মুখরা রমণী বশীকরণ

প্রকাশ : ১৫ মে ২০২৫, ১২:০৪ , অনলাইন ভার্সন
শিরোনামে ব্যবহৃত বাক্যটি একসময় মঞ্চে পরিবেশিত একটি নাটকের নাম ছিল। যেহেতু দেখার সুযোগ হয়নি, তাই বিষয়বস্তু নিয়ে কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকলাম। তবে শিরোনামের দিকে মনোনিবেশ করলে অনুমান করা যায়, জাহাঁবাজ মহিলাদেরকে কীভাবে শায়েস্তা করা হয়, নিশ্চয় তার একটা বিবরণ দেওয়া হয়েছিল অভিনয়ের মধ্য দিয়ে। অথবা তেমনটা নয়, যেমনটা অনুমান করার চেষ্টা করছি। তবে গত দিন কয়েক ধরে দুই মহিলার ঘরোয়া বিধান নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া খুব সরব ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। যারা ফেসবুকের কল্যাণে ঘটনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সুযোগ পেয়েছেন, তাদের বাদ দিলে, যারা জানার কোনো সুযোগই পাননি, তাদের অবগতির জন্য সামান্য ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছি।

বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সম্প্রতি নিজের পিস্তল মাথায় ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। তবে ওই ঘটনা ঘটানোর আগে এক সুইসাইড নোট লিখে রেখে গেছেন তিনি, সেখানে তার ওই মৃত্যুর জন্য তার মা এবং বউ কাউকেই দায়ী না করে গেলেও ভাষা ভাষাভাবে যা লিখে গেছেন তিনি, তাতে করে পাঠকমাত্রই বুঝতে পেরেছেন যে ওই দুজনের ঝগড়ার কারণেই সংসারের একমাত্র পুরুষপ্রবরকে প্রাণ দিয়ে মূল্য চুকাতে হলো। সংসারের ভাগ-বাঁটোয়ারা বড় জটিল বিষয়। ফেসবুকে এই ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে অনেককেই কলম চালাতে দেখা গেছে। ঘটনার পেছনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন, বিধবা মায়ের আরও দুজন পুত্র ছিলেন কিন্তু তিনি ওই দুই ছেলের সংসারে যেতে চাইতেন না। তিনি তার পুলিশ অফিসার ছেলের কাছে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। তাই নিয়ে পুত্রবধূর সঙ্গে তার বিরোধের অন্ত ছিল না। কেউ কেউ বলে থাকেন, মায়ের কাছে সব সন্তানই সমান। কথাটা সব ক্ষেত্রে সত্য নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার একাধিক সন্তানের ভেতরে কোনো একজনের প্রতি দুর্বলতা দেখাতে দেখা যায়। এটা নিয়ে কেউই কোনো জুতসই ব্যাখ্যা দিতে পারবেন না। মাও তার সন্তানদের মধ্যে ওই অবৈধ পক্ষপাতদুষ্টতার কারণটি ব্যাখ্যা করতে অপারগ হবেনÑসেটা সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়। পৃথিবীটা বড় রহস্যময়। প্রত্যেক মানুষই তার নিজের স্বার্থের বিষয়টা মাথায় রেখে পথ চলে; কিন্তু জগতে মাত্রই বোধহয় একমাত্র প্রাণী, যিনি সন্তানের মঙ্গল কামনার বাইরে কখনোই অন্য কোনো খারাপ চিন্তা করতে পারেন না। তাই বলে বিশেষ কোনো সন্তানের প্রতি আলগা স্নেহ দেখান বলে অন্য সন্তানদের অবহেলা করেন, মায়ের বিরুদ্ধে তেমন অভিযোগও ঢালাওভাবে করা যাবে না, যদিও বিষয়টা বেশ কিছুটা স্পর্শকাতর বলে কেউ কেউ বলেও থাকেন। ওই মায়ের বিরুদ্ধে পুত্রবধূর একটা অভিযোগ ছিল, মহিলার আরও দুজন ছেলের সংসার থাকার পরও কেন শুধু তার সংসারে ঝামেলা পাকাবেন তিনি। কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে পুত্রবধূটি তার শাশুড়ির গায়ে যখন হাত তুললেন, মায়ের সেই অপমানটা আর ছেলে হয়ে মেনে নিতে পারেননি বলেই শেষ পর্যন্ত নিজেকে শেষ করে দিতে পিস্তলের নলটা ঠেকালেন মাথায়। আর নির্মম মৃত্যুর বলিতে পরিণত হলো পুরোটা পরিবার!
আমার পরিচিত এক পরিবারের ইতিহাস ওই ঘটনার প্রায় কাছাকাছি ছিল। পুত্রের সংসারে মায়ের নিত্যদিনের অপমান। একদিন বাথরুমে ঢুকে বয়োবৃদ্ধ জননী দেখলেন বাথরুমের কল বন্ধ। ওজুটা করতে চেয়েছিলেন অথচ কলে পানি আসছে না। বাথরুম থেকে বের হয়ে সেই কথাটিই বলতে চেয়েছিলেন, মুখের কথা মাটিতে পড়ার আগেই পুত্রবধূ কথাটা লুফে নিয়ে বললেন, ওজু করতে হলে বাথটবে গিয়ে করুন। আপনি বাথরুম ইউজ করা চেনেন না। ওজু করতে গিয়ে সারা ফ্লোর ভিজিয়ে রাখেন। ভাগ্যিস, ওই দিন পুত্র ঘরে ছিলেন। তার কাছেও মায়ের বিশেষ কোনো মর্যাদা ছিল না; তার পরও যেন বউয়ের কথাটা শেল হয়ে বুকে বিঁধল। সামান্য বিষয় নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড! আর ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ৩০ বছরের সংসারে ভাঙনের সূত্রপাত। এখন একজন আরেকজনের মুখ দেখতে নারাজ। এমনকি এক ছাদের নিচে বাস করতেও রাজি নন দুজন। মাঝখানে কয়েকটা শিশুমুখ যন্ত্রণায় কাতরায়।

পরিচিত এক পরিবারের কাহিনি। সম্ভ্রান্ত এক পরিবারের সন্তান। ব্যারিস্টারি পাস করে লন্ডনেই সপরিবারে বাস করতেন। নিজের টিনএজার সন্তানদের নিয়ে ভালোই ছিলেন। কিন্তু বয়োবৃদ্ধ পিতা দেশের বাড়িতে বাস করতেন, একসময় সেই পিতার টানে দেশে ফেরত এলেন তিনি। ঢাকার অভিজাত পাড়ায় বাসাও নিয়েছেন। বড় ছেলেটা ক্লাস সেভেনে পড়ে। তাকে নিয়েই পিতাকে শেষ দেখার উদ্দেশ্যে গ্রামের বাড়িতে এসেছেন। বৃদ্ধ পিতাকে দেখাশোনা করার জন্য আপনজন বলতে কেউই নেই। বেশি পয়সা খরচ করে কাজের মানুষ রেখেছিলেন কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হলো না তারা বয়োবৃদ্ধ মানুষটাকে খুব একটা ভালো রাখার চেষ্টা করে। ময়লা ঘরদুয়ার, ততোধিক ময়লা তার গায়ের জামা কাপড়। সব দেখে মনে মনে একটু ঘেন্না হলেও চুপ করেই থাকলেন। এসব বিষয়ে তার আর কী করার আছে। তিনি তো আর নিজের দায়িত্বে পিতার ভরণপোষণ করতে পারবেন না নিজের কাছে রেখে। কিন্তু ১১ বছর বয়সী তার পুত্রটি রীতিমতো বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসল আইনজ্ঞ পিতার সাথে। বেশ জোর গলায় জানতে চাইল ছেলেটা তার পিতার কাছে, আমরা কি দাদাকে আমাদের সাথে রাখতে পারি না? পিতা নিরুপায় ভঙ্গিতে বললেন, তা হয় না, এখানেই থাকতে হবে। বাসায় কীভাবে রাখব তুমিই বলো...! ছেলেটার মুখে কোনো জবাব জোগাল না, শুধু দাঁতে দাঁত চেপে ধরে উচ্চারণ করল-ডেড, তোমার বয়স দাদার মতো হলে দেখে নিয়ো আমিও তোমাকে বাসায় রাখব না। সেই ছেলেটা তার কথা রেখেছিল। সম্প্রতি আইনজীবী মানুষটি তার পরিণত বয়সেই মারা গেলেন। তবে শেষ কয়েক বছর ঢাকার একটা বৃদ্ধাশ্রমে তিনি কাটিয়ে গিয়েছেন বলে শুনেছি।

আসলে জীবনে কোনো কিছুই বৃথা যায় না। মানুষ যৌবনে যা করে, জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে প্রকৃতি তাকে হাজার গুণ বেশি ফিরিয়ে দেয়। সব বিষয় নিয়ে বছরখানেক আগে আরও একটা লেখায় বলেছিলাম, সংসারের অপাঙ্্ক্তেয় হয়ে পড়া ওই অসহায় মা-বাবাকে নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে কিছু করা দরকার। বিশেষ করে, যারা সমাজসেবার সঙ্গে জড়িত আছেন তাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। আকাশে যেমন চাঁদ আর সূর্য একসাথে ওঠে না, একসাথে উঠলেই মহাপ্রলয়ের ঘটনা ঘটে যাওয়ার কথা, সেই রকম এক সংসারে শাশুড়ি আর পুত্রবধূর সম্মানজনক সহাবস্থান কোনো সময়েই সম্ভব হয়ে ওঠে না। সেটা বাস্তব সত্য ঘটনা। চিরন্তন বিষয় হচ্ছে একজন গৃহবধূ অনেক কষ্টে সংসারধর্ম পালন করে যখন আপন সন্তানকে বড় করে তুলে তাকে সংসারী করার উদ্দেশ্য নিয়ে বিয়ে দিয়ে ঘরে পুত্রবধূ আনেন, তখনই ঝামেলাটা ডালপালা মেলা শুরু করে। সব ক্ষেত্রে সবটা দায় কেবল পুত্রবধূরÑএমন ঢালাও অপবাদ দেওয়াটা কখনোই যুক্তিসংগত নয়। অনেক দাজ্জাল শাশুড়ি আছেন, যাদের দোষও কম থাকে না। ওই যেমন আত্মঘাতী ওই পুলিশ অফিসারের মায়ের বিরুদ্ধে অনেকেই সাক্ষ্য দিতে চেয়েছেন, ছেলে এবং ছেলে বউয়ের নিজস্ব জগৎ বলে কিছু ছিল না। কোথাও তারা বেড়াতে গেলে সেই সময়ে মাকেও তাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে হতো। এটা যে কতটা অপরাধযোগ্য বিষয়, যদি ঘটনা সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে সেই মায়ের ভূমিকাটা অবশ্যই নিন্দনীয়। কিন্তু ওই বিষয়ে কথিত মায়ের যেমন আমরা নিন্দা জানাতে পারি, সেই রকমভাবে পুত্রবধূর বিরুদ্ধেও অভিযোগ তুলতে পারি হাজারটা। কিন্তু তাতে সমাধানের কোনো পথ বের হয়ে আসবে না। আমাদেরকে সুনির্দিষ্ট একটা লক্ষ্য নিয়ে সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে বের করতেই হবে। আর সেটা হলে দেশে এবং বিদেশে যেখানেই আমাদের বসবাস থাকুক না কেন আমাদেরকে মুষ্টিভিক্ষা করে হলেও ওইসব বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধাদের জন্য বাসযোগ্য বৃদ্ধাশ্রম গড়ে তোলার লক্ষ্যে ফান্ড রাইজের ব্যবস্থা করতে হবে। অন্তত ওইসব মা-বাবাদের শেষ জীবনটা যেন একটু হলেও সম্মানজনক হয়। এর আর কোনো বিকল্প নেই। বিষয়টা বোঝার জন্য এবং গুরুত্ব দেওয়ার জন্য সবার কাছে বিনীতভাবে আবেদন জানাচ্ছি।

আরেকটা বিষয় নিয়ে লিখে লেখাটা শেষ করব। বর্তমানে এই যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাঙালি সমাজের মানুষদের কাছে তাদের বয়স্ক মা-বাবা অনেকটাই দামি সম্পদে পরিণত হয়ে উঠেছেন। এর পেছনের কারণ হচ্ছে সরকার প্রবর্তিত হোম কেয়ার বেনিফিট। দুজন জীবিত থাকলে এখানকার দম্পতিদের সুযোগ-সুবিধা বেশি থাকে, আর যদি একজন থাকেন, তাতেও লাভ। সংসারের বয়স্ক ওইসব সদস্যদের দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা আয়ের একটা সুযোগ তৈরি হয়। অধিকন্তু যিনি বয়স্কদের টেক কেয়ারের কথা, দেখা যায়, সেই তিনিই আবার শাশুড়ির জিম্মায় সন্তানদের রেখে বাইরে কাজ করতে যান। শুধু তা-ই নয়, সেই বয়স্ক মানুষটির ওপর একটা অলিখিত নির্দেশও থাকে, যেন ছেলে এবং তার বউ কাজ থেকে ফেরত আসার পরে রান্না করা খাবার টেবিলের ওপর রাখা থাকে। বিষয়টা অনৈতিক সন্দেহ নেই। হোম কেয়ারের সুযোগ নিয়ে এমন অনেকে অন্যায় কাজ করে যাচ্ছেন। আমাদের প্রবাসী বাঙালিদের এই অনৈতিক কাজ বন্ধে হোম কেয়ার কর্তৃপক্ষকে আরও সজাগ দৃষ্টি রাখা জরুরি, যদিও ইতিমধ্যে এসব বিষয়ে নানা ধরনের তদন্তের কথা উচ্চারিত হতে শোনা যাচ্ছে। -নিউইয়র্ক
 
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: 01711238078