লাবলু কাজী
বড় ভাইরা সব সময় বড় থাকে না। কথাটা প্রায়ই সত্যের বাস্তব নগ্ন রূপে সমাজে দেখা যায়। দুঃখে-কষ্টে শেষ বয়সের করুণ পরিণতি আমার চোখের সামনে পক্ষী নাচে। গ্রামের বড় ভাই, চাচাদের শেষ বয়সের আক্ষেপ, দুঃখ, জ্বালা বড়ই বেদনাবিধূর ও অসহনীয়। শরীর-মন ভেঙে যায় ও অপরিণত বয়সেই চলে যায় না ফেরার দেশে। নীরব হয়ে যায় তারা, বুকের ব্যথা বুকেই রয়ে যায়। এর ভুক্তভোগী সবচেয়ে বেশি প্রবাসফেরত আপনজনেরা। বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়লেও করতে হয় ডে লেবারের মতো কাজ। মানসম্মান গোল্লায় যাক, বাঁচতে তো হবে, তাই করা। জীবনের সোনালি দিনের কামাই পেট্রো ডলার দিয়ে ভাইবোনদের ফুর্তির ব্যবস্থা, বিয়েশাদির ব্যয়ভার বহন করলেও নিজের মেয়ে বিয়ে দিতে দেখা গেছে অন্যের নিকট হাত পাততে। এমন তো হওয়া উচিত নয়, এমন হতভাগা কেন নিঃস্বার্থ বড় ভাইয়েরা আমাদের? পরিচিত অনেকে চলে গেছেন নীরবে, বুকের ব্যথা, কষ্ট নীরবে হজম করে।
পেছনে রেখে গেছেন সহায়-সম্বলহীন বিধবা স্ত্রী ও মাছুম বাচ্চাদের। কষ্ট, আমরা কেন এত পয়সার পেছনে সব সময় ব্যস্ত থাকি আর করে যাই জুলুম, যারাই আমাদের ভালো করেছেন তাদের প্রতি।
জীবনের সবচেয়ে ভারী এবং শাশ্বত সত্য হচ্ছে আমরা সবাই মরে যাব, কিন্তু সঙ্গীসাথি কেউ সঙ্গে যাবে না। কিন্তু মানুষ মরতে চায় না, বাঁচতে চায়-এটাই স্বাভাবিক। যেহেতু চলে যেতেই হবে, এটাকে স্বাভাবিকভাবে নিয়ে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। জ্ঞানী যারা তারা তা-ই করেন। আমার নিজের কথায় আসি। আমার চার জেনারেশনের কথা ভাবি, তা আমায় সান্ত্বনার প্রলেপে ভোলায় মন না খারাপ করার জন্য। আমার বাবা চলে গেলেন। আমার ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে, বিয়ে করেছে এবং তারা তৈরি আমায় Reprentaion করার জন্য। তাদের ছেলে হয়েছে, তাদের কাছ থেকে বুঝে নেওয়ার জন্য। প্রকৃতির ঋতু পরিবর্তনের মতো এই যে জীবনধারার বিবর্তন, আমাদের তা বদলানোর সাধ্যি আছে কি? না নেই, তাই রাব্বুল আলামিনের ওপর ভরসা করে তাঁর ওপর ছেড়ে দেওয়াই ভালো। কবির সেই বাণী চিরন্তন দিয়ে শেষ করছি :
‘জন্মিলে মরিতে হবে
অমর কে কোথা রবে
চিরস্থির করে নীড়,
হায়রে জীবন নদে...
আমার খুব কাছের এক আত্মীয় ২৭ বছরের টগবগে যুবক। ব্যায়াম, খেলাধুলা সবকিছুতেই পারদর্শী। সবে বিয়ে করেছে। একটি ছেলে হয়েছে, সুখ যেন ধরে না। বাঁধভাঙা জোয়ারের পানির মতো উপচে পড়ে যেন। বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে। কনকনে শীতের এক সুবেহ সাদিকে হঠাৎ বুকে ব্যথা আর থামল না। চলে গেলেন না ফেরার দেশে অ্যাম্বুলেন্স আসার আগেই। আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে গেল মা-বাবা, বউ আর একমাত্র বোনের ক্রন্দনে। পরিবারটি আর আগের অবস্থায় নেই। ছোট বাচ্চাটিকে জিজ্ঞেস করি, বাবা কোথায়? খুব করুণ করে বলে, ‘আমি বাবাকে রোজ ফোন করি, বাবা উত্তর দেয় না।’ এই কি সহ্য হয়, না হয় না। আল্লাহর ইচ্ছায় খাই, বান্দার ইচ্ছায় ছাই। তিনি যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন।
করোনার তাণ্ডব নিউইয়র্ক শহরে। এ যেন ভয়ংকর মহামারি। কেউ ঘর থেকে বের হতে চান না, এই বুঝি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলো। গরম ট্রডি খেয়ে, মাস্ক পরে ঝুঁকিমুক্ত থাকার বৃথা চেষ্টা মানুষের। এর মাঝেও আমার বড় ভাই সাত দিনের সাত দিনই ট্রেনে চড়ে কাজে যেতে লাগলেন। সবাই মানা করা সত্ত্বেও ওনি ক্ষান্ত দিলেন না অফিস যাওয়ার। যা হওয়ার তা-ই হলো। করোনা পজিটিভ, ১০ দিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে চলে গেলেন চিরস্থায়ী জায়গায় পরপারে সবাইকে শোকসাগরে ভাসিয়ে। আফসোস, না আমরা কেউ পারলাম মুখখানি শেষবারের মতো একবার দেখতে, না পারলাম জানাজায় শরিক হতে। ভাগ্যের লিখন না যায় খণ্ডন, তা-ই মেনে নিয়েই জীবনের বৈঠা বেয়ে চলেছি।
জীবন কী, সব সময় ভাবি নীরবে একা একা। সূর্য ডোবা দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। সমুদ্রধারে বেড়াতে গেলে ওর লাল আভায় মিলিয়ে যেতে দেখি আর ভাবি, নিজ জীবনের অন্তিম আলোটুকুও এমনি কখন যেন দমকা হাওয়ায় নিভু নিভু থেকে নিভে যায়। অনাদিকাল থেকে অনন্তকাল পর্যন্ত এই আমাদের যাত্রাধ্বনি, তা কবে থামবে ভবিতব্যই জানেন। কচু পাতায় বৃষ্টির পানির ক্ষণিক পসরের এই যে জীবন আলো ঝলমলে বাতির নেশায় আমরা বুঁদ হয়ে আরও কত কিছুই না করি। বুঝি না কত ঠুনকো, কাচের চুড়ির মতো কত ভঙ্গুর এই আমাদের বানানো কাচের স্বর্গ।
আমার সবাই চলে গেছে। মা, বাবা, ভাই, বোন। ছেলেমেয়ে যা হয়েছে, তারাও বিয়ে করে নিজ সংসার বানিয়ে চলে গেছে। যাকেই ধরতে চেয়েছি, সে-ই ছেড়ে চলে গেছে। ভাবি, জীবন কী? উত্তর নেই। কে যেন বলেছেন, ‘LIFE IS A TALE TOLD BY AN IDIOT.’ তা-ই বোধ হয় রূঢ় সত্য। তার চেয়েও বড় সত্য, মাবুদ বিনে আমাদের এ ভবে আর কেউ নেই। বাকি সব মেকি আর ফাঁকা, শূন্য।
-নিউইয়র্ক, ৮/০৪/২০২৩
বড় ভাইরা সব সময় বড় থাকে না। কথাটা প্রায়ই সত্যের বাস্তব নগ্ন রূপে সমাজে দেখা যায়। দুঃখে-কষ্টে শেষ বয়সের করুণ পরিণতি আমার চোখের সামনে পক্ষী নাচে। গ্রামের বড় ভাই, চাচাদের শেষ বয়সের আক্ষেপ, দুঃখ, জ্বালা বড়ই বেদনাবিধূর ও অসহনীয়। শরীর-মন ভেঙে যায় ও অপরিণত বয়সেই চলে যায় না ফেরার দেশে। নীরব হয়ে যায় তারা, বুকের ব্যথা বুকেই রয়ে যায়। এর ভুক্তভোগী সবচেয়ে বেশি প্রবাসফেরত আপনজনেরা। বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়লেও করতে হয় ডে লেবারের মতো কাজ। মানসম্মান গোল্লায় যাক, বাঁচতে তো হবে, তাই করা। জীবনের সোনালি দিনের কামাই পেট্রো ডলার দিয়ে ভাইবোনদের ফুর্তির ব্যবস্থা, বিয়েশাদির ব্যয়ভার বহন করলেও নিজের মেয়ে বিয়ে দিতে দেখা গেছে অন্যের নিকট হাত পাততে। এমন তো হওয়া উচিত নয়, এমন হতভাগা কেন নিঃস্বার্থ বড় ভাইয়েরা আমাদের? পরিচিত অনেকে চলে গেছেন নীরবে, বুকের ব্যথা, কষ্ট নীরবে হজম করে।
পেছনে রেখে গেছেন সহায়-সম্বলহীন বিধবা স্ত্রী ও মাছুম বাচ্চাদের। কষ্ট, আমরা কেন এত পয়সার পেছনে সব সময় ব্যস্ত থাকি আর করে যাই জুলুম, যারাই আমাদের ভালো করেছেন তাদের প্রতি।
জীবনের সবচেয়ে ভারী এবং শাশ্বত সত্য হচ্ছে আমরা সবাই মরে যাব, কিন্তু সঙ্গীসাথি কেউ সঙ্গে যাবে না। কিন্তু মানুষ মরতে চায় না, বাঁচতে চায়-এটাই স্বাভাবিক। যেহেতু চলে যেতেই হবে, এটাকে স্বাভাবিকভাবে নিয়ে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। জ্ঞানী যারা তারা তা-ই করেন। আমার নিজের কথায় আসি। আমার চার জেনারেশনের কথা ভাবি, তা আমায় সান্ত্বনার প্রলেপে ভোলায় মন না খারাপ করার জন্য। আমার বাবা চলে গেলেন। আমার ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে, বিয়ে করেছে এবং তারা তৈরি আমায় Reprentaion করার জন্য। তাদের ছেলে হয়েছে, তাদের কাছ থেকে বুঝে নেওয়ার জন্য। প্রকৃতির ঋতু পরিবর্তনের মতো এই যে জীবনধারার বিবর্তন, আমাদের তা বদলানোর সাধ্যি আছে কি? না নেই, তাই রাব্বুল আলামিনের ওপর ভরসা করে তাঁর ওপর ছেড়ে দেওয়াই ভালো। কবির সেই বাণী চিরন্তন দিয়ে শেষ করছি :
‘জন্মিলে মরিতে হবে
অমর কে কোথা রবে
চিরস্থির করে নীড়,
হায়রে জীবন নদে...
আমার খুব কাছের এক আত্মীয় ২৭ বছরের টগবগে যুবক। ব্যায়াম, খেলাধুলা সবকিছুতেই পারদর্শী। সবে বিয়ে করেছে। একটি ছেলে হয়েছে, সুখ যেন ধরে না। বাঁধভাঙা জোয়ারের পানির মতো উপচে পড়ে যেন। বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে। কনকনে শীতের এক সুবেহ সাদিকে হঠাৎ বুকে ব্যথা আর থামল না। চলে গেলেন না ফেরার দেশে অ্যাম্বুলেন্স আসার আগেই। আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে গেল মা-বাবা, বউ আর একমাত্র বোনের ক্রন্দনে। পরিবারটি আর আগের অবস্থায় নেই। ছোট বাচ্চাটিকে জিজ্ঞেস করি, বাবা কোথায়? খুব করুণ করে বলে, ‘আমি বাবাকে রোজ ফোন করি, বাবা উত্তর দেয় না।’ এই কি সহ্য হয়, না হয় না। আল্লাহর ইচ্ছায় খাই, বান্দার ইচ্ছায় ছাই। তিনি যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন।
করোনার তাণ্ডব নিউইয়র্ক শহরে। এ যেন ভয়ংকর মহামারি। কেউ ঘর থেকে বের হতে চান না, এই বুঝি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলো। গরম ট্রডি খেয়ে, মাস্ক পরে ঝুঁকিমুক্ত থাকার বৃথা চেষ্টা মানুষের। এর মাঝেও আমার বড় ভাই সাত দিনের সাত দিনই ট্রেনে চড়ে কাজে যেতে লাগলেন। সবাই মানা করা সত্ত্বেও ওনি ক্ষান্ত দিলেন না অফিস যাওয়ার। যা হওয়ার তা-ই হলো। করোনা পজিটিভ, ১০ দিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে চলে গেলেন চিরস্থায়ী জায়গায় পরপারে সবাইকে শোকসাগরে ভাসিয়ে। আফসোস, না আমরা কেউ পারলাম মুখখানি শেষবারের মতো একবার দেখতে, না পারলাম জানাজায় শরিক হতে। ভাগ্যের লিখন না যায় খণ্ডন, তা-ই মেনে নিয়েই জীবনের বৈঠা বেয়ে চলেছি।
জীবন কী, সব সময় ভাবি নীরবে একা একা। সূর্য ডোবা দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। সমুদ্রধারে বেড়াতে গেলে ওর লাল আভায় মিলিয়ে যেতে দেখি আর ভাবি, নিজ জীবনের অন্তিম আলোটুকুও এমনি কখন যেন দমকা হাওয়ায় নিভু নিভু থেকে নিভে যায়। অনাদিকাল থেকে অনন্তকাল পর্যন্ত এই আমাদের যাত্রাধ্বনি, তা কবে থামবে ভবিতব্যই জানেন। কচু পাতায় বৃষ্টির পানির ক্ষণিক পসরের এই যে জীবন আলো ঝলমলে বাতির নেশায় আমরা বুঁদ হয়ে আরও কত কিছুই না করি। বুঝি না কত ঠুনকো, কাচের চুড়ির মতো কত ভঙ্গুর এই আমাদের বানানো কাচের স্বর্গ।
আমার সবাই চলে গেছে। মা, বাবা, ভাই, বোন। ছেলেমেয়ে যা হয়েছে, তারাও বিয়ে করে নিজ সংসার বানিয়ে চলে গেছে। যাকেই ধরতে চেয়েছি, সে-ই ছেড়ে চলে গেছে। ভাবি, জীবন কী? উত্তর নেই। কে যেন বলেছেন, ‘LIFE IS A TALE TOLD BY AN IDIOT.’ তা-ই বোধ হয় রূঢ় সত্য। তার চেয়েও বড় সত্য, মাবুদ বিনে আমাদের এ ভবে আর কেউ নেই। বাকি সব মেকি আর ফাঁকা, শূন্য।
-নিউইয়র্ক, ৮/০৪/২০২৩