ভালোবাসা কখনো মরে না!

প্রকাশ : ১০ এপ্রিল ২০২৫, ১৯:৫৩ , অনলাইন ভার্সন
‘Our souls at night’ মুভিটা ২০১৭ সালে প্রথম দেখেছিলাম। আবার দেখলাম আজ। দেখতে দেখতে হঠাৎ মনটা কেমন উদাস হয়ে গেল। জেন ফন্ডা আর রবার্ট রেডফোর্ডের অসাধারণ মুভি। মানুষের বয়স হয়ে গেলে মানুষ কতটা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে, বিশেষ করে নর্থ আমেরিকায়, স্বামী বা স্ত্রী হয়তো ছেড়ে চলে গেছে বা মারা গেছে, কিন্তু কেউ আর কখনোই বিয়ে করেনি। একসময় তারা সঙ্গী খোঁজে। মানুষ একা বাঁচতে পারে না। মানুষের সঙ্গী দরকার। তাই তো এসব দেশে অধিকাংশ বাড়িতে কুকুর বা বিড়াল পোষে। কুকুর-বিড়াল কি মানুষের চেয়েও ভালো সঙ্গী! কে জানে। মানুষ কি আসলে মনের মতো সঙ্গী পায়! সারা জীবনেও কি পায়! দুই নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ মানব-মানবীর পরস্পরের সঙ্গী হতে চেষ্টা করার এক যন্ত্রণাময় অভিজ্ঞতার অনবদ্য কাহিনি। ছবিটা যখন আবার দেখছিলাম, তখন জেসমিন একটু দূরে বসে কাজ করছিল। আমি জেসমিনকে খেয়াল করছিলাম। এটা আমার অভ্যাস। আমি সব সময় মানুষকে খুব খেয়াল করি। যেখানেই যাই, সেখানেই মানুষ দেখি। মানুষের অভিব্যক্তি, স্টাইল লক্ষ করি। এমনও হয়, কোনো আড্ডা বা কোনো অনুষ্ঠানে জ্ঞানগর্ভ কথা হচ্ছে, আমি আনমনা হয়ে মানুষ দেখতে লেগে যাই বা হয়তো বক্তার ঠোঁট নড়া দেখছি কিন্তু সে কী বলছে শুনতে পাইনি। হয়তো তার কথা না শুনে আমি বিরাট কিছু মিস করেছি। কখনো যদি কেউ জানতে চায় বক্তা কী বলেছিল, আমি বলতে না পেরে লজ্জা পাব নির্ঘাত।
আমি আমার ছেলেমেয়েকেও খেয়াল করতাম। এখনো করি। ওরা যখন শিশু ছিল তখন থেকে। ওদের কেমন করে পরিবর্তন ঘটছে, বেড়ে উঠছে, এটা আমি খুব আগ্রহ নিয়ে লক্ষ করতাম। এই যে অর্ক এখন নিজেই সংসার করছে, চাকরি, বাড়ি, গাড়ি হয়েছে, ওর মধ্যে কী কী পরিবর্তন হচ্ছে, সেগুলো আমি খুব গভীর মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করি। আমাদের সঙ্গে ওর আচরণ বদলেছে কি না, সেগুলো খেয়াল রাখি। অরিত্রির ক্ষেত্রেও তা-ই। সে ২০১৭-তে মাত্রই পোস্ট গ্রেড শেষ করে চাকরিতে জয়েন করেছে। নতুন চাকরি তার কেমন লাগছে, সেটা জানার চেষ্টা করতাম বা তার ভবিষ্যৎ প্ল্যান কী। কী ভাবছে নিজেকে নিয়ে। আমাদের কী চোখে দেখে তাও। এখনো বোঝার চেষ্টা করি দিনে দিনে কতখানি বদলেছে। তবে কোনো চাপ সৃষ্টি করিনি কখনো আমি। ওদেরকে ওদের মতো বড় হতে, ওদের মতো থাকতে দিতে পছন্দ করি সব সময়। ওরাও চায় বাবা তার মতো থাক। কিন্তু জেসমিন সব সময় কন্ট্রোল করতে চায়।
আমি আমার পরিবর্তন বুঝতে পারি। নিজের পরিবর্তনগুলো টের পাওয়া যায়। শৈশবকাল থেকেই আমি এমনি বেড়ে উঠেছি। আমাকে অন্য কেউ কখনো খেয়াল করেনি। প্রকৃতির মাঝে ছিল আমার বেড়ে ওঠা। এখনো যখন কোথাও যাই, নিজের মনে থাকি। হাঁটি, ঘুরে বেড়াই, গাড়ি নিয়ে চলে যাই দূরে কোথাও। পার্কে বা কোনো লেকের কাছে। চেনা মানুষের সঙ্গে দেখা হলে এড়িয়ে যাই। কী না কী বলবে! হঠাৎ কেউ এমন একটা মন্তব্য করে বসবে, যা অপ্রত্যাশিত। আমি নিতে পারব না। আজকাল যেমন বেশির ভাগ মানুষ বলে, জসিম অনেক শুকিয়ে গেছেন! চেহারা খারাপ হয়ে গেছে। ঘটনা কী! আমি তাৎক্ষণিক কোনো উত্তর খুঁজে পাই না। একটু হেসে বলি, হ্যাঁ, ডায়াবেটিস তো, একটু কন্ট্রোল করে চলতে হয়। নিজেকে আয়নায় দেখে চমকে যাই। সত্যি এই আমি কি সেই আমি! অচেনা একজন আমি মনে হয়। প্রতিদিন একটু একটু করে নিজের কাছে নিজে অচেনা হই। অন্যদের ক্ষেত্রেও এমন মনে হয় আমার। খুব চেনা কাউকে হঠাৎ আবিষ্কার করি, আরে মানুষটা তো কেমন বুড়োটে হয়ে গেছে! গাল বসে গেছে, চুলে পাক ধরেছে বা কোনো সুবেশী নারীর কড়া মেকআপেও ঢাকা পড়েনি তার চামড়ার লুকোনো ভাঁজ। এভাবেই আমরা ‘আওয়ার সোলস অ্যাট নাইট’ মুভির মতো হয়ে যাচ্ছি।
আমার কথা বলার বেশি মানুষ নেই বলে আমি একা কথা বলি। একা কথা বলতে আমার খারাপ লাগে না। একদিন অরিত্রি বলল, বাবা একা একা কথা বলে দেখেছ, মামণি! জেসমিন বলল, মাথা খারাপ মানুষ তো, তাই। স্ত্রীরা এমনই। সবকিছুতেই স্বামীর দোষ ধরে। আমি মুভিটা দেখতে দেখতে জেসমিনকে বললাম, সুন্দর মুভি, আসো দেখি। দুই বৃদ্ধ মানুষের গল্প। জেসমিন বলল, বৃদ্ধদের ছবি দেখছ কেন! বুড়ো হয়ে গেছ, সে জন্য! আমি বললাম, হুম। দেখো না কত ধরনের ব্যথায় ভুগছি, ব্যাক পেইন, ফুট পেইন, ডায়াবেটিস...। কেউ কারও কষ্ট বোঝে না, বুঝেছ! স্ত্রীরাও বোঝে না। শুধু দোষ ধরতে পারে। স্বামী ছাড়া পৃথিবীর সব ভালো। জেসমিন অবশ্য হিউমার নিতে পারে না। সিরিয়াস হয়ে যায়। আজও হলো। বলল, পুষ্টিকর খাওয়াদাওয়া করো নাই তো ছোটবেলায়, তাই নানা অসুখ। আমি কথা না বাড়িয়ে নিজের ঘরে চলে আসি। ছবিটা মন থেকে তাড়াতে পারছি না সেই তখন থেকে। বয়স কোনো ব্যাপার না আসলে। মনই আসল। একটা সুন্দর মন জীবনকে আনন্দময় করে তুলতে পারে। মনের দিক থেকে আমি খুবই রোমান্টিক। জেসমিন যে কেন তা বোঝে না! নিজেকে নিজে সান্ত্বনা দিই...।
অবসরে ফেসবুকে নিউজ ফিড দেখি। বন্ধুদের সুন্দর সুন্দর স্ট্যাটাস পড়ি। কারও কারও লেখা পড়ে মন ভালো হয়ে যায়। দুই লাইনের কোনো পোস্ট বা কবিতার লাইন, তাও কত হৃদয়গ্রাহী। এখন অবশ্য খুব ঝগড়া-ফ্যাসাদ চলছে। তীব্র মতভেদ, গালাগালি পর্যন্ত। আমার খুব ক্লান্তি লাগে। কখনো কখনো আমার লেখায় যারা কমেন্টস করেন, সেগুলো মন দিয়ে পড়ি আর ভাবি, এই আমি যদি কাল না থাকি, তাহলে কেউ আমার ফেসবুক খুলবে না। আমার পাসওয়ার্ড জানা নেই কারও। আমাকে অনলাইনে দেখবে না আর। যারা আমার লেখা পছন্দ করত না, তারা হয়তো খুশি হবে। কেউ হয়তো দু’ফোঁটা চোখের পানি ফেলবে। কিন্তু কেউ আর ইনবক্সে কুশল জানতে চাইবে না। কতজন কত সমস্যার কথা বলত আমাকেÑকষ্টের কথা, শূন্যতার কথা, ভালোবাসার কথা। কত ইনফরমেশন চাইত কানাডা আসার, চাইত সাহায্য। আমি চেষ্টা করতাম সেই সব চাহিদা পূরণ করতে। কিন্তু সব সময় পারিনি। আমার এই অক্ষমতার জন্য আমি লজ্জা পাই। আমিও বন্ধুদের খোঁজখবর নিই। যারা আমার বন্ধু, তারা যেন একটা পরিবার সবাই, এমন ভাবি আমি। কতজনকে কষ্ট দিয়েছি। সে জন্য ক্ষমা চাইতেও দ্বিধা নেই। মৃত্যুর পর কেউ আর ভালো লাগা বা মন্দ লাগা প্রকাশ করবে না। যেসব বন্ধু প্রতিদিন অপেক্ষা করত, আমি কী লিখলাম, তারা আর অপেক্ষা করবে না। ফেসবুককে বলা আছে অ্যাকাউন্ট ক্লোজ করে দিতে। এসবই বাস্তবতা...।
আজকে আমার মনটা আউলাঝাউলা। তাই যা মনে আসছে লিখলাম। কালকে একজন খারাপ ব্যবহার করেছে, লোকটা গোঁয়ার এবং দলান্ধ। অহংকারী টাইপের একজন মহিলা খারাপ ভাষা ব্যবহার করেছে। তাই আপসেট লাগছে। জানি, এই লেখা পড়ে কেউ কেউ বিরক্ত হবেন। আসলে এই মুহূর্তে আমার একটা ভ্যাকেশন দরকার। আমি বেশি দিন এক জায়গায় থাকতে পারি না। হাঁপিয়ে উঠি। জেসমিনকে একদিন বললাম, সামার তো চলে গেল, কোথাও বেড়ানো হলো না, চলো কোথাও ঘুরে আসি। জেসমিন বলল, কোথায় যাব! আমি বললাম, কোথাও গেলেই হয়। আটলান্টা যাই অরিত্রির ওখানে বা ফ্লোরিডা বা নিদেনপক্ষে নিউইয়র্ক যাওয়া যায়। জেসমিন কোনোটায়ই রাজি হলো না। আগামী মাসে আমাদের বিবাহিত জীবনের ৩৫ বছর পূর্ণ হবে। সে জন্যই প্ল্যান করতে চাইছিলাম। কত কথা মনে ভাবি আর টরন্টোর রাস্তায় একা একা ঘুরি। খারাপ লাগে না তো! আমার প্রিয় এই শহর। আমার কাজের জায়গায় একজন বয়স্ক মানুষের সঙ্গে দেখা হতো প্রায়ই। পনেরো বছর ধরে দেখছি। একা থাকে আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর ধরে। বাড়ির সামনে একটা ষাটের দশকের জাগুয়ার গাড়ি। এন্টিক টাইপ। দেখলেই বলবে, হাই নেইবার। আমি বলি হাই লুই। হাউ আর ইউ। দেখা হলে আমাদের একটা-দুটো কথা হতো। ল্ইুর নিঃসঙ্গতা আমি টের পাই। আমাকে স্পর্শ করে। বিকেল হলে একা বিয়ার খায়। লুই একদিন বলেছিল, সে তার স্ত্রীকে এখনো ভালোবাসে, তাই আর বিয়ে করেনি। স্ত্রী মারা গেছে ক্যান্সারে। এক ছেলে আছে, আমেরিকা থাকে। ল্ইুর বয়স প্রায় আশি। কিন্তু ভালোবাসা কখনো মরে না। লুই ওল্ড হোমে যেতে চায় না। কারণ এই বাড়িতে স্ত্রীর অনেক স্মৃতি। তারপর একদিন দেখি লুইর বাড়ির সামনে অন্য এক লোক, অন্য গাড়ি। লুইও চলে গেল পরপারে!
টাকা তুমি সময়মতো আইলা না
ছোটবেলায় যখন স্কুলে পড়ি, তখন লেইজারে আমার বন্ধুরা মালেক ভাইয়ের মালাই আইসক্রিম খেত। আমার কাছে প্রায়ই পয়সা থাকত না বলে আমি আইসক্রিম খেতে পারতাম না। বন্ধুরা খেত, আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। একবার আমার ক্লাসের ফার্স্ট বয় নাসির বলল, মল্লিক, আইসক্রিম খাবি! আমি তোকে খাওয়াই। তখন থেকেই আমার আত্মসম্মানবোধ প্রবল। আমি কখনো কারও কাছে কিছু চেয়ে নিতে পারতাম না। চেয়ে না পাওয়ার কষ্ট আমি সহ্য করতে পারব না। অপমানিতবোধ করতাম খুব। আমি নাসিরকে বললাম, নারে, আমার টনসিলের সমস্যা আছে, মা বলছে ঠান্ডা না খেতে। মনে আছে, বিকেলের দিকে আমাদের বাড়িতে একজন লোক ঘটিগরম বিক্রি করতে আসত। পায়ে ঘুঙুর লাগিয়ে রংচঙা পোশাক পরে ঘটি গরররররম বলে ডাক ছাড়ত। বাড়ির ছেলেমেয়েরা দৌড়ে যেত। ভিড় করত। আমি এমন একটা ভাব করতাম, যেন ওর চেয়ে পচা খাবার আর নাই। কিন্তু আমি জানি, সেই ঘটিগরম ছিল অতি সুস্বাদু। অসাধারণ তার সুবাস।
আমার পকেটে পয়সা থাকত না বলে আমি চিঠি লেখার স্ট্যাম্প কিনতে পারতাম না। কলেজে উঠে আমি পত্রিকায় চিঠিপত্র লিখি। আমার শ’খানেক পেনফ্রেন্ড। আমি করতাম কি, আমাকে বন্ধুরা যে চিঠি লিখত, সেই চিঠি থেকে স্ট্যাম্প উঠিয়ে আবার বসিয়ে দিতাম। বৃদ্ধ ডাকপিয়ন চাচা আমাকে যারপরনাই আদর করতেন, তিনি কিছু বলতেন না, সিল মেরে দিতেন। তখন থেকেই টাকার প্রতি একটা অনীহা তৈরি হয় আমার। তা সত্ত্বেও আমি মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম, বড় হয়ে যখন চাকরি করব, তখন অনেক আইসক্রিম খাব। আর যদি আমি বিয়ে করতে সক্ষম হই অর্থাৎ কোনো নারী যদি আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয় (তখন পর্যন্ত নিশ্চিত ছিলাম, আমাকে কেউ বিয়ে করবে না এবং আমি বিয়ে করেছিলাম টাকা-পয়সা ধার করে) এবং আমার যদি ছেলেমেয়ে হয়, তাহলে তাদের কোনো চাহিদাই আমি অপূর্ণ রাখব না।
আমার পুরো ছাত্রজীবন কেটেছে কষ্টেসৃষ্টে। হল-জীবনে অনেক রাত আমি না খেয়ে কাটিয়েছি কিন্তু কখনো কাউকে বুঝতে দিইনি। কেউ জানতে পারেনি। এমনকি আমার একটা-দুইটার বেশি প্যান্ট-শার্ট ছিল না। বিচিত্রায় কাজ করে যা পেতাম, তাতে চলত না। কিন্তু বিয়ের পর আমার জীবন বদলে গেল। দুজনই চাকরি করতাম। ভালো চাকরি। কিন্তু টাকার প্রতি তেমন আগ্রহ জন্মায়নি। অথচ টাকা খরচ করতে আমি পছন্দ করি। চ্যারিটি করতে পছন্দ করি। চায়ের টেবিলে বসলে আমার সামনে কেউ বিল দিতে পারে না সহজে, আমার অস্বস্তি লাগে। আমি স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়েছিলাম অন্যায়ের সঙ্গে আপস করব না বলে। বিদেশে আসার সময় আমাকে পৈতৃক জমি বিক্রি করতে হয়েছিল, অথচ সে সময় আমার সামনে টাকা আয়ের অঢেল হাতছানি আর প্রলোভন। ওসবকে উপেক্ষা করে আমি কানাডায় চলে আসি।
আমার ছেলেমেয়েরা এখন অনেক ভালো চাকরি করে, আমিও যা মন চায় করতে পারি। আইসক্রিম খেতে পারি, ঘটিগরম খেতে পারি, প্যান্ট-শার্ট কিনতে পারি, চিঠিতে স্ট্যাম্প কিনে লাগাতে পারি। এতেই আমি খুশি। টাকা জিনিসটা আসলে একটা নেশার মতো। একবার এই নেশা পেয়ে বসলে সহজে ছাড়ে না। ড্রাগের নেশার চেয়েও ভয়াবহ টাকার নেশা।
হ্যাঁ, এটা সত্যি, সুন্দর জীবনযাপনের জন্য টাকা দরকার। টাকা বন্দুকের চেয়েও শক্তিশালী, কলমের চেয়েও ক্ষমতাবান। টাকা থাকলে বাঘের চোখও মেলে প্রবাদের কথা হলেও খুব সত্য। টাকা থাকলে সুন্দরী গার্লফ্রেন্ড জোটে, টাকা থাকলে বিদেশে গিয়ে ভালো চিকিৎসা করা যায়, টাকা থাকলে বড় বড় ক্লাবের মেম্বার হওয়া যায়, জুয়ার কোর্টে লাখ লাখ টাকা ওড়ানো যায়, টাকা থাকলেই গাড়ি-বাড়ি হয় এবং দেশে-বিদেশে বিলাসী জীবনযাপন করা যায়। গাড়ি-বাড়িওয়ালা বন্ধু জোটে।
টাকার জোরে ক্ষমতায় আসা যায়। ভোট কেনা যায়। রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। টাকার জোরে অন্য দেশ দখল করা যায়, বোমা মেরে মানুষ মারা যায়। টাকার জোর থাকলে অন্যের বউ ভাগিয়ে নেওয়া যায়-টাকায় সব হয়। টাকা থাকলে দান-খয়রাত করা যায়। টাকার চেয়ে ক্ষমতাবান কিছু নাই। তাই মানুষ টাকার জন্য মরিয়া হবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে সবাই টাকার দেখা পায় না। টাকা উড়লেও সবাই ধরতে পারে না।
এই যেমন বাংলাদেশে শুধু টাকার গল্প চারদিকে। ছোটবেলায় এক পয়সা দুই পয়সা হলেই চিনাবাদাম কিনতে পারতাম, পাঁচ টাকা দশ টাকা হলে বেড়াতে যেতে পারতাম। তারপর শত টাকা, হাজার টাকা বা লাখ টাকার গল্প শুনতাম। একুশ পরিবার ছিল কোটিপতি একসময়। এখন কেউ কোটি টাকার গল্প করলে সেটা হাস্যকর মনে হয়। গত পনেরো বছর ধরে সব আলোচনাই হাজার কোটি টাকার। একশ কোটি বা পাঁচশ কোটি এখন অতি তুচ্ছ ব্যাপার। দুর্নীতি ব্যাপারটাকে জাতে উঠিয়ে দিয়ে গেছে। শিল্পে রূপ দিয়েছে!
এ ভ্রমণ আর কিছু নয়
সেই অর্থে আমার কখনো কোনো উচ্চাশা ছিল না। শৈশবে যখন থেকে আমি পৃথিবীকে জানতে শুরু করেছি, আমার পরিপার্শ্ব, আমার পৃথিবী, আমার অবস্থান, তখন থেকেই আমি বুঝতে পেরেছি আমার উচ্চাশা পোষণ করার কোনো কারণ নেই। জীবন তার আপন নিয়মে চলবে। প্রাকৃতিক নিয়মে বেড়ে উঠতে থাকি আমি। এই পৃথিবীতে আসার পেছনে আমার কোনো ভূমিকা নেই। মানুষ পৃথিবীতে আসে দুঃখ-কষ্ট, রোগ-শোকে ভুগে গত হওয়ার জন্য। সুখ সাময়িক। এটাই জন্মের রহস্য। এটাই মানুষের নিয়তি। যত দিন বেঁচে থাকে, একটা ছোট্ট জার্নি শুধু। সেই পথচলায় অনেক কিছু থাকে। সাফল্য থাকে, ব্যর্থতা থাকে। পাওয়া থাকে, হারানো থাকে। আমি জন্মের পর থেকেই জানতাম, আমার নিঃসঙ্গতা থাকবে, কাউকে না বোঝা থাকবে, আমাকে কারও বুঝতে না পারা থাকবে, নানা প্রতিকূলতা থাকবে, দুঃখ-কষ্ট, অভাব-অনটন, না-পাওয়া থাকবে। অনেক লড়াই থাকবে। ভুলভ্রান্তি থাকবে। পাপ থাকবে। অনুশোচনা থাকবে। প্রেম-ভালোবাসা থাকবে, মায়া-মমতা থাকবে। অন্যের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া থাকবে। আজও আমি কোনো উচ্চাশা পোষণ করি না। তেমন কোনো প্রত্যাশা নেই। শুধু একটাই প্রত্যাশাÑসুস্থভাবে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়া।
এই দীর্ঘ চলার পথে যা কিছু পেয়েছি, তার বেশির ভাগ অপ্রত্যাশিত। ভাগ্য সহায়তা করেছে। সংসার, সন্তান, বন্ধু তার সবই অচিন্ত্যনীয়ভাবে ঘটেছে। এত কিছু ঘটার কথা কথা ছিল না। এত আনুকূল্য পাওয়ার কথা ছিল না। এত বিস্তৃত পরিসর হওয়ার কথা ছিল না। কোনো পরিকল্পনা করে কিছু ঘটেনি আমার জীবনে। প্রকৃতি হাত ধরে আমাকে টেনে নিয়ে গেছে নানাভাবে। আমি নিজেকে সৃষ্টিকর্তার করুণার কাছে সঁপে দিয়েছিলাম। আমি সব সময় বিশ্বাস করতাম, একজন কেউ ক্ষমতাবান আছেন, যাঁর ইশারায় এই বিশ্বভ্রহ্মাণ্ড পরিচালিত হয়। না হলে এত সুচারুরূপে সব চলত না। রাতের পর দিন আসত না। শীতের পর গ্রীষ্ম আসত না। এত নিখুঁত হওয়া মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। আমি সেই অর্থে কঠিন ধার্মিক না হলেও আমার ঈশ্বর বিশ্বাসের জায়গাটায় কোনো খাঁদ নেই। যারা বিশ্বাস করে না, তাদের প্রতিও আমার কোনো দ্বিধা নেই। সবাই একভাবে সৃষ্টি, সবাই মানুষÑএই বিশ্বাস আমি নিজে নিজেই অর্জন করেছি। মানবতার চেয়ে বড় কোনো ধর্ম নেইÑএটা আমি কারও কাছ থেকে শিখিনি। তাই ধর্মবর্ণ-নির্বিশেষে আমি মানুষকে ভালোবাসি, সখ্য করি, বন্ধু ভেবে বুকে টেনে নিই। তারাও আমাকে বুকে টেনে নেয়।
আমার ভেতরে অনুশোচনা অনেক প্রবল। কৃতজ্ঞতাবোধ প্রবল। আমি জীবনে অনেক ভুল করেছি। আপাতদৃষ্টিতে সেই ভুলগুলো অন্যের জন্য ক্ষতিকর না হলেও এসব আমাকে সব সময় পীড়া দেয়, বিষণ্ন করে দেয়। আমি সামান্য মানুষ বলেই আমার ভুল হয়। এমন অনেক ভুল আছে, যা জেনেশুনেই করেছি। সেই সব ভুল এখন অহর্নিশ আমাকে যন্ত্রণা দেয়। মানসিকভাবে বিপর্যস্তবোধ করে। আমি আমার ভুলগুলো শোধরাতে চাই, অনুশোচনায় ভুগি এবং ভুলের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী থাকি সব সময়। ক্ষমা চাইতে আমার একটুও খারাপ লাগে না। নিজেকে ছোট মনে হয় না। আমি আমার সন্তানদের কাছেও ক্ষমা চাই। আমি স্ত্রী, বন্ধু, আত্মীয়দের কাছেও ক্ষমা পাওয়ার জন্য অনুনয় করি।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজের মধ্যে পরিবর্তন হয়। নানা কার্যকারণ, ঘটনা, পরিস্থিতি মানুষকে বদলে দেয়। আমার ক্ষেত্রেও এমনটা হচ্ছে। আমি নিজেকে প্রকাশ করার চেষ্টা করি বলে এসব কথা বলতে পারছি। বলতে পেরে নিজেকে কিছুটা হালকা করতে পারছি। তবে সব কথা বলা যায় না। সবারই এমন অনেক গোপনীয়তা আছে, যা কাউকে বলা যায় না। লেখা যায় না। আমি পৃথিবীর প্রতি মোহ ঘোচানোর চেষ্টা করছি। চাওয়া-পাওয়াগুলোকে ছোট করে আনতে চাচ্ছি। ঠিক শৈশবের দিনগুলোতে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা, যখন জীবনে কোনো আয়োজন ছিল না। দিন শেষে সবাইকেই এই পথ বেছে নিতে হয়। আমার এই বোধোদয় হচ্ছে যে জীবন অতি তুচ্ছ। ছোট্ট একটা জার্নি মাত্র। চোখ মুদলেই সবকিছুর পরিসমাপ্তি। এক অনন্ত ঘুম। মহান ঘুম। এই কথা আমি সব সময়ই লিখি। এটা চরম সত্য। চলার পথে আমাদের অনেক ভুলভ্রান্তি থাকে, অন্যকে কষ্ট দেওয়া থাকে, সাফল্য আর ব্যর্থতা থাকে, রোগ-শোক থাকে। কত মানুষ নানা কষ্টে ভুগছে, অসুস্থতায় ভুগছে, অভাবে ভুগছে, বিনে চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে। অনেকে চিকিৎসার অতীত। মানুষ আসলে অনেক অসহায়। মানুষ আসলে অনেক একলা। কেউ সফল, কেউবা ব্যর্থÑএই যা তফাত।
সৃষ্টির রহস্য বোঝা সত্যিই কঠিন। মানুষ যত দিন বাঁচে, তত দিনই আশা, স্বপ্ন আর প্রত্যাশা থাকে। আমি মুখে কোনো উচ্চাশা নাই বলি ঠিকই, কিন্তু অবচেতনে স্বপ্ন লালন করি। স্বপ্ন দেখি, একদিন দেশে ফিরে যাব। মা-বাবা, ভাইবোনের কবরের পাশে গিয়ে বসব। নিজেকে সুস্থ দেখতে চাই, অসুস্থতায় ভুগতে চাই না। জানি, জীবনে চাওয়ার মতো করে সবকিছু ঘটে না। সবকিছু মানুষের হাতে নেই। সব স্বপ্ন পূরণ হয় না। জীবন এমনই। রহস্যে ভরা। তাই বলে স্বপ্ন থাকবে না, তা নয়। স্বপ্নই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। শুধু জীবন জার্নিটা সুন্দর হোক, স্বাভাবিক হোক, ভালোবাসার হোক, মায়া-মমতার হোক, সুস্থ থাকার হোক-এই প্রত্যাশা।
-টরন্টো, কানাডা।
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: 01711238078