প্রসঙ্গ : পহেলগাম টেরর অ্যাটাক

প্রকাশ : ০৮ মে ২০২৫, ১২:১০ , অনলাইন ভার্সন
ষাটের দশকের গোড়ার দিকে শৈশবে ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট থানার জয়রামকুড়া এলাকায় গারো পাহাড় দেখতে যাওয়ার কথা মনে পড়ছে। আমাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন ছুটিতে বেড়াতে আসা আত্মীয় হারুন ভাই, যিনি সে সময় ঢাকায় বিএ ক্লাসের ছাত্র ছিলেন। জয়রামকুড়ায় খ্রিষ্টান মিশনারিদের প্রতিষ্ঠিত দৃষ্টিনন্দন হাসপাতাল দেখার পর আমরা গারো পাহাড়ের দিকে অগ্রসর হই। পথে সেখানকার তৎকালীন ইপিআর ক্যাম্পের একজন সদস্যের সঙ্গে হারুন ভাইয়ের কথা হয়। কথা প্রসঙ্গে জানা গেল, ওই ইপিআর সদস্য আমাদের গ্রামের পাশের গ্রামের বাসিন্দা। তিনি আমাদেরকে ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে চা-পান আপ্যায়ন করেন। চা-পানে আমাদের সঙ্গে তিন-চারজন বাঙালি ও অবাঙালি সদস্য যোগ দেন। আলাপচারিতায় সেখানে উপস্থিত একজন সৈনিক সীমান্ত এলাকায় তার টহল অভিজ্ঞতার কথা জানান। তার ভাষ্যমতে, প্রতিবার টহলের সময় ভারতের সীমান্তরক্ষীরা টহলরত ইপিআর সদস্যদের দেখামাত্র স্থান ত্যাগ করে চলে যায়। সীমান্তে আমাদের সৈনিকদের দাপুটে উপস্থিতির বিষয়টি জানতে পেরে গর্ব ও প্রীতবোধ করি। চা-পান শেষে ইপিআর সদস্যের দেখানো পথ ধরে আমরা মোটামুটি একটি সুউচ্চ পাহাড়ের উপরে উঠে পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝরনাধারা ও সবুজ বৃক্ষরাজিতে ভরা ওপরের ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়গুলো দেখতে পাই। পাহাড়ের চূড়ায় দু-একজন গারো অধিবাসী ও তাদের ঘরবাড়ি দেখার সৌভাগ্য হলেও ওপারে কোনো ভারতীয় সীমান্তরক্ষীর আনাগোনা নজরে পড়েনি।
বহু বছর আগের এই ঘটনাটি মনে পড়ে গেল গত ২২ এপ্রিল ভারত অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাম এলাকায় সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন পর্যটকের (২৫ জন ভারতীয় ও একজন নেপালি) হত্যা-পরবর্তী ঘটনায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তার সরকারের অন্য কতিপয় নেতা এবং বিজেপি সমর্থক মিডিয়ার তর্জন-গর্জন ও হম্বিতম্বি দেখে। ওই হামলায় বেছে বেছে শুধু হিন্দুদের হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ করা হয়। কাশ্মীরভিত্তিক রেজিস্ট্যান্স ফোর্স নামের একটি সংগঠন হত্যার দায় নিলেও ভারত সরকার ও মিডিয়া তাৎক্ষণিকভাবে হামলার দায়দায়িত্ব পাকিস্তানের ওপর চাপিয়ে সে দেশকে দাঁতভাঙা উচিত শিক্ষা ও মাটির সঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়ার উসকানিমূলক প্রচার-প্রচারণা শুরু করে। অবশ্য কাশ্মীরে যেকোনো সহিংসতার জন্য ভারত কর্তৃক পাকিস্তানকে দায়ী করার ঘটনা নতুন কোনো বিষয় নয়। অতীতে সংগঠিত প্রতিটি ঘটনার জন্য একই রকমভাবে পাকিস্তানকে দায়ী করা হয়।

মোদির রাজনৈতিক গুরু ভারতের হিন্দুত্ববাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (আরএসএস) নেতা মোহন ভগত মুসলমানরা যেভাবে বেছে বেছে হিন্দুদের খুন করেছে, হিন্দুদের দ্বারা সেভাবে কাউকে খুন করা সম্ভব হবে না বলে তার প্রগাঢ় মুসলিমবিদ্বেষ উগড়ে দেন। স্মরণ করা যেতে পারে, নিকট অতীতে তার মতো আরও কতিপয় বিজেপি নেতা ধর্ম-নির্বিশেষে যেসব ভারতীয় নাগরিক ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান উচ্চারণ করতে ব্যর্থ হবেন, তাদের ভারতে বসবাসের অধিকার নেই বলে নসিহত করেন। স্পষ্টত, মোহন ভগত ও তার অনুসারীরা ২০০২ সালে গুজরাটে হিন্দুদের দ্বারা এক হাজারের বেশি মুসলিমকে হত্যা এবং ২০০০ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের ভারত সফরের সময় ঠান্ডা মাথায় ৩৮ জন শিখকে হত্যার ঘটনার কথা বেমালুম ভুলে গেছেন। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি তথা মুসলিম বিদ্বেষে বুঁদ এসব নেতার তা ভুলে যাওয়াই স্বাভাবিক।

ভারতীয় নেতাদের পাকিস্তানকে ধ্বংস করার এহেন হুংকার ও তর্জন-গর্জনের কয়েক ঘণ্টা পর কাশ্মীরের পাক-ভারত সীমান্তে উভয় দেশের সেনাদের মধ্যে বিক্ষিপ্ত গোলাগুলির ঘটনায় একজন ভারতীয় সেনার নিহত ও পাকিস্তানি সেনার হাতে অপর একজনের আটক হওয়ার খবর প্রচারিত হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ শুরুর আগেই দুজন ভারতীয় সেনার পরিণতি দেখে বাংলাদেশে বহুলপ্রচলিত একটি কথা মনে পড়ে যায়, ‘ছিঁড়তে পারে না পাখির পাল (পালক), নাম জাগায় শেখ জামাল।’

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পসহ বিশ্বের বহু নেতা সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিলেন। ট্রাম্প কোনো পক্ষ না নিয়ে হামলার ঘটনাকে ‘খারাপ’ (Bad) বলে উল্লেখ করে ভারত-পাকিস্তানকে স্বাধীনভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে উদ্যোগী হতে আহ্বান জানান।

পহেলগাম ঘটনার পর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বেশ কিছু কূটনৈতিক পদক্ষেপ নেয় ভারত, যার মধ্যে রয়েছে সিন্ধু নদের পানিচুক্তি স্থগিত করে পাকিস্তানে পানিপ্রবাহ বন্ধ, পাকিস্তানিদের ভিসা বাতিল ইত্যাদি। পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে পাকিস্তান তার আকাশসীমার ওপর দিয়ে ভারতীয় বিমান চলাচল নিষিদ্ধ ও ভারতের সঙ্গে ব্যবসা বন্ধের ঘোষণা দেয়।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর থেকে কাশ্মীর পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে একটি বিষফোড়া ইস্যু হিসেবে বিরাজমান রয়েছে। নানা ঘটনা পরিক্রমায় কাশ্মীরের উত্তরের কিছু অংশ পাকিস্তানের সঙ্গে একীভূত হলেও কাশ্মীরের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা ভারতের অধিকারে আসে। জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুযায়ী কাশ্মীর কোন দিকে যাবে, সেটা সেখানকার জনগণের গণভোটে নির্ধারণের কথা থাকলেও ভারতের অনাগ্রহে সেটা বাস্তবে রূপ পায়নি, যে কারণে কাশ্মীর উপত্যকায় অশান্তি ও সহিংসতা হয়ে ওঠে অনেকটা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। স্বায়ত্তশাসন-সংক্রান্ত কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা মোদি সরকার ২০১৯ সালে বাতিল করে সেখানে নিরাপত্তার অজুহাতে প্রায় ৫ লাখ ভারতীয় সেনা প্রেরণ করে। নিজের দেশের একটি অংশের জনগণের ওপর নজরদারির জন্য এত বিপুলসংখ্যক সেনা মোতায়েনের ঘটনা বিশ্বে বিরল। সেই সঙ্গে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরের ডেমোগ্রাফি পরিবর্তনের লক্ষ্যে সেখানে অন্য রাজ্য থেকে বিপুলসংখ্যক (প্রায় ৮৫ হাজার) হিন্দুকে বসবাস ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ করে দেওয়া হয়, যেটাকে সেখানকার মুসলিম জনগোষ্ঠী তাদের সংখ্যালঘু করার একটি ষড়যন্ত্র বলে মনে করে। সন্ত্রাসী ও জঙ্গি খোঁজার অজুহাতে ভারতীয় সেনারা বাড়িঘরে হানা দিয়ে বহু মুসলিম তরুণকে ধরে নিয়ে জেলবন্দী করা ছাড়াও অনেককে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করে, যেটা কাশ্মীরের জনগণের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দেয়, যার বহিঃপ্রকাশ পহেলগামসহ আগের বহু ঘটনায় ঘটতে দেখা যায়।

পহেলগামের ঘটনাকে কেন্দ্র করে মোদির যুদ্ধের উন্মাদনা সৃষ্টির প্রচেষ্টাকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কিছু নেতা ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ভারতীয় বহু নাগরিক সুনজরে দেখছেন না। কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর স্বামী রবার্ট ভাদ্রা ও কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়ার বিবৃতি থেকে এটা আন্দাজ করা যায়। তারা হিন্দু-মুসলিম বিভেদের রাজনীতি বাদ দিয়ে যুদ্ধের বিপক্ষে অভিমত প্রকাশ করেন। ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশ। এই দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধে কোনো কারণে এই বিধ্বংসী অস্ত্রের ব্যবহার হলে সেটা যে কতটা ভয়ংকর ও ভয়াবহ হবে, তা বিশদে বলার অপেক্ষা রাখে বলে মনে করি না।
লেখক : কলামিস্ট
 
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: 01711238078