
বর্ণনাতীত রহমত, মাগফিরাত ও জাহান্নামের আগুন থেকে পরিত্রাণের সুমহান বার্তা নিয়ে পবিত্র মাহে রমজান বছর শেষে আবারও বিশ্ব মুসলমানের দ্বারে কড়া নাড়ছে। প্রতিটি নফলকে ফরজের এবং প্রতিটি ফরজের গুরুত্ব ৭০ গুণ বাড়িয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিপূর্ণ মাহে রমজান চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী ১ মার্চ শনিবার থেকে শুরু হতে যাচ্ছে। মাহে রমজানের সাওম সাধনার প্রস্তুতি গ্রহণের তাগিদদান এবং উম্মতগণকে ফরজ সাওম পালনে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে আমাদের প্রিয় নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) বলেছিলেন, পবিত্র রজব বিশ্বপ্রতিপালক আল্লাহর মাস, শাবান মহানবী (সা.) এর মাস এবং রমজান বান্দার মাস। অনবদ্য কারণে পশ্চিমাকাশে পবিত্র রজবের চন্দ্রোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে আখেরি নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) স্বয়ং উচ্চারণ করতেন এবং সাহাবাগণকে উচ্চারণ করতে অনুরোধ করেছিলেন, হে আল্লাহ, আপনি আমাদের রজব এবং শাবানের আশীর্বাদ বা বরকত দান করুন এবং রমজান পর্যন্ত আমাদের পৌঁছিয়ে (হায়াত বাড়িয়ে) দিন)।
সর্বশ্রেষ্ঠ নবী-রাসুল হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর সেই নির্দেশানুসারে সারা বিশ্বের অগণিত ধর্মপ্রাণ মুসলমান চলতি বছরের ১ জানুয়ারি বুধবার দিবাগত সন্ধ্যায় রজবের চন্দ্রোদয় মুহূর্ত থেকে (পবিত্র রমজানের চন্দ্রোদয় সাপেক্ষে) আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার সূর্যাস্ত পর্যন্ত প্রতিটি ফরজ নামাজের পূর্বে বা পরে দোয়াটি তেলাওয়াত করবেন। পবিত্র হাদিসের বর্ণনা অনুসারে, উল্লিখিত দোয়াটি তেলাওয়াত আরম্ভকারী কোনো মুসলিম ভাইবোন পবিত্র রমজানের আগেই ইন্তেকাল করলে মহান আল্লাহ তায়ালা তার বা তাদের আমলনামায় পুরো রমজান মাসের সওয়াব লিপিবদ্ধ করবেন।
প্রকৃত প্রস্তাবে গাজা উপত্যকাসহ পশ্চিমাকূলের লাখ লাখ বাসিন্দা ও বাস্তুহারা ফিলিস্তিনি, খোলা আকাশের নিচে কালযাপনে বাধ্য হাজার হাজার ইউক্রেনবাসী; ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষে লিপ্ত পাকিস্তান-মধ্যপ্রাচ্যসহ ইসলামের মৌলিক আদর্শচ্যুত বিশ্ব মুসলিম এবং সমগ্র বিশ্বের কোটি কোটি নির্যাতিত-নিগৃহীত জনগোষ্ঠীর দুঃখ-দুর্দশার বর্ণনায় ভাষা হার মানতে বাধ্য। তাই জগৎজুড়ে দানবীয় শক্তির উত্থান এবং মুসলিম নিধনে ইসরায়েলসহ অমুসলিম শক্তিগুলোকে বিশ্বপরাশক্তির অধীশ্বরদের অকুণ্ঠ সমর্থনের পটভূমিতে বিশ্ব মুসলিমের জীবনে বরাবরের মতো এবারের পবিত্র মাহে রমজানের গুরুত্বও সন্দেহাতীতভাবে অপরিসীম। বর্তমানের চরম যুগসন্ধিক্ষণে হে রাব্বুল আ’লামিন, পবিত্র রমজানের সাওম যথাযথভাবে পালন ও তাকওয়া অর্জনের তৌফিক অর্জনের নিমিত্তে আমরা তোমার বিশেষ রহমত ভিক্ষা করছি। হে দয়াময়, তুমি আমাদের সানুনয় মিনতি কবুল করো। আমিন!
বিশ্ব মুসলিমের অবিনশ্বর জীবনবিধান পবিত্র কোরআনে সাওমের প্রতি গুরুত্ব আরোপকালে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ইয়া আইয়ুহাল্লাজিনা আ’মানু কুতেবা আলাইকুমুস্ সিয়ামু কামা কুতেবা আলাল্লাজিনা মিন কাবলিকুম লায়াল্লাকুম তাত্তাকুন। অর্থাৎ হে মুমিনগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীগণের ওপর। আশা যে তোমরা মুত্তাকি হবে (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৩)। এর থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়, হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর উম্মত ছাড়াও প্রত্যেক শরিয়তে এবং পূর্ববর্তী সকল নবী-রাসুলের উম্মতের ক্ষেত্রে সাওম পালনের বাধ্যবাধকতা ছিল। এমনতর বাস্তবতায় প্রাপ্তবয়স্ক, সবল-সুস্থ প্রত্যেক নরনারীর জন্য সাওম পালন করা ফরজ বা বাধ্যতামূলক দায়িত্ব বললে বিন্দুমাত্র বাড়িয়ে বলা হবে না। বিশ্ব মুসলিমের দ্বিতীয় জীবনবিধান পবিত্র হাদিসের ভাষায় সাওম অস্বীকারকারী সন্দেহাতীতভাবে কাফের হবে। আর কোনো ধরনের যুক্তিসিদ্ধ ওজর ছাড়া শয়তানের প্ররোচনায় বা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে সাওম পালন না করলে সে ব্যক্তি ফাসিক ও গোনাহগার হবে। সর্বশ্রেষ্ঠ নবী-রাসুল হজরত মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো যুক্তিসিদ্ধ ওজর কিংবা রোগব্যাধি ছাড়া পবিত্র রমজানের একটি সাওম ইচ্ছাকৃতভাবে ছেড়ে দেবে, সে রমজান মাস ছাড়া সারা জীবন সাওম পালন করলেও তা স্বেচ্ছায় পরিত্যাগকৃত সাওমের ক্ষতিপূরণ হবে না (তিরমিজি ও আবু দাউদ)। পবিত্র হাদিসে আরও বলা হয়েছে, সাওম হচ্ছে ঢাল বা আত্মরক্ষার বর্মস্বরূপ।
মোদ্দাকথা, স্বার্থের মোহাবিষ্ট জগৎ-সংসারে অহর্নিশ যাবতীয় অনাচার-অশ্লীলতা ও কুপ্রবৃত্তির হাতছানির বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার ঢাল বা বর্ম হচ্ছে সাওম। মিতাচার, পরিমিত আহার ও তাকওয়ার সঙ্গে সাওম পালন করলে পানাহারে নিয়মানুবর্তিতার অনুশীলন হয় এবং অতিভোজন ও মুখরোচক খাবার গোগ্রাসে গেলার আসক্তি ও মোহমুক্তি ঘটে। উল্লেখ্য, আরবি সাওম শব্দের বাংলা আভিধানিক অর্থ সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকা বা পরিহার করা। শরিয়তের পরিভাষায় পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালার বিশেষ রহমত এবং পুণ্য হাসিলের প্রত্যাশায় একাগ্রচিত্তে সুবেহ সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়তের সঙ্গে সর্ববিধ পানাহার, হালাল স্ত্রীসম্ভোগ এবং জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে যাবতীয় অপরাধ পুরোপুরি বর্জন করার নামই সাওম বা রোজা। যথাযথ নিয়মে সাওম পালনকারীগণ আর্থিক সাশ্রয় ছাড়াও অনাকাক্সিক্ষত রোগব্যাধির হাত থেকে রেহাই পান। আবার পরিমিত ভোজনের ফলে সাওম পালনকারীর সুস্বাস্থ্য বজায় থাকে এবং ঘাতক ব্যাধি হার্ট অ্যাটাক, কোলেস্টেরল, উচ্চ রক্তচাপসহ নানা জঘন্য অসুখ-বিসুখের সংক্রমণ প্রতিহত করা যায়। একাগ্রচিত্তে সাওম পালনের ফলে মনুষ্যত্ববোধের উন্মেষ ঘটে, পারস্পরিক সহানুভূতি, সহমর্মিতা ও সৌভ্রাতৃত্ব এবং সৃষ্টির প্রতি সেবার মনোবৃত্তি জাগ্রত হয়। অতিভোজন ও বিলাসবহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত বিত্তশালী সাওম পালনকারীগণ অর্ধভুক্ত, অভুক্ত ও অনাহারক্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর দুঃখকষ্ট হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পারেন। তাই স্বার্থপর, পরহিতবিমুখ এবং আত্মকেন্দ্রিক সাওম পালনকারীরাও অভাবগ্রস্তদের দুর্দশা লাঘবে উদারহস্তে দান-খয়রাতে অনুপ্রাণিত হন। একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে সাওম সাধনা ইসলামের মৌলিক আদর্শচ্যুত বর্তমানের ঘুণেধরা মুসলমানদের ধ্যান-জ্ঞান ও চিন্তার জগতে আমূল পরিবর্তন আনয়ন করতে সক্ষম। যথাযথ সাওম পালন মুসলমানদের পাপপঙ্কিল অন্তরে আমূল পরিবর্তন আনয়ন করে, আত্মকেন্দ্রিকতার স্থলে বিশ্বজনীনতা, স্বার্থপরতার স্থলে পরার্থপরতা, ভোগ-লালসার স্থলে নির্মোহ, সর্বোপরি অপরের দুঃখ-কষ্ট লাঘবে সহমর্মী ও সমব্যথী হওয়ার অনুপ্রেরণা জোগায়।
সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য, সাওমের চরম এবং পরম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি এবং তাকওয়া বা ফরহেজগারি অর্জন করা। তাকওয়া প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনের সুরা বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, লায়াল্লাকুম তাত্তাকূন (যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো)। তাকওয়া মানে আল্লাহভীতি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আল্লাহ শাস্তিদানে অত্যন্ত কঠোর এবং পাপসাগরে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হওয়া সত্ত্বেও আখেরি নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর অছিলায় আমরা সকলেই জান্নাত-প্রত্যাশী। তাই মানুষের অন্তরে আল্লাহর ভীতি জাগ্রত হওয়া এবং আল্লাহর অনুকম্পা লাভের আকাক্সক্ষা জাগ্রত হলে শয়তানের প্ররোচনা কিংবা জাগতিক মোহ মানুষকে সহজে প্রলুব্ধ করতে পারে না। আবার ষড়রিপুর মোহ এবং জাগতিক অপরাধমুক্তির বহ্নিশিখা সাওম পালনকারীর অন্তরে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকায় তাকওয়া অর্জনও সহজসাধ্য হয়। তাই সাওম ধৈর্য অনুশীলন, ক্রোধ সংবরণ, আত্মসংযম এবং কৃচ্ছ্রসাধন সর্বোপরি তাকওয়া অর্জনের প্রকৃষ্ট হাতিয়ার। অনস্বীকার্য উপাদেয় মুখরোচক ইফতারি প্রস্তুতির মহড়া, রসনা বিলাস, টেলিভিশনে যৌন উদ্দীপক নাচ-গান উপভোগ, পরচর্চা, অন্যের প্রতি বিদ্বেষ কিংবা অহেতুক হিংসার মনোবৃত্তি পোষণ ইত্যাদি সাওমের কাক্সিক্ষত সাফল্য অর্জনের অন্তরায়। তাই মেকি ইবাদত-বন্দেগির স্থলে রমজানের প্রতিটি মুহূর্ত পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতসহ সব ধরনের ইবাদত-বন্দেগিতে কাটানোর শপথ নেওয়া আমাদের প্রত্যেকের ইমানি দায়িত্ব ও কর্তব্যই বটে।
সাওমের ফজিলত প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআন মজিদে বলা হয়েছে : রমজান এমন একটি তাৎপর্যমণ্ডিত মাস, যে মাসে বিশ্বমানবের অভ্রান্ত পথনির্দেশক, তাদের জন্য পার্থিব জীবনের বিধিবিধান আর হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়কারী আল কোরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে কেউ এ মাসটি পাবে, সে যেন সাওম পালন করে (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৫)। তাই বলা যায়, পবিত্র রমজান মাসে কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার কারণে এ মাসের মহিমা ও মর্যাদা বর্ণনাতীত। আখেরি নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, বিশ্বপ্রতিপালক আল্লাহ তায়ালা বলেন, আসসাওমু লী ওয়ানা আজজী বিহি অর্থাৎ সাওম কেবল আমারই জন্য এবং আমি স্বয়ং এর প্রতিদান দেব। (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)। হজরত মোহাম্মদ (সা.) আরও বলেছেন, যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে এবং আখিরাতে সওয়াবের আশায় একাগ্রচিত্তে সাওম পালন করে, তার অতীত জীবনের যাবতীয় সগিরা গোনাহ মাফ করে দেওয়া হয় (বুখারি ও মুসলিম)। আখেরি নবীর (সা.) ভাষায় : পবিত্র রমজান মাস পাওয়ার পরও যে ব্যক্তি তার অতীতকালীন গোনাহ (সগিরা) মাফ করে নিতে পারেনি, সে সন্দেহাতীতভাবে হতভাগ্য ও ভাগ্যবিড়ম্বিত।
পবিত্র রমজান মাস ধৈর্য অনুশীলন এবং সবর বা আত্মসংযমের মাস। আর ধৈর্য অবলম্বনের বিনিময় হচ্ছে জান্নাত। পবিত্র রমজান মাসে মুমিনদের রিজিক বাড়িয়ে দেওয়া হয়। কোনো ব্যক্তি সাওম পালনকারীকে ইফতার করালে বিনিময়ে ওই ব্যক্তির সাওমের সমান সওয়াব পাবে। অথচ সাওম পালনকারীর সওয়াবে বিন্দুমাত্র হেরফের বা কমতি ঘটবে না। আবার পবিত্র রমজানে প্রতিটি নফল ইবাদতকে অন্য সময়ের ফরজ ইবাদত হিসেবে এবং প্রতিটি ফরজ ইবাদতকে অন্য সময়ের ৭০টি বা ততোধিক ফরজ ইবাদত হিসেবে গণ্য করা হয়। সাওমের অনন্য ও ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য : সাওম দৃষ্টির অগ্রাহ্য এবং বোধশক্তির অতীত বিশেষ শ্রেণির ইবাদত। প্রকৃত সাওম পালনকারী এবং মেকি সাওম পালনকারীর মধ্যকার পার্থক্য নির্ণয়ের সক্ষমতা একমাত্র সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মদর্শী আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও নেই। তাই রমজান মাসের প্রতিটি নফলকে অন্য মাসের ফরজের মর্যাদা এবং প্রতিটি ফরজের সওয়াবকে কমপক্ষে ৭০ গুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। আবার কোনো কোনো উত্তম কাজের পুণ্য ১০ গুণ, ৭০ গুণ, হাজার গুণ বাড়িয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও মহান আল্লাহ প্রদান করেছেন। অথচ সাওমের ব্যাপারে সর্বশক্তিমান আল্লাহ বলেছেন, সাওম আমারই জন্য এবং আমি নিজেই এর প্রতিদান দেব (বুখারি ও মুসলিম)। বিশেষত, ইফতারের পূর্ব মুহূর্তের দোয়া কবুলের প্রতিশ্রুতি মহান আল্লাহ প্রদান করেছেন। তাই ইফতারের পূর্বমুহূর্ত আমরা যথাসাধ্য মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে তৎপর থাকব, ইনশা আল্লাহ!
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ফজিলতের বিচারে মাহে রমজানকে তিনটি অংশে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম অংশ রহমতের, দ্বিতীয় অংশ মাগফিরাতের এবং শেষ অংশ জাহান্নাম থেকে মুক্তিলাভের। অতএব, পশ্চিমাকাশে পবিত্র রমজানের চাঁদ উদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই রহমতের অংশ শুরু হবে এবং পরচর্চা-পরশ্রীকাতরতা-গিবতসহ সর্ববিধ বদ-অভ্যাস যথাসম্ভব পরিহারপূর্বক কায়মনোবাক্যে ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল হব, ইনশা আল্লাহ। সাওমের সঙ্গে আত্মিক পরিশুদ্ধি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সোনা অত্যন্ত মূল্যবান ধাতু হলেও বস্তুত স্বর্ণখনিতে বিশুদ্ধ সোনা পাওয়া যায় না। খনি থেকে উত্তোলিত আকরিক বা ময়লাযুক্ত সোনাকে আগুনে বারবার পুড়িয়ে অ্যালয় বা খাদমুক্ত এবং বিশুদ্ধ সোনায় পরিণত করা হয়। তদ্রƒপ মানুষের অন্তরের গভীরতম প্রদেশস্থিত যাবতীয় পাশবিক প্রবৃত্তি, কাম-ক্রোধ- লোভ ও ইন্দ্রিয়ের মূলোচ্ছেদ করেই আত্মার পরিশুদ্ধি বা তাকওয়া অর্জন করতে হবে। আর বর্তমানের সমস্যা জর্জরিত ও পাপপঙ্কিল মুসলমানদের পরিত্রাণ এবং তাকওয়া অর্জনের প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে একাগ্রচিত্তে সাওম পালন করা। জগৎ-সংসারে স্বার্থের হাতছানিতে আমরা সবাই প্রলুব্ধ। ভুলত্রুটি আমাদের পার্থিব জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। মূলত চারিত্রিক দৃঢ়তার অভাবেই আমাদের আদি পিতা হজরত আদম (আ.) এবং আদি মাতা বিবি হাওয়া (আ.) মহান আল্লাহর প্রত্যক্ষ হুঁশিয়ারি বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন। আর চিরশত্রু শয়তানের প্ররোচনায় প্রলুব্ধ হয়ে নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল খান এবং স্বর্গচ্যুত হয়ে ধরাধামে নিক্ষিপ্ত হন। তাই আদম-হাওয়ার উত্তরসূরি হিসেবে আমাদের পক্ষে আল্লাহর রহমত ছাড়া চিরশত্রু শয়তানের প্ররোচনা থেকে নিস্তার লাভ সম্ভব নয়। স্বার্থের মোহাবিষ্ট জগৎ-সংসারে আমরা জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে সারাক্ষণ শয়তানের প্ররোচনায় প্রলুব্ধ হচ্ছি এবং পাপসাগরে তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম। অবশ্য পশ্চিমাকাশে পবিত্র রমজানের চন্দ্র উদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্বপ্রতিপালক আল্লাহ তায়ালা বেহেশতের সকল দরজা খুলে দেন, দোজখের দরজাগুলো বন্ধ করে দেন এবং মানুষের চিরশত্রু শয়তানকেও শৃঙ্খলিত করেন। কিন্তু আত্মবিশ্লেষণ কিংবা আত্মসচেতনতার অভাবে পবিত্র রমজান মাসেও পরচর্চা বা গিবতসহ সব ধরনের পাপাচার থেকে আমরা মুক্ত হতে পারছি না। আবার অনেকেই নানা টালবাহানায় সাওম পালন না করে শয়তানের ঘাড়ে দোষ চাপানোর চেষ্টা করি। প্রকৃত প্রস্তাবে আল্লাহ অত্যন্ত সূক্ষ্মদর্শী এবং শাস্তিদানে কঠোর।
পবিত্র কোরআনের মক্কায় অবতীর্ণ সুরা মূলকের দ্বিতীয় আয়াতে বলা হয়েছে, যিনি মৃত্যু এবং জীবন তোমাদের পরীক্ষা করার জন্য সৃষ্টি করেছেনÑকে তোমাদের মধ্যে কর্মে উত্তম; তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল। আর মানুষের অন্তিমযাত্রার একমাত্র সঙ্গী নিজস্ব আমল বা কর্মফল। পার্থিব জীবনের অন্তরঙ্গ সঙ্গী, বিত্ত-বৈভব, স্ত্রী-পুত্র-পরিজন কেউই কারও কবরের সঙ্গী হয় না।
যাহোক, হেলায়-খেলায়, হাসি-আনন্দে জীবনের সিংহভাগ অতিক্রম করে আমরা অনেকেই জীবনসায়াহ্নে উপনীত হয়েছি। এবারের পবিত্র মাহে রমজান হয়তো-বা আমার মতো অনেক পাপী-তাপীর জন্য জীবনের পুঞ্জীভূত অপরাধমুক্তির বিশেষ আশীর্বাদ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। তাই নিষ্কলুষ অন্তরে পবিত্র মাহে রমজানের সাওম পালনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণের সবিনয় অনুরোধ রইল। হে রাব্বুল আ’লামিন মাহে রমজানের প্রতিটি মুহূর্তকে ইবাদত-বন্দেগিতে কাটানোর সৌভাগ্য আমাদের দান করুন। জীবনের পুঞ্জীভূত গোনাহর পাহাড় মার্জনার নিমিত্তে গাফুরুর রাহিম ও লাতিফুল খাবির আল্লাহর দরবারে মিনতি জানাচ্ছি। হে বিশ্বপ্রতিপালক, দয়া করে আমাদের প্রতি পবিত্র রমজানের অবর্ণনীয় রহমত বর্ষণ করুন। আমিন!
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, ঠিকানা, নিউইয়র্ক।
সর্বশ্রেষ্ঠ নবী-রাসুল হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর সেই নির্দেশানুসারে সারা বিশ্বের অগণিত ধর্মপ্রাণ মুসলমান চলতি বছরের ১ জানুয়ারি বুধবার দিবাগত সন্ধ্যায় রজবের চন্দ্রোদয় মুহূর্ত থেকে (পবিত্র রমজানের চন্দ্রোদয় সাপেক্ষে) আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার সূর্যাস্ত পর্যন্ত প্রতিটি ফরজ নামাজের পূর্বে বা পরে দোয়াটি তেলাওয়াত করবেন। পবিত্র হাদিসের বর্ণনা অনুসারে, উল্লিখিত দোয়াটি তেলাওয়াত আরম্ভকারী কোনো মুসলিম ভাইবোন পবিত্র রমজানের আগেই ইন্তেকাল করলে মহান আল্লাহ তায়ালা তার বা তাদের আমলনামায় পুরো রমজান মাসের সওয়াব লিপিবদ্ধ করবেন।
প্রকৃত প্রস্তাবে গাজা উপত্যকাসহ পশ্চিমাকূলের লাখ লাখ বাসিন্দা ও বাস্তুহারা ফিলিস্তিনি, খোলা আকাশের নিচে কালযাপনে বাধ্য হাজার হাজার ইউক্রেনবাসী; ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষে লিপ্ত পাকিস্তান-মধ্যপ্রাচ্যসহ ইসলামের মৌলিক আদর্শচ্যুত বিশ্ব মুসলিম এবং সমগ্র বিশ্বের কোটি কোটি নির্যাতিত-নিগৃহীত জনগোষ্ঠীর দুঃখ-দুর্দশার বর্ণনায় ভাষা হার মানতে বাধ্য। তাই জগৎজুড়ে দানবীয় শক্তির উত্থান এবং মুসলিম নিধনে ইসরায়েলসহ অমুসলিম শক্তিগুলোকে বিশ্বপরাশক্তির অধীশ্বরদের অকুণ্ঠ সমর্থনের পটভূমিতে বিশ্ব মুসলিমের জীবনে বরাবরের মতো এবারের পবিত্র মাহে রমজানের গুরুত্বও সন্দেহাতীতভাবে অপরিসীম। বর্তমানের চরম যুগসন্ধিক্ষণে হে রাব্বুল আ’লামিন, পবিত্র রমজানের সাওম যথাযথভাবে পালন ও তাকওয়া অর্জনের তৌফিক অর্জনের নিমিত্তে আমরা তোমার বিশেষ রহমত ভিক্ষা করছি। হে দয়াময়, তুমি আমাদের সানুনয় মিনতি কবুল করো। আমিন!
বিশ্ব মুসলিমের অবিনশ্বর জীবনবিধান পবিত্র কোরআনে সাওমের প্রতি গুরুত্ব আরোপকালে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ইয়া আইয়ুহাল্লাজিনা আ’মানু কুতেবা আলাইকুমুস্ সিয়ামু কামা কুতেবা আলাল্লাজিনা মিন কাবলিকুম লায়াল্লাকুম তাত্তাকুন। অর্থাৎ হে মুমিনগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীগণের ওপর। আশা যে তোমরা মুত্তাকি হবে (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৩)। এর থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়, হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর উম্মত ছাড়াও প্রত্যেক শরিয়তে এবং পূর্ববর্তী সকল নবী-রাসুলের উম্মতের ক্ষেত্রে সাওম পালনের বাধ্যবাধকতা ছিল। এমনতর বাস্তবতায় প্রাপ্তবয়স্ক, সবল-সুস্থ প্রত্যেক নরনারীর জন্য সাওম পালন করা ফরজ বা বাধ্যতামূলক দায়িত্ব বললে বিন্দুমাত্র বাড়িয়ে বলা হবে না। বিশ্ব মুসলিমের দ্বিতীয় জীবনবিধান পবিত্র হাদিসের ভাষায় সাওম অস্বীকারকারী সন্দেহাতীতভাবে কাফের হবে। আর কোনো ধরনের যুক্তিসিদ্ধ ওজর ছাড়া শয়তানের প্ররোচনায় বা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে সাওম পালন না করলে সে ব্যক্তি ফাসিক ও গোনাহগার হবে। সর্বশ্রেষ্ঠ নবী-রাসুল হজরত মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো যুক্তিসিদ্ধ ওজর কিংবা রোগব্যাধি ছাড়া পবিত্র রমজানের একটি সাওম ইচ্ছাকৃতভাবে ছেড়ে দেবে, সে রমজান মাস ছাড়া সারা জীবন সাওম পালন করলেও তা স্বেচ্ছায় পরিত্যাগকৃত সাওমের ক্ষতিপূরণ হবে না (তিরমিজি ও আবু দাউদ)। পবিত্র হাদিসে আরও বলা হয়েছে, সাওম হচ্ছে ঢাল বা আত্মরক্ষার বর্মস্বরূপ।
মোদ্দাকথা, স্বার্থের মোহাবিষ্ট জগৎ-সংসারে অহর্নিশ যাবতীয় অনাচার-অশ্লীলতা ও কুপ্রবৃত্তির হাতছানির বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার ঢাল বা বর্ম হচ্ছে সাওম। মিতাচার, পরিমিত আহার ও তাকওয়ার সঙ্গে সাওম পালন করলে পানাহারে নিয়মানুবর্তিতার অনুশীলন হয় এবং অতিভোজন ও মুখরোচক খাবার গোগ্রাসে গেলার আসক্তি ও মোহমুক্তি ঘটে। উল্লেখ্য, আরবি সাওম শব্দের বাংলা আভিধানিক অর্থ সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকা বা পরিহার করা। শরিয়তের পরিভাষায় পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালার বিশেষ রহমত এবং পুণ্য হাসিলের প্রত্যাশায় একাগ্রচিত্তে সুবেহ সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়তের সঙ্গে সর্ববিধ পানাহার, হালাল স্ত্রীসম্ভোগ এবং জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে যাবতীয় অপরাধ পুরোপুরি বর্জন করার নামই সাওম বা রোজা। যথাযথ নিয়মে সাওম পালনকারীগণ আর্থিক সাশ্রয় ছাড়াও অনাকাক্সিক্ষত রোগব্যাধির হাত থেকে রেহাই পান। আবার পরিমিত ভোজনের ফলে সাওম পালনকারীর সুস্বাস্থ্য বজায় থাকে এবং ঘাতক ব্যাধি হার্ট অ্যাটাক, কোলেস্টেরল, উচ্চ রক্তচাপসহ নানা জঘন্য অসুখ-বিসুখের সংক্রমণ প্রতিহত করা যায়। একাগ্রচিত্তে সাওম পালনের ফলে মনুষ্যত্ববোধের উন্মেষ ঘটে, পারস্পরিক সহানুভূতি, সহমর্মিতা ও সৌভ্রাতৃত্ব এবং সৃষ্টির প্রতি সেবার মনোবৃত্তি জাগ্রত হয়। অতিভোজন ও বিলাসবহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত বিত্তশালী সাওম পালনকারীগণ অর্ধভুক্ত, অভুক্ত ও অনাহারক্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর দুঃখকষ্ট হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পারেন। তাই স্বার্থপর, পরহিতবিমুখ এবং আত্মকেন্দ্রিক সাওম পালনকারীরাও অভাবগ্রস্তদের দুর্দশা লাঘবে উদারহস্তে দান-খয়রাতে অনুপ্রাণিত হন। একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে সাওম সাধনা ইসলামের মৌলিক আদর্শচ্যুত বর্তমানের ঘুণেধরা মুসলমানদের ধ্যান-জ্ঞান ও চিন্তার জগতে আমূল পরিবর্তন আনয়ন করতে সক্ষম। যথাযথ সাওম পালন মুসলমানদের পাপপঙ্কিল অন্তরে আমূল পরিবর্তন আনয়ন করে, আত্মকেন্দ্রিকতার স্থলে বিশ্বজনীনতা, স্বার্থপরতার স্থলে পরার্থপরতা, ভোগ-লালসার স্থলে নির্মোহ, সর্বোপরি অপরের দুঃখ-কষ্ট লাঘবে সহমর্মী ও সমব্যথী হওয়ার অনুপ্রেরণা জোগায়।
সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য, সাওমের চরম এবং পরম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি এবং তাকওয়া বা ফরহেজগারি অর্জন করা। তাকওয়া প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনের সুরা বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, লায়াল্লাকুম তাত্তাকূন (যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো)। তাকওয়া মানে আল্লাহভীতি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আল্লাহ শাস্তিদানে অত্যন্ত কঠোর এবং পাপসাগরে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হওয়া সত্ত্বেও আখেরি নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর অছিলায় আমরা সকলেই জান্নাত-প্রত্যাশী। তাই মানুষের অন্তরে আল্লাহর ভীতি জাগ্রত হওয়া এবং আল্লাহর অনুকম্পা লাভের আকাক্সক্ষা জাগ্রত হলে শয়তানের প্ররোচনা কিংবা জাগতিক মোহ মানুষকে সহজে প্রলুব্ধ করতে পারে না। আবার ষড়রিপুর মোহ এবং জাগতিক অপরাধমুক্তির বহ্নিশিখা সাওম পালনকারীর অন্তরে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকায় তাকওয়া অর্জনও সহজসাধ্য হয়। তাই সাওম ধৈর্য অনুশীলন, ক্রোধ সংবরণ, আত্মসংযম এবং কৃচ্ছ্রসাধন সর্বোপরি তাকওয়া অর্জনের প্রকৃষ্ট হাতিয়ার। অনস্বীকার্য উপাদেয় মুখরোচক ইফতারি প্রস্তুতির মহড়া, রসনা বিলাস, টেলিভিশনে যৌন উদ্দীপক নাচ-গান উপভোগ, পরচর্চা, অন্যের প্রতি বিদ্বেষ কিংবা অহেতুক হিংসার মনোবৃত্তি পোষণ ইত্যাদি সাওমের কাক্সিক্ষত সাফল্য অর্জনের অন্তরায়। তাই মেকি ইবাদত-বন্দেগির স্থলে রমজানের প্রতিটি মুহূর্ত পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতসহ সব ধরনের ইবাদত-বন্দেগিতে কাটানোর শপথ নেওয়া আমাদের প্রত্যেকের ইমানি দায়িত্ব ও কর্তব্যই বটে।
সাওমের ফজিলত প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআন মজিদে বলা হয়েছে : রমজান এমন একটি তাৎপর্যমণ্ডিত মাস, যে মাসে বিশ্বমানবের অভ্রান্ত পথনির্দেশক, তাদের জন্য পার্থিব জীবনের বিধিবিধান আর হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়কারী আল কোরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে কেউ এ মাসটি পাবে, সে যেন সাওম পালন করে (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৫)। তাই বলা যায়, পবিত্র রমজান মাসে কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার কারণে এ মাসের মহিমা ও মর্যাদা বর্ণনাতীত। আখেরি নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, বিশ্বপ্রতিপালক আল্লাহ তায়ালা বলেন, আসসাওমু লী ওয়ানা আজজী বিহি অর্থাৎ সাওম কেবল আমারই জন্য এবং আমি স্বয়ং এর প্রতিদান দেব। (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)। হজরত মোহাম্মদ (সা.) আরও বলেছেন, যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে এবং আখিরাতে সওয়াবের আশায় একাগ্রচিত্তে সাওম পালন করে, তার অতীত জীবনের যাবতীয় সগিরা গোনাহ মাফ করে দেওয়া হয় (বুখারি ও মুসলিম)। আখেরি নবীর (সা.) ভাষায় : পবিত্র রমজান মাস পাওয়ার পরও যে ব্যক্তি তার অতীতকালীন গোনাহ (সগিরা) মাফ করে নিতে পারেনি, সে সন্দেহাতীতভাবে হতভাগ্য ও ভাগ্যবিড়ম্বিত।
পবিত্র রমজান মাস ধৈর্য অনুশীলন এবং সবর বা আত্মসংযমের মাস। আর ধৈর্য অবলম্বনের বিনিময় হচ্ছে জান্নাত। পবিত্র রমজান মাসে মুমিনদের রিজিক বাড়িয়ে দেওয়া হয়। কোনো ব্যক্তি সাওম পালনকারীকে ইফতার করালে বিনিময়ে ওই ব্যক্তির সাওমের সমান সওয়াব পাবে। অথচ সাওম পালনকারীর সওয়াবে বিন্দুমাত্র হেরফের বা কমতি ঘটবে না। আবার পবিত্র রমজানে প্রতিটি নফল ইবাদতকে অন্য সময়ের ফরজ ইবাদত হিসেবে এবং প্রতিটি ফরজ ইবাদতকে অন্য সময়ের ৭০টি বা ততোধিক ফরজ ইবাদত হিসেবে গণ্য করা হয়। সাওমের অনন্য ও ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য : সাওম দৃষ্টির অগ্রাহ্য এবং বোধশক্তির অতীত বিশেষ শ্রেণির ইবাদত। প্রকৃত সাওম পালনকারী এবং মেকি সাওম পালনকারীর মধ্যকার পার্থক্য নির্ণয়ের সক্ষমতা একমাত্র সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মদর্শী আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও নেই। তাই রমজান মাসের প্রতিটি নফলকে অন্য মাসের ফরজের মর্যাদা এবং প্রতিটি ফরজের সওয়াবকে কমপক্ষে ৭০ গুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। আবার কোনো কোনো উত্তম কাজের পুণ্য ১০ গুণ, ৭০ গুণ, হাজার গুণ বাড়িয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও মহান আল্লাহ প্রদান করেছেন। অথচ সাওমের ব্যাপারে সর্বশক্তিমান আল্লাহ বলেছেন, সাওম আমারই জন্য এবং আমি নিজেই এর প্রতিদান দেব (বুখারি ও মুসলিম)। বিশেষত, ইফতারের পূর্ব মুহূর্তের দোয়া কবুলের প্রতিশ্রুতি মহান আল্লাহ প্রদান করেছেন। তাই ইফতারের পূর্বমুহূর্ত আমরা যথাসাধ্য মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে তৎপর থাকব, ইনশা আল্লাহ!
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ফজিলতের বিচারে মাহে রমজানকে তিনটি অংশে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম অংশ রহমতের, দ্বিতীয় অংশ মাগফিরাতের এবং শেষ অংশ জাহান্নাম থেকে মুক্তিলাভের। অতএব, পশ্চিমাকাশে পবিত্র রমজানের চাঁদ উদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই রহমতের অংশ শুরু হবে এবং পরচর্চা-পরশ্রীকাতরতা-গিবতসহ সর্ববিধ বদ-অভ্যাস যথাসম্ভব পরিহারপূর্বক কায়মনোবাক্যে ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল হব, ইনশা আল্লাহ। সাওমের সঙ্গে আত্মিক পরিশুদ্ধি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সোনা অত্যন্ত মূল্যবান ধাতু হলেও বস্তুত স্বর্ণখনিতে বিশুদ্ধ সোনা পাওয়া যায় না। খনি থেকে উত্তোলিত আকরিক বা ময়লাযুক্ত সোনাকে আগুনে বারবার পুড়িয়ে অ্যালয় বা খাদমুক্ত এবং বিশুদ্ধ সোনায় পরিণত করা হয়। তদ্রƒপ মানুষের অন্তরের গভীরতম প্রদেশস্থিত যাবতীয় পাশবিক প্রবৃত্তি, কাম-ক্রোধ- লোভ ও ইন্দ্রিয়ের মূলোচ্ছেদ করেই আত্মার পরিশুদ্ধি বা তাকওয়া অর্জন করতে হবে। আর বর্তমানের সমস্যা জর্জরিত ও পাপপঙ্কিল মুসলমানদের পরিত্রাণ এবং তাকওয়া অর্জনের প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে একাগ্রচিত্তে সাওম পালন করা। জগৎ-সংসারে স্বার্থের হাতছানিতে আমরা সবাই প্রলুব্ধ। ভুলত্রুটি আমাদের পার্থিব জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। মূলত চারিত্রিক দৃঢ়তার অভাবেই আমাদের আদি পিতা হজরত আদম (আ.) এবং আদি মাতা বিবি হাওয়া (আ.) মহান আল্লাহর প্রত্যক্ষ হুঁশিয়ারি বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন। আর চিরশত্রু শয়তানের প্ররোচনায় প্রলুব্ধ হয়ে নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল খান এবং স্বর্গচ্যুত হয়ে ধরাধামে নিক্ষিপ্ত হন। তাই আদম-হাওয়ার উত্তরসূরি হিসেবে আমাদের পক্ষে আল্লাহর রহমত ছাড়া চিরশত্রু শয়তানের প্ররোচনা থেকে নিস্তার লাভ সম্ভব নয়। স্বার্থের মোহাবিষ্ট জগৎ-সংসারে আমরা জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে সারাক্ষণ শয়তানের প্ররোচনায় প্রলুব্ধ হচ্ছি এবং পাপসাগরে তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম। অবশ্য পশ্চিমাকাশে পবিত্র রমজানের চন্দ্র উদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্বপ্রতিপালক আল্লাহ তায়ালা বেহেশতের সকল দরজা খুলে দেন, দোজখের দরজাগুলো বন্ধ করে দেন এবং মানুষের চিরশত্রু শয়তানকেও শৃঙ্খলিত করেন। কিন্তু আত্মবিশ্লেষণ কিংবা আত্মসচেতনতার অভাবে পবিত্র রমজান মাসেও পরচর্চা বা গিবতসহ সব ধরনের পাপাচার থেকে আমরা মুক্ত হতে পারছি না। আবার অনেকেই নানা টালবাহানায় সাওম পালন না করে শয়তানের ঘাড়ে দোষ চাপানোর চেষ্টা করি। প্রকৃত প্রস্তাবে আল্লাহ অত্যন্ত সূক্ষ্মদর্শী এবং শাস্তিদানে কঠোর।
পবিত্র কোরআনের মক্কায় অবতীর্ণ সুরা মূলকের দ্বিতীয় আয়াতে বলা হয়েছে, যিনি মৃত্যু এবং জীবন তোমাদের পরীক্ষা করার জন্য সৃষ্টি করেছেনÑকে তোমাদের মধ্যে কর্মে উত্তম; তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল। আর মানুষের অন্তিমযাত্রার একমাত্র সঙ্গী নিজস্ব আমল বা কর্মফল। পার্থিব জীবনের অন্তরঙ্গ সঙ্গী, বিত্ত-বৈভব, স্ত্রী-পুত্র-পরিজন কেউই কারও কবরের সঙ্গী হয় না।
যাহোক, হেলায়-খেলায়, হাসি-আনন্দে জীবনের সিংহভাগ অতিক্রম করে আমরা অনেকেই জীবনসায়াহ্নে উপনীত হয়েছি। এবারের পবিত্র মাহে রমজান হয়তো-বা আমার মতো অনেক পাপী-তাপীর জন্য জীবনের পুঞ্জীভূত অপরাধমুক্তির বিশেষ আশীর্বাদ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। তাই নিষ্কলুষ অন্তরে পবিত্র মাহে রমজানের সাওম পালনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণের সবিনয় অনুরোধ রইল। হে রাব্বুল আ’লামিন মাহে রমজানের প্রতিটি মুহূর্তকে ইবাদত-বন্দেগিতে কাটানোর সৌভাগ্য আমাদের দান করুন। জীবনের পুঞ্জীভূত গোনাহর পাহাড় মার্জনার নিমিত্তে গাফুরুর রাহিম ও লাতিফুল খাবির আল্লাহর দরবারে মিনতি জানাচ্ছি। হে বিশ্বপ্রতিপালক, দয়া করে আমাদের প্রতি পবিত্র রমজানের অবর্ণনীয় রহমত বর্ষণ করুন। আমিন!
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, ঠিকানা, নিউইয়র্ক।