জিমি কার্টারের সঙ্গে ৪০ মিনিট

প্রকাশ : ১৬ জানুয়ারী ২০২৫, ২০:৩৩ , অনলাইন ভার্সন
আজ থেকে ১৬ বছর আগের কথা। হিসাব কষে দেখলাম, তখন তার বয়স ছিল ৮৪ এবং আমার ছিল ৬৪। ১০ এপ্রিল ২০০৮। নেপালের সংবিধান পরিষদের ঐতিহাসিক নির্বাচনের দিনে বাংলাদেশ মানবাধিকার সমন্বয় পরিষদ (বামাসপ ) পর্যবেক্ষক দল তিনটি ভাগে ভাগ হয়ে পাহাড়ি এলাকাঘেরা ভক্তপুর, কাঠমান্ডু ও ললিতপুর জেলার মোট ২৫টি ভোটকেন্দ্র সরাসরি পর্যবেক্ষণ করি। ললিতপুর জেলার পটন দরবার স্কয়ার ভোটকেন্দ্রে কার্টার সেন্টারের প্রধান ও আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ হয়। স্কয়ার বারান্দায় জিমি কার্টারকে দেখে এগিয়ে গিয়ে পরিচিত হলাম । ‘বাংলাদেশ থেকে আমরা বামাসপের পক্ষ থেকে এসেছি, আমি বামাসপের প্রেসিডেন্ট।’ ‘ও-তুমি প্রেসিডেন্ট! ভালো-ওয়েলকাম, এই কথা বলে হ্যান্ডশেক করলেন। মতবিনিময়ে আন্তরিকতার সঙ্গে বললেন, আমাদের দেশের ড. ইউনূসসহ অনেককেই চেনেন। ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন সেটাও জানালেন। এছাড়া তিনি নিজ থেকেই প্রশ্নবোধক বাক্যে সহাস্যে বাংলাদেশের নির্বাচন বিষয়ে খোঁজখবর নেন। আমি বাংলাদেশের সে সময়ের নির্বাচনের সময় পর্যবেক্ষণে আসতে দাওয়াত দিলাম। তিনিও আসবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
এক ফাঁকে পটন দরবার ভোটকেন্দ্র দেখে বের হয়ে এসে দেখলাম, নিচতলার বারান্দায় পর্যটন দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে জনাব জিমি কার্টার। বেরোতে বেরোতে আমি বললাম, ‘স্যার, দেখা হবে আবার, আশা করি।’ এই বলে আমরা চারজনের টিম এগিয়ে যেতেই তিনি থামিয়ে বললেন, ‘হ্যালো প্রেসিডেন্ট, ওয়েট, আসো তোমার সঙ্গে একটি স্মৃতি-ছবি তুলি।’ তার সঙ্গে অনেক সহযোগী ছিল, তন্মধ্যে একজন ছবি নিলেন আমাদেরও আ হ ম ফয়সল ক্যামেরা দিয়ে ছবি নিলেন। জিমি কার্টার নিজেই আমার কাঁধে হাত রেখে হাসিমুখে দাঁড়ালেনÑ পোজ দিলেন। মুহূর্তেই আমার বামাসপের সঙ্গীরা অ্যাডভোকেট কাশেম, অ্যাডভোকেট শামছুদ্দীন ও প্রেমা আপা আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন, ফটোসেশন শেষ। একে অন্যের দিকে তাকিয়ে আবার কোলাকুলি করে অন্য কেন্দ্র পথে আমরা গাড়িতে উঠলাম। দেখলাম তার গাড়িবহরে তা ছয়-সাতটি গাড়ি হবে, ফ্ল্যাশসহ বিশেষ প্রোটোকলে তারাও পথ চললেন ।
সংবিধান পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে নেপালের নির্বাচন কমিশন সব ধরনের প্লানিং কনডাকটিং, মনিটরিং এবং কন্ট্রোল করার দায়িত্বে নিয়োজিত। রাজতন্ত্রের অবসান ও মাওয়াবাদীদের সঙ্গে সংগঠিত পরিস্থিতিতে ২০০৬ সালে সব পক্ষের শান্তি চুক্তির মাধ্যমে আয়োজিত এই নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে বাংলাদেশ মানবাধিকার সমন্বয় পরিষদÑ বামাসপ দেশের ১২টি সদস্য সংগঠনের সাতজন নারী এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খানসহ মোট ১৯ জন প্রতিনিধি, আমি টিম লিডার, নেপালে যাই। ১১ এপ্রিল নির্বাচনের পরের দিন। পর্যায়ক্রমে কার্টার সেন্টার, নেপালের এশিয়া ফাউন্ডেশনসহ দেশি- বিদেশি অন্যান্য সংস্থাও মতবিনিময় ও প্রেস ব্রিফিং করেন। এখানে জিমি কার্টার আমাকে দেখে হাসি হাসিভাবে বলেন, ‘হ্যালো মি. নোমান, আবারও দেখা হলো তোমার সঙ্গে। কী ও কেমন দেখলেÑ জিজ্ঞাসা করলে বললাম, “নেপালের সংবাদপত্রে নির্বাচন কমিশনের উদ্ধৃতিতে দেখা যায়, ভোট দানের হার ৭০ শতাংশ। নেপালের জনগণ আনন্দ ও উৎসবমুখর পরিবেশে এই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেছেন। আমরা যে ২৫টি ভোটকেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করেছি, সেখানে কোনো প্রকার বিশৃঙ্খলা দেখা যায়নি। একটি কেন্দ্রে দেখলাম মাওবাদী এক তরুণ যার প্রয়োজন তাকে পানি পান করাচ্ছেন। সারা দেশে শুধু একটি নির্বাচনী এলাকায় একজন প্রার্থী প্রতিপক্ষের আক্রমণে খুন হয়।
১ অক্টোবর ১৯২৪-এ জন্ম নেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের ৩৯তম প্রেসিডেন্ট কার্টারের ১০০ বছরের বর্ণিল জীবন সমাপ্তি ঘটল। তিনি ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে ঈশ্বরের কাছে চলে যান। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টদের মধ্যে জিমি কার্টার সবচেয়ে দীর্ঘ শত বছর জীবন পেয়েছিলেন ২০২৪, গত বছরের ১ অক্টোবর তার শততম জন্মদিন উদযাপন করা হয়। নিজের রাজনৈতিক ও ধর্মবিশ্বাসের বিষয়ে কার্টার বলেছিলেন, ‘আপনি ধর্মবিশ্বাস ও পাবলিক সার্ভিসকে আলাদা করতে পারেন না। আমি কখনোই ঈশ্বরের ইচ্ছা আর আমার রাজনৈতিক দায়িত্বের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখিনি । আপনি একটা ‘লঙ্ঘন করলে আরেকটাও লঙ্ঘিত হবে।’ প্রেসিডেন্ট থেকে বিশ্বমানবতাবাদী রাষ্ট্রনায়ক জিমি কার্টারের সহজ-সরল জীবনধারা এবং ন্যায়পরায়ণ আচরণ, খোলা মন তাকে আরো বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছিল । কার্টার তার নির্বাচন প্রচারণায় বলেছিলেন, ‘আমি আপনাদের সঙ্গে কখনো মিথ্যা কথা বলব না’। এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি একজন সৎ, নম্র ও খোদাভীরু ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রে মানবাধিকারের গুরুত্ব তুলে ধরেন।
১৯৭৬ সালের ডেমোক্র্যাটিভ কনভেনশনে তার দলের মনোনয়ন গ্রহণ করে সাধারণ অথচ বলিষ্ঠ ভাষায় ঘোষণা দেন, ‘আমার নাম জিমি কার্টার এবং আমি প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী। এ পরিপ্রেক্ষিতে ছোটবেলা থেকে একটা কথা শুনে এসেছি যে, ‘বাপের নামে আধা, দাদার নামে গাধা, নিজের নামে শাহাজাদা’। এখানেও আমি জিমি কার্টারের সাদামাটা পরিচিতি বক্তব্যটা তার নিজের ওপর আস্থা ও বিশ্বাসকে ফুটিয়ে তোলারই নামান্তর।
কার্টার, ১৯৭৭ সালে দায়িত্ব গ্রহণ করে ১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব শেষে ১৯৮২ সালে ‘কার্টার সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি শান্তি স্থাপন, সবার জন্য সমান অধিকার নিশ্চিতকরণ, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, রোগ নিরাময় ও দারিদ্র্য বিমোচনে নিজেকে নিয়োজিত করেন। তার প্রতিষ্ঠিত কার্টার সেন্টার ৪০টিরও বেশি দেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছে এবং বিভিন্ন দেশে জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে অসামান্য ভূমিকা রেখেছে। তিনি তার স্ত্রী রোজালিনের (মৃত) সঙ্গে দীর্ঘ ৭৭ বছর বিবাহিত জীবনে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করেছেন। রোজালিনের পাশেই ৯ জানুয়ারি ২০২৫ তাকে সমাহিত করা হয়। তিনিই প্রথম বিশ্বনেতা, যিনি জলবায়ু পরিবর্তনকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি ইসরাইলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের ওপর আক্রমণের অভিযোগ করেন। আন্তর্জাতিক সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধান, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের অগ্রগতি এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন কাজের জন্য তাকে ২০০২ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
জিমি কার্টারের মৃত্যুতে শোক জানিয়ে জো বাইডেনকে লেখা চিঠিতে ড. ইউনূস শেষ লাইনে লিখেন, ‘মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি তার অবিচল অঙ্গীকার আমাকে সব সময় উৎসাহিত করেছে।’ আমার আন্দাজ নোবেল বিজয়ী বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস কার্টার সেন্টারে এ উৎসাহিত হয়ে ‘ইউনূস সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করেছেন। নেপালের নির্বাচনের দিনগুলোতে তার সঙ্গে যতবারই দেখা হয়েছে, তিনি ছিলেন হাস্যোজ্জ্বল।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ডরূপ এবং গুসি আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার বিজয়ী।
 
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: +880  1338-950041