৩৬ শে জুলাই ‘২৪ : একটি সৃজনশীল গণঅভ্যুত্থান-৩ (প্রসঙ্গ স্লোগান)

প্রকাশ : ০৫ জুন ২০২৫, ১৯:১৬ , অনলাইন ভার্সন
পরের দিন ১৬ তারিখে আন্দোলনের ধারায় একটি অভাবিত ও অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে গেল। পুলিশের গুলিতে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র আবু সাঈদসহ মোট ৫ জন নিহত হন। পনেরো দিনের মাথায় প্রথম রক্ত ঝরল। আন্দোলন আর অহিংস ও অরাজনৈতিক রইল না, সহিংস ও রাজনৈতিক রূপ নিয়ে অন্যদিকে ঘুরে গেল। এরূপ ঘটনা আর থামেনি। পরের দিন ১৭ তারিখে বহুসংখ্যক হতাহতের ঘটনা ঘটে। এর পরের দিন ১৮ তারিখে ২৯ জন শহীদ হলেন। ১৯ তারিখে নিহতের সংখ্যা ২১। এর পর থেকে সরকারের পক্ষ থেকে একে একে কারফিউ জারি করা হলো, সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হলো, অফিস-আদালত বন্ধ করা হলো, ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করা হলো। পাশাপাশি দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষ ও হতাহতের ঘটনা চলতে থাকে। এসব ঘটনা শুধু ‘টার্নিং পয়েন্ট’ নয়, আন্দোলনকে ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্ন’ পর্যায়ে নিয়ে যায়। শিক্ষার্থীদের দাবিদাওয়া আর কোটার বা বৈষম্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ রইল না, শেখ হাসিনার পদত্যাগ চেয়ে আন্দোলন এক দফা এক দাবিতে পরিণত হলো। পরের দিনগুলোতেও সরকারের দমন-পীড়ন বন্ধ হয়নি-হত্যা, হামলা-মামলা, সমন্বয়কদের আটক, গণগ্রেপ্তার ইত্যাদি চলতে থাকে। ছাত্র-জনতার আন্দোলন শেষ পর্যায়ে গণঅভ্যুত্থানের রূপ গ্রহণ করে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিজয় ও সমাপ্তি ঘটে।

সকল মৃত্যুই বেদনাদায়ক। তবে বিপাকে বা অপঘাতে অকালে কারও মৃত্যু হলে তা অধিক মর্মদাহী হয়। তুরস্কের শিশুসন্তান আয়লান কুর্দি বাবার সঙ্গে গ্রিসের উদ্দেশে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে নৌকাডুবিতে মারা যায়; তার লাশ সাগরতীরে পড়ে থাকতে দেখা যায়। যোগাযোগমাধ্যমে তা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এ বড় করুণ দৃশ্য! অনুরূপ ভারতের বিএসএফের গুলিতে নিহত বাংলাদেশের শিশুকন্যা ফেলানির কাঁটাতারে ঝুলন্ত লাশ বিশ্ববিবেককে নাড়া দেয়। জুলাই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্র আবু সাঈদ বন্দুকধারী পুলিশের সামনে একা বুকটান ও হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানায়। পুলিশ ঠিকই গুলি চালায়। ভিডিওতে দেখা যায়, অদৃশ্য এক গুলি এসে তার বুকে বিঁধে; সাঈদ প্রথমে একটু ঝাঁকুনি খায়, ডিভাইডার পার হয়ে পরমুহূর্তে মাটিতে ঢলে পড়ে ও মৃত্যুবরণ করে। যোগাযোগমাধ্যমে এ করুণ দৃশ্য দেখে বিশ্বের বিবেকবান মানুষ অনুরূপভাবে মর্মাহত ও বেদনাবিদ্ধ হয়। আবু সাঈদসহ অন্য সবার মৃত্যুতে চলমান ছাত্র আন্দোলন তীব্রতর রূপ ধারণ করে এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘটনার অনুকূলে নতুন নতুন স্লোগানের জন্ম হয়। এমন কতক স্লোগান ছিল নিম্নরূপ :

২৮. বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর। ২৯. আমার খায় আমার পরে, আমার বুকেই গুলি করে। ৩০. রক্তের বন্যায়, ভেসে যাবে অন্যায়। ৩১. লাখো শহীদের রক্তে কেনা, দেশটা কারো বাপের না। [ভাষান্তর : মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, দেশটা কারো বাপের না।] ৩২. আমার ভাই কবরে, খুনি কেন গদিতে। ৩৩. লাশের ভেতর জীবন দে, নইলে গদি ছেড়ে দে।
২৮ নং স্লোগানটি যে গুলিবিদ্ধ আবু সাঈদকে অবলম্বন করে রচিত হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। এটি তার গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুমুখে ঢলে পড়া দৃশ্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়। তিনিই দুই হাত প্রসারিত করে পুলিশের সামনে বুক পেতে দাঁড়িয়েছিলেন। এ যেন তারই অন্তরের কথা! তার অসীম সাহসী নীরব ভঙ্গিকে স্লোগানের ভাষায় প্রমূর্ত করা হয়েছে। পরে আমরা দেখেছি, বহু গ্রাফিতি-পোস্টার-প্ল্যাকার্ডে আবু সাঈদের গুলিবিদ্ধ এই দৃশ্যের সঙ্গে স্লোগানটি সংগ্রথিত হয়েছে। ১৮ নং প্রবাদের মতোই এটি সর্বাধিক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। প্রথমটি শ্লেষাত্মক, দ্বিতীয়টি বীরত্বব্যঞ্জক। স্লোগানটি ‘জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য/ চিত্ত ভাবনাহীন।’ (বন্দী বীর) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উক্তি স্মরণ করিয়ে দেয়। এর মধ্যে প্রত্যক্ষ লড়াইয়ের ডাক ও প্রণোদনা রয়েছে।
২৮-৩৩ নং স্লোগানগুলো সাঈদসহ অন্য যারা শহীদ ও সমাধিস্থ হন, তাদের স্মৃতিকে ধারণ করে রচিত হয়। স্লোগানের ভাষা জুগিয়েছে পুলিশের গুলি, শহীদের রক্ত, লাশ, কবর ইত্যাদি। স্লোগানের ভাষা পরিবর্তিত হয়ে যন্ত্রণাক্লিষ্ট ও জ্বালামুখী হয়ে উঠেছে। শেষের তিনটি স্লোগান যেন সূচিমুখী তিনটি তীর; সরাসরি সরকার-প্রধানের গদি লক্ষ্য করে ছুড়ে দেওয়া হয়েছে। প্রবাদ আছে : ‘ছোড়া তীর আর ফিরে আসে না।’ আমরা পরবর্তীকালে দেখেছি, অনুরূপ আরও অনেক স্লোগানরূপ তীর নিক্ষিপ্ত হয়েছে এবং পরিণামে লক্ষ্যভেদ করতে সক্ষম হয়েছে। ৩১ নং স্লোগানের ভাষান্তর : ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, রাষ্ট্র কারোর বাপের না।’ স্লোগানটি তৈরি করেন ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হোম ইকোনমিক্স ইন্সটিটিউটে’র শিক্ষার্থীরা। তাদের ১৫ জুলাই মিছিলের প্ল্যাকার্ডে দেখা গেছে।
শেখ হাসিনার কথায় এবং ওবায়দুল কাদেরের উসকানিতে ১৫ জুলাই ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ক্যাডাররা যৌথভাবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিসোঁটা ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা করে। ঢাবি হলের ছাত্রীরাও তাদের নিষ্ঠুর হামলা ও নির্যাতনের শিকার হন। এমনকি ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত ছাত্রদের ওপরও হামলা চালানো হয়। সমকালের পত্রপত্রিকায় এরূপ সংবাদসহ বহু ছবি প্রকাশিত হয়।

৩৪. জনে জনে খবর দে, ছাত্রলীগের কবর দে। (এর বিপরীতে ছাত্রলীগের স্লোগান ছিল : ‘জনে জনে খবর দে, এক দফা কবর দে।’) ৩৫. আমার ভাই মরল কেন, প্রশাসন জবাব চাই। ৩৬. সন্ত্রাসীদের গালে গালে, জুতা মারো তালে তালে। ৩৭. সন্ত্রাসীদের আস্তানা, ক্যাম্পাসে হবে না।
শেষের তিনটি স্লোগান ছিল রোকেয়া হলের ছাত্রীদের। তারা পুলিশের উদ্দেশেও ‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগান দেন। [ডেইলি স্টার অনলাইন রিপোর্ট, ১৬-৭-২৪]।
২০ থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত আন্দোলনরত সমন্বয়কদের গ্রেপ্তার করে ডিবি অফিসে আটক, একবার ছেড়ে আবার আটক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্বারা গ্রেপ্তার, মামলা, ব্লক রেইড দিয়ে গণগ্রেপ্তার ইত্যাদি হয়রানি ও নির্যাতন চলে। ১ থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলন তুঙ্গে উঠে গণঅভ্যুত্থানের রূপ নেয়, যার পরিণতিতে শেখ হাসিনার পলায়ন ও সরকারের পতন ঘটে। এ সময়ের মধ্যে যেসব স্লোগান তৈরি হয়, সম্ভাব্য ঘটনাক্রম রক্ষা করে সেসব সাজালে নিম্নরূপ একটি তালিকা পাওয়া যায় :
৩৮. কে এসেছে কে এসেছে? পুলিশ এসেছে।/ কী করছে কী করছে? স্বৈরাচারের পা চাটছে। ৩৯. সকল লাশের হিসাব করো, গ্রেপ্তার-নির্যাতন বন্ধ করো। [পটভূমি : পুলিশের গণগ্রেপ্তার]। ৪০. সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই, হত্যাকারীর ক্ষমা নাই। ৪১. যেখানে অন্যায়ের রেশ, আওয়াজ ওঠা বাংলাদেশ। ৪২. আপস না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম। [পটভূমি : সমন্বয়কদের ডিবি অফিসে আটক অবস্থায় চাপের মুখে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা] ৪৩. দালালি না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ। [ঐ] ৪৪. এখন দরকার, জনগণের সরকার। ৪৫. তারুণ্যের শক্তিতে, দেশ গড়ি একসাথে। ৪৬. মেধাবীদের কান্না, আর না আর না। ৪৭. এক দুই তিন চার, শেখ হাসিনা গদি ছাড়। ৪৮. দফা এক দাবি এক, শেখ হাসিনার পদত্যাগ। ৪৯. এক দফা এক দাবি, শেখ হাসিনা কবে যাবি। ৫০. কারফিউ ভেঙে ফেল, শেখ হাসিনা গেল গেল। ৫১. খুনির সঙ্গে আপস না, গদি ছাড় হাসিনা। ৫২. দাবি একটাই, পরিবর্তন চাই। ৫৩. তোর কোটা তুই নে, আমার ভাইকে ফিরিয়ে দে। ৫৪. ছাড়ো ভারত ভক্তি, পেতে চাইলে মুক্তি। ৫৫. সোনার বাংলায়, ফ্যাসিবাদের ঠাঁই নাই। ৫৬. ছাড়তে হবে ক্ষমতা, ঢাকায় আসো জনতা। [পটভূমি : মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি]। ৫৭. দড়ি ধরে মারো টান, স্বৈরাচার হবে খান খান। ৫৮. হৈ হৈ রৈ রৈ, স্বৈরাচার গেল কৈ?/ পালাইছে রে পালাইছে, স্বৈরাচার পালাইছে। [২য় অংশের ভাষান্তর : ‘পালাইছে রে পালাইছে, খুনি হাসিনা পালাইছে।’] ৫৯. ছি! ছি! ছি! হাসিনা, লজ্জায় বাঁচি না।

স্লোগানগুলো যেমন সুসংহত, তেমনি আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রতিটি স্লোগানই সময়োপযোগী, সুপরিকল্পিত। আন্দোলনের এই পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি ওঠে এবং দ্রুত সে দাবি প্রকট রূপ ধারণ করে। এরই প্রেক্ষাপটে রচিত হয়েছে ৪৭-৫৭ নং স্লোগানসমূহ। ৫৭ নং স্লোগান নেওয়া হয়েছে সত্যজিৎ রায় নির্মিত ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র (১৯৮০) থেকে। ৫৭-৫৮ নং স্লোগান দুটি শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পটভূমিতে রচিত। কোনোরূপ ঘোষণা ছাড়াই তার দেশত্যাগের সংবাদ পেয়ে আন্দোলনকারীরা উল্লাসে ফেটে পড়ে। ‘হৈ হৈ রৈ রৈ’ ধ্বন্যাত্মক শব্দে তারই প্রতিধ্বনি রয়েছে। স্লোগানগুলোতে শেখ হাসিনাকে খুনি, স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদী বলা হয়েছে।

একটি বিষয় লক্ষণীয়, ৩৬ দিনের পুরো আন্দোলনটি বেগবান ও গতিশীল ছিল, কোনো একটি জায়গায় গতিবেগ হারিয়ে স্থবির হয়ে যায়নি। চলমান ঘটনার সঙ্গে সংগতি রেখে স্লোগানগুলো রচিত হয়েছে এবং মিছিল-সমাবেশে শতসহস্র কণ্ঠে শতসহস্রবার সমস্বরে উচ্চারিত হয়ে আন্দোলনকে সফল ও সার্থক করে তুলেছে। [চলবে]
 
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: 01711238078