নিউইয়র্কবাসীর চোখ এখন সিটি নির্বাচনের ওপর। সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে উজ্জ্বল ও গৌরবান্বিত এই সিটির মেয়র কে হতে চলেছেন—ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জোহরান মামদানি, স্বতন্ত্র প্রার্থী অ্যান্ড্রু ক্যুমো নাকি রিপাবলিকান প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়া—এই জটিল প্রশ্নের উত্তরের জন্য নগরবাসীকে অপেক্ষা করতে হবে আগামী মঙ্গলবার অনুষ্ঠেয় চূড়ান্ত ভোট গণনা পর্যন্ত। এই ভোট শুধু একজন প্রশাসক বেছে নেওয়ার নয়; এটি নির্ধারণ করবে বহুদিনের ক্ষমতার ভারসাম্য, শহরের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক দিকনির্দেশ।
ফেডারেল শাটডাউন, ওয়াশিংটন-নিউইয়র্ক সম্পর্কের টানাপোড়েন, অভিবাসন নীতির কড়াকড়ি আর জীবিকার ব্যয়বৃদ্ধি—সবকিছু মিলিয়ে শহরটি যেন বৈপরীত্যের প্রতীক। একদিকে ওয়াল স্ট্রিটের পুঁজিবাদ, অন্যদিকে অকুপাই আন্দোলনের প্রতিবাদ; আকাশচুম্বী ভবনের শহর আবার একই সঙ্গে ভাড়ার দুঃস্বপ্নে ক্লান্ত নাগরিকদের নগর। এই নির্বাচনে মূল ইস্যু হয়ে উঠেছে জীবনযাপনের সাশ্রয়, আবাসন, ট্রানজিট খরচ এবং শহরে টিকে থাকার প্রশ্ন।
তরুণ প্রার্থী জোহরান মামদানি, ৩৪ বছরের প্রগতিশীল অ্যাসেম্বলিম্যান, নিজেকে ‘অ্যাফোর্ডেবিলিটি’র প্রার্থী হিসেবে তুলে ধরেছেন। গণপরিবহন, শিশুসেবা, ভাড়া নিয়ন্ত্রণ ও মধ্যবিত্তের টিকে থাকার প্রশ্নই তার প্রচারের কেন্দ্রবিন্দু। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘এই শহর ট্রাম্পকেও সৃষ্টি করেছে’—যেন শহরের দ্বৈত চরিত্রের প্রতি এক আত্মসমালোচনার ইঙ্গিত।
অন্যদিকে সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু ক্যুমো স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অভিজ্ঞতা ও প্রশাসনিক সক্ষমতাকে হাতিয়ার করছেন। তার সতর্কবাণী—মামদানি জিতলে ফেডারেল সরকার নিউইয়র্ককে চাপের মুখে ফেলবে।
রিপাবলিকান প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়া বরাবরের মতো আইনশৃঙ্খলা ও ‘শহরের নিরাপত্তার ইস্যুতে প্রচার চালাচ্ছেন। উপরতলায় বসে ওয়াশিংটন নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে—বাজেট, অনুদান, অভিবাসন অভিযান বা ফেডারেল সংস্থার হস্তক্ষেপ—সবই নির্ধারণ করতে পারে নিউইয়র্কবাসীর ভবিষ্যৎ।
অভিবাসীদের শহর হওয়া সত্ত্বেও এখন অনেকেই আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। ৯/১১-পরবর্তী ঐক্যের প্রতীক এই নগর এবার তার প্রথম মুসলিম মেয়র দেখতে পারে—যা একদিকে মুসলিম ভোটারদের গর্বিত করেছে, আবার অন্যদিকে কিছু গোষ্ঠীতে উদ্বেগও সৃষ্টি করেছে। নিউইয়র্ক, যা দীর্ঘদিন ধরে আমেরিকার ইহুদি জীবনের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত, এখন ইসরায়েল নীতি নিয়ে গভীর বিভাজনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ধর্ম, রাজনীতি ও সামাজিক সহাবস্থানের সূক্ষ্ম রেখাগুলো আরও জটিল হয়ে উঠেছে।
শহরের প্রভাবশালী ভোটব্যাংক—ব্যবসায়ী মহল, প্রাচীন ডেমোক্র্যাট জোট, রক্ষণশীল ইহুদি গোষ্ঠী, কৃষ্ণাঙ্গ ভোটার—কার দিকে যাবে, তা এখনো অনিশ্চিত। ক্যুমো দাবি করছেন, তিনিই ‘ট্রু ডেমোক্র্যাট’, শহর আসলে ততটা বদলায়নি। মামদানির পক্ষের যুক্তি, পরিবর্তনের স্রোত থামানো যাবে না—উচ্চ ভাড়া ও জীবনযাপনের ব্যয় মানুষকে নতুন রাজনীতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। স্লিওয়া চেষ্টা করছেন মধ্যবিত্ত ক্ষোভকে ভোটে রূপ দিতে, বিশেষ করে বাইরের বরোগুলোর নিরাপত্তা উদ্বেগকে কেন্দ্র করে।
ওয়াশিংটনে নিউইয়র্কের প্রভাবও কম নয়—চাক শুমার, হাকিম জেফ্রিস, আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্টেজ—সবাই শহরটির প্রতিনিধি। তবু বাস্তবে নিউইয়র্কের ভাগ্য নির্ধারণে তারা অনেক সময়ই অসহায়। ফেডারেল বরাদ্দ, আদালতের আদেশ, নির্বাহী সিদ্ধান্ত—সব মিলিয়ে শহরের স্বাধীনতা প্রায়ই কেন্দ্রের ছায়ায় ঢাকা পড়ে। পূর্বতন মেয়র এরিক অ্যাডামসের বিরুদ্ধে মামলার অভিজ্ঞতা সেই বাস্তবতার প্রমাণ।
নিউইয়র্ক আসলে এক শহরের ভেতর বহু শহর—আট মিলিয়নের বেশি মানুষ, হাজারো পাড়া-মহল্লা, প্রতিটিতে আলাদা ইতিহাস ও দাবি। তাই এই নির্বাচনে বড় কথার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ছোট ছোট ইঙ্গিত—কে কার আস্থা জিততে পারছেন, কার বার্তা পৌঁছাচ্ছে বাস্তব সমস্যার ভেতর, আর কে ফেডারেল চাপের ভেতরেও শহরকে এগিয়ে নিতে পারবেন।
রায় আসবে ৪ নভেম্বর মঙ্গলবার। তার পরও নিউইয়র্ক থাকবে আগের মতোই—সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে জেদি, সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় শহর হিসেবে। কিন্তু ভোটের ফলাফলের পর শুরু হবে আসল লড়াই—বাজেট ঘাটতি সামলে উন্নয়ন চালিয়ে যাওয়া, অভিবাসন আতঙ্কের বাস্তব সংযম, সব ধর্ম ও সম্প্রদায়ের আস্থা পুনর্গঠন আর শহরকে আবার বাসযোগ্য রাখা।
নিউইয়র্ক কোনো সাধারণ শহর নয়—এটাই মানদণ্ড, যে শহরকে দেখে আমেরিকা নিজের প্রতিচ্ছবি খোঁজে। তাই এই নির্বাচনের রায় কেবল এক মেয়রের ভাগ্য নির্ধারণ করবে না, বরং আমেরিকার আত্মপরিচয়কেও নতুনভাবে প্রকাশ করবে—একটু বেশি স্পষ্টভাবে, একটু বেশি নির্মমভাবে।
ঠিকানা/এনআই
ফেডারেল শাটডাউন, ওয়াশিংটন-নিউইয়র্ক সম্পর্কের টানাপোড়েন, অভিবাসন নীতির কড়াকড়ি আর জীবিকার ব্যয়বৃদ্ধি—সবকিছু মিলিয়ে শহরটি যেন বৈপরীত্যের প্রতীক। একদিকে ওয়াল স্ট্রিটের পুঁজিবাদ, অন্যদিকে অকুপাই আন্দোলনের প্রতিবাদ; আকাশচুম্বী ভবনের শহর আবার একই সঙ্গে ভাড়ার দুঃস্বপ্নে ক্লান্ত নাগরিকদের নগর। এই নির্বাচনে মূল ইস্যু হয়ে উঠেছে জীবনযাপনের সাশ্রয়, আবাসন, ট্রানজিট খরচ এবং শহরে টিকে থাকার প্রশ্ন।
তরুণ প্রার্থী জোহরান মামদানি, ৩৪ বছরের প্রগতিশীল অ্যাসেম্বলিম্যান, নিজেকে ‘অ্যাফোর্ডেবিলিটি’র প্রার্থী হিসেবে তুলে ধরেছেন। গণপরিবহন, শিশুসেবা, ভাড়া নিয়ন্ত্রণ ও মধ্যবিত্তের টিকে থাকার প্রশ্নই তার প্রচারের কেন্দ্রবিন্দু। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘এই শহর ট্রাম্পকেও সৃষ্টি করেছে’—যেন শহরের দ্বৈত চরিত্রের প্রতি এক আত্মসমালোচনার ইঙ্গিত।
অন্যদিকে সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু ক্যুমো স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অভিজ্ঞতা ও প্রশাসনিক সক্ষমতাকে হাতিয়ার করছেন। তার সতর্কবাণী—মামদানি জিতলে ফেডারেল সরকার নিউইয়র্ককে চাপের মুখে ফেলবে।
রিপাবলিকান প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়া বরাবরের মতো আইনশৃঙ্খলা ও ‘শহরের নিরাপত্তার ইস্যুতে প্রচার চালাচ্ছেন। উপরতলায় বসে ওয়াশিংটন নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে—বাজেট, অনুদান, অভিবাসন অভিযান বা ফেডারেল সংস্থার হস্তক্ষেপ—সবই নির্ধারণ করতে পারে নিউইয়র্কবাসীর ভবিষ্যৎ।
অভিবাসীদের শহর হওয়া সত্ত্বেও এখন অনেকেই আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। ৯/১১-পরবর্তী ঐক্যের প্রতীক এই নগর এবার তার প্রথম মুসলিম মেয়র দেখতে পারে—যা একদিকে মুসলিম ভোটারদের গর্বিত করেছে, আবার অন্যদিকে কিছু গোষ্ঠীতে উদ্বেগও সৃষ্টি করেছে। নিউইয়র্ক, যা দীর্ঘদিন ধরে আমেরিকার ইহুদি জীবনের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত, এখন ইসরায়েল নীতি নিয়ে গভীর বিভাজনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ধর্ম, রাজনীতি ও সামাজিক সহাবস্থানের সূক্ষ্ম রেখাগুলো আরও জটিল হয়ে উঠেছে।
শহরের প্রভাবশালী ভোটব্যাংক—ব্যবসায়ী মহল, প্রাচীন ডেমোক্র্যাট জোট, রক্ষণশীল ইহুদি গোষ্ঠী, কৃষ্ণাঙ্গ ভোটার—কার দিকে যাবে, তা এখনো অনিশ্চিত। ক্যুমো দাবি করছেন, তিনিই ‘ট্রু ডেমোক্র্যাট’, শহর আসলে ততটা বদলায়নি। মামদানির পক্ষের যুক্তি, পরিবর্তনের স্রোত থামানো যাবে না—উচ্চ ভাড়া ও জীবনযাপনের ব্যয় মানুষকে নতুন রাজনীতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। স্লিওয়া চেষ্টা করছেন মধ্যবিত্ত ক্ষোভকে ভোটে রূপ দিতে, বিশেষ করে বাইরের বরোগুলোর নিরাপত্তা উদ্বেগকে কেন্দ্র করে।
ওয়াশিংটনে নিউইয়র্কের প্রভাবও কম নয়—চাক শুমার, হাকিম জেফ্রিস, আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্টেজ—সবাই শহরটির প্রতিনিধি। তবু বাস্তবে নিউইয়র্কের ভাগ্য নির্ধারণে তারা অনেক সময়ই অসহায়। ফেডারেল বরাদ্দ, আদালতের আদেশ, নির্বাহী সিদ্ধান্ত—সব মিলিয়ে শহরের স্বাধীনতা প্রায়ই কেন্দ্রের ছায়ায় ঢাকা পড়ে। পূর্বতন মেয়র এরিক অ্যাডামসের বিরুদ্ধে মামলার অভিজ্ঞতা সেই বাস্তবতার প্রমাণ।
নিউইয়র্ক আসলে এক শহরের ভেতর বহু শহর—আট মিলিয়নের বেশি মানুষ, হাজারো পাড়া-মহল্লা, প্রতিটিতে আলাদা ইতিহাস ও দাবি। তাই এই নির্বাচনে বড় কথার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ছোট ছোট ইঙ্গিত—কে কার আস্থা জিততে পারছেন, কার বার্তা পৌঁছাচ্ছে বাস্তব সমস্যার ভেতর, আর কে ফেডারেল চাপের ভেতরেও শহরকে এগিয়ে নিতে পারবেন।
রায় আসবে ৪ নভেম্বর মঙ্গলবার। তার পরও নিউইয়র্ক থাকবে আগের মতোই—সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে জেদি, সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় শহর হিসেবে। কিন্তু ভোটের ফলাফলের পর শুরু হবে আসল লড়াই—বাজেট ঘাটতি সামলে উন্নয়ন চালিয়ে যাওয়া, অভিবাসন আতঙ্কের বাস্তব সংযম, সব ধর্ম ও সম্প্রদায়ের আস্থা পুনর্গঠন আর শহরকে আবার বাসযোগ্য রাখা।
নিউইয়র্ক কোনো সাধারণ শহর নয়—এটাই মানদণ্ড, যে শহরকে দেখে আমেরিকা নিজের প্রতিচ্ছবি খোঁজে। তাই এই নির্বাচনের রায় কেবল এক মেয়রের ভাগ্য নির্ধারণ করবে না, বরং আমেরিকার আত্মপরিচয়কেও নতুনভাবে প্রকাশ করবে—একটু বেশি স্পষ্টভাবে, একটু বেশি নির্মমভাবে।
ঠিকানা/এনআই