
দিনভর ঝোড়ো হাওয়া বইছে। সাথে বৃষ্টির বেগ বাড়ে আর কমে। বৃষ্টি কমেছে কি না দেখতে ক্ষণিক পরপর জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়াই। অস্থিরতা বাড়লে মানুষ যেমন পায়চারি করে, তেমন। বৃষ্টি নিয়ে আমার কোনো আদিখ্যেতা নেই। আনন্দ নেই। খিচুড়ি-ইলিশ খাওয়ার আহ্লাদ নেই। আছে কেবল হৃদয়হীন বিরক্তি। আরেকটা দিন নষ্ট হয়ে গেল বলে। কয়দিনের জন্যই-বা দেশে এলাম। সময়গুলো যদি এমন আবহাওয়ার কারণে ভেস্তে যায়, তবে তো বিরক্তি লাগারই কথা।
বিকেলের দিকে বৃষ্টি থেমেছে। আপা বলল, চল অনুদের বাসায় যাই। অনু আমার ছোটবেলার খেলার সাথি। অনুর বড় বোন রুনু আমার আপার খেলার সাথি। আপার এমন আহ্বানে আকস্মাৎ অনুর মুখখানা ভেসে উঠল চোখের সামনে। কতকাল দেখা নেই, কথা নেই, স্পর্শ নেই। আমি একলাফে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াই। জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে হাত বাড়িয়ে আবহাওয়া বোঝার চেষ্টা করি। বৃষ্টি নেই। আকাশ ঘন মেঘে ঢাকা। থমথমে। অন্ধকারাচ্ছন্ন। যাক অন্তত বৃষ্টি তো নেই। ঝটপট তৈরি হয়ে নিই। অতটুকু পথ, হেঁটেই যাওয়া যেত। তবু বাসার গেটের সামনেই রিকশায় চেপে বেড়িয়ে পড়ি দুই বোন।
আপা রিকশাওয়ালাকে আদেশের স্বরে বলল, ‘মামা, হুড তুলে দেন।’ আমি আপাকে থামাই। বৃষ্টি নেই। খোলা আকাশ, শহরের মানুষ, দোকানপাট দেখতে দেখতে, প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে নিতে যাব। এটা আমার জন্মশহর। বেড়ে ওঠা শহর।
আপা শীতল স্বরে বলল, ‘দ্যাখ রুমকি, এটা মফস্বল শহর। সবাই আমাদের চেনে। আব্বাকে চেনে। মান্য করেছে আজীবন। এইভাবে চললে মানুষজন তাকায়ে থাকবে।’ কেউ তাকিয়ে থাকলে কী এসে যায়? তবু আপার আপত্তির কাছে হার মানলাম। সুবোধ বালিকার মতো চুপ করে রইলাম।
পিচঢালা ভেজা পথ। কোথাও-বা ছোটখাটো গর্তে বৃষ্টির পানি জমে আছে। এক তরুণ সেই জমে থাকা পানি এড়াতে লাফ দিয়ে হেঁটে গেল। রমিজের হোটেলের সামনে এক নেড়িকুকুর লেজ নাড়ছে। তার জিভ লকলক করছে। লালা ঝরছে। একজন ছিন্নমূল শিশু দাঁড়িয়ে আছে মলিন মুখে উচ্ছিষ্ট খাবারের আশায়। দুটি কাক কা কা করে ডেকে উঠল সমস্বরে টিনের চালের ওপর থেকে। আকাশে পাখপাখালি উড়ছে। খাবারের সুবাস নাকে এসে লাগছে। কত দিন এই হোটেলের পেঁয়াজু, আলুর চপ, শিঙাড়া, ডালপুরি বিকেলের নাশতায় পরিতৃপ্তির সঙ্গে খেয়েছি। বিকেলের নাশতা না পাওয়া অবধি পড়তে বসিনি কোনো সন্ধ্যায়। আপা নীরবতা ভেঙে বলল, বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। অনুর শরীরটা বেশি ভালো না, বুঝলি?
‘কেন, কী হয়েছে?’ খাবারের ভাবনা ঝেড়ে ফেলে আপার দিকে তাকালাম। অবচেতনে এমনভাবে প্রশ্নটি করলাম, যেন অনুর আজীবন একই রকম সুস্থ থাকার কথা। আপা শুকনো গলায় বলল, ‘অনুর ডায়াবেটিস অনেক হাই।’
‘ওহ্’, আমি ভাবলেশহীনভাবে বললাম।
ডায়াবেটিস আজকাল কোনো রোগ হলো নাকি? রুটিন মেনে চললে বরং রোগহীনদের তুলনায় ভালো থাকা যায়। রিকশার টুংটাং আওয়াজের মাঝে আমরা গাছগাছালি-ঘেরা একটি নির্মাণাধীন একতলা বাড়ির গেটে এসে থামলাম। ভাড়া চুকিয়ে চারপাশটা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম। পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পরিত্যক্ত রেললাইনটা এখনো অস্পষ্ট বুক পেতে শুয়ে আছে। বড় বড় ঘাস গজিয়েছে। ভালো করে লক্ষ না করলে বোঝার উপায় নেই, আড়ালে শুয়ে থাকা রেললাইনের অস্তিত্ব। এখানে লাফিয়ে লাফিয়ে এক্কা-দোক্কা খেলতাম একসময়। পাশেই কচুরিপানায় ভরা ডোবা ছিল। ডোবা, ঝোপঝাড় সাফ করে কবে এখানে এতগুলো বাড়ি নির্মাণ করা হলো, জানি না। আলাদা একটি মহল্লার মতো গড়ে উঠেছে।
আপা কলিং বেল টিপে দাঁড়িয়ে আছে। জিরাফের মতো ঘাড় টান টান করে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে তাকাচ্ছে কারও আগমনের প্রতীক্ষায়। সতেরো/আঠারো বছরের এক কিশোরী গেট খুলে দিল। সালাম দিল। আপা যেন খুব আপনজনের বাড়ি এসেছে, এমন স্বরে বলল, ‘তোমার আম্মু বাসায় আছেন?’ চিরদুঃখী কিষাণীর মতো গম্ভীর অবয়বের মেয়েটি ‘হ্যাঁ’-সূচক মাথা নাড়ল। কিন্তু কোনো কথা বলল না। তাকে অনুসরণ করে এগিয়ে যাচ্ছি আমি আর আপা। গেটের ভেতরে ফুলের বাগান। ঝোপঝাড়। বলা চলে, ছোট একটি বন পেরিয়ে বাড়ির দরজায় পৌঁছাই। ভেতর থেকে ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে আসে অনু। আমাদের দেখে মলিন মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এ উজ্জ্বলতা স্বতঃস্ফূর্ত নয়। অনিচ্ছাকৃত। যেন জোর করে মুখে হাসি আনার চেষ্টা করছে।
‘কিরে কেমন আছিস? কবে এসেছিস দেশে?’ খুব ধীরে দুটো প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে জড়িয়ে ধরল অনু।
‘তিন সপ্তাহ হয় এসেছি। চাঁদপুর এসেছি দুই দিন হলো।’
‘তোর তো কোনো পরিবর্তন হয়নি রে। সেই আগের মতোই আছিস।’ বলতে বলতে অনু আমার হাত ধরে নিয়ে ড্রইংরুমে সোফায় বসায়। নিজেও বসে। কুঁজো হয়ে বসার ভঙ্গিটা দেখে মনে হলো যেন বয়সের তুলনায় অনেকটাই বুড়িয়ে গিয়েছে সে। কানের পাশ দিয়ে উঁকি দিচ্ছে একগোছা শুভ্র চুল।
জিজ্ঞেস করি, ‘এটা তোর মেয়ে?’
‘হ্যাঁ, এবার এইচএসসি দিয়েছে। বড়টা ছেলে। ভার্সিটিতে পড়ে।’
আমি খানিকটা বিস্মিত হই, অনুর এত বড় বড় ছেলেমেয়ে আছে বলে নয়, সময় নামক পাগলা ঘোড়া কত দ্রুত বেগে ছুটছে, সেটি ভেবে। আমার পুত্রদ্বয় এখনো ছোট। স্কুলে পড়ছে। অনুর সন্তান হয়েছে অপ্রাপ্ত বয়সে। নাইনে পড়ার সময়। ক্লাস এইটে থাকাকালীন মন দেওয়া-নেওয়ায় জড়িয়ে পড়েছিল পাশের বাসার হিমেলের সঙ্গে। মুখোমুখি জানালায় দাঁড়িয়ে চোখাচোখি হতে হতে তাদের প্রেমের সূচনা। হিমেল তখন ইন্টারে পড়ে। এক সকালে শোনা গেল অনুকে পাওয়া যাচ্ছে না। হিমেলকেও না। রাতেই নিরুদ্দেশের পথে পা বাড়িয়েছিল দুজন সকলের অগোচরে। চাপা স্বভাবের অনু। ভেতরে এতটা ভাঙচুর প্রেম ছিল তাদের, কেউ ঘুণাক্ষরেও বোঝেনি। বড় দুটো বোনের তখনো বিয়ে থা হয়নি। প্রেমের টানে পরিবারের সকলের মুখে চুনকালি মেখে পালিয়েছিল। চারদিকে ছি ছি পড়ল। কিছুদিন পাড়াশুদ্ধ মানুষের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল হিমেল-অনু। এই ঘটনার পর অনুদের বাসায় যাওয়ার বিষয়ে আব্বা কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। সেই নিষেধাজ্ঞার পর আর দেখা হয়নি আমাদের। অনুর শ্বশুরবাড়ি চলে যাওয়া, আমার বিদেশে পাড়ি জমানোÑ এই সকল দীর্ঘ বিরতির কারণ। একবার অবশ্য হয়েছিল দেখা দূর থেকে, এক পলক। বিশাল এক পেটসহ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়েছিল অনু। সে-ও প্রায় একুশ বছর আগের কথা। ‘তোরা বস, আমি একটু চা করে আনি’ বলেই অনু উঠল খুব ধীরে। তার এই হেঁটে যাওয়া, হেলেদুলে এগিয়ে চলা পুরোনো বিকল-প্রায় রেলগাড়ির মতো মনে হলো। আমি রুমের চারপাশটায় চোখ বোলালাম। ছিমছাম গোছানো। কোনো আভিজাত্য নেই।
ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজিয়ে অনু ডাকতে এল আমাদের। আমি বিনা বাক্যব্যয়ে গিয়ে বসলাম। টেবিলে সাজানো শিঙাড়া, ডালপুরি, আলুর চপ, চা। নিকটস্থ রেস্তোরাঁ থেকে আনিয়েছে। শিঙাড়ায় কামড় বসিয়ে চিবোতে চিবোতে বললাম, ‘তোর শরীর কেমন? তোকে খুব দুর্বল লাগছে দেখতে।’ অনু দীর্ঘশ্বাস ফেলল, টের পেলাম। একা একা বাক্যালাপ করছে মনে হলো। কিন্তু তার ঠোঁট নড়ছে না। চায়ের কাপ এগিয়ে দিতে দিতে হতাশার স্বরে বলল, ‘আর শরীর।’ কেন রে? খুব কি বয়স হয়ে গিয়েছে আমাদের? এখনো তো চল্লিশ পেরোয়নি। অনু কিছু বলল না। চুপ করে রইল। নিঃশব্দে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছি। বৃষ্টিস্নাত এই সন্ধ্যায় এক কাপ গরম চায়ের জন্য তৃষ্ণার্ত ছিলাম। চা-টা বেশ লাগল। ঝালের পর চা, মুখের ভেতরে অন্য রকম স্বাদের অনুভূতি সৃষ্টি করল।
‘হিমেল ভাই কোথায়?’ অনু ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে হাঁপানি রোগীর মতো, যেন বাঁশঝাড়ের ওপর দিয়ে প্রবল বাতাস বইছে। শুকনো গলায় টেনে টেনে বলল, ‘ব্যস্ত আছে হয়তো। কখন ফিরবে ঠিক নাই।’ আপা, আমি আর অনু, আমরা তিনজন চুপ করে রইলাম কয়েক মুহূর্ত। অনুকে দিঘির শান্ত জলের মতো স্থির মনে হলো। সেই উচ্ছ্বাস নেই। হাসি নেই। অনর্গল কথা-বলা নেই। যদিও বরাবরই নির্বোধ ছিল সে। চলনে-বলনে বুদ্ধিমত্তার স্ফুরণ ছিল না কোনোকালে।
আপা তাগিদ দিচ্ছে, ‘চল উঠি।’ রাত বাড়ছে। বিদায় নিলাম। অনু গেট অবধি এগিয়ে এল। ‘এখানে রিকশা পাওয়া যাবে না। চল হাঁটি।’ আপা বলল। নিয়নের আলোয় আমরা হাঁটছি চুপচাপ। কেউ কোনো কথা বলছি না। মাথার ওপর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। আনমনে পেছনে তাকালাম। অনু দাঁড়িয়ে আছে আধো অন্ধকারে। আপা তাগাদা দিল, ‘তাড়াতাড়ি হাঁট।’ যেকোনো বিদায়ে পিছু ফিরে চাইতে নেই। তবু বাঁয়ে বাঁক নেওয়ার আগে শেষ আরেকবার পেছনে তাকালাম। অনু তখনো দাঁড়িয়ে। হাত নেড়ে বিদায় দিচ্ছে।
আপা পানি জমে থাকা গর্ত এড়াতে লাফ দিয়ে এক পাশে সরে এল। আমরা মাথায় কাপড় দিলাম বৃষ্টির ছাট থেকে মাথা বাঁচাতে। রহমান চাচার বাসার সামনে দিয়ে যেতে যেতে আপা বলল, ‘অনুর ডায়াবেটিস কেন এত হাই, জানোস?’
কেন?
ও অভিমান করে সুগার নিয়ন্ত্রণ করে না। ওষুধ খায় না। ইনসুলিন নেয় না।
কার সঙ্গে অভিমান? আমি বিস্ময়ে তাকাই আপার দিকে উত্তরের অপেক্ষায়।
‘ওর জামাইয়ের সাথে।’
হিমেল ভাইয়ের সাথে? আমি নিশ্চিত হতে আবারও জিজ্ঞেস করি।
‘হ্যাঁ, হিমেল অন্য এক নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে অনেক দিন হয়। তিন সন্তানের মা এক প্রবাসীর স্ত্রী। হিমেল সেখানে রাত কাটায়। বাসায় ফিরে না প্রায়ই।’
‘তোকে কে বলেছে এই সব, আপা?’ আমি চমকে উঠে জানতে চাইলাম।
আপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘অনুর বড় বোন রুনু।’
ঝিরিঝিরি কুয়াশার মতো বৃষ্টির মাঝে আমরা হাঁটছি। হাজি মহসিন রোড ধরে। হার্ডওয়্যারের দোকান, রড-সিমেন্টের দোকান, বলাই স্বর্ণকারের দোকান, ল্যাম্পপোস্ট পেছনে ফেলে। কোনো কথা বলছি না কেউ। যেন অচেনা দুই পথিক হেঁটে চলেছি অচিন পথে। দু-একটি যাত্রীহীন রিকশা হর্ন বাজাতে বাজাতে পাশ কেটে গেল। তাদেরও বোধ হয় বাড়ি ফেরার তাড়া।
দুই দিন চাঁদপুর কাটিয়ে ঢাকায় ফিরলাম। পরের সপ্তাহে নিউইয়র্ক। যেখানে আমার জন্য অপেক্ষা করছে আমার স্বামী ও সন্তানেরা। বিদেশ-বিভুঁইয়ে রুদ্ধশ্বাস ব্যস্ততায় ডুবে গেলাম যথারীতি। ঘর-সংসার, সন্তানদের স্কুল, চাকরি, কত কাজ। দেশ-সংক্রান্ত ভাবনা ভুলে গেলাম। শরৎ, হেমন্ত গেল। পাতাঝরার দিন শেষে শীত এল।
আটলান্টা থেকে বন্ধু এল সপরিবারে, বেড়াতে। নিউ-ইয়ার উদযাপন করতে। আমরা টাইমস স্কয়ারে গেলাম দলবেঁধে। উৎসবের আমেজে ভেসে যাচ্ছে আলো ঝলমলে টাইমস স্কয়ার। লোকে লোকারণ্য। কেউ প্যাঁ পোঁ বাঁশি বাজাচ্ছে। কেউবা রংবেরঙের পোশাক, মুখোশ পরেছে। বাধাবন্ধনহীনভাবে বিচরণ করছে। এক স্থানে মানুষের জটলা। এগিয়ে গিয়ে দেখি বিশাল এক সাপ গায়ে জড়িয়ে প্যাঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক শ্বেতাঙ্গ তরুণ। সাপের খেলা দেখাচ্ছে। বিশ ডলারের বিনিময়ে সাপটি দর্শনার্থীর গলায় ঝুলিয়ে দিচ্ছে ক্ষণিকের জন্য। এসব দেখতে ঘিরে অগণন কৌতূহলী তরুণ-তরুণী। চারদিকে মানুষের কোলাহল। যেন শীতের তীব্রতাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে সারা পৃথিবীর মানুষ জড়ো হয়েছে নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে থার্টি ফার্স্ট উদযাপন করতে। আচমকা ফোনের ভাইব্রেশন টের পাই জ্যাকেটের পকেটে। ফোন বের করে আনি। স্ক্রিনে ভেসে ওঠে, ‘আপা বিডি’। বাংলাদেশ থেকে আপা কল করেছে। হ্যালো বলতেই ওই পাশ থেকে আপার কণ্ঠস্বর শোনা গেল। কোনো কুশলাদি না জিজ্ঞেস করেই আপা সাংঘাতিক বিচলিত স্বরে বলল, ‘একটা দুঃসংবাদ দিতে ফোন করেছি রে। অনু মারা গেছে।‘ আমি ভাবলেশহীনভাবে কিংবা অস্ফুটে কিছু বলেছি হয়তো। নাকি কিছুই বলিনি, কে জানে! হয়তো-বা অবলীলায় সহজ সত্য মেনে নিয়েছি। ওই প্রান্তে খুট করে ফোন রাখার আওয়াজ পেলাম। প্রবল ঠান্ডায় মানুষের মুখ দিয়ে নিঃশ্বাসের সঙ্গে ধোঁয়া বের হচ্ছে। মানুষ সমবেত স্বরে চিৎকার করছে, ফাইভ, ফোর, থ্রি, টু, ওয়ান, জিরো... লক্ষ লক্ষ চোখ একযোগে তাকিয়ে আছে উপরের দিকে। বল নেমে আসছে নিচের দিকে। আমি তাকিয়ে আছি সেই দিকে। কে যেন দুটি নীল-সাদা রঙের বেলুন আকাশে উড়িয়ে দিয়েছে। দুই বেণি বাঁধা চুলে, নীল-সাদা স্কুল ইউনিফর্মে অনু ধীরে ধীরে উপরে উঠছে। মলিন মুখ। পরাজিত মুখ। ঝাপসা হয়ে আসছে মুখটি। উঠছে আরও উপরে। আকাশে। -নিউইয়র্ক
বিকেলের দিকে বৃষ্টি থেমেছে। আপা বলল, চল অনুদের বাসায় যাই। অনু আমার ছোটবেলার খেলার সাথি। অনুর বড় বোন রুনু আমার আপার খেলার সাথি। আপার এমন আহ্বানে আকস্মাৎ অনুর মুখখানা ভেসে উঠল চোখের সামনে। কতকাল দেখা নেই, কথা নেই, স্পর্শ নেই। আমি একলাফে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াই। জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে হাত বাড়িয়ে আবহাওয়া বোঝার চেষ্টা করি। বৃষ্টি নেই। আকাশ ঘন মেঘে ঢাকা। থমথমে। অন্ধকারাচ্ছন্ন। যাক অন্তত বৃষ্টি তো নেই। ঝটপট তৈরি হয়ে নিই। অতটুকু পথ, হেঁটেই যাওয়া যেত। তবু বাসার গেটের সামনেই রিকশায় চেপে বেড়িয়ে পড়ি দুই বোন।
আপা রিকশাওয়ালাকে আদেশের স্বরে বলল, ‘মামা, হুড তুলে দেন।’ আমি আপাকে থামাই। বৃষ্টি নেই। খোলা আকাশ, শহরের মানুষ, দোকানপাট দেখতে দেখতে, প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে নিতে যাব। এটা আমার জন্মশহর। বেড়ে ওঠা শহর।
আপা শীতল স্বরে বলল, ‘দ্যাখ রুমকি, এটা মফস্বল শহর। সবাই আমাদের চেনে। আব্বাকে চেনে। মান্য করেছে আজীবন। এইভাবে চললে মানুষজন তাকায়ে থাকবে।’ কেউ তাকিয়ে থাকলে কী এসে যায়? তবু আপার আপত্তির কাছে হার মানলাম। সুবোধ বালিকার মতো চুপ করে রইলাম।
পিচঢালা ভেজা পথ। কোথাও-বা ছোটখাটো গর্তে বৃষ্টির পানি জমে আছে। এক তরুণ সেই জমে থাকা পানি এড়াতে লাফ দিয়ে হেঁটে গেল। রমিজের হোটেলের সামনে এক নেড়িকুকুর লেজ নাড়ছে। তার জিভ লকলক করছে। লালা ঝরছে। একজন ছিন্নমূল শিশু দাঁড়িয়ে আছে মলিন মুখে উচ্ছিষ্ট খাবারের আশায়। দুটি কাক কা কা করে ডেকে উঠল সমস্বরে টিনের চালের ওপর থেকে। আকাশে পাখপাখালি উড়ছে। খাবারের সুবাস নাকে এসে লাগছে। কত দিন এই হোটেলের পেঁয়াজু, আলুর চপ, শিঙাড়া, ডালপুরি বিকেলের নাশতায় পরিতৃপ্তির সঙ্গে খেয়েছি। বিকেলের নাশতা না পাওয়া অবধি পড়তে বসিনি কোনো সন্ধ্যায়। আপা নীরবতা ভেঙে বলল, বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। অনুর শরীরটা বেশি ভালো না, বুঝলি?
‘কেন, কী হয়েছে?’ খাবারের ভাবনা ঝেড়ে ফেলে আপার দিকে তাকালাম। অবচেতনে এমনভাবে প্রশ্নটি করলাম, যেন অনুর আজীবন একই রকম সুস্থ থাকার কথা। আপা শুকনো গলায় বলল, ‘অনুর ডায়াবেটিস অনেক হাই।’
‘ওহ্’, আমি ভাবলেশহীনভাবে বললাম।
ডায়াবেটিস আজকাল কোনো রোগ হলো নাকি? রুটিন মেনে চললে বরং রোগহীনদের তুলনায় ভালো থাকা যায়। রিকশার টুংটাং আওয়াজের মাঝে আমরা গাছগাছালি-ঘেরা একটি নির্মাণাধীন একতলা বাড়ির গেটে এসে থামলাম। ভাড়া চুকিয়ে চারপাশটা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম। পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পরিত্যক্ত রেললাইনটা এখনো অস্পষ্ট বুক পেতে শুয়ে আছে। বড় বড় ঘাস গজিয়েছে। ভালো করে লক্ষ না করলে বোঝার উপায় নেই, আড়ালে শুয়ে থাকা রেললাইনের অস্তিত্ব। এখানে লাফিয়ে লাফিয়ে এক্কা-দোক্কা খেলতাম একসময়। পাশেই কচুরিপানায় ভরা ডোবা ছিল। ডোবা, ঝোপঝাড় সাফ করে কবে এখানে এতগুলো বাড়ি নির্মাণ করা হলো, জানি না। আলাদা একটি মহল্লার মতো গড়ে উঠেছে।
আপা কলিং বেল টিপে দাঁড়িয়ে আছে। জিরাফের মতো ঘাড় টান টান করে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে তাকাচ্ছে কারও আগমনের প্রতীক্ষায়। সতেরো/আঠারো বছরের এক কিশোরী গেট খুলে দিল। সালাম দিল। আপা যেন খুব আপনজনের বাড়ি এসেছে, এমন স্বরে বলল, ‘তোমার আম্মু বাসায় আছেন?’ চিরদুঃখী কিষাণীর মতো গম্ভীর অবয়বের মেয়েটি ‘হ্যাঁ’-সূচক মাথা নাড়ল। কিন্তু কোনো কথা বলল না। তাকে অনুসরণ করে এগিয়ে যাচ্ছি আমি আর আপা। গেটের ভেতরে ফুলের বাগান। ঝোপঝাড়। বলা চলে, ছোট একটি বন পেরিয়ে বাড়ির দরজায় পৌঁছাই। ভেতর থেকে ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে আসে অনু। আমাদের দেখে মলিন মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এ উজ্জ্বলতা স্বতঃস্ফূর্ত নয়। অনিচ্ছাকৃত। যেন জোর করে মুখে হাসি আনার চেষ্টা করছে।
‘কিরে কেমন আছিস? কবে এসেছিস দেশে?’ খুব ধীরে দুটো প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে জড়িয়ে ধরল অনু।
‘তিন সপ্তাহ হয় এসেছি। চাঁদপুর এসেছি দুই দিন হলো।’
‘তোর তো কোনো পরিবর্তন হয়নি রে। সেই আগের মতোই আছিস।’ বলতে বলতে অনু আমার হাত ধরে নিয়ে ড্রইংরুমে সোফায় বসায়। নিজেও বসে। কুঁজো হয়ে বসার ভঙ্গিটা দেখে মনে হলো যেন বয়সের তুলনায় অনেকটাই বুড়িয়ে গিয়েছে সে। কানের পাশ দিয়ে উঁকি দিচ্ছে একগোছা শুভ্র চুল।
জিজ্ঞেস করি, ‘এটা তোর মেয়ে?’
‘হ্যাঁ, এবার এইচএসসি দিয়েছে। বড়টা ছেলে। ভার্সিটিতে পড়ে।’
আমি খানিকটা বিস্মিত হই, অনুর এত বড় বড় ছেলেমেয়ে আছে বলে নয়, সময় নামক পাগলা ঘোড়া কত দ্রুত বেগে ছুটছে, সেটি ভেবে। আমার পুত্রদ্বয় এখনো ছোট। স্কুলে পড়ছে। অনুর সন্তান হয়েছে অপ্রাপ্ত বয়সে। নাইনে পড়ার সময়। ক্লাস এইটে থাকাকালীন মন দেওয়া-নেওয়ায় জড়িয়ে পড়েছিল পাশের বাসার হিমেলের সঙ্গে। মুখোমুখি জানালায় দাঁড়িয়ে চোখাচোখি হতে হতে তাদের প্রেমের সূচনা। হিমেল তখন ইন্টারে পড়ে। এক সকালে শোনা গেল অনুকে পাওয়া যাচ্ছে না। হিমেলকেও না। রাতেই নিরুদ্দেশের পথে পা বাড়িয়েছিল দুজন সকলের অগোচরে। চাপা স্বভাবের অনু। ভেতরে এতটা ভাঙচুর প্রেম ছিল তাদের, কেউ ঘুণাক্ষরেও বোঝেনি। বড় দুটো বোনের তখনো বিয়ে থা হয়নি। প্রেমের টানে পরিবারের সকলের মুখে চুনকালি মেখে পালিয়েছিল। চারদিকে ছি ছি পড়ল। কিছুদিন পাড়াশুদ্ধ মানুষের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল হিমেল-অনু। এই ঘটনার পর অনুদের বাসায় যাওয়ার বিষয়ে আব্বা কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। সেই নিষেধাজ্ঞার পর আর দেখা হয়নি আমাদের। অনুর শ্বশুরবাড়ি চলে যাওয়া, আমার বিদেশে পাড়ি জমানোÑ এই সকল দীর্ঘ বিরতির কারণ। একবার অবশ্য হয়েছিল দেখা দূর থেকে, এক পলক। বিশাল এক পেটসহ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়েছিল অনু। সে-ও প্রায় একুশ বছর আগের কথা। ‘তোরা বস, আমি একটু চা করে আনি’ বলেই অনু উঠল খুব ধীরে। তার এই হেঁটে যাওয়া, হেলেদুলে এগিয়ে চলা পুরোনো বিকল-প্রায় রেলগাড়ির মতো মনে হলো। আমি রুমের চারপাশটায় চোখ বোলালাম। ছিমছাম গোছানো। কোনো আভিজাত্য নেই।
ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজিয়ে অনু ডাকতে এল আমাদের। আমি বিনা বাক্যব্যয়ে গিয়ে বসলাম। টেবিলে সাজানো শিঙাড়া, ডালপুরি, আলুর চপ, চা। নিকটস্থ রেস্তোরাঁ থেকে আনিয়েছে। শিঙাড়ায় কামড় বসিয়ে চিবোতে চিবোতে বললাম, ‘তোর শরীর কেমন? তোকে খুব দুর্বল লাগছে দেখতে।’ অনু দীর্ঘশ্বাস ফেলল, টের পেলাম। একা একা বাক্যালাপ করছে মনে হলো। কিন্তু তার ঠোঁট নড়ছে না। চায়ের কাপ এগিয়ে দিতে দিতে হতাশার স্বরে বলল, ‘আর শরীর।’ কেন রে? খুব কি বয়স হয়ে গিয়েছে আমাদের? এখনো তো চল্লিশ পেরোয়নি। অনু কিছু বলল না। চুপ করে রইল। নিঃশব্দে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছি। বৃষ্টিস্নাত এই সন্ধ্যায় এক কাপ গরম চায়ের জন্য তৃষ্ণার্ত ছিলাম। চা-টা বেশ লাগল। ঝালের পর চা, মুখের ভেতরে অন্য রকম স্বাদের অনুভূতি সৃষ্টি করল।
‘হিমেল ভাই কোথায়?’ অনু ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে হাঁপানি রোগীর মতো, যেন বাঁশঝাড়ের ওপর দিয়ে প্রবল বাতাস বইছে। শুকনো গলায় টেনে টেনে বলল, ‘ব্যস্ত আছে হয়তো। কখন ফিরবে ঠিক নাই।’ আপা, আমি আর অনু, আমরা তিনজন চুপ করে রইলাম কয়েক মুহূর্ত। অনুকে দিঘির শান্ত জলের মতো স্থির মনে হলো। সেই উচ্ছ্বাস নেই। হাসি নেই। অনর্গল কথা-বলা নেই। যদিও বরাবরই নির্বোধ ছিল সে। চলনে-বলনে বুদ্ধিমত্তার স্ফুরণ ছিল না কোনোকালে।
আপা তাগিদ দিচ্ছে, ‘চল উঠি।’ রাত বাড়ছে। বিদায় নিলাম। অনু গেট অবধি এগিয়ে এল। ‘এখানে রিকশা পাওয়া যাবে না। চল হাঁটি।’ আপা বলল। নিয়নের আলোয় আমরা হাঁটছি চুপচাপ। কেউ কোনো কথা বলছি না। মাথার ওপর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। আনমনে পেছনে তাকালাম। অনু দাঁড়িয়ে আছে আধো অন্ধকারে। আপা তাগাদা দিল, ‘তাড়াতাড়ি হাঁট।’ যেকোনো বিদায়ে পিছু ফিরে চাইতে নেই। তবু বাঁয়ে বাঁক নেওয়ার আগে শেষ আরেকবার পেছনে তাকালাম। অনু তখনো দাঁড়িয়ে। হাত নেড়ে বিদায় দিচ্ছে।
আপা পানি জমে থাকা গর্ত এড়াতে লাফ দিয়ে এক পাশে সরে এল। আমরা মাথায় কাপড় দিলাম বৃষ্টির ছাট থেকে মাথা বাঁচাতে। রহমান চাচার বাসার সামনে দিয়ে যেতে যেতে আপা বলল, ‘অনুর ডায়াবেটিস কেন এত হাই, জানোস?’
কেন?
ও অভিমান করে সুগার নিয়ন্ত্রণ করে না। ওষুধ খায় না। ইনসুলিন নেয় না।
কার সঙ্গে অভিমান? আমি বিস্ময়ে তাকাই আপার দিকে উত্তরের অপেক্ষায়।
‘ওর জামাইয়ের সাথে।’
হিমেল ভাইয়ের সাথে? আমি নিশ্চিত হতে আবারও জিজ্ঞেস করি।
‘হ্যাঁ, হিমেল অন্য এক নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে অনেক দিন হয়। তিন সন্তানের মা এক প্রবাসীর স্ত্রী। হিমেল সেখানে রাত কাটায়। বাসায় ফিরে না প্রায়ই।’
‘তোকে কে বলেছে এই সব, আপা?’ আমি চমকে উঠে জানতে চাইলাম।
আপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘অনুর বড় বোন রুনু।’
ঝিরিঝিরি কুয়াশার মতো বৃষ্টির মাঝে আমরা হাঁটছি। হাজি মহসিন রোড ধরে। হার্ডওয়্যারের দোকান, রড-সিমেন্টের দোকান, বলাই স্বর্ণকারের দোকান, ল্যাম্পপোস্ট পেছনে ফেলে। কোনো কথা বলছি না কেউ। যেন অচেনা দুই পথিক হেঁটে চলেছি অচিন পথে। দু-একটি যাত্রীহীন রিকশা হর্ন বাজাতে বাজাতে পাশ কেটে গেল। তাদেরও বোধ হয় বাড়ি ফেরার তাড়া।
দুই দিন চাঁদপুর কাটিয়ে ঢাকায় ফিরলাম। পরের সপ্তাহে নিউইয়র্ক। যেখানে আমার জন্য অপেক্ষা করছে আমার স্বামী ও সন্তানেরা। বিদেশ-বিভুঁইয়ে রুদ্ধশ্বাস ব্যস্ততায় ডুবে গেলাম যথারীতি। ঘর-সংসার, সন্তানদের স্কুল, চাকরি, কত কাজ। দেশ-সংক্রান্ত ভাবনা ভুলে গেলাম। শরৎ, হেমন্ত গেল। পাতাঝরার দিন শেষে শীত এল।
আটলান্টা থেকে বন্ধু এল সপরিবারে, বেড়াতে। নিউ-ইয়ার উদযাপন করতে। আমরা টাইমস স্কয়ারে গেলাম দলবেঁধে। উৎসবের আমেজে ভেসে যাচ্ছে আলো ঝলমলে টাইমস স্কয়ার। লোকে লোকারণ্য। কেউ প্যাঁ পোঁ বাঁশি বাজাচ্ছে। কেউবা রংবেরঙের পোশাক, মুখোশ পরেছে। বাধাবন্ধনহীনভাবে বিচরণ করছে। এক স্থানে মানুষের জটলা। এগিয়ে গিয়ে দেখি বিশাল এক সাপ গায়ে জড়িয়ে প্যাঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক শ্বেতাঙ্গ তরুণ। সাপের খেলা দেখাচ্ছে। বিশ ডলারের বিনিময়ে সাপটি দর্শনার্থীর গলায় ঝুলিয়ে দিচ্ছে ক্ষণিকের জন্য। এসব দেখতে ঘিরে অগণন কৌতূহলী তরুণ-তরুণী। চারদিকে মানুষের কোলাহল। যেন শীতের তীব্রতাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে সারা পৃথিবীর মানুষ জড়ো হয়েছে নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে থার্টি ফার্স্ট উদযাপন করতে। আচমকা ফোনের ভাইব্রেশন টের পাই জ্যাকেটের পকেটে। ফোন বের করে আনি। স্ক্রিনে ভেসে ওঠে, ‘আপা বিডি’। বাংলাদেশ থেকে আপা কল করেছে। হ্যালো বলতেই ওই পাশ থেকে আপার কণ্ঠস্বর শোনা গেল। কোনো কুশলাদি না জিজ্ঞেস করেই আপা সাংঘাতিক বিচলিত স্বরে বলল, ‘একটা দুঃসংবাদ দিতে ফোন করেছি রে। অনু মারা গেছে।‘ আমি ভাবলেশহীনভাবে কিংবা অস্ফুটে কিছু বলেছি হয়তো। নাকি কিছুই বলিনি, কে জানে! হয়তো-বা অবলীলায় সহজ সত্য মেনে নিয়েছি। ওই প্রান্তে খুট করে ফোন রাখার আওয়াজ পেলাম। প্রবল ঠান্ডায় মানুষের মুখ দিয়ে নিঃশ্বাসের সঙ্গে ধোঁয়া বের হচ্ছে। মানুষ সমবেত স্বরে চিৎকার করছে, ফাইভ, ফোর, থ্রি, টু, ওয়ান, জিরো... লক্ষ লক্ষ চোখ একযোগে তাকিয়ে আছে উপরের দিকে। বল নেমে আসছে নিচের দিকে। আমি তাকিয়ে আছি সেই দিকে। কে যেন দুটি নীল-সাদা রঙের বেলুন আকাশে উড়িয়ে দিয়েছে। দুই বেণি বাঁধা চুলে, নীল-সাদা স্কুল ইউনিফর্মে অনু ধীরে ধীরে উপরে উঠছে। মলিন মুখ। পরাজিত মুখ। ঝাপসা হয়ে আসছে মুখটি। উঠছে আরও উপরে। আকাশে। -নিউইয়র্ক