
১৪ জুন, সকাল ৮টা। আমি তখনো বিছানায় শুয়ে টিভিতে নিউজ দেখছি। ২০১৭ সালে অসুস্থতার কারণে নিউইয়র্ক সিটির একটি এজেন্সির ঢাকা থেকে অবসর নেওয়ার পর সকালে বিছানায় শুয়ে অনেকটা সময় ধরে নিউজ দেখা আমার নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। অবসর জীবনের এটা একটা মজার দিক। এর ফলে প্রতিদিন খুব সকালে উঠে হাত মুখ ধুয়ে শেভকরে গোসল সেরে বাস-ট্রেন ধরে কর্মস্থলে যথাসময়ে পৌঁছার তাড়া থেকে মুক্তি মেলে। যদিও, যে অসুস্থতার কারণে আমার এই মুক্তি, সেটা আমার মোটেও কাম্য ছিল না। নিউজ দেখার সময় আমার মেয়েকে বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে দেখি। এত সকালে বাইরে যাওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে সে জানালো, নিউইয়র্ক সিটির ডেমোক্র্যাটিক প্রাইমারি নির্বাচনে ভোট দিতে সে ভোটকেন্দ্রে যাচ্ছে। সেদিন ছিল আগাম ভোটদানের প্রথম দিন। আগাম ভোটপর্ব চলবে ২২ জুন পর্যন্ত। ২৪ জুন মূল ভোটদানের দিন। কিছুক্ষণ পর দেখি তার বে সাইডের বাসা থেকে আমার ছেলেও এখানে এসে হাজির। তারপর দু’জনে মিলে ভোটদানের জন্য বেরিয়ে যায়। পরে জেনেছি, ভোটদানের জন্য তাদের এতটা আগ্রহের কারণ হলো, মেয়র পদে তরুণ-জোহরান মামদানির প্রার্থিতা। বুঝতে পারলাম এই প্রার্থী তরুণ সমাজের মধ্যে এতটাই প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে যে, তারা তাকে ভোট দেয়ার জন্য রীতিমতো উদগ্রীব হয়ে রয়েছে। পরে ছেলের কাছে শুনেছি, জোহরান তার হাইস্কুলের (ব্রংকস সায়েন্স হাইস্কুল) সহপাঠী। হাইস্কুল গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে জোহরান মেইনের বোউডেন (ইড়ফিড়রহ) কলেজে আফ্রিকান স্টাডিজ বিষয়ে তিনি ডিগ্রি নিয়ে রাজনীতিতে যোগ দিয়ে ২০২০ সালে নিউইয়র্কের কুইন্সের ৩৬ ডিস্ট্রিক্ট অ্যাস্টোরিয়া থেকে স্টেট অ্যাসেম্বলি ম্যান নির্বাচিত হন। ২০২২ ও ২০২৪ সালে তিনি এই পদে পুনর্নির্বাচিত হন। তার বিভিন্ন জনসহায়তামুখী পরিকল্পনা ঘোষণার পাশাপাশি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের একনায়ক সুলভ বিভিন্ন বেপরোয়া আবদার-আচরণ, ফিলিস্তিনে ইসরাইলি হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে মামাদানির প্রতিবাদী সাহসী উচ্চারণ আমার পুত্র-কন্যার মতো এই শহরের বহু প্রগতিশীল নাগরিককে তাকে সমর্থন করতে উৎসাহিত করে।
মেয়র পদে মামদানি ছাড়াও অন্যান্যের মধ্যে বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামস ও নিউইয়র্ক স্টেটের সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু ক্যুমোর মতো জাঁদরেল প্রার্থী রয়েছেন। বিভিন্ন জনমত জরিপে ক্যুমো এগিয়ে থাকায়, তিনি নির্বাচনে ফ্রন্টরানার হিসাবে গণ্য হন। বড় বড় কর্পোরেশনের বহু ধনকুবের কোটিপতি তাকে নির্বাচিত করতে বিপুল অর্থসহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসেন। এ ক্ষেত্রে নিউইয়র্কের সাবেক মেয়র মাইকেল ব্লুমবার্গ একাই তাকে ৮ মিলিয়ন ডলার অর্থসহায়তার ঘোষণা দেন।
নিউইয়র্ক স্টেটের রাজনীতিতে ক্যুমোর পরিবারের বিপুল প্রভাব-প্রতিপত্তি রয়েছে। তার বাবা মারিও ক্যুমো একসময় নিউইয়র্ক স্টেটের গভর্নর ছিলেন। তাদের সঙ্গে এই শহরের এলিট সম্প্রদায়ের গভীর সুসম্পর্ক রয়েছে। বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামসও অর্থবিত্ত ও জনসমর্থনের দিক দিয়ে তেমন পিছিয়ে নেই। এই শহরের কমবেশি সাড়ে ৮৮ মিলিয়ন জনসংখ্যার একটি বড় অংশ কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী।
এই জনগোষ্ঠী তার মূল ভোট ব্যাংক হলেও, অন্যান্য সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মধ্যেও তার সমর্থকের সংখ্যা একেবারে কম বলা যাবে না। সেই হিসাবে তিন মেয়াদে স্টেট অ্যাসেম্বলি ম্যান হিসেবে নিউইয়র্ক স্টেটের রাজনীতিতে যুক্ত থাকলেও এই শহরের মূল ধরার রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে তার তেমন একটা পরিচিতি নেই। মেয়র পদে প্রার্থিতা ঘোষণার পূর্বপর্যন্ত মিডিয়াতে তার উপস্থিতি খুব কম থাকায়, তিনি অন্য দু’জনের তুলনায় এই শহরের মানুষের কাছে স্বল্প পরিচিত। যদিও, মেয়র পদে নির্বাচনী প্রচারণায় তার বিভিন্ন জনমুখী ও বাস্তবানুগ পরিকল্পনার কথা প্রকাশ পেলে তিনি মিডিয়াসহ বিপুল জনগোষ্ঠীর ব্যাপক মনযোগ আকর্ষণে সক্ষম হন। তা ছাড়া তার নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় বিপুলসংখ্যক তরুণের অংশগ্রহণ ও নিজে শহরের বিভিন্ন জনপদে হেঁটে হেঁটে যেভাবে তিনি জনমানুষের সঙ্গে মিশে গিয়ে তার নির্বাচনী এজেন্ডা পৌঁছে দেন, তা সব শ্রেণীর ভোটারসহ বহু মহলের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়। অনেকে তার এজেন্ডা পৌঁছে দেয়ার কৌশলকে অসাধারণ ও অনুকরণীয় বলে অভিমত প্রকাশ করেন।
একজন প্রার্থীর সশরীরে হেঁটে জনতার দুয়ারে হাজির হওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এক্ষেত্রে মামদানির হাঁটার ব্যাপক সক্ষমতা ও সেই সক্ষমতার ব্যাপক প্রয়োগ খুবই কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়, যেটা ২৪ জুন ভোটগ্রহণ শেষে ভোটের ফলাফলে প্রতিফলিত হয়। সব জরিপ ও রাজনৈতিক পণ্ডিতদের ধারণা মিথ্যে প্রমাণ করে জোহরান মামদানি বিপুল ভোটে জয়ী হন। পরে ভোটের চূড়ান্ত গণনায় দেখা যায়, ক্যুমোর ৪৪ ভাগ ভোটপ্রাপ্তির বিপরীতে মামদানি ৫৬ ভাগ ভোট পেয়ে আগামী নভেম্বরে মেয়র পদের সাধারণ নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী মনোনীত হন। এরিক অ্যাডামস ও ক্যুমো নির্বাচনে হেরে প্রতিযোগিতা থেকে সরে না গিয়ে নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দেন। নিউইয়র্ক শহরে ডেমোক্র্যাট ভোটারদের বিপুল সংখ্যাধিক্য থাকায় বড় কোনো অঘটন না ঘটলে মেয়র পদে মামদানির বিজয় এক রকম স্বতন্ত্র প্রার্থী ক্যুমো ও এরিক অ্যাডামসের মধ্যে ভোট ভাগাভাগির কারণে মামদানির বিজয়ের সম্ভাবনা উজ্জ্বলতর হয়েছে।
জোহরান মামদানির নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণার মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল শহরের বিশেষ করে সীমিত আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় সহজসাধ্য করা (Affordability)। এটা করতে তিনি বাড়ি ভাড়া বিশেষ করে রেন্ট স্ট্যাবিলাইজড বাড়িঘরের ভাড়াবৃদ্ধি বন্ধ (Rent Freeze), বিনাভাড়ায় সরকারি বাসে যাতায়াতের সুবিধা, সুলভ চাইল্ড কেয়ার, সুলভমূল্যে গ্রোসারি-সামগ্রী বিক্রির জন্য সরকারি উদ্যোগে সুপার মার্কেট চালু জাতীয় পদক্ষেপ গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দেন। তথ্যমতে, বড় বড় কর্পোরেশন ও বছরে ১ মিলিয়ন ডলারের উপর যাদের আয়, তাদের উপর শতকরা ২ ভাগ কর আরোপের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দিয়ে উপরি উক্ত সুবিধাদির ব্যয় মেটানো হবে। মামদানির এসব জনমুখী পরিকল্পনার বিপরীতে অন্য প্রার্থীদের অনেকে মূলত মিডিয়ায় সরব থেকে বিদ্যমান উচ্চমূল্যের অসহনীয় পরিস্থিতির পরিবর্তনের পরিবর্তে কমবেশি স্থিতাবস্থা (Status quo) বজায় রাখার পক্ষে অবস্থান নেয়ায় তারা ব্যাপক জনগণের সমর্থন অর্জনে ব্যর্থ হন।
জোহরান মামদানি মেয়র নির্বাচিত হলে তিনি হবেন নিউইয়র্ক শহরের প্রথম দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত একজন মুসলমান মেয়র। মামদানির বাবা মাহমুদ মামদানি একজন অধ্যাপক ও মামী নায়ার একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা। তার নির্মিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চরচ্চিত্র হলো, মনসুন ওয়েডিং, সালাম বোম্বে ও মিসিসিপিমসালা ইত্যাদি। তার পিতা-মাতা দু’জনেই ভারতীয় বংশোদ্ভূত। জোহরান মামদানির জন্ম আফ্রিকার উগান্ডায় হলেও ৭ বছর বয়স থেকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বাস করছেন।
একজন দক্ষিণ এশীয় ও সর্বোপরি একজন মুসলমান ব্যক্তির নিউইয়র্কের মতো যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম শহরের মেয়র হওয়ার বিষয়টিকে সবাই সুনজরে দেখবেন, সেটা আশাকরা সম্ভবত ঠিক হবে না। প্রাইমারি নির্বাচনে জনগণের ব্যাপক সমর্থন পেয়ে মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন লাভে সক্ষম হলেও সাধারণ নির্বাচনের পূর্ব পর্যন্ত কুসুমাস্তীর্ণ হবে, সেটা ভাবার কারণ নেই। তাকে একজন কট্টর কমিউনিস্ট আখ্যা দিয়ে তার মেয়র হওয়া ঠেকাতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এরইমধ্যে তার সর্বশক্তি নিয়োগের আভাস দিয়েছেন। এ লক্ষ্যে তার ইমিগ্রেশন রেকর্ড খতিয়ে দেখার ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। শোনা যায়, কলেজে ভর্তির আবেদনে মামদানি নিজের জাতিগত পরিচয় (Ethnicity) দক্ষিণ এশীয় না লিখে আফ্রিকান আমেরিকান লেখেন। এটাকে ভুয়া তথ্য প্রদানের অভিযোগ করে জল ঘোলার চেষ্টা চলছে বলে কানাঘুষা রয়েছে। বিশেষ করে কোটিপতিদের উপর কর আরোপ যুদ্ধাপরাধী হিসাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত কর্তৃক অভিযুক্ত ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু নিউইয়র্কে এলে মামদানি কর্তৃক তাকে গ্রেপ্তারের ঘোষণায় ইসরাইল সমর্থক বিভিন্ন মহল তার উপর বেজায় ক্ষুব্ধ। এসব মহল তার বক্তব্যকে ইহুদিবিরোধী (Anti-Semitic) মনোভাবের প্রকাশ বলে প্রচার চালাচ্ছে।
যত সত্য নির্ভরই হোক, যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল ও তার সমর্থকদের সম্পর্কে কথাবার্তা ও বক্তব্যকে প্রায়ই ইহুদিবিরোধী আখ্যা দিয়ে তাকে ধামা চাপা দেয়া ও এ ধরনের বক্তব্য দানকারীকে নানাভাবে হেয় ও অপদস্ত করার একটি প্রবণতা বিদ্যমান। ইতোমধ্যে বিশেষ করে, ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যে তার দু-একজন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে এটা নিয়ে তার সম্পর্কে অপপ্রচারে লিপ্ত হতে দেখা যায়। এমতাবস্থায়, ইসরাইল সংক্রান্ত বিষয়ে কথাবার্তায় জোহরান মামদানির আরও সতর্ক ও সাবধানী হওয়া সমীচীন হবে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করেন, নতুবা তার মেয়র হওয়ার সম্ভাবনা বিপন্ন ও বাধাগ্রস্ত হতে পারে বলে অনেকে ধারণা করেন।
লেখক : কলামিস্ট।
মেয়র পদে মামদানি ছাড়াও অন্যান্যের মধ্যে বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামস ও নিউইয়র্ক স্টেটের সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু ক্যুমোর মতো জাঁদরেল প্রার্থী রয়েছেন। বিভিন্ন জনমত জরিপে ক্যুমো এগিয়ে থাকায়, তিনি নির্বাচনে ফ্রন্টরানার হিসাবে গণ্য হন। বড় বড় কর্পোরেশনের বহু ধনকুবের কোটিপতি তাকে নির্বাচিত করতে বিপুল অর্থসহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসেন। এ ক্ষেত্রে নিউইয়র্কের সাবেক মেয়র মাইকেল ব্লুমবার্গ একাই তাকে ৮ মিলিয়ন ডলার অর্থসহায়তার ঘোষণা দেন।
নিউইয়র্ক স্টেটের রাজনীতিতে ক্যুমোর পরিবারের বিপুল প্রভাব-প্রতিপত্তি রয়েছে। তার বাবা মারিও ক্যুমো একসময় নিউইয়র্ক স্টেটের গভর্নর ছিলেন। তাদের সঙ্গে এই শহরের এলিট সম্প্রদায়ের গভীর সুসম্পর্ক রয়েছে। বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামসও অর্থবিত্ত ও জনসমর্থনের দিক দিয়ে তেমন পিছিয়ে নেই। এই শহরের কমবেশি সাড়ে ৮৮ মিলিয়ন জনসংখ্যার একটি বড় অংশ কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী।
এই জনগোষ্ঠী তার মূল ভোট ব্যাংক হলেও, অন্যান্য সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মধ্যেও তার সমর্থকের সংখ্যা একেবারে কম বলা যাবে না। সেই হিসাবে তিন মেয়াদে স্টেট অ্যাসেম্বলি ম্যান হিসেবে নিউইয়র্ক স্টেটের রাজনীতিতে যুক্ত থাকলেও এই শহরের মূল ধরার রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে তার তেমন একটা পরিচিতি নেই। মেয়র পদে প্রার্থিতা ঘোষণার পূর্বপর্যন্ত মিডিয়াতে তার উপস্থিতি খুব কম থাকায়, তিনি অন্য দু’জনের তুলনায় এই শহরের মানুষের কাছে স্বল্প পরিচিত। যদিও, মেয়র পদে নির্বাচনী প্রচারণায় তার বিভিন্ন জনমুখী ও বাস্তবানুগ পরিকল্পনার কথা প্রকাশ পেলে তিনি মিডিয়াসহ বিপুল জনগোষ্ঠীর ব্যাপক মনযোগ আকর্ষণে সক্ষম হন। তা ছাড়া তার নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় বিপুলসংখ্যক তরুণের অংশগ্রহণ ও নিজে শহরের বিভিন্ন জনপদে হেঁটে হেঁটে যেভাবে তিনি জনমানুষের সঙ্গে মিশে গিয়ে তার নির্বাচনী এজেন্ডা পৌঁছে দেন, তা সব শ্রেণীর ভোটারসহ বহু মহলের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়। অনেকে তার এজেন্ডা পৌঁছে দেয়ার কৌশলকে অসাধারণ ও অনুকরণীয় বলে অভিমত প্রকাশ করেন।
একজন প্রার্থীর সশরীরে হেঁটে জনতার দুয়ারে হাজির হওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এক্ষেত্রে মামদানির হাঁটার ব্যাপক সক্ষমতা ও সেই সক্ষমতার ব্যাপক প্রয়োগ খুবই কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়, যেটা ২৪ জুন ভোটগ্রহণ শেষে ভোটের ফলাফলে প্রতিফলিত হয়। সব জরিপ ও রাজনৈতিক পণ্ডিতদের ধারণা মিথ্যে প্রমাণ করে জোহরান মামদানি বিপুল ভোটে জয়ী হন। পরে ভোটের চূড়ান্ত গণনায় দেখা যায়, ক্যুমোর ৪৪ ভাগ ভোটপ্রাপ্তির বিপরীতে মামদানি ৫৬ ভাগ ভোট পেয়ে আগামী নভেম্বরে মেয়র পদের সাধারণ নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী মনোনীত হন। এরিক অ্যাডামস ও ক্যুমো নির্বাচনে হেরে প্রতিযোগিতা থেকে সরে না গিয়ে নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দেন। নিউইয়র্ক শহরে ডেমোক্র্যাট ভোটারদের বিপুল সংখ্যাধিক্য থাকায় বড় কোনো অঘটন না ঘটলে মেয়র পদে মামদানির বিজয় এক রকম স্বতন্ত্র প্রার্থী ক্যুমো ও এরিক অ্যাডামসের মধ্যে ভোট ভাগাভাগির কারণে মামদানির বিজয়ের সম্ভাবনা উজ্জ্বলতর হয়েছে।
জোহরান মামদানির নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণার মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল শহরের বিশেষ করে সীমিত আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় সহজসাধ্য করা (Affordability)। এটা করতে তিনি বাড়ি ভাড়া বিশেষ করে রেন্ট স্ট্যাবিলাইজড বাড়িঘরের ভাড়াবৃদ্ধি বন্ধ (Rent Freeze), বিনাভাড়ায় সরকারি বাসে যাতায়াতের সুবিধা, সুলভ চাইল্ড কেয়ার, সুলভমূল্যে গ্রোসারি-সামগ্রী বিক্রির জন্য সরকারি উদ্যোগে সুপার মার্কেট চালু জাতীয় পদক্ষেপ গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দেন। তথ্যমতে, বড় বড় কর্পোরেশন ও বছরে ১ মিলিয়ন ডলারের উপর যাদের আয়, তাদের উপর শতকরা ২ ভাগ কর আরোপের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দিয়ে উপরি উক্ত সুবিধাদির ব্যয় মেটানো হবে। মামদানির এসব জনমুখী পরিকল্পনার বিপরীতে অন্য প্রার্থীদের অনেকে মূলত মিডিয়ায় সরব থেকে বিদ্যমান উচ্চমূল্যের অসহনীয় পরিস্থিতির পরিবর্তনের পরিবর্তে কমবেশি স্থিতাবস্থা (Status quo) বজায় রাখার পক্ষে অবস্থান নেয়ায় তারা ব্যাপক জনগণের সমর্থন অর্জনে ব্যর্থ হন।
জোহরান মামদানি মেয়র নির্বাচিত হলে তিনি হবেন নিউইয়র্ক শহরের প্রথম দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত একজন মুসলমান মেয়র। মামদানির বাবা মাহমুদ মামদানি একজন অধ্যাপক ও মামী নায়ার একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা। তার নির্মিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চরচ্চিত্র হলো, মনসুন ওয়েডিং, সালাম বোম্বে ও মিসিসিপিমসালা ইত্যাদি। তার পিতা-মাতা দু’জনেই ভারতীয় বংশোদ্ভূত। জোহরান মামদানির জন্ম আফ্রিকার উগান্ডায় হলেও ৭ বছর বয়স থেকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বাস করছেন।
একজন দক্ষিণ এশীয় ও সর্বোপরি একজন মুসলমান ব্যক্তির নিউইয়র্কের মতো যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম শহরের মেয়র হওয়ার বিষয়টিকে সবাই সুনজরে দেখবেন, সেটা আশাকরা সম্ভবত ঠিক হবে না। প্রাইমারি নির্বাচনে জনগণের ব্যাপক সমর্থন পেয়ে মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন লাভে সক্ষম হলেও সাধারণ নির্বাচনের পূর্ব পর্যন্ত কুসুমাস্তীর্ণ হবে, সেটা ভাবার কারণ নেই। তাকে একজন কট্টর কমিউনিস্ট আখ্যা দিয়ে তার মেয়র হওয়া ঠেকাতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এরইমধ্যে তার সর্বশক্তি নিয়োগের আভাস দিয়েছেন। এ লক্ষ্যে তার ইমিগ্রেশন রেকর্ড খতিয়ে দেখার ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। শোনা যায়, কলেজে ভর্তির আবেদনে মামদানি নিজের জাতিগত পরিচয় (Ethnicity) দক্ষিণ এশীয় না লিখে আফ্রিকান আমেরিকান লেখেন। এটাকে ভুয়া তথ্য প্রদানের অভিযোগ করে জল ঘোলার চেষ্টা চলছে বলে কানাঘুষা রয়েছে। বিশেষ করে কোটিপতিদের উপর কর আরোপ যুদ্ধাপরাধী হিসাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত কর্তৃক অভিযুক্ত ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু নিউইয়র্কে এলে মামদানি কর্তৃক তাকে গ্রেপ্তারের ঘোষণায় ইসরাইল সমর্থক বিভিন্ন মহল তার উপর বেজায় ক্ষুব্ধ। এসব মহল তার বক্তব্যকে ইহুদিবিরোধী (Anti-Semitic) মনোভাবের প্রকাশ বলে প্রচার চালাচ্ছে।
যত সত্য নির্ভরই হোক, যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল ও তার সমর্থকদের সম্পর্কে কথাবার্তা ও বক্তব্যকে প্রায়ই ইহুদিবিরোধী আখ্যা দিয়ে তাকে ধামা চাপা দেয়া ও এ ধরনের বক্তব্য দানকারীকে নানাভাবে হেয় ও অপদস্ত করার একটি প্রবণতা বিদ্যমান। ইতোমধ্যে বিশেষ করে, ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যে তার দু-একজন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে এটা নিয়ে তার সম্পর্কে অপপ্রচারে লিপ্ত হতে দেখা যায়। এমতাবস্থায়, ইসরাইল সংক্রান্ত বিষয়ে কথাবার্তায় জোহরান মামদানির আরও সতর্ক ও সাবধানী হওয়া সমীচীন হবে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করেন, নতুবা তার মেয়র হওয়ার সম্ভাবনা বিপন্ন ও বাধাগ্রস্ত হতে পারে বলে অনেকে ধারণা করেন।
লেখক : কলামিস্ট।