বিশ্বের অনেক শ্রেষ্ঠ নেতার জীবনের শেষ ইচ্ছা অপূর্ণ থেকে গেছে। আমি পাঁচ নেতার নাম উল্লেখ করে কিছুটা আলোচনা করছি। তারা হলেন লেনিন, মাও সেতুং, মহাত্মা গান্ধী, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও শেখ মুজিবুর রহমান। তাদের জীবন ঘটনাবহুল। আমি অতি সংক্ষেপে চুম্বক অংশ হিসেবে অপূর্ণ ইচ্ছার কিছুটা বর্ণনা দিচ্ছি।
ক্যাপিটালিজমের হর্তাকর্তারা এমনভাবে লেলিন, স্টালিন, মাও প্রমুখ বিশ্ব কমিউনিস্ট নেতার চরিত্র বিকৃত করেছেন যে এখন তাদের সম্পর্কে কোনো সঠিক তথ্যই জানা দুরূহ। আমি বিভিন্ন উপায়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে কিছুটা প্রকাশের প্রয়াস পাচ্ছি। একটি সোশ্যালিস্ট রাষ্ট্র হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠার পরই লেলিন বুঝতে পেরেছিলেন, কঠোর তথ্যভিত্তিক প্লোরেতারিয়েত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। প্লোরেতারিয়েতরা (সর্বহারা) চিরকাল গ্লোরেতারিয়েত বা সর্বহারা থাকে না। রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর তারাও শাসক শ্রেণিতে পরিণত হয় এবং তাদেরও চরিত্র বদল হয়। এই চরিত্র বদলের ফলে তারাও যাতে আগের ধনবাদী শাসকদের চরিত্র বৈশিষ্ট্যগুলো অর্জন না করে, সে জন্য তিনি কঠোর সমাজতান্ত্রিক একদলীয় ব্যবস্থার মধ্যেও হিউম্যানিজমের কিছু কিছু ব্যবস্থা রাখার কথা চিন্তা করেছিলেন।
লেনিনের মৃত্যু-পূর্ববর্তী চিন্তা-চেতনায় যে পরিবর্তন এসেছিল, তা তিনি বাস্তবে রূপ দিতে পারেননি। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ক্রমে ক্রমে তিনি অবশ হয়ে পড়েন, তার বাকশক্তিও হ্রাস পায়। তিনি রাষ্ট্র পরিচালনায় অনেক সময় ইঙ্গিতে কাউকে ডিকটেশন দিয়ে তার নির্দেশগুলো দিতেন। লেনিনের অসুস্থতার সময় তার দুই ঘনিষ্ঠ সহকর্মী স্টালিন ও ট্রটস্কির মধ্যে ভীষণ মতবিরোধ দেখা দেয়। স্টালিনই পলিটব্যুরোতে অধিক ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন এবং অঘটন ঘটান। লেনিন মৃত্যুর আগে যা চেয়েছিলেন তা যদি বাস্তবায়িত হতো, তাহলে সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি স্টেট ক্যাপিটালিজম-ভিত্তিক কঠোর একনায়কত্ববাদী রাষ্ট্র হওয়ার বদলে ধীরে ধীরে একধরনের প্লুরালিস্টিক সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে এগোত এবং তার হিউম্যান ফেস বা মানসিক চেহারা হারাত না।
লেনিনের মতো মাও সেতুং সম্ভবত বুঝতে পেরেছিলেন একদলীয় শাসনব্যবস্থা দ্বারা সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখা যাবে না। এই চিন্তা থেকেই তিনি ‘Let hundred flowers blossom’ বা ‘শতফুল ফুটতে দাও’ শীর্ষক তত্ত্বে সমাজতন্ত্রী সমাজে ভিন্নমতের অবস্থানকেও মেনে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, চীনের নতুন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা এখনো মজবুত হয়নি এবং এই ব্যবস্থায় দুর্বলতার ফাঁকে ‘শতফুল ফুটতে দাও’ থিওরির সুযোগ নিয়ে অধিক শক্তিশালী ধনবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত কমিউনিস্ট চীনকে ধ্বংস করতে পারে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে থিওরিটির বাস্তবায়ন বন্ধ করেন।
কিন্তু শেষ জীবনে মাও সেতুং আরেকটি সত্য অনুধাবন করেন। যে কৃষক ও শ্রমিক এবং নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণিকে সংঘবদ্ধ করে তিনি চীনে কমিউনিস্ট বিপ্লব সফল করেছেন, সেই কৃষক-শ্রমিক শ্রেণি বা তাদের প্রতিনিধিরা ক্ষমতায় আসার পর অল্প দিনে শাসক শ্রেণিতে রূপান্তরের ফলে অতীতের শাসকদের শ্রেণিচরিত্র অর্জন করতে শুরু করেছে। তাই মাও কালচারাল রেভলিউশনের পন্থা উদ্ভাবন করেন। এই রেভলিউশন কার্যকর করার ব্যাপারে তার পার্টিতে মতভেদ ছিল। কিন্তু তার স্ত্রী ও তিন ঘনিষ্ঠ অনুসারীর দ্বারা গঠিত ‘গ্যাং অব ফোর’ এই সাংস্কৃতিক বিপ্লবে নেতৃত্ব দেয়। এই বিপ্লবের মূলকথা ছিল কমিউনিস্ট শাসন প্রবর্তিত হওয়ার পরও সমাজ পরিবর্তনের ধারাতে সমাজের প্রতিটি পর্যায়ে প্রতিটি পেশায় এমনকি সরকারের পরিচালকদের মধ্যেও যে এলিট শ্রেণির উদ্ভব ঘটছে এবং পূর্বতন এলিট ও ক্ষমতাসীন শ্রেণির অভ্যাস, চিন্তাধারা, জীবনযাত্রা আভিজাত্যবোধ ফিরে আসছে, তাকে অঙ্কুরেই গুঁড়িয়ে দেওয়া এবং ধনবাদী সমাজের পেশাগত বৈষম্য ও কায়েমি আভিজাত্যবোধ বিলুপ্ত করে সমাজতন্ত্রী সমাজ গড়ার ব্যবস্থাটি যাতে ধনবাদী বিচ্যুতির পথে না গড়ায়, তার শেষ চেষ্টা করা।
বয়স ও বার্ধক্যের জন্য মাও সেতুং তার এই শেষ ইচ্ছা পূর্ণ করে যেতে পারেননি। তার পার্টির নতুন গজিয়ে ওঠা এলিট শ্রেণির বাধাদানের ফলেই কালচারাল রেজলিউশন ব্যর্থ হয় এবং এই বিপ্লবকে এক বিমূর্ত চেহারায় দাঁড় করিয়ে সারা বিশ্বে তাকে নিন্দিত করে তোলা হয়। কালচারাল রেভলিউশনকে পাগলামি, তুঘলকি কাণ্ড, সমাজের সম্মানিত ব্যক্তিদের অবমাননা ও নির্যাতন ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে মার্কিন ক্যাপিটালিস্ট এলিট ক্লাস ও মিডিয়া বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় সৃষ্টি করে। চীনের কমিউনিস্ট এলিট ক্লাসের একটি অংশকেও মাওয়ের মৃত্যুর পর সেই ঝড়ে গা ভাসাতে দেখা গেছে। বাংলাদেশে অনেক পরে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রবর্তিত বাকশাল-পদ্ধতি সম্পর্কে পশ্চিমা জগতে এবং আমাদের নব্য ধনী ও এলিট ক্লাসের কায়েমি স্বার্থভোগী অংশের মধ্যেও একই প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
মাও সেতুংয়ের জীবিতকালেই কালাচারাল রেভলিউশন ব্যর্থ করা হয়। মাওয়ের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী এবং ‘গ্যাং অব ফোরের’ অন্য তিন সদস্যকে গ্রেফতার করে কারাগারে বন্দী করা হয়। চীনে কমিউনিস্ট পার্টি ও সরকারের পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং পুরোনো শ্রেণিকাঠামোয় বিশ্বাসী তথাকথিত এলিট শ্রেণি ক্ষমতা দখল করে। আমেরিকা তাদের সবচাইতে প্রিয় ব্যবসাসঙ্গী হিসেবে ঘোষণা করে, দ্রুত ট্রেড পার্টনারশিপ মিলিটারি পার্টনারশিপে পরিণত হয়। এখন অবশ্য চীন-মার্কিন দ্বন্দ্ব স্বার্থ ও আধিপত্যের, আদর্শের নয়। মাওয়ের শেষ ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি। মাওবাদ-বর্জিত মাওয়ের চীন নতুনভাবে গড়ে উঠেছে।
লেনিন ও মাওয়ের পর বলতে হয় আমাদের উপমহাদেশের তিনজন প্রধান নেতার কথা। তাদের জীবনের শেষ ইচ্ছাও অপূর্ণ থেকে গেছে। শেষ জীবনে তাদেরও চিন্তা-চেতনায় রূপান্তর ঘটেছিল এবং তারা দেশকে নতুনভাবে গড়তে চেয়েছিলেন। তাদের ইচ্ছা সফল হয়নি। তারা মহাত্মা গান্ধী, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও শেখ মুজিবুর রহমান। গান্ধী ও জিন্নাহর শেষ জীবনের ইচ্ছা পূর্ণ না হওয়া নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে, অনেক বই বেরিয়েছে। শেখ মুজিবের মৃত্যু-পূর্ববর্তী শেষ জীবনের ইচ্ছা এবং তা পূর্ণ না হওয়া সম্পর্কে এখনো তেমন কোনো আলোচনা হয়নি। সম্ভবত কোনো বই বের হয়নি। মহাত্মা গান্ধী মাল্টি রিলিজিয়ান ইন্ডিয়ান সমাজব্যবস্থা গঠনে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই রাজনৈতিক স্লোগান হিসেবে বন্দেমাতরমের পাশাপাশি আল্লাহু আকবর গ্রহণ করেছিলেন এবং ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে মুসলমানদের খেলাফত আন্দোলনকে যুক্ত করেছিলেন এবং তাতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহও ছিলেন আধুনিকমনা ও সেক্যুলার। এটাই ছিল তার সবচাইতে বড় বৈশিষ্ট্য। প্রথম দিকে গান্ধীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কংগ্রেসেই রাজনীতি করতেন। কংগ্রেসে গান্ধীর পরেই ছিল জিন্নাহর স্থান। এদিকে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু বিলাতে উচ্চশিক্ষা শেষে ভারতে ফিরে আসেন। তখন তিনি আধুনিক ও সোশ্যালিস্ট। ভারতের সোশ্যালিস্টরা (জয়প্রকাশ নারায়ণসহ) আশা করছিলেন, নেহরু তাদের সোশ্যালিস্ট পার্টি গঠনে প্রচেষ্টায় যোগ দেবেন। কিন্তু নেহরু তাদের সেই আশা উপেক্ষা করে গান্ধী আশ্রমে গিয়ে গান্ধীভক্ত হয়ে যান। গান্ধীও তাকে স্বাগত জানান। জিন্নাহ তখন কংগ্রেসে একজন প্রভাবশালী নেতা। কংগ্রেসে গান্ধীর পরেই নেহরুর সর্বেসর্বা হয়ে ওঠার পথে প্রতিবন্ধক ছিলেন জিন্নাহ। নেহরু প্রথমে জিন্নাহবিরোধী পরে জিন্নাহবিদ্বেষী হলেন এবং শুরু নেহরু-জিন্নাহ ঘোরতর বিরোধ। কংগ্রেস রাজনীতিতে নেহরু কোটারি দ্বারা বারবার অপমানিত ও উপেক্ষিত হয়ে জিন্নাহ ধীরে ধীরে মুসলিম লীগের দিকে ঝোঁকেন এবং পরে নেতৃত্বহারা মুসলিম লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।
ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগের ঘোরবিরোধী ছিলেন মহাত্মা গান্ধী। এই দেশভাগ বন্ধ করার জন্য তিনি মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে স্বাধীন অখণ্ড ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। নেহরুর তীব্র বিরোধিতায় এই প্রস্তাব তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে কংগ্রেসে তুলতে পারেননি।
গান্ধী তার নিজের হাতে গড়া নেহরু সরকারের দ্বারা উপেক্ষিত হবেন এবং তার শেষ জীবনে রাজনৈতিক ইচ্ছা পূর্ণ হবে নাÑএটা হয়তো আগে বুঝতে পারেননি। ফলে ঘাতক নাথুরাম গডসের গুলির আঘাতে রক্তাক্ত বক্ষ চেপে ধরে যে ‘হা রাম’ উচ্চারণ করেছেন, তা শুধু গুলি লাগার ব্যথা ছিল নাÑসম্ভবত ছিল তার শেষ জীবনের ইচ্ছা পূরণ না হওয়ার দুঃখ প্রকাশও।
ইতিহাসের সত্য বেশি দিন গোপন থাকে না। এখন বহু ভারতীয় ইতিহাসবিদের গবেষণায় বেরিয়ে আসছে, ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগের জন্য জিন্নাহকে যতটা দায়ী করা হয়, তার চাইতে অনেক বেশি দায়ী নেহরু। ভারত ভাগের বদলে ব্রিটিশ কেবিনেট মিশনের এবিসি জোনে ভারতকে বিভক্ত করে একই শিথিল ফেডারেল রাষ্ট্রব্যবস্থার অধীনে রাখার যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, জিন্নাহ তা মেনে নিয়েছিলেন কিন্তু নেহরু তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। পরবর্তীকালে নেহরু স্বীকার করেছেন, কেবিনেট মিশনের এবিসি পরিকল্পনা গ্রহণ না করা ছিল তার জীবনের সবচাইতে বড় ভুল।
আমাদের উপমহাদেশের তিন মহানায়ক গান্ধী, জিন্নাহ ও শেখ মুজিব নিজেদের একাধিক বিশ্বস্ত সহকর্মী দ্বারা বাধাগ্রস্ত এবং প্রতারিত হওয়ার কারণে তাদের জীবনের শেষ ইচ্ছা পূরণ করে যেতে পারেননি। শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ছিল দেশকে জনগণের সহযোগিতায় স্বাধীন করে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে উন্নতির শিখরে আরোহণ করিয়ে সোনার বাংলায় রূপদান করা। প্রথম কাজটি অর্থাৎ দেশকে স্বাধীন করা হয়েছে, কিন্তু দ্বিতীয় কাজটি অর্থাৎ অর্থনৈতিক উন্নয়নের কাজটি সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। তার শাসনকালের সাড়ে তিন বছরের মাথায় কিছু রাজনীতিকের ষড়যন্ত্র এবং বঞ্চনায় ক্ষুব্ধ কতিপয় সেনাসদস্য কর্তৃক তিনি নৃশংসভাবে নিহত হন। শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যাপারে কিছুটা ভিন্নতাও রয়েছে। স্বাধীনতার পূর্বে সংগ্রামী শেখ মুজিব এবং স্বাধীনতার পরে শাসক শেখ মুজিবের মধ্যে তফাত ছিল। অনেকে মনে করেন, তিনি বাকশাল গঠন করেছিলেন একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। তবে এ ব্যাপারে অন্য মতও রয়েছে। তাই বাকশাল প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য রহস্যাবৃত। বাকশাল বাস্তবায়নের পূর্বেই শেখ মুজিব নিহত হন। তিনি যদি জীবিত থাকতেন, তাহলে বাকশাল গঠনের প্রকৃত উদ্দেশ্য উন্মোচিত হতো।
পরিসমাপ্তিতে বলতে চাই, গান্ধী, জিন্নাহ ও শেখ মুজিব যদি তাদের জীবনের শেষ রাজনৈতিক ইচ্ছা পূর্ণ করে যেতে পারতেন, তাহলে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান তথা গোটা উপমহাদেশের হয়তো অন্য কোনো রূপ একটা পরিবর্তন হতো।
লেখক : ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, একুশে পদকপ্রাপ্ত ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদকপ্রাপ্ত, রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ও কলামিস্ট। বাফেলো, নিউইয়র্ক।
ক্যাপিটালিজমের হর্তাকর্তারা এমনভাবে লেলিন, স্টালিন, মাও প্রমুখ বিশ্ব কমিউনিস্ট নেতার চরিত্র বিকৃত করেছেন যে এখন তাদের সম্পর্কে কোনো সঠিক তথ্যই জানা দুরূহ। আমি বিভিন্ন উপায়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে কিছুটা প্রকাশের প্রয়াস পাচ্ছি। একটি সোশ্যালিস্ট রাষ্ট্র হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠার পরই লেলিন বুঝতে পেরেছিলেন, কঠোর তথ্যভিত্তিক প্লোরেতারিয়েত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। প্লোরেতারিয়েতরা (সর্বহারা) চিরকাল গ্লোরেতারিয়েত বা সর্বহারা থাকে না। রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর তারাও শাসক শ্রেণিতে পরিণত হয় এবং তাদেরও চরিত্র বদল হয়। এই চরিত্র বদলের ফলে তারাও যাতে আগের ধনবাদী শাসকদের চরিত্র বৈশিষ্ট্যগুলো অর্জন না করে, সে জন্য তিনি কঠোর সমাজতান্ত্রিক একদলীয় ব্যবস্থার মধ্যেও হিউম্যানিজমের কিছু কিছু ব্যবস্থা রাখার কথা চিন্তা করেছিলেন।
লেনিনের মৃত্যু-পূর্ববর্তী চিন্তা-চেতনায় যে পরিবর্তন এসেছিল, তা তিনি বাস্তবে রূপ দিতে পারেননি। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ক্রমে ক্রমে তিনি অবশ হয়ে পড়েন, তার বাকশক্তিও হ্রাস পায়। তিনি রাষ্ট্র পরিচালনায় অনেক সময় ইঙ্গিতে কাউকে ডিকটেশন দিয়ে তার নির্দেশগুলো দিতেন। লেনিনের অসুস্থতার সময় তার দুই ঘনিষ্ঠ সহকর্মী স্টালিন ও ট্রটস্কির মধ্যে ভীষণ মতবিরোধ দেখা দেয়। স্টালিনই পলিটব্যুরোতে অধিক ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন এবং অঘটন ঘটান। লেনিন মৃত্যুর আগে যা চেয়েছিলেন তা যদি বাস্তবায়িত হতো, তাহলে সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি স্টেট ক্যাপিটালিজম-ভিত্তিক কঠোর একনায়কত্ববাদী রাষ্ট্র হওয়ার বদলে ধীরে ধীরে একধরনের প্লুরালিস্টিক সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে এগোত এবং তার হিউম্যান ফেস বা মানসিক চেহারা হারাত না।
লেনিনের মতো মাও সেতুং সম্ভবত বুঝতে পেরেছিলেন একদলীয় শাসনব্যবস্থা দ্বারা সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখা যাবে না। এই চিন্তা থেকেই তিনি ‘Let hundred flowers blossom’ বা ‘শতফুল ফুটতে দাও’ শীর্ষক তত্ত্বে সমাজতন্ত্রী সমাজে ভিন্নমতের অবস্থানকেও মেনে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, চীনের নতুন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা এখনো মজবুত হয়নি এবং এই ব্যবস্থায় দুর্বলতার ফাঁকে ‘শতফুল ফুটতে দাও’ থিওরির সুযোগ নিয়ে অধিক শক্তিশালী ধনবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত কমিউনিস্ট চীনকে ধ্বংস করতে পারে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে থিওরিটির বাস্তবায়ন বন্ধ করেন।
কিন্তু শেষ জীবনে মাও সেতুং আরেকটি সত্য অনুধাবন করেন। যে কৃষক ও শ্রমিক এবং নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণিকে সংঘবদ্ধ করে তিনি চীনে কমিউনিস্ট বিপ্লব সফল করেছেন, সেই কৃষক-শ্রমিক শ্রেণি বা তাদের প্রতিনিধিরা ক্ষমতায় আসার পর অল্প দিনে শাসক শ্রেণিতে রূপান্তরের ফলে অতীতের শাসকদের শ্রেণিচরিত্র অর্জন করতে শুরু করেছে। তাই মাও কালচারাল রেভলিউশনের পন্থা উদ্ভাবন করেন। এই রেভলিউশন কার্যকর করার ব্যাপারে তার পার্টিতে মতভেদ ছিল। কিন্তু তার স্ত্রী ও তিন ঘনিষ্ঠ অনুসারীর দ্বারা গঠিত ‘গ্যাং অব ফোর’ এই সাংস্কৃতিক বিপ্লবে নেতৃত্ব দেয়। এই বিপ্লবের মূলকথা ছিল কমিউনিস্ট শাসন প্রবর্তিত হওয়ার পরও সমাজ পরিবর্তনের ধারাতে সমাজের প্রতিটি পর্যায়ে প্রতিটি পেশায় এমনকি সরকারের পরিচালকদের মধ্যেও যে এলিট শ্রেণির উদ্ভব ঘটছে এবং পূর্বতন এলিট ও ক্ষমতাসীন শ্রেণির অভ্যাস, চিন্তাধারা, জীবনযাত্রা আভিজাত্যবোধ ফিরে আসছে, তাকে অঙ্কুরেই গুঁড়িয়ে দেওয়া এবং ধনবাদী সমাজের পেশাগত বৈষম্য ও কায়েমি আভিজাত্যবোধ বিলুপ্ত করে সমাজতন্ত্রী সমাজ গড়ার ব্যবস্থাটি যাতে ধনবাদী বিচ্যুতির পথে না গড়ায়, তার শেষ চেষ্টা করা।
বয়স ও বার্ধক্যের জন্য মাও সেতুং তার এই শেষ ইচ্ছা পূর্ণ করে যেতে পারেননি। তার পার্টির নতুন গজিয়ে ওঠা এলিট শ্রেণির বাধাদানের ফলেই কালচারাল রেজলিউশন ব্যর্থ হয় এবং এই বিপ্লবকে এক বিমূর্ত চেহারায় দাঁড় করিয়ে সারা বিশ্বে তাকে নিন্দিত করে তোলা হয়। কালচারাল রেভলিউশনকে পাগলামি, তুঘলকি কাণ্ড, সমাজের সম্মানিত ব্যক্তিদের অবমাননা ও নির্যাতন ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে মার্কিন ক্যাপিটালিস্ট এলিট ক্লাস ও মিডিয়া বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় সৃষ্টি করে। চীনের কমিউনিস্ট এলিট ক্লাসের একটি অংশকেও মাওয়ের মৃত্যুর পর সেই ঝড়ে গা ভাসাতে দেখা গেছে। বাংলাদেশে অনেক পরে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রবর্তিত বাকশাল-পদ্ধতি সম্পর্কে পশ্চিমা জগতে এবং আমাদের নব্য ধনী ও এলিট ক্লাসের কায়েমি স্বার্থভোগী অংশের মধ্যেও একই প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
মাও সেতুংয়ের জীবিতকালেই কালাচারাল রেভলিউশন ব্যর্থ করা হয়। মাওয়ের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী এবং ‘গ্যাং অব ফোরের’ অন্য তিন সদস্যকে গ্রেফতার করে কারাগারে বন্দী করা হয়। চীনে কমিউনিস্ট পার্টি ও সরকারের পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং পুরোনো শ্রেণিকাঠামোয় বিশ্বাসী তথাকথিত এলিট শ্রেণি ক্ষমতা দখল করে। আমেরিকা তাদের সবচাইতে প্রিয় ব্যবসাসঙ্গী হিসেবে ঘোষণা করে, দ্রুত ট্রেড পার্টনারশিপ মিলিটারি পার্টনারশিপে পরিণত হয়। এখন অবশ্য চীন-মার্কিন দ্বন্দ্ব স্বার্থ ও আধিপত্যের, আদর্শের নয়। মাওয়ের শেষ ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি। মাওবাদ-বর্জিত মাওয়ের চীন নতুনভাবে গড়ে উঠেছে।
লেনিন ও মাওয়ের পর বলতে হয় আমাদের উপমহাদেশের তিনজন প্রধান নেতার কথা। তাদের জীবনের শেষ ইচ্ছাও অপূর্ণ থেকে গেছে। শেষ জীবনে তাদেরও চিন্তা-চেতনায় রূপান্তর ঘটেছিল এবং তারা দেশকে নতুনভাবে গড়তে চেয়েছিলেন। তাদের ইচ্ছা সফল হয়নি। তারা মহাত্মা গান্ধী, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও শেখ মুজিবুর রহমান। গান্ধী ও জিন্নাহর শেষ জীবনের ইচ্ছা পূর্ণ না হওয়া নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে, অনেক বই বেরিয়েছে। শেখ মুজিবের মৃত্যু-পূর্ববর্তী শেষ জীবনের ইচ্ছা এবং তা পূর্ণ না হওয়া সম্পর্কে এখনো তেমন কোনো আলোচনা হয়নি। সম্ভবত কোনো বই বের হয়নি। মহাত্মা গান্ধী মাল্টি রিলিজিয়ান ইন্ডিয়ান সমাজব্যবস্থা গঠনে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই রাজনৈতিক স্লোগান হিসেবে বন্দেমাতরমের পাশাপাশি আল্লাহু আকবর গ্রহণ করেছিলেন এবং ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে মুসলমানদের খেলাফত আন্দোলনকে যুক্ত করেছিলেন এবং তাতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহও ছিলেন আধুনিকমনা ও সেক্যুলার। এটাই ছিল তার সবচাইতে বড় বৈশিষ্ট্য। প্রথম দিকে গান্ধীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কংগ্রেসেই রাজনীতি করতেন। কংগ্রেসে গান্ধীর পরেই ছিল জিন্নাহর স্থান। এদিকে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু বিলাতে উচ্চশিক্ষা শেষে ভারতে ফিরে আসেন। তখন তিনি আধুনিক ও সোশ্যালিস্ট। ভারতের সোশ্যালিস্টরা (জয়প্রকাশ নারায়ণসহ) আশা করছিলেন, নেহরু তাদের সোশ্যালিস্ট পার্টি গঠনে প্রচেষ্টায় যোগ দেবেন। কিন্তু নেহরু তাদের সেই আশা উপেক্ষা করে গান্ধী আশ্রমে গিয়ে গান্ধীভক্ত হয়ে যান। গান্ধীও তাকে স্বাগত জানান। জিন্নাহ তখন কংগ্রেসে একজন প্রভাবশালী নেতা। কংগ্রেসে গান্ধীর পরেই নেহরুর সর্বেসর্বা হয়ে ওঠার পথে প্রতিবন্ধক ছিলেন জিন্নাহ। নেহরু প্রথমে জিন্নাহবিরোধী পরে জিন্নাহবিদ্বেষী হলেন এবং শুরু নেহরু-জিন্নাহ ঘোরতর বিরোধ। কংগ্রেস রাজনীতিতে নেহরু কোটারি দ্বারা বারবার অপমানিত ও উপেক্ষিত হয়ে জিন্নাহ ধীরে ধীরে মুসলিম লীগের দিকে ঝোঁকেন এবং পরে নেতৃত্বহারা মুসলিম লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।
ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগের ঘোরবিরোধী ছিলেন মহাত্মা গান্ধী। এই দেশভাগ বন্ধ করার জন্য তিনি মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে স্বাধীন অখণ্ড ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। নেহরুর তীব্র বিরোধিতায় এই প্রস্তাব তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে কংগ্রেসে তুলতে পারেননি।
গান্ধী তার নিজের হাতে গড়া নেহরু সরকারের দ্বারা উপেক্ষিত হবেন এবং তার শেষ জীবনে রাজনৈতিক ইচ্ছা পূর্ণ হবে নাÑএটা হয়তো আগে বুঝতে পারেননি। ফলে ঘাতক নাথুরাম গডসের গুলির আঘাতে রক্তাক্ত বক্ষ চেপে ধরে যে ‘হা রাম’ উচ্চারণ করেছেন, তা শুধু গুলি লাগার ব্যথা ছিল নাÑসম্ভবত ছিল তার শেষ জীবনের ইচ্ছা পূরণ না হওয়ার দুঃখ প্রকাশও।
ইতিহাসের সত্য বেশি দিন গোপন থাকে না। এখন বহু ভারতীয় ইতিহাসবিদের গবেষণায় বেরিয়ে আসছে, ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগের জন্য জিন্নাহকে যতটা দায়ী করা হয়, তার চাইতে অনেক বেশি দায়ী নেহরু। ভারত ভাগের বদলে ব্রিটিশ কেবিনেট মিশনের এবিসি জোনে ভারতকে বিভক্ত করে একই শিথিল ফেডারেল রাষ্ট্রব্যবস্থার অধীনে রাখার যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, জিন্নাহ তা মেনে নিয়েছিলেন কিন্তু নেহরু তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। পরবর্তীকালে নেহরু স্বীকার করেছেন, কেবিনেট মিশনের এবিসি পরিকল্পনা গ্রহণ না করা ছিল তার জীবনের সবচাইতে বড় ভুল।
আমাদের উপমহাদেশের তিন মহানায়ক গান্ধী, জিন্নাহ ও শেখ মুজিব নিজেদের একাধিক বিশ্বস্ত সহকর্মী দ্বারা বাধাগ্রস্ত এবং প্রতারিত হওয়ার কারণে তাদের জীবনের শেষ ইচ্ছা পূরণ করে যেতে পারেননি। শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ছিল দেশকে জনগণের সহযোগিতায় স্বাধীন করে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে উন্নতির শিখরে আরোহণ করিয়ে সোনার বাংলায় রূপদান করা। প্রথম কাজটি অর্থাৎ দেশকে স্বাধীন করা হয়েছে, কিন্তু দ্বিতীয় কাজটি অর্থাৎ অর্থনৈতিক উন্নয়নের কাজটি সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। তার শাসনকালের সাড়ে তিন বছরের মাথায় কিছু রাজনীতিকের ষড়যন্ত্র এবং বঞ্চনায় ক্ষুব্ধ কতিপয় সেনাসদস্য কর্তৃক তিনি নৃশংসভাবে নিহত হন। শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যাপারে কিছুটা ভিন্নতাও রয়েছে। স্বাধীনতার পূর্বে সংগ্রামী শেখ মুজিব এবং স্বাধীনতার পরে শাসক শেখ মুজিবের মধ্যে তফাত ছিল। অনেকে মনে করেন, তিনি বাকশাল গঠন করেছিলেন একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। তবে এ ব্যাপারে অন্য মতও রয়েছে। তাই বাকশাল প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য রহস্যাবৃত। বাকশাল বাস্তবায়নের পূর্বেই শেখ মুজিব নিহত হন। তিনি যদি জীবিত থাকতেন, তাহলে বাকশাল গঠনের প্রকৃত উদ্দেশ্য উন্মোচিত হতো।
পরিসমাপ্তিতে বলতে চাই, গান্ধী, জিন্নাহ ও শেখ মুজিব যদি তাদের জীবনের শেষ রাজনৈতিক ইচ্ছা পূর্ণ করে যেতে পারতেন, তাহলে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান তথা গোটা উপমহাদেশের হয়তো অন্য কোনো রূপ একটা পরিবর্তন হতো।
লেখক : ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, একুশে পদকপ্রাপ্ত ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদকপ্রাপ্ত, রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ও কলামিস্ট। বাফেলো, নিউইয়র্ক।