‘জেন-জি’ বিপ্লবের সূতিকাগার দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যৎ কোন পথে

প্রকাশ : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৮:৪৫ , অনলাইন ভার্সন
ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, আফগানিস্তানের মানুষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক মিল রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জনসংখ্যা, শিক্ষা, জীবনযাত্রা প্রায় একই। অনুন্নত কিংবা উন্নয়নশীল দেশগুলো যেন দুর্নীতির কেন্দ্রভূমি। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতার লড়াই, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, শ্রমের মজুরি না পাওয়া, বেকারত্ব, জনজীবনে নিরাপত্তা না থাকা স্বাভাবিক ঘটনা। এক কথায় এরা ঐতিহাসিকভাবে তৃতীয় বিশ্বের দেশ। কিন্তু বর্তমানে এরা নিজেদের উন্নয়নশীল বা স্বল্পোন্নত দেশ বলে দাবি করলেও জীবনমানের কোনো উন্নতি নেই। ফলে হঠাৎ করে তৈরি হয় রাজনৈতিক সংকট। সরকার পতনের মতো বড় অভ্যুত্থান। সাম্প্রতিক সময়ে যেমন শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও নেপালে এ ধরনের চিত্র দেখা যায়।

তফাতটা শুধু পতাকার রং আর স্লোগানে। বাকিটা শুধুই মিল। জনতার স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভে। শাসকের প্রাথমিক অনমনীয়তা আর দমনপীড়নে। শেষ পর্যন্ত প্রবল জনবিক্ষোভের জেরে পতন এবং পলায়নে। কলম্বো, ঢাকার পরে এবার কাঠমাণ্ডুও দেখলো একই চিত্র। চার বছরের মধ্যে তিন দেশে গণ-আন্দোলনের জেরে হলো ক্ষমতাবদল।

২০২২ সালের জুলাই মাসে আর্থিক মন্দায় বিধ্বস্ত শ্রীলঙ্কায় বিক্ষুব্ধ জনতার নিশানা হয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে এবং তদারকি প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমসিংঘের (গণরোষের জেরে গোতাবায়ার দাদা মাহিন্দা প্রধানমন্ত্রী পদে ইস্তফা দিয়ে দেশ ছাড়ার পরে যিনি দায়িত্ব নিয়েছিলেন) সরকারি বাসভবনের দখল নিয়েছিল বিদ্রোহী জনতা। 

২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশে কোটা সংস্কার বিরোধী আন্দোলন রূপ নিয়েছিল দেড় দশকের শাসকদল আওয়ামী লীগবিরোধী হিংসাত্মক বিক্ষোভে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইস্তফা দিয়ে দেশ ছাড়ার পরে তার সরকারি আবাস গণভবনেরও একই পরিণতি হয়েছিল। 
গত কয়েক বছর ধরে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে রাজনৈতিক পালাবদলের হাওয়া বইছে। গত চার বছরে গণ-আন্দোলনের মুখে সরকার পতন হয়েছে তিনটি দেশে। বড় ধরনের আন্দোলন দেখেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গও। বিক্ষোভ হয়েছে ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, মিয়ানমারেও। 
অনেকেই দক্ষিণ এশিয়ার এই সরকার পতন কিংবা সরকারবিরোধী আন্দোলনের ঢেউকে আরব বসন্তের সঙ্গে তুলনা করতে চান। 
যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক রাজনীতি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক পল স্ট্যানিল্যান্ড এ প্রসঙ্গে বলেন, শাসক শ্রেণিকে দুর্নীতিগ্রস্ত ও অদক্ষ হিসেবে দেখার যে ধারণা তৈরি হয়েছে, সেটিই বড় ধরনের রাজনৈতিক সংকটের ভিত্তি তৈরি করেছে। 

তথ্যমতে, দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশে বাস করে দুই বিলিয়নের বেশি মানুষ, যারা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২৫ শতাংশ। ফলে এ অঞ্চল বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে অধিক জনসংখ্যা এবং শিল্পায়ন না হওয়ার ফলে অর্থনৈতিকভাবে স্থিতিশীল নয় এখানকার অর্থনীতি। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশ ঐতিহাসিকভাবে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটি ছিল। ১৭০০ সালের মতো নিকট অতীতেও এ অঞ্চল বিশ্বের জিডিপির ২৫ শতাংশ ধারণ করতো। কিন্তু ঔপনিবেশিক সময়কালে উল্লেখযোগ্য বি-শিল্পায়নের শিকার হয়। এর ফলে চরম দারিদ্র্যের হারও বৃদ্ধি পেয়ে দ্বিগুণ হয়। বর্তমানে ভারত, বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে শিল্পায়ন হলেও জনসংখ্যার অনুপাতে তা যথেষ্ট নয়। এ অঞ্চলের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর, ফলে দেশগুলোকে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য বিশ্বের প্রভাবশালী সংস্থা বা দেশগুলোর কাছ থেকে ঋণ নিতে হয়, যা একধরনের অর্থনৈতিক চাপ তৈরি করে স্থানীয় অর্থনীতিতে এবং অভ্যন্তরীণ দুর্নীতির ফলে এই সংকট সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। 

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, দুর্নীতি, নিরাপত্তাহীনতার ফলে সাধারণ জনগণ বারবার রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়। দুর্নীতি, দুঃশাসন, নির্যাতন-নিপীড়ণের মাধ্যমে সীমা লংঘণ, জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে ‘জেন-জি’ বা তরুণ প্রজন্মের যুদ্ধ ঘোষণা। তারা সফলও হয়েছে। আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী শাসকগোষ্ঠীকে হটিয়ে ‘জেন-জি’রা নিজেদের শক্তিমত্তার প্রমাণ দিয়েছে। জেন-জি’দের আকস্মিক গণবিস্ফোরণের ভয়ে দক্ষিণ এশিয়ার বাকি দেশগুলোও আতঙ্কগ্রস্ত। চরম অস্থির পরিস্থিতির শঙ্কায় রয়েছে ভারত, মালদ্বীপ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান।

এদিকে, দক্ষিণ এশিয়ার তিন দেশে ‘জিন-জি’ বসন্তের পর এখন চরম আতঙ্কে ভারতজুড়ে। কারণ যেভাবে শ্রীলঙ্কা-বাংলাদেশের ছায়া নেপালে পড়েছে, তা চিন্তারই বিষয়। মাত্র দুইদিনে তরুণদের বিক্ষোভে পদত্যাগে বাধ্য হয়ে দেশ ছেড়ে পালান প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি। তরুণদের নজিরবিহীন আন্দোলনে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় নেপালের মসনদ। প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীরা পদত্যাগ করেছেন। কেউ কেউ পালিয়েছেন। যারা পালাতে পারেননি, তাদের তাড়া করে মারপিট করেছে আন্দোলনকারীরা। অর্থমন্ত্রীকে ধাওয়া দিয়ে মারধরের পর দিগম্বর করে ছুঁড়ে ফেলেছে নদীতে। দুই দিনের বড় আন্দোলনের পর কার্যত সরকারবিহীন অবস্থায় হিমালয়-কন্যা। সেনাবাহিনীর হাতে দায়িত্ব হস্তান্তর করেছেন প্রেসিডেন্ট। অব্যাহত সহিংসতার জেরে বন্ধ হয়েছে বিমানবন্দর। সংসদ ভবন, প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে মন্ত্রীদের বাড়ি।

একে একে প্রতিবেশী বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপের পর নেপালেও এ ধরনের ঘটনা ভারতের জন্য উদ্বেগের। তার ওপর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ইন্দোনেশিয়াও অশান্তিতে। দেশটির সংসদ সদস্যরা জাকার্তায় ন্যূনতম মজুরির প্রায় ১০ গুণ বেশি আবাসন ভাতা পান। দেশের রাজনীতিবিদ এবং প্রশাসনের এ বৈষম্য ও দুর্নীতিতে ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ। তাদের সঙ্গে একাত্ম হয়েছে জেন-জিরা। নেপালের সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানের জেরে নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকিতে পড়েছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেসের সভানেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকার। এ ঝুঁকি থেকে উত্তরণে বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে ইতোমধ্যে সমঝোতা করেছেন মমতা। পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুঁড়ি জেলার চিকেন’স নেক এলাকায় নেপালের সঙ্গে ১০০ কিলোমিটার স্থল সীমান্ত আছে ভারতের।  

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, পরবর্তী জেন-জিদের টাগের্ট হতে যাচ্ছে ভারত। ভারতের মোদি সরকারের টানা ক্ষমতায় থাকা দেশেটিতে এখন প্রকাশ্যেই অনেক সমস্যা সামনে আসছে। দুর্নীতি-অর্থনীতির চাকা সক্রিয় রাখা, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্কযুদ্ধে পরাজয়, চীন-রাশিয়ামুখী পররাষ্ট্রনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে মোদি সরকারের। ২০২৪ সালের পর থেকে বাংলাদেশের সঙ্গেও সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। ফলে ভারতের অভ্যন্তরে ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস নামছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে অমীমাংসিত বৈষম্য, দুর্নীতি এবং প্রবীণ নেতাদের শাসন তরুণ প্রজন্মকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। নেপালের অলি ছিলেন ৭৩, বাংলাদেশের হাসিনা ৭৬, আর শ্রীলঙ্কার রাজাপাকসে ৭৪ বছর বয়সী নেতা। অথচ এই দেশগুলোর প্রায় অর্ধেক জনগণ ২৮ বছরের নিচে।

দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে সম্প্রতি তিনটি দেশে ‘জেন-জি’ বিপ্লবের মাধ্যমে যে নতুন ইতিহাস রচিত, তা থেকে যদি রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়করা শিক্ষা না নেন, তবে এই বিপ্লবের গণজোয়ার দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোকেও ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে ফেলতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
লেখক : সাংবাদিক।
 
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: +880  1338-950041