
স্নেহের আনোয়ার,
আমার চিঠি পেয়ে খুব একটা অবাক হয়ো না যেন। আমাকে চিনতে পারছ না মনে হয়! আমি তোমার প্রতিবেশী আন্টি। আমি তোমার ছোট্ট ঘরের পাশেই যে পুরোনো ঘরখানা আছে, তার ভেতরেই শুয়ে আছি দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে। আগাছায় জড়িয়ে দেয়ালখানা বিবর্ণ হয়ে গেছে কতটা কাল! সে বোধ হয় আমিও জানি না। তুমিও হয়তো খেয়াল করোনি কখনো। তবে আমি কিন্তু দেখেছি তোমায়। তুমি যেদিন এলে সেদিনই দেখেছি তোমায়, তোমার ঘরখানা একেবারেই নতুন। এখনো সোঁদা মাটির গন্ধ পাই! কত যে মানুষ এসেছিল তোমার সাথে তোমার ঘরে তোমাকে পৌঁছে দিতে। সুগন্ধি আতরে আগরবাতির ঘ্রাণে আমি বুঝতে পারলাম কেউ এল পাশের খালি জায়গায় বাড়ি করে! কিন্তু এত অসম বয়সী প্রতিবেশী শুনে বুকের ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে উঠেছিল। আমার মৃত মনটা বুঝে গেল, নিশ্চয় মা, বাবা, স্ত্রীর সাথে অভিমান করে এসেছ। ব্যাপারটা আমার একদম ভালো লাগেনি, বাজান! তোমাদের রাগ, অভিমান থাকতে কি আছে বলো? তোমরা হলে দেশের ভবিষ্যৎ, প্রকল্প থেকে বের করে আনবে সফেদ বিস্ময় অনুপ্রেরণা।
তোমার ছবি দেখেছি আমার মেয়ের কাছে। তাই তোমাকে চিনতে অসুবিধে হয়নি একবিন্দুও জানো তো! আমি সাদামাটা প্রাণোচ্ছল হাসিখুশি একজন ছেলেকে চিনি। অথচ এখন চিনতেও কষ্ট হচ্ছে। কষ্টের নীল এক ছায়া তোমার নিঃসর্গ অবয়বে। আমি তোমার মায়ের মতোই। খালাম্মা ডেকো নির্দ্বিধায়। তোমার বয়সী আমার ছেলেমেয়ে। ওদের সাথে তোমার বেশ ভাব, সে আমি জানি, বাবা। এখন বলো তো, তুমি কেন এখানে এতটা দূরে নির্জনতা বেছে নিলে? থাকতে পারবে তো এক বিশাল পৃথিবীকে পিছনে ফেলে। জানো তো, এখানে কিন্তু ইন্টারনেট, টেলিভিশন, টেলিফোন, পত্রিকা, কাগজ-কলম কিচ্ছুটি নেই। তুমি প্রাণপণে চাইলেও কেউ আসবে না তোমাকে দেখতে! সবাই ব্যস্ত যার যার জীবনের প্রয়োজনে, সুখ আরাম আয়েশ রেখে। এ জায়গাটা শহর থেকে বহুদূরের পথ। এত্ত ট্রাফিক, এতটা ব্যস্ত জীবন রেখে কে আসবে এই গ্রামের জংলি মেঠোপথের শেষ মাথায় এই মাটির তৈরি ঘরে?
সে যা-ই হোক বাবা, এখন তো আর একা লাগবে না আমার! কথাটা বললাম খুব স্বার্থপরের মতো, তাই না? দুঃখজনক হলেও সত্যি, এখন তো আমরা দুজনই প্রতিবেশী হিসেবে আছি! তা তোমার ঘরে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেছ? ভয় লাগে না তো আবার? লাগলে বলো আমার পরিচিত একজন মৌলভি আছে, আমি না হয় বলে দেব তোমাকে কিছু আলো দেবে! আমি কিন্তু বাবা কুপির আলো-আঁধারিতে আছি। চোখেও ছানি পড়েছে। কিছুই দেখতে পাই না ঠিকমতো। দরজা-জানালার যা অবস্থা! একবিন্দু আলো আসে না, বড় হাঁসফাঁস লাগে আমার। একটু বিশুদ্ধ বাতাসের জন্য বাবা! আমাকে এই ঘরে পৌঁছে দিয়ে কাঠের, বাঁশের খুঁটি দিয়ে দরজায় খিল তুলে দিল সারা জীবনের জন্য, যাতে আর ফিরে যেতে না পারি কাচের ঘেরা চার দেয়ালের সেই জেলখানায়। বড় খিদা পায় বাজান। একমুঠ ভাতের কষ্ট আমি জানি।
তোমার কি ভাবনা জীবনের সংজ্ঞা নিয়ে? কেন এই বেহাল অবস্থা তোমার? তোমার চেহারার অবয়ব বুঝতে পারি, কিন্তু স্পষ্ট করে দেখি না। তার পরও তোমার কণ্ঠে যেন কান্নার অনুরণ চুইয়ে পড়ছে! নাকি ভুল বকছি? কিসের এত কষ্ট তোমার? কিসের এত দুঃখ? মাকে জানিয়েছ কখনো? ভাইবোনের সাথে, বন্ধুদের সাথে? অবশ্য বলেও হয়তো কোনো সমাধান হয়নি বলেই তো তুমি চলে এসেছ এখানে।
আমার কথা জানতে চাইছ? কী আর শুনবে বলো! কত যে কষ্টের গল্পের বক্স বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছি লোকলজ্জার ভয়ে! তা ছাড়া আমার তো তোমাকে বলতেও ভীষণ লজ্জা লাগছে। কেন এখানে এত কষ্ট করছি?
কী করার ছিল বলো আমার? বাবা-মায়ের অমতেই বিয়ে করেছিলাম তোমার খালুকে।
ভাবছ তোমার খালাম্মা প্রেমে পড়েছিল!
না বাবা, ঠিক প্রেম বলা যাবে না এটাকে।
এটা উঠতি বয়সের মোহ ছিল, তা ছাড়া তোমার খালু হুমায়ূন আহমেদের মতো সুন্দর গুছিয়ে, বুঝিয়ে আমায় কনভিন্স করেছিল। ওনার মুদির দোকান থেকে এটা-ওটা আনতে পাঠাত আমার সৎমা। চুড়ি, ফিতা, শ্যাম্পু, আলতা, স্নো, পাউডার সবকিছু তার দোকান থেকেই কিনতে যেতাম। ওভাবেই পরিচয় হয় আমাদের। আরেকটা ব্যাপারও ছিল, সৎমায়ের ঘরে বড় হয়েছি। লেখাপড়ার সুযোগ পাইনি। পেটভরে ভাত খেতে দেয়নি। সাহস করে ভাতের পাতিলে হাত দিতে পারিনি আরেক মুঠো ভাতের জন্য। খুব অকথ্য ভাষায় গালাগালি করত সৎমা। চরিত্রে কলঙ্ক দিয়েছে বহুবার। বছরে একজোড়া সুতির শাড়ি বাবা কিনে দিত। তাতেও চুলের মুঠি ধরে দু-চার ঘা লাগিয়ে দিত যখন-তখন।
যন্ত্রণার শেষ পর্যায়ে আমার স্কুলশিক্ষক আট সন্তানের কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা আমার বিয়ের ব্যবস্থা করলেন অনিচ্ছাকৃতভাবে। পাত্র আমার চেয়ে বারো বছরের বড়। বিএ পরীক্ষায় অকৃতকার্য এক মুদি দোকানদার।
জানি না তোমাকে আজ কেন এত কথা বলছি! গত ২৮ বছর আমি এই নির্জন ঘরে সম্পূর্ণ একারে বাবা। বৃদ্ধা হয়ে গেছি, চোখে দেখি না, শরীরে শক্তি নেই। কাউকেই ঠিকমতো চিনতেও পারি না।
কিন্তু তুমি কেন এখানে? বাচ্চামানুষ তুমি। শুনেছি তোমার খুব মায়াবী সুন্দর বউ আছে! দুটো চাঁদের টুকরা আছে? তোমাকে আসতে দিল ওরা? একা থাকতে পারবে ওদের ছেড়ে? মন খারাপ করছে না?
আমার কথা আর কী শুনবে, বাবা! আমি এখানে এসেছি স্বামী নিগৃহীতা হয়ে। প্রতিদিন লাত্থি, ঝাঁটা খেয়েও সংসার আঁকড়ে ধরে রাখতে চেয়েছি। কিন্তু রাস্তার কুকুরটাও বোধ হয় কিছুটা বিশ্রাম পায়, আমার কোনো বিশ্রাম নেই, খাবার নেই, কথায় কথায় বাবার দুই বিয়ে নিয়ে খোঁটা আর গরিব বলে তাচ্ছিল্য ছিল নিত্যদিনের নিয়ম। আমার শ্বশুরের একটা ওয়ার্কশপের খান্দানি ব্যবসা ছিল। আমাদের ছোট মফস্বল শহরের রিকশা, সাইকেল, মোটরের যাবতীয় কাজ শ্যামলী ওয়ার্কশপে হতো। আমার দেবর ওয়ার্কশপে সাহায্য করত।
আমার স্বামী মুদিখানা একাই চালাতেন। মোটামুটি চলছিল সংসার। কিন্তু কিছু বন্ধুবান্ধবের পাল্লায় পড়ে বিপথে যাওয়া শুরু করল আমার বিয়ের তিন মাসের মাথায়। কিছু জিজ্ঞেস করলে চিৎকার-চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুলত। তারপর একদিন গায়ে হাত তোলা শুরু হলো। সারা দিন সংসার নিয়ে ব্যস্ততা আর রাতে শারীরিক-মানসিক অত্যাচার। অশালীন ব্যবহার নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে গেল ধীরে ধীরে। ঘরে টাকা দিতে পারে না বলে শাশুড়ি বললেন, ‘তোমার স্বামীকে বলবা টাহা-পয়সা না দিলে একবিন্দু জায়গা হ্যারে দিমু না। সবাই উন্নতি করে কিন্তু হ্যায় উন্নতির মুখ দেখতে পায় না! দেখবে কীভাবে বলো? সন্ধ্যা হলেই জুয়ার আড্ডায় চলে যেত। রাত এগারোটা পরেই মনে হতো বাড়ি ফেরা দরকার। আমি গর্ভাবস্থায়ও পৌষের প্রচণ্ড শীতে অপেক্ষায় থেকেছি কখন ঘরে ফিরবে! কত রাত যে ঘরে ফেরেনি, তার ইয়ত্তা নেই। আর রাস্তার নারী নিয়ে যাচ্ছেতাই করেছে। কখনো একদম জোর করেই আমাকে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দিত। আমি বাবার বাড়ি গেলে ব্যবসায়িক বন্ধুদের নিয়ে আসত বাসায়, সাথে কেরুর বোতল আর পতিতা। তোমাকে এসব বলতেও লজ্জা লাগছে, বাবা। কাজের মেয়েও বাদ দেয়নি। এসব নিয়ে কী বলব তোমায়! প্রতিবাদ করলেই মারধর। না থাকতে পেরেছি এই সংসারে শান্তিতে, না যেতে পেরেছি অসহায় অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক বাবার ঘরে।
আট-দশ দিন পরপর বিভিন্ন বাহানায় বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দিত। এভাবেই দুই বাচ্চার মা হয়ে গেলাম একসময়। এদিকে ভাশুরের কুনজরে পড়ে গেলাম। স্বামীর অবর্তমানে দরজায় টোকা দিত, ওনার যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে ননদ ও নানিশাশুড়িকে জানালাম। তারা উল্টো আমাকেই দায়ী করলেন। সব দোষ আমার রূপের। তারা আমাকে ঘোমটা করতে বললেন। ঘোমটা দিয়ে শাড়ি পরা তখনো আয়ত্ত করতে পারিনি। একমাত্র বিবাহিত ননদ তিন সন্তান ও স্বামী নিয়ে এ বাড়িতেই থাকতেন। তিনি ছিলেন এ বাড়ির প্রধানমন্ত্রী। এখানেও পেটের জ্বালায় মরেছি প্রতিদিন। বাচ্চাদের তোলা দুধের টাকাও আমার বাবা তিন মাইল রাস্তা পায়ে হেঁটে এসে লুকিয়ে দিয়ে গেছেন।
পাঁচ, দশ, চার আনা, আট আনা জমিয়ে রাখতাম হাঁসমার্কা নারিকেল তেলের ডিব্বার মধ্যে। যখন চিনি থাকত না, তখন আড়াই টাকা দিয়ে একশ গ্রাম চিনি আনতাম পাশের বাসার মেসের ছাত্রদের দিয়ে। আমার ননদ, শাশুড়ি ফ্রিজে তালা মেরে রাখত। ডিম পর্যন্ত গুনে রাখত, যাতে আমি না খাই। স্টোর রুমেও তালা দিয়ে কাজের মেয়ের কাছে দুটোরই চাবি দিয়ে বাইরে যেত শাশুড়ি-ননদ।
আমার বাবা আমাকে কিছু দিতে পারেননি বিয়েতে। আসলে সে ক্ষমতাও ছিল না বাবার। আমরা চার বোন। যে বাবার একই বয়সী পিঠাপিঠি চারটা মেয়ে থাকে, তার অবস্থাটা একবার ভাবো! বাবার নাভিশ্বাস প্রায়। আমার বাবা অনেক কষ্টে একশ বরযাত্রীর আপ্যায়ন করেন। জামাইকে স্যুটের কাপড় আর তিন আনার একটি আংটি দিয়েছিলেন। সেসব কথা বলে অপমান, অপদস্ত করতে কেউ কম করেনি। একমাত্র শ্বশুর সাহেব কিছু বলেননি কখনো।
আমার জীবনের কথা কী বলব তোমায়! প্রতিদিনই তালাকের হুমকি দেয় আমার স্বামী। মারধরের পর কোরআন শরিফ মাথায় চেপে ধরে শপথ করায়, ‘আমার মা লাইত্থাবে, উষ্ঠা দিবে, আমি মাগিবাজি করব, মদ খাব, জুয়া খেলব, ঘরে ইচ্ছে হলে আসব, না হলে আসব না, কোনো খরচ তোকে দিব না, থাকতে পারলে থাকবি নইলে এক্ষুনি তালাক দেব।’ আমি কেবল কেঁদেই যাচ্ছি। অসহায় আমি হাতে-পায়ে ধরি, যাতে তালাক না দেয়। আসলে আমি আমার স্বামীর মনমতো হইনি। বয়সের বিস্তর ব্যবধান, তার নেশাগুলো আগেই ছিল! আমার শাশুড়ির ইচ্ছে ছিল আপন বোনের মেয়েকে বিয়ে করাবে, বোনের জামাই প্রথম শ্রেণির কন্ট্রাক্টর। অনেক টাকা-পয়সা। দুই ছেলেমেয়ে। আমি তো সেখানে অবাঞ্ছিত। জানো! বিয়ের পরদিন ভোরে মুখ ধুয়ে বিয়েতে দেওয়া আয়নায় মুখ দেখতে গিয়ে দেখি দেখতে পারছি না কিছুই। হাতের গামছা দিয়ে ঘষে চেষ্টা করলাম, যাতে পরিষ্কার হয়, হাত ভরে গেল শিষ কলমের আঠালো কালিতে। আমি হতবাক, কিংকর্তব্যবিমূঢ়! আমি কাউকে জিজ্ঞেস করতেও সাহস পেলাম না। এভাবেই ব্যবহার করলাম এক বছর ধরে। একদিন আমার একজন চাচিকে বললাম। উনি খুব রাগ করে বললেন, এক্ষুনি বাসায় যা, আয়নাটা ফেলে দে। ওই আয়নায় কুফরি করেছে তোর শ্বশুরবাড়ির কেউ। আমি বিয়াল্লিশ বছর সংসারে থেকেও একবিন্দু শান্তি, সুখ পাইনি।
অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে একদিন ঘর থেকে দৌড়ে বের হয়ে গেট পেরিয়ে বাবার বাসায় যাওয়ার জন্য প্রাণপণে দৌড় দিলাম। বাচ্চাদের রেখেই। সারা পাড়ায় হইচই পড়ে গেল। রাস্তার আশপাশের দোকানের সবাই ঠেকাতে চেষ্টা করল। আমি চিৎকার করে কাঁদছি আর মায়ের কাছে যাব বলে মিনতি করছি একটা রিকশার জন্য। আমি জানি, আমাকে ধরতে পারলে ওরা মেরেই ফেলবে!
হঠাৎ চুলের মুঠি ধরে রিকশায় তুলে ফেলল আমার স্বামী।
‘ওর মা অসুস্থ, তাই ও যেতে চাইছে বাবার বাসায়’, এ কথা বলে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে বাসায় নিয়ে এসে বেদম পেটাল আমায়। রান্নাঘর থেকে চাকু এনে আমায় তলপেটে ও যৌনাঙ্গে দু-তিনটা পোঁচ মেরে রক্তাক্ত করে দিয়ে বলল, ‘খানকি মাগি, আরেক বেডার কাছে বিয়া বসবি। মৌজফুর্তি করবি? তা হবে না আমি বেঁচে থাকতে।’
দরজা বন্ধ করে বের হয়ে গেল একসময়। আমার ছোট বাচ্চা দুটো জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে আকুলভাবে কাঁদছে। বাচ্চাদের কান্না দেখে আমার স্বামী ছয় বছরের ছেলেটাকে প্রচণ্ড মারল। তারপর আছাড় মারল প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে। আর মেয়েটা ভয়ে দূরে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
ওদের বাবা ঘর থেকে যাওয়ার পর কেউ একজন দরজা খুলে দেয়। আমি খুব শান্ত হয়ে হাত-পা ছেড়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসি।
ভাবছি কই যাব? কার কাছে? মা নেই, মায়ের পেটের একটাই বোন। হার্টের রোগী। কোনো রকমে জানে বেঁচে আছে। তার ওপর মানসিক প্রতিবন্ধী। আহা! কী কপাল আমার!!
সন্ধ্যার পর বাচ্চারা পড়তে বসেছে। আমি কেবল ভাবছি আর ভাবছি। মরে যাওয়া ছাড়া আমার আর পথ নেই। লম্বা করে প্রায় দুই ইঞ্চির মতো তলপেটের বাম দিকে কেটেছে। শাড়ির টুকরায় চিনি দিয়ে পেঁচিয়ে তলপেট বেঁধেছি কিন্তু যৌনাঙ্গের রক্ত থামাতে পারছিলাম না। কষ্টে, দুঃখে, লজ্জায় অপমানে কেরোসিনের ডিব্বাটা বের করে আনলাম রান্নাঘরের ওপরের তাক থেকে। খুব কাঁদলাম। প্রাণভরে কাঁদলাম। রান্নাঘরের দরজা বন্ধ করে দিলাম। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে আল্লাহকে খুঁজে পেতে চাইলাম। অভিমানে আর ব্যথায় আমার কণ্ঠস্বর বুজে যাচ্ছে বারবার। আল্লাহর কাছে, মায়ের কাছে, বাবার কাছে মাফ চাইলাম।
ডিব্বার মাঝে গতকাল বাজার থেকে আনা এক সের কেরোসিন তেল মাথার ওপর তুলে চোখ বুজে ঢেলে দিলাম। চোখের পানি আর কেরোসিন মিলেমিশে আমাকে একেবারেই শান্ত করে দিল। আবারও ভাবলাম, কই যাব? কার কাছে যাব? কী খাব, বাচ্চাদের কী খাওয়াব? পড়াশোনা করেছি দশম শ্রেণি পর্যন্ত!
চুলার পাশ থেকে ম্যাচের বাক্সটা হাতে নিয়ে একটা কাঠি ধরালাম। ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে ফেললাম। আবার ধরালাম, আবারও। নাহ্্, বাঁচার ইচ্ছেটাই মরে গেছে। বেঁচে থেকে কী লাভ আর! আর কোথায়ই-বা পালাব?
আবার কাঠি ধরালাম, হাতটা ধীরে ধীরে হাঁটুর কাছে নিয়ে এলাম। দাউদাউ করে জ্বলে উঠলাম। আমি মুখ চেপে দাঁড়িয়েই আছি। দেখছি কী করে পুড়ছে চিতার আগুনে মা-বাবার বড় আদরের এই শরীরখানা। হঠাৎ কানে গেল আমার স্বামীর চিৎকার। আমাকে বের করে কারা আনল জানি না। আমার পুড়ে অঙ্গার হওয়া শরীর জড়িয়ে আমার স্বামী যেন বলছে, ‘কেন করলে এমন? তোমায় কত ভালোবাসি তা কি তুমি জানো?’ আমি তাকাই ওর দিকে। স্পষ্ট বলি, ‘তোমাকে হারিয়ে দিয়েই আমার সত্যিকারের শান্তি ও আনন্দ।’
তারপর আমাকে এই ঘরখানা কিনে দিয়ে পরিবার, সন্তান, দুনিয়া থেকে আলাদা করে রেখে গেছে ২৮ বছর আগে। ভালোই আছি এখানে। রান্না করি না, খিদে পায় না, লাত্থি-ঝাঁটা খেতে হয় না। ধর্ষিতা হই না প্রতি রাতে। কেউ আর মন্দ কথা বলে না। চরিত্রে কলঙ্ক দেয় না। তবে খুব কষ্ট লাগে, মন খারাপ করে। আমি আমার সন্তানদের দেখি না কতটা বছর! ওরা কতটা বড় হয়েছে, তুমি তো দেখেছ! ওরা কি আমায় মনে রেখেছে, আনোয়ার? আমি খোলা আকাশ দেখি না কতটা যুগ! বলতে পারো? বাড়ির শান্ত সবুজ জলে লাল শাপলায় ভরা পুকুরটা দেখি না, আনোয়ার! আমার না মনটা খুব আনচান করে। বাচ্চাদের জন্য, আমার ঘরের জন্য, আমার বিছানার জন্য। এখানে মাটিতে ঘুমাতে খুব কষ্ট হয়, ভয় করে বিচ্ছুর!
তুমিও কি আমার মতো অভিমান করেছ দুনিয়ার সাথে? তোমাকে তো সবাই ভালোবাসে, তাহলে! বাড়ি ফিরে যাও, বাবা। এই ঘরে তোমার কষ্ট হবে খুব। তোমার তো সব আছে, পুরো দুনিয়া! তোমার বন্ধু, ভাই, বোন, তোমার স্ত্রী! সবাই কাঁদছে তোমাকে পাওয়ার জন্য। তুমি কি আর আসবে না পুনর্বার এই স্বেচ্ছায় নির্বাসন ছেড়ে?
-আলবেনি
আমার চিঠি পেয়ে খুব একটা অবাক হয়ো না যেন। আমাকে চিনতে পারছ না মনে হয়! আমি তোমার প্রতিবেশী আন্টি। আমি তোমার ছোট্ট ঘরের পাশেই যে পুরোনো ঘরখানা আছে, তার ভেতরেই শুয়ে আছি দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে। আগাছায় জড়িয়ে দেয়ালখানা বিবর্ণ হয়ে গেছে কতটা কাল! সে বোধ হয় আমিও জানি না। তুমিও হয়তো খেয়াল করোনি কখনো। তবে আমি কিন্তু দেখেছি তোমায়। তুমি যেদিন এলে সেদিনই দেখেছি তোমায়, তোমার ঘরখানা একেবারেই নতুন। এখনো সোঁদা মাটির গন্ধ পাই! কত যে মানুষ এসেছিল তোমার সাথে তোমার ঘরে তোমাকে পৌঁছে দিতে। সুগন্ধি আতরে আগরবাতির ঘ্রাণে আমি বুঝতে পারলাম কেউ এল পাশের খালি জায়গায় বাড়ি করে! কিন্তু এত অসম বয়সী প্রতিবেশী শুনে বুকের ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে উঠেছিল। আমার মৃত মনটা বুঝে গেল, নিশ্চয় মা, বাবা, স্ত্রীর সাথে অভিমান করে এসেছ। ব্যাপারটা আমার একদম ভালো লাগেনি, বাজান! তোমাদের রাগ, অভিমান থাকতে কি আছে বলো? তোমরা হলে দেশের ভবিষ্যৎ, প্রকল্প থেকে বের করে আনবে সফেদ বিস্ময় অনুপ্রেরণা।
তোমার ছবি দেখেছি আমার মেয়ের কাছে। তাই তোমাকে চিনতে অসুবিধে হয়নি একবিন্দুও জানো তো! আমি সাদামাটা প্রাণোচ্ছল হাসিখুশি একজন ছেলেকে চিনি। অথচ এখন চিনতেও কষ্ট হচ্ছে। কষ্টের নীল এক ছায়া তোমার নিঃসর্গ অবয়বে। আমি তোমার মায়ের মতোই। খালাম্মা ডেকো নির্দ্বিধায়। তোমার বয়সী আমার ছেলেমেয়ে। ওদের সাথে তোমার বেশ ভাব, সে আমি জানি, বাবা। এখন বলো তো, তুমি কেন এখানে এতটা দূরে নির্জনতা বেছে নিলে? থাকতে পারবে তো এক বিশাল পৃথিবীকে পিছনে ফেলে। জানো তো, এখানে কিন্তু ইন্টারনেট, টেলিভিশন, টেলিফোন, পত্রিকা, কাগজ-কলম কিচ্ছুটি নেই। তুমি প্রাণপণে চাইলেও কেউ আসবে না তোমাকে দেখতে! সবাই ব্যস্ত যার যার জীবনের প্রয়োজনে, সুখ আরাম আয়েশ রেখে। এ জায়গাটা শহর থেকে বহুদূরের পথ। এত্ত ট্রাফিক, এতটা ব্যস্ত জীবন রেখে কে আসবে এই গ্রামের জংলি মেঠোপথের শেষ মাথায় এই মাটির তৈরি ঘরে?
সে যা-ই হোক বাবা, এখন তো আর একা লাগবে না আমার! কথাটা বললাম খুব স্বার্থপরের মতো, তাই না? দুঃখজনক হলেও সত্যি, এখন তো আমরা দুজনই প্রতিবেশী হিসেবে আছি! তা তোমার ঘরে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেছ? ভয় লাগে না তো আবার? লাগলে বলো আমার পরিচিত একজন মৌলভি আছে, আমি না হয় বলে দেব তোমাকে কিছু আলো দেবে! আমি কিন্তু বাবা কুপির আলো-আঁধারিতে আছি। চোখেও ছানি পড়েছে। কিছুই দেখতে পাই না ঠিকমতো। দরজা-জানালার যা অবস্থা! একবিন্দু আলো আসে না, বড় হাঁসফাঁস লাগে আমার। একটু বিশুদ্ধ বাতাসের জন্য বাবা! আমাকে এই ঘরে পৌঁছে দিয়ে কাঠের, বাঁশের খুঁটি দিয়ে দরজায় খিল তুলে দিল সারা জীবনের জন্য, যাতে আর ফিরে যেতে না পারি কাচের ঘেরা চার দেয়ালের সেই জেলখানায়। বড় খিদা পায় বাজান। একমুঠ ভাতের কষ্ট আমি জানি।
তোমার কি ভাবনা জীবনের সংজ্ঞা নিয়ে? কেন এই বেহাল অবস্থা তোমার? তোমার চেহারার অবয়ব বুঝতে পারি, কিন্তু স্পষ্ট করে দেখি না। তার পরও তোমার কণ্ঠে যেন কান্নার অনুরণ চুইয়ে পড়ছে! নাকি ভুল বকছি? কিসের এত কষ্ট তোমার? কিসের এত দুঃখ? মাকে জানিয়েছ কখনো? ভাইবোনের সাথে, বন্ধুদের সাথে? অবশ্য বলেও হয়তো কোনো সমাধান হয়নি বলেই তো তুমি চলে এসেছ এখানে।
আমার কথা জানতে চাইছ? কী আর শুনবে বলো! কত যে কষ্টের গল্পের বক্স বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছি লোকলজ্জার ভয়ে! তা ছাড়া আমার তো তোমাকে বলতেও ভীষণ লজ্জা লাগছে। কেন এখানে এত কষ্ট করছি?
কী করার ছিল বলো আমার? বাবা-মায়ের অমতেই বিয়ে করেছিলাম তোমার খালুকে।
ভাবছ তোমার খালাম্মা প্রেমে পড়েছিল!
না বাবা, ঠিক প্রেম বলা যাবে না এটাকে।
এটা উঠতি বয়সের মোহ ছিল, তা ছাড়া তোমার খালু হুমায়ূন আহমেদের মতো সুন্দর গুছিয়ে, বুঝিয়ে আমায় কনভিন্স করেছিল। ওনার মুদির দোকান থেকে এটা-ওটা আনতে পাঠাত আমার সৎমা। চুড়ি, ফিতা, শ্যাম্পু, আলতা, স্নো, পাউডার সবকিছু তার দোকান থেকেই কিনতে যেতাম। ওভাবেই পরিচয় হয় আমাদের। আরেকটা ব্যাপারও ছিল, সৎমায়ের ঘরে বড় হয়েছি। লেখাপড়ার সুযোগ পাইনি। পেটভরে ভাত খেতে দেয়নি। সাহস করে ভাতের পাতিলে হাত দিতে পারিনি আরেক মুঠো ভাতের জন্য। খুব অকথ্য ভাষায় গালাগালি করত সৎমা। চরিত্রে কলঙ্ক দিয়েছে বহুবার। বছরে একজোড়া সুতির শাড়ি বাবা কিনে দিত। তাতেও চুলের মুঠি ধরে দু-চার ঘা লাগিয়ে দিত যখন-তখন।
যন্ত্রণার শেষ পর্যায়ে আমার স্কুলশিক্ষক আট সন্তানের কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা আমার বিয়ের ব্যবস্থা করলেন অনিচ্ছাকৃতভাবে। পাত্র আমার চেয়ে বারো বছরের বড়। বিএ পরীক্ষায় অকৃতকার্য এক মুদি দোকানদার।
জানি না তোমাকে আজ কেন এত কথা বলছি! গত ২৮ বছর আমি এই নির্জন ঘরে সম্পূর্ণ একারে বাবা। বৃদ্ধা হয়ে গেছি, চোখে দেখি না, শরীরে শক্তি নেই। কাউকেই ঠিকমতো চিনতেও পারি না।
কিন্তু তুমি কেন এখানে? বাচ্চামানুষ তুমি। শুনেছি তোমার খুব মায়াবী সুন্দর বউ আছে! দুটো চাঁদের টুকরা আছে? তোমাকে আসতে দিল ওরা? একা থাকতে পারবে ওদের ছেড়ে? মন খারাপ করছে না?
আমার কথা আর কী শুনবে, বাবা! আমি এখানে এসেছি স্বামী নিগৃহীতা হয়ে। প্রতিদিন লাত্থি, ঝাঁটা খেয়েও সংসার আঁকড়ে ধরে রাখতে চেয়েছি। কিন্তু রাস্তার কুকুরটাও বোধ হয় কিছুটা বিশ্রাম পায়, আমার কোনো বিশ্রাম নেই, খাবার নেই, কথায় কথায় বাবার দুই বিয়ে নিয়ে খোঁটা আর গরিব বলে তাচ্ছিল্য ছিল নিত্যদিনের নিয়ম। আমার শ্বশুরের একটা ওয়ার্কশপের খান্দানি ব্যবসা ছিল। আমাদের ছোট মফস্বল শহরের রিকশা, সাইকেল, মোটরের যাবতীয় কাজ শ্যামলী ওয়ার্কশপে হতো। আমার দেবর ওয়ার্কশপে সাহায্য করত।
আমার স্বামী মুদিখানা একাই চালাতেন। মোটামুটি চলছিল সংসার। কিন্তু কিছু বন্ধুবান্ধবের পাল্লায় পড়ে বিপথে যাওয়া শুরু করল আমার বিয়ের তিন মাসের মাথায়। কিছু জিজ্ঞেস করলে চিৎকার-চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুলত। তারপর একদিন গায়ে হাত তোলা শুরু হলো। সারা দিন সংসার নিয়ে ব্যস্ততা আর রাতে শারীরিক-মানসিক অত্যাচার। অশালীন ব্যবহার নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে গেল ধীরে ধীরে। ঘরে টাকা দিতে পারে না বলে শাশুড়ি বললেন, ‘তোমার স্বামীকে বলবা টাহা-পয়সা না দিলে একবিন্দু জায়গা হ্যারে দিমু না। সবাই উন্নতি করে কিন্তু হ্যায় উন্নতির মুখ দেখতে পায় না! দেখবে কীভাবে বলো? সন্ধ্যা হলেই জুয়ার আড্ডায় চলে যেত। রাত এগারোটা পরেই মনে হতো বাড়ি ফেরা দরকার। আমি গর্ভাবস্থায়ও পৌষের প্রচণ্ড শীতে অপেক্ষায় থেকেছি কখন ঘরে ফিরবে! কত রাত যে ঘরে ফেরেনি, তার ইয়ত্তা নেই। আর রাস্তার নারী নিয়ে যাচ্ছেতাই করেছে। কখনো একদম জোর করেই আমাকে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দিত। আমি বাবার বাড়ি গেলে ব্যবসায়িক বন্ধুদের নিয়ে আসত বাসায়, সাথে কেরুর বোতল আর পতিতা। তোমাকে এসব বলতেও লজ্জা লাগছে, বাবা। কাজের মেয়েও বাদ দেয়নি। এসব নিয়ে কী বলব তোমায়! প্রতিবাদ করলেই মারধর। না থাকতে পেরেছি এই সংসারে শান্তিতে, না যেতে পেরেছি অসহায় অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক বাবার ঘরে।
আট-দশ দিন পরপর বিভিন্ন বাহানায় বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দিত। এভাবেই দুই বাচ্চার মা হয়ে গেলাম একসময়। এদিকে ভাশুরের কুনজরে পড়ে গেলাম। স্বামীর অবর্তমানে দরজায় টোকা দিত, ওনার যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে ননদ ও নানিশাশুড়িকে জানালাম। তারা উল্টো আমাকেই দায়ী করলেন। সব দোষ আমার রূপের। তারা আমাকে ঘোমটা করতে বললেন। ঘোমটা দিয়ে শাড়ি পরা তখনো আয়ত্ত করতে পারিনি। একমাত্র বিবাহিত ননদ তিন সন্তান ও স্বামী নিয়ে এ বাড়িতেই থাকতেন। তিনি ছিলেন এ বাড়ির প্রধানমন্ত্রী। এখানেও পেটের জ্বালায় মরেছি প্রতিদিন। বাচ্চাদের তোলা দুধের টাকাও আমার বাবা তিন মাইল রাস্তা পায়ে হেঁটে এসে লুকিয়ে দিয়ে গেছেন।
পাঁচ, দশ, চার আনা, আট আনা জমিয়ে রাখতাম হাঁসমার্কা নারিকেল তেলের ডিব্বার মধ্যে। যখন চিনি থাকত না, তখন আড়াই টাকা দিয়ে একশ গ্রাম চিনি আনতাম পাশের বাসার মেসের ছাত্রদের দিয়ে। আমার ননদ, শাশুড়ি ফ্রিজে তালা মেরে রাখত। ডিম পর্যন্ত গুনে রাখত, যাতে আমি না খাই। স্টোর রুমেও তালা দিয়ে কাজের মেয়ের কাছে দুটোরই চাবি দিয়ে বাইরে যেত শাশুড়ি-ননদ।
আমার বাবা আমাকে কিছু দিতে পারেননি বিয়েতে। আসলে সে ক্ষমতাও ছিল না বাবার। আমরা চার বোন। যে বাবার একই বয়সী পিঠাপিঠি চারটা মেয়ে থাকে, তার অবস্থাটা একবার ভাবো! বাবার নাভিশ্বাস প্রায়। আমার বাবা অনেক কষ্টে একশ বরযাত্রীর আপ্যায়ন করেন। জামাইকে স্যুটের কাপড় আর তিন আনার একটি আংটি দিয়েছিলেন। সেসব কথা বলে অপমান, অপদস্ত করতে কেউ কম করেনি। একমাত্র শ্বশুর সাহেব কিছু বলেননি কখনো।
আমার জীবনের কথা কী বলব তোমায়! প্রতিদিনই তালাকের হুমকি দেয় আমার স্বামী। মারধরের পর কোরআন শরিফ মাথায় চেপে ধরে শপথ করায়, ‘আমার মা লাইত্থাবে, উষ্ঠা দিবে, আমি মাগিবাজি করব, মদ খাব, জুয়া খেলব, ঘরে ইচ্ছে হলে আসব, না হলে আসব না, কোনো খরচ তোকে দিব না, থাকতে পারলে থাকবি নইলে এক্ষুনি তালাক দেব।’ আমি কেবল কেঁদেই যাচ্ছি। অসহায় আমি হাতে-পায়ে ধরি, যাতে তালাক না দেয়। আসলে আমি আমার স্বামীর মনমতো হইনি। বয়সের বিস্তর ব্যবধান, তার নেশাগুলো আগেই ছিল! আমার শাশুড়ির ইচ্ছে ছিল আপন বোনের মেয়েকে বিয়ে করাবে, বোনের জামাই প্রথম শ্রেণির কন্ট্রাক্টর। অনেক টাকা-পয়সা। দুই ছেলেমেয়ে। আমি তো সেখানে অবাঞ্ছিত। জানো! বিয়ের পরদিন ভোরে মুখ ধুয়ে বিয়েতে দেওয়া আয়নায় মুখ দেখতে গিয়ে দেখি দেখতে পারছি না কিছুই। হাতের গামছা দিয়ে ঘষে চেষ্টা করলাম, যাতে পরিষ্কার হয়, হাত ভরে গেল শিষ কলমের আঠালো কালিতে। আমি হতবাক, কিংকর্তব্যবিমূঢ়! আমি কাউকে জিজ্ঞেস করতেও সাহস পেলাম না। এভাবেই ব্যবহার করলাম এক বছর ধরে। একদিন আমার একজন চাচিকে বললাম। উনি খুব রাগ করে বললেন, এক্ষুনি বাসায় যা, আয়নাটা ফেলে দে। ওই আয়নায় কুফরি করেছে তোর শ্বশুরবাড়ির কেউ। আমি বিয়াল্লিশ বছর সংসারে থেকেও একবিন্দু শান্তি, সুখ পাইনি।
অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে একদিন ঘর থেকে দৌড়ে বের হয়ে গেট পেরিয়ে বাবার বাসায় যাওয়ার জন্য প্রাণপণে দৌড় দিলাম। বাচ্চাদের রেখেই। সারা পাড়ায় হইচই পড়ে গেল। রাস্তার আশপাশের দোকানের সবাই ঠেকাতে চেষ্টা করল। আমি চিৎকার করে কাঁদছি আর মায়ের কাছে যাব বলে মিনতি করছি একটা রিকশার জন্য। আমি জানি, আমাকে ধরতে পারলে ওরা মেরেই ফেলবে!
হঠাৎ চুলের মুঠি ধরে রিকশায় তুলে ফেলল আমার স্বামী।
‘ওর মা অসুস্থ, তাই ও যেতে চাইছে বাবার বাসায়’, এ কথা বলে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে বাসায় নিয়ে এসে বেদম পেটাল আমায়। রান্নাঘর থেকে চাকু এনে আমায় তলপেটে ও যৌনাঙ্গে দু-তিনটা পোঁচ মেরে রক্তাক্ত করে দিয়ে বলল, ‘খানকি মাগি, আরেক বেডার কাছে বিয়া বসবি। মৌজফুর্তি করবি? তা হবে না আমি বেঁচে থাকতে।’
দরজা বন্ধ করে বের হয়ে গেল একসময়। আমার ছোট বাচ্চা দুটো জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে আকুলভাবে কাঁদছে। বাচ্চাদের কান্না দেখে আমার স্বামী ছয় বছরের ছেলেটাকে প্রচণ্ড মারল। তারপর আছাড় মারল প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে। আর মেয়েটা ভয়ে দূরে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
ওদের বাবা ঘর থেকে যাওয়ার পর কেউ একজন দরজা খুলে দেয়। আমি খুব শান্ত হয়ে হাত-পা ছেড়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসি।
ভাবছি কই যাব? কার কাছে? মা নেই, মায়ের পেটের একটাই বোন। হার্টের রোগী। কোনো রকমে জানে বেঁচে আছে। তার ওপর মানসিক প্রতিবন্ধী। আহা! কী কপাল আমার!!
সন্ধ্যার পর বাচ্চারা পড়তে বসেছে। আমি কেবল ভাবছি আর ভাবছি। মরে যাওয়া ছাড়া আমার আর পথ নেই। লম্বা করে প্রায় দুই ইঞ্চির মতো তলপেটের বাম দিকে কেটেছে। শাড়ির টুকরায় চিনি দিয়ে পেঁচিয়ে তলপেট বেঁধেছি কিন্তু যৌনাঙ্গের রক্ত থামাতে পারছিলাম না। কষ্টে, দুঃখে, লজ্জায় অপমানে কেরোসিনের ডিব্বাটা বের করে আনলাম রান্নাঘরের ওপরের তাক থেকে। খুব কাঁদলাম। প্রাণভরে কাঁদলাম। রান্নাঘরের দরজা বন্ধ করে দিলাম। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে আল্লাহকে খুঁজে পেতে চাইলাম। অভিমানে আর ব্যথায় আমার কণ্ঠস্বর বুজে যাচ্ছে বারবার। আল্লাহর কাছে, মায়ের কাছে, বাবার কাছে মাফ চাইলাম।
ডিব্বার মাঝে গতকাল বাজার থেকে আনা এক সের কেরোসিন তেল মাথার ওপর তুলে চোখ বুজে ঢেলে দিলাম। চোখের পানি আর কেরোসিন মিলেমিশে আমাকে একেবারেই শান্ত করে দিল। আবারও ভাবলাম, কই যাব? কার কাছে যাব? কী খাব, বাচ্চাদের কী খাওয়াব? পড়াশোনা করেছি দশম শ্রেণি পর্যন্ত!
চুলার পাশ থেকে ম্যাচের বাক্সটা হাতে নিয়ে একটা কাঠি ধরালাম। ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে ফেললাম। আবার ধরালাম, আবারও। নাহ্্, বাঁচার ইচ্ছেটাই মরে গেছে। বেঁচে থেকে কী লাভ আর! আর কোথায়ই-বা পালাব?
আবার কাঠি ধরালাম, হাতটা ধীরে ধীরে হাঁটুর কাছে নিয়ে এলাম। দাউদাউ করে জ্বলে উঠলাম। আমি মুখ চেপে দাঁড়িয়েই আছি। দেখছি কী করে পুড়ছে চিতার আগুনে মা-বাবার বড় আদরের এই শরীরখানা। হঠাৎ কানে গেল আমার স্বামীর চিৎকার। আমাকে বের করে কারা আনল জানি না। আমার পুড়ে অঙ্গার হওয়া শরীর জড়িয়ে আমার স্বামী যেন বলছে, ‘কেন করলে এমন? তোমায় কত ভালোবাসি তা কি তুমি জানো?’ আমি তাকাই ওর দিকে। স্পষ্ট বলি, ‘তোমাকে হারিয়ে দিয়েই আমার সত্যিকারের শান্তি ও আনন্দ।’
তারপর আমাকে এই ঘরখানা কিনে দিয়ে পরিবার, সন্তান, দুনিয়া থেকে আলাদা করে রেখে গেছে ২৮ বছর আগে। ভালোই আছি এখানে। রান্না করি না, খিদে পায় না, লাত্থি-ঝাঁটা খেতে হয় না। ধর্ষিতা হই না প্রতি রাতে। কেউ আর মন্দ কথা বলে না। চরিত্রে কলঙ্ক দেয় না। তবে খুব কষ্ট লাগে, মন খারাপ করে। আমি আমার সন্তানদের দেখি না কতটা বছর! ওরা কতটা বড় হয়েছে, তুমি তো দেখেছ! ওরা কি আমায় মনে রেখেছে, আনোয়ার? আমি খোলা আকাশ দেখি না কতটা যুগ! বলতে পারো? বাড়ির শান্ত সবুজ জলে লাল শাপলায় ভরা পুকুরটা দেখি না, আনোয়ার! আমার না মনটা খুব আনচান করে। বাচ্চাদের জন্য, আমার ঘরের জন্য, আমার বিছানার জন্য। এখানে মাটিতে ঘুমাতে খুব কষ্ট হয়, ভয় করে বিচ্ছুর!
তুমিও কি আমার মতো অভিমান করেছ দুনিয়ার সাথে? তোমাকে তো সবাই ভালোবাসে, তাহলে! বাড়ি ফিরে যাও, বাবা। এই ঘরে তোমার কষ্ট হবে খুব। তোমার তো সব আছে, পুরো দুনিয়া! তোমার বন্ধু, ভাই, বোন, তোমার স্ত্রী! সবাই কাঁদছে তোমাকে পাওয়ার জন্য। তুমি কি আর আসবে না পুনর্বার এই স্বেচ্ছায় নির্বাসন ছেড়ে?
-আলবেনি