আমিনা ভেসে গেল মধুমতী জলে

প্রকাশ : ০৫ জুন ২০২৫, ১৯:১০ , অনলাইন ভার্সন
২০১৭ সালে প্রথম সাক্ষাতে লাল-কালো চেক শার্ট পরিহিত মেয়েটিকে দেখে চমকে উঠেছিলাম। একেবারেই বাঙালি মেয়েদের মতো, কোমনীয় চেহারায় লাবণ‍‍্যময় মায়াবী অবয়ব।
‘আন্টি, তোমাকে আমি খুব কষ্ট দিয়ে ফেললাম। আমি জানি, তোমাদের রমজান মাস চলছে, তার পরও আমার রক্তে যে বাঙালি টান মিশে আছে।’
সাধারণত আমেরিকানরা তাদের বড়দের নাম ধরেই সম্মোধন করে। আমাদের মতো সম্মান করে ভাইয়া, আপা, চাচা, মামা, ফুফু, খালা ডাকে না। মেয়েটা বাংলা জানলে হয়তো আমাকে ফুফি অথবা ফুফু ডাকত।

২০১৮ সালে আমাদের আলী ফ‍্যামেলির রি-ইউনিয়নের পর করোনা হামলে পড়ে মানুষ থেকে মানুষের দূরত্ব বাড়িয়ে দিল। মহামারি করোনার কারণে ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন অংশে বসবাস করা আমাদের পরিবারের সদস‍্যদেরও পারস্পরিক দেখা-সাক্ষাতের দরজা বন্ধ ছিল।
এ বছর এপ্রিল থেকে রোজা শুরু হলো। রোজা তখন শেষ দিকে। তেমনি একদিন আমার ফোনে আমিনা টেক্সট পাঠাল-
‘আন্টি, আমি নিউইয়র্কে এসেছি আজ সোমবার সকালে। বৃহস্পতিবার বিকেলে আমার ফ্লাইট, তোমার সাথে দেখা করতে চাই।’
‘কার সাথে এসেছ এবং কোথায় আছ?’
‘Rory(আমিনার স্বামী) তার অফিসের কাজে নিউইয়র্ক এসেছে। আমি তোমাকে দেখব বলে তার সাথে এসেছি এবং Shoho Hadson Velly-তে আছি।’
‘আমার বাসায় আসো, আর কখন আসবা এবং তুমি আন্টির তৈরি কোন খাবার খেতে চাও বলো?’
‘আমার কোনো খাবার লাগবে না। শুধু তোমাকে দেখতে চাই। আর তোমার কোনো অসুবিধা না থাকলে তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরতে চাই।’
‘আমার বাসায় আসো।’
‘না আন্টি, আমি জানি, তোমাদের রোজা ওই সময়, তোমার বাসায় গিয়ে তোমাদের সামনে কোনো খাবার আমি খেতে চাই না। মঙ্গলবার, বুধবার কর্মদিবস, সকলেই যার যার কাজে ব‍্যস্ত, Rory-রও সময় হবে না তোমার সাথে দেখা করার।’
‘তোমার যদি অসুবিধা না থাকে, তবে ম‍্যানহাটনে কোনো একটা জায়গায় আমরা দেখা করতে পারি।’
কী করি, কী করি? ছেলে কাজে, স্বামী ইতিকাফে মসজিদে। রোজা, তার ওপর পরিবারের সদস‍্যরা আমার একা কোথাও যাতায়াত অনিরাপদ মনে করে।
আমার রক্তপ্রবাহের যে নিরন্তর টান, আমার পরবর্তী বংশধরদের কাছে সে প্রাবল‍্য ততটুকু বেগবান নয়। আমাদের যাপিত যে জীবন, সে জীবনের বাইরেও বিশাল জীবনকে কাছে পেয়েও সে জীবনে ঢুকতে, ছুঁয়ে আসতে, কখনো ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও নানা প্রতিকূলতায় আমাদের পক্ষে সম্ভব হয় না।
৪৬ বছর বয়সী নারীকে মেয়ে বলা বোধ হয় বেমানান। কিন্তু সে আমার স্নেহের, আমার অতি আদরের জন, আমার ভাইজি। আমার দ্বিতীয় ভাই লুইস আলী (Louis Ali) ও ভাবি মাতিলদা রেইস আলীর (Matilda Reyes Ali) মেয়ে আমিনা।
আমিনা আলী গুভেটিস (Amina Ali Guvetis) নামের মেয়েটি তার নিজের ফেসবুক আইডিতে ন্যাটিভ আমেরিকান, মেক্সিকান, পুয়ের্তোরিকান ও বাঙালি পরিচয় লিখে রেখেছে।
এপ্রিলের রোদভাসা দিন কিন্তু প্রচণ্ড শীত ও দাপুটে শীতের বাতাস।
এমন দিনে ম‍্যানহাটনে এক কফিশপে তাকে দেখামাত্র বুকের ভেতরে কেমন আলোড়ন টের পেয়েছিলাম। আমরা মুখোমুখি কখনো পাশাপাশি বসে এবং বারবার পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে উষ্ণতা ও মমতা বিনিময় করেছিলাম।
পরিবারের স্বজনদের সঙ্গে গল্পের কথাগুলো, আলোচনাগুলো বেশির ভাগই অতীতের দিকে হেঁটে যায়। সে স্মৃতিচারণা হয়তো সুখের, হয়তো দুঃখের। ভবিষ্যৎ বা বর্তমান যেমনই হোক, সোনালি দিনগুলো কেবল অতীতের ক্ষেত্রেই প্রযোজ‍্য হয়।
প্রমথ চৌধুরীর কথায়-ভাষা মানুষের মুখ থেকেই কলমের মুখে আসে।
‘তোমার লেখা বই-বাংলাদেশ টু আমেরিকা-এক অসাধারণ লেখনী। আমি কয়েকবার পড়েছি, কোন অনুপ্রেরণায় তোমাকে এমন একটি বইটি লিখতে উৎসাহ দিয়েছে?’
‘আন্টি, আমাদের পরিবার অন‍্য সাধারণ পরিবারের মতো নয়। আমি গর্ব অনুভব করি আমার বাংলাদেশি দাদাকে নিয়ে, যার কারণে এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকাজুড়ে বিস্তৃত বৈচিত্র্যপূর্ণ এক অসাধারণ পরিবার আমরা পেয়েছি।’
আমিনা শান্তস্বরে খুব ধীরে ধীরে কথা বলছিল আর আমার অশুদ্ধ উচ্চারণের ইংরেজি কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল।
‘আমার বাবা (লুইস আলী) কোনো কিছু খাওয়ার আগে অথবা পাজল খেলার আগে-দুটো আগে সরিয়ে রাখেন আর বলেন-একটা আমার বোন সোনিয়া, আর একটা ভাই সারওয়ার...’
‘আন্টি, আমার বাবার ভেতর তোমার জন‍্য যে মমতা, সেটা কি তুমি অনুভব করতে পারো?’
মাত্র তিন বছর বয়সে বাবা-মায়ের ডিভোর্সের কারণে আমার ভাইয়ের বড় হওয়ার পদ্ধতি এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। ভাই লুইস আলী ও ভাবি মাতিলডা রসে রেইস আলী তাদের ছেলেমেয়েদের সেই পরিস্থিতিতে পড়তে দেননি। পরিবার নিয়ে খুব সুখী মানুষ। আমার দ্বিতীয় ভাইয়ের চার মেয়ে ও এক ছেলে। তারা সকলেই বিবাহিত ও ডিভোর্স নামক দানবের খপ্পর থেকে মুক্ত আছে।

আমিনার একমাত্র ভাই লুইস নওয়াব আলী আফগান যুদ্ধফেরত, আমেরিকান এয়ারফোর্সের ইঞ্জিনিয়ার। ভেটেরান ডে, মেমোরিয়াল ডেগুলোতে তাকে দেওয়া সম্মাননা দেখে গর্ব অনুভূত হলেও ওই সময়টাতে তার মা বাবা, বউ, ছেলেরা, বোনেরা এবং পরিবারের সদস্যরা ভীষণ উৎকণ্ঠার মধ্যে ছিলাম। তেমনি উৎকণ্ঠা ছিল বহু বছর আগে ভিয়েতনামে যুদ্ধরত আমার বড় ভাই জুনাব আলীর জন‍্যও।

সূর্য অস্ত গেলে পাখিরা নীড়ে ফেরে, শুধু কি পাখি, আমরা মানুষেরাও।
মায়া-মমতাকে হৃদয়বন্দী করে সূর্যাস্তের কালে যার যার নির্দিষ্ট পথে হাঁটতে থাকি আমি ও আমিনা।
কবি জয় গোস্বামীর কবিতার চরণ টোকা দিল মনে :
‘ভেসে যাচ্ছিল-ভেসে তো যেতই, মনে না করিয়ে দিলে;
... হৃদি ভেসে গেল-অলকানন্দা জলে।’
 
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: 01711238078