ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর একটি দেয়ালচিত্র জন্ম দিয়েছে বিতর্ক, দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের। সত্যিই এটি একটি দুঃখজনক ঘটনা। এই দেয়ালচিত্রটি একটি গাছের রূপক চিত্রের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় আদর্শ ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’ ধারণাটিকে তুলে ধরা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। গাছের শাখায় মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান-এ চারটি ধর্মীয় জাতিগোষ্ঠীর পরিচয়ের চারটি পাতার পাশাপাশি ‘আদিবাসী’ পরিচয়কে পঞ্চম পাতা হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে। প্রথমে এটি জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে প্রশংসিত হলেও এই দেয়ালচিত্রের প্রতিচ্ছবি পাঠ্যপুস্তকের পেছনের প্রচ্ছদে ব্যবহৃত হওয়ার পর বিষয়টি বিতর্কের জন্ম দেয়। প্রতিবাদের মুখে তা পাঠ্যবইয়ের ডিজিটাল কপি থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাহাড়ি জাতিগুলোর পক্ষে ‘সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতা’র (অ্যাগ্রিভড ইন্ডিজেনাস স্টুডেন্ট-মাসেস) ব্যানারে সেই প্রতিচ্ছবি পাঠ্যপুস্তকের ডিজিটাল কপিতে পুনর্বহালের দাবিতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের অফিস ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণা করলে এর বিরোধী পক্ষ ‘সার্বভৌমত্বের পক্ষে শিক্ষার্থীরা’ (স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টি) নামক একটি সংগঠন প্রতিরোধে মাঠে নামে। ফলে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ পরিস্থিতি সংঘর্ষে রূপ নেয়।
প্রথমত, দেয়ালচিত্রটিতে ব্যবহৃত শব্দগুলোর প্রতি যদি আমরা লক্ষ করি, ‘আদিবাসী’ শব্দটির ব্যবহার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে হতে পারে। কারণ ‘আদিবাসী’ শব্দটি চিত্রে ব্যবহৃত আর চারটি শব্দের ধর্মভিত্তিক পরিচয়ের সমগোত্রীয় নয়। তাই যে কারও মনে ‘আদিবাসী’ পরিচয়কে ধর্মভিত্তিক পরিচয়ের সমগোত্রীয় হিসেবে দেখানোর উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন জাগতে পারে। এটা সহজবোধ্য যে ‘আদিবাসী’ পরিচয়টি কোনো ধর্মের পরিচয় বহন করে না। বরং এটি সুস্পষ্টভাবে স্থানিক ও ঐতিহাসিক বাস্তবতায় আবাসিক অধিকারের পরিচয় বহন করে, যা মূলত একটি নির্দিষ্ট স্থানে ঐতিহাসিক পরম্পরায় বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর প্রথাগত ভূমি অধিকার, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি ও প্রকৃতি-ঘনিষ্ঠ জীবনধারার সঙ্গে সংযুক্ত। সাধারণত ‘মুসলিম’, ‘হিন্দু’, ‘বৌদ্ধ’, ‘খ্রিষ্টান’ শব্দগুলো অনুসারীদের ধর্মীয় পরিচয়ের মধ্য দিয়ে বিশ্বাস, উপাসনা-পদ্ধতি এবং আধ্যাত্মিক আদর্শের পরিচয় তুলে ধরে। কিন্তু ‘আদিবাসী’ শব্দটি ধর্মীয় পরিচয় বহন করে না। এটি একটি নির্দিষ্ট জায়গায় বসবাসকারীদের স্থানিক, ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক অবস্থানের সঙ্গে সম্পর্কিত, যা তাদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার লড়াই ও রাজনৈতিক দাবিকে প্রতিফলিত করে। তাই বিশ্বব্যাপী এই পরিচয় প্রথাগত ভূমির ওপর অধিকার, সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব রক্ষা এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে বিশেষ স্বীকৃতির জন্য একটি সুনির্দিষ্ট দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দ্বিতীয়ত, ইউরোপীয় জাতিগুলোর ঔপনিবেশিক বসতি স্থাপনের মাধ্যমে, বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় সেখানকার আদিবাসীদের উচ্ছেদ ও বিতাড়িত করার মাধ্যমে তাদের ভূসম্পত্তি জবর-দখলের প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতায় আদিবাসীদের অধিকার সংরক্ষণে নানা নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। নৃবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর পরিচয় গড়ে ওঠে ভূমিপুত্র হিসেবে তাদের ভূমি অধিকার, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি এবং স্থানীয় জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে। অ্যাংলো-আইরিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদ বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন (১৯৩৬-২০১৫) তার ‘কল্পিত সম্প্রদায়’ (ইমাজিনড কমিউনিটিস) তত্ত্বে জাতীয়তাবাদ এবং জাতিগত পরিচয় নির্মাণে একই লক্ষ্য ও ঐক্যের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই ধারণার আলোকে দেখা যায়, বাংলাদেশে বসবাসকারী নৃতাত্ত্বিক জাতিগুলোর একত্রে ‘আদিবাসী’ পরিচয়কে ধর্মীয় পরিচয়ের মতো একক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে সংজ্ঞায়িত করা অসম্ভব। বরং এটি নৃতাত্ত্বিক জাতিগুলোর বহুস্তরীয় এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বাইরে থেকে নিজেদের আবাসিক অবস্থানকে সংজ্ঞায়িত করার একটি প্রয়াস। ফলে প্রশ্ন থেকে যায়, আদিবাসী পরিচয়কে গাছের পঞ্চম পাতার অংশ হিসেবে দেখানো কি সত্যিই তাদের ধর্মীয় অবস্থানকে স্বীকৃতি দেয়? নাকি সেটা আমাদের পাহাড়ি ভাইবোনদের পরিচয়কে বিশেষায়িত করার মাধ্যমে বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা?
তৃতীয়ত, নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে উল্লিখিত ধর্মাবলম্বী মানুষ থাকা সত্ত্বেও তারা কেন নিজেদের সেই সব ধর্মীয় পরিচয়ে পরিচিত না হয়ে পৃথক ‘আদিবাসী’ পরিচয়কে গুরুত্ব দিচ্ছেন এবং সেটা প্রতিষ্ঠা করার জন্য আন্দোলনে যাচ্ছেন, এমনকি সংঘাতে জড়াচ্ছেন, সেটাও বোঝা জরুরি। তাত্ত্বিকভাবে সেটা বোঝার জন্য ইতালিয়ান দার্শনিক, ভাষাতাত্ত্বিক ও সমাজবিজ্ঞানী অ্যান্তোনিও গ্রামসির (১৮৯১-১৯৩৭) ‘সাংস্কৃতিক আধিপত্য’ (কালচারাল হেজিমনি) তত্ত্বের আশ্রয় নেওয়া যেতে পারে। এই তত্ত্বে বলা হয়েছে, শাসকগোষ্ঠী কখনো কখনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রভাবশালী ধারণাকে প্রচার ও সংরক্ষণ করতে গিয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বরকে দমন করে। বঞ্চনা, অন্যায় ও অবিচারের শিকার এ দেশে বসবাসকারী ছোট ছোট নৃতাত্ত্বিক জাতিগুলোর ‘আদিবাসী’ পরিচয় সেই কাঠামোগত দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে একটি প্রতিরোধী অবস্থান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এই ‘আদিবাসী’ শব্দের ছত্রচ্ছায়ায় তারা শুধু তাদের ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ নয়, বরং তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ খুঁজে পেতে চাচ্ছেন। তাই আমাদের ছোট ছোট নৃতাত্ত্বিক জাতির ভাইবোনদের এই স্বীকৃতি লাভের লড়াইয়ের মূলে রয়েছে পরিচিতির সূত্রে আন্তর্জাতিক সমর্থন ও আইনি বৈধতা আদায়ের প্রচেষ্টা। এখন প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে আমাদের যে ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক জাতিসত্তার পরিচয় ‘বাংলাদেশি’, সে রাষ্ট্রীয় জাতীয়তায় ছোট ছোট নৃতাত্ত্বিক জাতিগুলোর ভাইবোনেরা তাদের নৃতাত্ত্বিক বা ধর্মীয় পরিচয়কে গুরুত্ব না দিয়ে কেন ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের জন্য এমন মরিয়া ও মারমুখী হয়ে উঠেছেন?
আমরা যে বহুত্ববাদী সমাজের অঙ্গীকার করছি, রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে সে বাস্তবতায় পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী ছোট ছোট নৃতাত্ত্বিক জাতিগুলোকে অবশ্যই আমাদের সমমর্যাদায় গ্রহণ করতে হবে। তাদের আলাদা পরিচয়ের দাবিকে উপেক্ষা করলে সেটা হবে অন্যায় এবং সেই একই ঐতিহাসিক নিপীড়নের পুনরাবৃত্তি ঘটবে, যেটা পাকিস্তানিরা আমাদের সঙ্গে করেছিল। তাই পাহাড়ি অঞ্চলে বা সমতলে বসবাসকারী ছোট জনগোষ্ঠীগুলোর নিজস্ব পরিচয়কে যথাযথভাবে মর্যাদার সঙ্গে আলাদা গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরতে হবে। আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থায় অন্যদের সঙ্গে তারা শুধু সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যই নয়, বরং নিজস্ব রাজনৈতিক অবস্থানকে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগও পেতে হবে। নৃতাত্ত্বিক জাতিগুলোর সঙ্গে সংকর বাঙালির জাতিগত বিরোধের মূল কারণ আমাদের মূলধারার রাষ্ট্রীয় জাতিসত্তায় তাদের স্বাতন্ত্র্যের স্বীকৃতির ও সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণের অভাব এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে তাদেরকে প্রান্তিককরণের প্রভাব। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র বিনির্মাণের প্রক্রিয়ায় আমাদেরকে কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। রাষ্ট্র কি এই জাতিগোষ্ঠীগুলোর ‘অভ্যন্তরীণ অন্যতা’ (ইন্টারনাল আদারনেস) মেনে নিতে প্রস্তুত? নাকি তাদের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক অবস্থানকে অগ্রাহ্য করে তাদের পরিচয়কে একীভূতকরণের মাধ্যমে অবলুপ্ত করতে চায়? কিংবা ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে নানাভাবে তাদেরকে নিষ্পেষিত করতে চায়?
আদিবাসী পরিচয়ের দাবির পেছনে মূল কারণগুলো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এ পরিচয়কে একটি আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। ‘আদিবাসী’ শব্দটি ইংরেজি ‘ইন্ডিজেনাস’ শব্দের অনুবাদ, যা মূলত উপনিবেশ-উত্তর প্রেক্ষাপটে ইউরোপীয় জাতিগুলোর ঔপনিবেশিক ধ্যানধারণা ও নীতিমালার বিপরীতে অধিকৃত ভূমির প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার এবং স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠার একটি প্রতীক হয়ে উঠেছে। জাতিসংঘের সনদ এবং আদিবাসীদের অধিকারের ঘোষণা (ইউএন ডিক্লারেশন অন দ্য রাইটস অব ইন্ডিজেনাস পিপলস) বা সংক্ষেপে উনড্রিপ (ইউএনডিআইপি) বলা হয়। এ ঘোষণা অনুযায়ী, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর দাবির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে তাদের ঐতিহ্য, ভূমি অধিকার, সংস্কৃতির সংরক্ষণ এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। সে যা-ই হোক, এটা স্পষ্ট যে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর ‘আদিবাসী’ পরিচয় আদায় করতে চেষ্টা করার উদ্দেশ্য কেবল একটি সাংস্কৃতিক স্বীকৃতির প্রশ্ন নয়; এটি তাদের ভূমিগত, আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের সঙ্গেও জড়িত। ‘আদিবাসী’ হিসেবে তারা স্বীকৃতি পেলে অতি সহজেই তাদের ঐতিহাসিক নিপীড়ন এবং প্রান্তিককরণের বিষয়গুলো সামনে চলে আসবে। তাই এই দাবি আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার ক্ষেত্রেও নানা দিক থেকে স্পর্শকাতর। ‘আদিবাসী’ দাবিকে ঘিরে অভিযোগ রয়েছে, এটি কোনো কোনো ক্ষেত্রে আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে উৎসাহিত করতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের লড়াই মূলত একটি ‘বহিরাগত’ শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর প্রতিরোধ। গ্রামসির ‘আধিপত্য’ (হেজিমনি) তত্ত্বমতে, রাষ্ট্রশক্তি সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর চেতনাকে দমিয়ে রাখতে চায়। বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে, যেখানে একটি একক জাতি ধারণাকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছে, ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীগুলোর পরিচয়ের দাবি এই একক কাঠামোর বিরুদ্ধে একটি বহুত্ববাদী চ্যালেঞ্জ। জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী, আদিবাসী জনগণের স্বীকৃতি শুধু তাদের ঐতিহ্যকে রক্ষা নয়, বরং তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থরক্ষার একটি কাঠামো প্রদান করে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, রাষ্ট্র ও সমাজ কি ‘আদিবাসী’ দাবিদার এ ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর প্রাপ্য অধিকারগুলোকে শুধু সাংস্কৃতিক স্তরে সীমাবদ্ধ রাখবে, নাকি তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি বাড়ানোর ক্ষেত্রে বাস্তব পদক্ষেপ নেবে? তবে ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশে যারা নিজেদেরকে ‘আদিবাসী’ বলে দাবি করেন, তাদের অনেকেই এই অঞ্চলের আদি অধিবাসী নন, তারা বিভিন্ন সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ অন্যান্য অঞ্চলে এসে বসতি স্থাপন করেছেন। পিনাকী ভট্টাচার্য সাম্প্রতিক একটি ভিডিওতে ‘বোমাং’ রাজার মুখেই পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর আগমনের ইতিহাস তুলে ধরেছেন। তা ছাড়া ঐতিহাসিক নথিপত্র ও নানা ঐতিহাসিক বিবরণ রয়েছে, যেগুলো অনেকের কাছে দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়। ফলে স্থানিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে একটি বিতর্কের জন্ম হয়েছে, এই অঞ্চলে অভিবাসিত নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীগুলো কীভাবে নিজেদের এ দেশের ‘আদিবাসী’ তথা ভূমিপুত্র বলে দাবি করতে পারেন।
বিভিন্ন গবেষক, যেমন আমেরিকান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও নৃতাত্ত্বিক জেমস স্কট (১৯৩৬-২০২৪) তার ‘শাসিত না হওয়ার শিল্প’ (আর্ট অব নট বিয়িং গভর্নড, ২০০৯) গ্রন্থে দেখিয়েছেন, অনেক জনগোষ্ঠী পাহাড়ি অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছেন রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ এড়িয়ে নিজেদের সংস্কৃতি ও স্বাধীনতাকে রক্ষা করার জন্য। এ ছাড়া ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ এবং প্রাপ্ত নথিপত্র ও বিবরণকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ায় অভিবাসন, স্থানান্তর এবং ভূমি অধিকারের প্রশ্নে কোনো নিরবচ্ছিন্ন ঐতিহ্য নেই। বহু জনগোষ্ঠী বিভিন্ন সময়ে অভ্যন্তরীণ বা বাইরের চাপের কারণে স্থানান্তরিত হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান প্রজন্মের নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীগুলোর জন্য আদিবাসী পরিচয় তাদের আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থান রক্ষার একটি উপায় মাত্র। তাই এই দাবিকে ‘অযৌক্তিক’ বা ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলা যায় অতি সহজেই। কিন্তু সেটা বলার আগে এই দাবির পেছনের কারণগুলো কী এবং সেগুলো কীভাবে সমাধান করা যায়, সে ব্যবস্থা করতে হবে। নতুবা নানা চক্রান্তের কারণে এটি একটি বৃহত্তর বিভাজন ও বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রক্রিয়ার অংশ হবে, যেখানে আমাদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভাইবোনেরা তাদের অধিকার ও অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সহজেই নানা চক্রান্তের ফাঁদে পা দেবেন এবং আন্তর্জাতিক আইনের শরণাপন্ন হবেন। প্রশ্ন হতে পারে, এই দাবিকে ঐতিহাসিক বিতর্কের চেয়ে বহুত্ববাদী নতুন চেতনায় সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অস্তিত্বের প্রেক্ষাপটে কীভাবে মূল্যায়ন করা উচিত?
আমাদের মনে রাখতে হবে, আদিবাসী পরিচয়ের ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা অত্যন্ত জটিল এবং বহুমাত্রিক। বাংলাদেশের পাহাড়ি ও সমতলভূমির বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী নিজেদের ‘আদিবাসী’ বলে পরিচয় দিয়ে যে বার্তা দিচ্ছে, তা কেবল আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক দাবি নয়, এটি একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দাবিও বটে। এটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের প্রতীক এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে অধিকার আদায়ে তাদের নিজস্ব অবস্থান তুলে ধরার প্রয়াস। জাতিসংঘের উপরে উল্লেখিত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার-সংক্রান্ত ঘোষণাপত্রে ‘আদিবাসী’ পরিচয়কে একটি বৈশ্বিক কাঠামোতে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, যেখানে জাতিগত বৈচিত্র্য এবং প্রথাগত ভূমি অধিকারের স্বীকৃতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই কাঠামোর আওতায় নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ‘আদিবাসী’ দাবিদার জনগোষ্ঠীগুলো এই দাবিকে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। তাই ভূ-রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে এই পরিচয় বাংলাদেশের জন্য একটি বিতর্কিত ও সংবেদনশীল ইস্যু। রাষ্ট্রীয় পরিসীমা এবং সার্বভৌমত্বের প্রেক্ষাপটে অনেকেই মনে করেন, নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীগুলোর ‘আদিবাসী’ পরিচয় বিভাজনমূলক এবং জাতীয় ঐক্যের ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সমালোচকদের মতে, আমাদের নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীকে, বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাসকারী জাতিগুলোকে ‘আদিবাসী’ স্বীকৃতি আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদকে উসকে দিতে পারে। বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। এর প্রমাণ হিসেবে তারা ঐতিহাসিকভাবে বিভিন্ন সময়ে পাহাড়ি অঞ্চলে সংঘাত এবং সশস্ত্র আন্দোলনের উদাহরণগুলো তুলে ধরেন। বর্তমানে এই বিরোধিতা শুধু অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ নয়। এ দাবির পক্ষে ও বিপক্ষে নানা যুক্তি, তর্ক, প্রচার-প্রচারণা অব্যাহত রয়েছে দীর্ঘদিন ধরেই এবং সাম্প্রতিক ঘটনাবলি সেসবের ধারাবাহিকতারই ইঙ্গিতবহ।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের প্রশ্নে অনেক রাষ্ট্রই দ্বিধাগ্রস্ত। কারণ এই স্বীকৃতি প্রদান করলে তা রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব এবং অভ্যন্তরীণ নীতিমালা তৈরিতে বাইরের প্রভাব, এমনকি হস্তক্ষেপেরও সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। অপরদিকে ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের দাবি রাষ্ট্রীয় আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে এবং বহুত্ববাদী কাঠামো প্রতিষ্ঠার দাবি তোলে। ফলে প্রশ্নটি কেবল জাতীয় ঐক্যের জন্য হুমকি নাকি বৈচিত্র্যের স্বীকৃতির লড়াই, তা নির্ভর করে এই ইস্যুটিকে রাষ্ট্র কীভাবে দেখছে এবং মোকাবিলা করছে তার ওপর। ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের রাজনৈতিক বাস্তবতা শুধু স্থানিক নয়; এটি একটি আন্তর্জাতিক আন্দোলনের অংশ, যা শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিরুদ্ধেও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা হিসেবে দেখা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো, জাতীয় ঐক্যের প্রেক্ষাপটে আদিবাসী পরিচয় কেন বাধার সৃষ্টি করছে? বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়ে ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’ ধারণাটি একটি আদর্শ, যা ভাষাতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক, ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় বৈচিত্র্যকে একসঙ্গে ধারণ করার প্রত্যয়কে বোঝায়। রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে ‘বাংলাদেশি’ পরিচয়কে মূল পরিচয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেও এ দেশের ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীগুলোর নিজস্ব পরিচয়ের প্রতি উপেক্ষা বা সে পরিচয়ের ভুল ব্যাখ্যাও জাতীয় ঐক্যের ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।
বাঙালি ভাষাতাত্ত্বিক জাতি হলেও নৃতাত্ত্বিক বিচারে একটি সংকর জাতি। তাই বাঙালিত্বে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং নৃতাত্ত্বিক বৈচিত্র্য স্বাভাবিক এবং ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তবে দেয়ালচিত্রটিতে ‘আদিবাসী’ পরিচয়কে ধর্মীয় পরিচয়ের সমগোত্রীয় হিসেবে বিবেচনা করা এবং সেই দেয়ালচিত্রের অপসারণ নিয়ে আন্দোলন, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও সংঘাত স্পষ্টতই একটি তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক ভুল। আলোচনায় এটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে, আদিবাসী পরিচয় একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর স্থানিক, ঐতিহাসিক এবং আর্থসামাজিক বাস্তবতাকে প্রতিনিধিত্ব করে, যা তাদের সাংস্কৃতিক ও ভূমি অধিকারের জন্য একটি রাজনৈতিক দাবির ভিত্তি। ফলে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের ভূমির ওপর একই দেশের সেই অঞ্চলে বসবাসকারী অন্য জনগোষ্ঠীর স্থানিক ও ঐতিহাসিক অধিকারকে সরাসরি নাকচ করে দেয়। একই দেশের জনগণের মধ্যে ভূমি অধিকারে বৈষম্য তৈরি করে। ফলে ভূমির ওপর অধিকারের প্রশ্নে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত সৃষ্টি করে এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে তাদের দাবিকে আলাদা করে দেখায় ও বৈষম্য তৈরি করে। সংগত কারণে রাষ্ট্রীয় নীতি এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এই দাবিকে প্রায়শই বিভাজনমূলক এবং জাতীয় ঐক্যের জন্য হুমকি হিসেবে দেখা হয়। জাতিগত দ্বন্দ্ব এবং সংঘর্ষের প্রেক্ষাপট থেকে দেখলে বোঝা যায়, এই বিভাজনমূলক ধারণার জন্ম ও তা প্রতিষ্ঠা করার লড়াই মূলত রাষ্ট্রীয় শক্তির অপব্যবহার, ভূমি অধিকারের প্রশ্নে ন্যায্যতার অনুপস্থিতি এবং সাংস্কৃতিক সমতার অভাবের বিরুদ্ধে। পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ এবং সমতলভূমির জনগোষ্ঠীর মধ্যে সম্পর্কের ইতিহাসে দেখা যায়, স্থানিক অধিকার এবং সম্পদের ব্যবস্থাপনা নিয়ে যে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে, তা ক্রমাগত দ্বন্দ্ব-সংঘাতের রূপ নিচ্ছে এবং একটি জাতি-রাষ্ট্রের ঐক্যবদ্ধ কাঠামোর জন্য দীর্ঘস্থায়ী চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
বাংলাদেশে বসবাসকারী নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীগুলোর নিজস্ব পরিচয়ের স্বীকৃতি ও তাদেরকে মূলধারার বাঙালি জাতির সমমর্যাদায় সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন কেবল জাতীয় ঐক্যকে সুসংহতই করবে না; বরং এটি একটি বহুত্ববাদী রাষ্ট্রকাঠামো তৈরির সুযোগও সৃষ্টি করবে। তবে এই সুযোগ বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি, যা বৈচিত্র্যকে শুধু আলিঙ্গনই করবে না, বরং তাকে জাতীয় ঐক্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গণ্য করবে ও জাতীয় সমৃদ্ধির উৎস হিসেবে মূল্যায়ন করবে। বৈচিত্র্যের প্রতি যথাযথ স্বীকৃতি প্রদান না করলে তা শুধু জাতিগত সংঘাত বাড়ায় না, বরং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিশ্বাসের সংকটও সৃষ্টি করে। এখন প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের জাতীয় ঐক্য ও ভৌগোলিক সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন রাখতে সমাধানের পথ কী? আদিবাসী পরিচয়ের ইস্যুটি একটি জটিল সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা, যা চূড়ান্ত সমাধানের জন্য সুচিন্তিত, সমন্বিত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পদক্ষেপ দাবি করে। ‘আদিবাসী’ শব্দটি আমাদের পাহাড়ি ভাইবোনদের যদি নৃতাত্ত্বিক, ভাষাতাত্ত্বিক বা সাংস্কৃতিক পরিচয়ের সাধারণ (কমন) বহিঃপ্রকাশ না হয় এবং দেশের জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ এই শব্দটির ব্যবহারে আপত্তি জানায়, তবে এর ব্যবহারের যৌক্তিকতা ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে রাষ্ট্র ও সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর মধ্যে গঠনমূলক আলাপ, আলোচনা ও পর্যালোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যে পৌঁছানো অপরিহার্য। তবে এই আলাপ, আলোচনা ও পর্যালোচনায় উত্তেজনা, হটকারিতা কিংবা বিশৃঙ্খলা নয়, বরং শান্তি ও সমঝোতার মনোভাব নিয়ে মূল সমস্যাগুলো তথা বিরোধের কারণ ও দাবিগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর দ্রুত সমাধানের ব্যবস্থা করতে হবে।
রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের আলোকে একটি ন্যায়সংগত নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা, যা ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীগুলোর আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করবে। এর পাশাপাশি তাদের ভূমি অধিকার, আর্থসামাজিক নিরাপত্তাসহ শিক্ষার সুযোগ এবং উন্নয়ন-সংক্রান্ত চাহিদাগুলোকে গুরুত্বসহকারে মূল্যায়ন করে সেগুলো পূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যদিকে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীসহ সকল নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীগুলোকেও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রতি আস্থা ও আনুগত্য রেখে তাদের দাবিগুলোকে যুক্তিসংগত ও সমন্বিতভাবে তুলে ধরতে হবে, যাতে আলোচনার মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব হয়। বাংলাদেশি হিসেবে আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত, ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’ প্রতিষ্ঠা করা, জাতীয় ঐক্য ও সংহতির জন্য কাজ করা। যেমন একটি দেয়ালচিত্রে বিভিন্ন রং একত্রে সৌন্দর্য সৃষ্টি করে, তেমনি একটি রাষ্ট্রের বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীগুলো তাদের নিজস্ব পরিচিতি ও অধিকার বজায় রেখে ঐক্যের ভিত্তিতে একটি শক্তিশালী জাতি গঠন করতে পারে। তবে লক্ষ রাখতে হবে, বৈচিত্র্যকে আলিঙ্গন যেন আমাদের বিভাজনের কারণ না হয়, বরং তা যেন ঐক্যের ভিতকে আরও শক্তিশালী ও সুসংহত করে, সেটি নিশ্চিত করা বাংলাদেশি হিসেবে আমাদের সবারই দায়িত্ব ও কর্তব্য। কেবল সরকার, দেশের সাধারণ জনগণ এবং পাহাড়ি জনগণের আন্তরিকতা ও সহযোগিতার মাধ্যমেই বিদ্যমান সমস্যাগুলোর সমাধান সম্ভব। জাতীয় ঐক্য ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য আলোচনার পথ খোলা রাখতে হবে, এগিয়ে আসতে হবে আলোচনার পথে ও পৌঁছাতে হবে সমঝোতায়। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বাংলাদেশে বসবাসকারী প্রতিটি জনগোষ্ঠীর অধিকার, মর্যাদা এবং অবস্থানকে সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক কাঠামো তৈরি ও তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
লেখক : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য।
প্রথমত, দেয়ালচিত্রটিতে ব্যবহৃত শব্দগুলোর প্রতি যদি আমরা লক্ষ করি, ‘আদিবাসী’ শব্দটির ব্যবহার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে হতে পারে। কারণ ‘আদিবাসী’ শব্দটি চিত্রে ব্যবহৃত আর চারটি শব্দের ধর্মভিত্তিক পরিচয়ের সমগোত্রীয় নয়। তাই যে কারও মনে ‘আদিবাসী’ পরিচয়কে ধর্মভিত্তিক পরিচয়ের সমগোত্রীয় হিসেবে দেখানোর উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন জাগতে পারে। এটা সহজবোধ্য যে ‘আদিবাসী’ পরিচয়টি কোনো ধর্মের পরিচয় বহন করে না। বরং এটি সুস্পষ্টভাবে স্থানিক ও ঐতিহাসিক বাস্তবতায় আবাসিক অধিকারের পরিচয় বহন করে, যা মূলত একটি নির্দিষ্ট স্থানে ঐতিহাসিক পরম্পরায় বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর প্রথাগত ভূমি অধিকার, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি ও প্রকৃতি-ঘনিষ্ঠ জীবনধারার সঙ্গে সংযুক্ত। সাধারণত ‘মুসলিম’, ‘হিন্দু’, ‘বৌদ্ধ’, ‘খ্রিষ্টান’ শব্দগুলো অনুসারীদের ধর্মীয় পরিচয়ের মধ্য দিয়ে বিশ্বাস, উপাসনা-পদ্ধতি এবং আধ্যাত্মিক আদর্শের পরিচয় তুলে ধরে। কিন্তু ‘আদিবাসী’ শব্দটি ধর্মীয় পরিচয় বহন করে না। এটি একটি নির্দিষ্ট জায়গায় বসবাসকারীদের স্থানিক, ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক অবস্থানের সঙ্গে সম্পর্কিত, যা তাদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার লড়াই ও রাজনৈতিক দাবিকে প্রতিফলিত করে। তাই বিশ্বব্যাপী এই পরিচয় প্রথাগত ভূমির ওপর অধিকার, সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব রক্ষা এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে বিশেষ স্বীকৃতির জন্য একটি সুনির্দিষ্ট দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দ্বিতীয়ত, ইউরোপীয় জাতিগুলোর ঔপনিবেশিক বসতি স্থাপনের মাধ্যমে, বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় সেখানকার আদিবাসীদের উচ্ছেদ ও বিতাড়িত করার মাধ্যমে তাদের ভূসম্পত্তি জবর-দখলের প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতায় আদিবাসীদের অধিকার সংরক্ষণে নানা নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। নৃবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর পরিচয় গড়ে ওঠে ভূমিপুত্র হিসেবে তাদের ভূমি অধিকার, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি এবং স্থানীয় জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে। অ্যাংলো-আইরিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদ বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন (১৯৩৬-২০১৫) তার ‘কল্পিত সম্প্রদায়’ (ইমাজিনড কমিউনিটিস) তত্ত্বে জাতীয়তাবাদ এবং জাতিগত পরিচয় নির্মাণে একই লক্ষ্য ও ঐক্যের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই ধারণার আলোকে দেখা যায়, বাংলাদেশে বসবাসকারী নৃতাত্ত্বিক জাতিগুলোর একত্রে ‘আদিবাসী’ পরিচয়কে ধর্মীয় পরিচয়ের মতো একক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে সংজ্ঞায়িত করা অসম্ভব। বরং এটি নৃতাত্ত্বিক জাতিগুলোর বহুস্তরীয় এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বাইরে থেকে নিজেদের আবাসিক অবস্থানকে সংজ্ঞায়িত করার একটি প্রয়াস। ফলে প্রশ্ন থেকে যায়, আদিবাসী পরিচয়কে গাছের পঞ্চম পাতার অংশ হিসেবে দেখানো কি সত্যিই তাদের ধর্মীয় অবস্থানকে স্বীকৃতি দেয়? নাকি সেটা আমাদের পাহাড়ি ভাইবোনদের পরিচয়কে বিশেষায়িত করার মাধ্যমে বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা?
তৃতীয়ত, নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে উল্লিখিত ধর্মাবলম্বী মানুষ থাকা সত্ত্বেও তারা কেন নিজেদের সেই সব ধর্মীয় পরিচয়ে পরিচিত না হয়ে পৃথক ‘আদিবাসী’ পরিচয়কে গুরুত্ব দিচ্ছেন এবং সেটা প্রতিষ্ঠা করার জন্য আন্দোলনে যাচ্ছেন, এমনকি সংঘাতে জড়াচ্ছেন, সেটাও বোঝা জরুরি। তাত্ত্বিকভাবে সেটা বোঝার জন্য ইতালিয়ান দার্শনিক, ভাষাতাত্ত্বিক ও সমাজবিজ্ঞানী অ্যান্তোনিও গ্রামসির (১৮৯১-১৯৩৭) ‘সাংস্কৃতিক আধিপত্য’ (কালচারাল হেজিমনি) তত্ত্বের আশ্রয় নেওয়া যেতে পারে। এই তত্ত্বে বলা হয়েছে, শাসকগোষ্ঠী কখনো কখনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রভাবশালী ধারণাকে প্রচার ও সংরক্ষণ করতে গিয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বরকে দমন করে। বঞ্চনা, অন্যায় ও অবিচারের শিকার এ দেশে বসবাসকারী ছোট ছোট নৃতাত্ত্বিক জাতিগুলোর ‘আদিবাসী’ পরিচয় সেই কাঠামোগত দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে একটি প্রতিরোধী অবস্থান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এই ‘আদিবাসী’ শব্দের ছত্রচ্ছায়ায় তারা শুধু তাদের ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ নয়, বরং তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ খুঁজে পেতে চাচ্ছেন। তাই আমাদের ছোট ছোট নৃতাত্ত্বিক জাতির ভাইবোনদের এই স্বীকৃতি লাভের লড়াইয়ের মূলে রয়েছে পরিচিতির সূত্রে আন্তর্জাতিক সমর্থন ও আইনি বৈধতা আদায়ের প্রচেষ্টা। এখন প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে আমাদের যে ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক জাতিসত্তার পরিচয় ‘বাংলাদেশি’, সে রাষ্ট্রীয় জাতীয়তায় ছোট ছোট নৃতাত্ত্বিক জাতিগুলোর ভাইবোনেরা তাদের নৃতাত্ত্বিক বা ধর্মীয় পরিচয়কে গুরুত্ব না দিয়ে কেন ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের জন্য এমন মরিয়া ও মারমুখী হয়ে উঠেছেন?
আমরা যে বহুত্ববাদী সমাজের অঙ্গীকার করছি, রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে সে বাস্তবতায় পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী ছোট ছোট নৃতাত্ত্বিক জাতিগুলোকে অবশ্যই আমাদের সমমর্যাদায় গ্রহণ করতে হবে। তাদের আলাদা পরিচয়ের দাবিকে উপেক্ষা করলে সেটা হবে অন্যায় এবং সেই একই ঐতিহাসিক নিপীড়নের পুনরাবৃত্তি ঘটবে, যেটা পাকিস্তানিরা আমাদের সঙ্গে করেছিল। তাই পাহাড়ি অঞ্চলে বা সমতলে বসবাসকারী ছোট জনগোষ্ঠীগুলোর নিজস্ব পরিচয়কে যথাযথভাবে মর্যাদার সঙ্গে আলাদা গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরতে হবে। আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থায় অন্যদের সঙ্গে তারা শুধু সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যই নয়, বরং নিজস্ব রাজনৈতিক অবস্থানকে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগও পেতে হবে। নৃতাত্ত্বিক জাতিগুলোর সঙ্গে সংকর বাঙালির জাতিগত বিরোধের মূল কারণ আমাদের মূলধারার রাষ্ট্রীয় জাতিসত্তায় তাদের স্বাতন্ত্র্যের স্বীকৃতির ও সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণের অভাব এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে তাদেরকে প্রান্তিককরণের প্রভাব। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র বিনির্মাণের প্রক্রিয়ায় আমাদেরকে কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। রাষ্ট্র কি এই জাতিগোষ্ঠীগুলোর ‘অভ্যন্তরীণ অন্যতা’ (ইন্টারনাল আদারনেস) মেনে নিতে প্রস্তুত? নাকি তাদের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক অবস্থানকে অগ্রাহ্য করে তাদের পরিচয়কে একীভূতকরণের মাধ্যমে অবলুপ্ত করতে চায়? কিংবা ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে নানাভাবে তাদেরকে নিষ্পেষিত করতে চায়?
আদিবাসী পরিচয়ের দাবির পেছনে মূল কারণগুলো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এ পরিচয়কে একটি আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। ‘আদিবাসী’ শব্দটি ইংরেজি ‘ইন্ডিজেনাস’ শব্দের অনুবাদ, যা মূলত উপনিবেশ-উত্তর প্রেক্ষাপটে ইউরোপীয় জাতিগুলোর ঔপনিবেশিক ধ্যানধারণা ও নীতিমালার বিপরীতে অধিকৃত ভূমির প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার এবং স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠার একটি প্রতীক হয়ে উঠেছে। জাতিসংঘের সনদ এবং আদিবাসীদের অধিকারের ঘোষণা (ইউএন ডিক্লারেশন অন দ্য রাইটস অব ইন্ডিজেনাস পিপলস) বা সংক্ষেপে উনড্রিপ (ইউএনডিআইপি) বলা হয়। এ ঘোষণা অনুযায়ী, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর দাবির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে তাদের ঐতিহ্য, ভূমি অধিকার, সংস্কৃতির সংরক্ষণ এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। সে যা-ই হোক, এটা স্পষ্ট যে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর ‘আদিবাসী’ পরিচয় আদায় করতে চেষ্টা করার উদ্দেশ্য কেবল একটি সাংস্কৃতিক স্বীকৃতির প্রশ্ন নয়; এটি তাদের ভূমিগত, আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের সঙ্গেও জড়িত। ‘আদিবাসী’ হিসেবে তারা স্বীকৃতি পেলে অতি সহজেই তাদের ঐতিহাসিক নিপীড়ন এবং প্রান্তিককরণের বিষয়গুলো সামনে চলে আসবে। তাই এই দাবি আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার ক্ষেত্রেও নানা দিক থেকে স্পর্শকাতর। ‘আদিবাসী’ দাবিকে ঘিরে অভিযোগ রয়েছে, এটি কোনো কোনো ক্ষেত্রে আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে উৎসাহিত করতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের লড়াই মূলত একটি ‘বহিরাগত’ শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর প্রতিরোধ। গ্রামসির ‘আধিপত্য’ (হেজিমনি) তত্ত্বমতে, রাষ্ট্রশক্তি সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর চেতনাকে দমিয়ে রাখতে চায়। বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে, যেখানে একটি একক জাতি ধারণাকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছে, ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীগুলোর পরিচয়ের দাবি এই একক কাঠামোর বিরুদ্ধে একটি বহুত্ববাদী চ্যালেঞ্জ। জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী, আদিবাসী জনগণের স্বীকৃতি শুধু তাদের ঐতিহ্যকে রক্ষা নয়, বরং তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থরক্ষার একটি কাঠামো প্রদান করে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, রাষ্ট্র ও সমাজ কি ‘আদিবাসী’ দাবিদার এ ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর প্রাপ্য অধিকারগুলোকে শুধু সাংস্কৃতিক স্তরে সীমাবদ্ধ রাখবে, নাকি তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি বাড়ানোর ক্ষেত্রে বাস্তব পদক্ষেপ নেবে? তবে ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশে যারা নিজেদেরকে ‘আদিবাসী’ বলে দাবি করেন, তাদের অনেকেই এই অঞ্চলের আদি অধিবাসী নন, তারা বিভিন্ন সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ অন্যান্য অঞ্চলে এসে বসতি স্থাপন করেছেন। পিনাকী ভট্টাচার্য সাম্প্রতিক একটি ভিডিওতে ‘বোমাং’ রাজার মুখেই পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর আগমনের ইতিহাস তুলে ধরেছেন। তা ছাড়া ঐতিহাসিক নথিপত্র ও নানা ঐতিহাসিক বিবরণ রয়েছে, যেগুলো অনেকের কাছে দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়। ফলে স্থানিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে একটি বিতর্কের জন্ম হয়েছে, এই অঞ্চলে অভিবাসিত নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীগুলো কীভাবে নিজেদের এ দেশের ‘আদিবাসী’ তথা ভূমিপুত্র বলে দাবি করতে পারেন।
বিভিন্ন গবেষক, যেমন আমেরিকান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও নৃতাত্ত্বিক জেমস স্কট (১৯৩৬-২০২৪) তার ‘শাসিত না হওয়ার শিল্প’ (আর্ট অব নট বিয়িং গভর্নড, ২০০৯) গ্রন্থে দেখিয়েছেন, অনেক জনগোষ্ঠী পাহাড়ি অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছেন রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ এড়িয়ে নিজেদের সংস্কৃতি ও স্বাধীনতাকে রক্ষা করার জন্য। এ ছাড়া ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ এবং প্রাপ্ত নথিপত্র ও বিবরণকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ায় অভিবাসন, স্থানান্তর এবং ভূমি অধিকারের প্রশ্নে কোনো নিরবচ্ছিন্ন ঐতিহ্য নেই। বহু জনগোষ্ঠী বিভিন্ন সময়ে অভ্যন্তরীণ বা বাইরের চাপের কারণে স্থানান্তরিত হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান প্রজন্মের নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীগুলোর জন্য আদিবাসী পরিচয় তাদের আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থান রক্ষার একটি উপায় মাত্র। তাই এই দাবিকে ‘অযৌক্তিক’ বা ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলা যায় অতি সহজেই। কিন্তু সেটা বলার আগে এই দাবির পেছনের কারণগুলো কী এবং সেগুলো কীভাবে সমাধান করা যায়, সে ব্যবস্থা করতে হবে। নতুবা নানা চক্রান্তের কারণে এটি একটি বৃহত্তর বিভাজন ও বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রক্রিয়ার অংশ হবে, যেখানে আমাদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভাইবোনেরা তাদের অধিকার ও অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সহজেই নানা চক্রান্তের ফাঁদে পা দেবেন এবং আন্তর্জাতিক আইনের শরণাপন্ন হবেন। প্রশ্ন হতে পারে, এই দাবিকে ঐতিহাসিক বিতর্কের চেয়ে বহুত্ববাদী নতুন চেতনায় সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অস্তিত্বের প্রেক্ষাপটে কীভাবে মূল্যায়ন করা উচিত?
আমাদের মনে রাখতে হবে, আদিবাসী পরিচয়ের ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা অত্যন্ত জটিল এবং বহুমাত্রিক। বাংলাদেশের পাহাড়ি ও সমতলভূমির বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী নিজেদের ‘আদিবাসী’ বলে পরিচয় দিয়ে যে বার্তা দিচ্ছে, তা কেবল আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক দাবি নয়, এটি একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দাবিও বটে। এটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের প্রতীক এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে অধিকার আদায়ে তাদের নিজস্ব অবস্থান তুলে ধরার প্রয়াস। জাতিসংঘের উপরে উল্লেখিত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার-সংক্রান্ত ঘোষণাপত্রে ‘আদিবাসী’ পরিচয়কে একটি বৈশ্বিক কাঠামোতে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, যেখানে জাতিগত বৈচিত্র্য এবং প্রথাগত ভূমি অধিকারের স্বীকৃতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই কাঠামোর আওতায় নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ‘আদিবাসী’ দাবিদার জনগোষ্ঠীগুলো এই দাবিকে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। তাই ভূ-রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে এই পরিচয় বাংলাদেশের জন্য একটি বিতর্কিত ও সংবেদনশীল ইস্যু। রাষ্ট্রীয় পরিসীমা এবং সার্বভৌমত্বের প্রেক্ষাপটে অনেকেই মনে করেন, নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীগুলোর ‘আদিবাসী’ পরিচয় বিভাজনমূলক এবং জাতীয় ঐক্যের ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সমালোচকদের মতে, আমাদের নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীকে, বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাসকারী জাতিগুলোকে ‘আদিবাসী’ স্বীকৃতি আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদকে উসকে দিতে পারে। বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। এর প্রমাণ হিসেবে তারা ঐতিহাসিকভাবে বিভিন্ন সময়ে পাহাড়ি অঞ্চলে সংঘাত এবং সশস্ত্র আন্দোলনের উদাহরণগুলো তুলে ধরেন। বর্তমানে এই বিরোধিতা শুধু অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ নয়। এ দাবির পক্ষে ও বিপক্ষে নানা যুক্তি, তর্ক, প্রচার-প্রচারণা অব্যাহত রয়েছে দীর্ঘদিন ধরেই এবং সাম্প্রতিক ঘটনাবলি সেসবের ধারাবাহিকতারই ইঙ্গিতবহ।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের প্রশ্নে অনেক রাষ্ট্রই দ্বিধাগ্রস্ত। কারণ এই স্বীকৃতি প্রদান করলে তা রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব এবং অভ্যন্তরীণ নীতিমালা তৈরিতে বাইরের প্রভাব, এমনকি হস্তক্ষেপেরও সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। অপরদিকে ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের দাবি রাষ্ট্রীয় আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে এবং বহুত্ববাদী কাঠামো প্রতিষ্ঠার দাবি তোলে। ফলে প্রশ্নটি কেবল জাতীয় ঐক্যের জন্য হুমকি নাকি বৈচিত্র্যের স্বীকৃতির লড়াই, তা নির্ভর করে এই ইস্যুটিকে রাষ্ট্র কীভাবে দেখছে এবং মোকাবিলা করছে তার ওপর। ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের রাজনৈতিক বাস্তবতা শুধু স্থানিক নয়; এটি একটি আন্তর্জাতিক আন্দোলনের অংশ, যা শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিরুদ্ধেও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা হিসেবে দেখা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো, জাতীয় ঐক্যের প্রেক্ষাপটে আদিবাসী পরিচয় কেন বাধার সৃষ্টি করছে? বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়ে ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’ ধারণাটি একটি আদর্শ, যা ভাষাতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক, ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় বৈচিত্র্যকে একসঙ্গে ধারণ করার প্রত্যয়কে বোঝায়। রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে ‘বাংলাদেশি’ পরিচয়কে মূল পরিচয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেও এ দেশের ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীগুলোর নিজস্ব পরিচয়ের প্রতি উপেক্ষা বা সে পরিচয়ের ভুল ব্যাখ্যাও জাতীয় ঐক্যের ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।
বাঙালি ভাষাতাত্ত্বিক জাতি হলেও নৃতাত্ত্বিক বিচারে একটি সংকর জাতি। তাই বাঙালিত্বে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং নৃতাত্ত্বিক বৈচিত্র্য স্বাভাবিক এবং ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তবে দেয়ালচিত্রটিতে ‘আদিবাসী’ পরিচয়কে ধর্মীয় পরিচয়ের সমগোত্রীয় হিসেবে বিবেচনা করা এবং সেই দেয়ালচিত্রের অপসারণ নিয়ে আন্দোলন, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও সংঘাত স্পষ্টতই একটি তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক ভুল। আলোচনায় এটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে, আদিবাসী পরিচয় একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর স্থানিক, ঐতিহাসিক এবং আর্থসামাজিক বাস্তবতাকে প্রতিনিধিত্ব করে, যা তাদের সাংস্কৃতিক ও ভূমি অধিকারের জন্য একটি রাজনৈতিক দাবির ভিত্তি। ফলে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের ভূমির ওপর একই দেশের সেই অঞ্চলে বসবাসকারী অন্য জনগোষ্ঠীর স্থানিক ও ঐতিহাসিক অধিকারকে সরাসরি নাকচ করে দেয়। একই দেশের জনগণের মধ্যে ভূমি অধিকারে বৈষম্য তৈরি করে। ফলে ভূমির ওপর অধিকারের প্রশ্নে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত সৃষ্টি করে এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে তাদের দাবিকে আলাদা করে দেখায় ও বৈষম্য তৈরি করে। সংগত কারণে রাষ্ট্রীয় নীতি এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এই দাবিকে প্রায়শই বিভাজনমূলক এবং জাতীয় ঐক্যের জন্য হুমকি হিসেবে দেখা হয়। জাতিগত দ্বন্দ্ব এবং সংঘর্ষের প্রেক্ষাপট থেকে দেখলে বোঝা যায়, এই বিভাজনমূলক ধারণার জন্ম ও তা প্রতিষ্ঠা করার লড়াই মূলত রাষ্ট্রীয় শক্তির অপব্যবহার, ভূমি অধিকারের প্রশ্নে ন্যায্যতার অনুপস্থিতি এবং সাংস্কৃতিক সমতার অভাবের বিরুদ্ধে। পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ এবং সমতলভূমির জনগোষ্ঠীর মধ্যে সম্পর্কের ইতিহাসে দেখা যায়, স্থানিক অধিকার এবং সম্পদের ব্যবস্থাপনা নিয়ে যে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে, তা ক্রমাগত দ্বন্দ্ব-সংঘাতের রূপ নিচ্ছে এবং একটি জাতি-রাষ্ট্রের ঐক্যবদ্ধ কাঠামোর জন্য দীর্ঘস্থায়ী চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
বাংলাদেশে বসবাসকারী নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীগুলোর নিজস্ব পরিচয়ের স্বীকৃতি ও তাদেরকে মূলধারার বাঙালি জাতির সমমর্যাদায় সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন কেবল জাতীয় ঐক্যকে সুসংহতই করবে না; বরং এটি একটি বহুত্ববাদী রাষ্ট্রকাঠামো তৈরির সুযোগও সৃষ্টি করবে। তবে এই সুযোগ বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি, যা বৈচিত্র্যকে শুধু আলিঙ্গনই করবে না, বরং তাকে জাতীয় ঐক্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গণ্য করবে ও জাতীয় সমৃদ্ধির উৎস হিসেবে মূল্যায়ন করবে। বৈচিত্র্যের প্রতি যথাযথ স্বীকৃতি প্রদান না করলে তা শুধু জাতিগত সংঘাত বাড়ায় না, বরং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিশ্বাসের সংকটও সৃষ্টি করে। এখন প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের জাতীয় ঐক্য ও ভৌগোলিক সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন রাখতে সমাধানের পথ কী? আদিবাসী পরিচয়ের ইস্যুটি একটি জটিল সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা, যা চূড়ান্ত সমাধানের জন্য সুচিন্তিত, সমন্বিত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পদক্ষেপ দাবি করে। ‘আদিবাসী’ শব্দটি আমাদের পাহাড়ি ভাইবোনদের যদি নৃতাত্ত্বিক, ভাষাতাত্ত্বিক বা সাংস্কৃতিক পরিচয়ের সাধারণ (কমন) বহিঃপ্রকাশ না হয় এবং দেশের জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ এই শব্দটির ব্যবহারে আপত্তি জানায়, তবে এর ব্যবহারের যৌক্তিকতা ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে রাষ্ট্র ও সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর মধ্যে গঠনমূলক আলাপ, আলোচনা ও পর্যালোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যে পৌঁছানো অপরিহার্য। তবে এই আলাপ, আলোচনা ও পর্যালোচনায় উত্তেজনা, হটকারিতা কিংবা বিশৃঙ্খলা নয়, বরং শান্তি ও সমঝোতার মনোভাব নিয়ে মূল সমস্যাগুলো তথা বিরোধের কারণ ও দাবিগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর দ্রুত সমাধানের ব্যবস্থা করতে হবে।
রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের আলোকে একটি ন্যায়সংগত নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা, যা ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীগুলোর আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করবে। এর পাশাপাশি তাদের ভূমি অধিকার, আর্থসামাজিক নিরাপত্তাসহ শিক্ষার সুযোগ এবং উন্নয়ন-সংক্রান্ত চাহিদাগুলোকে গুরুত্বসহকারে মূল্যায়ন করে সেগুলো পূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যদিকে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীসহ সকল নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীগুলোকেও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রতি আস্থা ও আনুগত্য রেখে তাদের দাবিগুলোকে যুক্তিসংগত ও সমন্বিতভাবে তুলে ধরতে হবে, যাতে আলোচনার মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব হয়। বাংলাদেশি হিসেবে আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত, ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’ প্রতিষ্ঠা করা, জাতীয় ঐক্য ও সংহতির জন্য কাজ করা। যেমন একটি দেয়ালচিত্রে বিভিন্ন রং একত্রে সৌন্দর্য সৃষ্টি করে, তেমনি একটি রাষ্ট্রের বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীগুলো তাদের নিজস্ব পরিচিতি ও অধিকার বজায় রেখে ঐক্যের ভিত্তিতে একটি শক্তিশালী জাতি গঠন করতে পারে। তবে লক্ষ রাখতে হবে, বৈচিত্র্যকে আলিঙ্গন যেন আমাদের বিভাজনের কারণ না হয়, বরং তা যেন ঐক্যের ভিতকে আরও শক্তিশালী ও সুসংহত করে, সেটি নিশ্চিত করা বাংলাদেশি হিসেবে আমাদের সবারই দায়িত্ব ও কর্তব্য। কেবল সরকার, দেশের সাধারণ জনগণ এবং পাহাড়ি জনগণের আন্তরিকতা ও সহযোগিতার মাধ্যমেই বিদ্যমান সমস্যাগুলোর সমাধান সম্ভব। জাতীয় ঐক্য ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য আলোচনার পথ খোলা রাখতে হবে, এগিয়ে আসতে হবে আলোচনার পথে ও পৌঁছাতে হবে সমঝোতায়। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বাংলাদেশে বসবাসকারী প্রতিটি জনগোষ্ঠীর অধিকার, মর্যাদা এবং অবস্থানকে সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক কাঠামো তৈরি ও তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
লেখক : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য।