সোহরাওয়ার্দীর অখণ্ড বাংলার স্বপ্ন

ভারত তথা তৎকালীন কংগ্রেস নেতৃত্বের বিরোধিতা

প্রকাশ : ১০ জানুয়ারী ২০২৫, ২৩:২৭ , অনলাইন ভার্সন
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। ১৯৪৭ সালে অবিভক্ত ও স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। তার এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে ভারত, পাকিস্তান এবং একটি স্বাধীন বাংলা নামের রাষ্ট্রের জন্ম হতো। তবে কংগ্রেস ও ভারতের তৎকালীন নেতৃত্ব তার প্রস্তাবটি কখনোই মেনে নেয়নি, যা বাংলার ভবিষ্যৎ ইতিহাসে গভীর প্রভাব ফেলেছে।
১৯৪৬ সালের ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ এবং এর পরবর্তী সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সোহরাওয়ার্দীর অখণ্ড বাংলার ধারণাকে ত্বরান্বিত করলেও জওহরলাল নেহরু এবং সর্দার প্যাটেলের বিরোধিতা ও চক্রান্তের কারণে সেই স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। এমনকি কলকাতাকে ‘ফ্রি সিটি’ বা মুক্ত শহর হিসেবে ঘোষণা করার প্রস্তাবও কংগ্রেস নেতারা প্রত্যাখ্যান করেন।
অবশেষে ব্রিটিশ সরকারের দ্রুত ভারতবর্ষ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত এবং কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের অভ্যন্তরীণ বিরোধের কারণে সোহরাওয়ার্দীর প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভ হলেও সোহরাওয়ার্দীর স্বপ্নের অখণ্ড বাংলা বাস্তব রূপ পায়নি। যদি সেই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হতো, তবে বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন কিংবা স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রয়োজন হতো না।
ইতিহাসের নিরিখে দেখা যায়, ১৯৪৭ সালের প্রেক্ষাপট থেকে শুরু করে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ভারতীয় নেতৃত্ব বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী অবস্থান নিয়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা পাকিস্তানকে পরাজিত করার কৌশলের অংশ ছিল, ভালোবাসা নয়।
১৯৪৬ সালের ২৪ মার্চ ব্রিটিশ সরকার তাদের তিনজন মন্ত্রীকে ভারতবর্ষে পাঠায়। এটি ইতিহাসে ক্যাবিনেট মিশন হিসেবে পরিচিত। এই ক্যাবিনেট মিশনের লক্ষ্য ছিল কীভাবে ভারতবর্ষে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায়। এ জন্য ক্যাবিনেট মিশন কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে।
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ ঘোষণা করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ সরকারকে দেখানো যে মুসলিমরা তাদের দাবির ব্যাপারে অনড় ও একাত্ম। কিন্তু কংগ্রেস এবং হিন্দুরা বলল, এই কর্মসূচি তাদের বিরুদ্ধে। সোহরাওয়ার্দী তখন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। ১৬ আগস্ট তিনি সরকারি ছুটি ঘোষণা করলেন। কংগ্রেস ও হিন্দুরা বলল, তাদের বিরুদ্ধে কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য সোহরাওয়ার্দী এ কাজ করেছেন।
১৬ আগস্ট কলকাতায় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলো। এই দাঙ্গায় কম করে হলেও দুই হাজার মানুষ মারা যায়।
১৯৪৭ সালের ২৭ এপ্রিল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী দিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাধীন অখণ্ড বাংলার একটি প্রস্তাব তুলে ধরলেন। ব্রিটিশরা তখন ভারতবর্ষ বিভক্ত করে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি আলাদা রাষ্ট্রের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তুতি নিচ্ছে। লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভাইসরয় হিসেবে ভারতে এসে উপমহাদেশ ভাগ করার পরিকল্পনা পেশ করেন। জনাব সোহরাওয়ার্দীর প্রস্তাবটি ছিল অবিভক্ত এবং স্বাধীন বাংলার ধারণা। ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে যখন ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি আলাদা রাষ্ট্রের জন্ম হতে যাচ্ছে, তখন তিনি অবিভক্ত বাংলাকে নিয়ে আলাদা একটি রাষ্ট্রের ধারণা তুলে ধরেন।
সোহরাওয়ার্দীর সেই প্রস্তাব যদি বাস্তবায়ন হতো, তাহলে ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে তিনটি রাষ্ট্রের জন্ম হতো। বাংলা, আসাম এবং বিহার অঞ্চলের কয়েকটি জেলা নিয়ে বৃহৎ বাংলা নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের আকাক্সক্ষা ছিল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর। মুসলিম লীগের অন্য নেতাদের চেয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর চিন্তাভাবনা ছিল ভিন্ন ধরনের। সোহরাওয়ার্দী প্রথমে একটি কোয়ালিশন মন্ত্রিসভার কথা বলেছিলেন। কারণ তিনি ভাবছিলেন, একটি কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা হলে অবিভক্ত বাংলায় মুসলিমদের আধিপত্য থাকবে। কিন্তু হিন্দু মহাসভা এর তীব্র বিরোধিতা করে। ফলে সোহরাওয়ার্দীর সামনে একমাত্র বিকল্প ছিল কেন্দ্র থেকে আলাদা হয়ে অবিভক্ত স্বাধীন বাংলা গঠন করা। তার এই অখণ্ড স্বাধীন বাংলার ধারণাকে মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেসের কয়েকজন নেতা প্রথম দিকে সমর্থন দিয়েছিলেন। কিন্তু কংগ্রেসের মূল নেতৃত্ব এই চিন্তাকে কখনোই আমলে নেননি।
লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে জিন্নাহ বলেন, বাংলা যদি অবিভক্ত থেকে আলাদা রাষ্ট্র হয়, তাতে তিনি আনন্দিত হবেন। লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে জিন্নাহ বলেছিলেন, কলকাতা ছাড়া বাংলা কোনো কাজে আসবে না। এর চেয়ে ভালো তারা অবিভক্ত এবং স্বাধীন থাকুক। আমি নিশ্চিত যে তাদের সঙ্গে আমাদের ভালো সম্পর্ক থাকবে।
জিন্নাহর মনোভাব বুঝতে পরে সোহরাওয়ার্দী মনে করলেন, বাংলাকে বিভক্তির হাত থেকে রক্ষা করার এটাই মোক্ষম সুযোগ। ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে সোহরাওয়ার্দী বলেন, ১৯৪৭ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ভারতবর্ষ বিভক্ত করার বিষয়টি স্থগিত রাখতে।
১৯৪৭ সালের ২৩ মে ভারত বিভক্তির পরিকল্পনা নিয়ে বৈঠকে বসেন মাউন্টব্যাটেন। সে বৈঠকে জওহরলাল নেহরু বলেন, অবিভক্ত বাংলার প্রস্তাব তিনি মেনে নেবেন, যদি তারা ভারত ইউনিয়নের মধ্যে থাকে। নেহরু সতর্ক করে দেন, বাঙালি হিন্দুরা সোহরাওয়ার্দীর প্রস্তাবে বিভ্রান্ত হবে না। স্বাধীন বাংলা হলে সেখানে মুসলিম লীগের প্রাধান্য থাকবে এবং পুরো বাংলা পাকিস্তানের আওতায় চলে যাবে।
৩১ মে মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে দেখা করেন সোহরাওয়ার্দী। তিনি মাউন্টব্যাটেনকে জানান, অবিভক্ত বাংলা স্বাধীন করার বিষয়ে ভোটাভুটি করতে কংগ্রেস রাজি হবে না। এমন অবস্থায় দেশ বিভাগের সময় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা এড়াতে একটি মাত্র উপায় খোলা আছে। সে জন্য কলকাতাকে ‘ফ্রি সিটি’ বা ‘মুক্ত শহর’ হিসেবে ঘোষণা করার প্রস্তাব দেন সোহরাওয়ার্দী। কলকাতাকে ছয় মাসের জন্য ‘ফ্রি সিটি’ ঘোষণা করার একটি প্রস্তাব লর্ড মাউন্টব্যাটেন পাঠিয়েছিলেন কংগ্রেস নেতা সর্দার প্যাটেলের কাছে। কিন্তু সর্দার প্যাটেল সাফ জানিয়ে দেন, ছয় মাস তো দূরের কথা, ছয় ঘণ্টার জন্যও এটা সম্ভব নয়।
অখণ্ড স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য গণভোটের প্রস্তাবও করেছিলেন মি. সোহরাওয়ার্দী এবং বাংলার মুসলিম লীগ।
কিন্তু কংগ্রেস নেতারা এ প্রস্তাব সরাসরি খারিজ করে দেন। অবিভক্ত ও স্বাধীন বাংলার আশা তখন ক্ষীণ হয়ে আসে। কারণ কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ একমত না হলে স্বাধীন বাংলা নিয়ে নতুন কোনো প্রস্তাব আলোচনা করতে চাননি লর্ড মাউন্টব্যাটেন। লর্ড মাউন্টব্যাটেন কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ নেতাদের জানিয়ে দেন, দ্রুত ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ইন্ডিয়া বিল পাস হবে এবং দুটো আলাদা রাষ্ট্রের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। সুতরাং বাংলা ও পাঞ্জাব নিয়ে গণভোট আয়োজনের কোনো সম্ভাবনা থাকবে না। যদিও অবিভক্ত স্বাধীন বাংলার পক্ষে লর্ড মাউন্টব্যাটেন নমনীয় ছিলেন এবং সে জন্য তিনি লন্ডনকে বুঝিয়েছিলেন কিন্তু নেহরুর বিরোধিতার কারণে মাউন্টব্যাটেন সে পরিকল্পনা থেকে সরে আসেন। তখন ব্রিটিশ সরকারের লক্ষ্য ছিল, তাদের দ্রুত ভারতবর্ষ ত্যাগ করতে হবে। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ক্ষমতা হস্তান্তরের চূড়ান্ত দিন ধার্য করে ব্রিটিশরা। পাকিস্তান এর এক দিন আগে অর্থাৎ ১৪ আগস্ট স্বাধীনতা পায় এবং ক্ষমতা বুঝে নেয়। ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হলেও মি. সোহরাওয়ার্দীর স্বপ্নের অখণ্ড বাংলার প্রস্তাব অধরাই থেকে গেল সর্দার প্যাটেল ও জওহরলাল নেহরুর বিরোধিতা ও চক্রান্তের কারণে। সোহরাওয়ার্দীর প্রস্তাব অনুযায়ী বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম ১৯৪৭ সালে হলে তো আর ভাষা আন্দোলন তথা স্বাধীনতা আন্দোলনের দরকার হতো না। অর্থাৎ ভারত তথা কংগ্রেস অতীতে যেমন বাংলাদেশের শক্র হিসেবে কাজ করেছিল, বর্তমানেও তা-ই তারা করছে। ১৯৭১ সালে তারা বাংলাদেশকে ভালোবেসে সাহায্য করেনি। তারা পাকিস্তানকে হারাতে চেয়েছিল। তাই এখনো সময় আছে, আমাদের প্রকৃত শত্রু চিনতে হবে।
 
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: 01711238078