
‘ফিল’ আরবি শব্দ। এর বাংলা অর্থ হাতি। ব্রিটিশ শাসনামলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এখানে সরকারিভাবে হাতি রাখত। এখানে ব্যাপকভাবে হাতি পোষা ও প্রজনন করা হতো। পিলখানা মানে হাতিখানা। সে থেকেই এর নাম পিলখানা।
পিলখানা ঢাকার পশ্চিমাঞ্চলে এক বিরাট এলাকা নিয়ে অবস্থিত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে এই পিলখানা নির্মিত হয় এবং সরকারি হাতি রাখা হতো। তা ছাড়া বহু মানুষ ভাড়া দিয়ে তাদের হাতি রাখতেন। মুঘল আমলে ঢাকা শহরের উত্তরাংশে আরেকটি বড় পিলখানা ছিল। সেই সময় শাসনকর্তা পিলখানায় অবস্থানরত হাতিগুলোকে গোসলের জন্য উনবিংশ শতাব্দীতে ঢাকার নবাবগঞ্জ এলাকায় বুড়িগঙ্গার তীরে একটি ঘাট তৈরি করেছিলেন। অদ্যাবধি ওই ঘাটটিকে জনসাধারণ ‘হাতিঘাট’ বলেই আখ্যায়িত করে আসছেন। অন্যদিকে নতুন হাতি পোষ মানানোর ব্যবস্থা করা হতো পিলখানায়। ১৮৯৫ সালে বাংলার গভর্নর চার্লস এলিয়েটের উপস্থিতির সময়ও একবার হাতি মেলা প্রদর্শনী হয়েছিল। তা ছাড়া ব্রিটিশ শাসন আমলেই পিলখানায় একটি সেনানিবাস প্রতিষ্ঠা করা হয়। পাকিস্তান সময়ের ইপিআর এবং বর্তমানে আধাসামরিক বাংলাদেশ রাইফেলস বাহিনীর হেডকোয়ার্টার্স অবস্থিত।
সবুজের সমারোহ ও সৌন্দর্যের মূর্ত প্রতীক ছোট একটি দেশের নাম বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় এ দেশ। পৃথিবীর ইতিহাসে এ জাতির সন্তানেরাই প্রথম মায়ের ভাষার জন্য ১৯৫২ সালে বুকের তাজা রক্ত ঝরিয়েছিল এবং জাতি সেদিন হারিয়েছিল অনেক সূর্যসন্তানকে। ভাবতে খুব ভালো লাগে, আমি এ দেশেরই একজন গর্বিত সন্তান।
বাংলাদেশ রাইফেলস দেশপ্রেমের গৌরবময় ঐতিহ্যবাহী এক বাহিনী। এ বাহিনীর বীরত্বগাথা ২২৫ বছরের। প্রায় ৩ শতাব্দীর অধিক সময় ধরে এ বাহিনীর প্রতিটি সদস্য অপরিসীম ত্যাগ-তিতিক্ষা ও দক্ষতার সঙ্গে সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করে আসছে। ১৭৭০ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নাম ছিল রামগড় লোকাল ব্যাটালিয়ন বা আরএলবি। দ্য ফ্রন্টিয়ার প্রোটেকশন ফোর্স থেকে ১৭৭৫ সালে গঠিত হয় আরএলবি। ১৮৬১ সালে আরএলবি বিলুপ্ত করে গঠন করা হয় ফ্রন্টিয়ার গার্ডস বা এফজি। এ নামে বাহিনী ছিল ১৮৯০ সাল পর্যন্ত। ১৮৯১ সালে সীমান্তরক্ষী বাহিনী হিসেবে এফজি রূপান্তরিত হয় বেঙ্গল মিলিটারি পুলিশ বা বিএমপি হিসেবে। ১৯১৯ সাল পর্যন্ত ওই বাহিনী নামে দায়িত্ব পালন করে। ১৯২০ সালে নতুন নাম ধারণা করে ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার্স রাইফেলস বা ইএফআর।
১৯৪৬ সাল পর্যন্ত ইএফআর নামে দায়িত্ব পালন করার পর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর নাম ধারণ করে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস বা ইপিআর। ১৯৫৮ সালে ওই বাহিনীকে চোরাচালান দমনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। বাংলাদেশ রাইফেলস বিডিআর ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ইপিআর স্থলাভিষিক্ত বাহিনী। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে ইপিআর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাংলাদেশ রাইফেলস বা বিডিআর। ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ পিলখানা ট্রাজেডির পর এই বাহিনীর নাম রাখা হয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা বিজিবি। ১৯৮০ সালের ৩ মার্চ বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এই বাহিনীর কর্মকাণ্ডের বিশেষ স্বীকৃতি হিসেবে জাতীয় পতাকা প্রদান করা হয়। বিডিআরের ব্যবহৃত খাকি ইউনিফর্মের পরিবর্তে তিন রঙের সংমিশ্রণে ছাপা কাপড়ের ইউনিফর্ম প্রবর্তন করা হয় ২০০১ সালে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে দ্বিতীয় স্থলাভিষিক্ত হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল তৎকালীন ইপিআর তথা বর্তমান বিডিআর বাহিনীর। গর্বের সঙ্গে উচ্চারিত এই বাহিনীর সদস্যদের আত্মদান ও দেশপ্রেমের অনন্য দৃষ্টান্ত। ইতিহাসে চির অম্লান এক ছবি রেখে গেছে হাজারো সৈনিকের জন্য। দিগ্্বিদিক চলন, পীড়ন, জুলুম, হত্যাযজ্ঞ আর বিস্ফোরণ শুরুর প্রাক্কালে ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ রাতে পাকিস্তানের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধাচরণ করে স্বাধীনতাকামী মুক্তিপ্রত্যয়ী কয়েকজন বিডিআর সেনা তৎকালীন ইপিআর পিলখানায় প্রথম উত্তোলন করে স্বাধীন বাংলাদেশের বহ্নিমান সূর্যপতাকা। বিডিআর সদর দপ্তরে অবস্থিত প্যারেড গ্রাউন্ডের বটবৃক্ষের শীর্ষ শাখায় নির্ভীক এই সৈনিকেরা উড়িয়ে দিয়েছিল মুক্তির নিশান। এসব অকুতোভয় বিডিআর সেনাকে বেরী জান্তার চরম নির্মমতার শিকার হতে হলো।
মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে বাংলাদেশ রাইফেলস বাহিনীর সদস্যদের চরম আত্মত্যাগ জাতি চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। মহান মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত প্রান্তরে অসামান্য অবদান ও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখে বিজয়ের অন্যতম কারিগর হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয় বিডিআর তথা তৎকালীন ইপিআর। একটি আধাসামরিক বাহিনী হিসেবে সীমিত সংখ্যক পুরোনো অস্ত্রকে সম্বল করে ইপিআর সৈনিকেরা মুক্তিযুদ্ধে যে অগাধ দেশপ্রেম, বীরত্ব ও সুমহান আত্মত্যাগের ইতিহাস রচনা করেছে, তার উদাহরণ বিরল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান বাহিনীর আক্রমণের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের বাঙালি সদস্যরা প্রাথমিক প্রতিরোধ সৃষ্টি করেন। প্রথম দিকে ইপিআরের বাঙালি সৈনিকরা কলাকৌশলগত কারণে বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে জিঞ্জিরা থেকে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পরে পাকিস্তানের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ১ লাখ নিয়মিত সৈনিকের বিরুদ্ধে ইপিআরের ১২ হাজার বাঙালি সৈনিক ১১ সেক্টরে ৯ মাস প্রত্যক্ষ যুদ্ধে নিয়োজিত ছিলেন। ইপিআর বাঙালি সৈনিকদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা বাংলাদেশের জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে অধিকতর সংঘটিত করে প্রতিরোধ রচনা ও রণাঙ্গনের যুদ্ধ করার সাহসে উজ্জীবিত করে তুলেছিল। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এই বাহিনীকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী শুধু নিñিদ্র নিরাপত্তাব্যবস্থাই নয়, চোরাচালান রোধ করার মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে স্বাবলম্বী করার ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করছে। মানব পাচার বাংলাদেশের অন্যতম সমস্যা। এ মানব পাচার রোধে সীমান্তে তীক্ষè দৃষ্টি রয়েছে বিডিআরের। আধাসামরিক বাহিনী হলেও দেশের নিয়মিত সামরিক বাহিনীর চেয়ে এর গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়। সীমান্ত মহড়া ছাড়া ওই বাহিনীর অন্যান্য দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে সীমান্তবর্তী এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা, মাদকদ্রব্য আটক, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, বেআইনি কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ এবং প্রয়োজনে দেশের অভ্যন্তরে অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে শান্তি-শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে সরকারকে সহযোগিতা করা। জাতীয় দুর্যোগ ও সংকটে আর্তমানবতার সেবায় এই বাহিনী প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখে আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে রাখার ক্ষেত্রে ‘অপারেশন ডালভাত’ কর্মসূচি ছিল বাংলাদেশ রাইফেলসের আরেকটি অন্যতম সেবাধর্মী কাজ। তবে ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় ঘটে গেছে ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম ঘটনা। সবাই এর নাম দিয়েছে ‘পিলখানা ট্র্যাজেডি’। বিডিআর বিদ্রোহের নামে যে বর্বরোচিত ও জঘন্য হত্যাকাণ্ড ঘটে গেল, তা নিন্দা জানানোর ভাষা আমার নেই। বস্তুতপক্ষে, এরই মাধ্যমে জাতির ইতিহাসে যোগ হলো আরেকটি জঘন্যতম অধ্যায়। বিডিআর বিদ্রোহের অন্তরালে কী ছিল? কেনই-বা এ ঘটনা ঘটানো হলো? ষড়যন্ত্রকারী কারা? তাদের উদ্দেশ্যই-বা কী ছিল?
জাতিকে ভয়ংকর ঝাঁকুনি দিয়ে একটা রুদ্ধশ্বাস দশায় ফেলে ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিডিআর বিদ্রোহের যবনিকাপাত ঘটেছে। পরিকল্পিত নৃশংস হত্যাযজ্ঞে জাতি হারিয়েছে প্রতিরক্ষা কৌশলে সুশিক্ষিত ৫৪ বা ততোধিক কর্তব্যরত কৃতী সন্তান, সাহসী ও দক্ষ সেনা কর্মকর্তা। জাতি রাষ্ট্রের প্রহরায় বা প্রধান অঙ্গ এখন পক্ষাঘাতগ্রস্ত। রাষ্ট্রের কান্ডারি এবং দেশদরদি নাগরিকরা বেদিশা না হলেও আমরা মর্মাহত বিস্ময়-বিমূঢ়। আর গণচেতনায় বিপদাশঙ্কা ও অনিশ্চয়তার অবসাদ ঘনীভূত করে রেখেছে পিলখানা।
প্রতিবছরের মতো (২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯) শুরু হয়েছিল বিডিআর সপ্তাহ। তাদের বিগত বছরের সাফল্য, ব্যর্থতা ও সমস্যা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয় এবং নির্ধারণ করা হয় পরবর্তী বছরের কর্মপরিকল্পনা। নির্দিষ্ট সময়ে সভা শুরু হয়। বিডিআরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমদ ৯টা ১ মিনিটে বক্তব্য শুরু করেন। শেষ হওয়ার পূর্বেই দক্ষিণ দিক থেকে প্যান্ট ও গেঞ্জি পরিহিত এক সৈনিক এসএমজি তাক করে ডিজির সামনে এসে দাঁড়ায়। এ সময় কর্মকর্তারা ডিজিকে ঘিরে ফেলেন। এসএমজি তাক করে ওই সৈনিক ডিজিসহ সবাইকে এক লাইনে দাঁড়াতে বলে। ডিজি সামনে চলে যান, দরবার হলের কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই শুরু হয় গুলিবর্ষণ, সেই সাথে দরবার হল থেকে যে যেদিকে পারে সেদিকেই ছুটে পালিয়ে যেতে থাকে। তবে পুকুরের উত্তর দিক থেকে শুরু হয় ব্রাশফায়ার। ক্রমে গোলাগুলি বাড়তে থাকে এবং তীব্রতা বেড়ে যায়। বিদ্রোহী জওয়ানদের অধিকাংশই ছিল অল্পবয়স্ক। বিডিআর জওয়ানদের হত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাট মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে হার মানিয়েছে। ওই সময় বিডিআর সপ্তাহের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসে অনেকের আর ফিরে যাওয়া হয়নি। তাদের ফিরতে হয়েছিল লাশ হয়ে। বিডিআর বিদ্রোহীদের আচরণ ছিল হিংস্র ও কাপুরুষোচিত, যেটা জেহাদি জঙ্গিদের চরিত্রতুল্য নয়, যদিও জেহাদি নাশকতার ফলাফলও সমভাবে নৃশংস, নির্বিচার ও অমানবিক।
বিদ্রোহী জওয়ানরা দেশের অত্যন্ত দক্ষ, যোগ্য ও মেধাসম্পন্ন সেনা অফিসারদের ব্রাশফায়ার করে মেরেই ক্ষান্ত হয়নি, তাদের লাশ নিয়েও চালিয়েছিল অনেক ন্যক্কারজনক ঘটনা। লাশ পোড়ানো, লাশ বিকৃত করা, লাশ ড্রেনে ফেলে দেওয়া, গণকবর দেওয়া, সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারগুলোকে জিম্মি করে রাখা, তাদের বাসায় প্রবেশ করে মহিলাদের পাশবিক নির্যাতন করা, মালামাল লুটপাট করার ঘটনা যেন আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগকেও হার মানায়।
দেশবাসী কল্পনাই করতে পারেনি, বিদ্রোহী জওয়ানরা পিলখানার ভেতরে এত বড় নির্মম, জঘন্য ও নৃশংস কাণ্ড ঘটিয়েছে। দেশের এতগুলো সেনাসদস্যের জীবন কেড়ে নিয়েছে। এতগুলো পরিবারকে করেছে স্বামীহারা, সন্তানহারা ও পিতাহারা। সেনাসদস্যদের স্বজনদের আহাজারি দেখলে মনে হয়, আমরা আজ স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার অধিকার হারিয়ে ফেলেছি। যে প্রতিরক্ষা বাহিনী দেশ ও জনগণকে রক্ষা করবে কোনো বহিঃশক্তি বা অপশক্তি থেকে, আর সেই বাহিনীর মধ্যেই যদি ঘটে যায় এমন বর্বরোচিত ঘটনা, তাহলে নিরাপত্তা আজ কোথায়?
২৭ ফেব্রুয়ারি সেনা কর্মকর্তারা পিলখানার আনাচ-কানাচে তল্লাশি চালিয়ে তাণ্ডবলীলার অনেক বীভৎস চিত্র পেয়েছেন। একটি হলো গণকবর এবং ২৮ ফেব্রুয়ারি গণকবর থেকে উদ্ধার করা হয় ৬টি লাশ এবং আরো ৩টি গণকবরের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। এদের মধ্যে বিডিআরের মহাপরিচালকের পত্নী নাজনীন শাকিলও। বেসামরিক লোকসহ মৃতের সংখ্যা ৭৪। এ ছাড়া সেনাকর্মকর্তা নিখোঁজ রয়েছেন ৭০ জন। সব মিলিয়ে ১৫০ জন। পিলখানার ভেতরে দরবার হলের দিকে তাকালে মনে হয়, এখনো শেষ হয়নি বিডিআর সপ্তাহের রেশ। চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা জিনিসপত্র যেন এখনো অপেক্ষা করছে বিডিআর সপ্তাহ উদযাপনের জন্য। সমগ্র পিলখানার ভেতর এখন শুধু লাশ আর ধ্বংসের চিহ্ন।
তা ছাড়া বিয়ের ৮২ দিনের মাথায় স্বামীহারা নুসরাত নূর বাঁধন এখন নির্বাক, চোখে ভাসছে শুধু স্বামীর সেই হাস্যোজ্জ্বল চেহারা। বাঁধন স্বামীকে নিয়ে বেঁধেছিলেন নানা স্বপ্ন, কিন্তু বিয়ের বয়স ৩ মাস না পেরোতেই বাঁধনের সেই স্বপ্নের মৃত্যু ঘটে। বিদ্রোহীদের একটি তাজা বুলেট কেড়ে নেয় বাঁধনের প্রাণপ্রিয় স্বামী ক্যাপ্টেন মাজহারুল হায়দারের প্রাণ। পুলিশের সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদের বড় মেয়ে বাঁধনের শোক যেন গোটা পুলিশ বিভাগের শোক। আইজিপি নূর মোহাম্মদের মেয়ে নুসরাতের শোক যেন প্রতিটি পুলিশ সদস্যই বয়ে বেড়াচ্ছে। প্রাণবন্ত ক্যাপ্টেন মাজহারুল ছিলেন বিডিআর সদর দপ্তরের সকল সদস্যের প্রিয় মুখ। ছিলেন মহাপরিচালকের এডিসি। ২০০৮ সালের ৪ ডিসেম্বর বিয়ে করেছিলেন নুসরাতকে। ঘটা করে বৌভাত করেছিলেন বিডিআর দরবার হলে। ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ বুধবার সকালে বিডিআর মহাপরিচালক শাকিলের ওপর হামলার সময় তিনি তাকে রক্ষায় সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। কিন্তু তার চেষ্টা সফল হয়নি। যেসব বিডিআর জওয়ান ক্যাপ্টেন মাজহারুলের বৌভাত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল, তাদের হাতেই তিনি নির্মমভাবে নিহত হন। ঘাতকেরা তাতেই ক্ষান্ত হয়নি, তাকে দরবার হল থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে আনে। দরবার হলের বাইরে গুলি করে ঝাঁঝরা করে দেয় তার পুরো শরীর। মিনিটের মধ্যে নিভে যায় তার জীবনপ্রদীপ। এরপর ঘাতকেরা তার লাশ ফেলে দেয় স্যুয়ারেজ লাইনে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সামরিক বাহিনীর ৫৬ জন অফিসার শহীদ হয়েছেন, কিন্তু এক দিনে বা এক স্থানে মারা যাননি। তারা বিগত ৯ মাসের যুদ্ধ-প্রক্রিয়ায় মারা গিয়েছেন। অথচ ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ পিলখানায় মাত্র ১ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে ১২০ জন অফিসারকে মেরে ফেলা হয়। কেন তাদের মারা হলো? প্রমোশন বা চাকরির বেশি বেশি সুযোগ-সুবিধার জন্য কি এভাবে পিঁপড়ার মতো মিলিটারি অফিসার মারা হলো? আসলে ইস্যুটি কী ছিল? কোন ইস্যুতে এই রক্তের হোলি খেলা হলো? কে দেবে এর জবাব? জবাব দেওয়ার মতো কাউকে কি আর খুঁজে পাওয়া যাবে? আমি একজন শিক্ষক। এই পৈশাচিক ঘটনার ভেতর এবং বাইরের কথা কতটুকুই-বা জানি? তবে এতটুকুও নির্দ্বিধায় এখন বলা যায়, বিশাল একটি পরিকল্পনা ও চক্রান্তের বীভৎস পরিণতি। কারা রয়েছে এই চক্রান্তের সাথে জড়িত? এই হত্যাযজ্ঞের মেঘনাধ কে? অথবা কারা? যত দিন যাবে ততই এদের শনাক্ত করার দাবি প্রবল থেকে প্রবলতর হবে। দাবিদাওয়া এক জিনিস আর সেই দাবিদাওয়া আদায়ের পন্থা অন্য জিনিস।
ঢাকার সাভারে অবস্থিত সেনাবাহিনীর ৯ম ডিভিশনের অধিনায়ক ও বাংলাদেশ সরকারের সাবেক মন্ত্রী লেফটেন্যান্ট জেনারেল মীর শওকত আলী দৈনিক ইত্তেফাকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘বিডিআর জওয়ানদের বিদ্রোহ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে সেনাবাহিনীকে পিলখানায় ঢুকতে দেওয়া হলে তারা বিদ্রোহ দমন করতে পারত। সেনানিবাস থেকে মুভ করে এলে বিদ্রোহীরা ভয়ে পালিয়ে যেত। কারণ সবারই মৃত্যুর ভয় আছে। সেনাবাহিনী পারে না, এমন কাজ নেই। বিডিআরকে কেউ ইন্ধন জুগিয়েছে। এর পেছনে গভীর ষড়যন্ত্র কাজ করছে। আসল অপরাধী যারা, তাদের ধরা কঠিন। এই অপরাধীরা কীভাবে পালিয়েছে, তা উদঘাটন করতে হবে।’ তিনি আরো বলেন, এই পুরো ঘটনায় গোয়েন্দাদের চরম ব্যর্থতা আছে।
এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক যে ১৪ ব্যক্তিকে আলোচনার জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট নিয়ে গিয়েছিলেন, ওরা কারা? কী তাদের পরিচয়? ওরা এখন কোথায়?
উল্লেখ্য, ২৮ ফেব্রুয়ারি এক বিবৃতিতে বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্যরা বলেন, সেনা অফিসারদের ওপর যারা এই বর্বর হামলা চালিয়েছে, তারা হলো রাষ্ট্রবিরোধী শক্তি। এই শক্তি বিডিআরকে ধ্বংস করতে চায় এবং সেনাবাহিনীর মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে চায়। এই প্রেক্ষিতে জাতীয় স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব হুমকির সম্মুখীন। তাই এখন খুঁজে বের করতে হবে এই রাষ্ট্রবিরোধী শক্তির কোন স্থানীয় এজেন্ট কাজ করেছিল তাদের হয়ে? বিএনপিদলীয় নেতারা মনে করেন, সেনা অফিসার হত্যা এবং পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ব্যর্থ এবং হত্যা, লুট, অগ্নিসংযোগ এবং নারী নির্যাতন প্রতিরোধে তৎকালীন সরকার সময়মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে তার দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারেন না।
তবে বিডিআর বিদ্রোহ ও গণহত্যা নিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে উত্তপ্ত বিতর্ক হয়েছিল। তখন বিরোধী দলের সদস্যরা প্রশ্ন করেন, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকের পর বিডিআর প্রতিনিধিরা যখন অস্ত্র সমর্পণ করতে যাচ্ছিলেন, তখন এসএমএস করে কারা এ কাজটি করতে বারণ করেছিল? যখন হত্যাকাণ্ড চলছিল, তখন একটি অস্ত্রবোঝাই পিকআপ ভ্যান পিলখানায় প্রবেশ করে এবং অস্ত্র বিতরণ করে। কারা সেখানে এই অস্ত্র প্রেরণ করেছিল?
পক্ষান্তরে বিরোধী দলের (বিএনপি) সদস্যরা অভিযোগ করেন, পিলখানায় এই ভয়াবহ গণহত্যার পর ঘাতকরা পালিয়ে গেল কীভাবে? কেন সেখানে ২০ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছিল? তারা প্রশ্ন করেন, ঘাতকদের পালিয়ে যাওয়ার জন্য কি সমগ্র পিলখানা বিডিআর ক্যাম্প অন্ধকারে আচ্ছন্ন করা হয়েছিল? বিডিআরের যেসব সদস্য নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিল, তাদের মুখে গোলাপি, কমলা এবং নীল রঙের স্কার্ফ আঁটা ছিল। কারা এগুলো সরবরাহ করেছিল?
বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অস্ত্র সংবরণ করে ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার জন্য বিডিআর সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে ২৭ ফেব্রুয়ারি জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেছিলেন, ‘অন্যথায় আমি দেশবাসীর স্বার্থে যেকোনো পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হব। আমাকে সে পথে যেতে বাধ্য করবেন না।’ তিনি বিডিআর, পুলিশ, আনসার ও সশস্ত্র বাহিনীকে যেকোনো স্বার্থান্বেষী মহলের উসকানিমূলক প্ররোচনা থেকে নিজেদের বিরত থাকার অনুরোধ জানিয়ে ‘পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে করার জন্য বিশেষ মহল তৎপর’, সে বিষয়ে সকলকে সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়ে সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশে বলেছিলেন, কোনোমতেই নিজের হাতে আইন তুলে নেবেন না। চেইন-অব-কমান্ড মেনে চলতে হবে। তিনি নিজের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে এবং নিজের পরিবারের স্বার্থে ধৈর্যধারণের অনুরোধ জানান। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে পরিস্থিতি একদম পাল্টে যায়। সৈনিকদের মধ্যে উত্তেজনা কমে আসে।
২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিডিআর সদর দপ্তরে যেসব নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে, সে সম্পর্কে একটি বড় প্রশ্ন এই যে, বিডিআর সদর দপ্তরে এ ধরনের লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলো অথচ বিডিআরের নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থা তার কোনো আভাসই দিতে পারল না। এটা কি গোয়েন্দা সংস্থার চরম ব্যর্থতা নয়? ২৫ ফেব্রুয়ারির ঠিক আগের দিন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিডিআর সদর দপ্তরে প্রধান অতিথি হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চক্রান্তকারীরা সেদিন যদি তাদের হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠত, তাহলে ব্যাপারটা কী ঘটত? তা ভাবতেও শিউরে উঠতে হয়। বিডিআরের নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থাই সেনা কর্মকর্তাদের এই হত্যাযজ্ঞের পেছনে একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে বলে যে অভিযোগ উঠেছে, তার জবাব কী?
ভাবতে অবাক লাগে, বেঁচে যাওয়া অফিসারদের বক্তব্যে জানা যায়, অনেক বিডিআর জওয়ান নিজস্ব শক্তি দিয়ে অফিসারদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল, বাঁচানোর চেষ্টা করতে গিয়ে জওয়ানদের প্রাণ দিতে হয়েছে, তবে তারা অপেক্ষা করেছে তাদের কেউ মুক্ত করতে আসবে কিন্তু না! কেউ কি উদ্ধার করতে এসেছে? এমনকি প্রধানমন্ত্রীর নিকট বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমদ সাহায্যের জন্য টেলিফোন করার পরও তিনি কার পরামর্শে আর্মি না পাঠিয়ে হেলিকপ্টার পাঠিয়েছিলেন? উদ্ধার করতে কারা বাধা সৃষ্টি করেছিল? তার রহস্যই-বা কী ছিল? এখন সময় এসেছে তা উদঘাটন করার। এতগুলো মেধাবী বিডিআরের স্বাধীন দেশে জীবন দেওয়া কত যে নির্মম, তা ভাবতে অবাক লাগে। তবে ঘটনায় প্রমাণ করে, এই ঘটনা হঠাৎ করে সংঘটিত হয়নি। অন্তত ঘটনাটি অনেক আগে থেকেই পরিকল্পনা করা হয়েছিল, তাই সরকারের সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দারা কি ঘুমিয়ে ছিল, না জড়িত ছিল, কোনটি বলল?
তা ছাড়া বিডিআরের মহাপরিচালকসহ ৬৫-৭৪ জন ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাকে সকাল ১০ ঘটিকা থেকে আনুমানিক ১ থেকে দেড় ঘণ্টার মধ্যে গুলি করে হত্যা করা হলো। এমন একটি ঘটনার জন্য কি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কোনো ব্যর্থতা নেই? বিশেষ করে, বিদ্রোহ হত্যাকাণ্ড-পরবর্তী সময়ে তিনি যেভাবে পিলখানায় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে গিয়ে বিডিআর প্রধান জেনারেল শাকিল আহমদ ও অন্যান্য সামরিক কর্মকর্তার ভাগ্যে কী ঘটেছে এবং পিলখানার ভেতরে তাদের পরিবারবর্গের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার কোনো উদ্যোগ ছাড়াই দু-একটি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন, তা ছিল সম্পূর্ণ অমানবিক ও দায়িত্বহীন কাজ। শুধু একজন মন্ত্রী হিসেবে নয়, বরং একজন সাধারণ মানুষ হিসেবেও।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছাড়াও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সরকারের পক্ষ থেকে যারা পিলখানায় পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড ঘটে গিয়েছে এবং তা পর্যবেক্ষণ করে বেরিয়ে এসে দেশবাসীকে জানানোর কোনো প্রয়োজন মনে করেননি। বরং তারা পিলখানায় ঘটে যাওয়া বিদ্রোহ ও বিভিন্ন কাণ্ডের নেতৃত্বদানকারী কিছুসংখ্যক বিদ্রোহীকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে আসেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করার জন্য। যে তড়িৎ গতিতে প্রধানমন্ত্রী বিদ্রোহীদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শনের ঘোষণা দিলেন, তা দেখে এটা মনে করা স্বাভাবিক, বিশেষ করে ওই রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল বিদ্রোহীদের জন্য সরকারি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করার ব্যবস্থা করা। বিদ্রোহীদের প্রতি এত সহানুভূতি এবং বিদ্রোহীদের হাতে নিহত বিডিআর কর্মকর্তা ও তাদের পরিবার-পরিজনদের প্রতি এহেন উদাসীনতা কেন?
‘কিন্তু বিধাতার লিখন না যায় খণ্ডন’, নতুবা কেন এমন হবে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেও পুরো ঘটনা মোটেই আন্দাজ করতে পারেননি মন্ত্রী-এমপি এবং রাজনীতিবিদরা। তাদের চিন্তা ও চেতনা যেন সেই দিন বিধাতাই সংকীর্ণ করে রেখেছিলেন। আমি বিশ্বাস করি, মন্ত্রী, সংসদ সদস্যবৃন্দ অবশ্যই সম্মানিত আল্লাহর রহমতপ্রাপ্ত। নতুবা তারা লক্ষ লক্ষ মানুষের নেতা হতে পারতেন না। তারা কোনো না কোনো স্থানে পা রাখলে সেই জায়গার পরিস্থিতি সম্পর্কে অনেকটা ধারণা করতে পারেন। কিন্তু শুধু ২৫ ফেব্রুয়ারির ব্যাপারটাই ভিন্ন হয়ে গেল।
দেশবাসী আজও জানে না বিডিআর বিদ্রোহের নেপথ্যে কারা ছিল। এটা কি শুধু বিডিআরদের সামান্য দাবি-দাওয়ার ক্ষোভ, নাকি অন্য কিছু। তবে চৌকস সেনা অফিসার হত্যা করে প্রতিরক্ষা বাহিনীকে করেছে মারাত্মকভাবে দুর্বল, যা একটি দেশে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। অনেকগুলো সেনা পরিবারকে করেছে অভিভাবকহীন, অসহায় এবং পরনির্ভরশীল। সরকারের আর্থিক সহযোগিতায় তাদের পেটের ক্ষুধা নিবারণ হলেও মনের ক্ষুধা মিটবে না কোনো কিছুতেই। এসব মিলিয়ে ক্ষতি হলো কাদের? বিডিআরও বাংলাদেশের সন্তান, সেনাবাহিনীও বাংলাদেশের সন্তান। তাই সব দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত আজ বাংলাদেশ। তবে অনেকের মন্তব্য, এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের যেখানে নিরাপত্তা সরকার দিতে পারল না, তখন আমাদের ব্যাপারে তো প্রশ্নই আসে না। এ রকম হাজার প্রশ্নের উত্তর কে দেবে?
পৃথিবীর ইতিহাসের এক বর্বরোচিত কাণ্ড ঘটে গেল পিলখানায়। বিদ্রোহী বিডিআর সদস্য ও তাদের দোসরদের হাতে নৃশংসভাবে প্রাণ দিতে হলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বাঘা বাঘা অফিসারদের। তবে তারা জাতীয় বীর। সেনাবাহিনীকে উচ্চ র্যাংকে নিয়ে আসতে সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে এবং দেশ-বিদেশে বাঙালির জন্য শহীদ সেনারা অনেক সুনাম বয়ে এনেছিল। বিডিআরকে হত্যা করে দেশকে আরো ৩০ বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।
পিলখানার এ হত্যাকাণ্ড ছিল সম্পূর্ণ সুপরিকল্পিত। পলাশীর আক্রমণের মতো এক সুগভীর ষড়যন্ত্রের শিকার বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এ নির্মম হত্যাকাণ্ডে গোটা জাতি হতবাক ও স্তম্ভিত। গোটা বিশ্ব আশ্চর্যান্বিত হয়েছে। পৃথিবীর কোনো দেশে এভাবে একটি সেনাবাহিনীর কোনো অফিসারদের বিদ্রোহের নামে তাণ্ডবলীলা চালিয়ে হত্যা করা হয়নি। তবে সেনাবাহিনী হচ্ছে একটি দেশের জাতীয় সম্পদ।
রাজনীতি হচ্ছে জনগণের কল্যাণের জন্য। জাতিকে শোষণ, যন্ত্রণা ও নিপীড়ন থেকে রক্ষা করার জন্য। দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদরা কখনো আত্মঘাতী কোনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে জাতির বীর সন্তানদের ধ্বংস করে দিতে পারে না। তবে বাইরের ষড়যন্ত্রের সাথে কোনো রাজনৈতিক দলের ব্যক্তিবিশেষ সম্পর্ক থাকতে পারে। অর্থের লোভে তারা মীরজাফরের মতো জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে না। কেননা বাঙালিদের রক্তে নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও মীরজাফর উভয়ের রক্তের প্রবাহ রয়েছে। যেসব রাজনীতিবিদ বা বিডিআর সদস্য এসব ন্যক্কারজনক ঘটনার সাথে জড়িত, তারা পশু ও মীরজাফর। যারা এ পৈশাচিক ঘটনার খলনায়ক, তাদের সুবিচার বাংলার জনগণ চায় এবং তদন্ত কাজকে কখনো বাধাগ্রস্ত না করার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ও অন্য উপদেষ্টাদেরকে তদন্ত কাজকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত না করার আহ্বান জানিয়েছেন।
বাংলাদেশের আপামর জনগণের ও প্রবাসে বসবাসরত বাংলাদেশিরাও শোকে কাতর ও পাথর। অবাক বিস্ময়ে তারা তাকিয়ে আছেন তদন্ত কর্মের দিকে। অধিক আগ্রহে অপেক্ষা করছেন দোষীদের কবে শাস্তি হবে।
আট বছর আগেই পিলখানা হত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায় হলেও এক যুগ আগের বিস্ফোরক আইনের মামলার বিচার এখনো আদালতে ঝুলে আছে। মামলায় চূড়ান্ত নিষ্পত্তির আপিল শুনানি নিয়ে আইনজীবীরা অনিশ্চিত। পিলখানায় বিদ্রোহের ঘটনা যেমন পুরো বিশ্বে আলোড়ন তুলেছিল, এক মামলায় এত আসামির সর্বোচ্চ সাজার আদেশও ছিল নজিরবিহীন। পিলখানার ঘটনায় দায়ের করা দুটি মামলার মধ্যে বিচারিক আদালত ও হাইকোর্টে হত্যা মামলার রায় হলেও ১৬ বছরেও শেষ হয়নি বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা মামলার বিচার। তবে দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে শুধু খুনের বিচার করলেই চলবে না, ষড়যন্ত্রের আসল রূপ উন্মোচন করতে হবে। ২৫ ফেব্রুয়ারির হত্যাকাণ্ড শুধু এই ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারের অস্তিত্বের ওপর আঘাত নয়, এটা গোটা জাতির স্বাধীন অস্তিত্বের ওপর আঘাত। মনে রাখতে হবে, যে দেশ মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হয়, তার ক্ষয় নেই, পরাজয় নেই। তাই এখন প্রয়োজন জাতীয় ঐক্যের, ঐক্যবদ্ধ জাতীয় শক্তির এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ঐকান্তিকভাবে ধারণ করে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। তা ছাড়া দেশে নিরাপত্তার স্বার্থে শুধু খুনের বিচার করলেই চলবে না, ষড়যন্ত্রের আসল রূপ উন্মোচন সাম্প্রতিক সময়ে সচেতন জনগণের দাবি।
সর্বশেষে প্রচণ্ড ক্ষোভে ও দুঃখে বলতে হচ্ছে, আমরা শুধু বিপুলসংখ্যক সেনা কর্মকর্তাকে হারাইনি, হারিয়েছি বিডিআরের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকেও। বিডিআর ধ্বংস হয়েছে, বহু নিরপরাধ বিডিআর জওয়ানের জীবনও আজ ধ্বংস হবে। বহু পরিবার বিনষ্ট হবে। বহু জীবন ধুঁকে ধুঁকে মরবে। কে এই দায় নেবে?
লেখক : লোকসংস্কৃতি গবেষক, রাষ্ট্রচিন্তক, সমাজবিজ্ঞানী এবং প্রাবন্ধিক। পিএইচডি ফেলো, নিউইয়র্ক
পিলখানা ঢাকার পশ্চিমাঞ্চলে এক বিরাট এলাকা নিয়ে অবস্থিত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে এই পিলখানা নির্মিত হয় এবং সরকারি হাতি রাখা হতো। তা ছাড়া বহু মানুষ ভাড়া দিয়ে তাদের হাতি রাখতেন। মুঘল আমলে ঢাকা শহরের উত্তরাংশে আরেকটি বড় পিলখানা ছিল। সেই সময় শাসনকর্তা পিলখানায় অবস্থানরত হাতিগুলোকে গোসলের জন্য উনবিংশ শতাব্দীতে ঢাকার নবাবগঞ্জ এলাকায় বুড়িগঙ্গার তীরে একটি ঘাট তৈরি করেছিলেন। অদ্যাবধি ওই ঘাটটিকে জনসাধারণ ‘হাতিঘাট’ বলেই আখ্যায়িত করে আসছেন। অন্যদিকে নতুন হাতি পোষ মানানোর ব্যবস্থা করা হতো পিলখানায়। ১৮৯৫ সালে বাংলার গভর্নর চার্লস এলিয়েটের উপস্থিতির সময়ও একবার হাতি মেলা প্রদর্শনী হয়েছিল। তা ছাড়া ব্রিটিশ শাসন আমলেই পিলখানায় একটি সেনানিবাস প্রতিষ্ঠা করা হয়। পাকিস্তান সময়ের ইপিআর এবং বর্তমানে আধাসামরিক বাংলাদেশ রাইফেলস বাহিনীর হেডকোয়ার্টার্স অবস্থিত।
সবুজের সমারোহ ও সৌন্দর্যের মূর্ত প্রতীক ছোট একটি দেশের নাম বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় এ দেশ। পৃথিবীর ইতিহাসে এ জাতির সন্তানেরাই প্রথম মায়ের ভাষার জন্য ১৯৫২ সালে বুকের তাজা রক্ত ঝরিয়েছিল এবং জাতি সেদিন হারিয়েছিল অনেক সূর্যসন্তানকে। ভাবতে খুব ভালো লাগে, আমি এ দেশেরই একজন গর্বিত সন্তান।
বাংলাদেশ রাইফেলস দেশপ্রেমের গৌরবময় ঐতিহ্যবাহী এক বাহিনী। এ বাহিনীর বীরত্বগাথা ২২৫ বছরের। প্রায় ৩ শতাব্দীর অধিক সময় ধরে এ বাহিনীর প্রতিটি সদস্য অপরিসীম ত্যাগ-তিতিক্ষা ও দক্ষতার সঙ্গে সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করে আসছে। ১৭৭০ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নাম ছিল রামগড় লোকাল ব্যাটালিয়ন বা আরএলবি। দ্য ফ্রন্টিয়ার প্রোটেকশন ফোর্স থেকে ১৭৭৫ সালে গঠিত হয় আরএলবি। ১৮৬১ সালে আরএলবি বিলুপ্ত করে গঠন করা হয় ফ্রন্টিয়ার গার্ডস বা এফজি। এ নামে বাহিনী ছিল ১৮৯০ সাল পর্যন্ত। ১৮৯১ সালে সীমান্তরক্ষী বাহিনী হিসেবে এফজি রূপান্তরিত হয় বেঙ্গল মিলিটারি পুলিশ বা বিএমপি হিসেবে। ১৯১৯ সাল পর্যন্ত ওই বাহিনী নামে দায়িত্ব পালন করে। ১৯২০ সালে নতুন নাম ধারণা করে ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার্স রাইফেলস বা ইএফআর।
১৯৪৬ সাল পর্যন্ত ইএফআর নামে দায়িত্ব পালন করার পর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর নাম ধারণ করে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস বা ইপিআর। ১৯৫৮ সালে ওই বাহিনীকে চোরাচালান দমনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। বাংলাদেশ রাইফেলস বিডিআর ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ইপিআর স্থলাভিষিক্ত বাহিনী। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে ইপিআর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাংলাদেশ রাইফেলস বা বিডিআর। ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ পিলখানা ট্রাজেডির পর এই বাহিনীর নাম রাখা হয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা বিজিবি। ১৯৮০ সালের ৩ মার্চ বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এই বাহিনীর কর্মকাণ্ডের বিশেষ স্বীকৃতি হিসেবে জাতীয় পতাকা প্রদান করা হয়। বিডিআরের ব্যবহৃত খাকি ইউনিফর্মের পরিবর্তে তিন রঙের সংমিশ্রণে ছাপা কাপড়ের ইউনিফর্ম প্রবর্তন করা হয় ২০০১ সালে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে দ্বিতীয় স্থলাভিষিক্ত হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল তৎকালীন ইপিআর তথা বর্তমান বিডিআর বাহিনীর। গর্বের সঙ্গে উচ্চারিত এই বাহিনীর সদস্যদের আত্মদান ও দেশপ্রেমের অনন্য দৃষ্টান্ত। ইতিহাসে চির অম্লান এক ছবি রেখে গেছে হাজারো সৈনিকের জন্য। দিগ্্বিদিক চলন, পীড়ন, জুলুম, হত্যাযজ্ঞ আর বিস্ফোরণ শুরুর প্রাক্কালে ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ রাতে পাকিস্তানের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধাচরণ করে স্বাধীনতাকামী মুক্তিপ্রত্যয়ী কয়েকজন বিডিআর সেনা তৎকালীন ইপিআর পিলখানায় প্রথম উত্তোলন করে স্বাধীন বাংলাদেশের বহ্নিমান সূর্যপতাকা। বিডিআর সদর দপ্তরে অবস্থিত প্যারেড গ্রাউন্ডের বটবৃক্ষের শীর্ষ শাখায় নির্ভীক এই সৈনিকেরা উড়িয়ে দিয়েছিল মুক্তির নিশান। এসব অকুতোভয় বিডিআর সেনাকে বেরী জান্তার চরম নির্মমতার শিকার হতে হলো।
মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে বাংলাদেশ রাইফেলস বাহিনীর সদস্যদের চরম আত্মত্যাগ জাতি চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। মহান মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত প্রান্তরে অসামান্য অবদান ও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখে বিজয়ের অন্যতম কারিগর হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয় বিডিআর তথা তৎকালীন ইপিআর। একটি আধাসামরিক বাহিনী হিসেবে সীমিত সংখ্যক পুরোনো অস্ত্রকে সম্বল করে ইপিআর সৈনিকেরা মুক্তিযুদ্ধে যে অগাধ দেশপ্রেম, বীরত্ব ও সুমহান আত্মত্যাগের ইতিহাস রচনা করেছে, তার উদাহরণ বিরল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান বাহিনীর আক্রমণের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের বাঙালি সদস্যরা প্রাথমিক প্রতিরোধ সৃষ্টি করেন। প্রথম দিকে ইপিআরের বাঙালি সৈনিকরা কলাকৌশলগত কারণে বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে জিঞ্জিরা থেকে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পরে পাকিস্তানের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ১ লাখ নিয়মিত সৈনিকের বিরুদ্ধে ইপিআরের ১২ হাজার বাঙালি সৈনিক ১১ সেক্টরে ৯ মাস প্রত্যক্ষ যুদ্ধে নিয়োজিত ছিলেন। ইপিআর বাঙালি সৈনিকদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা বাংলাদেশের জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে অধিকতর সংঘটিত করে প্রতিরোধ রচনা ও রণাঙ্গনের যুদ্ধ করার সাহসে উজ্জীবিত করে তুলেছিল। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এই বাহিনীকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী শুধু নিñিদ্র নিরাপত্তাব্যবস্থাই নয়, চোরাচালান রোধ করার মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে স্বাবলম্বী করার ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করছে। মানব পাচার বাংলাদেশের অন্যতম সমস্যা। এ মানব পাচার রোধে সীমান্তে তীক্ষè দৃষ্টি রয়েছে বিডিআরের। আধাসামরিক বাহিনী হলেও দেশের নিয়মিত সামরিক বাহিনীর চেয়ে এর গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়। সীমান্ত মহড়া ছাড়া ওই বাহিনীর অন্যান্য দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে সীমান্তবর্তী এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা, মাদকদ্রব্য আটক, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, বেআইনি কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ এবং প্রয়োজনে দেশের অভ্যন্তরে অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে শান্তি-শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে সরকারকে সহযোগিতা করা। জাতীয় দুর্যোগ ও সংকটে আর্তমানবতার সেবায় এই বাহিনী প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখে আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে রাখার ক্ষেত্রে ‘অপারেশন ডালভাত’ কর্মসূচি ছিল বাংলাদেশ রাইফেলসের আরেকটি অন্যতম সেবাধর্মী কাজ। তবে ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় ঘটে গেছে ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম ঘটনা। সবাই এর নাম দিয়েছে ‘পিলখানা ট্র্যাজেডি’। বিডিআর বিদ্রোহের নামে যে বর্বরোচিত ও জঘন্য হত্যাকাণ্ড ঘটে গেল, তা নিন্দা জানানোর ভাষা আমার নেই। বস্তুতপক্ষে, এরই মাধ্যমে জাতির ইতিহাসে যোগ হলো আরেকটি জঘন্যতম অধ্যায়। বিডিআর বিদ্রোহের অন্তরালে কী ছিল? কেনই-বা এ ঘটনা ঘটানো হলো? ষড়যন্ত্রকারী কারা? তাদের উদ্দেশ্যই-বা কী ছিল?
জাতিকে ভয়ংকর ঝাঁকুনি দিয়ে একটা রুদ্ধশ্বাস দশায় ফেলে ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিডিআর বিদ্রোহের যবনিকাপাত ঘটেছে। পরিকল্পিত নৃশংস হত্যাযজ্ঞে জাতি হারিয়েছে প্রতিরক্ষা কৌশলে সুশিক্ষিত ৫৪ বা ততোধিক কর্তব্যরত কৃতী সন্তান, সাহসী ও দক্ষ সেনা কর্মকর্তা। জাতি রাষ্ট্রের প্রহরায় বা প্রধান অঙ্গ এখন পক্ষাঘাতগ্রস্ত। রাষ্ট্রের কান্ডারি এবং দেশদরদি নাগরিকরা বেদিশা না হলেও আমরা মর্মাহত বিস্ময়-বিমূঢ়। আর গণচেতনায় বিপদাশঙ্কা ও অনিশ্চয়তার অবসাদ ঘনীভূত করে রেখেছে পিলখানা।
প্রতিবছরের মতো (২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯) শুরু হয়েছিল বিডিআর সপ্তাহ। তাদের বিগত বছরের সাফল্য, ব্যর্থতা ও সমস্যা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয় এবং নির্ধারণ করা হয় পরবর্তী বছরের কর্মপরিকল্পনা। নির্দিষ্ট সময়ে সভা শুরু হয়। বিডিআরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমদ ৯টা ১ মিনিটে বক্তব্য শুরু করেন। শেষ হওয়ার পূর্বেই দক্ষিণ দিক থেকে প্যান্ট ও গেঞ্জি পরিহিত এক সৈনিক এসএমজি তাক করে ডিজির সামনে এসে দাঁড়ায়। এ সময় কর্মকর্তারা ডিজিকে ঘিরে ফেলেন। এসএমজি তাক করে ওই সৈনিক ডিজিসহ সবাইকে এক লাইনে দাঁড়াতে বলে। ডিজি সামনে চলে যান, দরবার হলের কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই শুরু হয় গুলিবর্ষণ, সেই সাথে দরবার হল থেকে যে যেদিকে পারে সেদিকেই ছুটে পালিয়ে যেতে থাকে। তবে পুকুরের উত্তর দিক থেকে শুরু হয় ব্রাশফায়ার। ক্রমে গোলাগুলি বাড়তে থাকে এবং তীব্রতা বেড়ে যায়। বিদ্রোহী জওয়ানদের অধিকাংশই ছিল অল্পবয়স্ক। বিডিআর জওয়ানদের হত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাট মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে হার মানিয়েছে। ওই সময় বিডিআর সপ্তাহের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসে অনেকের আর ফিরে যাওয়া হয়নি। তাদের ফিরতে হয়েছিল লাশ হয়ে। বিডিআর বিদ্রোহীদের আচরণ ছিল হিংস্র ও কাপুরুষোচিত, যেটা জেহাদি জঙ্গিদের চরিত্রতুল্য নয়, যদিও জেহাদি নাশকতার ফলাফলও সমভাবে নৃশংস, নির্বিচার ও অমানবিক।
বিদ্রোহী জওয়ানরা দেশের অত্যন্ত দক্ষ, যোগ্য ও মেধাসম্পন্ন সেনা অফিসারদের ব্রাশফায়ার করে মেরেই ক্ষান্ত হয়নি, তাদের লাশ নিয়েও চালিয়েছিল অনেক ন্যক্কারজনক ঘটনা। লাশ পোড়ানো, লাশ বিকৃত করা, লাশ ড্রেনে ফেলে দেওয়া, গণকবর দেওয়া, সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারগুলোকে জিম্মি করে রাখা, তাদের বাসায় প্রবেশ করে মহিলাদের পাশবিক নির্যাতন করা, মালামাল লুটপাট করার ঘটনা যেন আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগকেও হার মানায়।
দেশবাসী কল্পনাই করতে পারেনি, বিদ্রোহী জওয়ানরা পিলখানার ভেতরে এত বড় নির্মম, জঘন্য ও নৃশংস কাণ্ড ঘটিয়েছে। দেশের এতগুলো সেনাসদস্যের জীবন কেড়ে নিয়েছে। এতগুলো পরিবারকে করেছে স্বামীহারা, সন্তানহারা ও পিতাহারা। সেনাসদস্যদের স্বজনদের আহাজারি দেখলে মনে হয়, আমরা আজ স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার অধিকার হারিয়ে ফেলেছি। যে প্রতিরক্ষা বাহিনী দেশ ও জনগণকে রক্ষা করবে কোনো বহিঃশক্তি বা অপশক্তি থেকে, আর সেই বাহিনীর মধ্যেই যদি ঘটে যায় এমন বর্বরোচিত ঘটনা, তাহলে নিরাপত্তা আজ কোথায়?
২৭ ফেব্রুয়ারি সেনা কর্মকর্তারা পিলখানার আনাচ-কানাচে তল্লাশি চালিয়ে তাণ্ডবলীলার অনেক বীভৎস চিত্র পেয়েছেন। একটি হলো গণকবর এবং ২৮ ফেব্রুয়ারি গণকবর থেকে উদ্ধার করা হয় ৬টি লাশ এবং আরো ৩টি গণকবরের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। এদের মধ্যে বিডিআরের মহাপরিচালকের পত্নী নাজনীন শাকিলও। বেসামরিক লোকসহ মৃতের সংখ্যা ৭৪। এ ছাড়া সেনাকর্মকর্তা নিখোঁজ রয়েছেন ৭০ জন। সব মিলিয়ে ১৫০ জন। পিলখানার ভেতরে দরবার হলের দিকে তাকালে মনে হয়, এখনো শেষ হয়নি বিডিআর সপ্তাহের রেশ। চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা জিনিসপত্র যেন এখনো অপেক্ষা করছে বিডিআর সপ্তাহ উদযাপনের জন্য। সমগ্র পিলখানার ভেতর এখন শুধু লাশ আর ধ্বংসের চিহ্ন।
তা ছাড়া বিয়ের ৮২ দিনের মাথায় স্বামীহারা নুসরাত নূর বাঁধন এখন নির্বাক, চোখে ভাসছে শুধু স্বামীর সেই হাস্যোজ্জ্বল চেহারা। বাঁধন স্বামীকে নিয়ে বেঁধেছিলেন নানা স্বপ্ন, কিন্তু বিয়ের বয়স ৩ মাস না পেরোতেই বাঁধনের সেই স্বপ্নের মৃত্যু ঘটে। বিদ্রোহীদের একটি তাজা বুলেট কেড়ে নেয় বাঁধনের প্রাণপ্রিয় স্বামী ক্যাপ্টেন মাজহারুল হায়দারের প্রাণ। পুলিশের সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদের বড় মেয়ে বাঁধনের শোক যেন গোটা পুলিশ বিভাগের শোক। আইজিপি নূর মোহাম্মদের মেয়ে নুসরাতের শোক যেন প্রতিটি পুলিশ সদস্যই বয়ে বেড়াচ্ছে। প্রাণবন্ত ক্যাপ্টেন মাজহারুল ছিলেন বিডিআর সদর দপ্তরের সকল সদস্যের প্রিয় মুখ। ছিলেন মহাপরিচালকের এডিসি। ২০০৮ সালের ৪ ডিসেম্বর বিয়ে করেছিলেন নুসরাতকে। ঘটা করে বৌভাত করেছিলেন বিডিআর দরবার হলে। ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ বুধবার সকালে বিডিআর মহাপরিচালক শাকিলের ওপর হামলার সময় তিনি তাকে রক্ষায় সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। কিন্তু তার চেষ্টা সফল হয়নি। যেসব বিডিআর জওয়ান ক্যাপ্টেন মাজহারুলের বৌভাত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল, তাদের হাতেই তিনি নির্মমভাবে নিহত হন। ঘাতকেরা তাতেই ক্ষান্ত হয়নি, তাকে দরবার হল থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে আনে। দরবার হলের বাইরে গুলি করে ঝাঁঝরা করে দেয় তার পুরো শরীর। মিনিটের মধ্যে নিভে যায় তার জীবনপ্রদীপ। এরপর ঘাতকেরা তার লাশ ফেলে দেয় স্যুয়ারেজ লাইনে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সামরিক বাহিনীর ৫৬ জন অফিসার শহীদ হয়েছেন, কিন্তু এক দিনে বা এক স্থানে মারা যাননি। তারা বিগত ৯ মাসের যুদ্ধ-প্রক্রিয়ায় মারা গিয়েছেন। অথচ ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ পিলখানায় মাত্র ১ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে ১২০ জন অফিসারকে মেরে ফেলা হয়। কেন তাদের মারা হলো? প্রমোশন বা চাকরির বেশি বেশি সুযোগ-সুবিধার জন্য কি এভাবে পিঁপড়ার মতো মিলিটারি অফিসার মারা হলো? আসলে ইস্যুটি কী ছিল? কোন ইস্যুতে এই রক্তের হোলি খেলা হলো? কে দেবে এর জবাব? জবাব দেওয়ার মতো কাউকে কি আর খুঁজে পাওয়া যাবে? আমি একজন শিক্ষক। এই পৈশাচিক ঘটনার ভেতর এবং বাইরের কথা কতটুকুই-বা জানি? তবে এতটুকুও নির্দ্বিধায় এখন বলা যায়, বিশাল একটি পরিকল্পনা ও চক্রান্তের বীভৎস পরিণতি। কারা রয়েছে এই চক্রান্তের সাথে জড়িত? এই হত্যাযজ্ঞের মেঘনাধ কে? অথবা কারা? যত দিন যাবে ততই এদের শনাক্ত করার দাবি প্রবল থেকে প্রবলতর হবে। দাবিদাওয়া এক জিনিস আর সেই দাবিদাওয়া আদায়ের পন্থা অন্য জিনিস।
ঢাকার সাভারে অবস্থিত সেনাবাহিনীর ৯ম ডিভিশনের অধিনায়ক ও বাংলাদেশ সরকারের সাবেক মন্ত্রী লেফটেন্যান্ট জেনারেল মীর শওকত আলী দৈনিক ইত্তেফাকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘বিডিআর জওয়ানদের বিদ্রোহ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে সেনাবাহিনীকে পিলখানায় ঢুকতে দেওয়া হলে তারা বিদ্রোহ দমন করতে পারত। সেনানিবাস থেকে মুভ করে এলে বিদ্রোহীরা ভয়ে পালিয়ে যেত। কারণ সবারই মৃত্যুর ভয় আছে। সেনাবাহিনী পারে না, এমন কাজ নেই। বিডিআরকে কেউ ইন্ধন জুগিয়েছে। এর পেছনে গভীর ষড়যন্ত্র কাজ করছে। আসল অপরাধী যারা, তাদের ধরা কঠিন। এই অপরাধীরা কীভাবে পালিয়েছে, তা উদঘাটন করতে হবে।’ তিনি আরো বলেন, এই পুরো ঘটনায় গোয়েন্দাদের চরম ব্যর্থতা আছে।
এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক যে ১৪ ব্যক্তিকে আলোচনার জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট নিয়ে গিয়েছিলেন, ওরা কারা? কী তাদের পরিচয়? ওরা এখন কোথায়?
উল্লেখ্য, ২৮ ফেব্রুয়ারি এক বিবৃতিতে বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্যরা বলেন, সেনা অফিসারদের ওপর যারা এই বর্বর হামলা চালিয়েছে, তারা হলো রাষ্ট্রবিরোধী শক্তি। এই শক্তি বিডিআরকে ধ্বংস করতে চায় এবং সেনাবাহিনীর মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে চায়। এই প্রেক্ষিতে জাতীয় স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব হুমকির সম্মুখীন। তাই এখন খুঁজে বের করতে হবে এই রাষ্ট্রবিরোধী শক্তির কোন স্থানীয় এজেন্ট কাজ করেছিল তাদের হয়ে? বিএনপিদলীয় নেতারা মনে করেন, সেনা অফিসার হত্যা এবং পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ব্যর্থ এবং হত্যা, লুট, অগ্নিসংযোগ এবং নারী নির্যাতন প্রতিরোধে তৎকালীন সরকার সময়মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে তার দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারেন না।
তবে বিডিআর বিদ্রোহ ও গণহত্যা নিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে উত্তপ্ত বিতর্ক হয়েছিল। তখন বিরোধী দলের সদস্যরা প্রশ্ন করেন, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকের পর বিডিআর প্রতিনিধিরা যখন অস্ত্র সমর্পণ করতে যাচ্ছিলেন, তখন এসএমএস করে কারা এ কাজটি করতে বারণ করেছিল? যখন হত্যাকাণ্ড চলছিল, তখন একটি অস্ত্রবোঝাই পিকআপ ভ্যান পিলখানায় প্রবেশ করে এবং অস্ত্র বিতরণ করে। কারা সেখানে এই অস্ত্র প্রেরণ করেছিল?
পক্ষান্তরে বিরোধী দলের (বিএনপি) সদস্যরা অভিযোগ করেন, পিলখানায় এই ভয়াবহ গণহত্যার পর ঘাতকরা পালিয়ে গেল কীভাবে? কেন সেখানে ২০ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছিল? তারা প্রশ্ন করেন, ঘাতকদের পালিয়ে যাওয়ার জন্য কি সমগ্র পিলখানা বিডিআর ক্যাম্প অন্ধকারে আচ্ছন্ন করা হয়েছিল? বিডিআরের যেসব সদস্য নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিল, তাদের মুখে গোলাপি, কমলা এবং নীল রঙের স্কার্ফ আঁটা ছিল। কারা এগুলো সরবরাহ করেছিল?
বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অস্ত্র সংবরণ করে ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার জন্য বিডিআর সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে ২৭ ফেব্রুয়ারি জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেছিলেন, ‘অন্যথায় আমি দেশবাসীর স্বার্থে যেকোনো পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হব। আমাকে সে পথে যেতে বাধ্য করবেন না।’ তিনি বিডিআর, পুলিশ, আনসার ও সশস্ত্র বাহিনীকে যেকোনো স্বার্থান্বেষী মহলের উসকানিমূলক প্ররোচনা থেকে নিজেদের বিরত থাকার অনুরোধ জানিয়ে ‘পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে করার জন্য বিশেষ মহল তৎপর’, সে বিষয়ে সকলকে সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়ে সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশে বলেছিলেন, কোনোমতেই নিজের হাতে আইন তুলে নেবেন না। চেইন-অব-কমান্ড মেনে চলতে হবে। তিনি নিজের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে এবং নিজের পরিবারের স্বার্থে ধৈর্যধারণের অনুরোধ জানান। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে পরিস্থিতি একদম পাল্টে যায়। সৈনিকদের মধ্যে উত্তেজনা কমে আসে।
২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিডিআর সদর দপ্তরে যেসব নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে, সে সম্পর্কে একটি বড় প্রশ্ন এই যে, বিডিআর সদর দপ্তরে এ ধরনের লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলো অথচ বিডিআরের নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থা তার কোনো আভাসই দিতে পারল না। এটা কি গোয়েন্দা সংস্থার চরম ব্যর্থতা নয়? ২৫ ফেব্রুয়ারির ঠিক আগের দিন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিডিআর সদর দপ্তরে প্রধান অতিথি হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চক্রান্তকারীরা সেদিন যদি তাদের হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠত, তাহলে ব্যাপারটা কী ঘটত? তা ভাবতেও শিউরে উঠতে হয়। বিডিআরের নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থাই সেনা কর্মকর্তাদের এই হত্যাযজ্ঞের পেছনে একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে বলে যে অভিযোগ উঠেছে, তার জবাব কী?
ভাবতে অবাক লাগে, বেঁচে যাওয়া অফিসারদের বক্তব্যে জানা যায়, অনেক বিডিআর জওয়ান নিজস্ব শক্তি দিয়ে অফিসারদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল, বাঁচানোর চেষ্টা করতে গিয়ে জওয়ানদের প্রাণ দিতে হয়েছে, তবে তারা অপেক্ষা করেছে তাদের কেউ মুক্ত করতে আসবে কিন্তু না! কেউ কি উদ্ধার করতে এসেছে? এমনকি প্রধানমন্ত্রীর নিকট বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমদ সাহায্যের জন্য টেলিফোন করার পরও তিনি কার পরামর্শে আর্মি না পাঠিয়ে হেলিকপ্টার পাঠিয়েছিলেন? উদ্ধার করতে কারা বাধা সৃষ্টি করেছিল? তার রহস্যই-বা কী ছিল? এখন সময় এসেছে তা উদঘাটন করার। এতগুলো মেধাবী বিডিআরের স্বাধীন দেশে জীবন দেওয়া কত যে নির্মম, তা ভাবতে অবাক লাগে। তবে ঘটনায় প্রমাণ করে, এই ঘটনা হঠাৎ করে সংঘটিত হয়নি। অন্তত ঘটনাটি অনেক আগে থেকেই পরিকল্পনা করা হয়েছিল, তাই সরকারের সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দারা কি ঘুমিয়ে ছিল, না জড়িত ছিল, কোনটি বলল?
তা ছাড়া বিডিআরের মহাপরিচালকসহ ৬৫-৭৪ জন ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাকে সকাল ১০ ঘটিকা থেকে আনুমানিক ১ থেকে দেড় ঘণ্টার মধ্যে গুলি করে হত্যা করা হলো। এমন একটি ঘটনার জন্য কি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কোনো ব্যর্থতা নেই? বিশেষ করে, বিদ্রোহ হত্যাকাণ্ড-পরবর্তী সময়ে তিনি যেভাবে পিলখানায় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে গিয়ে বিডিআর প্রধান জেনারেল শাকিল আহমদ ও অন্যান্য সামরিক কর্মকর্তার ভাগ্যে কী ঘটেছে এবং পিলখানার ভেতরে তাদের পরিবারবর্গের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার কোনো উদ্যোগ ছাড়াই দু-একটি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন, তা ছিল সম্পূর্ণ অমানবিক ও দায়িত্বহীন কাজ। শুধু একজন মন্ত্রী হিসেবে নয়, বরং একজন সাধারণ মানুষ হিসেবেও।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছাড়াও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সরকারের পক্ষ থেকে যারা পিলখানায় পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড ঘটে গিয়েছে এবং তা পর্যবেক্ষণ করে বেরিয়ে এসে দেশবাসীকে জানানোর কোনো প্রয়োজন মনে করেননি। বরং তারা পিলখানায় ঘটে যাওয়া বিদ্রোহ ও বিভিন্ন কাণ্ডের নেতৃত্বদানকারী কিছুসংখ্যক বিদ্রোহীকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে আসেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করার জন্য। যে তড়িৎ গতিতে প্রধানমন্ত্রী বিদ্রোহীদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শনের ঘোষণা দিলেন, তা দেখে এটা মনে করা স্বাভাবিক, বিশেষ করে ওই রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল বিদ্রোহীদের জন্য সরকারি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করার ব্যবস্থা করা। বিদ্রোহীদের প্রতি এত সহানুভূতি এবং বিদ্রোহীদের হাতে নিহত বিডিআর কর্মকর্তা ও তাদের পরিবার-পরিজনদের প্রতি এহেন উদাসীনতা কেন?
‘কিন্তু বিধাতার লিখন না যায় খণ্ডন’, নতুবা কেন এমন হবে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেও পুরো ঘটনা মোটেই আন্দাজ করতে পারেননি মন্ত্রী-এমপি এবং রাজনীতিবিদরা। তাদের চিন্তা ও চেতনা যেন সেই দিন বিধাতাই সংকীর্ণ করে রেখেছিলেন। আমি বিশ্বাস করি, মন্ত্রী, সংসদ সদস্যবৃন্দ অবশ্যই সম্মানিত আল্লাহর রহমতপ্রাপ্ত। নতুবা তারা লক্ষ লক্ষ মানুষের নেতা হতে পারতেন না। তারা কোনো না কোনো স্থানে পা রাখলে সেই জায়গার পরিস্থিতি সম্পর্কে অনেকটা ধারণা করতে পারেন। কিন্তু শুধু ২৫ ফেব্রুয়ারির ব্যাপারটাই ভিন্ন হয়ে গেল।
দেশবাসী আজও জানে না বিডিআর বিদ্রোহের নেপথ্যে কারা ছিল। এটা কি শুধু বিডিআরদের সামান্য দাবি-দাওয়ার ক্ষোভ, নাকি অন্য কিছু। তবে চৌকস সেনা অফিসার হত্যা করে প্রতিরক্ষা বাহিনীকে করেছে মারাত্মকভাবে দুর্বল, যা একটি দেশে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। অনেকগুলো সেনা পরিবারকে করেছে অভিভাবকহীন, অসহায় এবং পরনির্ভরশীল। সরকারের আর্থিক সহযোগিতায় তাদের পেটের ক্ষুধা নিবারণ হলেও মনের ক্ষুধা মিটবে না কোনো কিছুতেই। এসব মিলিয়ে ক্ষতি হলো কাদের? বিডিআরও বাংলাদেশের সন্তান, সেনাবাহিনীও বাংলাদেশের সন্তান। তাই সব দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত আজ বাংলাদেশ। তবে অনেকের মন্তব্য, এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের যেখানে নিরাপত্তা সরকার দিতে পারল না, তখন আমাদের ব্যাপারে তো প্রশ্নই আসে না। এ রকম হাজার প্রশ্নের উত্তর কে দেবে?
পৃথিবীর ইতিহাসের এক বর্বরোচিত কাণ্ড ঘটে গেল পিলখানায়। বিদ্রোহী বিডিআর সদস্য ও তাদের দোসরদের হাতে নৃশংসভাবে প্রাণ দিতে হলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বাঘা বাঘা অফিসারদের। তবে তারা জাতীয় বীর। সেনাবাহিনীকে উচ্চ র্যাংকে নিয়ে আসতে সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে এবং দেশ-বিদেশে বাঙালির জন্য শহীদ সেনারা অনেক সুনাম বয়ে এনেছিল। বিডিআরকে হত্যা করে দেশকে আরো ৩০ বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।
পিলখানার এ হত্যাকাণ্ড ছিল সম্পূর্ণ সুপরিকল্পিত। পলাশীর আক্রমণের মতো এক সুগভীর ষড়যন্ত্রের শিকার বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এ নির্মম হত্যাকাণ্ডে গোটা জাতি হতবাক ও স্তম্ভিত। গোটা বিশ্ব আশ্চর্যান্বিত হয়েছে। পৃথিবীর কোনো দেশে এভাবে একটি সেনাবাহিনীর কোনো অফিসারদের বিদ্রোহের নামে তাণ্ডবলীলা চালিয়ে হত্যা করা হয়নি। তবে সেনাবাহিনী হচ্ছে একটি দেশের জাতীয় সম্পদ।
রাজনীতি হচ্ছে জনগণের কল্যাণের জন্য। জাতিকে শোষণ, যন্ত্রণা ও নিপীড়ন থেকে রক্ষা করার জন্য। দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদরা কখনো আত্মঘাতী কোনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে জাতির বীর সন্তানদের ধ্বংস করে দিতে পারে না। তবে বাইরের ষড়যন্ত্রের সাথে কোনো রাজনৈতিক দলের ব্যক্তিবিশেষ সম্পর্ক থাকতে পারে। অর্থের লোভে তারা মীরজাফরের মতো জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে না। কেননা বাঙালিদের রক্তে নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও মীরজাফর উভয়ের রক্তের প্রবাহ রয়েছে। যেসব রাজনীতিবিদ বা বিডিআর সদস্য এসব ন্যক্কারজনক ঘটনার সাথে জড়িত, তারা পশু ও মীরজাফর। যারা এ পৈশাচিক ঘটনার খলনায়ক, তাদের সুবিচার বাংলার জনগণ চায় এবং তদন্ত কাজকে কখনো বাধাগ্রস্ত না করার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ও অন্য উপদেষ্টাদেরকে তদন্ত কাজকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত না করার আহ্বান জানিয়েছেন।
বাংলাদেশের আপামর জনগণের ও প্রবাসে বসবাসরত বাংলাদেশিরাও শোকে কাতর ও পাথর। অবাক বিস্ময়ে তারা তাকিয়ে আছেন তদন্ত কর্মের দিকে। অধিক আগ্রহে অপেক্ষা করছেন দোষীদের কবে শাস্তি হবে।
আট বছর আগেই পিলখানা হত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায় হলেও এক যুগ আগের বিস্ফোরক আইনের মামলার বিচার এখনো আদালতে ঝুলে আছে। মামলায় চূড়ান্ত নিষ্পত্তির আপিল শুনানি নিয়ে আইনজীবীরা অনিশ্চিত। পিলখানায় বিদ্রোহের ঘটনা যেমন পুরো বিশ্বে আলোড়ন তুলেছিল, এক মামলায় এত আসামির সর্বোচ্চ সাজার আদেশও ছিল নজিরবিহীন। পিলখানার ঘটনায় দায়ের করা দুটি মামলার মধ্যে বিচারিক আদালত ও হাইকোর্টে হত্যা মামলার রায় হলেও ১৬ বছরেও শেষ হয়নি বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা মামলার বিচার। তবে দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে শুধু খুনের বিচার করলেই চলবে না, ষড়যন্ত্রের আসল রূপ উন্মোচন করতে হবে। ২৫ ফেব্রুয়ারির হত্যাকাণ্ড শুধু এই ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারের অস্তিত্বের ওপর আঘাত নয়, এটা গোটা জাতির স্বাধীন অস্তিত্বের ওপর আঘাত। মনে রাখতে হবে, যে দেশ মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হয়, তার ক্ষয় নেই, পরাজয় নেই। তাই এখন প্রয়োজন জাতীয় ঐক্যের, ঐক্যবদ্ধ জাতীয় শক্তির এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ঐকান্তিকভাবে ধারণ করে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। তা ছাড়া দেশে নিরাপত্তার স্বার্থে শুধু খুনের বিচার করলেই চলবে না, ষড়যন্ত্রের আসল রূপ উন্মোচন সাম্প্রতিক সময়ে সচেতন জনগণের দাবি।
সর্বশেষে প্রচণ্ড ক্ষোভে ও দুঃখে বলতে হচ্ছে, আমরা শুধু বিপুলসংখ্যক সেনা কর্মকর্তাকে হারাইনি, হারিয়েছি বিডিআরের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকেও। বিডিআর ধ্বংস হয়েছে, বহু নিরপরাধ বিডিআর জওয়ানের জীবনও আজ ধ্বংস হবে। বহু পরিবার বিনষ্ট হবে। বহু জীবন ধুঁকে ধুঁকে মরবে। কে এই দায় নেবে?
লেখক : লোকসংস্কৃতি গবেষক, রাষ্ট্রচিন্তক, সমাজবিজ্ঞানী এবং প্রাবন্ধিক। পিএইচডি ফেলো, নিউইয়র্ক