রক্ষণশীল বঙ্কিম উদার বঙ্কিম

প্রকাশ : ১৬ জানুয়ারী ২০২৫, ২০:৩৯ , অনলাইন ভার্সন
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-৯৪) বাংলা সাহিত্যে প্রথম সার্থক উপন্যাস রচয়িতা। সাহিত্যসম্রাট হিসেবে খ্যাত এই মনীষী উপন্যাস রচনায় প্রখ্যাত ইংরেজ ঔপন্যাসিক স্যার ওয়াল্টার স্কটের রোমান্স-আশ্রয়ী ঐতিহাসিক উপন্যাসের আদর্শের অনুসারী ছিলেন। আবার তিনি বাঙালির জীবন ও আদর্শের সঙ্গে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য আদর্শের মিলন ঘটিয়ে মননশীল সাহিত্য, কথাসাহিত্য, দেশ ও দেশের কথা প্রভৃতি রচনার মাধ্যমে বাংলা এবং বাঙালিকে ঊনবিংশ শতাব্দীর জীবন ও প্রাণবাণীতে উদ্বুদ্ধ করেন। উপন্যাসের কথা বাদ দিলে সে সময়ে রামমোহন, বিদ্যাসাগর এবং বঙ্কিমচন্দ্র এই তিনজন বাঙালির জীবন ও আদর্শে এক নতুন আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। সামগ্রিকভাবে সমাজে জীবনাদর্শকে অগ্রবর্তী করেছিলেন পথের দিশারি হিসেবে। এ ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রভাব ছিল অগ্রণী ভূমিকায়। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বঙ্গ দর্শন’ (১৮৭২) এর মধ্য দিয়ে আত্মদর্শনের মূলমন্ত্র খুঁজে পেয়েছিল পুরো বাঙালি সমাজ। তা সত্ত্বেও কোথাও একটা অপূর্ণতা থেকেই যায়। বঙ্কিমচন্দ্রের ক্ষেত্রেও এই বাস্তবতার কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি। সমকালীন জীবন-ভাবনা ও ঐতিহ্য-ভাবনায় বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসগুলো সমৃদ্ধ হয়েও সমকালীন মানসের সংস্কার আকাক্সক্ষা এবং বৃহত্তর জীবনে উত্তীর্ণ হওয়ার আকুতি ও অভিপ্রায় তাতে ততখানি পূর্ণতা লাভ করতে পারেনি। এই একটি জায়গায় এসেই বঙ্কিম মানসে জেঁকে বসেছে ধর্মীয় সংস্কার কিংবা প্রচলিত সামাজিক বিধিবিধান অথবা অন্ধ সংস্কার। এখানে তিনি হয়ে উঠেছেন পুরোপুরি রক্ষণশীল। অন্যভাবে বলতে গেলে বলা যায়, উদার বঙ্কিম মানসের অনুদার এই দিকটি তার প্রায় সকল উপন্যাসেই লক্ষণীয় বিষয় হয়ে উঠেছে। এ ক্ষেত্রে তার ‘সীতারাম, দেবী চৌধুরাণী, বিষবৃক্ষ ও কৃষ্ণকান্তের উইল’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তা সত্ত্বেও বলা যায়, যেদিন জধলসড়যধহ’ং রিভব এর লেখক ইংরেজি বর্ণফলক ও বর্ণতুলিকা পরিত্যাগ করে স্বদেশি ইতিহাসের সঙ্গে অপূর্ব কল্পনার মিশ্রণ ঘটিয়ে চারু চিত্রাবলি অঙ্কন করার প্রয়াস পেলেন, সেদিন বাংলার গদ্য সাহিত্যের এক নতুন যুগের সূচনা হলো। যিনি বৈদেশিক ভাষায় দেশীয় গার্হস্থ্য সমাজের চিত্র অঙ্কন করছিলেন, তিনিই আবার স্বদেশীয় ভাষায় আপন কল্পলোকের নর-নারীর সৃষ্টি করলেন।
বঙ্কিমচন্দ্রের সর্বশ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব হচ্ছে তিনি মানুষকে যথার্থই আবিষ্কার করতে পেরেছেন। অর্থাৎ যে মানুষ অন্তরের অপরিসীম নিঃসঙ্গতা সত্ত্বেও কঠিন জয়যাত্রার পথে নিজেকে বিকশিত করার সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করেছে, সেই মানুষকে তিনি আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন। তার রোমান্স ও উপন্যাসে আমরা এই মানুষের সঙ্গেই পরিচিত হই। সামাজিক উপন্যাস হোক, আধা ঐতিহাসিক, আধা কাল্পনিক কাহিনিতেই হোক অথবা বিশুদ্ধ ঐতিহাসিক উপন্যাসেই হোক, সর্বত্রই তার নায়ক-নায়িকার মধ্যে এই স্বাতন্ত্র্যধর্মিতা পরিলক্ষিত হয়। বেদনা ও বাস্তব জীবনের সমবেদনাহীন পরিবেশের বিরুদ্ধে একটা অব্যক্ত বিদ্রোহের সুর দেখা যায়। জীবনের প্রতি আকর্ষণ তাদের প্রবল, জীবনকে উপভোগ করার আকাক্সক্ষাও অপরিসীম এবং বেঁচে থাকা কিংবা বেঁচে থাকার প্রচেষ্টাই যেন কত আনন্দময়, কত মধুর তাদের কাছে। এমন এক সামাজিক পরিবেশের সন্তান তারা, যে পরিবেশে বাঁচতে জানা এবং বাঁচতে শেখার জন্য তারা চালিয়ে যাচ্ছে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা। অর্থাৎ এমন এক সৃষ্টিশীল, নব অনুপ্রেরণায় চঞ্চল পরিবেশে তাদের জন্ম, যেখানে নতুন সংস্কৃতি, নতুন জীবন দর্শন গড়ে উঠতে শুরু করেছে। এমনই পরিবেশে জীবনকে জানা, দেখা, আর উপভোগ করাই হয়ে ওঠে মূলকথা। তাই বলতে হয়, কর্মটাই যেন পরম বিস্ময়ের বিষয়। এই মানুষকেই ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র তার সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা দিতে চেয়েছেন এবং তা সফল হয়েছে। তার এই মানসজাত নায়ক-নায়িকারা প্রত্যেকেই যেন জীবনের অপূর্ব আস্বাদের কথা, জীবনকে নবরূপে সৃজন করার চাঞ্চল্যের কথা, আমাদের কানে কানে বলে যায়। মানবজীবন তথা সংস্কৃতি সেখানে সৃষ্টির পথে। এ কারণে বঙ্কিমচন্দ্রের সৃষ্ট চরিত্রগুলোর সঙ্গে বর্তমান পচনশীল সমাজের অথবা শরৎচন্দ্রের সৃষ্ট চরিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে বিরাট পার্থক্য। বঙ্কিমচন্দ্রের যুগে ক্রমেই মানুষের ব্যবহারিক জীবনের ব্যর্থতা দেখা দিতে শুরু করলেও জীবনের প্রতি আকর্ষণ কিংবা জীবনের স্বাদ গ্রহণের বাসনা মানুষ ভুলে যায়নি। জীবনকে তারা নিরঙ্কুশভাবেই উপভোগ করতে চায়, জীবনের অবলুপ্তি তারা চায় না। তারা যে জীবনকে ভালোবেসেছে, সেই কথাটিই জানিয়ে দিতে চায় সকলকে। তাদের প্রাণশক্তি প্রবল, তাদের মন বিকারগ্রস্ত কিংবা পঙ্গু নয় এবং তার গতি অদম্য। শরীরও তাদের দুর্বল নয়, জীবনের প্রতি তাদের আকর্ষণ মুক্তোঝরা দিনের আলোর মতোই উজ্জ্বল এবং প্রাণবন্ত। মোটকথা বঙ্কিমচন্দ্রের সৃষ্ট চরিত্রগুলোর মধ্যে কোনোটাই কাপুরুষ কিংবা দুর্বল মনের নয়। তাদের কারোরই ব্যক্তিত্বের কিংবা পৌরুষের কোনো ঘাটতি পরিলক্ষিত হয় না। বিশেষ কোনো কারণে কিংবা বিশেষ কোনো পরিস্থিতিতে হয়তো নিন্দিত হতে পারে, কিন্তু তাই বলে কোনোভাবেই হীন বা ক্ষুদ্র হিসেবে চিহ্নিত করার সুযোগ সেখানে নেই। আত্মসম্মান বিচারে তারা ম্রিয়মাণ নয়। চরিত্র নিরূপণ ও চরিত্র গঠনের এই বলিষ্ঠতা এবং দৃঢ়তা সেই যুগধর্মেরই লক্ষণ, আর সে কারণেই বঙ্কিমচন্দ্রের মানস চরিত্রগুলোও ক্ষুদ্র অথবা হীন অথবা শক্তিহীন হতে পারে না। উদার মানবিক গুণে তারা পরিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ। ভোগে যেমন তাদের আনন্দ আছে, তেমনি       চরম মূহূর্তে তারা অস্বীকার করতেও কুণ্ঠিত হয় না।
বঙ্কিমচন্দ্রের সমস্ত উপন্যাস ও রোমান্সে জীবনের প্রতি প্রবল আকর্ষণ, বাঁচার এই আনন্দের পরিচয় সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তার নির্মিত প্রতিটি চরিত্রই জীবনের এই চেতনায় প্রাণবন্ত। এদিক থেকে বিভিন্ন চরিত্রের মধ্যে সাদৃশ্যে বাইরের অঙ্গসৌষ্ঠবের দিক হতে যতখানি, ভাবের দিক হতে, মানস জীবনের দিক হতে তা আরও অনেক বেশি। কিন্তু প্রচলিত সামাজিক সম্পর্ক এই মানুষকে আত্মস্ফূর্তির যথোপযুক্ত সুযোগ দিচ্ছে না; বরং তার মনুষ্যত্বকে উদার অভ্যর্থনা না জানিয়ে বাধাগ্রস্ত করছে। এ কারণে ব্যক্তিমন, পরিবেশের সঙ্গে তার কোনো সামঞ্জস্য খুঁজে পায়নি। এক হৃদয়হীন পরিবেশের মধ্যে আবদ্ধ দেখতে পায় নিজেকে, যে পরিবেশ তার সুখ-সমৃদ্ধি ও মনোবেদনার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে নিজস্ব নিয়মের গণ্ডিতেই প্রবাহিত হচ্ছে, সেই প্রবাহের মধ্যে নিজের জীবনের কোনোরূপ স্ফূর্তি দেখতে না পেয়ে সহজেই সে এই প্রবাহ থেকে দূরে সরে যায় এবং আত্মস্ফূর্তির আকুতিতে চঞ্চল হয়ে ওঠে।
কতলুখাঁর কাম কণ্টকাকীর্ণ প্রাসাদের বিলাসব্যসনের মধ্যেও আয়েশা স্বাতন্ত্র্যধর্মী, তার হৃদয়ানুভূতি প্রকাশের জায়গা নেই এবং তার একাকিত্বই একদিন জগৎসিংহের কাছে নিজেকে প্রকাশ করে ফেলে। অথচ রাজপ্রাসাদের দুর্নীতির মধ্যে আত্মনিমজ্জন করা তার পক্ষে ছিল খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের আয়েশা তা করতে পারে না। এমনকি ওসমানও নিঃসঙ্গ আয়েশাকে বলেছে, ‘আমি আশালতা ধরিয়া আছি, আর কতকাল তার তলে জল সিঞ্চন করিব।’ হেমচন্দ্র তার প্রেমাস্পদকে হারিয়ে দিগ্্ভ্রান্ত আর ‘কণ্টকে গঠিল বিধি মৃণাল অধমে।’ তিলোত্তমা, ভ্রমর, শৈবলিনী, রজনী, রোহিনী, কুন্দ প্রত্যেকেই তাদের নিজ নিজ পরিবেশের মধ্যে একা, আত্মীয়হীন। তাদের সকলের কথাই রোহিনীর এই উক্তির মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। ‘রাত্রিদিন দারুণ তৃষা, হৃদয় পুড়িতেছে, সম্মুখে শীতল জল। কিন্তু ইহজন্মে সে জল স্পর্শ করিতে পারিব না। আশাও নাই।’ আর অমরনাথ বলছে, ‘আমার রাজ্য লইয়া আমি সুখী হইতে পারি না কেন? জড়জগৎ, অন্তর্জগৎ কি জগৎ নয়? আপনার মন লইয়া কি থাকা যায় না? তোমার বাহ্য জগতে কয়েকটি সামগ্রী আছে, আমার অন্তরে কীবা নাই? আমার অন্তরে যা আছে, তাহা তোমার বাহ্য জগৎ দেখাইবে সাধ্য কী?’ বহুবিধ কর্মে এবং আত্মজয়ের সংগ্রামে নিয়োজিত প্রতাপের মনের গোপন কথাও ঠিক তা-ই। এই নিঃসঙ্গতা বোধ সমষ্টি ক্রিয়ায় নিয়োজিত আনন্দমঠের সন্তানদের মধ্যেও একইভাবে হতে দেখা যায়। তাদের একটি গানের একটি লাইন এই ‘তুমি কার কে তোমার কেন এসো সঙ্গে।’ এই চরিত্রগুলোর প্রত্যেকের মধ্য দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের সমকালীন সমাজের মানুষের নিঃসঙ্গ জীবনের অপ্রকাশিত কাহিনির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। যে কথা আর কাউকেই বলা যায় না, যে কথা কেবল মনই মনকে বারবার শুনাতে চায়, শুনিয়ে সান্ত্বনা লাভ করে, সে কথাই জীবনের প্রতি অনাবিল মোহসজ্ঞাত-এই দুঃখবোধই বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের নায়ক-নায়িকার মধ্যে কখনো-বা স্ফুট, কখনো-বা অস্ফুটভাবে জীবন্ত হয়ে আছে। তাদের প্রত্যেকের জীবনেই বিদ্যমান কল্পনা ও বাস্তবতার বিরোধ। অধিকাংশের জীবনই না পাওয়ার বেদনায় ধূসর, অতৃপ্ত আকাক্সক্ষার চাপে মুহ্যমান, আর যারা কাহিনির পরিসমাপ্তিতে সুখের স্পর্শ লাভ করেছে অথবা যাদের জীবন ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার ইঙ্গিতে মুখর হয়ে উঠেছে। তারাও দীর্ঘদিনের বঞ্চনা এবং কঠোর পরীক্ষার পর শিল্পীর একান্ত পক্ষপাতিত্বের জন্যই অনেক সময় এই পুরস্কার লাভ করেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের প্রত্যেকের জীবনের কঠোর অভিজ্ঞতা ও দুঃখ ভোগের ভেতর দিয়ে, সীতারামের মাধ্যমে শিল্পীর এই আকুতি ‘হায় তোমার আমার কি নূতন মিলিবে না? তোমার আমার কি শ্রী মিলিবে না?’
বঙ্কিমচন্দ্রের পুরুষ চরিত্রগুলোও শক্তিমান, বীর্যবান, বুদ্ধি ও তেজে প্রদীপ্ত, অঙ্গসৌষ্ঠবে তারা আকর্ষণীয়, আর তার স্ত্রী চরিত্রগুলোও অত্যন্ত স্বাভাবিক এবং সহজভাবে পাঠককে আকৃষ্ট করে। তার পাত্র-পাত্রী প্রত্যেকেই সৃজনীশক্তিতে উদ্বেল। তাদের মধ্যে যে ভোগের শক্তি রয়েছে, তাদের হৃদয়ে যে প্রেম এবং ত্যাগের শক্তি রয়েছে, এককথায় জীবনকে উপলব্ধি করার যে প্রেরণা রয়েছে, তা নিজেকে প্রকাশ করার জন্য চঞ্চল হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই উপলব্ধির পথে আসে দুর্জয় বাধা, যা তাদেরকে লক্ষ্য থেকে সরিয়ে রেখেছে অনেক দূরে। এ বাধা অতিক্রম করা যাবে না। দুর্লঙ্ঘ, এ ধরনের একটা গোপন চেতনা তাদের অনেককেই সর্বদা করেছে পীড়িত। আর এই চেতনা থেকেই তাদের দুঃখবাদের জন্ম নেয়, কী যেন নেই, মরীচিকার মতো দূর হতে কী যেন আকর্ষণ করছে অথচ কোনোকালেই যেন তা উপলব্ধির স্তরে এসে ধরা দেবে না, কোথায় যেন এক অজানা অসম্পূর্ণতা গোপনে অসার করে রেখেছে জীবনকে। পৃথিবীর অনন্ত ঐশ্বর্য ভোগ করার কোনো সুযোগই যেন কোনোকালেই আর আসবে না। জীবনের মূল্য যেন অস্বীকৃত, এই চেতনাই তার পাত্র-পাত্রীকে নিজের সম্পর্কে এবং প্রতিকূল পরিবেশ সম্পর্কে সজাগ করে তুলেছে।
কিন্তু এই চেতনা তাদের কাউকে কখনো ক্লান্ত, অবসন্ন করতে পারেনি। তাদের অন্তরের গভীর মুক্তি চেতনা এবং অসীম প্রাণপ্রাচুর্য তাদেরকে এই প্রতিকূল পরিবেশের বিরুদ্ধে কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত করেছে এবং প্রতিবেশের বুকে অম্লান স্বাক্ষর স্থাপন করে নিজেকে প্রকাশ করার প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করেছে। উপন্যাসে এই সংগ্রাম ব্যক্তি বনাম প্রচলিত সামাজিক ধর্ম ও বাধা-নিষেধের সংগ্রামে অভিব্যক্ত হয়েছে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে শিল্পীর অন্তর্নিহিত সংরক্ষণশীলতা প্রচলিত সমাজধর্মকে নির্দোষ ও পবিত্র বলে চিত্রিত করায় ব্যক্তির সংগ্রাম যথার্থ মর্যাদা লাভ করতে পারেনি এবং নীতিবিরুদ্ধ আচরণরূপেই তা অঙ্কিত হয়েছে (যেমন কুন্দ-নগেন্দ, রোহিনী-গোবিন্দলাল, প্রতাপ-শৈবালিনী) সম্পর্ক, কিন্তু তা সত্ত্বেও কুন্দর অব্যক্ত আকুতি, রোহিনীর অবিচল সংকল্প এবং প্রতাপের অকলঙ্ক আত্মত্যাগের মধ্যে একটা নতুন আবেগ, নিগূঢ় আত্মঘোষণার সুরই ব্যঞ্জনা লাভ করেছে।
বঙ্কিমচন্দ্র মানুষকে তার এই সংগ্রামশীল মহিমায় আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন। যেমন বুঝতে পেরেছিলেন তার পরাভবকে, তেমনি অনুভব করতে পেরেছিলেন তার শক্তিকেও। যার চাওয়ার এবং পাওয়ার ক্ষমতা আছে, হারানোর জন্যও তাকে আবার প্রস্তুত থাকতে হয়। কিন্তু এই পরাজয়ের মুখে সেই আত্মগ্লানি, অপরাধ অথবা অক্ষমতার জন্য শোক বা বিলাপ করতে বসে না অথবা বিষাদে অবসন্ন হয়ে পড়ে না। তার পরাজয় চেতনা এই অনুভূতি হতেই জন্ম নেয়, যার কাছে তার পরাজয় তাকে জয় করা তার ক্ষমতার অতীত; সুতরাং তার পরাভবের জন্য সে নিজে দায়ী নয়। সংগ্রামের মধ্যেই সে শক্তিমান।
বঙ্কিমচন্দ্র তার মুক্তি পিপাসাকেই সমকালীন মানুষের গোচরীভূত করতে প্রয়াসী হয়ে উঠেছিলেন। তৎকালীন মানুষের অনুভূতিকে জাগিয়ে, তার বুদ্ধিকে উদ্দীপ্ত করে, তার জড়তা ও আচ্ছন্নতাকে নির্মমভাবে আঘাত করে তিনি তার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন। নর-নারীর একনিষ্ঠ প্রেম ও ইন্দ্রিয় সংযমের অভাবে সর্বনাশ, স্বার্থত্যাগ ও আত্মবিসর্জনের অপূর্ব আদর্শ এবং স্বার্থপরতার পঙ্কিল চিত্র প্রভৃতি পাপ-পুণ্যের ও ভালো-মন্দের কত বিচিত্র চিত্র নানা পারিপার্শ্বিকের প্রভাবে বিভিন্ন মূর্তিতে তার উপন্যাসে জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছে। আর তাই অন্তরঙ্গ পরিচিতের ন্যায় আমাদের জীবনের নিত্যদিনের সহচর হয়েছে। বাংলার এবং বাঙালির ঘরে ঘরে ইন্দ্রিয়ের অসংযমী যে ‘বিষবৃক্ষ’ নতুন আবহাওয়ায় দ্রুত গতিতে বেড়ে উঠছিল, তার যথার্থ ও বিষময় ফলের জীবন্ত চিত্র অঙ্কন ও প্রদর্শন করে বঙ্কিমচন্দ্র তার উদ্দেশ্য সাধনে যতটা সহায়তা করেছিলেন, কোন নীতি শিক্ষকের প্রচারে তা ততটা হতো না এ কথা নিশ্চিত করেই বলা যেতে পারে। তার বিভিন্ন উপন্যাসে, বিভিন্ন নায়ক-নায়িকা চরিত্রের চিত্রে পুরুষ ও নারীর যে মহান ও বিচিত্র আদর্শ ফুটে উঠেছে, তা আমাদের জীবন চলার পথনির্দেশে ধ্রুবতারার মতো উজ্জ্বল হয়ে আছে। আমাদের সামাজিক জীবনের কত দিকই না বঙ্কিমচন্দ্রের বিচিত্র তুলির আঁচড়ে উজ্জ্বল বর্ণে অঙ্কিত হয়েছে এবং তার প্রতি আমাদের সহানুভূতি ও মনোযোগ আকৃষ্ট করেছে। ‘সীতারাম’ ও ‘দেবী চৌধুরানী’-তে হিন্দুধর্মের সারতত্ত্ব যেমন যুগের উপযোগী আকারে ও সাধনের বোধগম্য ভাবনায় আত্মপ্রকাশ করেছে, প্রাচীন শাস্ত্রগ্রন্থের বহুল প্রচারেও তা সম্ভব হতো কি না এ ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের দু-একটি চরিত্রের আলোচনাতেই তা আরও পরিষ্কার হয়ে ওঠে। তিনি তার উপন্যাসে ব্যক্তির সুখ ও ধর্মকে পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও সামাজিক ব্যবস্থার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করেছেন। তাই বঙ্কিমচন্দ্র ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের পরিপূর্ণ স্ফূর্তিকে স্বীকার করতে পারেননি। বিধবার প্রতি বঙ্কিমচন্দ্রের সহানুভূতি থাকলেও তিনি কুন্দনন্দিনী ও রোহিনীর জন্য কোনো পথ খুঁজে বের করতে পারেননি।
কৃষ্ণকান্তের উইলের প্রধান চরিত্র রোহিনী। গোবিন্দলালকে রোহিনী অকৃত্রিম এবং অকপটেই ভালোবেসেছিল, এ প্রেমের প্রতিদান যে সে পায়নি, তাও নয়, কিন্তু হিন্দুধর্মের সুনীতির আদর্শে এ প্রেমের অধিকার তার নেই, এ ভালোবাসা তার প্রাপ্য নয়। সে পাপিষ্ঠা, তাই পাপিষ্ঠাদের জন্য নির্ধারিত নীতির আইনে তার বিশ্বাসঘাতিনী হওয়া চাই এবং হলোও সে তাই। রোহিনী ও গোবিন্দলাল গভীর প্রেমের সম্পূর্ণতা ও বিশ্বস্ততা লাভ করতে পারেনি। লালসার পরিতৃপ্তির সঙ্গে সঙ্গে এসেছে ক্লান্তি, আকর্ষণের পশ্চাতে এসেছে বিতৃষ্ণা। গোবিন্দলালের দিক থেকে এই চিত্র অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। গোবিন্দলাল নিজে সংগীতবিদ্যায় যথেষ্ট নৈপুণ্য লাভ করেছিলেন, কিন্তু রোহিনী যখন দানেশ খাঁর সঙ্গে গান শিখছিলেন, তখন তিনি পাশের ঘরে অর্ধ অন্যমনস্কভাবে নভেল পড়ছিলেন। তখনো গোবিন্দলাল রোহিনীর প্রতি আকৃষ্ট, তার রূপে মুগ্ধ, কিন্তু তারা পরিপূর্ণ সুখ লাভ করতে পারেনি।
সীতারামের সীতারাম ও শ্রীর চরিত্রের কথাও এখানে বলা যেতে পারে। স্বামী শ্রীকে পরিত্যাগ করলেও তার অনুরাগ ও ভক্তির কোনো কমতি হয়নি। সে স্বামীর উদ্দেশে ভালোবাসা ও সেবা পাঠিয়ে মনকে প্রবোধ দিতে চেষ্টা করেছে। তারপর জ্যোতিষ গণনার কথা শুনে নিজেই স্বামীকে পরিত্যাগ করেছে ও সন্ন্যাসিনী জয়ন্তীর কাছে সন্ন্যাস শিক্ষা গ্রহণ করেছে। এরপর যেদিন আবার স্বামী সন্দর্শনের ডাক এল, সেদিন শ্রীর আর পূর্বের উৎসাহ নেই বরং স্বামীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার ব্যাপারে তার মাঝে অনিচ্ছাই প্রভাব বিস্তার করল। এই যে অনুরাগিনী স্ত্রী থেকে সন্ন্যাসিনীতে পরিবর্তন, শ্রীর জীবনে এটাই সবচেয়ে বড় কথা। কেমন করে অদম্য আসক্তি গভীর ঔদাসীন্যে পরিণত হলো, নারীহৃদয়ের সেই দুর্জেয় রহস্যই ঔপন্যাসিক উদ্্ঘাটন করবেন। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র এই রহস্য উদ্ঘাটন তো দূরের কথা, তা একেবারে বাদই দিয়েছেন। বিরুদ্ধ প্রবৃত্তির সংগ্রামকে বঙ্কিম তার উপন্যাসে আনেনইনি। পরে ‘চিত্তবিশ্রামে’ শ্রী যখন অধিষ্ঠিত, তখন তাকে জীবন্ত রমণী অপেক্ষা অনুভূতিহীন প্রতিমা বলে মনে হয়, রাজা দুর্বার আকাক্সক্ষা নিয়ে তার কাছে সর্বদা উপস্থিত, সে শুধু রাজাকে গীতোক্ত নিস্কাম ধর্মের মহিমা শুনিয়েছে। কারও সংযম সম্পূর্ণ নয়। পাষাণেরও ক্ষয় হয়। তাই শ্রীও নিজের ওপর আস্থা হারাতে শুরু করেছে, সে জয়ন্তীকে বলেছে, ‘পলায়ন ভিন্ন তো উপায় দেখি না। কেবল রাজার জন্য বা রাজ্যের জন্য বলি না। আমার আপনার জন্য বলিতেছি। ...শত্রু, রাজা লইয়া বারো জন।’ এর পরই শ্রীর পলায়ন। তার হৃদয়ে কেমন করে প্রণয়ের আকর্ষণ পুনরায় সঞ্জীবিত হলো, কেমন করে চির নতুন অথচ চির পুরাতন আবেগে ধর্ম বুদ্ধির সঙ্গে বোঝাপড়া করতে লাগল তার কোনো চিত্র নেই। অথচ এই পরস্পরবিরোধী প্রবৃত্তির সংঘর্ষ ও সমন্বয়ই শ্রীর চরিত্রের গভীরতম রহস্য। বঙ্কিমচন্দ্র এই রহস্যের আভাস দিয়েছেন কিন্তু এর পরিপূর্ণ স্বরূপ প্রকাশ করেননি।
সীতারাম উপন্যাসের পরিধি খুব বিস্তৃত। একটি নারীর হৃদয়ের রহস্য যত গভীর ও বিচিত্রই হোক না কেন, তা প্রকাশ করার মতো অবকাশ এ উপন্যাসে নেই। বঙ্কিমচন্দ্র তার বিষবৃক্ষেই সর্বপ্রথম সমকালকে এবং সমসাময়িক সমাজকে স্পর্শ করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র নিজে উচ্চমধ্যবিত্ত সমাজের লোক ছিলেন, এ উপন্যাসেও তার নিজস্ব সমাজের চিত্র আঁকা হয়েছে। বাঙালি হিন্দু জাতির আদর্শের অনুসারী হয়ে তার শিল্পীমনের অভিব্যক্তি ঘটেছিল। বিষবৃক্ষে বঙ্কিম দূরস্থিত ইতিহাসের কাল বর্জন করে নিজ কালের জটিল প্রকৃতির সম্মুখীন হন। বলা যেতে পারে, বিষবৃক্ষে লেখক নিজ শক্তির ক্ষেত্রকে প্রসারিত করার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। কৃষ্ণকান্তের উইল এবং বিষবৃক্ষের ঘটনা প্রায় সমসাময়িক বলা যায়। কিন্তু কৃষ্ণকান্তের উইল অপেক্ষা বিষবৃক্ষের কাল লক্ষণকে স্পষ্টতই স্ফুটতর করে তোলা হয়েছে। সীমিতভাবে হলেও এই কাল লক্ষণে এবং পটভূমি পরিবেশে সমকালীন বাংলাদেশেরই এক উপন্যাসে উপস্থাপন করার চেষ্টা এতে লক্ষণীয়। বঙ্কিমের ব্যাপক সহানুভূতি বিষবৃক্ষে রূপায়িত হয়েছে আর কোথাও তেমন নয়। নীতিবাদী বঙ্কিম বিষবৃক্ষে কখনো কখনো পাপ বিশ্লেষকের ভূমিকায় উপস্থিত থাকলেও এবং মাঝে মাঝে নীতি প্রচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেও দেবেন্দ্রের জীবনের জটিলতা, হীরার প্রেম খাঁ সমস্তই প্রত্যক্ষ করেছেন শিল্পীর দৃষ্টিতে। এ উপন্যাসে সূর্যমুখী কেবল স্বামীগত প্রাণা সাব্ধী সহধর্মিণী নন, তিনি নগেন্দ্রের গৃহে সম্রাজ্ঞী। সূর্যমুখীর প্রগাঢ় প্রেম ও পতিব্রতা নগেন্দ্রনাথের চরিত্র বিষয়ে তাকে অন্তর্দৃষ্টি দান করেছিল। সূর্যমুখী গম্ভীরা প্রগলভা, একমাত্র পতিকে কেন্দ্র করে নিঃসন্তানা সূর্যমুখীর চিত্ত রয়েছে সূর্যমুখীর মতোই ঊর্ধ্বমুখী হয়ে। স্বামীর সঙ্গে স্বেচ্ছায় কুন্দের মিলন সংঘটনের মধ্যে ছিল একটা আত্মত্যাগের প্রচ্ছন্ন অথচ দুর্জয় অভিমান। ছিন্নমূল ব্রতীর ন্যায় দুদিনেই লুটিয়ে পড়লেন ভূমিতে। অভিমান তাকে গৃহত্যাগিনী করে ক্রমে নগেন্দ্রনাথকে মোহ প্রলুব্ধ করল। বঙ্কিমচন্দ্র তার উপন্যাসে দেখিয়েছেন সকল মানুষই সুখ কামনা করে কিন্তু কেউই পায় না। কেউই নিশ্চিত জানে না যে, সে কিসে সুখী হবে। কুন্দনন্দিনী ও নগেন্দ্রনাথ মনে করেছিল যে পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হলেই তারা সুখী হবে। কিন্তু তারা দেখল যে সকল সুখেরই সীমা আছে। বিয়ের অব্যবহিত পরে নগেন্দ্রনাথ মনে করেছেন, তিনি কত সুখী। পনেরো দিন পরে তার সন্দেহ হয়েছে তিনি কুন্দনন্দিনীকে ভালোবাসেন কি না, এক মাস পরে তার কাছে কুন্দনন্দিনীর সান্নিধ্য অসহ্য হয়ে উঠেছে। পাপের ক্ষয় করার শক্তি অনন্যসাধারণ, তা শুধু অপরকে নষ্ট করে না, পাপীকেও ধ্বংস করে। দেবেন্দ্র ও হীরার কাছে কুন্দ সম্পূর্ণ নিরপরাধ, এদের পাপে কুন্দ ধ্বংস হয়েছে কিন্তু দেবেন্দ্র ও হীরার কোনো সুখ হয়নি। পাপ তাদেরকে একেবারে ক্ষয় করে ফেলেছে। কুন্দের মৃত্যুর পর নগেন্দ্রনাথ ও সূর্যমুখী যখন পুনর্মিলিত হলেন, তখন একটি ক্ষুদ্র বালিকার মৃত্যুর স্মৃতি তাদের মাঝখানে পড়ল। বঙ্কিম-মানসে একটি মাত্র অনুদার দিক থাকা সত্ত্বেও বাংলা সাহিত্যের অপরাপর সকল দিক থেকেই তিনি এখনো অগ্রবর্তী। বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক উপন্যাস ‘দুর্গেশ নন্দিনী’র রচয়িতা বঙ্কিমচন্দ্র তার বাইশ বছরের সাহিত্যজীবনে রচনা করেছেন চৌদ্দটি উপন্যাস। এগুলো হলো দুর্গেশনন্দিনী (১৮৬৫), কপাল কুণ্ডলা (১৮৬৬), মৃণালিনী (১৮৬৯), বিষবৃক্ষ (১৮৭৩), ইন্দিরা (১৮৭৩), যুগলাঙ্গুরীয় (১৮৭৪), রাধারাণী (১৮৭৫), চন্দ্রশেখর (১৮৭৫), রজনী (১৮৭৭), কৃষ্ণকান্তের উইল (১৮৭৮), রাজসিংহ (১৮৮১), আনন্দমঠ (১৮৮২), দেবীচৌধুরাণী (১৮৮৪) ও সীতারাম (১৮৮৭)। বাইশ বছরের সাহিত্যজীবনে বঙ্কিমচন্দ্রের রচিত এসব উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বিরাট পরিবর্তন এনেছে উপন্যাসের ধারায়, তার হাতেই উপন্যাস পেয়েছে সার্থকতা। আর এর মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলা, বাঙালি এবং সব ছাপিয়ে বাংলা প্রথম সার্থক ঔপন্যাসিক হিসেবে বিশ্ববরেণ্য। সবশেষে বলা যায়, তার তুলনা তিনি নিজেই। অর্থাৎ উদার বঙ্কিমচন্দ্র রক্ষণশীল হয়েও ‘বঙ্কিম’ বঙ্কিম-ই।
লেখক : সাবেক মহাসচিব, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)


 
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: 01711238078