
মুকিত আলী ও তার স্ত্রী আমাদের বাসার বেসমেন্টে থাকতেন। বাড়ি সিলেটের সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে। প্রায় পাঁচ বছর আমরা একসঙ্গে একই ছাদের নিচে ছিলাম, যেন একটিই পরিবার। দুজনই ছিলেন অসম্ভব সাদাসিধে। শহুরে আধুনিকতা তাদের ছুঁয়ে যায়নি। নিউইয়র্কের মতো শহরে থাকলেও তারা ছিলেন নিখাদ গ্রামীণ সরলতায় মোড়ানো মানুষ।
মুকিত চাচাকে আমি ডাকতাম ‘চাচা’ আর ওনার স্ত্রীকে ‘চাচি’। তারা আমাকে ‘মাই’ ডেকে যত্ন করতেন, ভালোবাসতেন। ভোর ছয়টায় আমি অফিসে বের হই, আর ঠিক তার আগে ফজরের নামাজ সেরে চাচা অপেক্ষা করেন দরজার কাছে, যেন আমাকে বিদায় জানাতে পারেন। তুষার ঝরার দিনেও লুঙ্গির নিচে থার্মাল পরে বের হতে রাজি হননি।
-নাগো মাই, ইতা কুটকুটি খরে!
এই এক কথা শুনে আর কিছু বলিনি। মানুষটা জীবনের সহজ স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে কোনো চাপেই হাঁটতেন না।
চাচির হাতের রান্না, মুখে হাসি আর চাচার দরজায় দাঁড়িয়ে প্রতিদিনের সালাম-এসব ছিল আমার নিউইয়র্ক জীবনের প্রাত্যহিক স্বস্তির খণ্ডচিত্র। কখনো পিঠা, কখনো পায়েস, ভর্তা বা মাছের ঝোল-যা-ই থাকুক না কেন, ঘরে ফিরলেই দুজনের আহ্লাদে মন ভরে উঠত।
২০২০ সালের বসন্ত
বিশ্বজুড়ে তখন এক অদৃশ্য আতঙ্কÑকরোনা। লকডাউন, মৃত্যুভয়, হাসপাতালে ঠাঁই নেই, মানুষের মুখে মাস্ক, চোখে ভয়। এ অবস্থায় মুকিত চাচা গিয়েছিলেন দেশে, ছোট ছেলের বিয়ে দিতে। কিন্তু দেশে গিয়েই ঘটে যায় বিপর্যয়।
এয়ারপোর্ট থেকে পরিবারসহ আলাদা করে ফেলা হয়। তাদের নিজ বাড়িতেই ঘরবন্দী রাখা হয়। গ্রামের মানুষ যেন করোনা মানেই মৃত্যু বলে ধরে নিয়েছিল। চাচা ফোন করে বলেছিলেন :
-মাই, আমরা ঘরে বন্দী, পুত রে আলগা ঘরে রাখছে। সব জমানো টেহা শেষ, কেমনে থাকিমু?
বিয়ের তারিখ পেছানো হয়। পরে ভেঙেও যায়। কনেপক্ষ জানায়, তারা আমেরিকার অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, চাকরি হারানো কালো ছেলে, ট্রাম্পের কঠোর ভিসা নীতির ভয়Ñএসব কারণে আর বিয়েতে আগ্রহী নয়।
আমি ফোন রেখে ভাবি, যুগ বদলেছে। এখন গ্রামের মানুষও আমেরিকার সামগ্রিক রাজনৈতিক, সামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আনছে।
২০২০-২০২৫ : পাঁচ বছরের গল্প
করোনা পেরিয়ে পৃথিবী ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়। কিন্তু সেই ছেলেটির বিয়ে আর হয় না। চাচা ধীরে ধীরে বিষণ্ন হয়ে পড়েন। মাঝে একবার আবার ছোটখাটো চাকরি নেন, পরে ছেড়ে দেন। প্রতিদিন সকালে দরজায় দাঁড়িয়ে সেই চিরচেনা কণ্ঠে বলেন :
-মাই, খামো যাওনি?
আমি যেন জীবনের প্রতিদিন একটি ভালোবাসার কণা হাতে পেতাম ওনার কাছ থেকে। চাচি আগের মতোই রান্না করেন। তবে চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ।
২০২৩ সালে চাচির হার্টের সমস্যা ধরা পড়ে। হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন কিছুদিন। সুস্থ হয়ে ফিরে আসেন ঠিকই, কিন্তু মুকিত চাচার মুখে তখনো সেই এক কথা :
-আল্লারে দোয়া করি, আমরা যত দিন বাঁচি, মাইর লাইগা দোয়া করুম।
মে, ২০২৫
আবারও ছড়িয়ে পড়ে করোনাভাইরাসের এক নতুন ভ্যারিয়েন্ট। এবার আর মুকিত চাচা বাঁচেন না। ঠান্ডা-জ্বর নিয়েই কদিন বিছানায় ছিলেন, হাসপাতালে নিতে নিতে শেষ। চাচি ভেঙে পড়েন, আমি বাকরুদ্ধ।
সেদিন সকালে আর শোনা যায়নি :
-মাই, খামো যাওনি?
চাচির হাতে সেই রান্নার পাত্র নেই, মুখে হাসিও নেই।
আমি সেই প্রথমবার তাদের বাসার দরজা খুলে দেখি, ভেতরটা যেন শূন্য।
চাচার চলে যাওয়া যেন এক যুগের সমাপ্তি। করোনার সঙ্গে লড়ে প্রথমবার বেঁচে গিয়েছিলেন, দ্বিতীয়বারে পারেননি।
চাচার গল্প শুধু একটা পরিবার নয়, প্রবাস-জীবনের এক টুকরো ইতিহাস।
তার সরল জীবন, নীরব ভালোবাসা আর শেষ অবধি একটি অসমাপ্ত আশার গল্পÑসবকিছু মিলিয়ে চাচা হয়ে রইলেন প্রবাসে এক নিখুঁত মানসিক আশ্রয়স্থল।
আজও ভোরে ঘুম ভাঙলে মনে হয় দরজার বাইরে কেউ ডাকছে :
-মাই, খামো যাওনি?
কিন্তু আমি জানি, সেই ডাক আর কোনো দিন ফিরবে না।
চিরকাল থেকে যাবে শুধু স্মৃতির গায়ে মেখে থাকা মুকিত চাচার স্নিগ্ধ ভালোবাসা।
মুকিত চাচাকে আমি ডাকতাম ‘চাচা’ আর ওনার স্ত্রীকে ‘চাচি’। তারা আমাকে ‘মাই’ ডেকে যত্ন করতেন, ভালোবাসতেন। ভোর ছয়টায় আমি অফিসে বের হই, আর ঠিক তার আগে ফজরের নামাজ সেরে চাচা অপেক্ষা করেন দরজার কাছে, যেন আমাকে বিদায় জানাতে পারেন। তুষার ঝরার দিনেও লুঙ্গির নিচে থার্মাল পরে বের হতে রাজি হননি।
-নাগো মাই, ইতা কুটকুটি খরে!
এই এক কথা শুনে আর কিছু বলিনি। মানুষটা জীবনের সহজ স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে কোনো চাপেই হাঁটতেন না।
চাচির হাতের রান্না, মুখে হাসি আর চাচার দরজায় দাঁড়িয়ে প্রতিদিনের সালাম-এসব ছিল আমার নিউইয়র্ক জীবনের প্রাত্যহিক স্বস্তির খণ্ডচিত্র। কখনো পিঠা, কখনো পায়েস, ভর্তা বা মাছের ঝোল-যা-ই থাকুক না কেন, ঘরে ফিরলেই দুজনের আহ্লাদে মন ভরে উঠত।
২০২০ সালের বসন্ত
বিশ্বজুড়ে তখন এক অদৃশ্য আতঙ্কÑকরোনা। লকডাউন, মৃত্যুভয়, হাসপাতালে ঠাঁই নেই, মানুষের মুখে মাস্ক, চোখে ভয়। এ অবস্থায় মুকিত চাচা গিয়েছিলেন দেশে, ছোট ছেলের বিয়ে দিতে। কিন্তু দেশে গিয়েই ঘটে যায় বিপর্যয়।
এয়ারপোর্ট থেকে পরিবারসহ আলাদা করে ফেলা হয়। তাদের নিজ বাড়িতেই ঘরবন্দী রাখা হয়। গ্রামের মানুষ যেন করোনা মানেই মৃত্যু বলে ধরে নিয়েছিল। চাচা ফোন করে বলেছিলেন :
-মাই, আমরা ঘরে বন্দী, পুত রে আলগা ঘরে রাখছে। সব জমানো টেহা শেষ, কেমনে থাকিমু?
বিয়ের তারিখ পেছানো হয়। পরে ভেঙেও যায়। কনেপক্ষ জানায়, তারা আমেরিকার অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, চাকরি হারানো কালো ছেলে, ট্রাম্পের কঠোর ভিসা নীতির ভয়Ñএসব কারণে আর বিয়েতে আগ্রহী নয়।
আমি ফোন রেখে ভাবি, যুগ বদলেছে। এখন গ্রামের মানুষও আমেরিকার সামগ্রিক রাজনৈতিক, সামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আনছে।
২০২০-২০২৫ : পাঁচ বছরের গল্প
করোনা পেরিয়ে পৃথিবী ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়। কিন্তু সেই ছেলেটির বিয়ে আর হয় না। চাচা ধীরে ধীরে বিষণ্ন হয়ে পড়েন। মাঝে একবার আবার ছোটখাটো চাকরি নেন, পরে ছেড়ে দেন। প্রতিদিন সকালে দরজায় দাঁড়িয়ে সেই চিরচেনা কণ্ঠে বলেন :
-মাই, খামো যাওনি?
আমি যেন জীবনের প্রতিদিন একটি ভালোবাসার কণা হাতে পেতাম ওনার কাছ থেকে। চাচি আগের মতোই রান্না করেন। তবে চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ।
২০২৩ সালে চাচির হার্টের সমস্যা ধরা পড়ে। হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন কিছুদিন। সুস্থ হয়ে ফিরে আসেন ঠিকই, কিন্তু মুকিত চাচার মুখে তখনো সেই এক কথা :
-আল্লারে দোয়া করি, আমরা যত দিন বাঁচি, মাইর লাইগা দোয়া করুম।
মে, ২০২৫
আবারও ছড়িয়ে পড়ে করোনাভাইরাসের এক নতুন ভ্যারিয়েন্ট। এবার আর মুকিত চাচা বাঁচেন না। ঠান্ডা-জ্বর নিয়েই কদিন বিছানায় ছিলেন, হাসপাতালে নিতে নিতে শেষ। চাচি ভেঙে পড়েন, আমি বাকরুদ্ধ।
সেদিন সকালে আর শোনা যায়নি :
-মাই, খামো যাওনি?
চাচির হাতে সেই রান্নার পাত্র নেই, মুখে হাসিও নেই।
আমি সেই প্রথমবার তাদের বাসার দরজা খুলে দেখি, ভেতরটা যেন শূন্য।
চাচার চলে যাওয়া যেন এক যুগের সমাপ্তি। করোনার সঙ্গে লড়ে প্রথমবার বেঁচে গিয়েছিলেন, দ্বিতীয়বারে পারেননি।
চাচার গল্প শুধু একটা পরিবার নয়, প্রবাস-জীবনের এক টুকরো ইতিহাস।
তার সরল জীবন, নীরব ভালোবাসা আর শেষ অবধি একটি অসমাপ্ত আশার গল্পÑসবকিছু মিলিয়ে চাচা হয়ে রইলেন প্রবাসে এক নিখুঁত মানসিক আশ্রয়স্থল।
আজও ভোরে ঘুম ভাঙলে মনে হয় দরজার বাইরে কেউ ডাকছে :
-মাই, খামো যাওনি?
কিন্তু আমি জানি, সেই ডাক আর কোনো দিন ফিরবে না।
চিরকাল থেকে যাবে শুধু স্মৃতির গায়ে মেখে থাকা মুকিত চাচার স্নিগ্ধ ভালোবাসা।