Love & Longings

প্রকাশ : ০৮ মে ২০২৫, ১২:০০ , অনলাইন ভার্সন
আমার জীবনীভিত্তিক গ্রন্থ খড়াব ্ খড়হমরহমং মূলত অর্ক-অরিত্রির জন্য লেখা। বইটি কলকাতার ভিরাসাত আর্ট পাবলিকেশন থেকে অচিরেই প্রকাশিত হচ্ছে। বইটি ট্রান্সলেট করেছেন লেখক সাহেলি মিত্রা। বইটির কথা এখনো ওদেরকে বলিনি। সারপ্রাইজ দেব, তাই। নতুন বই হাতে দেব। একদিন আমি গাড়িতে যেতে যেতে অরিত্রিকে বললাম, তুমি তো বাংলা পড়তে পারো না। অরিত্রি বলল, একটু একটু পারি। চেষ্টা করলে পারব, বাবা। আমি আর কিছু বলি না। অর্ক-অরিত্রি ফেসবুক করে না বলে এই লেখাও পড়বে না। সুতরাং সারপ্রাইজটা থাকল। যেদিন আমি সন্তানের বাবা হলাম, সেদিন থেকেই আমার মনের মধ্যে কিছু পরিকল্পনা কাজ করত। সেই পরিকল্পনার কথা কেউ জানে না। নিজে নিজে পরিকল্পনা সাজাই আমি। স্বপ্ন দেখি। আমি সব সময়ই স্বপ্নবাজ। স্বপ্ন পূরণ হোক বা না হোক, স্বপ্ন দেখায় আমার জুড়ি নেই। স্বপ্ন আছে বলেই বেঁচে থাকি। আমাদের জন্মের সময়কাল আর আমাদের সন্তানদের সময়কাল একরকম হবে না-এটা সহজ হিসাব। আবার আমার সন্তানদের যখন সন্তান হবে, সেটাও হবে আলাদা, ভিন্ন। আমার মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা অনেক অপ্রাপ্তি আর অবহেলার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে। স্বল্প আয়ের পরিবারের সন্তান ছিলাম আমি। এক জোড়া জুতা, একটা দুটো শার্ট আর প্যান্ট পরে দিনের পর দিন স্কুলে গিয়েছি বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে। ছাতা ছিল না বলে বৃষ্টি শরীরেই শুকিয়ে যেত। সর্দি জ্বর হতো না সহজে। শরীর সব সয়ে নিত। অনেক কিছু যে নাই সে রকম অনুভূতি কাজ করত না।
আমার পুরো ছাত্রজীবনই ছিল অনন্ত লড়াই-সংগ্রামের। যেকোনো সময় ছিটকে পড়তে পারতাম আমি। হারিয়ে যেতে পারতাম। কোনো লক্ষ্যও ছিল না জীবনের। ছিল শুধু স্বপ্ন। আর ছিল বুকভরা ভালোবাসা। কোনো দিন বিয়ে করব, সংসার হবে, সন্তানের বাবা হবÑএসব ভাবিনি। কেউ আমাকে বিয়ে করবে, তাও ভাবিনি। আমি খুবই আউলাঝাউলা মানুষ। সবকিছুই হয়েছে পরিকল্পনা ছাড়া। কিন্তু যেদিন থেকে সন্তানের বাবা হয়ে গেলাম, তখন সন্তানদের নিয়ে আমার কিছু স্বপ্ন তৈরি হতে লাগল। সব বাবাদেরই যেমন স্বপ্ন থাকে। সন্তানের জন্য বাবাদের অনন্ত ক্ষুধা থাকে। আমি যেসব কষ্ট ভোগ করেছি, সেসব আমার সন্তানেরা যেন না ভোগ করে, এটা ছিল আমার প্রধান লক্ষ্য। কখনো তাদের ওপর কিছু চাপিয়ে দেব না। তাদের মতামতের মূল্য দেব, তাদের ভুলগুলো ধরিয়ে দেব এবং তাদের বন্ধু হতে চেষ্টা করব। আমার যতই সীমাবদ্ধতা থাকুক, অসুবিধা থাকুক, সেসব তাদেরকে যেন স্পর্শ না করে।
জানি, সবকিছু পারফেক্ট-মতো ঘটবে না। পৃথিবীতে কিছুই পারফেক্ট নয়। ভালো মানুষ যেন হয়Ñএই চেষ্টাটা অন্তত করতে পারি। অর্ক এবং অরিত্রি একদিন বড় হলো, পড়াশোনা, চাকরি এবং বিয়ে এসব হলো। দুজনের বয়সের ব্যবধান দুই বছর। তাদের প্রতিটি ক্ষণ আমার অবজারভেশনে ছিল। সব বাবা-মায়েরই যা থাকে। এই অদ্ভুত জীবনযাপন থেকে সাময়িক মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করি নিজের কথা, মানুষের কথা আর সন্তানদের কথা লিখে। অন্যদের মতো আমারও ছেলেমেয়ে বেড়ে ওঠার সময়টায় একটা আবেগ ছিল। তখন তাদের খুব ছবি তুলতাম। তখন তো আর স্মার্টফোন ছিল না! আমার একটা প্যানট্যাক্স কে-১০০০ ক্যামেরা ছিল। আসলে দুটো ক্যামেরা ছিল। ঢাকা স্টেডিয়ামের নিচতলায় ছিল নামকরা ইলেকট্রনিক্সের দোকানÑমিতালী। সেখান থেকে ক্যামেরাগুলো কিনেছিলাম। ছেলেমেয়ের ছবি তুলতাম আর গুলশান ১-এ ফুজি কালার ল্যাব থেকে ছবি প্রিন্ট করতাম। ছত্রিশটার মতো ছবি তোলা যেত প্রতিটা ফিল্মে। ব্যাপারটা একটু ব্যয়বহুল ছিল বটে কিন্তু এটা ছিল আমার একটা আনন্দের জায়গা। বাচ্চাদের বেড়ে ওঠা লক্ষ করতাম। এখন এই অবসরে মাঝে মাঝে পুরোনো অ্যালবাম দেখি। কত শত ছবি তুলেছি। এখন ভাবলে অবাক লাগে!
মনে আছে, ছোটবেলায় আমার একটা ছাগলের বাচ্চা ছিল। সেটাকে অনেক মায়া করতাম আমি। ওটার সাথে খেলতাম, কথা বলতাম। আমরা বন্ধুর মতো হয়ে গিয়েছিলাম। আমার ভাষা বুঝতে পারত অবোধ পশুটা। স্কুল থেকে এসেই এটা ছিল আমার একমাত্র কাজ। প্রতিদিন ছাগলের বাচ্চাটা বেড়ে উঠছে, আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। খুব সুদর্শন ছিল বাচ্চাটা। আমাকে দেখলেই খুশি হতো, আমি বুঝতাম। একদিন কারা যেন ছাগলের বাচ্চাটার একটা পা ভেঙে দিল। ছাগলটা যন্ত্রণায় কাতরাত। তারপর একদিন ওটাকে জবাই করা হলো। বিরিয়ানি রান্না হলো। সেই বিরিয়ানি আমার কাছে অতি কুৎসিত মনে হলো। আমি হাপুস নয়নে কেঁদেছিলাম কয়েক দিন। আমি মানুষের নির্মমতায় অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম।
একদিন যখন আমার সন্তান হলো, আমি ছাগলের বাচ্চাটার জন্য যেমন আবেগতাড়িত ছিলাম, আমার সন্তানদের জন্যও তা-ই। এখন মাঝে মাঝে অর্ক-অরিত্রিকে হোয়াটসঅ্যাপে এইসব পুরোনো ছবি পাঠিয়ে চমকে দিই। তাদের ফেসবুক নেই বলে দেখতে পায় না। আমার কোনো লেখা পড়ে না। অর্ক বাংলা পড়তে পারে কিন্তু গাদা গাদা ইংরেজি বই কেনে। সব বেস্ট সেল বই অর্কর সংগ্রহে আছে। অরিত্রি আমার লেখা পড়তে চায়।
একদিন বলল, বাবা, আমি বাংলা শিখতে চাই।
অরিত্রিকে বললাম, তোমাকে নিয়ে অনেক লিখি আমি। সবাই বলে, তুমি আমার মতো দেখতে।
অরিত্রি বলল, হ্যাঁ, অনেক দিন আগে একদিন ইউনিভার্সিটি থেকে বাসে আসছি, একজন আন্টি বলল, তুমি অরিত্রি না! আরেকদিন ইটন সেন্টারে গিয়েছিÑসেখানে একজন বলল, তুমি অরিত্রি, রাইট!
আমি বলেছি, জি।
তোমার বাবার লেখায় ছবি দেখেছি।
হ্যাঁ, বাবা খুব লেখে আমাকে নিয়ে।
ওরা যখন একটু বড় হতে লাগল, তারপর আর ছবি নাই তেমন, কারণ হচ্ছে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে চাইত না। অর্ক ক্যামেরা দেখলেই মুখ ঢেকে রাখত। এখনকার ছেলেমেয়েরা ছবি তুলতে দেয় না সহজে।
জেসমিনের কথায় বুঝতে পারি, আমার অনেক ত্রুটি। আমি যা-ই বলি, যত সুন্দর কথাই বলি, যত যুক্তি দিয়েই বলি না কেন, সবকিছুতে দ্বিমত পোষণ করবে। একই কথা যদি অন্য কেউ বলত, তাহলে বলত ঠিক আছে। আমার কোনো কিছু ঠিক না। সব ভুল। কিন্তু তাতে আমার কোনো সমস্যা হয় না। এটাতেই আমি অভ্যস্ত। নেগেটিভটাকেই পজিটিভ ধরে নিই। আমার কোনো কিছু ঠিক নাÑহাঁটা ঠিক না, পোশাক ঠিক না, খাওয়া ঠিক না, বেড়ানো ঠিক না, লেখালেখি হয় না...। তবে বাইরের কারও সাথে যখন কথা বলে, তখন সবকিছুতে আমার রেফারেন্স দেয়। জসিম এটা বলেছে, জসিম ওটা বলেছে। রেফারেন্স ছাড়া কথা বলতে পারে না। আবার যখন আমার সাথে কথা বলে, তখন অন্যের রেফারেন্স দিতে থাকে। অন্যের সাথে আমার তুলনা করে এবং সে তুলনায় আমি সব সময় ফেল! বাইরের লোকের কাছে প্রধান কমপ্লেন হচ্ছে ভাতটাও বেড়ে খেতে চায় না, বাজারে যেতে চায় না...।
কিন্তু আমার ছেলেমেয়ে দুজন সম্পূর্ণ আলাদা। ওরা যখন আমার কাছে ছিল, তখন দুজনের স্বভাবেই একটা মিল দেখতাম। সেটা হচ্ছে দুজনের একজনও কখনো আমাদের স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপারে ইন্টারফেয়ার করত না। কখনো যদি আমাদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি হতো, অরিত্রি একটু রিঅ্যাক্ট করত। অর্ক ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকত। অরিত্রি বলত, মা রিলাক্স। আমাকে বলত, চিল বাবা। আমি তখন লজ্জা পেতাম। চেষ্টা করতাম ওদের অনুপস্থিতিতে ঝগড়া করতে। ওরা থাকলে জমত না। এখন ঝগড়াঝাঁটি করার তেমন মুড পাই না। ওরা দূরে চলে যাওয়ায় জীবন হয়ে গেছে আরও নিরামিষ টাইপ, একঘেয়ে, বিরক্তিকর। অর্ক-অরিত্রি না থাকায় আরও বিষময়। এখন গৃহে শান্তিরক্ষার জন্য আমি নানা কৌশল অবলম্বন করি। তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে নির্বিকার থাকা। লেখার দিকে চেয়ে থাকা, যেন ওরাই আমার সব। এর চেয়ে ভালো উপায় আর নেই।
তবে জেসমিন যতই অভিযোগ করুক, অর্ক-অরিত্রি আজ পর্যন্ত আমাকে নিয়ে কোনো অভিযোগ করেনি। কোনো ত্রুটি ধরেনি। আমি যা-ই করি, সব ঠিক আছে, যা বলি তা-ই মন দিয়ে শোনে। যা কিছু ওদের সাথে শেয়ার করি, সবকিছুতেই সায় আছে, বলবে ওকে বাবা। অর্ক কখনো নিজের মতামত দিয়ে বলবে, তোমার ইচ্ছা বাবা। এখনো যা-ই বলি শোনে। যদিও আমি জানি, ওরা অনেক বাস্তববাদী। ওরা ওদের মতোই সিদ্ধান্ত নেবে। আমি কখনো কিছু চাপিয়ে দিই না। ওদের নিজস্ব জীবন আছে, মতামত আছে।
সন্তানই হচ্ছে বাবাদের অক্সিজেন! আমার জন্মদিন বা আমাদের বিবাহবার্ষিকী বা বাবা দিবসে আমি কাঙালের মতো অপেক্ষা করি। কী সেই অপেক্ষা! কেন করি! এর উত্তর আমার কাছে নেই। আমি তো বেশি কিছু চাই না কারও কাছে। শুধু কেউ আমাকে অবহেলা না করুক, আমার প্রাপ্যটুকু আমাকে দিক, আমাকে ভালোবাসুক-এটুকু চাই। এগুলো কি খুব বেশি চাওয়া! কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে, পৃথিবীতে কেউই তার প্রত্যাশামতো সব পায় না। নানা অজুহাতে কাউকে ছোট করে দিতে পারা বা একটু অবহেলা দেখানো আমাদের সমাজের মানুষের মজ্জাগত। এর থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় বেশি নেই। আমি জীবনে মানুষের কাছ থেকে অনেক অবহেলা পেয়েছি, আমাকে ছোট করার নানা কায়দাকানুন করতে দেখেছি। কিন্তু এসবকে ছাপিয়ে ভালোবাসাই সবচেয়ে বেশি পেয়েছি, তাই ওসব তুচ্ছ কষ্টকে ভুলে যাই আমি।
কিন্তু আমি কাঙাল সন্তানের কাছ থেকে কিছু পাওয়ার জন্য। সেটা হচ্ছে তারা আমাকে কতটুকু কেয়ার করে, কতটুকু ভালোবাসে, এইটুকু জানার জন্য আমি বসে থাকি। আমি কি একটু আজব! প্রতি বাবা দিবসে এমন হয় আমার। জন্মদিনেও হয়। সকালে ঘুম ভেঙেই দেখি অর্কর মেসেজ। সাথে সাথে মন ভালো হয়ে যায়। কিন্তু অরিত্রি কিছু লিখছে না কেন! আমার প্রতীক্ষা শেষ হয় না। একসময় লজ্জার মাথা খেয়ে জেসমিনকে বলি, অরিত্রি তো আমাকে উইশ করল না! জেসমিন বলল, সময় পার হয়ে যায় নাই। সন্ধ্যায় ঠিক অরিত্রি আর সাদ উপস্থিত হয়ে যায়। কেকের প্যাকেট, সুন্দর কার্ড এবং আমার প্রিয় পারফিউম, শার্ট বা টাই নিয়ে হাজির হয়ে যায়। সন্তানের জন্য বাবাদের বুকের গভীরে চৈত্রের কুয়োর তলানি জলের মতো কিছু ভালোবাসা সব সময় পড়ে থাকে। ওই দুস্তর পথ পার হয়ে সেইটুকু স্পর্শ করবে কে? অভিমানই বাবাদের অস্তিত্ব। তার সঙ্গে চলে অপেক্ষা অপেক্ষা। তার পাশে কেউ আসুক, সবাই আসুক...। -টরন্টো
 
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: 01711238078