
ডা. বি এম আতিকুজ্জামান
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা খাত সাম্প্রতিক দশকগুলোতে অগ্রগতি অর্জন করেছে। বিশেষত, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস, টিকাদান কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন এবং কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রসারের মাধ্যমে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা অনেক দূর এগিয়েছে। তবে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে, বিশেষ করে সরকারি ও বেসরকারি খাতের সমন্বয়, পর্যাপ্ত চিকিৎসা-সুবিধার অভাব এবং চিকিৎসা ব্যয়ের চাপ। পর্যাপ্ত চিকিৎসা-ব্যবস্থা ও পেশাদারত্বের ঘাটতি অনেক রোগীকে দেশের বাইরে গিয়ে চিকিৎসাসেবা নিতে উৎসাহিত করছে।
স্বাস্থ্যসেবার বর্তমান অবস্থা
ক্স বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রধানত সরকারি ও বেসরকারি খাতে বিভক্ত।
ক্স সরকারি স্বাস্থ্যসেবা : সরকার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে হাসপাতাল, কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র পরিচালনা করছে। তবে এসব প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসকের স্বল্পতা, প্রয়োজনীয় ওষুধ ও সরঞ্জামের অভাব সাধারণ চিত্র।
ক্স বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা : শহরাঞ্চলে উন্নতমানের বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক থাকলেও তা ব্যয়বহুল হওয়ায় সাধারণ জনগণের জন্য সীমিত।
ক্স প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা : কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, যা কিছু ক্ষেত্রে সফল হলেও এর মান ও পর্যাপ্ততা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।
প্রধান চ্যালেঞ্জসমূহ
১. স্বাস্থ্য খাতে বাজেটের সীমাবদ্ধতা : দেশের মোট জিডিপির তুলনায় স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ খুবই কম।
২. জনসংখ্যার তুলনায় চিকিৎসা-সুবিধার ঘাটতি : চিকিৎসকের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পেতে মানুষকে শহরমুখী হতে হয়।
৩. স্বাস্থ্যসেবায় দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা : সরকারি হাসপাতালে সেবা পেতে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
৪. ওষুধের উচ্চমূল্য ও অনিয়ন্ত্রিত বাজার : অনেক গুরুত্বপূর্ণ ওষুধের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে।
৫. মানসিক স্বাস্থ্য অবহেলিত : মানসিক স্বাস্থ্যসেবা এখনো অধিকাংশ মানুষের নাগালের বাইরে এবং এ বিষয়ে সচেতনতা কম।
সম্ভাবনা ও সুপারিশ
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে :
১. প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা শক্তিশালীকরণ
গ্রামীণ এলাকায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি অত্যন্ত জরুরি। বর্তমানে দেশের ৫১% মানুষ প্রয়োজনের সময় মানসম্পন্ন সেবা পায়, অর্থাৎ ৪৯% মানুষ এই সেবার বাইরে রয়ে গেছে।
২. আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার
স্বাস্থ্যসেবায় ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো দরকার। উদাহরণস্বরূপ, স্বাস্থ্য বাতায়ন ১৬২৬৩ একটি সরকারি উদ্যোগ, যা জনগণকে টেলিমেডিসিন সেবা প্রদান করে আসছে।
৩. সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের সমন্বয়
সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাসেবার মান উন্নত করতে আরও বিনিয়োগ প্রয়োজন। বর্তমানে স্বাস্থ্যের মোট ব্যয়ে ব্যক্তির নিজস্ব অংশ ৬৮.৫%। এই উচ্চ ব্যয় সাধারণ মানুষের জন্য একটি বড় চাপ সৃষ্টি করে।
৪. চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ
বাংলাদেশে প্রতি ১০,০০০ মানুষের জন্য মাত্র ৫.২৬ জন চিকিৎসক এবং ২.২২ জন নার্স রয়েছে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ডের তুলনায় অনেক কম।
৫. স্বাস্থ্যবিমা চালু করা
সবার জন্য স্বাস্থ্যবিমা চালু করা জরুরি। বর্তমানে দেশের বেশির ভাগ মানুষ কোনো ধরনের স্বাস্থ্যবিমার আওতায় নেই, যা চিকিৎসা ব্যয় বহনে তাদের জন্য বড় বাধা সৃষ্টি করে।
৬. ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ ও মূল্য নিয়ন্ত্রণ
দেশে উৎপাদিত ওষুধের মান উন্নত করতে কঠোর মনিটরিং প্রয়োজন। পাশাপাশি জরুরি ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারি হস্তক্ষেপ বাড়াতে হবে, যাতে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা সহজে ওষুধ সংগ্রহ করতে পারেন।
৭. রোগ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ
বাংলাদেশে ৫ বছরের নিচে শিশুমৃত্যুহার প্রতি ১,০০০ জীবিত জন্মে ৩৮ জন। এই হার কমাতে রোগ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।
৮. গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি
স্বাস্থ্য খাতে গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন, যাতে নতুন রোগ, চিকিৎসাপদ্ধতি ও ওষুধ-সংক্রান্ত গবেষণা পরিচালনা করা যায়।
উপরিউক্ত পরিসংখ্যানগুলো বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার বর্তমান চিত্র তুলে ধরে। প্রস্তাবিত পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত করা সম্ভব, যা একটি সুস্থ ও কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী গড়ে তুলতে সহায়তা করবে।
লেখক : বিশিষ্ট পরিপাকতন্ত্র ও লিভার বিশেষজ্ঞ, ফ্যাকাল্টি, কলেজ অব মেডিসিন ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা। চেয়ারম্যান, প্ল্যানেটরি হেলথ একাডেমিয়া, অরল্যান্ডো, ফ্লোরিডা।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা খাত সাম্প্রতিক দশকগুলোতে অগ্রগতি অর্জন করেছে। বিশেষত, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস, টিকাদান কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন এবং কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রসারের মাধ্যমে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা অনেক দূর এগিয়েছে। তবে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে, বিশেষ করে সরকারি ও বেসরকারি খাতের সমন্বয়, পর্যাপ্ত চিকিৎসা-সুবিধার অভাব এবং চিকিৎসা ব্যয়ের চাপ। পর্যাপ্ত চিকিৎসা-ব্যবস্থা ও পেশাদারত্বের ঘাটতি অনেক রোগীকে দেশের বাইরে গিয়ে চিকিৎসাসেবা নিতে উৎসাহিত করছে।
স্বাস্থ্যসেবার বর্তমান অবস্থা
ক্স বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রধানত সরকারি ও বেসরকারি খাতে বিভক্ত।
ক্স সরকারি স্বাস্থ্যসেবা : সরকার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে হাসপাতাল, কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র পরিচালনা করছে। তবে এসব প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসকের স্বল্পতা, প্রয়োজনীয় ওষুধ ও সরঞ্জামের অভাব সাধারণ চিত্র।
ক্স বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা : শহরাঞ্চলে উন্নতমানের বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক থাকলেও তা ব্যয়বহুল হওয়ায় সাধারণ জনগণের জন্য সীমিত।
ক্স প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা : কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, যা কিছু ক্ষেত্রে সফল হলেও এর মান ও পর্যাপ্ততা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।
প্রধান চ্যালেঞ্জসমূহ
১. স্বাস্থ্য খাতে বাজেটের সীমাবদ্ধতা : দেশের মোট জিডিপির তুলনায় স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ খুবই কম।
২. জনসংখ্যার তুলনায় চিকিৎসা-সুবিধার ঘাটতি : চিকিৎসকের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পেতে মানুষকে শহরমুখী হতে হয়।
৩. স্বাস্থ্যসেবায় দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা : সরকারি হাসপাতালে সেবা পেতে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
৪. ওষুধের উচ্চমূল্য ও অনিয়ন্ত্রিত বাজার : অনেক গুরুত্বপূর্ণ ওষুধের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে।
৫. মানসিক স্বাস্থ্য অবহেলিত : মানসিক স্বাস্থ্যসেবা এখনো অধিকাংশ মানুষের নাগালের বাইরে এবং এ বিষয়ে সচেতনতা কম।
সম্ভাবনা ও সুপারিশ
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে :
১. প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা শক্তিশালীকরণ
গ্রামীণ এলাকায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি অত্যন্ত জরুরি। বর্তমানে দেশের ৫১% মানুষ প্রয়োজনের সময় মানসম্পন্ন সেবা পায়, অর্থাৎ ৪৯% মানুষ এই সেবার বাইরে রয়ে গেছে।
২. আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার
স্বাস্থ্যসেবায় ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো দরকার। উদাহরণস্বরূপ, স্বাস্থ্য বাতায়ন ১৬২৬৩ একটি সরকারি উদ্যোগ, যা জনগণকে টেলিমেডিসিন সেবা প্রদান করে আসছে।
৩. সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের সমন্বয়
সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাসেবার মান উন্নত করতে আরও বিনিয়োগ প্রয়োজন। বর্তমানে স্বাস্থ্যের মোট ব্যয়ে ব্যক্তির নিজস্ব অংশ ৬৮.৫%। এই উচ্চ ব্যয় সাধারণ মানুষের জন্য একটি বড় চাপ সৃষ্টি করে।
৪. চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ
বাংলাদেশে প্রতি ১০,০০০ মানুষের জন্য মাত্র ৫.২৬ জন চিকিৎসক এবং ২.২২ জন নার্স রয়েছে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ডের তুলনায় অনেক কম।
৫. স্বাস্থ্যবিমা চালু করা
সবার জন্য স্বাস্থ্যবিমা চালু করা জরুরি। বর্তমানে দেশের বেশির ভাগ মানুষ কোনো ধরনের স্বাস্থ্যবিমার আওতায় নেই, যা চিকিৎসা ব্যয় বহনে তাদের জন্য বড় বাধা সৃষ্টি করে।
৬. ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ ও মূল্য নিয়ন্ত্রণ
দেশে উৎপাদিত ওষুধের মান উন্নত করতে কঠোর মনিটরিং প্রয়োজন। পাশাপাশি জরুরি ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারি হস্তক্ষেপ বাড়াতে হবে, যাতে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা সহজে ওষুধ সংগ্রহ করতে পারেন।
৭. রোগ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ
বাংলাদেশে ৫ বছরের নিচে শিশুমৃত্যুহার প্রতি ১,০০০ জীবিত জন্মে ৩৮ জন। এই হার কমাতে রোগ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।
৮. গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি
স্বাস্থ্য খাতে গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন, যাতে নতুন রোগ, চিকিৎসাপদ্ধতি ও ওষুধ-সংক্রান্ত গবেষণা পরিচালনা করা যায়।
উপরিউক্ত পরিসংখ্যানগুলো বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার বর্তমান চিত্র তুলে ধরে। প্রস্তাবিত পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত করা সম্ভব, যা একটি সুস্থ ও কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী গড়ে তুলতে সহায়তা করবে।
লেখক : বিশিষ্ট পরিপাকতন্ত্র ও লিভার বিশেষজ্ঞ, ফ্যাকাল্টি, কলেজ অব মেডিসিন ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা। চেয়ারম্যান, প্ল্যানেটরি হেলথ একাডেমিয়া, অরল্যান্ডো, ফ্লোরিডা।