
বাংলাদেশে চালের মূল্যবৃদ্ধি এখন শুধু একটি অর্থনৈতিক ইস্যু নয় বরং এটি হয়ে উঠেছে সামাজিক স্থিতিশীলতা ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য একটি বড় হুমকি। চলমান পরিস্থিতিতে দরিদ্র ও নিম্নআয়ের মানুষদের বেঁচে থাকাই যেন এক অনিশ্চিত যুদ্ধ। দৈনিক বাজার পর্যবেক্ষণ, জাতীয় পত্রিকা ও সরকারি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে চালের দাম প্রতি কেজিতে গড়ে ২০-২৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে (সূত্র: টিসিবি, ২০২৫; বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, এপ্রিল ২০২৫)। বর্তমানে খুচরা বাজারে মাঝারি মানের সিদ্ধ চালের দাম প্রতিকেজি ৬৫ থেকে ৭২ টাকা এবং উচ্চমানের চাল ৮০ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ১৫-২০ টাকা বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই মূল্যবৃদ্ধি বাংলাদেশের কোটি কোটি প্রান্তিক মানুষের খাদ্য নিরাপত্তাকে চরমভাবে বিপন্ন করে তুলেছে।
চাল বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যপণ্য। দেশের প্রায় ১৬ কোটি মানুষ দৈনন্দিন ভাবে চাল নির্ভরখাদ্য গ্রহণ করে থাকে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ ‘হাউজ হোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (HIES) ২০২২’-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশের গড় খাদ্য ব্যয়ের ৪৮ শতাংশ চালের পেছনে যায়, বিশেষ করে নিম্নআয়ের পরিবারে এই হার ৬০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায় (সূত্র: BBS, HIES 2022 ২০২২)। অথচ গত কয়েক মাসে চালের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেক পরিবার তাদের দৈনন্দিন খাবার কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। দিনমজুর, রিকশাচালক, হকার ও গ্রামীণ শ্রমজীবীদের মধ্যে অনেকেই এখন দুই বেলা ভাত খেতেও হিমশিম খাচ্ছেন। এই সংকটের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে চালের বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকারের দুর্বলতা, আড়তদারদের মজুদ-সিন্ডিকেট এবং উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির যৌথ প্রভাব। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (BRRI)-এর মতে, ২০২৪ সালের আমন মৌসুমে উৎপাদন ২.১ শতাংশ কমেছে, যা বন্যা ও খরার কারণে হয়েছে (সূত্র: BRRIকৃষি রিপোর্ট ২০২৪)। কৃষকরা একদিকে ফসল উৎপাদনে বেশি ব্যয় করছে সারের দাম, ডিজেল, কীটনাশক এবং কৃষি যন্ত্রপাতির মূল্যবৃদ্ধির কারণে অন্যদিকে ন্যায্যমূল্য না পেয়ে উৎপাদনে আগ্রহ হারাচ্ছে। মিলমালিক ও মধ্যস্বত্বভোগীরা কৃষকের কাছ থেকে ধান কম দামে কিনে পরে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে চালের দাম বাড়িয়ে তোলে। বাংলাদেশ ধান মিলমালিক সমিতির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, একটি অসাধু সিন্ডিকেট চালের বাজারকে অস্থির করে তুলছে এবং সরকারের নজরদারি অপ্রতুল (সূত্র: দৈনিক প্রথমআলো, ২৯ মার্চ ২০২৫)।
অন্যদিকে খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সরকারি খাদ্যগুদামে বর্তমানে গড় মজুদ ১০ লাখ মেট্রিক টনের নিচে নেমে এসেছে, যেখানে নিরাপদ মজুদের জন্য এটি কমপক্ষে ১৫-১৬ লাখ মেট্রিক টন হওয়া উচিত (সূত্র: খাদ্য অধিদপ্তর, এপ্রিল ২০২৫)। এতে ওএমএস (ওপেন মার্কেট সেল) কার্যক্রম নিয়মিত ভাবে পরিচালনা করা যাচ্ছে না। ফলে দরিদ্র জনগণের জন্য স্বল্পমূল্যে চাল ক্রয়ের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়েছে। সরকারের টার্গেট খাদ্য বিতরণ কর্মসূচি (VGD, VGF, OMS) অপ্রতুল হওয়ায় ভোক্তা পর্যায়ে চাপ বাড়ছে।
আন্তর্জাতিক বাজারেও চালের মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে চালের দাম ২০২৫ সালের শুরুতে প্রতিটন ৫০০ মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যায় (সূত্র: FAO, Global Rice Market Report, February ২০২৫)। বাংলাদেশের মতো আমদানিনির্ভর দেশের জন্য এতে আমদানিকৃত চালের ব্যয় বেড়েছে। ডলার সংকট ও আমদানি শুল্কের কারণে ব্যবসায়ীরা চাল আমদানিতে অনাগ্রহী হয়ে পড়েছে, যার ফলে স্থানীয় বাজারে সরবরাহ হ্রাস পেয়েছে এবং মূল্য বেড়েছে। এই অবস্থায় দরিদ্র জনগণ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ‘সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশ’-এর ২০২৫ সালের একটি জরিপে দেখা গেছে, নগরবস্তি এলাকার প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৭ জন পরিবার তিন বেলা খাবার পাচ্ছে না এবং শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির হার ২২ শতাংশে পৌঁছেছে (সূত্র: Save the Children, Urban Nutrition Report, ২০২৫)। শুধু তাই নয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চালের দাম নিয়ে জনঅসন্তোষ দেখা দিচ্ছে, কোথাও কোথাও ওএমএস পয়েন্টে হট্টগোল ও বিশৃঙ্খলাও সৃষ্টি হয়েছে।
চালের বাজারে এই অস্থিরতার কারণে সামাজিক অস্থিরতা, চুরি-ছিনতাই ও অপরাধ প্রবণতা বাড়ার আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। একই সঙ্গে এর প্রভাব পড়ছে অন্যান্য খাতে। পোশাকখাতের শ্রমিকরা বেতন বৃদ্ধির দাবি তুলছে, কারণ তাদের খাদ্য ব্যয় বেড়ে গেছে; শিক্ষার্থীরা ক্ষুধার্ত অবস্থায় ক্লাস করছে, যার ফলে তাদের মনোযোগ ও উপস্থিতি কমে যাচ্ছে। এমন একটি পরিস্থিতিতে সরকারের জোরালো হস্তক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অবিলম্বে বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। প্রথমত, জাতীয় খাদ্য মজুদ বাড়াতে হবে এবং সারাদেশে ওএমএস কার্যক্রম নিয়মিত ও বিস্তৃত ভাবে পরিচালনা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান সংগ্রহ করে মিলমালিকদের সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে এবং কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয়ত, বাজারে নজরদারি বৃদ্ধি করে মজুদদার ও মুনাফাখোরদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়া আমদানি শুল্ক কমিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সরকারি আমদানির ব্যবস্থা করা যেতে পারে, যাতে বাজারে চালের সরবরাহ বাড়ে এবং দাম কিছুটা সহনীয় মাত্রায় আসে।
সাম্প্রতিক এক সংবাদ সম্মেলনে খাদ্য উপদেষ্টা স্বীকার করেছেন যে, বাজারে চালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে এবং আমরা সিন্ডিকেট ভাঙার জন্য জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দিয়েছি (সূত্র: বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা- বাসস, মে ২০২৫)। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু নির্দেশ দিলেই হবে না; মাঠ পর্যায়ে কার্যকর বাস্তবায়ন ও নজরদারির প্রয়োজন রয়েছে। চালের বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরানো না গেলে দেশের দরিদ্র মানুষের অস্তিত্বের সংকট আরও তীব্র হবে। একটি কল্যাণ রাষ্ট্রে জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই সরকারের প্রথম দায়িত্ব। মনে রাখতে হবে, শুধু অবকাঠামো নয়, একটি দেশের উন্নয়নকে টিকিয়ে রাখতে হলে মানুষের পেটে ভাত থাকা জরুরি। সরকারের পক্ষ থেকে চাল নিয়ে সময়োচিত ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে ভবিষ্যতে এই সংকট ভয়াবহ সামাজিক অস্থিরতায় রূপ নিতে পারে। তাই এখনই সময় ব্যবস্থা নেওয়ার, ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার এবং প্রমাণ করার যে রাষ্ট্র তার জনগণের পাশে আছে।
অতএব বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকারকে এখনই কার্যকর, সুস্পষ্ট এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে যাতে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিমুক্ত রাখা যায়। প্রথমত, সরকারকে একটি জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা নীতিমালা নবায়ন ও শক্তিশালী করতে হবে, যেখানে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য স্থায়ী রেশনিং ব্যবস্থা, স্বচ্ছ ও ডিজিটালাইজড খাদ্য বিতরণ পদ্ধতি এবং দুর্যোগকালীন জরুরি খাদ্য সংরক্ষণ কৌশল অন্তর্ভুক্ত থাকবে। দ্বিতীয়ত, কৃষককে উৎপাদনে উৎসাহ দিতে তাদের উৎপাদিত ধানের জন্য মৌসুমভিত্তিক ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ ও সরাসরি ক্রয় প্রক্রিয়া চালু করতে হবে, যেন মধ্যস্বত্বভোগীদের ভূমিকা হ্রাস পায়। তৃতীয়ত, চালের আমদানি নীতিতে সময়োচিত পরিবর্তন এনে প্রয়োজন মতো শুল্কহ্রাস করে দ্রুত সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে। চতুর্থত, প্রতিটি উপজেলায় সরকারি খাদ্যগুদামের সক্ষমতা বাড়ানো এবং ওএমএস ও টার্গেট খাদ্য কর্মসূচিকে ডিজিটাল কার্ডের মাধ্যমে আরো স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও নিয়মিত করতে হবে এবং পঞ্চমত, বাজারে নজরদারি বাড়াতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের সংখ্যাবৃদ্ধি, জেলা প্রশাসক ও র্যাব-পুলিশের সমন্বয়ে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করে চালের মজুদ ও বিক্রয় চিত্র নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। এই পদক্ষেপগুলো এখনই নেওয়া না হলে দেশে শুধুমাত্র খাদ্য সংকট নয় বরং এক গভীর সামাজিক সংকটের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যেতে পারে জাতি।
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, অন্যচিত্র ফাউন্ডেশন, ময়মনসিংহ, এমফিল গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
চাল বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যপণ্য। দেশের প্রায় ১৬ কোটি মানুষ দৈনন্দিন ভাবে চাল নির্ভরখাদ্য গ্রহণ করে থাকে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ ‘হাউজ হোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (HIES) ২০২২’-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশের গড় খাদ্য ব্যয়ের ৪৮ শতাংশ চালের পেছনে যায়, বিশেষ করে নিম্নআয়ের পরিবারে এই হার ৬০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায় (সূত্র: BBS, HIES 2022 ২০২২)। অথচ গত কয়েক মাসে চালের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেক পরিবার তাদের দৈনন্দিন খাবার কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। দিনমজুর, রিকশাচালক, হকার ও গ্রামীণ শ্রমজীবীদের মধ্যে অনেকেই এখন দুই বেলা ভাত খেতেও হিমশিম খাচ্ছেন। এই সংকটের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে চালের বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকারের দুর্বলতা, আড়তদারদের মজুদ-সিন্ডিকেট এবং উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির যৌথ প্রভাব। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (BRRI)-এর মতে, ২০২৪ সালের আমন মৌসুমে উৎপাদন ২.১ শতাংশ কমেছে, যা বন্যা ও খরার কারণে হয়েছে (সূত্র: BRRIকৃষি রিপোর্ট ২০২৪)। কৃষকরা একদিকে ফসল উৎপাদনে বেশি ব্যয় করছে সারের দাম, ডিজেল, কীটনাশক এবং কৃষি যন্ত্রপাতির মূল্যবৃদ্ধির কারণে অন্যদিকে ন্যায্যমূল্য না পেয়ে উৎপাদনে আগ্রহ হারাচ্ছে। মিলমালিক ও মধ্যস্বত্বভোগীরা কৃষকের কাছ থেকে ধান কম দামে কিনে পরে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে চালের দাম বাড়িয়ে তোলে। বাংলাদেশ ধান মিলমালিক সমিতির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, একটি অসাধু সিন্ডিকেট চালের বাজারকে অস্থির করে তুলছে এবং সরকারের নজরদারি অপ্রতুল (সূত্র: দৈনিক প্রথমআলো, ২৯ মার্চ ২০২৫)।
অন্যদিকে খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সরকারি খাদ্যগুদামে বর্তমানে গড় মজুদ ১০ লাখ মেট্রিক টনের নিচে নেমে এসেছে, যেখানে নিরাপদ মজুদের জন্য এটি কমপক্ষে ১৫-১৬ লাখ মেট্রিক টন হওয়া উচিত (সূত্র: খাদ্য অধিদপ্তর, এপ্রিল ২০২৫)। এতে ওএমএস (ওপেন মার্কেট সেল) কার্যক্রম নিয়মিত ভাবে পরিচালনা করা যাচ্ছে না। ফলে দরিদ্র জনগণের জন্য স্বল্পমূল্যে চাল ক্রয়ের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়েছে। সরকারের টার্গেট খাদ্য বিতরণ কর্মসূচি (VGD, VGF, OMS) অপ্রতুল হওয়ায় ভোক্তা পর্যায়ে চাপ বাড়ছে।
আন্তর্জাতিক বাজারেও চালের মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে চালের দাম ২০২৫ সালের শুরুতে প্রতিটন ৫০০ মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যায় (সূত্র: FAO, Global Rice Market Report, February ২০২৫)। বাংলাদেশের মতো আমদানিনির্ভর দেশের জন্য এতে আমদানিকৃত চালের ব্যয় বেড়েছে। ডলার সংকট ও আমদানি শুল্কের কারণে ব্যবসায়ীরা চাল আমদানিতে অনাগ্রহী হয়ে পড়েছে, যার ফলে স্থানীয় বাজারে সরবরাহ হ্রাস পেয়েছে এবং মূল্য বেড়েছে। এই অবস্থায় দরিদ্র জনগণ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ‘সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশ’-এর ২০২৫ সালের একটি জরিপে দেখা গেছে, নগরবস্তি এলাকার প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৭ জন পরিবার তিন বেলা খাবার পাচ্ছে না এবং শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির হার ২২ শতাংশে পৌঁছেছে (সূত্র: Save the Children, Urban Nutrition Report, ২০২৫)। শুধু তাই নয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চালের দাম নিয়ে জনঅসন্তোষ দেখা দিচ্ছে, কোথাও কোথাও ওএমএস পয়েন্টে হট্টগোল ও বিশৃঙ্খলাও সৃষ্টি হয়েছে।
চালের বাজারে এই অস্থিরতার কারণে সামাজিক অস্থিরতা, চুরি-ছিনতাই ও অপরাধ প্রবণতা বাড়ার আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। একই সঙ্গে এর প্রভাব পড়ছে অন্যান্য খাতে। পোশাকখাতের শ্রমিকরা বেতন বৃদ্ধির দাবি তুলছে, কারণ তাদের খাদ্য ব্যয় বেড়ে গেছে; শিক্ষার্থীরা ক্ষুধার্ত অবস্থায় ক্লাস করছে, যার ফলে তাদের মনোযোগ ও উপস্থিতি কমে যাচ্ছে। এমন একটি পরিস্থিতিতে সরকারের জোরালো হস্তক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অবিলম্বে বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। প্রথমত, জাতীয় খাদ্য মজুদ বাড়াতে হবে এবং সারাদেশে ওএমএস কার্যক্রম নিয়মিত ও বিস্তৃত ভাবে পরিচালনা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান সংগ্রহ করে মিলমালিকদের সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে এবং কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয়ত, বাজারে নজরদারি বৃদ্ধি করে মজুদদার ও মুনাফাখোরদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়া আমদানি শুল্ক কমিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সরকারি আমদানির ব্যবস্থা করা যেতে পারে, যাতে বাজারে চালের সরবরাহ বাড়ে এবং দাম কিছুটা সহনীয় মাত্রায় আসে।
সাম্প্রতিক এক সংবাদ সম্মেলনে খাদ্য উপদেষ্টা স্বীকার করেছেন যে, বাজারে চালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে এবং আমরা সিন্ডিকেট ভাঙার জন্য জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দিয়েছি (সূত্র: বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা- বাসস, মে ২০২৫)। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু নির্দেশ দিলেই হবে না; মাঠ পর্যায়ে কার্যকর বাস্তবায়ন ও নজরদারির প্রয়োজন রয়েছে। চালের বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরানো না গেলে দেশের দরিদ্র মানুষের অস্তিত্বের সংকট আরও তীব্র হবে। একটি কল্যাণ রাষ্ট্রে জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই সরকারের প্রথম দায়িত্ব। মনে রাখতে হবে, শুধু অবকাঠামো নয়, একটি দেশের উন্নয়নকে টিকিয়ে রাখতে হলে মানুষের পেটে ভাত থাকা জরুরি। সরকারের পক্ষ থেকে চাল নিয়ে সময়োচিত ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে ভবিষ্যতে এই সংকট ভয়াবহ সামাজিক অস্থিরতায় রূপ নিতে পারে। তাই এখনই সময় ব্যবস্থা নেওয়ার, ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার এবং প্রমাণ করার যে রাষ্ট্র তার জনগণের পাশে আছে।
অতএব বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকারকে এখনই কার্যকর, সুস্পষ্ট এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে যাতে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিমুক্ত রাখা যায়। প্রথমত, সরকারকে একটি জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা নীতিমালা নবায়ন ও শক্তিশালী করতে হবে, যেখানে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য স্থায়ী রেশনিং ব্যবস্থা, স্বচ্ছ ও ডিজিটালাইজড খাদ্য বিতরণ পদ্ধতি এবং দুর্যোগকালীন জরুরি খাদ্য সংরক্ষণ কৌশল অন্তর্ভুক্ত থাকবে। দ্বিতীয়ত, কৃষককে উৎপাদনে উৎসাহ দিতে তাদের উৎপাদিত ধানের জন্য মৌসুমভিত্তিক ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ ও সরাসরি ক্রয় প্রক্রিয়া চালু করতে হবে, যেন মধ্যস্বত্বভোগীদের ভূমিকা হ্রাস পায়। তৃতীয়ত, চালের আমদানি নীতিতে সময়োচিত পরিবর্তন এনে প্রয়োজন মতো শুল্কহ্রাস করে দ্রুত সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে। চতুর্থত, প্রতিটি উপজেলায় সরকারি খাদ্যগুদামের সক্ষমতা বাড়ানো এবং ওএমএস ও টার্গেট খাদ্য কর্মসূচিকে ডিজিটাল কার্ডের মাধ্যমে আরো স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও নিয়মিত করতে হবে এবং পঞ্চমত, বাজারে নজরদারি বাড়াতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের সংখ্যাবৃদ্ধি, জেলা প্রশাসক ও র্যাব-পুলিশের সমন্বয়ে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করে চালের মজুদ ও বিক্রয় চিত্র নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। এই পদক্ষেপগুলো এখনই নেওয়া না হলে দেশে শুধুমাত্র খাদ্য সংকট নয় বরং এক গভীর সামাজিক সংকটের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যেতে পারে জাতি।
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, অন্যচিত্র ফাউন্ডেশন, ময়মনসিংহ, এমফিল গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।