সিএনএনের বিশ্লেষণ

যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধ সত্ত্বেও রাশিয়ার তেল কিনতে কেন অনড় ভারত

প্রকাশ : ০৭ অগাস্ট ২০২৫, ১৭:২৯ , অনলাইন ভার্সন
রাশিয়ার থেকে তেল কিনতে বন্ধু রাষ্ট্র ভারতকে নিষেধ করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, তবে ভারত তা শোনেনি। ফলে নয়াদিল্লির ওপর নেমে এসেছে ট্রাম্পের অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্কের খড়গ। বিষয়টি নিয়ে বর্তমানে নানা মহলে চলছে বিভিন্ন আলোচনা।

যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সঙ্গে এক কঠিন ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছেন নরেন্দ্র মোদি। একদিকে ট্রাম্প ও ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছেন, অন্যদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকার চেষ্টা করছেন তিনি। তবে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে ভারতের এই দ্বিমুখী নীতি হতাশার। মস্কোর ওপর ইউরোপ-আমেরিকার অনেক দেশ নানাভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও ভারতের মতো বিশাল অর্থনীতির একটি দেশ রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখায় তাদের সেসব নিষেধাজ্ঞা অনেকটা দুর্বল হয়ে যায় বলে মনে করে তারা। আর এসব বিষয় নিয়েই চটেছেন ট্রাম্প।

ভারতের এই ‘গাছ থেকে খাওয়া, তলা থেকেও কুড়ানো’ নীতি নিয়ে আর ধৈর্য ধরতে পারছেন না যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। ফলে মোদির কাছে তার স্পষ্ট দাবি, ভারতের নির্দিষ্ট একটি পক্ষ নিতে হবে।

নিজের এই দাবি জোরদার করতে রাশিয়ার থেকে ভারতের সস্তায় তেল কেনার বিষয়টিকে কাজে লাগাচ্ছেন ট্রাম্প। আর এখানে তিনি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন তার বহুল আলোচিত বাণিজ্যনীতি। ফলে এতদিন ‘বন্ধু’ দাবি করে এলেও ধীরে ধীরে মুখোমুখি অবস্থানে চলে যাচ্ছেন ট্রাম্প ও মোদি।

রাশিয়ার থেকে তেল কেনার কারণে ৬ আগস্ট (বুধবার) ভারতের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্কারোপ করেছেন ট্রাম্প। এর ফলে আগের ২৫ শতাংশ পাল্টা শুল্কসহ ভারতীয় পণ্যে মোট ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করল যুক্তরাষ্ট্র। বুধবার থেকে ২১ দিন পর এই নতুন শুল্কহার কার্যকর হবে।

এর আগে, এ বিষয়ে ভারতকে হুমকিও দিয়েছিলেন ট্রাম্প। তখন তার অভিযোগ ছিল, রাশিয়া থেকে তেল কিনে ইউক্রেনে হামলায় মস্কোকে সহায়তা করছে ভারত।

সামাজিক যোগাযাগামাধ্যমে দেওয়া এক পোস্টে তিনি লিখেছিলেন, ‘কেবল বিপুল পরিমাণে রুশ তেল কিনেই থেমে থাকছে না ভারত, তারা সেই তেলের বড় একটি অংশ খোলা বাজারে বিক্রি করে বিশাল মুনাফা করছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধাস্ত্র কত মানুষকে হত্যা করছে, এ নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যাথা নেই।’

এদিকে, অন্যান্য দেশ শুল্ক কমাতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি চুক্তি করতে যেখানে উঠেপড়ে লেগেছে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত শুল্ক আরোপকে ‘অন্যায্য, অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য’ আখ্যা দিয়েছে নয়াদিল্লি। কারণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অনেক দেশ রাশিয়ার কাছ থেকে এখনও সার ও রাসায়নিকসহ অন্যান্য পণ্য কিনছে বলে দাবি করেছে ভারত।

রুশ তেলের ওপর ভারতের নির্ভরশীলতা কেন?

বহুদিন ধরেই রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানি করে আসছে ভারত। ভারতের ১৪০ কোটির জনগণের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই এই তেল আমদানি করা হয়ে থাকে বলে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

বর্তমানে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তেল ব্যবহারকারী দেশ হয়ে উঠেছে ভারত। এমনকি ২০৩০ সালের মধ্যে তেল ব্যবহারে তারা চীনকেও ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকদের অনেকে।

বাণিজ্য বিশ্লেষণ সংস্থা কেপলারের তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ভারতের মোট আমদানির ৩৬ শতাংশই হলো রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল।

অন্য কোথাও থেকে কেন তেল কিনছে না দিল্লি

২০২২ সালে ইউক্রেনে হামলা শুরুর পর ইউরোপের অধিকাংশ দেশ রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করে দেয়। এরপর থেকে রাশিয়ার তেলের প্রধান ক্রেতা হয়ে ওঠে চীন, ভারত ও তুরস্ক।

জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের রাশিয়া ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক কেন্দ্রের সহযোগী অধ্যাপক অমিতাভ সিং জানান, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞায় পড়ে তেল বিক্রির ওপর বড় ধরনের ছাড় দেয় রাশিয়া। সেই ছাড়েই তেল কিনছে ভারত। অন্য কোনো দেশ থেকে এত কম মূল্যে যা সম্ভব নয়। এটি পুরোপুরি একটি ‘অর্থনৈতিক বা বাণিজ্যিক সিদ্ধান্ত’ বলে  মনে করে ভারত। তবে ইউক্রেন ও তার মিত্ররা এটিকে তীব্র সমালোচনার চোখে দেখছে।

যদিও গত কয়েক বছর ধরে ভারত অন্যান্য উৎস থেকেও তেল কিনতে শুরু করেছে, তবে রাশিয়ার থেকে তেল কেনা পুরোপুরি বন্ধ করে দিলে সেই শূন্যতা সহজে পূরণীয় নয় বলে মনে করেন অমিতাভ সিং।

কেপলারের জ্যেষ্ঠ তেল বিশ্লেষক মুইউ জু বলেন, নিজেদের মোট তেলের চাহিদার ৮০ শতাংশই আমদানি করে থাকে ভারত। বিশ্বের প্রধান তেল উৎপাদকদের জোট ওপেক কিছু বাড়তি উৎপাদন ক্ষমতা রাখলেও রাশিয়া দৈনিক সমুদ্রপথে যে পরিমাণ তেল রপ্তানি করে, সেই পরিমাণ তেল উত্তোলন করাটা তাদের জন্য কঠিন। এর আগে, ইরানের তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতা ছিল ভারত। দৈনিক ৪ লাখ ৮০ হাজার ব্যারেল তেন কিনত দিল্লি।

অমিতাভ সিং বলেন, ‘আসলে আমাদের হাত এখন বাঁধা। তেলের বাজার পরিচালনার জন্য ভারতের খুব বেশি পরিসর অবশিষ্ট নেই।’

তার মতে, অন্তত এখনই ট্রাম্পের দাবির কাছে দিল্লির নত হওয়ার সম্ভাবনা কম। মোদি সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনা চালিয়ে যাবে এবং আগের মতো মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেল আমদানির পথ খুঁজবে। তবে রুশ তেলের বাজার থেকে রাতারাতি বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়।

বৈশ্বিক বাজারেও পড়তে পারে প্রভাব

ভারতের অর্থনীতি চলছে রাশিয়ার তেলে, যা বৈশ্বিক তেল বাজারেও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

ভারতের দাবি, রাশিয়ার থেকে তেল কেনার কারণে তারা পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের তেলের জন্য প্রতিযোগিতায় নামেনি। এভাবে তারা বৈশ্বিক বাজারে তেলের দাম কম রাখতে সহায়তা করছে। সরকারের এই দাবিকে সমর্থন করেছেন অধ্যাপক অমিতাভ।

অধ্যাপক অমিতাভ আরও জানান, ভারত যদি অন্য কোনো উৎস থেকে তুলনামূলক বেশি দামে তেল আমদানি শুরু করে, তবে তার প্রভাব মার্কিন ভোক্তারাও টের পাবেন। কারণ রাশিয়ার অপরিশোধিত তেলের একটি অংশ শোধন করে আবার বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে ভারত। এটি শুধু ভারত নয়, অন্যান্য তেল আমদানিকারক দেশের জন্যও সুবিধাজনক।

সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ারের তথ্যমতে, অপরিশোধিত তেল থেকে উৎপাদিত ভারতীয় পণ্যগুলোর বড় ক্রেতাদের মধ্যে রয়েছে ইউরোপ, যুক্তরাজ্য ও খোদ যুক্তরাষ্ট্রও।

ঐতিহাসিক অংশীদারত্ব ও ভারসাম্যের কূটনীতি

ভারত-রাশিয়ার অংশীদারত্ব শুধু তেলেই সীমাবদ্ধ নয়, বহু দশকজুড়ে এই সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।

স্নায়ুযুদ্ধের সময় আনুষ্ঠানিকভাবে নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকলেও সত্তরের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে ঝুঁকে পড়ে ভারত। সে সময় ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানকে সামরিক ও আর্থিক সহায়তা দেওয়া শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। তখন থেকেই ভারতের অন্যতম প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী হয়ে ওঠে রাশিয়া।

তবে গত কয়েক বছরে আবার ওয়াশিংটনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছে ভারত। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ তাদের মিত্র দেশ ফ্রান্স ও ইসরায়েল থেকেও অস্ত্র কেনা বাড়িয়েছে। তবে এখনো রাশিয়ার শীর্ষ অস্ত্র ক্রেতা ভারতই। সেই সঙ্গে কেবল ট্রাম্প নন, পুতিনের সঙ্গেও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে মোদির।

২০১৯ সালের এক জনসভায় ট্রাম্প-মোদি বন্ধুত্বের প্রশংসা করে তৎকালীন এই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের মতো ভারতের আর কখনো এমন বন্ধু ছিল না।’

অধ্যাপক সিং বলেন, ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে হোয়াইট হাউসে ফেরার পরও আশা করা হয়েছিল এই বন্ধুত্ব অব্যাহত থাকবে। কিন্তু এবার সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র একদিকে সাম্প্রতিক ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে সমঝোতার কৃতিত্ব দাবি করছে, আবার ভারতের রুশ তেল কেনাকে রাশিয়ার যুদ্ধাস্ত্র টিকিয়ে রাখার জন্য দায়ী করছে। আর এসব বিষয় নিয়ে অসন্তুষ্ট মোদি সরকার।

অন্যদিকে, দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিনই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিলেও এখনো কিছু করতে না পারায় ট্রাম্প নিজেও হতাশ।

গত সপ্তাহে ট্রুথ সোশ্যালে দেওয়া এক পোস্টে ক্ষোভ প্রকাশ করে ট্রাম্প লিখেছেন, ‘ভারত রাশিয়ার সঙ্গে কী করছে তা আমি পরোয়া করি না। তারা চাইলে একসঙ্গে তাদের মৃতপ্রায় অর্থনীতিকে ধ্বংস করতে পারে। আমার তাতে কিছু যায় আসে না।’

ঠিকানা/এএস 
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: 01711238078