ভালোবাসা দিবস ও ‘আমি’

প্রকাশ : ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১১:৩০ , অনলাইন ভার্সন
ফেব্রুয়ারি মাসের ১৪ তারিখে আমেরিকায় ঘটা করে ভ্যালেনটাইন্স ডে বা ভালোবাসা দিবস পালন করা হয়। ভালোবাসা দিবস নিয়ে আগের বছর একটা লেখা লিখেছিলাম। কেমন করে আমেরিকায় ভালোবাসা দিবসের সূচনা হয়, এর ইতিহাস, এই দিবসটি পালনের বৃত্তান্ত ইত্যাদি। সেখান থেকে কিছুটা অংশ আবার তুলে ধরলাম। মূল লেখায় পরে আসছি।
ভ্যালেনটাইন্স ডে’র শুরুটা খুব আনন্দের ছিল না। ২৭০ এডিতে রোমান সাম্রাজ্যের রাজা ক্লডিয়াস তার রাজ্যে বিবাহযোগ্য সকল ছেলের বিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। কারণ তাদের সকলকে যুদ্ধে যেতে হবে। এতে করে প্রেমিক-প্রেমিকারা দারুণ অসুবিধায় পড়ে যায়। তাদের কী হবে। এই খবর জানতে পেরে ‘ভ্যালেনটাইন’ নামের একজন পুরোহিত বা পাদরি গোপনে বিয়ে করতে ইচ্ছুক অসংখ্য প্রেমিক যুগলের বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে থাকেন। কারণ তিনি ছিলেন ভালোবাসায় বিশ্বাসী একজন মানুষ।
একসময় রাজা এটা জানতে পেরে ভ্যালেনটাইনকে জেলে ভরেন এবং তার ফাঁসির আদেশ হয়। এরই মধ্যে ভ্যালেনটাইন আবার জেলার সাহেবের মেয়ের সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। তাই রাজার নির্দেশে ১৪ ফেব্রুয়ারি তার ফাঁসির দিন ধার্য করা হয়। মৃত্যুর আগে তিনি তার প্রেমিকার জন্য চিঠি লিখে যান, যার পরিশেষে লেখা থাকে ‘ইতি, তোমার ভ্যালেনটাইন’। এই ঘটনার প্রায় ২০০ বছর পরে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে সেন্ট ভ্যালেনটাইন্স ডে হিসেবে ধার্য করা হয়।
১৩৮১ সালে একজন ইংরেজি কবি তার কবিতায় রোমান্টিক ভালোবাসার বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রথম ভ্যালেনটাইনের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। তার পর থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেনটাইন্স ডে বা ভালোবাসা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ১৯১৩ সালে হলমার্ক কোম্পানি প্রথম ভ্যালেনটাইন্স ডে’র কার্ড প্রকাশ করে।
একে একে কালের বিবর্তনে কার্ড ছাড়াও ফুল, চকলেট, কেক, বই, আংটি, জুয়েলারি নানা উপহারসামগ্রী আদান-প্রদানের মাধ্যমে ভালোবাসা দিবসের পালন শুরু হয়। শুধু প্রেমিক-প্রেমিকা নয়, বরং পরিবারের যেকোনো সদস্য তার পছন্দের প্রিয় মানুষকে এই দিনে উপহার দিতে পারে। এই বিশেষ দিনটিতে বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা, ছেলে মেয়েকে প্রপোজ করা বা ক্যান্ডেল লাইট ডিনার করা পশ্চিমা জগতে খুবই পপুলার কিছু রীতি।
এ বছর ধারণা করা হয়েছিল, সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রে ভ্যালেনটাইন্স ডে উপলক্ষে রেস্টোরান্ট, শপিং আর উপহার বাবদ ২৮ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা হবে। এই হিসাবমতে, প্রতিটি আমেরিকান পরিবার গড়ে ২০০ থেকে ৩০০ ডলার ভ্যালেনটাইন্স ডে উপলক্ষে খরচ করে থাকে। এই দিবসটি আমেরিকা ছাড়াও যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, মেক্সিকো, ফ্রান্স, ইতালি, আর্জেন্টিনা, ডেনমার্কে পালন করা হয়। পশ্চিমা রীতি ফলো করে আমাদের বাংলাদেশেও ভালোবাসা দিবস পালন করা হয় প্রিয় মানুষকে উপহার দিয়ে বা তার সঙ্গে বিশেষ সময় কাটিয়ে।
এবার মূল লেখায় আসি। আমার আজকের এই লেখাটি ‘ভালোবাসা’ নিয়ে ঠিকই, তবে একটু ভিন্ন প্রকৃতির ভালোবাসা। এই ভালোবাসা অপরের জন্য নয়, নিজের জন্য।
নিজেকে অতিরিক্ত ভালোবাসা এবং অন্যের প্রতি বিন্দুমাত্র সহানুভূতি অনুভব না করা, এমন একটি ব্যাপারকে মনোবিজ্ঞানীরা নার্সিসিজম বা আত্মপ্রেম বলে থাকেন। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, পুরোপুরি নার্সিসিস্ট না হলেও নার্সিসিজম বা নার্সিসিস্টিক চিন্তাধারা মানবসমাজের প্রত্যেক মানুষের মধ্যে কমবেশি বিদ্যমান। কেউ খুব বেশি মাত্রায় নিজেকে প্রকাশ করে, আবার কেউ করে না। আমরা সবাই জানি, নিজের সম্পর্কে বলতে কে না পছন্দ করে। যারা মুখ ফুটে বলতে পারে না, তারা অন্যের কাছ থেকে নিজের সম্পর্কে শুনতে পছন্দ করে।
এই শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে একটু কথা বলি। গ্রিক মিথোলজিতে বহু দেবদেবীর কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে ‘নার্সিসাস’ এর কথাও বলা হয়েছে। নার্সিসাস ছিল নদীর দেবতা এবং অরণ্যের দেবীর ঘরে জন্মানো অতি সুদর্শন একজন যুবক। সে দেখতে এতটাই সুন্দর ছিল যে তার গর্ব ও অহমিকা তাকে নিজের সম্পর্কে অন্ধ করে দিয়েছিল। সে তার নিজেকে ছাড়া আর কাউকে পছন্দ করত না। উচ্চ মহলের দেবতারা তাই নার্সিসাসকে একটা অভিশাপ দেয়।
একদিন জঙ্গলে শিকার করতে গিয়ে সে পুকুরের পানির ওপর নিজের ছায়া বা প্রতিবিম্ব দেখে অভিভূত হয়ে যায়। এত সুন্দর মুখ দেখে সে এতটাই অভিভূত হয়ে যায় যে সে ওই জায়গাতেই স্থির হয়ে বসে থাকে। দিন নেই, রাত নেই পানিতে নিজের চেহারার দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকে। ধীরে ধীরে সে নিজের খাওয়াদাওয়া, ঘুম ভুলতে বসে এবং একই জায়গায় অনাহারে থাকতে থাকতে একদিন মৃত্যুবরণ করে।
এই গল্পটার মধ্যে একটা ভয়াবহ মেসেজ লুকিয়ে আছে। প্রকৃতি কোনো কিছুর বাড়াবাড়ি পছন্দ করে না। গুরুজনেরা বলে থাকেন, নিজের সুন্দর চেহারা পছন্দ করা দোষের কিছু নয়, তবে একই সঙ্গে মানুষের হওয়া উচিত নম্র ও বিনয়ী। নিজের সম্পর্কে দম্ভ ও অহংকার একসময় পতন ডেকে আনে।
নিজেকে ভালোবাসা কোনো অপরাধ নয়। নিজের সঙ্গে প্রেম করা কোনো আদালতেই দোষী সাব্যস্ত হয় না। আর নিজেকে অন্য মানুষের চাইতে কতটা বেশি ভালোবাসি বা কম বাসি, সেটা মাপার কোনো যন্ত্র পৃথিবীতে আবিষ্কার হয়নি। কিন্তু একটা সমস্যা হলো, আত্মপ্রেমিকেরা তাদের কথাবার্তায়, আচার ব্যবহারে, ভাব প্রকাশে বুঝিয়ে দেয় যে তার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলো সে নিজে।
আত্মমুগ্ধতা বা আত্মমগ্নতা এমনই একটি ব্যাপার, যেটা ধীরে ধীরে মানুষকে নিজের সম্পর্কে অন্ধ করে ফেলে। এরা একপর্যায়ে তাদের পরিবার বা আপনজনদের জন্য বিরক্তিকর হয়ে ওঠে। কিন্তু তারা নিজেদের চিন্তায় এতই মগ্ন থাকে যে সেটা তাদের চোখে পড়ে না। এ ধরনের মানুষেরা আমাদের নিত্যদিনের পথপরিক্রমায় উঠতে, বসতে, চলতে, ফিরতে প্রায়ই দেখা যায়।
যেকোনো সম্পর্ককে সুস্থ ও মধুর রাখার দায়ভার দুই পক্ষেরই সমান থাকে। হোক না সেটা দাম্পত্যের বা বন্ধুত্বের সম্পর্ক। একজন খালি তার শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করে যাবে আর অন্যজন নিজেকে ক্ষুদ্র মেনে নিয়ে তাকে খুশি করে যাবে, এমন সম্পর্ক বেশি দিন স্থায়ী হওয়ার নয়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে সম্পর্কের অসমতা চলতে থাকলে অনেক সময় বৈবাহিক সম্পর্কে ভাঙন ধরে। অনেক সময় বন্ধুবান্ধব গ্রুপের মধ্যে বন্ধুত্বে ফাটল ধরে। আপন মানুষ, আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর মানুষ থেকে দূরে সরে যায়। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, নার্সিসিস্টিক চিন্তাধারার লোকজন দিয়ে আমাদের পৃথিবীটা ভরে যাচ্ছে। আমি নিজেকে প্রচণ্ড ভালোবাসি-এই সত্য কথাটি মনে মনে পোষণ করলেও খুব কম মানুষই নির্দ্বিধায় তা স্বীকার করতে পারে। তবে এখন সেই সমস্যারও সমাধান হয়েছে। ইদানীংকালে আমাদের মনোভাব প্রকাশের প্রধান মাধ্যম হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আমাদের আর কিছু শেখাক বা না শেখাক, নিজের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা প্রকাশ করতে শিখিয়েছে। আমি কী করলাম, কোথায় গেলাম, কী খেলাম, কী দেখলাম, আমার অর্জন, আমি কতটা সুন্দর, আমি কতটা গুণের ইত্যাদি ইত্যাদি আমরা আমাদের প্রিয় ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, ইউটিউবে প্রতিনিয়ত পোস্ট করে চলেছি। সর্বদা নিজেদের সেলফি, ছবি, ভিডিও, ব্লগ, রিলস, লাইভ শো, পোস্ট করতে থাকি এবং ভার্চুয়াল বন্ধুদের লাইক, লাভ, কমেন্টের অপেক্ষায় বসে থাকি। বারবার প্রোফাইল পেজ চেক করি কতগুলা লাইকস পেলাম, কতগুলা কমেন্টস পড়ল, কতগুলো ভিউ হলো, কতজন ফলোয়ারস বাড়ল। এসবের ওপরই নির্ভর করে বাড়তে থাকে সোশ্যাল মিডিয়া ইউজারদের আত্মবিশ্বাস ও নিজের সম্পর্কে আস্থা অর্জন।
সর্বদা অন্যের মনে বিরাজ করতে চাওয়া এবং অন্যের থেকে প্রশংসা ও গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া-এ ধরনের প্রবৃত্তিই হলো নার্সিসিজম।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মধ্যে নার্সিসিজম বেশি লক্ষণীয়। কারণ তারা প্রায় সময়ই একধরনের হীনম্মন্যতা বা ভীরুতায় ভোগে। অন্যে তাদের সম্পর্কে কী ভাবছে এটা তাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার। এটা কাটাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারা শুধু তাদের ভালো দিকগুলো তুলে ধরে। ভালো খবর, সুন্দর ছবি, সুন্দর সময় যাপন অথবা তাদের কৃতিত্ব বা অর্জনের কথা ফলাও করে প্রচার করে। আর তাতে করে কারও মুখোমুখি হয়ে প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় না। এভাবে তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়ে।
তবে শুধু তরুণ প্রজন্ম নয়, যারা বয়সে প্রবীণ বা যাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি নেই, তারাও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল। নিজেকে আত্মপ্রকাশের এটাই এখন বহুলব্যবহৃত মাধ্যম। তারা নিজেদের প্রচার ও প্রচারণায় বিশ্বাসী। তারা সর্বদা অন্যের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চায়। যুগ পাল্টাচ্ছে, পাল্টাচ্ছে মানুষের মানসিকতা। কেউ কারোর হয়ে এখন তরফদারি করে না। নিজের ঢোল নিজেকেই পেটাতে হয়। নিজেকে ভালো না বেসে আর কি কোনো উপায় আছে।
ইতিহাস, সমাজ, সংস্কৃতিতে যুগে যুগে বহু নার্সিসিস্ট মানুষের নাম উঠে এসেছে। হিটলার, স্টালিন, মুসোলিনি, নেপোলিয়ন, ক্লিওপ্যাট্রা, মেরিলিন মনরো, ম্যাডোনা প্রমুখ। তবে সবার উপরে আছে বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাম। তিনি নিজেকে দুনিয়ার সবথেকে শ্রেষ্ঠ ও ক্ষমতাশালী ব্যক্তি মনে করেন। তিনি নিজেকে দুনিয়ার রাজা মনে করেন। তার কথায়, কাজে, আচরণে কে বিরক্ত হচ্ছে বা আহত হচ্ছে, সে সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। ওনার যা মনে হচ্ছে উনি তা-ই করবেন, বলবেন। সেই সঙ্গে সমমনা দোসরদের খুঁজে নেবেন, যারা তার প্রশংসা করবে সব সময়।
পৃথিবীর বিনয়ী, দয়ালু ও নম্র মানুষদের তালিকায় যে নামগুলো সব সময় উঠে আসে, তাদের মধ্যে মাদার তেরেসা, রাজকুমারী ডায়না প্রধান। রাজকুমারী ডায়নাকে ডাকা হতো সাধারণ মানুষের রাজকুমারী, রয়্যাল পরিবারের নয়। তিনি তার জীবদ্দশায় বরাবর সাধারণ মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। রাজপরিবারের সদস্যা হওয়া সত্ত্বেও কোনো অহংকার বা অহমিকা তার মধ্যে ছিল না। জীবন সম্পর্কে তার একটা বিখ্যাত উক্তির বাংলা করছি : ‘আমাদের উচিত অন্যের জন্য কোনো না কোনো দয়ালু কাজ করার, আর সেটা কোনো প্রাপ্তির আশা না করেই। কারণ একদিন সেই একই কাজ অন্য কেউ আমাদের জন্য করবে।’ বলাই বাহুল্য, ভালোবাসা দিবসে এমন মানুষেরা খালি অন্যকেই ভালোবেসে যাবে, নিজেকে নয়।
লেখক : ব্লগার, কলামিস্ট, গল্পকার। টেক্সাস।
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: 01711238078