা গ্রহণ করে, তা মস্তিষ্ক কোষের মধ্যে অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়ায় অনেক অজানা পদ্ধতিতে স্মৃতিকোষে গিয়ে সঞ্চিত হয় এবং তা একসময় তার নিজের মুখ দিয়ে বলতে শুরু করে। বিষয়টা এখানেই শেষ নয়, শিশুটির যখন বয়ঃক্রমে জ্ঞান উন্মেষ ঘটে, তখন সে শুধু শ্রুত কথাগুলোই বলে না, সে তার মেধা দিয়ে নতুন নতুন কথা নিজে থেকে বানিয়ে বলতে থাকে। আমরা কি কবি-সাহিত্যিকদের কথা কখনো ভেবে দেখেছি, তারা অনর্গল শব্দ সৃষ্টি করে যাচ্ছেন, আপনি কি বলবেন এসব শব্দ তার স্মৃতিভান্ডার থেকে বেরিয়ে আসছে? আপনি আগে শুনতে পাননি এমন শব্দ কি কখনোই বলতে পারছেন না? বিজ্ঞান কি এ ক্ষেত্রে কোনো স্থির সিদ্ধান্ত দিতে পারে? যদি বলেন পারে, তবে ভাষাবিজ্ঞানীদের কথা ভাবুন, তারা অক্ষরের সঙ্গে অক্ষর জুড়ে কীভাবে একেবারে নতুন শব্দ তৈরি করেন? এ সবই প্রশ্ন। কোনো শিশুকে বালি নিয়ে খেলতে দেখেছেন? দেখবেন, সে তার মনের মতো করে ঘর বানায়, এগুলো হয়তো-বা এর আগে দেখেনি। মস্তিষ্কের উদ্ভাবনী ক্ষমতা আর তার স্মৃতি এক নয়। হয়তো বলতে পারেন, উদ্ভাবনী ক্ষমতাকে স্মৃতি সহযোগিতা করে; সে নিজের মনে অনেক সমস্যা তৈরি করে তা ভাবনা-চিন্তার মধ্য দিয়ে সমাধানও দিতে পারে।
এসবই হয় তার মেধাগত অর্জন। এই মেধার কীভাবে উন্মেষ ঘটে, বিজ্ঞান তার সর্বগ্রাহ্য ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। তবে এ-ও সত্য, বিজ্ঞানের পরীক্ষালব্ধ ফলাফল এড়িয়ে কেউ বাস্তবতার নিরিখে ভিন্ন কোনো চিত্র তুলে ধরতেও পারেনি। বিজ্ঞান যেমন পরীক্ষিতভাবে শেষ কথা বলতে পারেনি, তেমনি কল্পনাপ্রসূত হয়ে মনের কোনো সঠিক ঠিকানাও কেউ খুঁজে পায়নি। এমনই একটা টানাপোড়েনের মধ্যে ভাবুকেরা দোদুল্যমান হয়ে পড়েছে, হন্যে হয়ে খুঁজছে প্রকৃত ধারণা। প্রাচীনকাল থেকেই দর্শন, ধর্ম এমনকি মনস্তত্ত্বও মনের যে আলাদা অস্তিত্ব অনুভব করে আসছে, আজকের বিজ্ঞান তার বিরোধিতা করে ভিন্ন মেরুতে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু সমন্বয় করতে পারছে না। তার পরও সমাধানের আশায় ভাবুকেরা নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এ পর্যায়ে আমরা বিজ্ঞানের চিন্তাধারায় অতি সংক্ষেপে মানব মস্তিষ্কের যৎসামান্য গঠন-প্রকৃতি দেখব।
মস্তিষ্কের গঠন (Structure of brain)
বিজ্ঞান বলছে, মানুষের শরীরের যাবতীয় কাজ নিয়ন্ত্রণ করে তার মস্তিষ্ক। এই কাজ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তার সমগ্র শরীরে ছড়িয়ে থাকে এক বিশাল ও জটিল জালিকা, যাকে বলা হয় কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র বা সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম। আমাদের জ্ঞানে-অজ্ঞানে যাবতীয় ক্রিয়াকর্ম এই কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রই নিয়ন্ত্রণ করে। আমরা দেখে, শুনে, স্পর্শ করে বা স্বাদ নিয়ে যেসব তথ্য সংগ্রহ করি, তা এই জালিকা মস্তিষ্কে প্রেরণ করে, মস্তিষ্ক তা বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে আমাদের অঙ্গকে কার্যক্ষম করে তোলে। কেন্দ্রীয় মস্তিষ্ক থেকে সুষষ্মা কাণ্ডের মাধ্যমে সমগ্র শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। এই স্নায়ুতন্ত্র তৈরি হয় স্নায়ুকোষ দিয়ে, যাদের বলা হয় নিউরন। প্রায় এক হাজার কোটি (১০০০০০০০০০০০) নিউরন দিয়ে মানবদেহের স্নায়ুতন্ত্র তৈরি হয়।
মানবদেহের মতো স্নায়ুতন্ত্রও স্নায়ুকোষ বা নিউরন দিয়ে গঠিত হয়। এই স্নায়ুকোষের প্রধান অংশ হলো কোষ দেহ (Cell Body)। কোষ দেহ স্নায়ুকোষ বা নিউরনের প্রধান অংশ। নিউরনের মধ্যে থাকে নিউক্লিয়াস।
এ ছাড়া আছে এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম, রাইবোজম। নিউরনের দেহ নষ্ট হয়ে গেলে তার মৃত্যু ঘটে। সেল বডি বা দেহ থেকে তন্তু আকারে লম্বা লেজ বের হয়। এই লেজের আকৃতি বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে, যেমন আঙুলের ডগায় অবস্থিত নিউরনের লেজটি কনুই পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে; আবার মস্তিষ্কে অবস্থিত নিউরনের লেজ অত্যন্ত ছোট আকৃতির হয়ে থাকে।
বিজ্ঞানের ভাষায় এই লেজের নাম দেওয়া হয়েছে এক্সন, এটি অনেকটা সরু তারের মতো কাজ করে। এর উপরে প্রোটিনের আবরণ থাকে, যা এক্সনকে তড়িৎ রাসায়নিক সংকেত দ্রুততার সঙ্গে বহন করতে সহায়তা করে। এই আবরণটির নাম মায়েলিন শেথ। এক্সনের মাথায় তন্তুর মতো শিকড় দেখা যায়, এগুলো নিউরনের দেহ থেকেও বেরোতে পারে। এদের নাম ডেনড্রাইটস। নিউরনের সঙ্গে নিউরনের যোগাযোগ রাখতে এদের ব্যবহার হয়ে থাকে। এরা রিসিপ্টর বা অ্যান্টেনার কাজ করে থাকে। কার্যভেদে নিউরন বিভিন্ন প্রকার হয়ে থাকে।
যেমন ১. সেন্সরি নিউরন, ২. মোটর নিউরন, ৩. ইন্টার নিউরন।
সেন্সরি নিউরনের প্রধান কাজ হলো শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে প্রয়োজনীয় সংকেত গ্রহণ করে তা মস্তিষ্কে প্রেরণ করে। মস্তিষ্ক এসব সংকেত বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় কার্যাদেশ মোটর নিউরনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট স্থানগুলোতে প্রেরণ করে। ইন্টার নিউরনের কাজ হলো বিভিন্ন নিউরনের মধ্যে আন্তযোগাযোগ রক্ষা করা। এদেরকে বেশি দেখা যায় মস্তিষ্কে ও সুষষ্মা কাণ্ডে। এসব নিউরন মিলে শরীরের বিভিন্ন অংশে জটিল জালিকা তৈরি করে।
মস্তিষ্কের অংশগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচয়
মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে সামান্য পরিচিত হওয়া দরকার। উন্নত প্রাণীদের প্রত্যেকের শরীরের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ উল্লেখযোগ্য মস্তিষ্ক থাকলেও কিছু কিছু অমেরুদণ্ডী প্রাণীর মস্তিষ্ককে আলাদাভাবে বোঝার উপায় থাকে না, যেমন চিংড়ি মাছের কোনো কেন্দ্রীয় মস্তিষ্ক থাকে না, তাদের মস্তিষ্কের কাজ হয় শরীরের স্থানে স্থানে গুচ্ছাকারে থাকা ‘নিউরোনাল সেল বডির’ বিন্যাস দ্বারা, যাদেরকে বলা হয় গ্যাংলিয়া। এই গ্যাংলিয়া ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের কাজ করে থাকে। আরও একটু উন্নততর প্রাণীদের মধ্যে এই যোগাযোগকর্ম বিন্যাসের মাধ্যমে তৈরি করে সরল মস্তিষ্কের। এদের থেকে উন্নততর প্রাণীদের এই গ্যাংলিয়াগুলো পরস্পর যোগাযোগ করে তৈরি করে সরল মস্তিষ্কের। সাধারণত উন্নত প্রাণীদের মস্তিষ্কে নিম্নোক্ত অংশগুলো থাকবেই :
১. ব্রেইনস্টিম-এর মধ্যে থাকে মেডুলা, পনস, মিডব্রেইন। এই ব্রেইনস্টিমের কাজের মধ্যে প্রধানত রিফ্লেস্ক বা প্রতিবর্ত ক্রিয়া, কিছু স্বয়ংক্রিয় কাজ, যেমন হৃৎস্পন্দনের হার, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা এবং বিভিন্ন অঙ্গের সঞ্চালন ও আন্ত্রিক কাজ পরিচালনা করা।
২. সেরেবেলাম-এটি প্রাণিদেহের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
৩. হাইপোথ্যালামাস ও পিটুইটারি গ্রন্থিÑএরা মানবদেহের প্রয়োজনীয় হরমোন নিঃসরণ করে।
৪. সেরেব্রাম-এটি মস্তিষ্কের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। একে সেরেব্রাল কর্টেক্স বা কর্টেক্সও বলা হয়। এর প্রধান কাজ হলো শরীরের বিভিন্ন ইন্দ্রিয় থেকে সংকেত বা তথ্য সংগ্রহ করে সমস্যার সমাধান করে তা মোটর নিউরনের সাহায্যে যথাস্থানে পৌঁছে দিয়ে প্রয়োজনীয় কাজ সিদ্ধি করা। আবেগ নিয়ন্ত্রণ, স্মৃতিধারণ এবং চিন্তাশক্তি নামক জটিল বিষয়কে নিয়ন্ত্রণ করাও এই অংশেরই কাজ।
এখানে বিজ্ঞান বলছে, সেরেব্রাম প্রাণীর ইন্দ্রিয়প্রদত্ত সংকেত নিয়ে কাজ করে, যেমন ধরুন আপনার আঙুলের আগায় কোনো বস্তুর স্পর্শ লাগল, এই সংকেত সেন্সরি নিউরন সেরেব্রাম অঞ্চলে প্রেরণ করে আর এই অঞ্চল সেই সংকেতের বিশ্লেষণ করে তার ফলাফল অর্থাৎ স্পর্শের গভীরতা তার অবস্থান যন্ত্রণা ইত্যাদির অনুভূতি তৈরি করে এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনাবলি মোটর নিউরনের সাহায্যে আঙুলের ডগায় প্রেরণ করে। বিজ্ঞান আরও বলছে, মস্তিষ্ক কোনো ইন্দ্রিয় থেকে সংকেত বা নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত কার্যক্ষম হয় না। এখন প্রশ্ন হলো মানুষের আবেগ-ভালোবাসা বা বিশ্বাস এই অনুভূতিগুলো সৃষ্টি হয় কোনো ইন্দ্রিয়ের তাড়নায়? আমরা ধীরে ধীরে এই প্রশ্নের জবাব বুঝতে চেষ্টা করব।
আমরা জানি, মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী উন্নততর কোনো চিন্তাভাবনা করতে পারে না। নিম্ন প্রাণীদের চিন্তাভাবনার ক্ষেত্র খুবই সীমিত, কোনো কিছু নিয়ে ভেবে দেখার অবকাশ তারা পায় না। তাহলে প্রশ্ন জাগে, নিম্ন শ্রেণির প্রাণী, যেমন গৃহপালিত পশুপাখি বা বন্য প্রাণীরা তাদের দৈনন্দিন চাহিদা বা প্রয়োজনীয়তা বোঝে কী করে। বিস্ময়করভাবে লক্ষ করা গেছে, নিম্ন প্রাণীদের দৈনন্দিন জীবন কিন্তু থেমে নেই। তারাও কিন্তু উন্নত প্রাণীদের মতোই তাদের জীবন তাদের মতো করে পরিচালনা করে।
উন্নত প্রাণী মানুষ আর নিম্ন প্রাণীদের মস্তিষ্কের মধ্যে প্রধান পার্থক্য হলো মানুষ যেকোনো সময় চিন্তাভাবনা করে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে তার প্রবৃত্তির পরিবর্তন ঘটাতে পারে, কিন্তু নিম্ন প্রাণীরা তার প্রবৃত্তি অনুযায়ী দৈনন্দিন জীবন পরিচালনা করে। আর এই জীবনব্যবস্থা একটা সুনির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে ব্যাপৃত, চাইলেই সে তার জীবনব্যবস্থাকে পরিবর্তন করতে পারে না। তা ছাড়া উভয় শ্রেণির মধ্যেই কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যাদেরকে বলে প্রবৃত্তি। বিজ্ঞান বলছে, এই প্রবৃত্তিমূলক কাজগুলো নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্কের নিম্নভাগ।
মস্তিষ্কের নিম্নভাগে রয়েছে মেডুলা, পনস, মিডব্রেইন। মেডুলা হলো সুষষ্মা কাণ্ডের ঠিক উপরের স্ফীত অংশ। এই অংশের মধ্য দিয়ে শরীরের বিভিন্ন অঞ্চলের সংকেত মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চলে যাতায়াত করে। এ ছাড়া মস্তিষ্কের উপরের দিকে কয়েকটি বড় বড় অংশ রয়েছে। তার মধ্যে প্যারাইটাল লোব, ফ্রন্টাল লোব, অক্সিপেটাল লোব, টেম্পোরাল লোব, ইনসুলা উল্লেখযোগ্য।
মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চলের কাজ
প্যারাইটাল লোবÑপ্যারাইটাল লোবের সঙ্গে শরীরের বিভিন্ন অঞ্চল সংযুক্ত থাকে। এরা শরীরের বহিঃত্বক থেকে আসা বিভিন্ন সংবেদনশীলতা, যেমন চাপ, স্পর্শ, ব্যথা ইত্যাদির অনুভব সৃষ্টি করে এবং প্রয়োজনীয় আদেশ-নিষেধ প্রদান করে। প্যারাইটাল লোবের পেছন দিকে ওয়ের্নকাস অঞ্চল অবস্থিত। ভাষা-সংক্রান্ত ব্যাপারে এর ভূমিকা অপরিসীম। শ্রবণ-দর্শন সংকেত সংশ্লেষণের কাজে সহযোগিতা করে।
ফ্রন্টাল লোব-মস্তিষ্কের অতীব গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলটি মেধা ও সক্রিয়তা সৃষ্টির অঞ্চল। মানুষের চিন্তা, বোধ, মননশীলতার মতো জটিল কাজগুলো নিয়ন্ত্রণ করে এই অংশটি। তা ছাড়া চলন, গমন, বিভিন্ন অঙ্গের নাড়াচাড়া অর্থাৎ মোটর ফাংশন নিয়ন্ত্রণ করে ফ্রন্টাল লোবের পেছন দিকে থাকা মোটর কেন্দ্র। প্যারাইটাল লোব ও সোমাটোসেনসরি অংশ থেকে মোটর কেন্দ্র সংকেত আহরণ করে তা ফ্রন্টাল লোবের সহায়তায় প্রয়োজনীয় কাজ পরিচালনা করে।
অক্সিপিটাল লোব-এর কাজ হলো চোখ থেকে আসা দৃষ্টি সংকেতকে প্যারাইটাল লোবের ওয়ের্নিকাস ও ফ্রন্টাল লোবের মোটর কেন্দ্রের সহযোগতায় মস্তিষ্কে বাইরের দৃশ্যপটের ছবি তৈরি করে। ছবি তৈরিতে এর বিস্ময়কর ভূমিকা হলো রেটিনায় পতিত উল্টো ছবিটাকে মস্তিষ্কে সঠিকভাবে তৈরি করা। ছবি তৈরির কাজটি অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়া। বড় কোনো বস্তুর প্রতিবিম্ব দেখতে হলে আমাদের একটি বড় আয়নার দরকার হয়, কিন্তু পরীক্ষায় জানা গেছে, আমাদের মস্তিষ্কে একটা ক্ষুদ্র বিন্দুর সমস্থানে আমরা বিশাল দৃশ্যপটের প্রতিবিম্ব দেখি; যা পদার্থবিজ্ঞানের নীতি নিয়মে ব্যাখ্যা করা যায় না। বিজ্ঞান এ ক্ষেত্রে বিস্মিত।
টেম্পোরাল লোবÑশ্রবণেন্দ্রিয় থেকে শব্দ সংকেত গ্রহণ করে এটি ওয়ের্নিকাস ও মোটর কেন্দ্রের সহযোগিতায় তা শ্রবণ উপযোগী করে তোলে। ইনসুলা নামের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ রয়েছে, যা শরীরের ছোটখাটো বা সূক্ষ্ম সঞ্চালন-প্রক্রিয়াকে পরিচালনা করে।
আমরা উপরের আলোচনা থেকে অতি সংক্ষিপ্তভাবে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের কার্যপ্রণালি জানতে পেলাম। এ ছাড়া মস্তিষ্ক যে কত বিস্ময়করভাবে হাজারো কাজ পরিচালনা করে, তা স্বল্প পরিসরে ব্যাখ্যা করার উপায় নেই। এই আলোচনা থেকে পরিষ্কারভাবে বোঝা গেল, মস্তিষ্কই হলো প্রাণিদেহের সকল কাজের নিয়ন্ত্রণকারী। আরও বোঝা গেল, মস্তিষ্ক নিজে থেকে উদ্যোগী হয়ে কোনো কাজ করে না। যেকোনো অঙ্গের চাহিদামতো তার কাজ পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। এই আলোচনায় আমাদের যে মৌলিক জিজ্ঞাসা, তা হলো বিভিন্ন অঙ্গের চাহিদার পাশাপাশি আমাদের যে মননশীলতা বা মনের চাহিদা, তা কোনো অঙ্গের জিজ্ঞাসা থেকে সৃষ্টি হয়।
যদি বলা হয় মন নামক দৃশ্য বা অদৃশ্য অঙ্গ আছে! তবে তার অবস্থান কোথায়? বিজ্ঞান পরিষ্কারভাবে মনের অবস্থান ব্যাখ্যা করেনি। বলছে, মানুষের সেরিব্রামের সহায়তায় ফ্রন্টাল লোব এই মননশীলতার জন্ম দেয়। এ ক্ষেত্রেও বিজ্ঞান স্ববিরোধী। মননশীলতার এই বৈজ্ঞানিক ধারণা যদি সঠিক হয়, তবে প্রশ্ন হলো এই দুই অঞ্চল কোন অনুপ্রেরণা থেকে এ কাজে উদ্যোগী হয়? কারণ মস্তিষ্ক বিনা উদ্যোগে কোনো কাজে ব্রতী হয় না। যদি বলা হয়, মানুষ তার দৃষ্টি ইন্দ্রিয় দিয়ে কোনো কিছু দেখে ওই দুই অঞ্চলের সহযোগিতায় ভাবনা-চিন্তা করে বা অনুরূপভাবে শ্রবণেন্দ্রিয় দ্বারা সংগৃহীত তথ্য নিয়েও মস্তিষ্ক ভাবনা-চিন্তা করতে পারে, তবে মানুষ যখন দৃষ্টি ও শ্রবণ ছাড়া জটিল চিন্তায় নিমগ্ন হয়, তখন মস্তিষ্ক কীভাবে তা সমন্বয় করে? যদি বলা হয়, মানুষের মনের অবস্থান মস্তিষ্কে এবং সেটিই মস্তিষ্কে এই অনুভূতি জাগায়, কিন্তু বিজ্ঞান সেই অবস্থানটির খোঁজ এখনো পায়নি।
বিজ্ঞান এর কোনো খোঁজ দিতে না পারলেও মানুষ কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের জন্মের আগে থেকেই তার খোঁজ পেয়েছে। আবেগে আপ্লুত হয়ে তার নাম দিয়েছে মন বা অন্তর। তবে মনের সঠিক অবস্থানটি কেউ সঠিকভাবে বলতে পারছে নাÑকেউ বলছেন এর অবস্থান হৃৎপিণ্ডে, কেউ বলছেন মস্তিষ্কে। মানুষ তার সীমিত মেধা দিয়ে যা-ই বলুক না কেন, এই বিশ্বসংসারের মহান স্রষ্টা বলছেন, মন মানুষের হৃৎপিণ্ডে অবস্থিত। মনের এই অবস্থান নিয়ে পবিত্র কোরআনে প্রচুর আয়াত নাজিল হয়েছে, যা থেকে ধরে নেওয়া যায়, মানুষের ভাবনা-চিন্তার ওপর মনের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। মন মানুষের মস্তিষ্কে কিছু সুনির্দিষ্ট ভাবনার উদ্রেক করে, যা অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের প্রভাবমুক্ত। মনের সঙ্গে মস্তিষ্কের ভাবনা-চিন্তার কেন্দ্রের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। বলতে গেলে দু-দুটো কেন্দ্রই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
মনকে বাদ দিয়ে মস্তিষ্কের ভাবনা-চিন্তার কথা যেমন কল্পনা করা যায় না, তেমনি মস্তিষ্ককে বাদ দিয়ে মন কোনো ভাবনা-চিন্তা করতে পারে না। মূলত মন বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ভাবনা-চিন্তার উদ্রেক তৈরি করে আর মস্তিষ্ক তার সম্প্রসারণ ঘটায়। মূলত ভাবনা-চিন্তার কাজ ও তার ফলে পরিকল্পনা গ্রহণ ইত্যাদি সবই মস্তিষ্কের কাজ। এই আলোচনায় একটা বিষয় পরিষ্কার, ভাবনা-চিন্তার কাজটি মস্তিষ্কই সম্পন্ন করে, মন কেবলই তার জোগানদাতা।
মন হলো প্রাণীর জ্ঞানমন্দির, যেখান থেকে উৎপন্ন হয় সচেতনতা, ইন্দ্রিয়ানুভূতি, চিন্তাভাবনা, বিচারবুদ্ধি ও স্মৃতিশক্তি। দর্শন, ধর্ম, মনস্তত্ত্ব ও বুদ্ধিবিজ্ঞানে মন সম্পর্কীয় কৌতূহল রয়েছে, সকল ক্ষেত্রেই স্ব স্ব ধারণা অনুযায়ী মনের বৈশিষ্ট্য নিরূপিত হয়েছে। তবে সকল ক্ষেত্রেই কতগুলো অমীমাংসিত প্রশ্ন লুকিয়ে আছে। এর মধ্যে অতি সাধারণটি হলো, মন কি জাগতিক মস্তিষ্কের কার্যক্রম নাকি আলাদা কোনো অস্তিত্ব, যা মস্তিষ্কের সমন্বয়ে কাজ করে? আবার অনেক সময় বলা হয়ে থাকে ‘মন-শরীর বৈকল্য’, যা থেকে পরিষ্কার প্রতীয়মান হয়, মন ও শরীর দুটি আলাদা অস্তিত্ব; যারা একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। শরীরের সঙ্গে মনের সম্পর্ক যা-ই হোক না কেন, এ কথা সকলেই স্বীকার করে, প্রাণীর মন হলো সেই সত্ত্বা, যার রয়েছে আধ্যাত্মীয় বা অন্তর্মুখী সতর্কতা ও পারিপার্শ্বিকতার প্রতি অনুভূতিপ্রবণতা। এর আরও রয়েছে চিন্তাশক্তি ও আবেগপ্রবণতা।
অনেক মনস্তাত্ত্বিকের মতে, বুদ্ধিদীপ্ত কার্যকারিতাই মনের সংগঠক, বিশেষ করে বিচারবুদ্ধি ও স্মৃতিশক্তি। আবেগ, ভালোবাসা, ভয়, সাহস, আনন্দ ইত্যাদি সবই প্রাণীর মনের মৌলিক বৈশিষ্ট্য। অনেকে মনে করেন, মন হলো প্রাণীর চিন্তাশক্তি, যা রক্ষিত ও উদ্ভূত হয় আমাদের মস্তিষ্ক থেকে। কেউ মনকে দেখে না, মন সম্পর্কে সম্যক কোনো জ্ঞান কারোরই নেই, শুধু মনে করে প্রাণীর অন্তর বা মন বলে কিছু আছে, যা শুধু অনুভব বা উপলব্ধি দিয়ে ধারণা করা হয়। বিভিন্ন প্রাণীর মন বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে বলেই সবার ধারণা; যেমন কারও মন কঠিন আবার কারও মন নরম। মনের এই বৈশিষ্ট্যগুলো বুঝতে হয় শুধু অনুভবের দ্বারা।
তবে মন যে মানুষকে তাড়িয়ে বেড়ায়, তা প্রভাত রবির মতোই পরিষ্কার। আমরা লক্ষ করলেই বুঝতে পারব, বিভিন্ন মানুষের মনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। মনের বৈশিষ্ট্যগুলোকে কোনো সাধারণ ছকে ফেলা যায় না; তবে বিভিন্ন প্রজাতির মনের বিভিন্ন রকম মানসিক বৈশিষ্ট্য, যেমন মানুষের মনের কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। এর মধ্যে রয়েছে আবেগ, ভালোবাসা, বুদ্ধি, ভাবপ্রবণতা, চিন্তাশক্তি, ভয়, কাঠিন্য ইতাদি।
স্নায়ুবিজ্ঞান বলছে, মনের ভৌত কাঠামো হলো স্নায়ুতন্ত্র। স্নায়ুবিজ্ঞানীরা খুঁজে দেখছেন কীভাবে জৈব স্নায়ুতন্ত্র মন তৈরি করে এবং ভৌতভাবে পরস্পর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করে মানসিক কার্যক্রম, যেমন রিফ্লেক্স, বিভিন্ন সংবেদনশীলতার একত্রীকরণ (multisensory integration), মোটর সমন্বয় (motor coordination), আবেগ তৈরি, শিক্ষা গ্রহণ, স্মৃতিশক্তি তৈরি ইত্যাদি পরিচালনা করে।
এ সবই বিজ্ঞানের গবেষণাধীন। এসব বিষয়ে বিজ্ঞান অনেক দূর এগিয়ে গেলেও প্রতি পদেই স্তম্ভিত হয়ে ভাবছে কী করে এসব সম্ভব হচ্ছে। বিজ্ঞানকে ভাবিয়ে তুলেছে, কী করে কিছু জৈব কোষের মধ্যে প্রাণীর স্বকীয়তা, আবেগ, উদ্যম বা ইচ্ছাশক্তি কাজ করছে। হতে পারে সেসব কোষ বিশেষভাবে নির্মিত, তবু তাদের সম্মিলিত কার্যক্রমের মাধ্যমে কীভাবে প্রাণীর মধ্যে এসব বিষয় অনুভূত হয়, তা বিজ্ঞানকে ভাবিয়ে তুলছে। প্রাণীর, বিশেষ করে মানুষের মস্তিষ্ক কীভাবে চিন্তাভাবনা করে, তা বিজ্ঞানের কাছেও বিস্ময়।
মন ও মস্তিষ্কের সম্পর্ক
পশুর ক্ষেত্রে মস্তিষ্ক কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের কেন্দ্র ও চিন্তাশক্তির আধার। অধিকাংশ প্রাণীরই মগজ মাথার মধ্যে করোটি দ্বারা আবৃত থাকে এবং তার মধ্যে কিছু সংবেদনশীল অঙ্গ, যেমন শ্রবণেন্দ্রিয়, দৃষ্টিকেন্দ্র, সাম্য বজায় রাখা, স্বাদ গ্রহণ, ঘ্রাণেন্দ্রিয় ইত্যাদি সংযুক্ত থাকে। অধিকাংশ মেরুদণ্ডী প্রাণীরই মগজ রয়েছে। এর মধ্যে মানুষের মগজ খুবই জটিল। তাতে প্রায় ৮৬ বিলিয়ন নিউরন থাকে এবং প্রতিটি কম করে হলেও ১০ হাজার অন্যান্য নিউরনের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই মানুষের ধারণা, মস্তিষ্ক ও মানবমনের মধ্যে একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে, যাকে মন-শরীর সমস্যা (mind-body problem) বলা হয়।
যখন থেকে মানুষের মনে উন্নত চিন্তার অভ্যুদয় ঘটে, তখন থেকেই মানুষ মনের অস্তিত্ব অনুভব করতে থাকে এবং ক্রমান্বয়ে মানুষ মস্তিষ্কের প্রভাব বুঝতে শুরু করে। তার পর থেকেই শুরু হয় মন-মস্তিষ্কের দ্বৈত প্রতিক্রিয়া। মানুষ দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে ভাসতে থাকে-মন না মস্তিষ্ক মানুষের পরিচালক? এই প্রশ্ন দর্শন, বিজ্ঞান এমনকি সকল ভাবুকের সামনে এক মহা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। দ্বৈত নীতি বা মন ও জড় পদার্থ মতবাদ অনুযায়ী মন হলো প্রাণীর স্বাধীন সত্ত্বা; তার ওপর মস্তিষ্কের কোনো প্রভাব নেই। জড়বাদ অনুযায়ী, মন স্নায়ুতন্ত্রের মতোই আরেকটা সক্রিয় পদ্ধতি। আদর্শবাদ বা ভাববাদ অনুযায়ী মনই মানুষের চিন্তাশক্তির পরিচালক।
ইতিহাস থেকে দেখা যায়, অনেক দার্শনিক মনে করতেন, মস্তিষ্ক কর্তৃক চিন্তাশক্তির অভ্যুদয় ধারণার অতীত। মস্তিষ্কের পেশিকলা থেকে চিন্তার উদ্ভব দুরূহ ব্যাপার। দার্শনিক ডেসকার্টিস (Descartes) মন ও মস্তিষ্ক সম্পর্কে অনেক গবেষণায় দেখতে পেয়েছেন, প্রতিবর্তী বা রিফ্লেক্স ক্রিয়া অর্থাৎ দৃশ্য ঘটনার ওপর প্রতিক্রিয়া ও সাধারণ আচরণকে মস্তিষ্ক কোষের যান্ত্রিক ক্রিয়ার দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় কিন্তু তিনি এটা বিশ্বাস করতেন না, জটিল চিন্তাভাবনা ও ভাষা সৃষ্টি অর্থাৎ আবেগ-অনুভূতিকে কথায় প্রকাশ মস্তিষ্ক পেশিকলার পক্ষে সম্ভব। তবে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা যায়, মন যদি প্রাণীর আলাদা কোনো সত্ত্বা হয়ে থাকে, তবে তার সঙ্গে মস্তিষ্কের গভীর যোগসূত্র রয়েছে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, ট্রম্যাটিক ব্রেন ইনজুরি (traumatic brain injury) ও সাইকো অ্যাকটিভ ড্রাগ মস্তিষ্কের মাধ্যমে মনের ওপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। দার্শনিক প্যাট্রিসিয়া মনে করেন, মস্তিষ্কে এই ওষুধের ক্রিয়া মনের ওপর যে প্রভাব ফেলে, তাতেই বোঝা যায়, মন ও মস্তিষ্ক একসূত্রে গাঁথা। এই কৌতূহল শুধু দার্শনিকদের মনেই নয়, তা বিজ্ঞানীদের মনেও দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসছে।
মানুষের মনে দীর্ঘ দিন ধরে একটা প্রশ্ন প্রচলিত হয়ে আসছে, তা হলো ‘intellect’ বা বুদ্ধিমত্তা মানবদেহের কোন অঙ্গ থেকে উত্থিত হয়। কেউ কেউ মনে করেন, তা মানুষের হৃৎপিণ্ড থেকে তৈরি হয়, আবার কেউ কেউ বলেন বুদ্ধিমত্তা মানুষের মস্তিষ্ক থেকেই উত্থিত হয়। বিজ্ঞানের প্রত্যুষকালে দার্শনিকদের মধ্যেও এই বিভেদ ছিল। বিখ্যাত দার্শনিক প্লেটো মনে করতেন, মানুষের বুদ্ধিমত্তা তার মস্তিষ্কের কাজ, কিন্তু তার শিষ্য অ্যারিস্টটল মনে করতেন, হৃৎপিণ্ডই বুদ্ধিমত্তার আধার। তিনি আরও বললেন, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস ও বাতাসের সহযোগিতায় মানুষ কথা বলে থাকে। সময়ের দীর্ঘ ব্যবধানে বিজ্ঞান যখন অনেকটা পথ এগিয়ে এসেছে, তখন বিজ্ঞানী গ্যালেন (Galen) পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণ করে বললেন, মানুষের বুদ্ধিমত্তায় মস্তিষ্কের গভীর প্রভাব রয়েছে। তিনি বললেন, শব্দ উৎপাদনের জন্য পরিপূর্ণ মস্তিষ্কের প্রয়োজন। বিজ্ঞান এই ধারণার মধ্যেই বহুদিন স্থিতিশীল ছিল।
নতুন বিজ্ঞানীদের অনেকেই অ্যারিস্টটলের ধারণাকে ব্যঙ্গ করেছিলেন এ জন্য যে, বিজ্ঞানীরা নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করেন, মানুষের মস্তিষ্কই শরীরের সকল কাজের পরিচালক। ফলে আধুনিক বিজ্ঞানীদের কাছে বৃদ্ধ অ্যারিস্টটল হাস্যস্পদ হয়েই রইলেন। আধুনিক বিজ্ঞানীদের ধারণামতে, হৃৎপিণ্ড প্রাণিদেহে রক্ত সঞ্চালনকারী এক টুকরো মাংসপিণ্ড, যা অনবরত পাম্প করে শরীরের সকল অঙ্গে রক্ত সংবহন স্বাভাবিক রাখে। মানুষের মনের ওপর তার কোনো প্রভাব নেই।
অতি অধুনা আশ্চর্যজনকভাবে বিজ্ঞানীরা অনুধাবন করতে শুরু করেছেন, অ্যারিস্টটল সম্পূর্ণরূপে ভুল ছিলেন না। বিজ্ঞানীরাও মনে করতে শুরু করেছেন, হৃৎপিণ্ড শুধু রক্ত সঞ্চালনকারী অঙ্গ নয়, এর নিজস্ব স্নায়ুতন্ত্র রয়েছে এবং তা প্রায় ৪০ হাজার নিউরন দিয়ে গঠিত। এই নিউরনগুলো শরীরের অন্যন্য অঙ্গের তুলনায় কিছুটা আলাদা ও বিভিন্ন উপায়ে ও বিস্তৃতভাবে সংযুক্ত এবং তারা সংবেদনশীলতার পাশাপাশি মস্তিষ্ক কর্তৃক ও বিভিন্ন গ্ল্যান্ড থেকে ক্ষরিত নানা প্রকার রাসায়নিক পদার্থকে শনাক্ত করতে সক্ষম; আগত হরমোন ও নানাবিদ রাসায়নিক পদার্থের মধ্যে তার প্রয়োজনীয় অংশটুকু চিনে নিতে সক্ষম। তারা স্বাধীনভাবে তাদের নিজ দক্ষতায় কাজ করে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, হৃৎপিণ্ডের খুদে মস্তিষ্ক রয়েছে, যে কারণে তার প্রতিস্থাপন করা যায়। কারণ সাধারণত শরীরের অন্যান্য অঙ্গে কাটা পড়া স্নায়ু পুনঃসংযুক্ত হয় না।
বৈদ্যুতিক পালসের মাধ্যমে হৃৎপিণ্ডের পাম্পিং ক্রিয়া সচল রাখা ছাড়াও এই স্নায়ুতন্ত্রের বহুবিধ কাজ রয়েছে। সম্ভবত সে কারণেই কোনো প্রাণী অজ্ঞান হলেও তার হৃৎপিণ্ড সম্পূর্ণ সচল থাকে। তা ছাড়া আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা লক্ষ করেছেন, হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপনে রোগীর মধ্যে সক্রিয়তার অনেক পরিবর্তন আসে। আরও দেখা গেছে, রোগীর মধ্যে হৃৎপিণ্ডদাতার কিছু বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, মস্তিষ্ক ও হৃৎপিণ্ড সমন্বিতভাবে কাজ করে। হৃৎপিণ্ড যদি সম্পূর্ণই মস্তিষ্কের নির্দেশে কাজ করত, তবে সমন্বয় বা বোঝাপড়ার প্রয়োজন হতো না। শুধু মস্তিষ্কের নির্দেশ মেনে চলত।
অনেক সময় দেখা গেছে, আক্রান্ত হৃৎপিণ্ডের কার্যপ্রণালিতে নানাবিধ পরিবর্তনের ফলে মস্তিষ্ক তার সঙ্গে মানিয়ে তার নিজের কাজ পরিচালনা করে, বিশেষ করে মেধা ও সচেতনতার ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন আসে। মানুষের মেধার উন্নয়ন আজও বিজ্ঞানের কাছে এক বিস্ময়। বিজ্ঞান বুঝতে পারছে, গুণিতকভাবে মানুষের মেধার উন্নয়ন হচ্ছে। তা মস্তিষ্কের কোনো অংশ এই উন্নয়নকাজ সাধন করছে এবং তা কোথায় স্থায়িত্ব লাভ করছে, তা-ও আজ বিজ্ঞানের কাছে প্রশ্নবোধক।
বিজ্ঞান বলছে, মানুষের মস্তিষ্কের সম্মুখভাগ বা টেম্পোরাল লোব চিন্তাভাবনার কাজ করে আর সেরেব্রাম এই টেম্পোরাল লোবের সহায়তায় আবেগ নিয়ন্ত্রণ, স্মৃতিধারণ এবং চিন্তাশক্তি নামক জটিল বিষয়কে নিয়ন্ত্রণ করে। মস্তিষ্কের এই দুটি অঞ্চলের ক্ষমতা কতটুকু, তার উত্তর বিজ্ঞানের কাছে নেই। অতি নিম্ন প্রাণী থেকে ক্রমান্বয়ে এর উত্তরণ ঘটতে ঘটতে মানুষ পর্যন্ত এসে যে মাত্রা পেয়েছে, তার গড় নিয়ে যদি বিজ্ঞান কোনো হিসাব করতে চায়, তবে তা বিস্ময়করভাবে বিজ্ঞানীদের অবাক করবে। মানুষের বেলায় এই লেখচিত্রের আকৃতি যা হবে তাকে কোনো ক্রমিক উত্তরণ বলা চলে না। এবার প্রশ্ন হলো মানুষের বেলায় মেধার উন্নয়ন বিভিন্নজনের মধ্যে বিভিন্ন কেন? নিউরনের গঠন ও আকৃতিতে তো তেমন কোনো পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। তবে এই বৈষম্য ও মেধা বিকাশের ব্যাখ্যা কোথায়? এসব প্রশ্ন এখনো বিজ্ঞানের কাছে প্রশ্ন হয়েই আছে।
প্রাণীর মস্তিষ্ক নিয়ে আজকের বিজ্ঞানও গোলকধাঁধায় পড়ে আছে। কগনেটিভ সায়েন্স (Cognitive science) নামে বিজ্ঞানের এক বিশেষ শাখাই তৈরি হয়েছে, যার কাজ হলো প্রাণীর মনে চিন্তাভাবনা তৈরির বিষয়টি খতিয়ে দেখা। কীভাবে প্রাণীর মনে চিন্তাভাবনা সৃষ্টি হয়, কীভাবে প্রাণী তথা মানুষ নতুন নতুন চিন্তার মাধ্যমে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করে, সাধারণ স্নায়ুকোষ কীভাবে উজ্জীবিত হয়ে মস্তিষ্কে এই চেতনার সৃষ্টি করে-এসবই বিজ্ঞানের কাছে বিস্ময়কর ব্যাপার। বিজ্ঞানীরা নানা গবেষণার মাধ্যমে এসব বিষয় সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করছেন।
বিজ্ঞানীরা গভীরভাবে ভাবছেন, কী করে মানুষের মেধার পরিস্ফুটন ঘটে এবং তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়; কীভাবে মানুষের মনে ভাষার উৎপত্তি হয়, আবার কী করেই-বা কোনো বিষয় বা চিন্তিত ভাবনা স্মৃতি হয়ে মস্তিষ্কে জমা থাকে; এসবই বিজ্ঞানীদের কাছে নিষ্কলুষভাবে পরিষ্কার নয়। যদিও বিজ্ঞান বলছে, এসব কাজ সেরেব্রাম ফ্রন্টাল লোবের সহায়তায় করে থাকে, তবু সর্বগ্রাহ্য ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারছে না যে কীভাবে এ কাজগুলো সমাধা হচ্ছে। তারা শুধু ফলাফলটাকেই তুলে ধরছে।
প্রাণীর ভাষাজ্ঞান এক জটিল বিষয়। প্রাণী, বিশেষত মানুষ তার শিশু অবস্থায় পরিবেশ থেকে শ্রুত শব্দগুলো তার মস্তিষ্কের স্মৃতিকোষে সঞ্চিত করতে থাকে এবং তা তার নিজের মুখ দিয়ে বলতে শুরু করে। পরিবেশ থেকে শ্রুত শব্দগুলো তার মস্তিষ্কের স্মৃতিকোষে যাওয়া থেকে শুরু করে মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসা কথাগুলো অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়ায় সংঘটিত হয়। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি কীভাবে ঘটে, তা আজকের বিজ্ঞানের কাছেও পরীক্ষিতভাবে প্রমাণিত নয়; তবু বিজ্ঞান মনে করে, এই প্রক্রিয়াটি ঘটে থাকে মানুষের স্নায়ুকোষের কার্যকারিতার মাধ্যমে।
যৌক্তিকভাবে এটাই বলা যায়, শিশুটি তার শ্রবণেন্দ্রিয় দিয়ে যা গ্রহণ করে, তা মস্তিষ্ক কোষের মধ্যে অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়ায় অনেক অজানা পদ্ধতিতে স্মৃতিকোষে গিয়ে সঞ্চিত হয় এবং তা একসময় তার নিজের মুখ দিয়ে বলতে শুরু করে। বিষয়টা এখানেই শেষ নয়, শিশুটির যখন বয়ঃক্রমে জ্ঞান উন্মেষ ঘটে, তখন সে শুধু শ্রুত কথাগুলোই বলে না, সে তার মেধা দিয়ে নতুন নতুন কথা নিজে থেকে বানিয়ে বলতে থাকে। আমরা কি কবি-সাহিত্যিকদের কথা কখনো ভেবে দেখেছি, তারা অনর্গল শব্দ সৃষ্টি করে যাচ্ছেন, আপনি কি বলবেন এসব শব্দ তার স্মৃতিভান্ডার থেকে বেরিয়ে আসছে? আপনি আগে শুনতে পাননি এমন শব্দ কি কখনোই বলতে পারছেন না? বিজ্ঞান কি এ ক্ষেত্রে কোনো স্থির সিদ্ধান্ত দিতে পারে? যদি বলেন পারে, তবে ভাষাবিজ্ঞানীদের কথা ভাবুন, তারা অক্ষরের সঙ্গে অক্ষর জুড়ে কীভাবে একেবারে নতুন শব্দ তৈরি করেন? এ সবই প্রশ্ন। কোনো শিশুকে বালি নিয়ে খেলতে দেখেছেন? দেখবেন, সে তার মনের মতো করে ঘর বানায়, এগুলো হয়তো-বা এর আগে দেখেনি। মস্তিষ্কের উদ্ভাবনী ক্ষমতা আর তার স্মৃতি এক নয়। হয়তো বলতে পারেন, উদ্ভাবনী ক্ষমতাকে স্মৃতি সহযোগিতা করে; সে নিজের মনে অনেক সমস্যা তৈরি করে তা ভাবনা-চিন্তার মধ্য দিয়ে সমাধানও দিতে পারে।
এসবই হয় তার মেধাগত অর্জন। এই মেধার কীভাবে উন্মেষ ঘটে, বিজ্ঞান তার সর্বগ্রাহ্য ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। তবে এ-ও সত্য, বিজ্ঞানের পরীক্ষালব্ধ ফলাফল এড়িয়ে কেউ বাস্তবতার নিরিখে ভিন্ন কোনো চিত্র তুলে ধরতেও পারেনি। বিজ্ঞান যেমন পরীক্ষিতভাবে শেষ কথা বলতে পারেনি, তেমনি কল্পনাপ্রসূত হয়ে মনের কোনো সঠিক ঠিকানাও কেউ খুঁজে পায়নি। এমনই একটা টানাপোড়েনের মধ্যে ভাবুকেরা দোদুল্যমান হয়ে পড়েছে, হন্যে হয়ে খুঁজছে প্রকৃত ধারণা। প্রাচীনকাল থেকেই দর্শন, ধর্ম এমনকি মনস্তত্ত্বও মনের যে আলাদা অস্তিত্ব অনুভব করে আসছে, আজকের বিজ্ঞান তার বিরোধিতা করে ভিন্ন মেরুতে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু সমন্বয় করতে পারছে না। তার পরও সমাধানের আশায় ভাবুকেরা নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এ পর্যায়ে আমরা বিজ্ঞানের চিন্তাধারায় অতি সংক্ষেপে মানব মস্তিষ্কের যৎসামান্য গঠন-প্রকৃতি দেখব।
মস্তিষ্কের গঠন (Structure of brain)
বিজ্ঞান বলছে, মানুষের শরীরের যাবতীয় কাজ নিয়ন্ত্রণ করে তার মস্তিষ্ক। এই কাজ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তার সমগ্র শরীরে ছড়িয়ে থাকে এক বিশাল ও জটিল জালিকা, যাকে বলা হয় কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র বা সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম। আমাদের জ্ঞানে-অজ্ঞানে যাবতীয় ক্রিয়াকর্ম এই কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রই নিয়ন্ত্রণ করে। আমরা দেখে, শুনে, স্পর্শ করে বা স্বাদ নিয়ে যেসব তথ্য সংগ্রহ করি, তা এই জালিকা মস্তিষ্কে প্রেরণ করে, মস্তিষ্ক তা বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে আমাদের অঙ্গকে কার্যক্ষম করে তোলে। কেন্দ্রীয় মস্তিষ্ক থেকে সুষষ্মা কাণ্ডের মাধ্যমে সমগ্র শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। এই স্নায়ুতন্ত্র তৈরি হয় স্নায়ুকোষ দিয়ে, যাদের বলা হয় নিউরন। প্রায় এক হাজার কোটি (১০০০০০০০০০০০) নিউরন দিয়ে মানবদেহের স্নায়ুতন্ত্র তৈরি হয়।
মানবদেহের মতো স্নায়ুতন্ত্রও স্নায়ুকোষ বা নিউরন দিয়ে গঠিত হয়। এই স্নায়ুকোষের প্রধান অংশ হলো কোষ দেহ (Cell Body)। কোষ দেহ স্নায়ুকোষ বা নিউরনের প্রধান অংশ। নিউরনের মধ্যে থাকে নিউক্লিয়াস।
এ ছাড়া আছে এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম, রাইবোজম। নিউরনের দেহ নষ্ট হয়ে গেলে তার মৃত্যু ঘটে। সেল বডি বা দেহ থেকে তন্তু আকারে লম্বা লেজ বের হয়। এই লেজের আকৃতি বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে, যেমন আঙুলের ডগায় অবস্থিত নিউরনের লেজটি কনুই পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে; আবার মস্তিষ্কে অবস্থিত নিউরনের লেজ অত্যন্ত ছোট আকৃতির হয়ে থাকে।
বিজ্ঞানের ভাষায় এই লেজের নাম দেওয়া হয়েছে এক্সন, এটি অনেকটা সরু তারের মতো কাজ করে। এর উপরে প্রোটিনের আবরণ থাকে, যা এক্সনকে তড়িৎ রাসায়নিক সংকেত দ্রুততার সঙ্গে বহন করতে সহায়তা করে। এই আবরণটির নাম মায়েলিন শেথ। এক্সনের মাথায় তন্তুর মতো শিকড় দেখা যায়, এগুলো নিউরনের দেহ থেকেও বেরোতে পারে। এদের নাম ডেনড্রাইটস। নিউরনের সঙ্গে নিউরনের যোগাযোগ রাখতে এদের ব্যবহার হয়ে থাকে। এরা রিসিপ্টর বা অ্যান্টেনার কাজ করে থাকে। কার্যভেদে নিউরন বিভিন্ন প্রকার হয়ে থাকে।
যেমন ১. সেন্সরি নিউরন, ২. মোটর নিউরন, ৩. ইন্টার নিউরন।
সেন্সরি নিউরনের প্রধান কাজ হলো শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে প্রয়োজনীয় সংকেত গ্রহণ করে তা মস্তিষ্কে প্রেরণ করে। মস্তিষ্ক এসব সংকেত বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় কার্যাদেশ মোটর নিউরনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট স্থানগুলোতে প্রেরণ করে। ইন্টার নিউরনের কাজ হলো বিভিন্ন নিউরনের মধ্যে আন্তযোগাযোগ রক্ষা করা। এদেরকে বেশি দেখা যায় মস্তিষ্কে ও সুষষ্মা কাণ্ডে। এসব নিউরন মিলে শরীরের বিভিন্ন অংশে জটিল জালিকা তৈরি করে।
মস্তিষ্কের অংশগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচয়
মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে সামান্য পরিচিত হওয়া দরকার। উন্নত প্রাণীদের প্রত্যেকের শরীরের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ উল্লেখযোগ্য মস্তিষ্ক থাকলেও কিছু কিছু অমেরুদণ্ডী প্রাণীর মস্তিষ্ককে আলাদাভাবে বোঝার উপায় থাকে না, যেমন চিংড়ি মাছের কোনো কেন্দ্রীয় মস্তিষ্ক থাকে না, তাদের মস্তিষ্কের কাজ হয় শরীরের স্থানে স্থানে গুচ্ছাকারে থাকা ‘নিউরোনাল সেল বডির’ বিন্যাস দ্বারা, যাদেরকে বলা হয় গ্যাংলিয়া। এই গ্যাংলিয়া ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের কাজ করে থাকে। আরও একটু উন্নততর প্রাণীদের মধ্যে এই যোগাযোগকর্ম বিন্যাসের মাধ্যমে তৈরি করে সরল মস্তিষ্কের। এদের থেকে উন্নততর প্রাণীদের এই গ্যাংলিয়াগুলো পরস্পর যোগাযোগ করে তৈরি করে সরল মস্তিষ্কের। সাধারণত উন্নত প্রাণীদের মস্তিষ্কে নিম্নোক্ত অংশগুলো থাকবেই :
১. ব্রেইনস্টিম-এর মধ্যে থাকে মেডুলা, পনস, মিডব্রেইন। এই ব্রেইনস্টিমের কাজের মধ্যে প্রধানত রিফ্লেস্ক বা প্রতিবর্ত ক্রিয়া, কিছু স্বয়ংক্রিয় কাজ, যেমন হৃৎস্পন্দনের হার, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা এবং বিভিন্ন অঙ্গের সঞ্চালন ও আন্ত্রিক কাজ পরিচালনা করা।
২. সেরেবেলাম-এটি প্রাণিদেহের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
৩. হাইপোথ্যালামাস ও পিটুইটারি গ্রন্থিÑএরা মানবদেহের প্রয়োজনীয় হরমোন নিঃসরণ করে।
৪. সেরেব্রাম-এটি মস্তিষ্কের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। একে সেরেব্রাল কর্টেক্স বা কর্টেক্সও বলা হয়। এর প্রধান কাজ হলো শরীরের বিভিন্ন ইন্দ্রিয় থেকে সংকেত বা তথ্য সংগ্রহ করে সমস্যার সমাধান করে তা মোটর নিউরনের সাহায্যে যথাস্থানে পৌঁছে দিয়ে প্রয়োজনীয় কাজ সিদ্ধি করা। আবেগ নিয়ন্ত্রণ, স্মৃতিধারণ এবং চিন্তাশক্তি নামক জটিল বিষয়কে নিয়ন্ত্রণ করাও এই অংশেরই কাজ।
এখানে বিজ্ঞান বলছে, সেরেব্রাম প্রাণীর ইন্দ্রিয়প্রদত্ত সংকেত নিয়ে কাজ করে, যেমন ধরুন আপনার আঙুলের আগায় কোনো বস্তুর স্পর্শ লাগল, এই সংকেত সেন্সরি নিউরন সেরেব্রাম অঞ্চলে প্রেরণ করে আর এই অঞ্চল সেই সংকেতের বিশ্লেষণ করে তার ফলাফল অর্থাৎ স্পর্শের গভীরতা তার অবস্থান যন্ত্রণা ইত্যাদির অনুভূতি তৈরি করে এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনাবলি মোটর নিউরনের সাহায্যে আঙুলের ডগায় প্রেরণ করে। বিজ্ঞান আরও বলছে, মস্তিষ্ক কোনো ইন্দ্রিয় থেকে সংকেত বা নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত কার্যক্ষম হয় না। এখন প্রশ্ন হলো মানুষের আবেগ-ভালোবাসা বা বিশ্বাস এই অনুভূতিগুলো সৃষ্টি হয় কোনো ইন্দ্রিয়ের তাড়নায়? আমরা ধীরে ধীরে এই প্রশ্নের জবাব বুঝতে চেষ্টা করব।
আমরা জানি, মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী উন্নততর কোনো চিন্তাভাবনা করতে পারে না। নিম্ন প্রাণীদের চিন্তাভাবনার ক্ষেত্র খুবই সীমিত, কোনো কিছু নিয়ে ভেবে দেখার অবকাশ তারা পায় না। তাহলে প্রশ্ন জাগে, নিম্ন শ্রেণির প্রাণী, যেমন গৃহপালিত পশুপাখি বা বন্য প্রাণীরা তাদের দৈনন্দিন চাহিদা বা প্রয়োজনীয়তা বোঝে কী করে। বিস্ময়করভাবে লক্ষ করা গেছে, নিম্ন প্রাণীদের দৈনন্দিন জীবন কিন্তু থেমে নেই। তারাও কিন্তু উন্নত প্রাণীদের মতোই তাদের জীবন তাদের মতো করে পরিচালনা করে।
উন্নত প্রাণী মানুষ আর নিম্ন প্রাণীদের মস্তিষ্কের মধ্যে প্রধান পার্থক্য হলো মানুষ যেকোনো সময় চিন্তাভাবনা করে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে তার প্রবৃত্তির পরিবর্তন ঘটাতে পারে, কিন্তু নিম্ন প্রাণীরা তার প্রবৃত্তি অনুযায়ী দৈনন্দিন জীবন পরিচালনা করে। আর এই জীবনব্যবস্থা একটা সুনির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে ব্যাপৃত, চাইলেই সে তার জীবনব্যবস্থাকে পরিবর্তন করতে পারে না। তা ছাড়া উভয় শ্রেণির মধ্যেই কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যাদেরকে বলে প্রবৃত্তি। বিজ্ঞান বলছে, এই প্রবৃত্তিমূলক কাজগুলো নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্কের নিম্নভাগ।
মস্তিষ্কের নিম্নভাগে রয়েছে মেডুলা, পনস, মিডব্রেইন। মেডুলা হলো সুষষ্মা কাণ্ডের ঠিক উপরের স্ফীত অংশ। এই অংশের মধ্য দিয়ে শরীরের বিভিন্ন অঞ্চলের সংকেত মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চলে যাতায়াত করে। এ ছাড়া মস্তিষ্কের উপরের দিকে কয়েকটি বড় বড় অংশ রয়েছে। তার মধ্যে প্যারাইটাল লোব, ফ্রন্টাল লোব, অক্সিপেটাল লোব, টেম্পোরাল লোব, ইনসুলা উল্লেখযোগ্য।
মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চলের কাজ
প্যারাইটাল লোবÑপ্যারাইটাল লোবের সঙ্গে শরীরের বিভিন্ন অঞ্চল সংযুক্ত থাকে। এরা শরীরের বহিঃত্বক থেকে আসা বিভিন্ন সংবেদনশীলতা, যেমন চাপ, স্পর্শ, ব্যথা ইত্যাদির অনুভব সৃষ্টি করে এবং প্রয়োজনীয় আদেশ-নিষেধ প্রদান করে। প্যারাইটাল লোবের পেছন দিকে ওয়ের্নকাস অঞ্চল অবস্থিত। ভাষা-সংক্রান্ত ব্যাপারে এর ভূমিকা অপরিসীম। শ্রবণ-দর্শন সংকেত সংশ্লেষণের কাজে সহযোগিতা করে।
ফ্রন্টাল লোব-মস্তিষ্কের অতীব গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলটি মেধা ও সক্রিয়তা সৃষ্টির অঞ্চল। মানুষের চিন্তা, বোধ, মননশীলতার মতো জটিল কাজগুলো নিয়ন্ত্রণ করে এই অংশটি। তা ছাড়া চলন, গমন, বিভিন্ন অঙ্গের নাড়াচাড়া অর্থাৎ মোটর ফাংশন নিয়ন্ত্রণ করে ফ্রন্টাল লোবের পেছন দিকে থাকা মোটর কেন্দ্র। প্যারাইটাল লোব ও সোমাটোসেনসরি অংশ থেকে মোটর কেন্দ্র সংকেত আহরণ করে তা ফ্রন্টাল লোবের সহায়তায় প্রয়োজনীয় কাজ পরিচালনা করে।
অক্সিপিটাল লোব-এর কাজ হলো চোখ থেকে আসা দৃষ্টি সংকেতকে প্যারাইটাল লোবের ওয়ের্নিকাস ও ফ্রন্টাল লোবের মোটর কেন্দ্রের সহযোগতায় মস্তিষ্কে বাইরের দৃশ্যপটের ছবি তৈরি করে। ছবি তৈরিতে এর বিস্ময়কর ভূমিকা হলো রেটিনায় পতিত উল্টো ছবিটাকে মস্তিষ্কে সঠিকভাবে তৈরি করা। ছবি তৈরির কাজটি অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়া। বড় কোনো বস্তুর প্রতিবিম্ব দেখতে হলে আমাদের একটি বড় আয়নার দরকার হয়, কিন্তু পরীক্ষায় জানা গেছে, আমাদের মস্তিষ্কে একটা ক্ষুদ্র বিন্দুর সমস্থানে আমরা বিশাল দৃশ্যপটের প্রতিবিম্ব দেখি; যা পদার্থবিজ্ঞানের নীতি নিয়মে ব্যাখ্যা করা যায় না। বিজ্ঞান এ ক্ষেত্রে বিস্মিত।
টেম্পোরাল লোবÑশ্রবণেন্দ্রিয় থেকে শব্দ সংকেত গ্রহণ করে এটি ওয়ের্নিকাস ও মোটর কেন্দ্রের সহযোগিতায় তা শ্রবণ উপযোগী করে তোলে। ইনসুলা নামের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ রয়েছে, যা শরীরের ছোটখাটো বা সূক্ষ্ম সঞ্চালন-প্রক্রিয়াকে পরিচালনা করে।
আমরা উপরের আলোচনা থেকে অতি সংক্ষিপ্তভাবে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের কার্যপ্রণালি জানতে পেলাম। এ ছাড়া মস্তিষ্ক যে কত বিস্ময়করভাবে হাজারো কাজ পরিচালনা করে, তা স্বল্প পরিসরে ব্যাখ্যা করার উপায় নেই। এই আলোচনা থেকে পরিষ্কারভাবে বোঝা গেল, মস্তিষ্কই হলো প্রাণিদেহের সকল কাজের নিয়ন্ত্রণকারী। আরও বোঝা গেল, মস্তিষ্ক নিজে থেকে উদ্যোগী হয়ে কোনো কাজ করে না। যেকোনো অঙ্গের চাহিদামতো তার কাজ পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। এই আলোচনায় আমাদের যে মৌলিক জিজ্ঞাসা, তা হলো বিভিন্ন অঙ্গের চাহিদার পাশাপাশি আমাদের যে মননশীলতা বা মনের চাহিদা, তা কোনো অঙ্গের জিজ্ঞাসা থেকে সৃষ্টি হয়।
যদি বলা হয় মন নামক দৃশ্য বা অদৃশ্য অঙ্গ আছে! তবে তার অবস্থান কোথায়? বিজ্ঞান পরিষ্কারভাবে মনের অবস্থান ব্যাখ্যা করেনি। বলছে, মানুষের সেরিব্রামের সহায়তায় ফ্রন্টাল লোব এই মননশীলতার জন্ম দেয়। এ ক্ষেত্রেও বিজ্ঞান স্ববিরোধী। মননশীলতার এই বৈজ্ঞানিক ধারণা যদি সঠিক হয়, তবে প্রশ্ন হলো এই দুই অঞ্চল কোন অনুপ্রেরণা থেকে এ কাজে উদ্যোগী হয়? কারণ মস্তিষ্ক বিনা উদ্যোগে কোনো কাজে ব্রতী হয় না। যদি বলা হয়, মানুষ তার দৃষ্টি ইন্দ্রিয় দিয়ে কোনো কিছু দেখে ওই দুই অঞ্চলের সহযোগিতায় ভাবনা-চিন্তা করে বা অনুরূপভাবে শ্রবণেন্দ্রিয় দ্বারা সংগৃহীত তথ্য নিয়েও মস্তিষ্ক ভাবনা-চিন্তা করতে পারে, তবে মানুষ যখন দৃষ্টি ও শ্রবণ ছাড়া জটিল চিন্তায় নিমগ্ন হয়, তখন মস্তিষ্ক কীভাবে তা সমন্বয় করে? যদি বলা হয়, মানুষের মনের অবস্থান মস্তিষ্কে এবং সেটিই মস্তিষ্কে এই অনুভূতি জাগায়, কিন্তু বিজ্ঞান সেই অবস্থানটির খোঁজ এখনো পায়নি।
বিজ্ঞান এর কোনো খোঁজ দিতে না পারলেও মানুষ কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের জন্মের আগে থেকেই তার খোঁজ পেয়েছে। আবেগে আপ্লুত হয়ে তার নাম দিয়েছে মন বা অন্তর। তবে মনের সঠিক অবস্থানটি কেউ সঠিকভাবে বলতে পারছে নাÑকেউ বলছেন এর অবস্থান হৃৎপিণ্ডে, কেউ বলছেন মস্তিষ্কে। মানুষ তার সীমিত মেধা দিয়ে যা-ই বলুক না কেন, এই বিশ্বসংসারের মহান স্রষ্টা বলছেন, মন মানুষের হৃৎপিণ্ডে অবস্থিত। মনের এই অবস্থান নিয়ে পবিত্র কোরআনে প্রচুর আয়াত নাজিল হয়েছে, যা থেকে ধরে নেওয়া যায়, মানুষের ভাবনা-চিন্তার ওপর মনের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। মন মানুষের মস্তিষ্কে কিছু সুনির্দিষ্ট ভাবনার উদ্রেক করে, যা অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের প্রভাবমুক্ত। মনের সঙ্গে মস্তিষ্কের ভাবনা-চিন্তার কেন্দ্রের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। বলতে গেলে দু-দুটো কেন্দ্রই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
মনকে বাদ দিয়ে মস্তিষ্কের ভাবনা-চিন্তার কথা যেমন কল্পনা করা যায় না, তেমনি মস্তিষ্ককে বাদ দিয়ে মন কোনো ভাবনা-চিন্তা করতে পারে না। মূলত মন বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ভাবনা-চিন্তার উদ্রেক তৈরি করে আর মস্তিষ্ক তার সম্প্রসারণ ঘটায়। মূলত ভাবনা-চিন্তার কাজ ও তার ফলে পরিকল্পনা গ্রহণ ইত্যাদি সবই মস্তিষ্কের কাজ। এই আলোচনায় একটা বিষয় পরিষ্কার, ভাবনা-চিন্তার কাজটি মস্তিষ্কই সম্পন্ন করে, মন কেবলই তার জোগানদাতা।