
মিস্টার হোজে সোলানো (MR. JOSE SOLANO) একজন চমৎকার সুপুরুষ মানুষ। কথ্য ইংরেজি ভালোই বলতে পারলেও ইংরেজি তিনি পড়তে শেখেননি। ২০০২ সালে আমার সঙ্গে পরিচয়ের বছর দশেক আগে তিনি মেক্সিকো থেকে সীমান্ত পেরিয়ে মার্কিন মুল্লুকে ঢুকে পড়েন। পরবর্তী কয়েক বছরে আইনজীবী ধরে অবশ্য আইনসংগতভাবেই যথাযথ কাগজপত্র মানে Green Card জোগাড় করতেও সমর্থ হন। তার সঙ্গে আমার পরিচয় তারই কাজের দক্ষতার কারণে। ২০০২ সালে আমি লস অ্যাঞ্জেলেস শহরের পশ্চিম প্রান্তে ৪৪ বছরের পুরোনো একটি ভাঙাচোরা (Fixer-Upper) বাড়ি কিনে ফেললাম। যেমন ভাঙাচোরা ছাদ, তেমনি ভাঙাচোরা ফ্লোর। হঠাৎ এক গভীর রাতে বৃষ্টি হলে আমার লেপ-তোশক সব ভিজে গেল। অন্যদিকে জানালা একটিও খোলা যায় না। আর কিচেন বা বাথরুমে কল ছাড়লে হলুদ পানির বন্যায় হাত ধুতেও ভয় পেতাম। তেমনি অবস্থায় একজন ভালো, দক্ষ, সবজান্তা Handyman খুঁজতে গিয়ে কয়েকজনকে পেলেও তাদেরকে আমার তেমন পছন্দ হলো না। কারণ তারা কাজ তেমন ভালো না করলেও মজুরি নিতেন অনেক বেশি।
১৯৭৫ সালের জুন মাসে এ দেশে এসে এর আগেও কয়েক বছরের ব্যবধানে দুটি বাড়ি কেনার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তবে সে বাড়িগুলো ছিল কমবেশি নতুন। কিন্তু এবার লস অ্যাঞ্জেলেস শহরের অপেক্ষাকৃত দামি এলাকায় এক ‘Fixer-Upper’ কিনে আমার মাসিক আয়ের মোটা অংশই Handyman-দের পেছনেই ব্যয় করতে শুরু করলাম। অবশ্য মনে মনে বুঝতাম, এর সবটাই হচ্ছে Investment. ভাগ্যিস, তখনো এই শহরে অনেক সস্তায় বাড়িঘর কেনা যেত। বাড়ি কেনার মাস তিনেক পর ঘটনাচক্রে Mr. Solano-এর সঙ্গে পরিচয় হলে আমার Handyman সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। তিনি যেমন ছিলেন সর্বকাজের কাজি, তেমনি ছিলেন সৎ। আবার মজুরিও নিতেন অন্যদের চেয়ে অনেক কম। কিন্তু কেউ যদি তার অত্যন্ত Reasonable মজুরি নিয়েও ‘ঘাপলা’ করত, তাহলে তিনি ইচ্ছে করেই নিরুদ্দেশ হয়ে যেতেন। আমি প্রথম থেকেই এ ব্যাপারে অবশ্য সতর্ক ছিলাম। কারণ সস্তায় ভালো কাজ করতে পারা মানুষ সব সমাজেই দুর্লভ।
কম পুঁথিগত বিদ্যা জানা Mr. Solano-এর কাজের দক্ষতা এবং তার মাসিক আয় দেখে আমি সত্যি সত্যি অবাক হতাম সেই ২০০২ সালেই। ততদিনে আমার Post Office-এর চাকরিতে ১৭ বছর পার হয়ে গেছে। এ চাকরির আগে ১৯৮২-এর জানুয়ারি থেকে ’৮৫-এর জানুয়ারি পর্যন্ত একটি ব্যাংকে চাকরি করতাম। তখন ক্যালিফোর্নিয়াতে minimum wage ছিল ৩.৩৫। কিন্তু Bank দিত পাঁচ ডলার করে প্রতি ঘণ্টায়। Bank-এর চাকরিতে কোট ও টাই (Tie) পরে যেতে হতো। আবার প্রতি দুই ঘণ্টায় কফি ব্রেকও পেতাম ১৫ মিনিট করে। মাসের শেষে বেতন পেতাম হাজারখানেক ডলার। কিন্তু নানা রকম Deductions মানে ফেডারেল ও স্টেট Tax, Social Security, হেলথ ইন্স্যুরেন্স ইত্যাদি বাবদ ফি কাটার পরে পকেটে আসত মাত্র ৭০০ ডলার মাসপ্রতি। অনেকেই মনে করত, ব্যাংকে কোট-টাই পরে কতই না আরামের চাকরি করি, লাঞ্চ টাইমে আশপাশের দোকানে ঘুরে বেড়াই। কিন্তু কেউ জানে না যে মাসের শেষে ক্রেডিট কার্ড থেকে উচ্চ সুদে টাকা ধার নিয়ে Apartment-এর ভাড়া দিই। আর বাংলাদেশে থাকা আত্মীয়স্বজনেরা মনে করত, আমি বা আমরা বুঝি টাকার সমুদ্রে ভাসছি। মার্কিন মুল্লুক-সে তো দুনিয়াতেই এক স্বর্গ। স্বপ্নে মানুষ কত কিছুই না দেখে। কিন্তু বাস্তবে থাকে আকাশ-পাতালের ব্যবধান।
যা হোক, অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অচিরেই আমাকে দ্বিতীয় চাকরি নিতে হলো। দ্বিতীয় চাকরিতে সপ্তাহে ২৪ ঘণ্টা কাজ করেও Bank-এর Full Time চাকরির চেয়েও বেশি আয় করতাম। তবে বাসায় ফিরতাম রাত ১২টায়। টাকার দৈন্য কমে গেলেও পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব ঘটত সপ্তাহে ৬ দিনই। এদিকে তখন মিস্টার সোলানো সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৬টা পর্যন্ত কাজ করেই মাসে আয় করতেন ৬-৭ হাজার ডলার। তা-ও আবার ক্যাশ টাকা। তার জন্য কোনো Deduction-এর বালাই ছিল না। কী আশ্চর্য-লোকটা হাইস্কুল পর্যন্ত পাস করেনি। আর আমি দুটো চাকরি করেও ১৯৮১ থেকে পরবর্তী তিন বছর মাত্র ১৫০০ ডলার আয় করতাম। তখন মনে হতো, জীবনের এক-চতুর্থাংশ পার দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও আমেরিকার ওকলাহোমা রাজ্যের এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি নয় বরং দুটি মাস্টার্স ডিগ্রির পাশাপাশি ক্যালিফোর্নিয়ার Community কলেজে পড়ানোর জন্য Teaching Cirtificate হাতে নিয়েও ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৬ ঘণ্টা ঘরের বাইরে থেকে মাত্র হাজার দেড়েক ডলার আয় করি ঠিক কোন কারণে? অত্যন্ত Non-Technical, Liberal Arts পড়া মানুষ হিসেবে আমার জন্য এটাই হয়তো ছিল প্রাপ্য!
অন্যদিকে ছোটবেলা থেকেই একদল মানুষের সামনে আমি কথা বলতে অভ্যস্ত ছিলাম না। কেমন যেন নার্ভাসনেস আমাকে গ্রাস করত। স্বভাবতই স্কুল-কলেজের শিক্ষক হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিন্তু তাই বলে আরও বেশি আয়ের চাকরির জন্য চেষ্টা করব না, তা তো হতে পারে না। অচিরেই বেশ কটি Post Office-এ পরীক্ষা দিতে দিতে একটিতে চাকরি পেয়ে গেলাম। এ চাকরিটা প্রতিদিনই ছিল কেমন যেন ছেলেখেলার মতো। কোনো চাকরি করে মনে মনে যে এত বেশি আনন্দ পাব, তা কখনো আগে জানতাম না। nternet gfv E-mail-এর জলোচ্ছ্বাসের অনেক আগে আমরা লক্ষ লক্ষ চিঠির বন্যায় প্রায়ই তলিয়ে যেতাম। এ দেশে জন্ম নেওয়া মানুষগুলো ৮ বা ১০ ঘণ্টা কাজ করেই বাড়িতে ফেরার জন্য উতলা হয়ে উঠতেন। আর অন্য দেশে জন্ম নেওয়া তখনো স্বল্প কজনা বিদেশি ১২ ঘণ্টা কাজ করেও কেমন যেন অতৃপ্ত থেকে যেতাম। মনে হতো, আরও দু-চার ঘণ্টা কাজ করলে অসুবিধাটা কোথায়? যেই ভাবা সেই কাজ। দেখতে দেখতে আমি আবারও দ্বিতীয় কাজে রাত ১২টা পর্যন্ত ব্যস্ত থাকতাম। এত এনার্জি কোথা থেকে আসত, তা আমার জানা নেই। অবশেষে দীর্ঘ ৩৭ বছর চাকরি করে ৭২ বছর বয়সে পোস্ট অফিসকে বিদায় জানালাম।
মজার ব্যাপার হলো, চাকরি করে মাসের শেষে যে নিট বা ক্যাশ টাকা পেতাম, এখন Retire করে তার ডাবল টাকা পাচ্ছি ঘরে বসে বিগত চারটি বছর ধরেই। Stable চাকরি, বিশেষ করে সরকারি চাকরির Benefits সত্যি বুড়ো বয়সে জীবনকে সহজ করে দেয়। তবু একজন দক্ষ Handyman-এর আয় এ যুগে কত বেশি হতে পারে, তা বোধ করি অনেকেই জানেন না। আপনার Ph.D. থাকলেও MR. Solano-এর আয়ের ধারেকাছেও আপনি সহসা আসতে পারবেন না বলেই আমি মনে করি, যদি আপনি ছাত্রাবস্থায় বর্তমান যুগের চাহিদানুযায়ী প্রকৃত বিজ্ঞান বা Health-ভিত্তিক যথোপযুক্ত কার্যকর বিষয় বা Subject নিয়ে লেখাপড়া না করে থাকেন। কথা হচ্ছে, আমি কী বিষয় নিয়ে পড়েছিলাম? বর্তমানের বৈজ্ঞানিক যুগে ইতিহাস, ভূগোল, ফিলোসফি, সাইকোলজি, Sociology বা Political Science পড়ে একজন অত্যন্ত নন-টেকনিক্যাল মানুষ হিসেবে আমি কখনোই বেশি আয় করার স্বপ্ন দেখতাম না। ব্যক্তিগতভাবে আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে বেশ কটি বড় বড় ডিগ্রি নিয়েও বড়জোর একটি কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে অনেক মান-সম্মান পেলেও পেতে পারেন। কিন্তু টাকা-পয়সার রাজ্যে হাইস্কুল পাস না করা আমার বন্ধু মিস্টার সোলানোর ধারেকাছেও যে আসতে পারবেন না অধিকাংশই অতীব শিক্ষিত মানুষেরা, তাতে আমি একপ্রকার নিশ্চিন্ত। তবে এটাও সত্য, অনেকের ভাগ্য অনেকভাবেই ঘুরে যেতে পারে। ভাগ্যের গুণে অনেকেই ব্যবসা খুলে ব্যাপক সফলতার মুখ দেখতে পান। আর যারা মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে ভালো বা আকর্ষণীয় বক্তৃতা করতে পারেন, তাদের তো কপালই খুলে যায়Ñবিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে। আদতে কোনো ইঞ্জিনিয়ার-ডাক্তার বা ভালো টেকনিশিয়ান না হয়েও যদি অল্প চেষ্টাতেই রাজনীতিবিদ বনে গিয়ে চুরি-বাটপারি, লুণ্ঠনের টেকনিকটা একবার একটু আয়ত্ত করতে পারেন, তাহলে তো কথাই নেই। বাংলাদেশের পার্লামেন্টের মেম্বারদের মধ্যে কজন সত্যি সত্যি শিক্ষিত এবং ইংরেজিতে একটি ভালো-নির্ভুল দরখাস্ত লিখতে পারেন, তা আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। আবার তাদের মধ্যে চরিত্র ঠিক রেখে কজনই-বা শেষ বয়স পর্যন্ত সত্যি সত্যি নিষ্কলুষ বা দুর্নীতিমুক্ত থাকতে পারেন, তা অবশ্যই জনগণের জানার অধিকার আছে।
আজকের এ নিবন্ধে রাজনীতি নিয়ে লেখার কথা ছিল না। তবু মনের দুঃখে একটু হলেও রাজনৈতিক কথাবার্তা চলে আসে বৈকি, বিশেষ করে আমাদের মগজের মধ্যে রাজনীতির ‘কালচার’ যখন সব সময়ই টগবগ করে। ২০২৫ সালে এসে বন্ধুবর মিস্টার সোলানোর মাসিক আয় কত, তা হয়তো অনেকেই জানতে চাইবেন। কিন্তু তার আগে সম্প্রতি বাংলাদেশে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম, তার একটু বিবরণ দেওয়া যাক। দেশে গেলেই আমি ঢাকা শহরে রিকশায় উঠে এদিক-সেদিক বেড়াতে যাই। আবার রিকশায় উঠেই রিকশাওয়ালা ‘মামা’র সঙ্গে এটা-সেটা নিয়ে গল্প করতে শুরু করি। তারা যাতে মন খুলে আলাপ করেন সে জন্য আমি মিষ্টির দোকান দেখলেই তাদেরকে চা-শিঙাড়া-মিষ্টি ইত্যাদি দিয়ে আপ্যায়ন করি। রিকশা চুরি হয়ে যাবে বলে তাদের মধ্যে অনেকেই রিকশাতেই এটা-সেটা খেয়ে থাকেন। খাওয়ার পর তারা স্বাভাবিকভাবেই প্রাণখুলে কথা বলতে শুরু করেন। এমনভাবে অচেনা মানুষদের আপ্যায়ন করার পেছনে অবশ্যই একটি কারণ থাকে। আমি শুধু জানতে চাই, তাদের লেখাপড়া কতটুকু? ছোটবেলায়, মানে ৫০-৬০ বছর আগে মেহনতি মানুষদের শতকরা ৯০ জনই ছিলেন কমবেশি না পড়তে পারা মানুষ। কিন্তু মাস ছয়েক আগে দেশে গেলে মোট ১৫ জন রিকশাওয়ালা বা অটোচালকের মধ্যে বেশ কয়েকজনকেই পেলাম শুধু হাইস্কুল নয়, এমনকি IA, BA পাস করা মানুষও। আর ছিলেন কয়েকজন মাদ্রাসা থেকে পাস করা কোরআনে হাফেজ পর্যন্ত। একজন বললেন, তিনি ছিলেন কোনো এক মসজিদের মোয়াজ্জিন। কিন্তু বেতনের টাকায় সংসার চলে না বলে এক মাসের ট্রেনিং নিয়ে এখন অটোরিকশা চালাচ্ছেন। ভালো আয়ের চাকরি না পেয়ে সবাই প্রচণ্ড রোদ-বৃষ্টির মধ্যেও জীবনের হাল ছেড়ে দেননি। মনে মনে ভাবলাম, আমিও তো আসলে তাদের মতোই একজন ‘কামলা’-তফাত শুধু আমি বাসিন্দা মার্কিন মুল্লুকের। টাকার বদলে ডলার আয় করি-এটাই আমার সৌভাগ্য। যে দেশে এক চুল কাটতেই ২০-২৫ ডলার লেগে যায়, সে দেশে টাকা জমানোর টেকনিকটা আমার ঠিক জানা নেই। কথায় বলে, ‘যত আয় তত ব্যয়।’ এই আয়-ব্যয়ের গোলকধাঁধার মধ্যেই আটকে আছে আমার এই ছোট্ট জীবন। ওদিকে মধ্যপ্রাচেও যে লক্ষ লক্ষ অদক্ষ নির্মাণ শ্রমিক সামান্য কিছু বেশি আয়ের জন্য প্রচণ্ড গরমসহ মারাত্মক প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে বছরের পর বছর ধরে জীবনপাত করে যাচ্ছেন, তারও কি কোনো শেষ আমরা জাতি হিসেবে কোনো দিন দেখতে পাব?
বলি একটি জাতিকে এই অত্যন্ত বিজ্ঞাননির্ভর পৃথিবীতে সঠিক শিক্ষার পথে ধাবিত করার দায়িত্বটা কার? দেশের শিশু-কিশোর প্রজন্মকে অধিক হারে কারিগরি বা বৃত্তিমূলক শিক্ষার জন্য প্রস্তুত না করে সাধারণ জ্ঞান (Liberal Arts) বা মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত করার যে ব্যবস্থা দিন দিনই অত্যন্ত শক্তিশালী করা হয়েছে বিগত বহু দশক ধরেই, তাতে বিদেশিরা আমাদের নন-টেকনিক্যাল, কম টাকা আয়কারী ‘কামলার জাত’ হিসেবেই বেশি করে জানে। স্বাধীনতার ৫৫ বছর পরেও দেশে-বিদেশে পাঠানোর জন্য পর্যাপ্ত ইলেকট্রিশিয়ান, প্লাম্বার (Plumber), কার্পেন্টার (Carpenter), ‘মেকানিক’ কিংবা হসপিটালের নার্স দেশটি তৈরি করতে পারছে না কেন? ছোটবেলা থেকেই যদি লক্ষ লক্ষ গরিব শিশুকে মানসিকভাবে চাপ না দিয়েও বিভিন্ন বৃত্তিমূলক কাজ শেখায় উৎসাহিত করা যায়-মানে এসব কাজ শেখার পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়, বিশেষ করে গ্রাম-বাংলায়, তাহলে দেশের জনসংখ্যার অন্তত ২৫ ভাগ মানুষকে দেশে-বিদেশে মোটামুটি একট সচ্ছল জীবনযাপনের একটি সুন্দর পথের ঠিকানা দেওয়া যায়। জনসংখ্যার একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার এমনকি Handyman হতে পারে বা হওয়ার যোগ্যতা রাখে। কিন্তু তার পরও দেশভর্তি কোটি কোটি সাধারণ শ্রমিক বা রিকশাওয়ালা তৈরির ‘কালচার’ বদলানোর জন্য বিগত পাঁচ দশক ধরে আমাদের রাজনীতিবিদেরা বা সরকারগুলো কতটুকু আন্তরিক ছিলেন? ঠিক কী কারণে আমরা এশিয়া মহাদেশের আরেকটি দেশ ফিলিপাইনের মানুষদের মতো বিশ্বজুড়ে নার্স, ইলেকট্রিশিয়ান, মেকানিক, প্লাম্বারসহ নানা ধরনের দক্ষ শ্রমিক সৃষ্টি করতে পারিনি? সব গরিব দেশেই অধিকাংশ রাজনীতিবিদই কমবেশি দুর্নীতি করে থাকেন। কিন্তু বাংলাদেশের তথাকথিত শিক্ষিত বা আধাশিক্ষিত রাজনীতিবিদ নামক ‘জানোয়ার’দের বিবেক বা চরিত্র বলতে কিছুই নেই। দেশটাকে তারা কোটি কোটি অবৈধ টাকা বানানোর কারখানা হিসেবে ব্যবহার করছেন স্বাধীনতার পর থেকেই। জাতি হিসেবে এর চেয়ে বড় লজ্জা ও দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে?
ভালো কথা, আমার নিকটতম বন্ধু Handyman মিস্টার সোলানো এখন আয় করেন প্রতি মাসে কমপক্ষে কুড়ি হাজার ডলার। মাঝেমধ্যে তারও বেশি। একবার মাত্র দুই সপ্তাহে তার আয় ছিল ২৪ হাজার ডলার-নিকটবর্তী অভিজাত এলাকা Beverly Hills-এ এক মিলিয়নিয়ারের বাড়িতে চোখ-ঝলসানো এক বাথরুম রেনোভেট (Renovate) করে। ভাবছি, কী করতে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্তই লেখাপড়া করেছিলাম? সাধারণ বিষয়গুলো পড়ে বছরের অতীব মূল্যবান সময়ের মারাত্মক অপচয় করে যাই আমাদেরই একাংশ। আসলে সবার মাথার ‘ঘিলু তো একরকম হয় না। ছোটবেলা থেকেই আমি Liberal Arts-এর ছাত্র। তার মানে ফিজিক্স, অঙ্ক, কেমিস্ট্রি, স্ট্যাটিসটিকস, ক্যালকুলাস ইত্যাদি বিষয়ের বই দেখলেই আমি ভয় পেতাম। অন্যদিকে মানুষকে ঠকানো, মানুষের সঙ্গে চালাকি বা বাটপারি করে নিজের আখের গোছানো ইত্যাদি টেকনিকও (Technique) কোনো দিন রপ্ত করতে পারিনি। ভ্যাগিস, আমার এক বোন মার্কিন নাগরিক হয়েছিলেন তারই সমবয়সী এক বাংলাদেশি ফার্মাসিস্টকে বিয়ে করে সেই ১৯৭৩ সালে। সেই সূত্রের বদান্যতায় আমিও আছি এই দেশে ১৯৭৫ সাল থেকেই। তা না হলে হয়তো বাংলাদেশে রাজনীতির কারণে বহু আগেই মারা পড়তাম। কারণ আমি ১৯৬০ সাল থেকেই রাজনীতির পোকা বনে গিয়েছিলাম তৎকালীন ঢাকা শহরে। আর যদি ভাগ্যক্রমে না-ও মারা পড়তাম, তাহলে হয়তো-বা কোনো এক স্কুলের মাস্টার বনে গিয়ে ছাত্রদের ইতিহাস-ভূগোল পড়িয়ে তাদের ব্রেন (Brain) গুলোকে অনুৎপাদক শিক্ষার পথে ধাবিত করে তাদের চিরদিনের জন্যই গরিব হয়ে বেঁচে থাকার পথ বাতলে দিতাম। আবার ভাগ্য যদি আরও বেশি খারাপ হতো, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েও কোনো রকম ‘মামা’র জোর না থাকায় চাকরি-বাকরি জোগাড় করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত ঢাকা শহরে একজন রিকশাওয়ালা ‘মামা’ বনে গিয়ে রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ের মধ্যে কঠোর পরিশ্রম করে করে দরিদ্রতার চরম কশাঘাত সইতে সইতে একদিন হয়তো হঠাৎ করেই ‘অক্কা’ পেতাম।
মানুষের জীবন বা আমাদের ভাগ্য সব সময় নিয়মকানুন মেনে চলে না। কারণে-অকারণে, ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় ‘দুর্ভাগ্য’ আমাদের সহসাই গ্রাস করতে পারে যখন তখন। এটা প্রায়ই লক্ষণীয় যে আমরা যেসব বিষয়ে লেখাপড়া করে বড় হই, সেসব বিষয়কে ভিত্তি করে আর চাকরি করতে পারি না। কারণ সেসব বিষয়ভিত্তিক চাকরি প্রায়ই সহজলভ্য হয় না। অনুৎপাদক ও চাহিদাবিহীন শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আমাদের অধিকাংশকেই কম বেতনের চাকরি পেয়েই খুশি থাকতে হয় সারা জীবনের জন্যই। অন্যদিকে ডাক্তার, নার্স, ইঞ্জিনিয়ার, নানা কিসিমের টেকনিশিয়ান বা ‘হ্যান্ডিম্যান’রা, নিজেদের স্কুল-কলেজ লাইফের পছন্দনীয় বিষয়গুলোতে চাকরি করে ক্রমেই ধনিক শ্রেণিতে পরিণত হন একেবারে সৎপথেই প্রচুর টাকা-পয়সা আয় করে। এ কারণেই কারিগরি ও বিজ্ঞানভিত্তিক সাবজেক্টগুলোর গুরুত্ব আমরা বা আমাদের সরকারগুলো যতই তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবেন, জাতি হিসেবে আমাদের দৈন্য বা দরিদ্রতার হাত থেকে আমরা ততই তাড়াতাড়ি মুক্তি পাব বৈকি!
১৯৭৫ সালের জুন মাসে এ দেশে এসে এর আগেও কয়েক বছরের ব্যবধানে দুটি বাড়ি কেনার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তবে সে বাড়িগুলো ছিল কমবেশি নতুন। কিন্তু এবার লস অ্যাঞ্জেলেস শহরের অপেক্ষাকৃত দামি এলাকায় এক ‘Fixer-Upper’ কিনে আমার মাসিক আয়ের মোটা অংশই Handyman-দের পেছনেই ব্যয় করতে শুরু করলাম। অবশ্য মনে মনে বুঝতাম, এর সবটাই হচ্ছে Investment. ভাগ্যিস, তখনো এই শহরে অনেক সস্তায় বাড়িঘর কেনা যেত। বাড়ি কেনার মাস তিনেক পর ঘটনাচক্রে Mr. Solano-এর সঙ্গে পরিচয় হলে আমার Handyman সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। তিনি যেমন ছিলেন সর্বকাজের কাজি, তেমনি ছিলেন সৎ। আবার মজুরিও নিতেন অন্যদের চেয়ে অনেক কম। কিন্তু কেউ যদি তার অত্যন্ত Reasonable মজুরি নিয়েও ‘ঘাপলা’ করত, তাহলে তিনি ইচ্ছে করেই নিরুদ্দেশ হয়ে যেতেন। আমি প্রথম থেকেই এ ব্যাপারে অবশ্য সতর্ক ছিলাম। কারণ সস্তায় ভালো কাজ করতে পারা মানুষ সব সমাজেই দুর্লভ।
কম পুঁথিগত বিদ্যা জানা Mr. Solano-এর কাজের দক্ষতা এবং তার মাসিক আয় দেখে আমি সত্যি সত্যি অবাক হতাম সেই ২০০২ সালেই। ততদিনে আমার Post Office-এর চাকরিতে ১৭ বছর পার হয়ে গেছে। এ চাকরির আগে ১৯৮২-এর জানুয়ারি থেকে ’৮৫-এর জানুয়ারি পর্যন্ত একটি ব্যাংকে চাকরি করতাম। তখন ক্যালিফোর্নিয়াতে minimum wage ছিল ৩.৩৫। কিন্তু Bank দিত পাঁচ ডলার করে প্রতি ঘণ্টায়। Bank-এর চাকরিতে কোট ও টাই (Tie) পরে যেতে হতো। আবার প্রতি দুই ঘণ্টায় কফি ব্রেকও পেতাম ১৫ মিনিট করে। মাসের শেষে বেতন পেতাম হাজারখানেক ডলার। কিন্তু নানা রকম Deductions মানে ফেডারেল ও স্টেট Tax, Social Security, হেলথ ইন্স্যুরেন্স ইত্যাদি বাবদ ফি কাটার পরে পকেটে আসত মাত্র ৭০০ ডলার মাসপ্রতি। অনেকেই মনে করত, ব্যাংকে কোট-টাই পরে কতই না আরামের চাকরি করি, লাঞ্চ টাইমে আশপাশের দোকানে ঘুরে বেড়াই। কিন্তু কেউ জানে না যে মাসের শেষে ক্রেডিট কার্ড থেকে উচ্চ সুদে টাকা ধার নিয়ে Apartment-এর ভাড়া দিই। আর বাংলাদেশে থাকা আত্মীয়স্বজনেরা মনে করত, আমি বা আমরা বুঝি টাকার সমুদ্রে ভাসছি। মার্কিন মুল্লুক-সে তো দুনিয়াতেই এক স্বর্গ। স্বপ্নে মানুষ কত কিছুই না দেখে। কিন্তু বাস্তবে থাকে আকাশ-পাতালের ব্যবধান।
যা হোক, অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অচিরেই আমাকে দ্বিতীয় চাকরি নিতে হলো। দ্বিতীয় চাকরিতে সপ্তাহে ২৪ ঘণ্টা কাজ করেও Bank-এর Full Time চাকরির চেয়েও বেশি আয় করতাম। তবে বাসায় ফিরতাম রাত ১২টায়। টাকার দৈন্য কমে গেলেও পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব ঘটত সপ্তাহে ৬ দিনই। এদিকে তখন মিস্টার সোলানো সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৬টা পর্যন্ত কাজ করেই মাসে আয় করতেন ৬-৭ হাজার ডলার। তা-ও আবার ক্যাশ টাকা। তার জন্য কোনো Deduction-এর বালাই ছিল না। কী আশ্চর্য-লোকটা হাইস্কুল পর্যন্ত পাস করেনি। আর আমি দুটো চাকরি করেও ১৯৮১ থেকে পরবর্তী তিন বছর মাত্র ১৫০০ ডলার আয় করতাম। তখন মনে হতো, জীবনের এক-চতুর্থাংশ পার দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও আমেরিকার ওকলাহোমা রাজ্যের এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি নয় বরং দুটি মাস্টার্স ডিগ্রির পাশাপাশি ক্যালিফোর্নিয়ার Community কলেজে পড়ানোর জন্য Teaching Cirtificate হাতে নিয়েও ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৬ ঘণ্টা ঘরের বাইরে থেকে মাত্র হাজার দেড়েক ডলার আয় করি ঠিক কোন কারণে? অত্যন্ত Non-Technical, Liberal Arts পড়া মানুষ হিসেবে আমার জন্য এটাই হয়তো ছিল প্রাপ্য!
অন্যদিকে ছোটবেলা থেকেই একদল মানুষের সামনে আমি কথা বলতে অভ্যস্ত ছিলাম না। কেমন যেন নার্ভাসনেস আমাকে গ্রাস করত। স্বভাবতই স্কুল-কলেজের শিক্ষক হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিন্তু তাই বলে আরও বেশি আয়ের চাকরির জন্য চেষ্টা করব না, তা তো হতে পারে না। অচিরেই বেশ কটি Post Office-এ পরীক্ষা দিতে দিতে একটিতে চাকরি পেয়ে গেলাম। এ চাকরিটা প্রতিদিনই ছিল কেমন যেন ছেলেখেলার মতো। কোনো চাকরি করে মনে মনে যে এত বেশি আনন্দ পাব, তা কখনো আগে জানতাম না। nternet gfv E-mail-এর জলোচ্ছ্বাসের অনেক আগে আমরা লক্ষ লক্ষ চিঠির বন্যায় প্রায়ই তলিয়ে যেতাম। এ দেশে জন্ম নেওয়া মানুষগুলো ৮ বা ১০ ঘণ্টা কাজ করেই বাড়িতে ফেরার জন্য উতলা হয়ে উঠতেন। আর অন্য দেশে জন্ম নেওয়া তখনো স্বল্প কজনা বিদেশি ১২ ঘণ্টা কাজ করেও কেমন যেন অতৃপ্ত থেকে যেতাম। মনে হতো, আরও দু-চার ঘণ্টা কাজ করলে অসুবিধাটা কোথায়? যেই ভাবা সেই কাজ। দেখতে দেখতে আমি আবারও দ্বিতীয় কাজে রাত ১২টা পর্যন্ত ব্যস্ত থাকতাম। এত এনার্জি কোথা থেকে আসত, তা আমার জানা নেই। অবশেষে দীর্ঘ ৩৭ বছর চাকরি করে ৭২ বছর বয়সে পোস্ট অফিসকে বিদায় জানালাম।
মজার ব্যাপার হলো, চাকরি করে মাসের শেষে যে নিট বা ক্যাশ টাকা পেতাম, এখন Retire করে তার ডাবল টাকা পাচ্ছি ঘরে বসে বিগত চারটি বছর ধরেই। Stable চাকরি, বিশেষ করে সরকারি চাকরির Benefits সত্যি বুড়ো বয়সে জীবনকে সহজ করে দেয়। তবু একজন দক্ষ Handyman-এর আয় এ যুগে কত বেশি হতে পারে, তা বোধ করি অনেকেই জানেন না। আপনার Ph.D. থাকলেও MR. Solano-এর আয়ের ধারেকাছেও আপনি সহসা আসতে পারবেন না বলেই আমি মনে করি, যদি আপনি ছাত্রাবস্থায় বর্তমান যুগের চাহিদানুযায়ী প্রকৃত বিজ্ঞান বা Health-ভিত্তিক যথোপযুক্ত কার্যকর বিষয় বা Subject নিয়ে লেখাপড়া না করে থাকেন। কথা হচ্ছে, আমি কী বিষয় নিয়ে পড়েছিলাম? বর্তমানের বৈজ্ঞানিক যুগে ইতিহাস, ভূগোল, ফিলোসফি, সাইকোলজি, Sociology বা Political Science পড়ে একজন অত্যন্ত নন-টেকনিক্যাল মানুষ হিসেবে আমি কখনোই বেশি আয় করার স্বপ্ন দেখতাম না। ব্যক্তিগতভাবে আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে বেশ কটি বড় বড় ডিগ্রি নিয়েও বড়জোর একটি কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে অনেক মান-সম্মান পেলেও পেতে পারেন। কিন্তু টাকা-পয়সার রাজ্যে হাইস্কুল পাস না করা আমার বন্ধু মিস্টার সোলানোর ধারেকাছেও যে আসতে পারবেন না অধিকাংশই অতীব শিক্ষিত মানুষেরা, তাতে আমি একপ্রকার নিশ্চিন্ত। তবে এটাও সত্য, অনেকের ভাগ্য অনেকভাবেই ঘুরে যেতে পারে। ভাগ্যের গুণে অনেকেই ব্যবসা খুলে ব্যাপক সফলতার মুখ দেখতে পান। আর যারা মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে ভালো বা আকর্ষণীয় বক্তৃতা করতে পারেন, তাদের তো কপালই খুলে যায়Ñবিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে। আদতে কোনো ইঞ্জিনিয়ার-ডাক্তার বা ভালো টেকনিশিয়ান না হয়েও যদি অল্প চেষ্টাতেই রাজনীতিবিদ বনে গিয়ে চুরি-বাটপারি, লুণ্ঠনের টেকনিকটা একবার একটু আয়ত্ত করতে পারেন, তাহলে তো কথাই নেই। বাংলাদেশের পার্লামেন্টের মেম্বারদের মধ্যে কজন সত্যি সত্যি শিক্ষিত এবং ইংরেজিতে একটি ভালো-নির্ভুল দরখাস্ত লিখতে পারেন, তা আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। আবার তাদের মধ্যে চরিত্র ঠিক রেখে কজনই-বা শেষ বয়স পর্যন্ত সত্যি সত্যি নিষ্কলুষ বা দুর্নীতিমুক্ত থাকতে পারেন, তা অবশ্যই জনগণের জানার অধিকার আছে।
আজকের এ নিবন্ধে রাজনীতি নিয়ে লেখার কথা ছিল না। তবু মনের দুঃখে একটু হলেও রাজনৈতিক কথাবার্তা চলে আসে বৈকি, বিশেষ করে আমাদের মগজের মধ্যে রাজনীতির ‘কালচার’ যখন সব সময়ই টগবগ করে। ২০২৫ সালে এসে বন্ধুবর মিস্টার সোলানোর মাসিক আয় কত, তা হয়তো অনেকেই জানতে চাইবেন। কিন্তু তার আগে সম্প্রতি বাংলাদেশে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম, তার একটু বিবরণ দেওয়া যাক। দেশে গেলেই আমি ঢাকা শহরে রিকশায় উঠে এদিক-সেদিক বেড়াতে যাই। আবার রিকশায় উঠেই রিকশাওয়ালা ‘মামা’র সঙ্গে এটা-সেটা নিয়ে গল্প করতে শুরু করি। তারা যাতে মন খুলে আলাপ করেন সে জন্য আমি মিষ্টির দোকান দেখলেই তাদেরকে চা-শিঙাড়া-মিষ্টি ইত্যাদি দিয়ে আপ্যায়ন করি। রিকশা চুরি হয়ে যাবে বলে তাদের মধ্যে অনেকেই রিকশাতেই এটা-সেটা খেয়ে থাকেন। খাওয়ার পর তারা স্বাভাবিকভাবেই প্রাণখুলে কথা বলতে শুরু করেন। এমনভাবে অচেনা মানুষদের আপ্যায়ন করার পেছনে অবশ্যই একটি কারণ থাকে। আমি শুধু জানতে চাই, তাদের লেখাপড়া কতটুকু? ছোটবেলায়, মানে ৫০-৬০ বছর আগে মেহনতি মানুষদের শতকরা ৯০ জনই ছিলেন কমবেশি না পড়তে পারা মানুষ। কিন্তু মাস ছয়েক আগে দেশে গেলে মোট ১৫ জন রিকশাওয়ালা বা অটোচালকের মধ্যে বেশ কয়েকজনকেই পেলাম শুধু হাইস্কুল নয়, এমনকি IA, BA পাস করা মানুষও। আর ছিলেন কয়েকজন মাদ্রাসা থেকে পাস করা কোরআনে হাফেজ পর্যন্ত। একজন বললেন, তিনি ছিলেন কোনো এক মসজিদের মোয়াজ্জিন। কিন্তু বেতনের টাকায় সংসার চলে না বলে এক মাসের ট্রেনিং নিয়ে এখন অটোরিকশা চালাচ্ছেন। ভালো আয়ের চাকরি না পেয়ে সবাই প্রচণ্ড রোদ-বৃষ্টির মধ্যেও জীবনের হাল ছেড়ে দেননি। মনে মনে ভাবলাম, আমিও তো আসলে তাদের মতোই একজন ‘কামলা’-তফাত শুধু আমি বাসিন্দা মার্কিন মুল্লুকের। টাকার বদলে ডলার আয় করি-এটাই আমার সৌভাগ্য। যে দেশে এক চুল কাটতেই ২০-২৫ ডলার লেগে যায়, সে দেশে টাকা জমানোর টেকনিকটা আমার ঠিক জানা নেই। কথায় বলে, ‘যত আয় তত ব্যয়।’ এই আয়-ব্যয়ের গোলকধাঁধার মধ্যেই আটকে আছে আমার এই ছোট্ট জীবন। ওদিকে মধ্যপ্রাচেও যে লক্ষ লক্ষ অদক্ষ নির্মাণ শ্রমিক সামান্য কিছু বেশি আয়ের জন্য প্রচণ্ড গরমসহ মারাত্মক প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে বছরের পর বছর ধরে জীবনপাত করে যাচ্ছেন, তারও কি কোনো শেষ আমরা জাতি হিসেবে কোনো দিন দেখতে পাব?
বলি একটি জাতিকে এই অত্যন্ত বিজ্ঞাননির্ভর পৃথিবীতে সঠিক শিক্ষার পথে ধাবিত করার দায়িত্বটা কার? দেশের শিশু-কিশোর প্রজন্মকে অধিক হারে কারিগরি বা বৃত্তিমূলক শিক্ষার জন্য প্রস্তুত না করে সাধারণ জ্ঞান (Liberal Arts) বা মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত করার যে ব্যবস্থা দিন দিনই অত্যন্ত শক্তিশালী করা হয়েছে বিগত বহু দশক ধরেই, তাতে বিদেশিরা আমাদের নন-টেকনিক্যাল, কম টাকা আয়কারী ‘কামলার জাত’ হিসেবেই বেশি করে জানে। স্বাধীনতার ৫৫ বছর পরেও দেশে-বিদেশে পাঠানোর জন্য পর্যাপ্ত ইলেকট্রিশিয়ান, প্লাম্বার (Plumber), কার্পেন্টার (Carpenter), ‘মেকানিক’ কিংবা হসপিটালের নার্স দেশটি তৈরি করতে পারছে না কেন? ছোটবেলা থেকেই যদি লক্ষ লক্ষ গরিব শিশুকে মানসিকভাবে চাপ না দিয়েও বিভিন্ন বৃত্তিমূলক কাজ শেখায় উৎসাহিত করা যায়-মানে এসব কাজ শেখার পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়, বিশেষ করে গ্রাম-বাংলায়, তাহলে দেশের জনসংখ্যার অন্তত ২৫ ভাগ মানুষকে দেশে-বিদেশে মোটামুটি একট সচ্ছল জীবনযাপনের একটি সুন্দর পথের ঠিকানা দেওয়া যায়। জনসংখ্যার একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার এমনকি Handyman হতে পারে বা হওয়ার যোগ্যতা রাখে। কিন্তু তার পরও দেশভর্তি কোটি কোটি সাধারণ শ্রমিক বা রিকশাওয়ালা তৈরির ‘কালচার’ বদলানোর জন্য বিগত পাঁচ দশক ধরে আমাদের রাজনীতিবিদেরা বা সরকারগুলো কতটুকু আন্তরিক ছিলেন? ঠিক কী কারণে আমরা এশিয়া মহাদেশের আরেকটি দেশ ফিলিপাইনের মানুষদের মতো বিশ্বজুড়ে নার্স, ইলেকট্রিশিয়ান, মেকানিক, প্লাম্বারসহ নানা ধরনের দক্ষ শ্রমিক সৃষ্টি করতে পারিনি? সব গরিব দেশেই অধিকাংশ রাজনীতিবিদই কমবেশি দুর্নীতি করে থাকেন। কিন্তু বাংলাদেশের তথাকথিত শিক্ষিত বা আধাশিক্ষিত রাজনীতিবিদ নামক ‘জানোয়ার’দের বিবেক বা চরিত্র বলতে কিছুই নেই। দেশটাকে তারা কোটি কোটি অবৈধ টাকা বানানোর কারখানা হিসেবে ব্যবহার করছেন স্বাধীনতার পর থেকেই। জাতি হিসেবে এর চেয়ে বড় লজ্জা ও দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে?
ভালো কথা, আমার নিকটতম বন্ধু Handyman মিস্টার সোলানো এখন আয় করেন প্রতি মাসে কমপক্ষে কুড়ি হাজার ডলার। মাঝেমধ্যে তারও বেশি। একবার মাত্র দুই সপ্তাহে তার আয় ছিল ২৪ হাজার ডলার-নিকটবর্তী অভিজাত এলাকা Beverly Hills-এ এক মিলিয়নিয়ারের বাড়িতে চোখ-ঝলসানো এক বাথরুম রেনোভেট (Renovate) করে। ভাবছি, কী করতে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্তই লেখাপড়া করেছিলাম? সাধারণ বিষয়গুলো পড়ে বছরের অতীব মূল্যবান সময়ের মারাত্মক অপচয় করে যাই আমাদেরই একাংশ। আসলে সবার মাথার ‘ঘিলু তো একরকম হয় না। ছোটবেলা থেকেই আমি Liberal Arts-এর ছাত্র। তার মানে ফিজিক্স, অঙ্ক, কেমিস্ট্রি, স্ট্যাটিসটিকস, ক্যালকুলাস ইত্যাদি বিষয়ের বই দেখলেই আমি ভয় পেতাম। অন্যদিকে মানুষকে ঠকানো, মানুষের সঙ্গে চালাকি বা বাটপারি করে নিজের আখের গোছানো ইত্যাদি টেকনিকও (Technique) কোনো দিন রপ্ত করতে পারিনি। ভ্যাগিস, আমার এক বোন মার্কিন নাগরিক হয়েছিলেন তারই সমবয়সী এক বাংলাদেশি ফার্মাসিস্টকে বিয়ে করে সেই ১৯৭৩ সালে। সেই সূত্রের বদান্যতায় আমিও আছি এই দেশে ১৯৭৫ সাল থেকেই। তা না হলে হয়তো বাংলাদেশে রাজনীতির কারণে বহু আগেই মারা পড়তাম। কারণ আমি ১৯৬০ সাল থেকেই রাজনীতির পোকা বনে গিয়েছিলাম তৎকালীন ঢাকা শহরে। আর যদি ভাগ্যক্রমে না-ও মারা পড়তাম, তাহলে হয়তো-বা কোনো এক স্কুলের মাস্টার বনে গিয়ে ছাত্রদের ইতিহাস-ভূগোল পড়িয়ে তাদের ব্রেন (Brain) গুলোকে অনুৎপাদক শিক্ষার পথে ধাবিত করে তাদের চিরদিনের জন্যই গরিব হয়ে বেঁচে থাকার পথ বাতলে দিতাম। আবার ভাগ্য যদি আরও বেশি খারাপ হতো, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েও কোনো রকম ‘মামা’র জোর না থাকায় চাকরি-বাকরি জোগাড় করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত ঢাকা শহরে একজন রিকশাওয়ালা ‘মামা’ বনে গিয়ে রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ের মধ্যে কঠোর পরিশ্রম করে করে দরিদ্রতার চরম কশাঘাত সইতে সইতে একদিন হয়তো হঠাৎ করেই ‘অক্কা’ পেতাম।
মানুষের জীবন বা আমাদের ভাগ্য সব সময় নিয়মকানুন মেনে চলে না। কারণে-অকারণে, ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় ‘দুর্ভাগ্য’ আমাদের সহসাই গ্রাস করতে পারে যখন তখন। এটা প্রায়ই লক্ষণীয় যে আমরা যেসব বিষয়ে লেখাপড়া করে বড় হই, সেসব বিষয়কে ভিত্তি করে আর চাকরি করতে পারি না। কারণ সেসব বিষয়ভিত্তিক চাকরি প্রায়ই সহজলভ্য হয় না। অনুৎপাদক ও চাহিদাবিহীন শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আমাদের অধিকাংশকেই কম বেতনের চাকরি পেয়েই খুশি থাকতে হয় সারা জীবনের জন্যই। অন্যদিকে ডাক্তার, নার্স, ইঞ্জিনিয়ার, নানা কিসিমের টেকনিশিয়ান বা ‘হ্যান্ডিম্যান’রা, নিজেদের স্কুল-কলেজ লাইফের পছন্দনীয় বিষয়গুলোতে চাকরি করে ক্রমেই ধনিক শ্রেণিতে পরিণত হন একেবারে সৎপথেই প্রচুর টাকা-পয়সা আয় করে। এ কারণেই কারিগরি ও বিজ্ঞানভিত্তিক সাবজেক্টগুলোর গুরুত্ব আমরা বা আমাদের সরকারগুলো যতই তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবেন, জাতি হিসেবে আমাদের দৈন্য বা দরিদ্রতার হাত থেকে আমরা ততই তাড়াতাড়ি মুক্তি পাব বৈকি!