
পর্যটন একটা ব্যতিক্রমধর্মী রপ্তানি বাণিজ্য। অন্যান্য রপ্তানি বাণিজ্যে বিদেশে পণ্য প্রেরণ করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা হয়। কিন্তু পর্যটনের ক্ষেত্রে বিদেশিদের দেশ ভ্রমণে আকৃষ্ট করে বিভিন্ন ধরনের সেবা ও সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে অর্থ সমাগম করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা হয়। পর্যটনে বিদেশি পর্যটক নিজের দেশ থেকে অন্য দেশে ভ্রমণে এসে থাকা, খাওয়া, যাতায়াত, বিনোদন ইত্যাদিতে যে অর্থ ব্যয় করে, তা অপর দেশের বৈদেশিক মুদ্রারূপে অর্জিত হয়।
বর্তমান বিশ্বে পর্যটন একটা দ্রুত প্রসারণশীল শিল্প হিসেবে পরিগণিত এবং কোনো কোনো দেশে একক বৃহত্তম লাভজনক শিল্প হিসেবে স্বীকৃত। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে পর্যটনের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পর্যটন উন্নয়নে বিনিয়োগ অন্যান্য খাতে বিনিয়োগের তুলনায় কোনো অংশেই কম লাভজনক নয়, বরং কোনো কোনো দেশে অন্যান্য শিল্পে বিনিয়োগের তুলনায় পর্যটনশিল্পে বিনিয়োগ অধিক লাভজনক প্রমাণিত হয়েছে। পর্যটনশিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত হোটেল, মোটেল, পরিবহন ও অন্যান্য সহ-সংস্থা কর্তৃক অর্জিত অর্থ দেশের তুলনামূলকভাবে শিল্পে অনুন্নত অঞ্চলগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখে। এভাবে পর্যটনশিল্পের উন্নয়ন জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে প্রগতিশীল ভূমিকা রাখতে সক্ষম। পর্যটন কর্তৃক সৃষ্ট বাণিজ্যিক লেনদেনের গতিধারা দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে অন্যান্য খাতের চেয়ে তুলনামূলকভাবে উচ্চতর ও দ্রুততর। পর্যটনশিল্পে বিনিয়োগকৃত অর্থ থেকে আয়-ব্যয়ের হিসাবে অনেকগুণ অধিক লভ্যাংশ পাওয়া যায়। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, অন্যান্য রপ্তানির তুলনায় পর্যটনশিল্প থেকে আয়ের পরিমাণ দ্রুত বর্ধনশীল। কোনো কোনো দেশে পর্যটনক্ষেত্রে ‘ব্যালেন্স অব পেমেন্ট’-এর বাণিজ্য ঘাটতি আংশিক পূরণে বিশেষ সহায়ক বলে লক্ষ করা যায়।
পর্যটনশিল্পের উন্নয়নের সঙ্গে দেশে চাকরি প্রসারের বিশেষ সুযোগ সৃষ্টি হয়ে থাকে। একটা পর্যটন অঞ্চল গঠন ও উন্নয়নের ফলে সেখানে পর্যটক ও দর্শক সমাগমের মাধ্যমে অর্থপ্রবাহ সৃষ্টি হয়। উল্লিখিত অঞ্চলে, যেখানে অতীতে কোনো শিল্প গড়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল না, সেখানে পর্যটন সমাগমে পর্যটকদের থাকা, খাওয়া, যাতায়াত ও বিনোদনের সুযোগ-সুবিধা সংবলিত প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। বিশেষ করে, এসব কম শিল্পায়িত অঞ্চলে পর্যটক সমাগমের কারণে হোটেল, মোটেল, পরিবহন ও অন্যান্য বিনোদনমূলক সংস্থা/প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে এবং এ ধরনের শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসার লাভের সঙ্গে সঙ্গে পর্যাপ্ত চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হয়ে থাকে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল ও বেকার সমস্যা জর্জরিত দেশে এর গুরুত্ব অপরিসীম এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এর ইতিবাচক প্রভাব অনস্বীকার্য।
অবসর বিনোদন, আরাম-আয়েশ ও উপভোগের উদ্দেশ্য ছাড়াও আধুনিককালে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যেও ব্যাপক পর্যটন সংঘটিত হয়ে থাকে। এটাকে বলা হয় ‘বিজনেস ট্যুরিজম’। বিভিন্ন দেশের উৎপাদিত পণ্যের আন্তর্জাতিক বিপণন, সরবরাহ ও চাহিদা মেটানোর জন্য ব্যবসায়ী মহলের জন্য পর্যটন একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ উপায়। শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের এই আন্তর্জাতিক ভ্রমণ অন্যান্য পর্যটকদের ভ্রমণের পরিপূরক এবং বিভিন্ন দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রকৃষ্ট সহায়ক। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের পারস্পরিক প্রতিনিধিদের বিভিন্ন সভা, সম্মেলন, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ইত্যাদি অংশগ্রহণও পর্যটনের আওতাভুক্ত। এ ধরনের অংশগ্রহণের কারণেও দেশে পর্যটন থেকে প্রভূত অর্থ উপার্জন হয়ে থাকে। পর্যটন থেকে এসব উপার্জন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অনেক সুযোগ সৃষ্টি করে। বর্তমান বিশ্বের অনেক দেশ, যেমন সুইজারল্যান্ড, গ্রিস, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, হাওয়াই, কানাডা, সাইপ্রাস, মিসর, শ্রীলঙ্কা, কেনিয়া, মরক্কো, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, থাইল্যান্ড, মেক্সিকো, তিউনিসিয়া, মালয়েশিয়া ইন্দোনেশিয়া, মালদ্বীপ, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন, হংকং, নিউজিল্যান্ড, ফিজি, অস্ট্রেলিয়ার তাসমানিয়া, পেনিনসুলা ও এলিস স্প্রিং পর্যটন থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় প্রচুর অর্থ উপার্জন করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করছে। সামগ্রিক পর্যালোচনায় সারসংক্ষেপ হিসেবে বলা যায়
* পর্যটন প্রসারের ফলে জাতীয় আয় ও রাজস্ব বৃদ্ধি তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নে পর্যটনশিল্পের অবদান বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
* দেশের যেসব অঞ্চল সাধারণভাবে শিল্পায়ন বা বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের উপযুক্ত নয়, সেসব অঞ্চলে পর্যটন প্রসারের কারণে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি ও উন্নয়নের ধারাপ্রবাহে সামাজিক সমতা সৃষ্টি উল্লেখযোগ্য।
* নতুন নতুন চাকরির সুযোগ সৃষ্টির ফলে বেকার সমস্যার আংশিক সমাধানে পর্যটনের অবদান অনস্বীকার্য।
* পর্যটনশিল্পের বিনিয়োগকৃত অর্থের লভ্যাংশ দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা গুরুত্বপূর্ণ।
* পর্যটনশিল্প থেকে অর্জিত উদ্বৃত্ত অর্থের মাধ্যমে দেশের অন্য সব শিল্পক্ষেত্রের ‘ব্যালেন্স অব পেমেন্ট’-এর বাণিজ্য ঘাটতি আংশিক পূরণে ভূমিকা লক্ষণীয়।
* পর্যটনশিল্পে বিনিয়োগকৃত অর্থের রাজস্ব আয় তুলনামূলকভাবে অনেকগুণ অধিক পরিগণিত।
এককথায় দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এভাবে পর্যটনের ভূমিকা আজ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত।
পর্যটনশিল্পে বাংলাদেশের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। স্বাধীনতা উত্তরকালে সীমিত সম্পদের মধ্যে পর্যটনশিল্পের প্রসারকল্পে সরকারি উদ্যোগে দেশের পর্যটন আকর্ষণীয় স্থানসমূহে হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ তৈরি এবং যাতায়াত ও বিনোদনের ব্যবস্থাসহ পর্যটকদের আরাম-আয়েশের জন্য কিছু কিছু সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করা হয়েছে। বলা বাহুল্য, পর্যটনশিল্পে বাংলাদেশ অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের তুলনায় অনেকটা পিছিয়ে আছে। অথচ অনেক দেশ শুধু পর্যটনশিল্পের দৌলতে পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করছে ও বিশ্বের দরবারে সম্মানজনক আসন দখল করে আছে। ‘ইউরোপের খেলার মাঠ’ রূপে পরিচিত পর্যটনের বনেদি দেশ সুইজারল্যান্ডের কথা বাদ দিলেও বাংলাদেশের অতি নিকটের অনেক ছোট দেশ পর্যটনশিল্পে অনেক অগ্রসর। এ প্রসঙ্গে সিঙ্গাপুর, নেপাল ও মালদ্বীপের কথা উল্লেখ করা যায়।
পরিসংখ্যানে প্রতীয়মান হয়, ২০১০-২০১১ সালে বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশ সফরে আগত পর্যটকের সংখ্যা ৩ লাখের মতো। এতে বৈদেশিক মুদ্রায় আয় হয়েছে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। পরবর্তী বছরগুলোর পরিসংখ্যান সংগ্রহ সম্ভব হয়নি। তবে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, পরবর্তী সময়ে পর্যটনের সংখ্যা আশানুরূপ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়নি এবং আয়ও তেমন বাড়েনি। অথচ এশিয়া মহাদেশেও এমন বহু দেশ রয়েছে, যাদের আয়ের প্রধান উৎস পর্যটন। স্মরণযোগ্য, পর্যটন সিঙ্গাপুরের সমৃদ্ধির অন্যতম প্রধান উৎস। প্রধানত, তিনটি কারণে বাংলাদেশ আশানুরূপভাবে পর্যটকদের আকর্ষণ করতে পারেনি :
(ক) থাকা, খাওয়া, যাতায়াতে মোটামুটি উন্নত ব্যবস্থা যদিও হয়েছে, বিনোদনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও নিরাপত্তার অভাব;
(খ) রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং কারণে অকারণে আন্দোলন, বিক্ষোভ, ধর্মঘটের দরুন পর্যটকদের মধ্যে ভীতি ও নেতিবাচক ভাবনা :
(গ) গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় স্থানসমূহের পরিচয় যথাযথভাবে তুলে ধরার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকা।
(ঘ) কক্সবাজারসহ অন্যান্য পর্যটনকেন্দ্র যতটুকু আধুনিক করা হয়েছে আরও অধিক আধুনিকায়ন করার প্রয়োজন ছিল। পর্যটন সম্ভাবনাময় স্থানসমূহেও আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় করে তোলা উচিত ছিল। সমুদ্রভিত্তিক পর্যটনের সঙ্গে নতুন কিছু যুক্ত হয়নি দীর্ঘদিন। বিনোদন ও সুবিধা ঘাটতি লক্ষণীয়। সুন্দরবন ঘিরে পর্যটনের সম্ভাবনাকে উন্নত করার ব্যাপারে পরিকল্পনার অভাবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি অপরূপ দৃশ্যাবলি-সমৃদ্ধ বিশ্বের সুপরিচিত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল সুন্দরবনকে পর্যটকদের জন্য আশানুরপভাবে আকৃষ্ট করে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থা নিরসনের লক্ষ্যে :
(ক) কক্সবাজার, সুন্দরবন, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের অন্যান্য এলাকার দর্শনীয় স্থানসমূহে অধিকতর সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করে পর্যটকদের জন্য আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে।
(খ) ধর্মীয়, ঐতিহাসিক ও পুরাকীর্তির নিদর্শনসমূহের সুষ্ঠু সংরক্ষণের ব্যবস্থাসহ ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে তাদের পরিচয় তুলে ধরতে হবে।
(গ) পাহাড়পুর ও ময়নামতির প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহ দেশ-বিদেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের জন্য আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে। অন্যান্য পর্যটন সম্ভাবনাময় স্থানগুলোকে সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় করে গড়ে তুলতে হবে।
(ঘ) পর্যটনের ক্ষেত্রে বিদেশি পুঁজি আকর্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে।
(ঙ) সব দেশেই বেসরকারি উদ্যোগেই পর্যটন সমৃদ্ধ হয়। অথচ বাংলাদেশে পর্যটনশিল্পে বেসরকারি খাতের কার্যক্রম আশানুরূপ প্রসারিত হয়নি। এর কারণ সম্ভবত অবকাঠামোর অভাব। দেশের বর্তমান অবস্থায় পর্যটনক্ষেত্রে অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারি উদ্যোগের অপরিহার্যতা অবশ্যই রয়েছে। তবু বাংলাদেশে পর্যটনশিল্পের সমৃদ্ধির জন্য বেসরকারি উদ্যোগকে ক্রমান্বয়ে প্রাধান্য দিয়ে সক্রিয় করে তোলার প্রয়াস নিতে হবে।
(চ) আন্তর্জাতিক পর্যটকদের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় পর্যটকদের আকর্ষণের জন্যও প্রচেষ্টা চালাতে হবে। দেশীয় পর্যটন আন্তর্জাতিক পর্যটন প্রসারের পূর্বশর্ত। এ প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের ডমেস্টিক ট্যুরিজমের প্রচার বিজ্ঞাপনের একটি কথা মনে পড়ে গেল, ‘বহুদিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু। দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া বাড়ীর পাশের মাঠের সবুজ ঘাসের উপর এবং সরোবরে পদ্মপত্রে ঝলমলে মনোমুগ্ধকর শিশির বিন্দু।’ দেশের বিভিন্ন পেশার লোকদের পর্যটন ভাবাপন্ন করে তুলতে হবে। পর্যটন-সংক্রান্ত আধুনিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। অফিস-আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পর্যটনে উৎসাহিত করার জন্য বার্ষিক বিনোদন ছুটির প্রথা চালু করতে হবে। বিভিন্ন পেশার লোকদের দর্শনীয় স্থানসমূহে যাতায়াতের সুবিধার্থে ট্রেনে বাসে বিমানে ও নৌপথে দেশীয় পর্যটকদের জন্য হ্রাসকৃত হারে টিকিটের ব্যবস্থা করে আকর্ষণ বাড়াতে হবে।
(ছ) বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের আদলে দেশে বিশেষ পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। সেই সঙ্গে কোস্টাল ট্যুরিজম, নাইট লাইফ ট্যুরিজম, কমিউনিটি ট্যুরিজম, ইকো ট্যুরিজম উন্নয়নসহ পর্যটন বহুমুখীকরণ, পর্যটনবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিতকরণ, সেবার মান ও নিরাপত্তা জোরদার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এভাবে পর্যটন পণ্য ও সেবাকে বহুমুখীকরণের মাধ্যমে অর্থনীতিতে এই খাতের অংশীদারত্ব বহুগুণ বৃদ্ধি সম্ভব।
(জ) বিদেশি পর্যটক পাওয়ার ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ, বিশেষ করে ভিসা জটিলতা একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। ভিসা জটিলতা দূরীকরণসহ পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে যোগাযোগব্যবস্থা উন্নতকরণ, সেবার মান উন্নতকরণ, নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং পর্যটন গন্তব্য হিসেবে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং জোরদার করতে হবে।
(ঝ) পর্যটনকে কেন্দ্র করে অঞ্চলভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ, বিমানবন্দরের সংখ্যা বৃদ্ধি (অবশ্য ইতিমধ্যে সরকার দেশের পরিত্যক্ত বিমানবন্দরগুলো পুনঃ চালুর পরিকল্পনা গ্রহণ করছে), পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে যোগাযোগ ও ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়ন, ভিসা ব্যবস্থা ও টিকিট বুকিং সহজীকরণ, পর্যটক-সহায়তার সেবায় দক্ষ প্রহরী তৈরি, পর্যটন উন্নয়নে বাজেট বরাদ্দ, পর্যটন সেবায় স্মার্ট প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি, পর্যটন কেন্দ্রসমূহে পর্যাপ্ত মানি চেঞ্জার বা মানি এক্সচেঞ্জ সেবা চালু, ই-ভিসা এবং অন-অ্যারাইভাল ভিসা সহজীকরণ ইত্যাদি অত্যাবশ্যক।
(ঞ) পর্যটন দর্শনীয় সম্ভাবনাময় স্থানে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। উদাহরণস্বরূপ মাওয়া ফেরিঘাট বর্তমান সময়ে দেশের পর্যটনশিল্পে অনন্য একটি নাম। মাওয়া ঘাটে অবস্থিত দেশের বৃহত্তম পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু আকর্ষণীয় পর্যটন রিসোর্ট গড়ে উঠেছে। আধুনিক মানের এই রিসোর্টগুলোকে পর্যটকদের কাছে তুলে ধরা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ সরকার পর্যটন উন্নয়নে অবশ্য এক মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করেছে। এই মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী কার্যক্রমের তৎপরতা বাড়াতে হবে। পর্যায়ক্রমে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সঙ্গে সঙ্গে কিছু কিছু অত্যাবশ্যকীয় স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নও বাঞ্ছনীয়।
বিদেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মতো উপরিউক্ত প্রয়াস বিবেচনায় যথাযোগ্যভাবে বাংলাদেশে পর্যটন বিকাশের মাধ্যমেও পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভবপর, যা এদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান ও ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
লেখক : ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, একুশে পদকপ্রাপ্ত ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদকপ্রাপ্ত, রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ও কলামিস্ট।
বর্তমান বিশ্বে পর্যটন একটা দ্রুত প্রসারণশীল শিল্প হিসেবে পরিগণিত এবং কোনো কোনো দেশে একক বৃহত্তম লাভজনক শিল্প হিসেবে স্বীকৃত। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে পর্যটনের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পর্যটন উন্নয়নে বিনিয়োগ অন্যান্য খাতে বিনিয়োগের তুলনায় কোনো অংশেই কম লাভজনক নয়, বরং কোনো কোনো দেশে অন্যান্য শিল্পে বিনিয়োগের তুলনায় পর্যটনশিল্পে বিনিয়োগ অধিক লাভজনক প্রমাণিত হয়েছে। পর্যটনশিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত হোটেল, মোটেল, পরিবহন ও অন্যান্য সহ-সংস্থা কর্তৃক অর্জিত অর্থ দেশের তুলনামূলকভাবে শিল্পে অনুন্নত অঞ্চলগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখে। এভাবে পর্যটনশিল্পের উন্নয়ন জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে প্রগতিশীল ভূমিকা রাখতে সক্ষম। পর্যটন কর্তৃক সৃষ্ট বাণিজ্যিক লেনদেনের গতিধারা দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে অন্যান্য খাতের চেয়ে তুলনামূলকভাবে উচ্চতর ও দ্রুততর। পর্যটনশিল্পে বিনিয়োগকৃত অর্থ থেকে আয়-ব্যয়ের হিসাবে অনেকগুণ অধিক লভ্যাংশ পাওয়া যায়। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, অন্যান্য রপ্তানির তুলনায় পর্যটনশিল্প থেকে আয়ের পরিমাণ দ্রুত বর্ধনশীল। কোনো কোনো দেশে পর্যটনক্ষেত্রে ‘ব্যালেন্স অব পেমেন্ট’-এর বাণিজ্য ঘাটতি আংশিক পূরণে বিশেষ সহায়ক বলে লক্ষ করা যায়।
পর্যটনশিল্পের উন্নয়নের সঙ্গে দেশে চাকরি প্রসারের বিশেষ সুযোগ সৃষ্টি হয়ে থাকে। একটা পর্যটন অঞ্চল গঠন ও উন্নয়নের ফলে সেখানে পর্যটক ও দর্শক সমাগমের মাধ্যমে অর্থপ্রবাহ সৃষ্টি হয়। উল্লিখিত অঞ্চলে, যেখানে অতীতে কোনো শিল্প গড়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল না, সেখানে পর্যটন সমাগমে পর্যটকদের থাকা, খাওয়া, যাতায়াত ও বিনোদনের সুযোগ-সুবিধা সংবলিত প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। বিশেষ করে, এসব কম শিল্পায়িত অঞ্চলে পর্যটক সমাগমের কারণে হোটেল, মোটেল, পরিবহন ও অন্যান্য বিনোদনমূলক সংস্থা/প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে এবং এ ধরনের শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসার লাভের সঙ্গে সঙ্গে পর্যাপ্ত চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হয়ে থাকে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল ও বেকার সমস্যা জর্জরিত দেশে এর গুরুত্ব অপরিসীম এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এর ইতিবাচক প্রভাব অনস্বীকার্য।
অবসর বিনোদন, আরাম-আয়েশ ও উপভোগের উদ্দেশ্য ছাড়াও আধুনিককালে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যেও ব্যাপক পর্যটন সংঘটিত হয়ে থাকে। এটাকে বলা হয় ‘বিজনেস ট্যুরিজম’। বিভিন্ন দেশের উৎপাদিত পণ্যের আন্তর্জাতিক বিপণন, সরবরাহ ও চাহিদা মেটানোর জন্য ব্যবসায়ী মহলের জন্য পর্যটন একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ উপায়। শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের এই আন্তর্জাতিক ভ্রমণ অন্যান্য পর্যটকদের ভ্রমণের পরিপূরক এবং বিভিন্ন দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রকৃষ্ট সহায়ক। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের পারস্পরিক প্রতিনিধিদের বিভিন্ন সভা, সম্মেলন, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ইত্যাদি অংশগ্রহণও পর্যটনের আওতাভুক্ত। এ ধরনের অংশগ্রহণের কারণেও দেশে পর্যটন থেকে প্রভূত অর্থ উপার্জন হয়ে থাকে। পর্যটন থেকে এসব উপার্জন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অনেক সুযোগ সৃষ্টি করে। বর্তমান বিশ্বের অনেক দেশ, যেমন সুইজারল্যান্ড, গ্রিস, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, হাওয়াই, কানাডা, সাইপ্রাস, মিসর, শ্রীলঙ্কা, কেনিয়া, মরক্কো, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, থাইল্যান্ড, মেক্সিকো, তিউনিসিয়া, মালয়েশিয়া ইন্দোনেশিয়া, মালদ্বীপ, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন, হংকং, নিউজিল্যান্ড, ফিজি, অস্ট্রেলিয়ার তাসমানিয়া, পেনিনসুলা ও এলিস স্প্রিং পর্যটন থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় প্রচুর অর্থ উপার্জন করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করছে। সামগ্রিক পর্যালোচনায় সারসংক্ষেপ হিসেবে বলা যায়
* পর্যটন প্রসারের ফলে জাতীয় আয় ও রাজস্ব বৃদ্ধি তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নে পর্যটনশিল্পের অবদান বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
* দেশের যেসব অঞ্চল সাধারণভাবে শিল্পায়ন বা বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের উপযুক্ত নয়, সেসব অঞ্চলে পর্যটন প্রসারের কারণে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি ও উন্নয়নের ধারাপ্রবাহে সামাজিক সমতা সৃষ্টি উল্লেখযোগ্য।
* নতুন নতুন চাকরির সুযোগ সৃষ্টির ফলে বেকার সমস্যার আংশিক সমাধানে পর্যটনের অবদান অনস্বীকার্য।
* পর্যটনশিল্পের বিনিয়োগকৃত অর্থের লভ্যাংশ দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা গুরুত্বপূর্ণ।
* পর্যটনশিল্প থেকে অর্জিত উদ্বৃত্ত অর্থের মাধ্যমে দেশের অন্য সব শিল্পক্ষেত্রের ‘ব্যালেন্স অব পেমেন্ট’-এর বাণিজ্য ঘাটতি আংশিক পূরণে ভূমিকা লক্ষণীয়।
* পর্যটনশিল্পে বিনিয়োগকৃত অর্থের রাজস্ব আয় তুলনামূলকভাবে অনেকগুণ অধিক পরিগণিত।
এককথায় দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এভাবে পর্যটনের ভূমিকা আজ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত।
পর্যটনশিল্পে বাংলাদেশের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। স্বাধীনতা উত্তরকালে সীমিত সম্পদের মধ্যে পর্যটনশিল্পের প্রসারকল্পে সরকারি উদ্যোগে দেশের পর্যটন আকর্ষণীয় স্থানসমূহে হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ তৈরি এবং যাতায়াত ও বিনোদনের ব্যবস্থাসহ পর্যটকদের আরাম-আয়েশের জন্য কিছু কিছু সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করা হয়েছে। বলা বাহুল্য, পর্যটনশিল্পে বাংলাদেশ অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের তুলনায় অনেকটা পিছিয়ে আছে। অথচ অনেক দেশ শুধু পর্যটনশিল্পের দৌলতে পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করছে ও বিশ্বের দরবারে সম্মানজনক আসন দখল করে আছে। ‘ইউরোপের খেলার মাঠ’ রূপে পরিচিত পর্যটনের বনেদি দেশ সুইজারল্যান্ডের কথা বাদ দিলেও বাংলাদেশের অতি নিকটের অনেক ছোট দেশ পর্যটনশিল্পে অনেক অগ্রসর। এ প্রসঙ্গে সিঙ্গাপুর, নেপাল ও মালদ্বীপের কথা উল্লেখ করা যায়।
পরিসংখ্যানে প্রতীয়মান হয়, ২০১০-২০১১ সালে বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশ সফরে আগত পর্যটকের সংখ্যা ৩ লাখের মতো। এতে বৈদেশিক মুদ্রায় আয় হয়েছে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। পরবর্তী বছরগুলোর পরিসংখ্যান সংগ্রহ সম্ভব হয়নি। তবে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, পরবর্তী সময়ে পর্যটনের সংখ্যা আশানুরূপ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়নি এবং আয়ও তেমন বাড়েনি। অথচ এশিয়া মহাদেশেও এমন বহু দেশ রয়েছে, যাদের আয়ের প্রধান উৎস পর্যটন। স্মরণযোগ্য, পর্যটন সিঙ্গাপুরের সমৃদ্ধির অন্যতম প্রধান উৎস। প্রধানত, তিনটি কারণে বাংলাদেশ আশানুরূপভাবে পর্যটকদের আকর্ষণ করতে পারেনি :
(ক) থাকা, খাওয়া, যাতায়াতে মোটামুটি উন্নত ব্যবস্থা যদিও হয়েছে, বিনোদনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও নিরাপত্তার অভাব;
(খ) রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং কারণে অকারণে আন্দোলন, বিক্ষোভ, ধর্মঘটের দরুন পর্যটকদের মধ্যে ভীতি ও নেতিবাচক ভাবনা :
(গ) গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় স্থানসমূহের পরিচয় যথাযথভাবে তুলে ধরার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকা।
(ঘ) কক্সবাজারসহ অন্যান্য পর্যটনকেন্দ্র যতটুকু আধুনিক করা হয়েছে আরও অধিক আধুনিকায়ন করার প্রয়োজন ছিল। পর্যটন সম্ভাবনাময় স্থানসমূহেও আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় করে তোলা উচিত ছিল। সমুদ্রভিত্তিক পর্যটনের সঙ্গে নতুন কিছু যুক্ত হয়নি দীর্ঘদিন। বিনোদন ও সুবিধা ঘাটতি লক্ষণীয়। সুন্দরবন ঘিরে পর্যটনের সম্ভাবনাকে উন্নত করার ব্যাপারে পরিকল্পনার অভাবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি অপরূপ দৃশ্যাবলি-সমৃদ্ধ বিশ্বের সুপরিচিত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল সুন্দরবনকে পর্যটকদের জন্য আশানুরপভাবে আকৃষ্ট করে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থা নিরসনের লক্ষ্যে :
(ক) কক্সবাজার, সুন্দরবন, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের অন্যান্য এলাকার দর্শনীয় স্থানসমূহে অধিকতর সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করে পর্যটকদের জন্য আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে।
(খ) ধর্মীয়, ঐতিহাসিক ও পুরাকীর্তির নিদর্শনসমূহের সুষ্ঠু সংরক্ষণের ব্যবস্থাসহ ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে তাদের পরিচয় তুলে ধরতে হবে।
(গ) পাহাড়পুর ও ময়নামতির প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহ দেশ-বিদেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের জন্য আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে। অন্যান্য পর্যটন সম্ভাবনাময় স্থানগুলোকে সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় করে গড়ে তুলতে হবে।
(ঘ) পর্যটনের ক্ষেত্রে বিদেশি পুঁজি আকর্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে।
(ঙ) সব দেশেই বেসরকারি উদ্যোগেই পর্যটন সমৃদ্ধ হয়। অথচ বাংলাদেশে পর্যটনশিল্পে বেসরকারি খাতের কার্যক্রম আশানুরূপ প্রসারিত হয়নি। এর কারণ সম্ভবত অবকাঠামোর অভাব। দেশের বর্তমান অবস্থায় পর্যটনক্ষেত্রে অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারি উদ্যোগের অপরিহার্যতা অবশ্যই রয়েছে। তবু বাংলাদেশে পর্যটনশিল্পের সমৃদ্ধির জন্য বেসরকারি উদ্যোগকে ক্রমান্বয়ে প্রাধান্য দিয়ে সক্রিয় করে তোলার প্রয়াস নিতে হবে।
(চ) আন্তর্জাতিক পর্যটকদের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় পর্যটকদের আকর্ষণের জন্যও প্রচেষ্টা চালাতে হবে। দেশীয় পর্যটন আন্তর্জাতিক পর্যটন প্রসারের পূর্বশর্ত। এ প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের ডমেস্টিক ট্যুরিজমের প্রচার বিজ্ঞাপনের একটি কথা মনে পড়ে গেল, ‘বহুদিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু। দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া বাড়ীর পাশের মাঠের সবুজ ঘাসের উপর এবং সরোবরে পদ্মপত্রে ঝলমলে মনোমুগ্ধকর শিশির বিন্দু।’ দেশের বিভিন্ন পেশার লোকদের পর্যটন ভাবাপন্ন করে তুলতে হবে। পর্যটন-সংক্রান্ত আধুনিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। অফিস-আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পর্যটনে উৎসাহিত করার জন্য বার্ষিক বিনোদন ছুটির প্রথা চালু করতে হবে। বিভিন্ন পেশার লোকদের দর্শনীয় স্থানসমূহে যাতায়াতের সুবিধার্থে ট্রেনে বাসে বিমানে ও নৌপথে দেশীয় পর্যটকদের জন্য হ্রাসকৃত হারে টিকিটের ব্যবস্থা করে আকর্ষণ বাড়াতে হবে।
(ছ) বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের আদলে দেশে বিশেষ পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। সেই সঙ্গে কোস্টাল ট্যুরিজম, নাইট লাইফ ট্যুরিজম, কমিউনিটি ট্যুরিজম, ইকো ট্যুরিজম উন্নয়নসহ পর্যটন বহুমুখীকরণ, পর্যটনবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিতকরণ, সেবার মান ও নিরাপত্তা জোরদার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এভাবে পর্যটন পণ্য ও সেবাকে বহুমুখীকরণের মাধ্যমে অর্থনীতিতে এই খাতের অংশীদারত্ব বহুগুণ বৃদ্ধি সম্ভব।
(জ) বিদেশি পর্যটক পাওয়ার ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ, বিশেষ করে ভিসা জটিলতা একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। ভিসা জটিলতা দূরীকরণসহ পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে যোগাযোগব্যবস্থা উন্নতকরণ, সেবার মান উন্নতকরণ, নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং পর্যটন গন্তব্য হিসেবে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং জোরদার করতে হবে।
(ঝ) পর্যটনকে কেন্দ্র করে অঞ্চলভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ, বিমানবন্দরের সংখ্যা বৃদ্ধি (অবশ্য ইতিমধ্যে সরকার দেশের পরিত্যক্ত বিমানবন্দরগুলো পুনঃ চালুর পরিকল্পনা গ্রহণ করছে), পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে যোগাযোগ ও ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়ন, ভিসা ব্যবস্থা ও টিকিট বুকিং সহজীকরণ, পর্যটক-সহায়তার সেবায় দক্ষ প্রহরী তৈরি, পর্যটন উন্নয়নে বাজেট বরাদ্দ, পর্যটন সেবায় স্মার্ট প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি, পর্যটন কেন্দ্রসমূহে পর্যাপ্ত মানি চেঞ্জার বা মানি এক্সচেঞ্জ সেবা চালু, ই-ভিসা এবং অন-অ্যারাইভাল ভিসা সহজীকরণ ইত্যাদি অত্যাবশ্যক।
(ঞ) পর্যটন দর্শনীয় সম্ভাবনাময় স্থানে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। উদাহরণস্বরূপ মাওয়া ফেরিঘাট বর্তমান সময়ে দেশের পর্যটনশিল্পে অনন্য একটি নাম। মাওয়া ঘাটে অবস্থিত দেশের বৃহত্তম পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু আকর্ষণীয় পর্যটন রিসোর্ট গড়ে উঠেছে। আধুনিক মানের এই রিসোর্টগুলোকে পর্যটকদের কাছে তুলে ধরা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ সরকার পর্যটন উন্নয়নে অবশ্য এক মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করেছে। এই মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী কার্যক্রমের তৎপরতা বাড়াতে হবে। পর্যায়ক্রমে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সঙ্গে সঙ্গে কিছু কিছু অত্যাবশ্যকীয় স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নও বাঞ্ছনীয়।
বিদেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মতো উপরিউক্ত প্রয়াস বিবেচনায় যথাযোগ্যভাবে বাংলাদেশে পর্যটন বিকাশের মাধ্যমেও পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভবপর, যা এদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান ও ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
লেখক : ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, একুশে পদকপ্রাপ্ত ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদকপ্রাপ্ত, রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ও কলামিস্ট।