
২০১১ সালের ৪ জানুয়ারির কথা। উত্তর আফ্রিকার দেশ তিউনিসিয়ার তরুণ সবজি বিক্রেতা মোহাম্মদ বুয়াজিজি নিদারুণ অর্থকষ্টে গায়ে আগুন দিয়ে আত্মাহুতির পথ বেছে নেন। তাঁর এ আগুন আরববিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। দেশে দেশে শুরু হয় সরকারবিরোধী বিক্ষোভ। এসব বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশই তরুণ। এর নামকরণ হয় ‘আরব বসন্ত’।
কয়েক বছর ধরে দক্ষিণ এশিয়ায় যেনো সেই আদলেই বিক্ষোভ-আন্দোলন চলছে। ধরণটা একটু ভিন্ন হলেও মিল অনেক। উভয় বিক্ষোভের কেন্দ্রে দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের বিরোধিতা। দক্ষিণ এশিয়ায় এ বিক্ষোভ একসঙ্গে সব দেশে হচ্ছে না। ধারাবাহিকভাবে ঘটছে। একের পর এক দেশে আন্দোলনে পতন হচ্ছে নিপীড়ক শাসকদের। বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিচ্ছেন যারা, তাদের প্রায় সবার বয়স ১৪ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে।
তারা জেন-জি। তাদের আন্দোলন দেশে দেশে হলেও কিছু বিষয় একই রকম। সেটা হোক শ্রীলঙ্কা, হোক বাংলাদেশ, বা নেপাল। তাদের আন্দোলন প্রচলিত রাজনৈতিক বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে। যে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বৈষম্যে পূর্ণ; স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, অর্থ পাচার, অভিজাততন্ত্র, অনিয়ম যেখানে সাধারণ বিষয়।
নেপালে গত ৯ সেপ্টেম্বর দেশটির প্রধানন্ত্রী কে পি শর্মা অলি জেন-জির বিক্ষোভের মধ্যে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। আগের দিন, গত ৮ সেপ্টেম্বর, ১৯ জনকে গুলি করে হত্যা করে নিরাপত্তা বাহিনী। কিন্তু তা বিক্ষোভকে আরো বেশি উস্কে দেয়। আন্দোলনকারীরা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েন। যথারীতি নেপালের মন্ত্রীদের আবাসিক এলাকায় হামলা হয়, যেমনটা বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে ঘটেছিল। দেশটির সেনাসদস্যরা হেলিকপ্টার দিয়ে মন্ত্রী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের উদ্ধার করেন।
বিক্ষোভে অংশ নেয়া কাঠমান্ডুর ২৭ বছর বয়সী স্নাতকোত্তরের ছাত্র আয়ুশ বাসিয়াল আল জাজিরাকে বলেন, এটি অভূতপূর্ব ঘটনা। স্কুল ও কলেজ শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে। তারা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। তিনি জানান, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায় বিক্ষোভে কর্তৃত্বপরায়ণ সরকারের পতনের ঘটনায় উদ্বুদ্ধ।
বাংলাদেশে ২০২৪-এর জুলাই অভ্যুত্থানে এভাবেই বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ-তরুণীসহ দমনপীড়ন উপেক্ষা করে লাখ লাখ সাধারণ মানুষ সরকারবিরোধী বিক্ষোভে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। এতে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন শাসকরা। তবে বাংলাদেশের মতো নেপালে হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছোঁড়া, ব্যাপক হারে গুলি চালিয়ে নাগরিকদের হত্যার ঘটনা ঘটেনি। বাংলাদেশে দেড় হাজার মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। পঙ্গু হয়েছে অন্তত ১০ হাজার মানুষ। তবে দুই সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো একই রকমÑ বৈষম্য, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, অর্থ পাচার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ।
সর্বশেষ যে বিষয়ে নিয়ে আন্দোলন হয়, সেটা ছিল ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যম বন্ধ করে দেয়া। কার্যত এটা ছিল দৃশ্যমান দিক। নেপালের অভ্যন্তরে দীর্ঘদিন ধরে আগ্নেয়গিরির মতো দানা বাঁধছিল ক্ষোভের আগুন। দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক। সেখানকার তরুণদের অভিযোগ, রাজনীতিকদের সন্তানরা বিলাসবহুল জীবন যাপন করছেন, আর তারা বিশ্ববদ্যালয়ে পড়ার খরচ চালাতেই হিমশিম খাচ্ছেন।
কার্যত নতুন এ প্রজন্ম, যাকে আমরা জেন-জি বলছি, বিভিন্ন দেশে প্রচলিত যে তাদের সম্পর্কে শাসক শ্রেণির স্পষ্ট ধারণা নেই। এ শাসক শ্রেণি কপট ও গিরগিটির মতো রং পরিবর্তনকারী। ধমক দিলে লেজ গুটিয়ে পালায়। এ কারণে ক্ষমতায় থাকাকালে তারা কপটতা ও ধমক দেয়ার মতো অস্ত্রই ব্যবহার করে। তারা হত্যা-খুনের মাধ্যমে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে। জেন-জির ক্ষেত্রে এটা কার্যকর হয় না। বাংলাদেশ বা শ্রীলঙ্কায় হয়নি। নেপালেও না। এরা অনমনীয়; জেদে অটল; আবেগপ্রবণ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার।
দক্ষিণ এশিয়ায় একে একে পরিবর্তন আসছে। শ্রীলঙ্কায় নতুন সরকার এসেছে। বাংলাদেশে আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটলে অন্তর্বর্তী সরকার নতুন নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে। নেপালেও নতুন সরকার আসবে। আর নতুন মানেই সম্ভাবনা।
এ অঞ্চলে পরিবর্তনগুলো ঘটছে বৃহৎ দেশ ভারতের চারপাশে। দীর্ঘদিন ধরে দেশটিতে শাসন করছে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার। এ সরকারের জনপ্রিয়তায়ও ধস নেমেছে বলে জানা যায়। কংগ্রেসসহ বিভিন্ন বিরোধী দল বলছে, সর্বশেষ ২০২৪ সালে যে লোকসভা নির্বাচন হয়, সেখানেও বিজেপি ভালো ফল করেনি। ভোট কারচুপির মাধ্যমে দলটি জয় পেয়েছে।
ডলারের বিপরীতে রুপির দর পতন অব্যাহত আছে। দেশটিতে বেকারত্ব বাড়ছে। এ অবস্থায় মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা-এর মতো যুক্তরাষ্ট্র ভারতের পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। এটা বহাল থাকলে মোদি সরকারের পক্ষে ভারতের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। আর তা না করতে পারলে মোদির টিকে থাকাও কঠিন হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
কয়েক বছর ধরে দক্ষিণ এশিয়ায় যেনো সেই আদলেই বিক্ষোভ-আন্দোলন চলছে। ধরণটা একটু ভিন্ন হলেও মিল অনেক। উভয় বিক্ষোভের কেন্দ্রে দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের বিরোধিতা। দক্ষিণ এশিয়ায় এ বিক্ষোভ একসঙ্গে সব দেশে হচ্ছে না। ধারাবাহিকভাবে ঘটছে। একের পর এক দেশে আন্দোলনে পতন হচ্ছে নিপীড়ক শাসকদের। বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিচ্ছেন যারা, তাদের প্রায় সবার বয়স ১৪ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে।
তারা জেন-জি। তাদের আন্দোলন দেশে দেশে হলেও কিছু বিষয় একই রকম। সেটা হোক শ্রীলঙ্কা, হোক বাংলাদেশ, বা নেপাল। তাদের আন্দোলন প্রচলিত রাজনৈতিক বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে। যে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বৈষম্যে পূর্ণ; স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, অর্থ পাচার, অভিজাততন্ত্র, অনিয়ম যেখানে সাধারণ বিষয়।
নেপালে গত ৯ সেপ্টেম্বর দেশটির প্রধানন্ত্রী কে পি শর্মা অলি জেন-জির বিক্ষোভের মধ্যে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। আগের দিন, গত ৮ সেপ্টেম্বর, ১৯ জনকে গুলি করে হত্যা করে নিরাপত্তা বাহিনী। কিন্তু তা বিক্ষোভকে আরো বেশি উস্কে দেয়। আন্দোলনকারীরা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েন। যথারীতি নেপালের মন্ত্রীদের আবাসিক এলাকায় হামলা হয়, যেমনটা বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে ঘটেছিল। দেশটির সেনাসদস্যরা হেলিকপ্টার দিয়ে মন্ত্রী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের উদ্ধার করেন।
বিক্ষোভে অংশ নেয়া কাঠমান্ডুর ২৭ বছর বয়সী স্নাতকোত্তরের ছাত্র আয়ুশ বাসিয়াল আল জাজিরাকে বলেন, এটি অভূতপূর্ব ঘটনা। স্কুল ও কলেজ শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে। তারা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। তিনি জানান, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায় বিক্ষোভে কর্তৃত্বপরায়ণ সরকারের পতনের ঘটনায় উদ্বুদ্ধ।
বাংলাদেশে ২০২৪-এর জুলাই অভ্যুত্থানে এভাবেই বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ-তরুণীসহ দমনপীড়ন উপেক্ষা করে লাখ লাখ সাধারণ মানুষ সরকারবিরোধী বিক্ষোভে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। এতে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন শাসকরা। তবে বাংলাদেশের মতো নেপালে হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছোঁড়া, ব্যাপক হারে গুলি চালিয়ে নাগরিকদের হত্যার ঘটনা ঘটেনি। বাংলাদেশে দেড় হাজার মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। পঙ্গু হয়েছে অন্তত ১০ হাজার মানুষ। তবে দুই সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো একই রকমÑ বৈষম্য, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, অর্থ পাচার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ।
সর্বশেষ যে বিষয়ে নিয়ে আন্দোলন হয়, সেটা ছিল ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যম বন্ধ করে দেয়া। কার্যত এটা ছিল দৃশ্যমান দিক। নেপালের অভ্যন্তরে দীর্ঘদিন ধরে আগ্নেয়গিরির মতো দানা বাঁধছিল ক্ষোভের আগুন। দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক। সেখানকার তরুণদের অভিযোগ, রাজনীতিকদের সন্তানরা বিলাসবহুল জীবন যাপন করছেন, আর তারা বিশ্ববদ্যালয়ে পড়ার খরচ চালাতেই হিমশিম খাচ্ছেন।
কার্যত নতুন এ প্রজন্ম, যাকে আমরা জেন-জি বলছি, বিভিন্ন দেশে প্রচলিত যে তাদের সম্পর্কে শাসক শ্রেণির স্পষ্ট ধারণা নেই। এ শাসক শ্রেণি কপট ও গিরগিটির মতো রং পরিবর্তনকারী। ধমক দিলে লেজ গুটিয়ে পালায়। এ কারণে ক্ষমতায় থাকাকালে তারা কপটতা ও ধমক দেয়ার মতো অস্ত্রই ব্যবহার করে। তারা হত্যা-খুনের মাধ্যমে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে। জেন-জির ক্ষেত্রে এটা কার্যকর হয় না। বাংলাদেশ বা শ্রীলঙ্কায় হয়নি। নেপালেও না। এরা অনমনীয়; জেদে অটল; আবেগপ্রবণ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার।
দক্ষিণ এশিয়ায় একে একে পরিবর্তন আসছে। শ্রীলঙ্কায় নতুন সরকার এসেছে। বাংলাদেশে আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটলে অন্তর্বর্তী সরকার নতুন নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে। নেপালেও নতুন সরকার আসবে। আর নতুন মানেই সম্ভাবনা।
এ অঞ্চলে পরিবর্তনগুলো ঘটছে বৃহৎ দেশ ভারতের চারপাশে। দীর্ঘদিন ধরে দেশটিতে শাসন করছে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার। এ সরকারের জনপ্রিয়তায়ও ধস নেমেছে বলে জানা যায়। কংগ্রেসসহ বিভিন্ন বিরোধী দল বলছে, সর্বশেষ ২০২৪ সালে যে লোকসভা নির্বাচন হয়, সেখানেও বিজেপি ভালো ফল করেনি। ভোট কারচুপির মাধ্যমে দলটি জয় পেয়েছে।
ডলারের বিপরীতে রুপির দর পতন অব্যাহত আছে। দেশটিতে বেকারত্ব বাড়ছে। এ অবস্থায় মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা-এর মতো যুক্তরাষ্ট্র ভারতের পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। এটা বহাল থাকলে মোদি সরকারের পক্ষে ভারতের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। আর তা না করতে পারলে মোদির টিকে থাকাও কঠিন হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।