মনের ওপর জোর চলে না

প্রকাশ : ১৬ অক্টোবর ২০২৫, ১২:২৪ , অনলাইন ভার্সন
সেদিন স্কুল থেকে একটা ইমেইল পেলাম, আমরা যারা প্রাইমারি বা সেকেন্ডারি স্কুলে কাজ করি, আমাদের সবাইকে একটা আবশ্যকীয় ট্রেনিং নিতে হবে মানসিক সুস্থতা-সংক্রান্ত। এটা টেক্সাস স্টেট থেকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে সকল কর্মীর জন্য, যারা প্রতিদিন স্কুলের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কাজ করে বা স্কুলের কোনো কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই ভিডিও ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে স্কুলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে, যাতে তারা প্রাথমিকভাবে স্কুলের ছেলেমেয়েদের মধ্যে মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ দেখলে শনাক্ত করতে পারে এবং পরবর্তীতে তাদেরকে স্কুলের কাউন্সেলর বা বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে পরামর্শ দিতে পারে।

ছেলেমেয়েদের মধ্যে যেসব অস্বাভাবিকতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়, সেগুলো হলো বিষণ্নতা, মানসিক অবসাদ, চড়া মেজাজ, ক্লাসের কোনো কাজে অনীহা, অন্যের প্রতি ভীতি, সর্বদা আশঙ্কা ও উদ্বেগ প্রকাশ। এ ছাড়া বাড়িতে কোনো শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে বোঝা গেলে অথবা আত্মহত্যা করার মতো কোনো বার্তা বা সংকেত দিয়ে থাকলে তা সঠিক সময়ে শনাক্ত করাও বিশেষভাবে জরুরি।

প্রতিবছর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস পালিত হয় ১০ অক্টোবর। বিশ্বজুড়ে এই দিনটি পালনের মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা হয় এবং পরিচিতজন ও আশপাশের মানুষের মধ্যে মানসিক সমস্যায় আক্রান্তদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে উদ্বুদ্ধ করা হয়। বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের এ বছরের প্রতিপাদ্যÑবিশ্বব্যাপী কোনো জরুরি বা দুর্যোগপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হলে সবাই যেন তাদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার সুযোগ ও সাহায্য পায়। যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পুনর্বাসন-এ রকম বিভিন্ন বৈশ্বিক সংকটের সময় সাধারণ মানুষ যাতে মানসিক ব্যাধির চিকিৎসা পেতে পারে, তার কথা মনে রেখেই এ বছরের প্রতিপাদ্য নির্বাচন করা হয়েছে।

মানসিক অসুস্থতা ইদানীংকালের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। এটা এমন একটা ব্যাপার, যা চোখে দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না, শুধু অনুভব করা যায়-নিজের মধ্যে, অন্য কারও মধ্যে অথবা আশপাশের কোনো চেনা মানুষের মাঝে। আর সে কারণেই বর্তমানে মানসিক অসুস্থতাকে শারীরিক অসুস্থতার চাইতেও বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।

শরীরে কোনো কাটাছেঁড়া, জ্বরজারি, মাথাব্যথা, গলাব্যথা হলে আমরা নিজেরাই বাড়িতে তার উপশমের ব্যবস্থা নিই। বড় ধরনের কোনো অসুখ হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হই। কিন্তু মানসিক কোনো যন্ত্রণা আমাদের যখন পীড়া দেয়, তখন প্রথমেই আমাদের মাথায় যে চিন্তাটা আসে, তা হলো চেপে যাওয়া বা লুকিয়ে রাখা। আমরা মন খুলে কারও সঙ্গে এটা নিয়ে আলাপ করতে ভয় পাই। পাছে আমাদের কেউ পাগল ভাবে।

আমাদের বাঙালি সমাজে পাগল হিসেবে চিহ্নিত হওয়াটা খুব গর্হিত একটি কাজ। ছোটবেলা থেকেই এটা আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। যেকোনো ধরনের মানসিক অস্বাভাবিকতা দেখা দিলেই বলা হবে, তুমি পাগল। কথায় কথায় বলা হবে, তোমাকে পাবনার পাগলা গারদে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত। এই কথাটা শুনতে আমরা বাঙালিরা ভীষণভাবে অভ্যস্ত। তাই আমরা আমাদের মানসিক পীড়ার কারণটা খুব সাবধানে লুকিয়ে রাখতে চাই। আর সেটা যদি কোনোভাবে বের হয়ে আসে, তাহলে আমরা তা অস্বীকার করি বা ডাক্তারের কাছে যেতে অস্বীকৃতি জানাই।
মানসিক অসুস্থতা অনেকের জন্য প্রতিদিনের যুদ্ধ, অনেকের কাছে এটা নিত্যবাস। অনেকে নিজের মধ্যে ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে দিনের পর দিন কাটাচ্ছে, কাউকে বলতে পারছে না। অনেকে তার পরিবারের কোনো সদস্যের মধ্যে মানসিক সমস্যা দেখতে পাচ্ছে, তার সঙ্গে দিনের পর দিন কাটাচ্ছে, কাউকে বলতে পারছে না। তাই এ ব্যাপারে আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা খুবই জরুরি।

আমাদের জীবন ব্যস্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। পারিবারিক দায়িত্ব, চাকরি-বাকরি, পড়াশোনা, সামাজিক সম্পর্ক, নৈতিক দায়িত্বÑসবকিছুর ভারে আমরা ক্রমাগত নুয়ে পড়ছি। অনেকে বিভিন্ন স্তরের চাপ সহ্য করতে না পেরে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। এ অবস্থায় এই মানসিক পীড়া আমাদের কখনোই অবহেলা করা উচিত নয়। বিশ্বাস করা যায় বা খুব নিকটের কারও সঙ্গে আমাদের সমস্যার ব্যাপারে আলাপ করা উচিত। বাবা-মা, শিক্ষক, কাছের কোনো বন্ধু অথবা স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের সঙ্গে খোলাখুলি আমাদের সমস্যার কথা আলাপ করতে পারি। তবে ব্যক্তি নির্বাচন করার আগে আমাদের জানতে হবে বা বোঝার চেষ্টা করতে হবে, সেই ব্যক্তিটি কতটা উদার মনে আপনার সব কথা শুনবে এবং উপযুক্ত গোপনীয়তা রক্ষা করে সঠিক পথে এগোনোর পরামর্শ দান করবে। কম বয়সী ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রে এটা একটা বিরাট সমস্যা। এরা কাউকেই বিশ্বাস করে তাদের সমস্যার কথা পুরোপুরি বলতে পারে না। কারণ ভুলের সমাধান দেওয়ার আগে তাদের কেন ভুল হয়েছে, এ ব্যাপারেই বড়দের থেকে তাদের বেশি লেকচার শুনতে হয়। তখন তারা নিজেদের আরও গুটিয়ে ফেলে। বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যায় ভোগে। অনেকে অতিরিক্ত হতাশাগ্রস্ত হয়ে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে, অনেকে নিজের জীবন শেষ করে দেওয়ার মতো চরম সিদ্ধান্ত নেয়।

প্রতিবছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি পাঁচজনে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ মানসিক অসুস্থতায় ভোগে। ৬ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের মধ্যে প্রতি ছয়জনে একজন তরুণ-তরুণী কোনো ধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত। শতকরা ৫০ ভাগ মানসিক সমস্যা শুরু হয় ১৪ বছর বয়স থেকে। আর শতকরা ৭৫ ভাগ শুরু হয় ২৪ বছর বয়স থেকে। ১০-১৪ বছরের ছেলেমেয়েদের মধ্যে আত্মহত্যা দ্বিতীয় প্রধান কারণ হিসেবে মৃত্যুর জন্য দায়ী। এই ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলো এত সহজেই নিজেদের জীবন কেড়ে নেওয়ার কথা ভাবে। মাঝে মাঝে মনে হয় পুরো দুনিয়াটাই কি মানসিক অসুস্থতার শিকার? সোশ্যাল মিডিয়ায় গেলে, টিভি খুললে, খবরের কাগজ পড়লে খালি চোখে পড়বে চারদিকের সব খারাপ, অবিশ্বাস্য, ভয়াবহ খবর। সন্তানের বাবা-মাকে খুন করার খবর, কাউকে কুপিয়ে হত্যা করার স্টোরি, কারও মাথা কেটে দেওয়ার ভিডিও পোস্ট, সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সারকে খুনের লাইভ স্ট্রিম, আত্মহত্যা করার আগে ধারাবাহিক বর্ণনা, কাউকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারার দৃশ্যÑএমন কত শত খবর প্রতিনিয়ত আমাদের সামনে আসছে, মনের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে এবং কোথায় যেন একটা প্রভাব ফেলে যাচ্ছে।

বর্তমানকালে পশ্চিমা দুনিয়ায় ‘ডুমস্ক্রলিং’ বলে একটা বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছে। যদিও বিষয়টা কোনো অংশেই ভালো বা আশাব্যঞ্জক নয়। আমরা সব সময় আমাদের মুঠোফোনে স্ক্রল করি এবং প্রতিনিয়ত অনলাইন নিউজ বা খবরের মধ্যে ডুবে থাকি। এই করতে করতে সর্বক্ষণ খারাপ নিউজ দেখা ও পড়ার কারণে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটছে। এই বিষয়টাই তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ডুমস্ক্রলিং বলে পরিচিত। সামাজিক বিজ্ঞানীরা এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের কিছু উপায় বলে দিয়েছেন। প্রাত্যহিক একটা নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করে সামাজিক মাধ্যমে যাওয়া, হাতের কাছ থেকে ফোনটা মাঝে মাঝে সরিয়ে রাখা, দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়ে খবর দেখা, প্রতিদিন শারীরিক ব্যায়াম করা, ভালো সঙ্গ, ভালো বন্ধু নির্বাচন করা ইত্যাদি ছোট ছোট ব্যাপার আমাদের মানসিকতা পাল্টে দিতে পারে। মানসিক অসুস্থতা একটা ধারাবাহিকতার মধ্যে বিভিন্ন স্তরে তার তীব্রতা ও উপসর্গের ভিত্তিতে ওঠানামা করে। কেউ মাথায় সামান্য আউলা হতে পারে। কেউ হতে পারে বদ্ধ পাগল। আবার কেউ হতে পারে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক, কিন্তু মানসিক চাপ সহ্য করার পরে ভারসাম্যহীন। সমস্যা যেই লেভেলের বা যেই প্রকৃতির হোক না কেন, সেটা টের পাওয়ার পরে নিজের জন্য বা অন্য কারও জন্য তার সমাধানের উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসা উচিত। জীবনযুদ্ধ মোকাবিলা করতে সবচেয়ে বেশি সাহসের প্রয়োজন আমাদের তরুণ সমাজের। তাই বড়দের উচিত তরুণ প্রজন্মের কাছ থেকে আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনের উপায় বের করা। আমাদের সবার মনোবৃত্তি হওয়া উচিত সাহায্য, সহযোগিতা, সহমর্মিতা। সবার মনে রাখতে হবে, এই যাত্রায় আমরা একা নই। জীবনের কোনো না কোনো সময়ে আমরা কিছু মানসিক সমস্যা বা চাপের মুখোমুখি হব। তখন যেন আমরা হাল ছেড়ে না দিই। মনের ওপর কখনোই জোর-জবরদস্তি চলে না। মনকে চাই সঠিক উপায়ে, সঠিক দিকে পরিচালিত করা; যাতে সে এই জগতের সব সুন্দর আর সব ভালোর দিকে আকর্ষিত হয়। সুন্দর সুন্দর চিন্তা, ভালো ভালো কথা-এই যেন হয় আমাদের প্রতিদিনকার মন্ত্র। 
লেখক : ব্লগার, টেক্সাস।
 
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: +880  1338-950041