মুসলিমবিদ্বেষী প্রচারণা তুঙ্গে, বিপক্ষে ডোনাল্ড ট্রাম্পের শক্ত অবস্থান

মামদানিকে ঠেকাতে মাফিয়া গেম

প্রকাশ : ০২ জুলাই ২০২৫, ২২:২৯ , অনলাইন ভার্সন
জোহরান মামদানি ইতিহাসে নাম লিখিয়েছেন। বিশ্বের রাজধানী হিসাবে পরিচিত নিউইয়র্ক সিটির মেয়র হতে তাকে আর একটি মাত্র ধাপ পার হতে  হবে। ৪ নভেম্বর অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনের পর নিউইয়র্কবাসী অপেক্ষাকৃত বয়সে তরুণ, ৩৩ বছর বয়সী জোহরান মামদানিকে মেয়র হিসাবে পাচ্ছেন, এটা অনেকটা নিশ্চিত। কিন্তু ডেমোক্রেট প্রাইমারিতে জোহরান মামদানি ‘বাঘা’ প্রার্থী সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু ক্যুমোকে ১২ শতাংশ ভোটে পরাজিত করেছেন। 
এটি যেমন মামদানির বড় সাফল্য, তেমনি তাকে মেয়র হিসাবে মানতে নারাজ নিউইয়র্ক সিটির প্রভাবশালী মহল। তাদের ঘুম হারাম করে দিয়েছেন এই তরুণ সোশ্যালিস্ট। -এখন জোহরান মামদানিকে ঠেকাতে শুরু হয়েছে মাফিয়া গেম। আর এই গেম থেকে নিজেকে নিরাপদে রাখা দিন দিন কঠিন হচ্ছে তার জন্য। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পই তার বিপক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন। যে কোনোভাবে থামাতে হবে মামদানিকে। এ কারণে মামদানি একজন মুসলিম এবং তার বিরুদ্ধে মুসলিমবিদ্বেষী প্রচারণা চালানো হচ্ছে জোরেশোরে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তো জোহরান মামদানিকে জেলে ভরার হুমকি দিয়েছেন। এমনকী ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট-আইসের অভিবাসী বিতাড়ন চেষ্টা ঠেকালে নিউইয়র্ক সিটির মেয়র প্রার্থী জোরান মামদানিকে গ্রেপ্তার করার হুমকি ট্রাম্পের।
ডেমোক্রেটিক প্রাইমারিতে জয় নিশ্চিত করা মামদানিকে ‘কমিউনিস্ট’ অ্যাখা দিয়ে তার প্রতিটি কাজ সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি। প্রাইমারি নির্বাচনের রাতেই বিজয়ী বক্তৃতায় জোহরান মামদানি ট্রাম্পের ফ্যাসিবাদী কোনো আচরণের ঠাঁই নিউইয়র্ক সিটিতে হবে না বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
ডেমোক্রেটিক প্রাইমারির প্রচারজুড়েই অভিবাসীদের বিরুদ্ধে ট্রাম্প প্রশাসনের কঠোর অবস্থানের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন সমাজতন্ত্রী এ প্রার্থী। প্রাইমারিতে সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু ক্যুমোর পরাজয় নিশ্চিত করে দেশ ও বহির্বিশ্বের রাজনীতিতে ব্যাপক আলোড়ন তোলেন মামদানি। ৩৩ বছর বয়সী এ তরুণ তুর্কির সাড়া জাগানো পারফরম্যান্সের প্রতিক্রিয়ায় ট্রাম্প তাকে ‘উন্মাদ, কমিউনিস্ট’ আখ্যা দেন।
ট্রাম্পের পাশাপাশি তার প্রশাসন ও বিরোধীদের মধ্যে মামদানিকে একহাত নেওয়ার আরও নজির রয়েছে। টেনেসির রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান অ্যান্ডি অগলস অ্যাটর্নি জেনারেল পাম বন্ডির কাছে পাঠানো চিঠিতে মামদানির নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে তাকে বিতাড়নের দাবি তোলেন। এর বাইরে কানেকটিকাটের ডেমোক্রেটিক সিনেটর ক্রিস মারফিও মামদানির নাগরিকত্ব কেড়ে নিতে প্রেসিডেন্টের প্রতি আহ্বান জানান। এমন বাস্তবতায় ১ জুলাই মঙ্গলবার নিউইয়র্কের বোর্ড অব ইলেকশনস প্রাইমারির র‌্যাঙ্কড চয়েস ভোটের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করে। সেখানে ৫৬-৪৪ ব্যবধানে ক্যুমোকে হারিয়ে জয় নিশ্চিত করেন মামদানি।
এ জয়ের উচ্ছ্বাস বেশিক্ষণ স্থায়ী হওয়ার আগেই মামদানিকে ফের আক্রমণ করেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তিনি বলেন, আইসের কাজে বাধা দিলে মামদানিতে করা হবে গ্রেপ্তার। ফেডারেল সরকার থেকে পাঠানো অর্থে নিউইয়র্ক সিটি চলে জানিয়ে ট্রাম্প বলেন, মেয়র নির্বাচিত হলে মামদানির প্রতিটি কাজ সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা হবে।
সাত বছর বয়সে উগান্ডা থেকে পরিবারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন জোহরান মামদানি। ২০১৮ সালে তিনি এদেশের নাগরিকত্ব পান।
বছরের পর বছর নিউইয়র্কের মুসলিমরা ঈদ উপলক্ষে ওয়াশিংটন স্কয়ার পার্কে নামাজ আদায়ের জন্য জড়ো হন। সেখানে এ শহরের ধর্মীয় ও জাতিগত বৈচিত্র্য ফুটে ওঠে। তবে এবার ডানপন্থী প্রভাবশালীরা সেই জমায়েতের ভিডিও ছড়িয়ে দিয়ে তা ‘অশুভ তৎপরতা’ বলে প্রচার করছেন। এর সঙ্গে মুসলিম মার্কিন নাগরিক ও নিউইয়র্ক সিটির ডেমোক্র্যাট মেয়র প্রার্থী জোহরান মামদানির যোগসূত্র টেনে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।
‘এটা (এই অপপ্রচার) ভয় দেখানোর জন্য একধরনের পাগলামি’, বলেন স্থানীয় ইতিহাসবিদ ও মুসলিম আমেরিকান কর্মী আসাদ দান্দিয়া। মামদানির প্রচারাভিযানের এই সমর্থক আরও বলেন, ‘আমার মনে হয়, আমাদের কমিউনিটি ও নেতৃত্ব জানে, আমরা এখন নজরদারিতে রয়েছি।’
নিউইয়র্কসহ যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে আসাদ দান্দিয়ার মতো মুসলিমরা বলছেন, সম্প্রতি ডেমোক্রেট প্রাইমারিতে মামদানির জয়ের পর ইসলামবিদ্বেষী বক্তব্যের প্রবণতা বেড়েছে।
মামদানির সমর্থকেরা বলছেন, এসব ঘৃণামূলক মন্তব্য প্রমাণ করে যে যুক্তরাষ্ট্রে ইসলামবিদ্বেষ এখনো ঘৃণার একটি সহনীয় রূপ হিসেবে টিকে আছে; যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় তা কিছুটা কমে গিয়েছিল।
‘যতই পরিবর্তন হোক, প্রকৃতপক্ষে কিছুই বদলায়নি’, বলেন দান্দিয়া। 
বোরকা পরা’ স্ট্যাচু অব লিবার্টির কার্টুন : ইন্টারনেটে বেনামি ব্যবহারকারী এবং মুসলিমবিদ্বেষী অ্যাকাউন্টগুলোই শুধু মামদানি ও তাঁর মুসলিম পরিচিতিকে নিয়ে আক্রমণ করছে না। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ অনেক রাজনীতিকও এমন আক্রমণে শামিল হয়েছেন।
কংগ্রেস সদস্য র‍্যান্ডি ফাইন কোনো প্রমাণ ছাড়াই বলেছেন, মামদানি জয়ী হলে নিউইয়র্কে ‘খিলাফত’ কায়েম করবেন। আরেক কংগ্রেস সদস্য মার্জোরি টেলর গ্রিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে বোরকা পরা স্ট্যাচু অব লিবার্টির কার্টুন পোস্ট করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইকেল ফ্লিনের ভাষ্যমতে, ‘ইসলাম একটি রাজনৈতিক মতবাদ, ধর্ম নয়।’
রক্ষণশীল কর্মী চার্লি কার্ক ৯/১১ হামলা প্রসঙ্গ টেনে মামদানিকে আখ্যা দিয়েছেন ‘মুসলিম মাওবাদী’ হিসেবে। আর ডানপন্থী ভাষ্যকার অ্যাঞ্জি ওং সিএনএনে বলেছেন, ‘একজন মুসলিম মেয়রকে নিয়ে নিউইয়র্কবাসী নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।’
ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ ও কট্টর ডানপন্থী লরা লুমার মামদানিকে বলেছেন ‘জিহাদপন্থী মুসলিম’ এবং ভিত্তিহীন অভিযোগ করেছেন যে তাঁর সঙ্গে ইরান ও মুসলিম ব্রাদারহুডের সম্পর্ক রয়েছে।
বিচার বিভাগে চিঠি দিয়ে মামদানির নাগরিকত্ব বাতিল ও তাঁকে বহিষ্কারের দাবি তুলেছেন রিপাবলিকান কংগ্রেস সদস্য অ্যান্ডি ওগলস।
গত ২৯ জুন রোববার কংগ্রেস সদস্য ব্র্যান্ডন গিল মামদানির হাতে বিরিয়ানি খাওয়ার একটি ভিডিও পোস্ট করে বলেছেন, ‘তাঁর উচিত তৃতীয় বিশ্বে ফিরে যাওয়া। “সভ্য মানুষ” যুক্তরাষ্ট্রে এভাবে খায় না।’

ইসলামবিদ্বেষী বক্তব্যের নিন্দা জানানোর দাবি
‘৯/১১ পরবর্তী সময়ের কথা মনে পড়ছে’, বললেন নিউইয়র্ক সিটি কাউন্সিল সদস্য শাহানা হানিফ। বলেন, ‘আমি তখন শিশু ছিলাম। তবু সেই সময়কার বিদ্বেষ ও ইসলামবিদ্বেষ ছিল ভয়ংকর।’
ব্রুকলিনের প্রতিনিধিত্বকারী হানিফ সম্প্রতি পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর নির্বাচনী প্রচারে ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষে অবস্থান ও গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান ছিল কেন্দ্রীয় ইস্যু।
আল-জাজিরাকে শাহানা বলেন, মামদানির জয়ের পর যে ইসলামবিদ্বেষী প্রচার চলছে, তা প্রগতিশীল শক্তিকে বিভ্রান্ত ও বাধাগ্রস্ত করতেই।
এই জনপ্রতিনিধি আরও বলেন, সব রাজনৈতিক মহল থেকে ইসলামবিদ্বেষী মন্তব্যের সমভাবে নিন্দা জানানো উচিত। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদ প্রতিরোধে আমাদের আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।’
যদিও কয়েকজন ডেমোক্রেট নেতা মামদানির বিরুদ্ধে এ প্রচারণা-আক্রমণের নিন্দা জানিয়েছেন, কিন্তু নিউইয়র্কসহ দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা এখনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেননি।
‘নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনের প্রাইমারিতে মামদানির জয়ের পর ইসলামবিদ্বেষী যে মন্তব্যের বন্যা দেখা যাচ্ছে, তার কোনোটি হচ্ছে সরাসরি, কোনোটি সূক্ষ্মভাবে। এগুলোর সবই আমাদের বিব্রত করার মতো’, এক বিবৃতিতে বলেন সিনেটর ক্রিস ভ্যান হোলেন।
ক্রিস ভ্যান বলেন, ‘এ ঘৃণায় যাঁরা অংশ নিয়েছেন, তাঁদের লজ্জা হওয়া উচিত। আর যাঁরা এ ঘৃণার বিরুদ্ধে কিছু বলছেন না, তাঁদের জন্যও এটি লজ্জার।’

ট্রাম্প ও মুসলিম ভোটার
একই সময় নিউইয়র্কের ডেমোক্রেট সিনেটর ক্রির্স্টিন জিলিব্র্যান্ডের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে তিনিও মামদানির বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়িয়েছেন। গত সপ্তাহে তিনি অসত্য কথা বলেছেন যে মামদানি ‘বিশ্বজুড়ে জিহাদের’ কথা বলেছেন।
পরে জিলিব্র্যান্ডের কার্যালয় যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমগুলোকে জানায়, তাঁকে ‘ভুলভাবে উপস্থাপন’ করা হয়েছে। আসলে তিনি (জিলিব্র্যান্ড) ‘গ্লোবালাইজ দ্য ইন্তিফাদা’ স্লোগান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। মামদানি এ স্লোগানের নিন্দা জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।
সমালোচকেরা বলছেন, ইন্তিফাদা শব্দটি ১৯৮০ দশকের শেষভাগে ও ২০০০ দশকের শুরুতে ফিলিস্তিনিদের আন্দোলনের কথা মনে করিয়ে দেয়। সেখানে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ ও সশস্ত্র প্রতিরোধ-দুটিই ছিল। ফলে এটি (ইন্তিফাদা শব্দের ব্যবহার) ইহুদি জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভীতির সঞ্চার করতে পারে।
ভারতীয় বংশোদ্ভূত মামদানি মূলত নিউইয়র্ককে বাসযোগ্য রাখার প্রতিশ্রুতির ওপর তাঁর প্রচার চালান। তবে তাঁর ফিলিস্তিনপন্থী অবস্থান তাঁকে নিশানা করার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডেমোক্রেট প্রাইমারিতে জেতার পর থেকেই বিশেষ করে উগ্র ডানপন্থীরা তাঁর মুসলিম পরিচয়কে কেন্দ্র করে আক্রমণ করছেন।
এ ধরনের আক্রমণ নতুন নয়। ট্রাম্প ও তাঁর সহযোগীরা যখন গত বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সামনে রেখে মুসলিম ভোটারদের দ্বারে গিয়েছিলেন, তখনো ইসলামবিদ্বেষী বক্তব্য শোনা গেছে। এমনকি ট্রাম্প মিশিগানের দুই মুসলিম মেয়রকে তিউনিসিয়া ও কুয়েতে রাষ্ট্রদূত হিসেবেও মনোনীত করেন।
নির্বাচনের আগে ট্রাম্প মুসলিমদের স্মার্ট ও ভালো মানুষ বলে প্রশংসা করেন। সে সময় তাঁর রিপাবলিকান দল নিজেদের আগের ইসলামবিদ্বেষী ভাষা কিছুটা কমিয়ে সামাজিকভাবে রক্ষণশীল এ সম্প্রদায়ের ভোট টানার চেষ্টা করে। কিন্তু ‘কাউন্সিল অন আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশনস’ এর গবেষণা ও প্রচার শাখার পরিচালক কোরি সেলার বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে ইসলামবিদ্বেষ বারবারই ঘুরেফিরে আসে।’
‘ইসলামবিদ্বেষ যেন মার্কিন সমাজের মজ্জাগত’, বলেন কোরি। তিনি আরও বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে এটি প্রকাশ্যে ও আলোচনায় ছিল না। কিন্তু সামান্য কিছু ঘটলেই যেন সেই সুইচ চালু হয়ে যায়Ñএখন আমরা সেই চিত্রই দেখছি।’
ইসলামবিদ্বেষের ‘শিল্প’ : যুক্তরাষ্ট্রে দশকের পর দশক গণমাধ্যম, সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে আরব এবং মুসলমানদের উপস্থাপন করা হচ্ছে নেতিবাচকভাবে। যুক্তরাষ্ট্রে ২০০১ সালের ৯/১১ হামলার পর এই প্রবণতা তীব্র হয়। এরপর কট্টর ডানপন্থীরা পশ্চিমা দেশে শরিয়াহ্‌ আইন কায়েমের ষড়যন্ত্রের কথা বলে প্রচারণা শুরু করেন। এ ছাড়া অভিবাসনের মাধ্যমেও যুক্তরাষ্ট্রে ‘ইসলামিকরণের’ চেষ্টা চলছে- মুসলিমদের বিরুদ্ধে ছড়ানো হয় এমন সব ষড়যন্ত্র তত্ত্ব।
২০০০-এর দশকের শুরুতে ইসলামবিরোধী ভাষ্যকার, তথাকথিত সন্ত্রাসবাদবিশেষজ্ঞ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের আবির্ভাব ঘটে। এরা ইসলামের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে থাকে। অধিকারকর্মীরা এ প্রচেষ্টাকে ‘শিল্প’ বলে চিহ্নিত করেছেন।
এ পরিবেশ মূলধারার রাজনীতিতেও ঢুকে পড়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৫ সালে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘মুসলমানদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ পুরোপুরি ও সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে হবে।’
এমনকি উদারপন্থী বলে পরিচিত নিউইয়র্কেও মুসলিমরা বিদ্বেষের শিকার হন। এ শহরেই ২০০১ সালের ৯/১১ হামলায় ২ হাজার ৬০০ জনের বেশি নিহত হন। হামলার পর নিউইয়র্ক পুলিশ মুসলিম কমিউনিটিকে নজরদারিতে রাখতে গোপন তথ্যদাতাদের একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে। এরা মসজিদ, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীদের সংগঠন পর্যবেক্ষণ করা শুরু করে।
২০১৪ সালে এ কর্মসূচি বাতিল হয়। কয়েক বছর পর মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে একটি আইনগত সমঝোতায় পৌঁছায় শহর কর্তৃপক্ষ। এর আগে ২০১০ সালে নিউইয়র্কের মুসলিম সম্প্রদায় আবারও জাতীয় আলোচনায় আসে। ওই সময় ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের কাছে একটি মুসলিম কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণের পরিকল্পনা তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়ে।
তৎকালীন অনেক রিপাবলিকান নেতা এ প্রকল্পের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছড়ান। এমনকি কিছু ডেমোক্র্যাট নেতা ও সুপরিচিত ইসরায়েলপন্থী সংগঠন ‘অ্যান্টি-ডিফেমেশন লিগ’ও এ প্রকল্পের বিরোধিতা করে। শেষ পর্যন্ত এটি বাতিল করা হয়।
‘প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন মুসলিমরা’ : নিউইয়র্কের মুসলিমরা এখন আবার ইসলামবিদ্বেষের ঝড়ের মুখে পড়েছেন। তবে এবার তাঁদের অবস্থান অনেক বেশি দৃঢ় ও সংগঠিত বলে মনে করছেন অধিকারকর্মীরা।
‘আমাদের কমিউনিটির কণ্ঠ, সাংগঠনিক শক্তি ও মিত্রদের সমর্থন বিষয়ে এখন আমরা অনেক আত্মবিশ্বাসী’, বলেন ইতিহাসবিদ আসাদ দান্দিয়া।
দান্দিয়া বলেন, ‘হ্যাঁ, আমরা ইসলামবিদ্বেষী আক্রমণের শিকার হচ্ছি। কিন্তু এটা বলেই শেষ করতে চাই না। কারণ, আমরা এখন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারি। এটি (নিউইয়র্কের প্রাইমারি) ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মুসলিম ভোটারদের সংগঠিত উদ্যোগ—এটাই প্রমাণ করে আমরা কতটা এগিয়েছি।’
এ কথার সঙ্গে একমত নিউইয়র্ক সিটি কাউন্সিলের সদস্য শাহানা হানিফও। ‘গত ২৫ বছরে আমরা শক্তিশালী একটি জোট গড়ে তুলেছি। সেখানে আছে ইহুদি সম্প্রদায়, এশীয়, লাতিনো, কৃষ্ণাঙ্গ সবাই। আমরা একসঙ্গে দাঁড়াই এবং একে অপরের জন্য লড়ি’, বলেন তিনি।
ট্রাম্পের ‘সবচেয়ে বড় দুঃস্বপ্ন’ জোহরান মামদানি : নিউইয়র্ক সিটির রাজনীতিতে জোহরান মামদানির উত্থান যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে তুলনা টানা শুরু হয়ে গেছে। এর কারণ শুধু তাঁদের বিপরীতমুখী আদর্শের জন্য নয়, বরং মামদানি নিজেই তাঁর প্রচারকে ট্রাম্পের ধারার রাজনীতির সম্পূর্ণ বিপরীত হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।
মামদানি ঘোষণা করেছেন, ‘আমি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সবচেয়ে বড় দুঃস্বপ্ন- একজন প্রগতিশীল মুসলিম অভিবাসী, যে সত্যিকারের বিশ্বাস থেকে লড়ে।’ এই বক্তব্যে স্পষ্ট যে মামদানির প্রার্থিতা ট্রাম্পের রাজনীতির প্রতিক্রিয়াস্বরূপ, যা গত কয়েক বছরে জাতীয় ও নগর রাজনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।
এই তুলনাটা কেবল কথার তুলনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। মামদানির জনপ্রিয় হয়ে ওঠা তৃণমূলভিত্তিক প্রচারাভিযান প্রচলিত ধারাকে ভেঙে দিয়েছে। ট্রাম্পও এভাবে প্রচলিত ধারাকে ভেঙেছিলেন, তবে মামদানির বার্তা ও সমর্থক জোট ট্রাম্পের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
নিউইয়র্ক সিটির সবচেয়ে কনিষ্ঠ ও প্রথম মুসলিম মেয়র হওয়ার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা জোহরান মামদানি শুধু তাঁর রাজনৈতিক উত্থানের জন্যই নয়, বরং তাঁর স্বল্প আর্থিক অবস্থা এবং ব্যতিক্রমধর্মী পারিবারিক পটভূমির কারণেও জাতীয় পর্যায়ে দৃষ্টি কেড়েছেন।
জোহরান মামদানির সম্পদ : ফোর্বস ও সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ৩৩ বছর বয়সী মামদানির মোট সম্পদের পরিমাণ আনুমানিক দুই লাখ থেকে তিন লাখ ডলারের মধ্যে। তাঁর এ সম্পদ ডোনাল্ড ট্রাম্পসহ অনেক মার্কিন রাজনীতিকের বিপুল সম্পদের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম।
মামদানির প্রধান আয়ের উৎস হলো নিউইয়র্ক স্টেট অ্যাসেম্বলির সদস্য হিসেবে পাওয়া বাৎসরিক ১ লাখ ৪২ হাজার ডলারের বেতন। এর পাশাপাশি তিনি অতীতে ‘ইয়াং কার্ডামন’ নাম নিয়ে র‍্যাপসংগীত করতেন, সেখান থেকে বছরে প্রায় ১ হাজার ২৬৭ ডলারের রয়্যালটি পান। মামদানি উগান্ডার জিনজা শহরে চার একর জমির মালিক, যার মূল্য প্রায় দেড় লাখ থেকে আড়াই লাখ ডলারের মধ্যে। তবে তাঁর উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যবসায়িক মালিকানা বা বিনিয়োগ নেই।
মামদানি জন্মগ্রহণ করেন উগান্ডায়। তাঁর বাবা প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ মাহমুদ মামদানি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। মা মীরা নায়ার, একজন খ্যাতনামা ভারতীয়-মার্কিন চলচ্চিত্র নির্মাতা। মামদানি  প্রায় ২৫ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর তিনি ২০১৮ সালে মার্কিন নাগরিকত্ব লাভ করেন এবং রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে কুইন্স এলাকা থেকে নিউইয়র্ক স্টেট অ্যাসেম্বলিতে নির্বাচিত হন।
নিউইয়র্ক সিটির মেয়র হওয়ার লক্ষ্যে তাঁর প্রচারাভিযান পরিচালিত হচ্ছে তৃণমূল পর্যায়ের অনুদানের ভিত্তিতে। এ পর্যন্ত তিনি ৭০ লাখ ডলারের বেশি সংগ্রহ করেছেন ১৬ হাজারের বেশি ব্যক্তিগত দাতার কাছ থেকে, যাঁদের অধিকাংশই দিয়েছেন ছোট অঙ্কের অনুদান, যা কর্মজীবী, অভিবাসী ও প্রগতিশীল জনগণের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা তুলে ধরে।
ট্রাম্পের ব্যক্তিজীবন ও বিপরীত অবস্থানে মামদানির রাজনীতি : ডোনাল্ড ট্রাম্পের রয়েছে বিপুল ব্যক্তিগত সম্পদ, আবাসন বা রিয়েল এস্টেট ব্যবসা ও বহু দশকের বাণিজ্যিক অভিজ্ঞতা। প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে আজীবন নিউইয়র্কের বাসিন্দা ট্রাম্প তাঁর আর্থিক অবস্থান ও তারকাখ্যাতিকে ব্যবহার করেছেন রাজনৈতিক পরিচয় ও নীতিগত অগ্রাধিকারের রূপদান করতে।
যেখানে ট্রাম্পের সম্পদ আনুমানিক কয়েক বিলিয়ন ডলারের, সেখানে মামদানির আর্থিক তথ্য একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র তুলে ধরে। একজন প্রার্থী যার আর্থিক সক্ষমতা ব্যক্তিগত ব্যবসা বা উত্তরাধিকারসূত্রে অর্জিত নয়, বরং গড়ে উঠেছে জনসেবা ও সম্প্রদায়ের সহায়তার মাধ্যমে।
ট্রাম্প ও জোহরান মামদানির নীতিগত পার্থক্যও ততটাই তীক্ষ্ণ। মামদানি বাড়িভাড়া জমার হার বন্ধ রাখা, বিনা মূল্যে গণপরিবহন, সম্প্রসারিত সামাজিক আবাসন এবং ধনীদের ওপর অধিক কর আরোপ করে জনসেবা উন্নয়নের পক্ষে। এসব নীতিই ট্রাম্পের নিয়ন্ত্রণ শিথিল, পুলিশিং ও ধনীদের করছাড়-কেন্দ্রিক নীতির সরাসরি বিপরীতে অবস্থান করে।
মামদানির রাজনীতির কেন্দ্রে রয়েছে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ, অভিবাসীদের অধিকার রক্ষা এবং সংহতির বার্তা; অন্যদিকে ট্রাম্পের ভাষ্য ঘুরে ফিরে এসেছে বহিষ্কার, সীমান্ত নিরাপত্তা ও প্রগতিশীল সংস্কারগুলোর বিপরীত অবস্থানে।
মধ্যপ্রাচ্যসংক্রান্ত মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির কড়া সমালোচক হিসেবেও মামদানিকে চেনা যায়, বিশেষত ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে। বিপরীতে ট্রাম্প বরাবরই কট্টরপন্থী ইসরায়েলি নেতৃত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অবস্থানে থেকেছেন।
ট্রাম্প ও মামদানির রাজনৈতিক লড়াই শুধু নীতিমালার প্রশ্নেই সীমাবদ্ধ নেই। প্রচারের সময় নিউইয়র্কে ট্রাম্পপন্থী কয়েকজন, যার মধ্যে রয়েছেন রিপাবলিকান কাউন্সিলর ভিকি পেলাডিনো, খোলাখুলি মামদানিকে দেশচ্যুতির দাবি করেন, যা এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার ব্যক্তিগত ও আদর্শগত তীব্রতাকে আরও স্পষ্ট করে। মামদানি জবাব দিয়ে বলেন, ‘মৃত্যু হুমকি। ইসলামভীতির বৈষম্য। এখন বসে থাকা একজন কাউন্সিলর যে আমার দেশচ্যুতি চান। যথেষ্ট হয়েছে। ট্রাম্প ও তাঁর অনুগতরা এ রকমই পরিস্থিতি তৈরি করেছেন। এটা আমাদের শহর ও সংবিধানের মূল্যবোধের ওপর আক্রমণ।’
 
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: 01711238078