চাওয়া আর পাওয়া

প্রকাশ : ২৩ জানুয়ারী ২০২৫, ১৩:০৫ , অনলাইন ভার্সন
কিছুদিন ধরে মেহজাবীনের মনটা ভীষণ খারাপ। সাজগোজ, আড্ডা কোনো কিছুই ভালো লাগছে না। জীবনটাকে যেভাবে চেয়েছিল, সেভাবে সাজাতে পারেনি। ছোটবেলা থেকেই রূপের প্রশংসা শুনে শুনে বড় হয়েছে।
মনে মনে ভাবে, লোকজন বাইরে থেকে তাকে যেভাবে ঘিরে রাখে কিন্তু যখনই তাদের সাথে সম্পর্কে জড়ায়, তার পরই কি তাদের সেই ভালোবাসা উবে যায়! সে নিজেকে বুঝতে পারে না। সব ভুল কি তার একার? বয়স যখন আঠারো হয়ে ওঠেনি, তখনই বউ সাজতে হয়েছিল তার। যার সাথে বিয়ে হলো, তিনি ছিলেন বয়সে পনেরো বছরের বড়। পৃথিবীর রংঢং বুঝে ওঠার আগেই তার হাত দুটো মেহদির রঙে রাঙিয়ে দেওয়া হলো। ঘরনি হতে হলো অনেক টাকা-পয়সাওয়ালা ভদ্রলোকের। লোকটাকে কখনোই স্বামী মনে হয়নি তার। সব সময়ই মনে হতো বাড়ির অভিভাবক, যার সাথে অনিচ্ছা সত্ত্বেও পার করতে হবে পুরো রাত। একটা সময় কোলজুড়ে আসে ছেলে সাকলাইন। বিশাল বাড়ি, একের অধিক গাড়ি আর কাজ করার লোকজনের তো কোনো অভাবই নেই। তার পরও মেহজাবীনের কিছুতেই মন টেকে না এ বাড়িতে। ওর বয়সী লোকজন কী সুন্দর পড়াশোনা করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এদিক-সেদিক আনাচ-কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছে বন্ধুদের সাথে। আর ওর সময় কাটছে মিসেস জুলকারনাইন হিসেবে। মেহজাবীন ছিল পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি উচ্চতার একটি মানুষ, সোনালি রেশমি চুল কোমর ছাড়িয়ে যেত তার। গোলাপি গায়ের রং আর নীলাভ রঙের চোখ, খাড়া নাক আর গোলাপি কপোল দেখে মনে হতো বাসন পরা। মেহজাবীন দেখতে ছিল একদম ওর দাদির মতো। দাদি মূলত পাকিস্তানি আর উর্দুভাষী ছিলেন। মহিলার সৌন্দর্য, কায়দাকানুন আর দাপটের কাছে মেহজাবীনের বাবা-মায়ের কোনো কথাই টিকত না। ওনার পছন্দেই মেহজাবীনের বিয়ে হয় ওনার বাবার বাড়ির আত্মীয়ের সাথে।
টাকা-পয়সার অভাব কী জিনিস, মেহজাবীন কখনো টের পায়নি। বাবা ছিলেন বিরাট ব্যবসায়ী আর তার স্বামীর অবস্থা তো তার চেয়েও ভালো। শুধু মানুষ হিসেবে যে সম্মান ও অধিকার বউদেরও থাকা দরকার, এটাই বুঝত না এই দুই পরিবারের কেউ। তিন বছর সংসার করার পর মেহজাবীন টের পেল, ওর স্বামী বিয়ে করে আরো একটা সংসার পেতেছেন। সবকিছু জানাজানি হলে মেহজাবীনের দাদির মত অনুযায়ী ওর ডিভোর্স হয়ে যায়, যদিও মেহজাবীন খুব একটা ভাঙা-গড়ার পক্ষপাতী ছিল না। কিন্তু দাদির মতের বাইরে যাওয়ার সাহস তাদের কারোরই ছিল না। ডিভোর্স হলেও ওই পরিবার ছেলে সাকলাইনকে মায়ের সাথে আসতে দেয়নি। সবাই সবার মতো করে ভাবল আর সিদ্ধান্ত নিল। মেহজাবীনের কথা কেউ একবার ভেবেও দেখল না। একটা মেয়ের সংসার ভাঙলে কেমন লাগে বা বাচ্চা ছাড়া দিন পার করতে কেমন কষ্ট হয়, সেগুলো নিয়ে কারো ভাবার কোনো সময় ছিল না। মেহজাবীনও সবকিছু চুপচাপ মেনে নিল। শুধু ভেতর থেকে ভেঙেচুরে টুকরো টুকরো হয়ে গেল সবার অজান্তে।
তারপর শুরু হলো তার আরেক পথচলা। আবারও পড়াশোনা শুরু করল। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে চাকরিতেও জয়েন করল। যদিও পরিবারের সবাই চাকরি করার বিপক্ষে ছিল। সবার কথাÑটাকা-পয়সার তো আর অভাব নেই। কিন্তু মেহজাবীন জোর করেই চাকরিতে জয়েন করে। ভালোই চলছিল সবকিছু। ওর বস ভাস্কর আহমেদ, দারুণ হ্যান্ডসাম আর মেধাবী একজন মানুষ। অনেক মেয়েরই ক্রাশ তিনি। ওনার সাথে বেশ সখ্য হয় মেহজাবীনের। কিন্তু মেহজাবীনের ওপর ক্রাশ খেয়ে বসে থাকে ওরই আরেক কলিগ মাহমুদ। মাহমুদ ওর পেছন পেছন ঘোরে আর মেহজাবীনের ভালো লাগে ভাস্করকে। উনিও বেশ মনোযোগী মেহজাবীনের ব্যাপারে। যদিও ওনার অ্যাফেয়ার ছিল ওনার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী দীপ্তির সাথে। দীপ্তির সাথে নাকি ওনার জমছিল না। প্রায়ই উনি এগুলো নিয়ে আলাপ করতেন মেহজাবীনের সাথে। অনেক বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও অফিস এবং অফিসের বাইরে সব জায়গায়ই প্রেম করে বেড়াত দুজন। মেহজাবীন এটা খুব ভালো করেই জানত, ওর বস সুন্দরের পূজারি। ওদিকে মাহমুদ তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করত কখন মেহজাবীন ওর সাথে একটু কথা বলবে। সে প্রাণভরে ভালোবাসত মেহজাবীনকে।
হঠাৎ একদিন খবর পাওয়া গেল দীপ্তির সাথে ভাস্করের বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে। ভাস্করকে জিজ্ঞেস করলে বলে, বাধ্য হয়েই ওর বিয়েটা করতে হচ্ছে। দীপ্তির সাথে ভাস্করের পাঁচ বছরের প্রেম ছিল। কিন্তু শেষের দিকে দুজনের মতের মিল হচ্ছিল না খুব একটা। ভাস্কর চেয়েছিল সম্পর্কটা থেকে বের হয়ে আসতে কিন্তু দীপ্তির জন্য সম্ভব হয়নি। দীপ্তি একটু ডমিনেটিং স্বভাবের ছিল, আর ভাস্কর ছিল ভীষণ উড়নচণ্ডী একজন মানুষ। বিয়ের খবর শুনে মেহজাবীন খুব মন খারাপ করে। এর পর থেকেই ধীরে ধীরে মাহমুদের সাথে তার সখ্য বাড়তে থাকে। দুজন এদিক-সেদিক যায়, শপিং করে, একসাথে ঘুরে বেড়ায়। একসময় দুজন মিলে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। এই ব্যাপারটাতে খুব অযৌক্তিকভাবেই রাগ হয় ভাস্কর, মেহজাবীনের সাথে দেখা করতে চাইলে মেহজাবীন তাকে এড়িয়ে যায়।
মেহজাবীনের পরিবারের লোকজন মাহমুদের সাথে বিয়েতে একদম রাজি ছিল না। মাহমুদের পরিবার খুব একটা সচ্ছল ছিল না। তা ছাড়া মাহমুদ দেখতে-শুনতেও খুব একটা ভালো না। মেহজাবীন বেশ অগোছালোভাবেই মাহমুদের সাথে জড়িয়ে যায় এবং সম্পর্কটা বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়। পরিবারের সবাই খুব ভালো করেই জানতেন, মেহজাবীন আর্থিক সচ্ছলতা ছাড়া চলতে পারবে না।
এভাবে দিন যায়, বছর যায়, প্রত্যেকে প্রত্যেকের মতো সংসার করতে থাকে। মেহজাবীন একটি ছেলেসন্তানের মা হয়। আদর করে তাদের দুজনের নামের সাথে মিলিয়ে ছেলের নাম রাখে মাহের। ভালো-মন্দ সব মিলিয়ে মেহজাবীন আর মাহমুদের সংসার ভালোই চলছিল। মাহমুদ ওকে ভীষণ ভালোবেসে আগলে রাখে। কিন্তু সীমিত টাকা-পয়সার মধ্যে চলতে তার কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসে। সবকিছুতেই হিসাব করতে হয়। জন্ম থেকে কোনো দিন অভাব কী জিনিস, ওর জানা ছিল না। সব থেকেও কেমন যেন অসম্পূর্ণ মনে হয় সংসারটা। নিজের একটা বাড়ি, একটা গাড়ি-এগুলো জীবনের জন্য ভীষণ প্রয়োজন, এই ব্যাপারটাই মাহমুদ বোঝে না। এগুলো নিয়ে মেহজাবীনের দাদি ওকে অনেক কথা শোনান। ওরও মনে হয় মাহমুদকে বিয়ে করা ভুল হয়েছে। ওর তো পছন্দ ছিল ভাস্করকে, কিন্তু ভাস্কর তো বেইমানি করল। ভাস্কর ছিল শিক্ষা-দীক্ষা, টাকা-পয়সা এবং সামাজিক মর্যাদা সব দিক মিলিয়ে একজন পরিপূর্ণ মানুষ। মেহজাবীন ছেলেটাকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াতে চায় কিন্তু টাকা-পয়সার কারণে তা আর হয়ে ওঠে না। মনমতো একটু শপিং করতে পারে না। তা ছাড়া গাড়ি ছাড়াও চলতে খুব কষ্ট হয় তার। যদিও মাহমুদ বলে, আরেকটা প্রমোশন হলেই তার বেতন অনেক বেড়ে যাবে, তা ছাড়া অফিস থেকে ওকে গাড়িও দেবে। মেহজাবীনের সেই অপেক্ষার প্রহর আর কাটতে চায় না।
ভাস্কর ওর বিয়ের পরে চাকরি বদলায়, মাহমুদও চলে যায় অন্য চাকরিতে। আর মেহজাবীন তো চাকরিই ছেড়ে দেয়। কারো সাথে কেউ আর কোনো যোগাযোগ রাখে না। অনেক বছর পরে হঠাৎ একটা শপিং মলে দেখা হয় ভাস্করের সাথে। একসাথে কফিশপে বসে অনেক সুখ-দুঃখের আলাপ করে দুজন। তার পর থেকে প্রায়ই দুজনের যোগাযোগ হতে থাকে। ভাস্করের সাথে দেখা হওয়ার ব্যাপারটা মেহজাবীন শুরুতে গোপন রাখে মাহমুদের কাছে। পরে একদিন মাহমুদ জিজ্ঞেস করলে ওকে জানায় দেখা হওয়ার কথা। মেহজাবীন আজও ভালোবাসে ভাস্করকে, ভাস্করের মাঝে তার স্বপ্নের রাজকুমারকে খুঁজে পায় সে। ভাস্কর আর দীপ্তির সংসারটা শেষ পর্যন্ত টেকেনি। তাদের দুটি যমজ মেয়ে রয়েছে। ডিভোর্সের পর দীপ্তি চলে গেছে কানাডায় পড়াশোনা করতে। মেয়ে দুটো ভাস্করের কাছেই আছে। ভাস্কর খুব দুঃখ করে বলতে থাকে, দীপ্তিকে বিয়ে করা তার ভুল ছিল। মেহজাবীন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে আর ভাবতে থাকে, সব সময় তার সাথেই কেন এমন হবে। মনে মনে ভাবে, দীপ্তি একটা বোকা মেয়ে, ভাস্করের মতো এ রকম একটা সুদর্শন মানুষকে ফেলে কেউ কোনো দিন যেতে পারে।
এমনিতেই মাহমুদের সংসারে মেহজাবীনের অভাব-অভিযোগ ছিল অনেক, তার ওপর ভাস্করের সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে মন টেকে না আর এই সংসারে। বাচ্চাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে প্রতিদিন ভাস্করের সাথে দেখা করে। তারপর দুজন মিলে একসাথে দুপুরের খাবারদাবার খেয়ে বাচ্চা নিয়ে বাসায় ফেরে মেহজাবীন। মাহমুদ সব বুঝেও চুপ থাকে। সে জানে, এই মানুষটাকে সে একতরফা ভালোবাসে। ভাস্কর ওর কাছ থেকে চলে না গেলে মেহজাবীন কখনোই তার হতো না। কিন্তু ওর এত ভালোবাসা পাওয়ার পরও মেহজাবীনের কেন মন ভরে না। মেহজাবীনের অনেক চাহিদা, বড় বাড়ি, দামি গাড়ি, ব্র্যান্ডের দোকানে শপিং, দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ানো, ওর সব চাই, সব। মাহমুদের সংসারে আসার আগে মেহজাবীনের জীবনে এসব কোনো কিছুরই অভাব ছিল না। অভাব ছিল শুধু সম্মান, ভালোবাসা আর মায়া-মমতার। মাহমুদ তার সংসারে সাধ্যমতো সবকিছু দেওয়ার চেষ্টা করে মেহজাবীনকে, কিন্তু তাও তাকে সন্তুষ্ট করতে পারে না। চাকরির জন্য মাহমুদকে চীনে গিয়ে থাকতে হয় তিন মাস। ওই সময়টাতে ভাস্করের সাথে মেহজাবীনের সম্পর্কটা চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে। বাচ্চাকে স্কুলে দিয়ে ঘরে ফিরলে ভাস্কর মেহজাবীনের বাসায় এসে সময় কাটায়। এই সবকিছুই মাহমুদের কানে যায়। মেহজাবীনকে বোঝানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় সে। মেহজাবীনের দাদি এসব কথা জেনে ভীষণ রাগ হন।
মেহজাবীনকে বোঝাতে চান,
-দো দো দিন বাদ সহর বাদাল না আচ্ছে বাত নেহি হে বেটি।
-দাদি, তোমরাই তো আমাকে ঘরছাড়া করেছ, এখন আমাকে জ্ঞান দিচ্ছ।
তোমাদের জন্যই আজ আমি আমার ছেলে সাকলাইন থেকে দূরে, তোমাদের মত অনুযায়ী আমার প্রথম সংসার ভেঙেছ। আমি কী চাই, কখনো কি কেউ জানতে চেয়েছ? আমাকে আমার জীবনের সিদ্ধান্ত কখনো নিতে দিয়েছ তোমরা? আমার জীবন আমিই ভালো বুঝব। তোমাদের কাউকে কিছু ভাবতে হবে না।
দাদির সাথে অনেক হইচই করে মেহজাবীন। ভাস্করের ব্যাপারে সে একরোখা আর জেদি হয়ে ওঠে, কারো কোনো কথাই শুনতে চায় না। তার একটাই কথাÑসে এত দিনে তার মনের মানুষ পেয়েছে, এটা সে হারাতে পারবে না।
মাহমুদ দেশে ফেরার পরে ওদের ডিভোর্সের প্রক্রিয়া শুরু হলে মেহজাবীন বাসা ছেড়ে বাবার বাসায় চলে যায় ছেলে মাহেরকে নিয়ে। যাওয়ার সময় মাহের প্রচণ্ড আপত্তি করতে থাকে।
-মা, মা, বাবাকে ছেড়ে আমরা কেন যাচ্ছি? বাবা তো আমাদের ভীষণ ভালোবাসে।
-শুধু ভালোবাসা দিয়ে জীবন চলে না, মাহের। দেখো না, তোমার বাবার একটা গাড়িও নাই। আমরা ভাস্কর আংকেলের সাথে কানাডা যাব। অনেক মজা হবে।
মাহমুদ চীন থেকে আসার সময় মেহজাবীনের জন্য ব্র্যান্ডের পারফিউম আর কিছু এক্সেসরিজ নিয়ে আসে। মেহজাবীনের হাতে দেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও, যদি নিতে রাজি না হয় সেই ভয়ে লুকিয়ে সেগুলো ওর ব্যাগে ভরে দেয়, সাথে একটা চিঠিও দেয়। মাহেরকে নিয়েও আর কোনো কথা বাড়ায় না মাহমুদ। খুব ভালো করেই জানে, মেহজাবীন অনেক একরোখা একটা মানুষ। তাকে কথা শোনানো যাবে না। চুপচাপ নিজের আবেগ লুকিয়ে রাখে একান্তে আর গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
প্রিয় মেহজাবীন,
আমি মনেপ্রাণে সব সময় যতটাই তোমার ছিলাম, তুমি তার বিন্দুমাত্রও আমার ছিলে না, এটা আমি জানি। তোমার মনের মানুষটাকে তুমি তখন না পেলেও এখন পেয়েছ, তাকে কেন হারাবে? প্রিয় মানুষ হারানোর কষ্ট অনেক, সে তুমি বুঝবে না, আমি বুঝি। চলার পথে কখনো আমার সাহায্য লাগলে নিশ্চিন্তে চলে আসবে, আমার সাহায্যের হাত তোমার জন্য সব সময়ই আছে আর থাকবে। তোমার পছন্দের পারফিউম আর কিছু জিনিস ব্যাগে ভরে দিলাম, সাহস করে হাতে দিতে পারলাম না।
ইতি
মাহমুদ।
একপর্যায়ে ভাস্কর আর মেহজাবীনের বিয়ে হয়। মেহজাবীন তার মায়ের বাসায় থাকে মাহেরকে নিয়ে, আর ভাস্কর থাকে তার বাসায় তার মেয়েদের নিয়ে। দুজন মিলে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ায়, ভালোই কাটতে থাকে তাদের দিন। মাহমুদ মাঝেমধ্যে ছেলেকে ওর কাছে নিয়ে রাখে। একসময় কানাডায় ভাস্কর তার মেয়ে দুটোসহ চলে যায়, তার কিছুদিন পর মেহজাবীন আর তার ছেলের জন্যও ভিসা পাঠায়। মাহমুদ প্রচণ্ড আপত্তি করে মাহেরকে না নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু কোনোভাবেই মেহজাবীনকে রাজি করাতে পারে না। হাল ছেড়ে দেয় মাহমুদ। একাকিত্ব আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়া তার জীবনে আর কিছুই বাকি থাকে না। মেহজাবীনকে ভীষণ ভালোবাসে সে, কীভাবে ওকে ফেলে যেতে পারল মেহজাবীন। মাহমুদ সব সময়ই খুব চাপা স্বভাবের একজন মানুষ। প্রতিবাদ করার শক্তি, সাহস কোনো কিছুই ওর নেই। শুধু পারে নীরবে-নিভৃতে বুকের ভেতর কষ্ট চেপে রাখতে।
কানাডা গিয়ে নতুন জীবন শুরু হয় সবার। মাহের দেশ আর বাবাকে ছেড়ে ওখানে গিয়ে ভীষণ মনমরা হয়ে থাকে। ভাস্করের মেয়ে দুটোর সাথেও মেহজাবীনের প্রায়ই কথা-কাটাকাটি হয়। ভাস্করও আর আগের মতো নেই। দেশে থাকতে কখনোই এত পরিশ্রম করতে হয়নি মেহজাবীনকে। এখানে সে কিসের টানে কী পেতে এসেছে, এটা নিয়ে মেহজাবীন ভীষণভাবে ভাবতে থাকে। ভাস্করের সব সময়ই বাইরের দিকে মনোযোগ বেশি ছিল। কানাডায় গিয়ে সেটা আরো বেড়ে যায়। সংসারে ঝগড়াঝাটি, হইচই লেগেই থাকে সারাক্ষণ। কেউ কারো কথা শুনতে চায় না। মেহজাবীন ভাস্করকে বলে, মেয়ে দুটোকে তাদের মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিতে। তাদেরকে দেখাশোনার ভার সে নিতে পারবে না। ঘরে-বাইরে এত কাজ করে সে হাঁপিয়ে ওঠে। এভাবে বিভিন্ন ঝুটঝামেলার মধ্যে কেটে যায় কয়েক বছর। মাহের টিনএজে পা দেওয়ার সাথে সাথে তারও কথাবার্তা, চালচলন সব বদলে যায়।
মাহের তার মা ছাড়া আর কাউকেই মেনে নিতে চায় না ওই সংসারে। যে সোনার হরিণের খোঁজে মেহজাবীন মাহমুদকে ছেড়ে এসেছিল, তার খোঁজ সে আর পায় না। ভীষণ মন খারাপ করে মেহজাবীন। মাহমুদের কাছ থেকে চলে আসার সিদ্ধান্ত তার ভুল ছিল। এটা সে এখন হাড়ে হাড়ে টের পায়। মনে মনে ভাবে, হয়তো মাহমুদের অভিশাপ লেগে গেছে তার ওপর। সে আসলে মাহমুদকে ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি। মাহমুদের সাথে অনেক অন্যায় করে ফেলেছে সে নিজের অজান্তে।
ভাস্কর আর তার মেয়েদের লাগামহীন জীবনযাপনে মেহজাবীন প্রচণ্ড ক্লান্ত হয়ে পড়ে। একবার প্রচণ্ড ঝগড়া হলে মেহজাবীন লুকিয়ে মাহেরকে নিয়ে দেশে চলে আসে। দেশে এসে তার বাবার বাসায় ওঠে। সিদ্ধান্ত নেয় কানাডা আর ফিরে যাবে না। পরিকল্পনা করে মাহেরকে তার বাবার কাছে দিয়ে দেবে।
মেহজাবীনের এসব হুটহাট ডিসিশনে ওর বাবা ভীষণ রাগ হন। তিনি সাফ জানিয়ে দেন, মেহজাবীনের কোনো সিদ্ধান্তের সাথে তিনি আর নেই, তার যা খুশি সে করুক। মেহজাবীনের মা ওর সাথে খুব একটা কথাবার্তা বলেন না আর দাদির আগের মতো আর হুঁশ থাকে না। একবার চিনতে পারলেও পরক্ষণেই ভুলে যান, প্রশ্ন করেন, আপনি কে, কোথা থেকে এসেছেন ইত্যাদি। মেহজাবীন দেশে এসেও শান্তি পাচ্ছে না। কেউই তাকে সাহায্য করতে রাজি হচ্ছে না।
অনেক কষ্টে মাহমুদের অফিস থেকে ওর বাসার ঠিকানা জোগাড় করে মেহজাবীন। কানাডা যাওয়ার পর থেকে ওর সাথে আর কোনো যোগাযোগ রাখেনি সে। ভেবেছিল, ফোনে কথা না বলে অফিসে গিয়ে সরাসরি কথা বলবে, অফিসে গিয়ে শোনে, মাহমুদ ছুটিতে বাসায় আছে, ওর শরীর ভালো নয়। সেদিন সন্ধ্যায় মাহেরকে নিয়ে মাহমুদের বাসায় যায় মেহজাবীন। কলিংবেল চাপ দিতেই বুয়া এসে দরজা খোলে।
-কাকে চাই?
-মাহমুদ সাহেব আছেন?
-হ আছেন, বসেন।
একটু পরেই মাহমুদ আসে।
-আরে মেহজাবীন, কোত্থেকে? কবে এলে?
-এই তো দুদিন হয়েছে, তোমার অফিসে গিয়েছিলাম, শুনলাম তুমি অসুস্থ, ছুটিতে আছ।
-ফোন দিতে।
-ফোনে কথা বলতে ইচ্ছে হলো না, আর ফোনে সব কথা আলাপও করা যাবে না।
-মাহের আসো, বাবার কাছে আসো।
-যাও বাবার কাছে যাও। এখন থেকে বাবার কাছেই থাকবে তুমি।
-মেহজাবীন, কী হয়েছে বলো তো?
-মনে আছে, যাওয়ার সময় তুমি একটা চিঠি দিয়েছিলে। লিখেছিলে, আমার কোনো প্রয়োজন হলে তোমার দরজা আমার জন্য খোলা। আমার এখন সেই খোলা দরজার খুব প্রয়োজন, মাহমুদ।
-আচ্ছা, সব কথা পরে হবে, চলো আমরা একসাথে খাওয়াদাওয়া করি।
সেদিন কিছু কথাবার্তা সেরে মেহজাবীন ওর বাবার বাসায় ফিরে আসে মাহেরকে নিয়ে।
মাহমুদকে সবই খুলে বলে মেহজাবীন। তারপর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মাহেরকে ওর বাবার কাছে রেখে আসতে যায় মেহজাবীন। কিন্তু মাহেরের একটাই কথা, মা, আমি তোমাকে ছাড়া থাকব না। মেহজাবীন যতই বোঝাতে যায়, মাহের ততই অবুঝের মতো আচরণ করে। অবশেষে মাহের রাজি হলে মাহমুদ ওকে নিয়ে যায়।
মেহজাবীন মনে মনে কানাডা ফিরে যাওয়ার চিন্তা করতে থাকে। শুধু যাওয়ার আগে বড় ছেলে সাকলাইনকে দেখে যেতে চায় সে। কী ভাগ্য তার, সংসার তিনটা, ছেলে দুটো, কিন্তু কিছুই তার নাগালে নেই। একা একা ভাবে, সব দোষ কি তার একার? তার চাওয়া আর পাওয়ার মিল কখনোই হলো না কেন?
পনেরো দিন যেতে না যেতেই মাহমুদ একদিন ফোন দিয়ে মেহজাবীনকে যেতে বলে। মাহেরের প্রচণ্ড শরীর খারাপ। মেহজাবীন দৌড়ে মাহমুদের বাসায় যায়। মাহেরকে ডাক্তার দেখিয়ে সব ওষুধপত্র ঠিকঠাক করে বাড়ি ফিরতে চাইলে মাহের খুব কান্নাকাটি শুরু করে।
-মা, আমরা তিনজন আগের মতো একসাথে থাকলে কী হয়, মা। এখন তো বাবার বড় বাসা, গাড়ি সবই আছে। এখন তো আর আমাদের অসুবিধা হবে না, মা।
-না মাহের, চাইলেই এখন আর আমি থাকতে পারব না।
মাহমুদ বলে, আজকে রাতটা থাকো মেহজাবীন, মাহেরের শরীরটা ঠিক হোক।
রাতে মেহজাবীন বাধ্য হয়েই মাহমুদের বাসায় থাকে মাহেরের জন্য।
-আলমারিতে তোমার কাপড়চোপড় আগের মতোই আছে। চেঞ্জ করে ফেলো।
মেহজাবীন আলমারি খুলে দেখে, তাকে তাকে তার আর মাহেরের রেখে যাওয়া কাপড়চোপড় সাজানো রয়েছে। দেয়ালে এখনো টানানো আছে তাদের তিনজনের একটা ছবি। কী বুদ্ধিতে যে সে মাহমুদকে ছেড়ে গিয়েছিল, তা নিয়ে খুব আফসোস করতে থাকে মেহজাবীন।
পরের দিন মাহেরকে রেখে মেহজাবীন বাবার বাসায় চলে আসে। কানাডা যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকে। কিন্তু দেশে ফেরার পর থেকেই ভাস্কর তার ফোন ধরে না। এটা নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় মেহজাবীন। একসময় শুনতে পায়, ভাস্কর নাকি ডিভোর্সের প্রস্তুতি নিচ্ছে। মেহজাবীনের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। কী করবে বুঝে উঠতে পারে না।
মেহজাবীনের বাবা ওকে আশ্বস্ত করেন, ‘তুই চিন্তা করিস না মা, আমি কথা বলব ভাস্করের সাথে।’
ভাস্কর মেহজাবীনের বাবার ফোনও ধরে না। সকালে ঘুম থেকে উঠে ড্রয়িংরুমে চুপচাপ একা বসে থাকে মেহজাবীন। হঠাৎ কলিংবেলের শব্দ শুনে দরজা খুলতেই দেখে তার বড় ছেলে সাকলাইন এসেছে। দরজা খুলেই
মেহজাবীন ওর বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। বড় ছেলে মেহজাবীনকে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
-আমার জীবনটা এমন কেন রে, বাবা। এত কিছু থেকেও আমার কিছু নেই।
-কে বলল কিছু নেই, সবই আছে মা। আমি আছি, মাহের আছে। আমরা তো তোমার সন্তান, আমরা তো চাইলেও এই বন্ধন ছিঁড়তে পারব না।
সাকলাইন মেহজাবীনের হাতে তার বিয়ের কার্ড দেয়। মাহেরও এসেছে, মাহমুদ ওকে নামিয়ে দিয়ে অফিসে গেছে। মেহজাবীন দুই ছেলেকে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে আর বলতে থাকে, ‘সব ভুল আমার, সব ভুল আমার।’
তখনই ভেতরের রুম থেকে দাদির আওয়াজ পাওয়া যায়।
-না বেটি, তুমহারা কই কসুর নেহি হে, সব কসুর মেরা। সব কসুর মেরা।
 
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: 01711238078