বাংলাদেশের মানুষ বেশ বুঝতে পারছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র নিয়ে একটা জটিলতা চলছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা অনেক রক্ত ও জীবনের বিনিময়ে শেখ হাসিনার ১৬ বছরের শাসনের অবসান ঘটায় একটা গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। যে সময় সবাই প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল শেখ হাসিনার অচলায়তন ভাঙা অসম্ভব, সে সময় ছাত্র-জনতা একতাবদ্ধ হয়ে এই কাজটি সম্ভব করে। শেখ হাসিনা বোন রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন। কেবল শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ভারতে আশ্রয় নেননি, আওয়ামী লীগের টানা প্রায় ১৬ বছর শাসনে তার সামান্য বেনিফিশিয়ারি যিনি, তিনিও দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। দেখা গেল সেই পলাতক দলের মধ্যে এমপি-মন্ত্রীদের চাকর-বাকর পর্যন্ত পালিয়ে যান। এমনকি মসজিদের ইমাম, খাদেম পর্যন্ত দেশ ছেড়ে পালান। ইতিহাসে এ রকম ঘটনার উল্লেখ খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাংলা-পাক-ভারতেও এমন নজির নেই।
১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন হয়েছিল বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভের জন্য। সে আন্দোলনে এ রকম ঘটনার কোনো প্রশ্ন ছিল। ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে আইয়ুব খান আরেক জেনারেলের কাছে ক্ষমতা দিয়ে নিজে পদত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু তার বা তার কোনো বেনিফিশিয়ারি কিংবা তার কোনো সমর্থককে পালিয়ে যেতে হয়নি। ১৯৯০-এর এরশাদবিরোধী আন্দোলনেও শুধু এরশাদ ক্ষমতা ছেড়েছিলেন। কিন্তু কোনো একজনকেও দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়নি। বরং পরবর্তী নির্বাচনে এরশাদ ৫টি আসনে দাঁড়িয়ে ৫টিতেই জয়ী হয়েছিলেন। তিনি সে সময় জেলে ছিলেন। কোনো নির্বাচনী প্রচারণাও চালাতে পারেননি।
আওয়ামী লীগ দাপটের সঙ্গে গত প্রায় ১৬ বছর দেশ পরিচালনা করেছে। কোনো দল বা কাউকে শেখ হাসিনা সামান্য স্পেসও দেননি। নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে প্রশ্ন উঠলেও তিনি তাতে কান দেননি। উন্নয়নের নামে শেখ হাসিনা গণতন্ত্র, মানবিকতার কোনো কিছুকে প্রশ্রয় দেননি। রাজনৈতিক দলগুলো কথা বলবে, সরকারের সমালোচনা করবে, বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন করবেÑবাংলাদেশে সে রেওয়াজ বন্ধ করে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। তারা পুলিশের পাশাপাশি ছাত্রলীগকেও একটি বাহিনী করে গঠন করেছিল। শেষ দিকে ছাত্রলীগকে আর ’৫২, ’৭১, ’৯০-এর ঐতিহ্যধারণকারী ছাত্রসংগঠন বলা যেত না। আওয়ামী লীগকেও গণতন্ত্র চর্চাকারী কোনো রাজনৈতিক দল বলে মনে হতো না।
এ রকম পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গণবিদ্রোহ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল। অনেক চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে গত জুলাই-আগস্টে গণ-অভ্যুত্থান সফল হয়। হাসিনা সরকার পরাজিত হয়। তিনি প্রতিবেশী দেশ ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন এবং তার সব সমর্থক, সুবিধাভোগী, তোষামোদকারী সবাই যার যার মতো করে পালিয়ে যান বা আত্মগোপন করেন। বিদেশে অবস্থানকারী নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. ইউনূসের নেতৃত্বে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়। তারা সংবিধান স্থগিত না করে সেই সংবিধান সমুন্নত রাখার অঙ্গীকার করে শেখ হাসিনার মনোনীত রাষ্ট্রপতির অধীনেই শপথ নিয়ে রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব পালন শুরু করে দেন। সে সময় তাদের কারও মনে সংবিধান ছুড়ে ফেলে দেওয়ার কথা কিংবা সংবিধান সমুন্নত রেখে এই রাষ্ট্রপতির কাছেই শপথ না নেওয়ার কথা উদয় হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ড. ইউনূস বাংলাদেশের দলনেতা হয়ে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনেও যোগ দেন।
এভাবেই প্রায় পাঁচ মাস কেটে যায়। সাধারণ মানুষ যখন সবকিছু মেনে নিতে অভ্যস্ত হতে যাচ্ছে, সে সময় হঠাৎ করেই ছাত্রনেতাদের পক্ষ থেকে চব্বিশের ঘোষণাপত্র প্রকাশের দাবি তোলা হয় এবং সেটি ঘোষণার একটি নির্দিষ্ট তারিখও বলে দেওয়া হয়। পরে প্রধান উপদেষ্টার পক্ষে তার প্রেস সচিব সরকারের পক্ষে ঘোষণা দেওয়ার কথা বলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতাদের আপাতত শান্ত করেন। এখন আবার তারা ঘোষণাপত্রের দাবি তুলছে। তারা বলছে, চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের লিখিত অঙ্গীকারনামা চায়। তাদের কি ভয় পেয়ে বসেছে, এই অভ্যুত্থানের কথা মানুষ যদি ভুলে যায়? নাকি তারা ঘোষণাপত্র নিয়ে একটা রাজনৈতিক হট্টগোল বাধিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নির্বাচনের দাবিকে চাপা দিতে চায়, নাকি মানুষের চোখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিতে চায়? দুটি ভাবনাই অর্থহীন ভাবনা।
নির্বাচন না দিয়ে কি অন্তর্বর্তী সরকারের অন্য কোনো বিকল্প আছে? জোর করে ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার স্বপ্নের যে কী ভয়াবহ পরিণতি, তা যে কারও পক্ষেই অনুধাবন করা কঠিন নয়। রাজনৈতিক দলগুলো আগে-পরে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। তারা যদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নির্বাচন না দেওয়ার অভিসন্ধি বুঝতে পারে, তার পরিণতি কেন ভয়ংকর হতে পারে, তা রাজনীতির পাঠ যাদের নেওয়া আছে, তারা বুঝতে পারেন। গায়ের জোরে বা একগুঁয়েমি করে রাজনীতি হয় না। তার পরিণতি যেমন ইতিহাসে পাওয়া যাবে, তেমনি নিজ দেশের সাম্প্রতিককালের ঘটনাও আমাদের প্রায় সবার জানা। তবে দেশকে যদি কেউ ভিন্ন পথে নিয়ে যেতে চায়, তার পরিণতিও খুব শুভ হবে বলে মনে হয় না।
আর যদি বিস্মরণের ভয়ে লিখিত অঙ্গীকারনামা চায় বৈষম্যবিরোধীরা, তবে এ কথাই তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে হয়, তারা নিজেরা ভুলে গেলেও ইতিহাস কখনো মানুষের জয়-পরাজয়ের কথা বিস্মৃত হয় না। হাজার বছর পরে হলেও ইতিহাসের পাতা উল্টিয়ে খুঁজে পাওয়া যায়, ইতিহাস পাল্টে দেওয়ার ইতিহাস। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতারা নিশ্চয় এক স্বৈরাচারকে পরাজিত করে আরেক স্বৈরাচারকে অধিষ্ঠিত করতে চান না। কিন্তু পাঁচ-ছয় মাস বাহাত্তরের সংবিধান মতে শপথ নিয়ে রাষ্ট্রপরিচালনা করে এখন ঘোষণাপত্রের নামে দেশে একটা নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা হলে সাধারণ মানুষ কখনো আর ছাত্র নেতৃত্বের প্রতি বিশ্বাস রেখে ভবিষ্যতের কোনো ফ্যাসিস্টকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পথে নামবে না।
১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন হয়েছিল বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভের জন্য। সে আন্দোলনে এ রকম ঘটনার কোনো প্রশ্ন ছিল। ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে আইয়ুব খান আরেক জেনারেলের কাছে ক্ষমতা দিয়ে নিজে পদত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু তার বা তার কোনো বেনিফিশিয়ারি কিংবা তার কোনো সমর্থককে পালিয়ে যেতে হয়নি। ১৯৯০-এর এরশাদবিরোধী আন্দোলনেও শুধু এরশাদ ক্ষমতা ছেড়েছিলেন। কিন্তু কোনো একজনকেও দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়নি। বরং পরবর্তী নির্বাচনে এরশাদ ৫টি আসনে দাঁড়িয়ে ৫টিতেই জয়ী হয়েছিলেন। তিনি সে সময় জেলে ছিলেন। কোনো নির্বাচনী প্রচারণাও চালাতে পারেননি।
আওয়ামী লীগ দাপটের সঙ্গে গত প্রায় ১৬ বছর দেশ পরিচালনা করেছে। কোনো দল বা কাউকে শেখ হাসিনা সামান্য স্পেসও দেননি। নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে প্রশ্ন উঠলেও তিনি তাতে কান দেননি। উন্নয়নের নামে শেখ হাসিনা গণতন্ত্র, মানবিকতার কোনো কিছুকে প্রশ্রয় দেননি। রাজনৈতিক দলগুলো কথা বলবে, সরকারের সমালোচনা করবে, বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন করবেÑবাংলাদেশে সে রেওয়াজ বন্ধ করে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। তারা পুলিশের পাশাপাশি ছাত্রলীগকেও একটি বাহিনী করে গঠন করেছিল। শেষ দিকে ছাত্রলীগকে আর ’৫২, ’৭১, ’৯০-এর ঐতিহ্যধারণকারী ছাত্রসংগঠন বলা যেত না। আওয়ামী লীগকেও গণতন্ত্র চর্চাকারী কোনো রাজনৈতিক দল বলে মনে হতো না।
এ রকম পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গণবিদ্রোহ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল। অনেক চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে গত জুলাই-আগস্টে গণ-অভ্যুত্থান সফল হয়। হাসিনা সরকার পরাজিত হয়। তিনি প্রতিবেশী দেশ ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন এবং তার সব সমর্থক, সুবিধাভোগী, তোষামোদকারী সবাই যার যার মতো করে পালিয়ে যান বা আত্মগোপন করেন। বিদেশে অবস্থানকারী নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. ইউনূসের নেতৃত্বে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়। তারা সংবিধান স্থগিত না করে সেই সংবিধান সমুন্নত রাখার অঙ্গীকার করে শেখ হাসিনার মনোনীত রাষ্ট্রপতির অধীনেই শপথ নিয়ে রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব পালন শুরু করে দেন। সে সময় তাদের কারও মনে সংবিধান ছুড়ে ফেলে দেওয়ার কথা কিংবা সংবিধান সমুন্নত রেখে এই রাষ্ট্রপতির কাছেই শপথ না নেওয়ার কথা উদয় হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ড. ইউনূস বাংলাদেশের দলনেতা হয়ে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনেও যোগ দেন।
এভাবেই প্রায় পাঁচ মাস কেটে যায়। সাধারণ মানুষ যখন সবকিছু মেনে নিতে অভ্যস্ত হতে যাচ্ছে, সে সময় হঠাৎ করেই ছাত্রনেতাদের পক্ষ থেকে চব্বিশের ঘোষণাপত্র প্রকাশের দাবি তোলা হয় এবং সেটি ঘোষণার একটি নির্দিষ্ট তারিখও বলে দেওয়া হয়। পরে প্রধান উপদেষ্টার পক্ষে তার প্রেস সচিব সরকারের পক্ষে ঘোষণা দেওয়ার কথা বলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতাদের আপাতত শান্ত করেন। এখন আবার তারা ঘোষণাপত্রের দাবি তুলছে। তারা বলছে, চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের লিখিত অঙ্গীকারনামা চায়। তাদের কি ভয় পেয়ে বসেছে, এই অভ্যুত্থানের কথা মানুষ যদি ভুলে যায়? নাকি তারা ঘোষণাপত্র নিয়ে একটা রাজনৈতিক হট্টগোল বাধিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নির্বাচনের দাবিকে চাপা দিতে চায়, নাকি মানুষের চোখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিতে চায়? দুটি ভাবনাই অর্থহীন ভাবনা।
নির্বাচন না দিয়ে কি অন্তর্বর্তী সরকারের অন্য কোনো বিকল্প আছে? জোর করে ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার স্বপ্নের যে কী ভয়াবহ পরিণতি, তা যে কারও পক্ষেই অনুধাবন করা কঠিন নয়। রাজনৈতিক দলগুলো আগে-পরে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। তারা যদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নির্বাচন না দেওয়ার অভিসন্ধি বুঝতে পারে, তার পরিণতি কেন ভয়ংকর হতে পারে, তা রাজনীতির পাঠ যাদের নেওয়া আছে, তারা বুঝতে পারেন। গায়ের জোরে বা একগুঁয়েমি করে রাজনীতি হয় না। তার পরিণতি যেমন ইতিহাসে পাওয়া যাবে, তেমনি নিজ দেশের সাম্প্রতিককালের ঘটনাও আমাদের প্রায় সবার জানা। তবে দেশকে যদি কেউ ভিন্ন পথে নিয়ে যেতে চায়, তার পরিণতিও খুব শুভ হবে বলে মনে হয় না।
আর যদি বিস্মরণের ভয়ে লিখিত অঙ্গীকারনামা চায় বৈষম্যবিরোধীরা, তবে এ কথাই তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে হয়, তারা নিজেরা ভুলে গেলেও ইতিহাস কখনো মানুষের জয়-পরাজয়ের কথা বিস্মৃত হয় না। হাজার বছর পরে হলেও ইতিহাসের পাতা উল্টিয়ে খুঁজে পাওয়া যায়, ইতিহাস পাল্টে দেওয়ার ইতিহাস। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতারা নিশ্চয় এক স্বৈরাচারকে পরাজিত করে আরেক স্বৈরাচারকে অধিষ্ঠিত করতে চান না। কিন্তু পাঁচ-ছয় মাস বাহাত্তরের সংবিধান মতে শপথ নিয়ে রাষ্ট্রপরিচালনা করে এখন ঘোষণাপত্রের নামে দেশে একটা নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা হলে সাধারণ মানুষ কখনো আর ছাত্র নেতৃত্বের প্রতি বিশ্বাস রেখে ভবিষ্যতের কোনো ফ্যাসিস্টকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পথে নামবে না।