
প্রকৃতপক্ষে আমি কোথাও থিতু হতে পারিনি। সেটা আমার অস্থির স্বভাবের জন্যই। কী যে চাই, কোথায় যে স্বস্তি, কোথায় সুখ, সেটাই জানি না আজও। সুখ-দুঃখের হিসাবটাও মেলাতে পারলাম না। কখনো মনে হয় এই যে সামান্য জীবন, এই যে বেঁচে আছি এতেই সুখ, আবার পরক্ষণে মনে হয় কোথায় সুখ! কোথাও সুখ নাই। বুঝতে পারি না কিছুই। সুখ-দুঃখের সংজ্ঞাটা বড়ই গোলমেলে। কিছুতেই মেলাতে পারি না। একসময় বরিশাল ছেড়েছিলাম স্বেচ্ছায়। মনে হয়েছিল বরিশালের গণ্ডিবদ্ধ যে জীবন, সে জীবন আমার নয়। বরিশাল ছাড়তে হবে। কিন্তু বরিশাল ছেড়ে কোথায় যাব, কার কাছে যাব, কেন যাব, তা জানতাম না। কিন্তু পূর্বাপর পরিণতি না জেনেই বরিশাল ছাড়লাম একদিন। নিজেকে নিয়ে যেহেতু আমার কোনো উচ্চাকাক্সক্ষা নেই, কোনো লক্ষ্য নেই, তাই আমি যেকোনো কিছুই করতে পারি। নিজেকে আমি প্রকৃতির হাতে ছেড়ে দিয়েছি। বরিশালের পর আমি ঢাকায় একটা লম্বা সময় কাটালাম। পরিবার তৈরি হলো। সবকিছুই যেন অটো সিস্টেমে ঘটে গেছে। নিয়তি আমাকে চালিত করে গেছে, যেন এক অদৃশ্য শক্তি কলকাঠি নাড়ছে। সেই শক্তি বিপদ দিয়েছে আবার বিপদমুক্তও করেছে। নিজের প্রত্যাশা ও ইচ্ছার বাইরে অনেক কিছু ঘটেছে। জীবনে অলৌকিক অনেক কিছু ঘটে। আমার জীবনটাও তা-ই।
একটা বিল্ডিং শক্ত-পোক্তভাবে তৈরি না হলে তার আয়ু হয় ক্ষণস্থায়ী। ভালো রড-সিমেন্ট দিতে হয়, তাহলেই বিল্ডিং মজবুত হয়। ঝড়-বৃষ্টি এলে শণের ঘর মুহূর্তে খসে পড়ে, উড়িয়ে নিয়ে যায়। পলকা কোনো কিছু টেকে না। ভালো মেধা না থাকলে, বৈষয়িক বুদ্ধি না থাকলে, আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে মানুষ সফল হতে পারে না, ঝরে যায়, খসে পড়ে। আমার ক্ষেত্রে এসবই হওয়ার কথা ছিল। ঝরে যাওয়ারই কথা ছিল। আমি নিজেকে গুছিয়ে এক জায়গায় জড়ো করতে পারিনি। নিজেকে কখনো তৈরি করতে পারিনি। গোটা জীবনটাই প্রিম্যাচিউরড বেবির মতো। মানুষ নিজেকে সবটা গোছাতে পারে না। আমি অনেক স্পর্শকাতর মানুষ। আবেগপ্রবণ মানুষ। এগুলোই আমার সমস্যা। মানুষ তার স্বভাব বদলাতে পারে না। আমিও না। কোনো কিছু গভীরভাবে তলিয়ে ভাবতে পারি না। আবেগের কাছে বাস্তবতা পরাভূত হয়। আমি সামান্য কারণে বেসামাল হই, ভেঙে গুঁড়িয়ে যাই। নিজেকে ভাঙাচোরা কিছু মনে হয়। ভগ্নস্তূপের বাসিন্দা মনে হয়। আমি যা কিছু করিÑএই জীবনযাপন, সংসার, সন্তান, বন্ধুত্ব, আত্মীয়তা, লেখালেখি এর কিছ্ইু মনে হয় আমার জন্য প্রযোজ্য নয়। আমি এর কোনো কিছুর অংশ মাত্র নই। মনে হয় রাগ, দুঃখ, মায়া, অভিমান, প্রেম এসবের ঊর্ধ্বে এক অলৌকিক জীবনে বসবাস করতে পারলে ভালো হতো।
চারদিকে মানুষের এই যে এত আয়োজন, মনে হয় আমি এসবের অংশ নই। প্রতিযোগিতাময় এই পৃথিবী, যুদ্ধ, দখল, খুন, হত্যা, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি, প্রতিযোগিতা, ঈর্ষা, ঘৃণা, ভুল-বোঝাবুঝি, সাফল্য লাভের চেষ্টা-এসব থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারলে ভালো হতো। বাকি যে কদিন বাঁচি, শান্তিতে থাকতে পারলেই ভালো। মনের এসব চঞ্চল ভাবনাই আমাকে কোথাও স্থির হতে দিল না। কখনোই দেবে না। একদিন আমি ঢাকা শহর ছেড়ে দিলাম। চলে এলাম কানাডায় পরিবার নিয়ে। কোনো ঝুঁকির কথা মাথায় আসেনি। জীবনটা সমান তিনভাগে বিভক্ত আমার। বরিশাল-ঢাকা-টরন্টো। টরন্টো শহরে দীর্ঘদিন থেকেও নিজেকে উন্মুল মনে হয়। এখানেও আমি আসলে থিতু নই। নানা কিছু মাথায় আসে এখনো। যেকোনো সময় সবকিছু ফেলে চলে যেতে হবে অজানা কোথাও। সেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। কাফনের কাপড় কেনা আছে। আমি এমনই। কিছুই অনিবার্য নয় পৃথিবীতে। আবেগী বলেই মানুষকে ভালোবাসি, নিজের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলি, আপন মনে করি। নিজেকে উজাড় করে দিই। গোপনীয়তা বলেও কিছু থাকে না। আমার হারানোর কিছু নেই। আড়াল করার কিছু নেই। যাদের আপন করতে চেয়েছি কোনো এক দুর্ভেদ্য কারণে তারা আপন থাকেনি। আবার যাদের আপন মনে করিনি, তারাই আপন হয়েছে। এই রহস্য কিছুতেই ভেদ করতে পারি না। টরন্টো শহরও শেষ পর্যন্ত আমাকে আটকে রাখতে পারবে কি না জানি না। থিতু হতে দেবে কি না জানি না!
টরন্টো আমার টরন্টো!
টরন্টো শহরটা আমার কেমন লাগে? এখানকার মানুষেরা কেমন? এই প্রশ্নটা আমি প্রায়ই করি। অন্য কাউকে করি না। নিজেকে নিজে করি। নিজের সঙ্গে আমার অনেক কথা থাকে। যেহেতু আমার কথা বলার মানুষ কম, তাই নিজের সঙ্গে নিজেই কথা বলি। আমার তেমন কথাও থাকে না। কথার পিঠে কথা একদমই আসে না আমার। কেউ আমাকে কথা দিয়ে আক্রমণ করলে আমি তোতলাতে থাকি। কথা হারিয়ে যায়। তাই যেখানে কথা আছে, সেখানে আমি পারতপক্ষে যাই না। বস্তুত, আমি গর্তজীবী মানুষ। মানুষ অনেক কথা বলে। বলতে ভালোবাসে। নিজের কথাই বলে বেশি। অন্যের কথা শুনতে চায় না। রাস্তাঘাটে, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, সিনেমা হলে, লিভিং রুমে, বক্তৃতার মঞ্চে, লবিতে, পার্কে, পিকনিকে, বাসে, ট্রেনে, প্লেনে, আড্ডায় শুধু কথা আর কথা। কথা জিনিসটা যে কে আবিষ্কার করেছে! বড় ভালো জিনিস। তবে বেশির ভাগই আগডুম বাগডুম। ফেলে দেওয়ার মতো। মাঝে মাঝে দু’একটা ওজনদার কথাও শোনা যায়। তখন মনে হয়, কথা তো নয়, যেন কুন্ডুল! অনেক কথার ভিড়ে আমার কথা তলিয়ে যায়। আমি কিছু বললে তা কারও কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না। অরিত্রি একদিন বলেছিল, ‘মা দেখেছ, বাবা একা একা কথা বলে!’ জেসমিন উত্তরে বলল, ‘মাথায় ছিট আছে, তাই।’ আমি ঘরে যে কথা বলি, প্রায়ই জেসমিন শুনতে পায় না। আমি তখন রেগে যাই। জেসমিন ততোধিক রেগে বলে, মিনমিনা স্বভাবটা বদলাও।
তবে আমি লিখে ভালো বোঝাতে পারি। আমার অবজারভেশন অনেক ভালো। আগামীকাল কী ঘটবে তার একটা আগাম বার্তা পাই প্রায়শই। এ ধরনের অলৌকিক ইমাজিনেশন আমি প্রকৃতি থেকে পেয়েছি। এ কারণে আমি জীবনে অনেক অঘটন থেকে মুক্তি পেয়েছি। কানাডা আসার আগে টরন্টো সম্পর্কে আমার তেমন কোনো ধারণা ছিল না। কানাডা নিয়ে আমি কোনো গবেষণা করিনি। কানাডা আসার আগেও আমি ইউরোপ-আমেরিকা ঘুরেছি। কিন্তু কখনো কোথাও স্থায়ী হওয়ার কথা ভাবিনি। কিন্তু মানুষ যা ভাবে, হয় তার উল্টো। একদিন আকস্মিক আমি পরিবার নিয়ে কানাডায় এলাম। কেন কানাডাকেই বেছে নিয়েছিলাম, কে জানে। কানাডা না হয়ে হতে পারত আমেরিকা, হতে পারত ইংল্যান্ড বা অন্য কোনো দেশ। কিন্তু নিয়তি আমাকে কানাডার মতো মহান একটি দেশে নিয়ে এল। আমি যেহেতু বিচিত্রা বা সাপ্তাহিক ২০০০ এর মতো পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেছি, তাই সাংবাদিক ক্যাটাগরিতে অ্যাপ্লাই করি। ইন্টারভিউ দিয়েছি লস অ্যাঞ্জেলেসে গিয়ে এবং অনায়াসেই কোয়ালিফাই করি। আমি কখনো কারও কাছে দয়াভিক্ষা করিনি। যখন আমার অনেক কষ্টের দিন গেছে, তখনো আমি কারও কাছে হাত পাতিনি। আমি চাইলেই আমেরিকা বা অন্য কোথাও থেকে যেতে পারতাম। কিন্তু সন্তানদের কথা চিন্তা করে কোনো অনিশ্চিত জীবন বেছে নিইনি।
আজ থেকে ২০ বছর আগে যখন এই শহরে পা দিই, তখন আমার চোখে বিরাট কোনো স্বপ্ন ছিল না। আমি শুধু চেয়েছি, আমি যেখানেই থাকব, আমার সন্তানেরা আমার সঙ্গে থাকবে। ওদের ছাড়া আমি থাকতে পারব না। আমি যে ধরনের কষ্টের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছি, আমার সন্তানদের যেন সেটা না পেতে হয়, সেটা আমার মাথায় ছিল। জেসমিন সব সময় আমার সংগ্রামী জীবনের সঙ্গে ছায়ার মতো থেকেছে। কখনো বিরক্ত হয়নি। হাল ছেড়ে দেয়নি। আমি যে শুধু লেখক হতে চেয়েছি, জেসমিন কখনো তাতে বাধা তৈরি করেনি, আমার জগতে কখনো নাক গলায়নি। আমার সন্তানেরাও তা-ই। ওরা আমাকে আমার মতো থাকতে দিয়েছে। আমার কোনো কিছুর সঙ্গে ওরা জড়িয়ে পড়েনি। আমিও স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে চলেছি। কোনো কিছু চাপিয়ে দিইনি। সেটা আমার জন্য ভালোই হয়েছে। আমি নিজে কিছুটা কমিউনিটিবেজ হলেও ওদেরকে এই জগতের নেগেটিভ কোনো কিছু যাতে স্পর্শ না করে, সে ব্যাপারে আমি সচেতন থেকেছি। জেসমিন প্রচণ্ড দূরদর্শী মানুষ। সে টরন্টো পা দিয়েই আবহাওয়া টের পেয়ে যায়।
আমি ২০০৪ সালে টরন্টো আসি। তার আগে এক বছর অটোয়া ছিলাম। ওরা যেমন একদমই কানাডা আসতে চায়নি, তেমনি অটোয়া থেকে টরন্টোও আসতে চায়নি। আমি জোর করে এনেছি। তখন টরন্টোর বাঙালি কমিউনিটি এত বড় ছিল না। এত সংগঠন, সমিতি, রাজনীতি, গ্রুপিং, দলাদলি, এত পত্রিকা, টেলিভিশন ছিল না। টরন্টো এসে আমি একটা নতুন ভুবনের সন্ধান পেলাম। চমৎকার গোছানো একটি শহর। পৃথিবীতে কত শহরই তো দেখেছি কিন্তু টরন্টোর কোনো তুলনা নেই। টরন্টোর রাস্তায় পা দিলেই মনে হয় এটা আমার নিজের শহর। শক্তি ও সাহস পাই। এই শহর কাউকে পর করে না। বিপদগ্রস্ত করে না। উপেক্ষা করে না। একা একা এই শহরে বসবাস করা যায়। এটা এমনই এক শহর, যে শহর যে কাউকে বুকে তুলে নেয়। তবে যত বেশি মানুষের সঙ্গে জড়াবেন, তত বেশি যন্ত্রণাময় হবে জীবন। প্রবাসে সর্বত্র যেটা দেখা যায়, সেটা হচ্ছে যার যেটা বলার কথা নয়, সে যখন সেটা বলছে, যার যা হওয়ার কথা নয়, সে যখন তা হতে চাইছে, তখন এই জাতীয় মানুষের সঙ্গে মানিয়ে চলা কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক ভালো ভালো কর্মকাণ্ডও হচ্ছে এই শহরে। তবে ভালো-মন্দ থাকবেই, কোনো কিছু নিয়েই বিস্মিত হওয়ারও কিছু নেই। সবার সমান স্বাধীনতা। আপনি চাইলেই যে কাউকে উপেক্ষা করতে পারেন। চাইলেই নিজেকে বিরাট কিছু ভাবতে পারেন। জমিদার বলে প্রচার করতে পারেন। চাইলেই কাউকে ছেঁটে ফেলতে পারেন। কেউ আটকাচ্ছে না। তবে সবকিছুই নির্ভর করে মানুষের শিক্ষা, রুচি আর কালচারের ওপর। একাডেমিক এবং পারিবারিক শিক্ষা অনেক বড় ফ্যাক্টর।
জীবনের সবকিছুই একটা অভিজ্ঞতা। কোনো অভিজ্ঞতাই বৃথা যায় না। সবকিছু থেকেই মানুষ শেখে। জীবন এমনই। আমি টরন্টো শহরটাকে ভালোবাসি। এই শহর আমাকে অনেক দিয়েছে। যদিও আমি কোনো কিছুর সঙ্গে জড়িত নই, আমি কোনো সভাপতি বা সেক্রেটারি নই, মঞ্চের লোক নই। মাইকের সামনে দাঁড়ানোর সবিশেষ ইচ্ছা আমার নেই। আমি সামনের আসনের স্যুট-টাই পরাও কেউ নই। আমি সব সময় পেছনের সারির মানুষ। আমাকে কেউ খেয়ালও করে না। সামনের আসনের বড় মানুষেরা পেছনের মানুষদের দেখতে পায় না। সেটা আমার জন্য স্বস্তির। আমি বড় মানুষদের সামনে একদমই সহজ হতে পারি না। তাদের মধ্যে কী একটা যেন ব্যাপার আছে, যা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। আমার দম বন্ধ লাগে।
আমি কোনো কিছু পাওয়ার জন্য কারও কাছে ধরনা দিইনি। পৃথিবীতে কিছুই আমার কাছে অনিবার্য মনে হয় না। এটা না পেলে আমি বাঁচব না, ওটা না হলে আমার চলবে না, এমন মনে হয় না। জীবনে অনেক কিছুই পাব না, তাই বলে জীবন বৃথা হয়ে যাবে না। জীবনে যা পেয়েছি, তাও তো কম নয়। এত পাওয়ার কথা ছিল না। বেশি পেয়েছি মানুষের ভালোবাসা। সামান্য উপেক্ষা ভালোবাসার কাছে নস্যি। ওসব গায়ে না মাখলেও চলে। গত পনেরো বছর ধরে টরন্টো বইমেলায় আমার বই বেস্ট সেলের তালিকায় থেকেছে। আমি যেহেতু লেখকই হতে চেয়েছি, তাই এটা আমার জীবনে বড় প্রাপ্তি। কবি আল মাহমুদ বলেছেন, লেখকদের বেশি সামাজিক হতে নেই, এতে লেখক-সত্ত্বা নষ্ট হয়, এটা আমি মেনে চলি।
সেদিন বিকেলে
তত দিনে জেসমিনের সঙ্গে আমার জমে উঠেছে। ক্যাম্পাসে আমাদের প্রথম পরিচয়টা ছিল যথেষ্ট নাটকীয়। সে গল্প আগেও করেছি। একমাত্র সিনেমাতেই এ রকম হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসীন হলে থাকি আমি। খুব টানাটানির মধ্যে আমার দিন চলে। বিচিত্রায় কাজ করে যা পাই, তাতে চলে না। মাঝে মাঝে না খেয়েও থাকি। তাতে মাইন্ড করি না। ডাক্তারি শাস্ত্রে আছে, না খেয়ে কেউ মরে না। সো ওসব নিয়ে না ভাবলেও চলে। হলের বিস্বাদ খাওয়া একদমই খেতে পারি না। পাতলা ডাল থেকে বিটকেল গন্ধ আসে। চালও অতি নিম্নমানের, অর্ধেকই নুড়ি পাথর। অবশেষে একদিন সিঙ্গেল রুমে মুভ হলাম। একটি ছেলে হায়ার করলাম। চুলা, কিছু হাঁড়ি-পাতিল জোগাড় হলো। রুমেই রান্নাবান্না শুরু হলো। মোটামুটি বেঁচে গেলাম। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়েছে জেসমিনের জন্যই। ওই সব অ্যারেঞ্জমেন্ট করে দিয়েছিল। খায়খরচাপাতি পর্যন্ত দিত। মাঝে মাঝে ওদের বাড়ির খাবারও আসত। গরম গরম খিচুড়ি আর গরুর মাংস এসেছিল একদিন। প্রথম দিনটার কথা মনে আছে আজও। ওসব ভোলা যায় না। ক্লাসের পর লাইব্রেরির চিপায় দেখা হতো আমাদের। একটা টিফিন বক্সে চিকেন নিয়ে এল জেসমিন। বলল, কখনো রান্না করিনি। আজকে প্র্যাকটিস করলাম। জানি না কেমন হয়েছে।
ইউ টেল মি হাউ ইট ইজ!
আমি খেতে খেতে বললাম, ওয়ান অব দ্য বেস্ট চিকেন আই হ্যাভ এভার টেস্টেড।
তখন বিকেল হয়ে সন্ধ্যা নেমে গেছে। ওই অল্প আলোতেই দেখলাম, জেসমিন লজ্জা পেয়ে আলতো করে আমার কাঁধের কাছে মাথা ঠেকিয়ে হাসছিল। কেমন যেন একটা নেশা ধরা ভ্যানিলার গন্ধ পেলাম আমি। একটু অবাক হয়ে তাকালাম ওর দিকে। মাথার ওপর দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে ছিল লাইব্রেরি ভবনটা। দূরে গুনগুন শব্দ করে জ্বলছিল হলুদ আলো। আর আবছা ক্যাম্পাসে সন্ধ্যা নেমে আসছিল মৃদু পায়ে।
সেই সন্ধ্যায় আচমকা আমার মনে হলো, জেসমিন এত সুন্দর। ওর মন, ব্যবহার এত ভালো। ও আমার কাছে বসে রয়েছে। আমি খাওয়া থামিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে।
জেসমিন নিজের মনে কত কথা বলে যাচ্ছিল। ওরা মহাখালীর বাসিন্দা। বাবা পাবলিক হেলথে চাকরি করেন। মা স্কুলে পড়ান। আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেছেÑএই সব কথা...।
আমি কিছুটা শুনছিলাম, কিছুটা খাচ্ছিলাম। আর এসবের মাঝে অস্বস্তিকর একটা প্রশ্ন খোঁচাচ্ছিল আমাকে, যে মেয়ের পেছনে এত বিশাল লাইন, সে আমার সঙ্গে বিকেলবেলাগুলো কাটায় কেন!
আচমকা চিকেন কেমন যেন স্বাদ হারাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এই বিশাল অন্ধকারের ওদিকে এমন কিছু ঘটেছে, যা আমি বুঝতে পারছি না বা বুঝতে পারলেও চাইছি না। মানতে চাইছি না এমন একটা মেয়ে আমার জন্য...। না না, ধুর এসব হতে পারে না। সপ্তাহ, দিন, মাস কাটছিল এভাবে। লুকিয়ে-চুরিয়ে আমাদের দেখাশোনাগুলো বাড়ছিল ক্রমশ। সেটা ছিল নভেম্বরের একটা নির্জন দুপুর ও বিকেলের মাঝামাঝি। চিড়িয়াখানার আশপাশে কী দারুণ হাওয়া ছিল সেদিন। বড় বড় দেবদারু আর ইউক্যালিপটাসের পাতার ফাঁক দিয়ে নেমে আসছিল ঝিরিঝিরি রোদ্দুর। পাখির ডাক আর বহতা জলের শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছিল না।
সদা হাস্যোজ্জ্বল জেসমিন সেদিন অন্য দিনের চেয়ে বেশ একটু চুপচাপ ছিল। কিন্তু আমি ওসব একটা পাত্তা দিইনি। এই নির্জনতার মধ্যে আমার মনে হয়েছিল কী হবে বিশ্ববিদ্যালয় পাস করে! আমি তো আসলে শুধু লিখতে চাই। কোনো দিন সংসারী হব না। মাকেও বলেছি, মা, আমি কোনো দিন বিয়ে করব না। আমার কোনো উচ্চাকাক্সক্ষা নাই। আমি ঝরনার এক পাশে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে শুষে নিচ্ছিলাম ওই আলো, ওই হাওয়া আর জলের শব্দ।
হঠাৎ তাকিয়ে দেখি জেসমিনের চোখে পানি। ওর নরম হাতটা ধরে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে? হোয়াই ইউ ক্রাইং?
জেসমিনের মুখটা লাল হয়ে ছিল। নাকের ডগাটা মুছে বলল, আমার বিয়ের সম্বন্ধ আসতেছে। ও একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে আসা ঝিলমিলে রোদ এসে পড়ছে ওর মুখে-কাঁধে। নীল চুড়িদারের ওপর। আর হাওয়া দিচ্ছে খুব। হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে চুল। আমার মধ্যে কী যে হয়ে গেল। আমার নিজের ওপর নিজেরই কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকল না। আমি আলতো করে আবার ধরেছিলাম ওর হাত। একা থাকার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হলো আমাকে সেদিন...। -টরন্টো
একটা বিল্ডিং শক্ত-পোক্তভাবে তৈরি না হলে তার আয়ু হয় ক্ষণস্থায়ী। ভালো রড-সিমেন্ট দিতে হয়, তাহলেই বিল্ডিং মজবুত হয়। ঝড়-বৃষ্টি এলে শণের ঘর মুহূর্তে খসে পড়ে, উড়িয়ে নিয়ে যায়। পলকা কোনো কিছু টেকে না। ভালো মেধা না থাকলে, বৈষয়িক বুদ্ধি না থাকলে, আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে মানুষ সফল হতে পারে না, ঝরে যায়, খসে পড়ে। আমার ক্ষেত্রে এসবই হওয়ার কথা ছিল। ঝরে যাওয়ারই কথা ছিল। আমি নিজেকে গুছিয়ে এক জায়গায় জড়ো করতে পারিনি। নিজেকে কখনো তৈরি করতে পারিনি। গোটা জীবনটাই প্রিম্যাচিউরড বেবির মতো। মানুষ নিজেকে সবটা গোছাতে পারে না। আমি অনেক স্পর্শকাতর মানুষ। আবেগপ্রবণ মানুষ। এগুলোই আমার সমস্যা। মানুষ তার স্বভাব বদলাতে পারে না। আমিও না। কোনো কিছু গভীরভাবে তলিয়ে ভাবতে পারি না। আবেগের কাছে বাস্তবতা পরাভূত হয়। আমি সামান্য কারণে বেসামাল হই, ভেঙে গুঁড়িয়ে যাই। নিজেকে ভাঙাচোরা কিছু মনে হয়। ভগ্নস্তূপের বাসিন্দা মনে হয়। আমি যা কিছু করিÑএই জীবনযাপন, সংসার, সন্তান, বন্ধুত্ব, আত্মীয়তা, লেখালেখি এর কিছ্ইু মনে হয় আমার জন্য প্রযোজ্য নয়। আমি এর কোনো কিছুর অংশ মাত্র নই। মনে হয় রাগ, দুঃখ, মায়া, অভিমান, প্রেম এসবের ঊর্ধ্বে এক অলৌকিক জীবনে বসবাস করতে পারলে ভালো হতো।
চারদিকে মানুষের এই যে এত আয়োজন, মনে হয় আমি এসবের অংশ নই। প্রতিযোগিতাময় এই পৃথিবী, যুদ্ধ, দখল, খুন, হত্যা, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি, প্রতিযোগিতা, ঈর্ষা, ঘৃণা, ভুল-বোঝাবুঝি, সাফল্য লাভের চেষ্টা-এসব থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারলে ভালো হতো। বাকি যে কদিন বাঁচি, শান্তিতে থাকতে পারলেই ভালো। মনের এসব চঞ্চল ভাবনাই আমাকে কোথাও স্থির হতে দিল না। কখনোই দেবে না। একদিন আমি ঢাকা শহর ছেড়ে দিলাম। চলে এলাম কানাডায় পরিবার নিয়ে। কোনো ঝুঁকির কথা মাথায় আসেনি। জীবনটা সমান তিনভাগে বিভক্ত আমার। বরিশাল-ঢাকা-টরন্টো। টরন্টো শহরে দীর্ঘদিন থেকেও নিজেকে উন্মুল মনে হয়। এখানেও আমি আসলে থিতু নই। নানা কিছু মাথায় আসে এখনো। যেকোনো সময় সবকিছু ফেলে চলে যেতে হবে অজানা কোথাও। সেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। কাফনের কাপড় কেনা আছে। আমি এমনই। কিছুই অনিবার্য নয় পৃথিবীতে। আবেগী বলেই মানুষকে ভালোবাসি, নিজের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলি, আপন মনে করি। নিজেকে উজাড় করে দিই। গোপনীয়তা বলেও কিছু থাকে না। আমার হারানোর কিছু নেই। আড়াল করার কিছু নেই। যাদের আপন করতে চেয়েছি কোনো এক দুর্ভেদ্য কারণে তারা আপন থাকেনি। আবার যাদের আপন মনে করিনি, তারাই আপন হয়েছে। এই রহস্য কিছুতেই ভেদ করতে পারি না। টরন্টো শহরও শেষ পর্যন্ত আমাকে আটকে রাখতে পারবে কি না জানি না। থিতু হতে দেবে কি না জানি না!
টরন্টো আমার টরন্টো!
টরন্টো শহরটা আমার কেমন লাগে? এখানকার মানুষেরা কেমন? এই প্রশ্নটা আমি প্রায়ই করি। অন্য কাউকে করি না। নিজেকে নিজে করি। নিজের সঙ্গে আমার অনেক কথা থাকে। যেহেতু আমার কথা বলার মানুষ কম, তাই নিজের সঙ্গে নিজেই কথা বলি। আমার তেমন কথাও থাকে না। কথার পিঠে কথা একদমই আসে না আমার। কেউ আমাকে কথা দিয়ে আক্রমণ করলে আমি তোতলাতে থাকি। কথা হারিয়ে যায়। তাই যেখানে কথা আছে, সেখানে আমি পারতপক্ষে যাই না। বস্তুত, আমি গর্তজীবী মানুষ। মানুষ অনেক কথা বলে। বলতে ভালোবাসে। নিজের কথাই বলে বেশি। অন্যের কথা শুনতে চায় না। রাস্তাঘাটে, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, সিনেমা হলে, লিভিং রুমে, বক্তৃতার মঞ্চে, লবিতে, পার্কে, পিকনিকে, বাসে, ট্রেনে, প্লেনে, আড্ডায় শুধু কথা আর কথা। কথা জিনিসটা যে কে আবিষ্কার করেছে! বড় ভালো জিনিস। তবে বেশির ভাগই আগডুম বাগডুম। ফেলে দেওয়ার মতো। মাঝে মাঝে দু’একটা ওজনদার কথাও শোনা যায়। তখন মনে হয়, কথা তো নয়, যেন কুন্ডুল! অনেক কথার ভিড়ে আমার কথা তলিয়ে যায়। আমি কিছু বললে তা কারও কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না। অরিত্রি একদিন বলেছিল, ‘মা দেখেছ, বাবা একা একা কথা বলে!’ জেসমিন উত্তরে বলল, ‘মাথায় ছিট আছে, তাই।’ আমি ঘরে যে কথা বলি, প্রায়ই জেসমিন শুনতে পায় না। আমি তখন রেগে যাই। জেসমিন ততোধিক রেগে বলে, মিনমিনা স্বভাবটা বদলাও।
তবে আমি লিখে ভালো বোঝাতে পারি। আমার অবজারভেশন অনেক ভালো। আগামীকাল কী ঘটবে তার একটা আগাম বার্তা পাই প্রায়শই। এ ধরনের অলৌকিক ইমাজিনেশন আমি প্রকৃতি থেকে পেয়েছি। এ কারণে আমি জীবনে অনেক অঘটন থেকে মুক্তি পেয়েছি। কানাডা আসার আগে টরন্টো সম্পর্কে আমার তেমন কোনো ধারণা ছিল না। কানাডা নিয়ে আমি কোনো গবেষণা করিনি। কানাডা আসার আগেও আমি ইউরোপ-আমেরিকা ঘুরেছি। কিন্তু কখনো কোথাও স্থায়ী হওয়ার কথা ভাবিনি। কিন্তু মানুষ যা ভাবে, হয় তার উল্টো। একদিন আকস্মিক আমি পরিবার নিয়ে কানাডায় এলাম। কেন কানাডাকেই বেছে নিয়েছিলাম, কে জানে। কানাডা না হয়ে হতে পারত আমেরিকা, হতে পারত ইংল্যান্ড বা অন্য কোনো দেশ। কিন্তু নিয়তি আমাকে কানাডার মতো মহান একটি দেশে নিয়ে এল। আমি যেহেতু বিচিত্রা বা সাপ্তাহিক ২০০০ এর মতো পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেছি, তাই সাংবাদিক ক্যাটাগরিতে অ্যাপ্লাই করি। ইন্টারভিউ দিয়েছি লস অ্যাঞ্জেলেসে গিয়ে এবং অনায়াসেই কোয়ালিফাই করি। আমি কখনো কারও কাছে দয়াভিক্ষা করিনি। যখন আমার অনেক কষ্টের দিন গেছে, তখনো আমি কারও কাছে হাত পাতিনি। আমি চাইলেই আমেরিকা বা অন্য কোথাও থেকে যেতে পারতাম। কিন্তু সন্তানদের কথা চিন্তা করে কোনো অনিশ্চিত জীবন বেছে নিইনি।
আজ থেকে ২০ বছর আগে যখন এই শহরে পা দিই, তখন আমার চোখে বিরাট কোনো স্বপ্ন ছিল না। আমি শুধু চেয়েছি, আমি যেখানেই থাকব, আমার সন্তানেরা আমার সঙ্গে থাকবে। ওদের ছাড়া আমি থাকতে পারব না। আমি যে ধরনের কষ্টের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছি, আমার সন্তানদের যেন সেটা না পেতে হয়, সেটা আমার মাথায় ছিল। জেসমিন সব সময় আমার সংগ্রামী জীবনের সঙ্গে ছায়ার মতো থেকেছে। কখনো বিরক্ত হয়নি। হাল ছেড়ে দেয়নি। আমি যে শুধু লেখক হতে চেয়েছি, জেসমিন কখনো তাতে বাধা তৈরি করেনি, আমার জগতে কখনো নাক গলায়নি। আমার সন্তানেরাও তা-ই। ওরা আমাকে আমার মতো থাকতে দিয়েছে। আমার কোনো কিছুর সঙ্গে ওরা জড়িয়ে পড়েনি। আমিও স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে চলেছি। কোনো কিছু চাপিয়ে দিইনি। সেটা আমার জন্য ভালোই হয়েছে। আমি নিজে কিছুটা কমিউনিটিবেজ হলেও ওদেরকে এই জগতের নেগেটিভ কোনো কিছু যাতে স্পর্শ না করে, সে ব্যাপারে আমি সচেতন থেকেছি। জেসমিন প্রচণ্ড দূরদর্শী মানুষ। সে টরন্টো পা দিয়েই আবহাওয়া টের পেয়ে যায়।
আমি ২০০৪ সালে টরন্টো আসি। তার আগে এক বছর অটোয়া ছিলাম। ওরা যেমন একদমই কানাডা আসতে চায়নি, তেমনি অটোয়া থেকে টরন্টোও আসতে চায়নি। আমি জোর করে এনেছি। তখন টরন্টোর বাঙালি কমিউনিটি এত বড় ছিল না। এত সংগঠন, সমিতি, রাজনীতি, গ্রুপিং, দলাদলি, এত পত্রিকা, টেলিভিশন ছিল না। টরন্টো এসে আমি একটা নতুন ভুবনের সন্ধান পেলাম। চমৎকার গোছানো একটি শহর। পৃথিবীতে কত শহরই তো দেখেছি কিন্তু টরন্টোর কোনো তুলনা নেই। টরন্টোর রাস্তায় পা দিলেই মনে হয় এটা আমার নিজের শহর। শক্তি ও সাহস পাই। এই শহর কাউকে পর করে না। বিপদগ্রস্ত করে না। উপেক্ষা করে না। একা একা এই শহরে বসবাস করা যায়। এটা এমনই এক শহর, যে শহর যে কাউকে বুকে তুলে নেয়। তবে যত বেশি মানুষের সঙ্গে জড়াবেন, তত বেশি যন্ত্রণাময় হবে জীবন। প্রবাসে সর্বত্র যেটা দেখা যায়, সেটা হচ্ছে যার যেটা বলার কথা নয়, সে যখন সেটা বলছে, যার যা হওয়ার কথা নয়, সে যখন তা হতে চাইছে, তখন এই জাতীয় মানুষের সঙ্গে মানিয়ে চলা কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক ভালো ভালো কর্মকাণ্ডও হচ্ছে এই শহরে। তবে ভালো-মন্দ থাকবেই, কোনো কিছু নিয়েই বিস্মিত হওয়ারও কিছু নেই। সবার সমান স্বাধীনতা। আপনি চাইলেই যে কাউকে উপেক্ষা করতে পারেন। চাইলেই নিজেকে বিরাট কিছু ভাবতে পারেন। জমিদার বলে প্রচার করতে পারেন। চাইলেই কাউকে ছেঁটে ফেলতে পারেন। কেউ আটকাচ্ছে না। তবে সবকিছুই নির্ভর করে মানুষের শিক্ষা, রুচি আর কালচারের ওপর। একাডেমিক এবং পারিবারিক শিক্ষা অনেক বড় ফ্যাক্টর।
জীবনের সবকিছুই একটা অভিজ্ঞতা। কোনো অভিজ্ঞতাই বৃথা যায় না। সবকিছু থেকেই মানুষ শেখে। জীবন এমনই। আমি টরন্টো শহরটাকে ভালোবাসি। এই শহর আমাকে অনেক দিয়েছে। যদিও আমি কোনো কিছুর সঙ্গে জড়িত নই, আমি কোনো সভাপতি বা সেক্রেটারি নই, মঞ্চের লোক নই। মাইকের সামনে দাঁড়ানোর সবিশেষ ইচ্ছা আমার নেই। আমি সামনের আসনের স্যুট-টাই পরাও কেউ নই। আমি সব সময় পেছনের সারির মানুষ। আমাকে কেউ খেয়ালও করে না। সামনের আসনের বড় মানুষেরা পেছনের মানুষদের দেখতে পায় না। সেটা আমার জন্য স্বস্তির। আমি বড় মানুষদের সামনে একদমই সহজ হতে পারি না। তাদের মধ্যে কী একটা যেন ব্যাপার আছে, যা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। আমার দম বন্ধ লাগে।
আমি কোনো কিছু পাওয়ার জন্য কারও কাছে ধরনা দিইনি। পৃথিবীতে কিছুই আমার কাছে অনিবার্য মনে হয় না। এটা না পেলে আমি বাঁচব না, ওটা না হলে আমার চলবে না, এমন মনে হয় না। জীবনে অনেক কিছুই পাব না, তাই বলে জীবন বৃথা হয়ে যাবে না। জীবনে যা পেয়েছি, তাও তো কম নয়। এত পাওয়ার কথা ছিল না। বেশি পেয়েছি মানুষের ভালোবাসা। সামান্য উপেক্ষা ভালোবাসার কাছে নস্যি। ওসব গায়ে না মাখলেও চলে। গত পনেরো বছর ধরে টরন্টো বইমেলায় আমার বই বেস্ট সেলের তালিকায় থেকেছে। আমি যেহেতু লেখকই হতে চেয়েছি, তাই এটা আমার জীবনে বড় প্রাপ্তি। কবি আল মাহমুদ বলেছেন, লেখকদের বেশি সামাজিক হতে নেই, এতে লেখক-সত্ত্বা নষ্ট হয়, এটা আমি মেনে চলি।
সেদিন বিকেলে
তত দিনে জেসমিনের সঙ্গে আমার জমে উঠেছে। ক্যাম্পাসে আমাদের প্রথম পরিচয়টা ছিল যথেষ্ট নাটকীয়। সে গল্প আগেও করেছি। একমাত্র সিনেমাতেই এ রকম হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসীন হলে থাকি আমি। খুব টানাটানির মধ্যে আমার দিন চলে। বিচিত্রায় কাজ করে যা পাই, তাতে চলে না। মাঝে মাঝে না খেয়েও থাকি। তাতে মাইন্ড করি না। ডাক্তারি শাস্ত্রে আছে, না খেয়ে কেউ মরে না। সো ওসব নিয়ে না ভাবলেও চলে। হলের বিস্বাদ খাওয়া একদমই খেতে পারি না। পাতলা ডাল থেকে বিটকেল গন্ধ আসে। চালও অতি নিম্নমানের, অর্ধেকই নুড়ি পাথর। অবশেষে একদিন সিঙ্গেল রুমে মুভ হলাম। একটি ছেলে হায়ার করলাম। চুলা, কিছু হাঁড়ি-পাতিল জোগাড় হলো। রুমেই রান্নাবান্না শুরু হলো। মোটামুটি বেঁচে গেলাম। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়েছে জেসমিনের জন্যই। ওই সব অ্যারেঞ্জমেন্ট করে দিয়েছিল। খায়খরচাপাতি পর্যন্ত দিত। মাঝে মাঝে ওদের বাড়ির খাবারও আসত। গরম গরম খিচুড়ি আর গরুর মাংস এসেছিল একদিন। প্রথম দিনটার কথা মনে আছে আজও। ওসব ভোলা যায় না। ক্লাসের পর লাইব্রেরির চিপায় দেখা হতো আমাদের। একটা টিফিন বক্সে চিকেন নিয়ে এল জেসমিন। বলল, কখনো রান্না করিনি। আজকে প্র্যাকটিস করলাম। জানি না কেমন হয়েছে।
ইউ টেল মি হাউ ইট ইজ!
আমি খেতে খেতে বললাম, ওয়ান অব দ্য বেস্ট চিকেন আই হ্যাভ এভার টেস্টেড।
তখন বিকেল হয়ে সন্ধ্যা নেমে গেছে। ওই অল্প আলোতেই দেখলাম, জেসমিন লজ্জা পেয়ে আলতো করে আমার কাঁধের কাছে মাথা ঠেকিয়ে হাসছিল। কেমন যেন একটা নেশা ধরা ভ্যানিলার গন্ধ পেলাম আমি। একটু অবাক হয়ে তাকালাম ওর দিকে। মাথার ওপর দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে ছিল লাইব্রেরি ভবনটা। দূরে গুনগুন শব্দ করে জ্বলছিল হলুদ আলো। আর আবছা ক্যাম্পাসে সন্ধ্যা নেমে আসছিল মৃদু পায়ে।
সেই সন্ধ্যায় আচমকা আমার মনে হলো, জেসমিন এত সুন্দর। ওর মন, ব্যবহার এত ভালো। ও আমার কাছে বসে রয়েছে। আমি খাওয়া থামিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে।
জেসমিন নিজের মনে কত কথা বলে যাচ্ছিল। ওরা মহাখালীর বাসিন্দা। বাবা পাবলিক হেলথে চাকরি করেন। মা স্কুলে পড়ান। আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেছেÑএই সব কথা...।
আমি কিছুটা শুনছিলাম, কিছুটা খাচ্ছিলাম। আর এসবের মাঝে অস্বস্তিকর একটা প্রশ্ন খোঁচাচ্ছিল আমাকে, যে মেয়ের পেছনে এত বিশাল লাইন, সে আমার সঙ্গে বিকেলবেলাগুলো কাটায় কেন!
আচমকা চিকেন কেমন যেন স্বাদ হারাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এই বিশাল অন্ধকারের ওদিকে এমন কিছু ঘটেছে, যা আমি বুঝতে পারছি না বা বুঝতে পারলেও চাইছি না। মানতে চাইছি না এমন একটা মেয়ে আমার জন্য...। না না, ধুর এসব হতে পারে না। সপ্তাহ, দিন, মাস কাটছিল এভাবে। লুকিয়ে-চুরিয়ে আমাদের দেখাশোনাগুলো বাড়ছিল ক্রমশ। সেটা ছিল নভেম্বরের একটা নির্জন দুপুর ও বিকেলের মাঝামাঝি। চিড়িয়াখানার আশপাশে কী দারুণ হাওয়া ছিল সেদিন। বড় বড় দেবদারু আর ইউক্যালিপটাসের পাতার ফাঁক দিয়ে নেমে আসছিল ঝিরিঝিরি রোদ্দুর। পাখির ডাক আর বহতা জলের শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছিল না।
সদা হাস্যোজ্জ্বল জেসমিন সেদিন অন্য দিনের চেয়ে বেশ একটু চুপচাপ ছিল। কিন্তু আমি ওসব একটা পাত্তা দিইনি। এই নির্জনতার মধ্যে আমার মনে হয়েছিল কী হবে বিশ্ববিদ্যালয় পাস করে! আমি তো আসলে শুধু লিখতে চাই। কোনো দিন সংসারী হব না। মাকেও বলেছি, মা, আমি কোনো দিন বিয়ে করব না। আমার কোনো উচ্চাকাক্সক্ষা নাই। আমি ঝরনার এক পাশে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে শুষে নিচ্ছিলাম ওই আলো, ওই হাওয়া আর জলের শব্দ।
হঠাৎ তাকিয়ে দেখি জেসমিনের চোখে পানি। ওর নরম হাতটা ধরে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে? হোয়াই ইউ ক্রাইং?
জেসমিনের মুখটা লাল হয়ে ছিল। নাকের ডগাটা মুছে বলল, আমার বিয়ের সম্বন্ধ আসতেছে। ও একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে আসা ঝিলমিলে রোদ এসে পড়ছে ওর মুখে-কাঁধে। নীল চুড়িদারের ওপর। আর হাওয়া দিচ্ছে খুব। হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে চুল। আমার মধ্যে কী যে হয়ে গেল। আমার নিজের ওপর নিজেরই কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকল না। আমি আলতো করে আবার ধরেছিলাম ওর হাত। একা থাকার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হলো আমাকে সেদিন...। -টরন্টো