পরাধীনতার জিঞ্জিরাবদ্ধ ভারতীয় উপমহাদেশের পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার অন্তর্গত দেবানন্দপুর গ্রামের নুন আনতে পান্তা ফুরায় এক ব্রাহ্মণ পরিবারে অপ্রতিদ্বন্দ্বী কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। নিয়তিলাঞ্ছিত ও অভাবগ্রস্ত পরিবারের সদস্য শরৎচন্দ্রের শৈশব ও কৈশোর কেটেছিল অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট, অর্ধভুক্ত-অভুক্ত অবস্থায়। এফএ (ফ্যাকাল্টি অব আর্টস) পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার আগেই পারিবারিক দৈন্যদশা প্রকট আকার ধারণ করায় ফাইনাল পরীক্ষার ফি জোগানো তার পিতার পক্ষে সম্ভব হয়নি। অনন্যোপায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আনুষ্ঠানিক শিক্ষাজীবনের ইতি ঘটে এখানেই। আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় ছেদ পড়ার পর যৌবনের উল্লেখযোগ্য সময় শরৎচন্দ্র সন্ন্যাসী বেশে ভবঘুরের মতো ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে চষে বেড়ান ও বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। অবশেষে অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পর তিনি ১৯০৩ সালে মিয়ানমারে গমন করেন এবং রেঙ্গুনে অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেলের দপ্তরে করনিক পদে চাকরি লাভ করেন। জীবনের এ পর্যায়ে ভাগ্যলক্ষ্মী তার প্রতি মুখ তুলে তাকান এবং জগদীশ্বর প্রদত্ত সৃজনশীল প্রতিভার অধিকারী শরৎচন্দ্র সাহিত্য সাধনায় মনোনিবেশ করেন। একাদশে বৃহস্পতিতে ভাগ্যলক্ষ্মীর অবস্থানের সুবাদে অল্প দিনেই শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সাড়াজাগানো গল্পকার-সাহিত্যিক হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি অর্জন ও খ্যাতির শীর্ষে আরোহণ করেন।
১৯১৬ সালে সাড়াজাগানো কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং সাহিত্য সাধনায় আকণ্ঠ নিমগ্ন হয়ে পড়েন। গল্প-উপন্যাস রচনার পাশাপাশি মননশীল প্রবন্ধকার হিসেবেও সর্বমহলে শরৎচন্দ্রের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। বাংলা কথাসাহিত্যে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রীতিমতো অপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেন এবং তার গগনচুম্বী জনপ্রিয়তার কাছে অনেক নামী-দামি গল্পকার-সাহিত্যিকের সুখ্যাতি ম্লান হয়ে যায়। ব্রিটিশ বেনিয়াদের পাশবিক প্রবৃত্তি ও নিষ্ঠুরতার পাশাপাশি নিপুণ শিল্পীর তুলির আঁচড়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আচারনিষ্ঠ হিন্দুসমাজে পুরোহিতদের দৌরাত্ম্য ও জমিদারদের বর্বরতার নিখুঁত ভাষাচিত্রও অঙ্কিত করেছেন বিভিন্ন গল্প-উপন্যাসে। হিন্দু পুরোহিত সম্প্রদায় এবং জমিদারগোষ্ঠী চরম প্রতিবাদী শরৎচন্দ্রকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল বলেও জানা যায়। শরৎচন্দ্রের অমর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯২৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে জগত্তারিণী পদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৩৬ সালে তাকে ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে। শরৎচন্দ্রের বড়দিদি, মেজদিদি, বিরাজ বৌ, বিন্দুর ছেলে, সধবার একাদশী, পণ্ডিতমশাই, পরিণীতা, পল্লীসমাজ, বৈকুণ্ঠের উইল, চরিত্রহীন, শ্রীকান্ত, বিপ্রদাস, গৃহদাহ, দত্তা, শেষ প্রশ্ন, ছবি, পথের দাবী, দেনা-পাওনা ইত্যাদি কালোত্তীর্ণ গ্রন্থে তৎকালীন সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সংগতি-অসংগতির দৃষ্টিগ্রাহ্য ভাষাাচিত্র অঙ্কিত হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের অন্যতম প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জীবনভর ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে উচ্চবর্ণের আচারনিষ্ঠ হিন্দু ও পুরোহিত সম্প্রদায়ের অমানবিক আচরণ, ধর্মের ছদ্মাবরণে অধর্মীয় পাপাচার, কুসংস্কার, ভণ্ডামি ও দৌরাত্ম্যের নিখুঁত ও বস্তুনিষ্ঠ ভাষাচিত্র অঙ্কনের পর অবশেষে ১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি মৃত্যুর হিমশীতল স্পর্শে অনন্তলোকে পাড়ি জমান। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের রমরমা বাজার, চরম উৎকর্ষ ও সমৃদ্ধির সাম্রাজ্যে উনিশ ও বিশ শতকের অমর কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বহুলাংশে বিস্মৃতপ্রায়। তাই বিবেকের তাড়নায় এই অপ্রতিদ্বন্দ্বী কথাসাহিত্যিকের ৮৭তম মহাপ্রয়াণ দিবস উপলক্ষে তারই ‘হরিলক্ষ্মী’ নামক গল্পগ্রন্থ থেকে ‘গফুর’ ছোটগল্পের অংশবিশেষ উদ্ধৃত করে কৈয়ের তেলে কৈ ভাজার আদলে প্রয়াত শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হলো :
‘গ্রামের নাম কাশীপুর। বৈশাখের শেষ পর্যায়ে অনাবৃষ্টির আকাশ থেকে যেন আগুন ঝরে পড়ছে। সম্মুখের দিগন্তজোড়া মাঠখানা জ্বলে-পুড়ে ফুটিফাটা হয়ে আছে, আর সেই লক্ষ ফাটল দিয়ে ধরিত্রীর বুকের রক্ত নিরন্তর ধুঁয়া হয়ে উড়ে যাচ্ছে। এরই সীমানায় পথের ধারে গফুর মিঞার বাড়ি। তার মাটির প্রাচীর পড়ে গিয়ে প্রাঙ্গণে এসে পথে মিশেছে এবং অন্তঃপুরের লজ্জা সম্ভ্রম পথিকের করুণায় আত্মসমর্পণ করে নিশ্চিত হয়েছে। গফুরের নিত্য অনটনের সংসারে আছে বছর-দশেকের মা-মরা মেয়ে আমিনা এবং বলদ মহেশ। বিঘে চারেক জমি গফুর ভাগে চাষ করে। উপর্যুপরি দু সন অজন্মা-মাঠের ধান মাঠে শুকিয়ে যাওয়ায়, বাপ-বেটিতে দুবেলা দুটো পেটভরে খেতে পর্যন্ত পায় না। কাহনখানেক খড় এবার গফুর ভাগে পেয়েছিল, কিন্তু গেল সনের বকেয়া বাবত কর্তামশায় সবে ধরে রাখায় বৃষ্টি-বাদলে খড়বিহীন চালের নিচে বাপ-বেটি ঘরের কোণে বসে রাত কাটায়। তদুপরি কয়েক দিন অনবরত জ্বরে গফুর শয্যাশায়ী হয়ে পড়ায় মহেশকে খেতে দিতে পারে না। আবার জমিদার শিবচরণ বাবু শ্মশানধারে গাঁয়ের যে গোচরটুকু ছিল তাও পয়সার লোভে জমা-বিলি করে দিয়েছেন। তাই চরে বেড়ানো এবং ঘাসের অভাবে দিনে দিনে মহেশ অস্থিচর্মসার হয়ে উঠে। একদা ক্ষুধার তাড়নায় মহেশ দড়ি ছিঁড়ে নিখোঁজ হয়ে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর পীড়িত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত গফুরকে কন্যা আমিনা জানায় যে গো-ব্রাহ্মণে ভক্ত মাণিক ঘোষের বাগানে ঢুকে মহেশ গাছ-পালা নষ্ট করায় মহেশকে দরিয়াপুরের খোঁয়াড়ে দেয়া হয়েছে। বিচলিত গফুরের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। অনন্যোপায় গফুর রাতের অন্ধকারে নিজের পিতলের থালাটি বংশীর নিকট বন্ধক রেখে একটি টাকা ধার করে এবং মহেশকে বসত বাড়িতে ফিরিয়ে আনে। পরদিন ২ জন কসাই নগদ ১২ টাকা গফুরের হাতে গুঁজে দেয় মহেশের মূল্য বাবত। অপত্য স্নেহবশে গফুর মহেশকে কসাইর হাতে তুলে দিতে পারে না এবং কসাইর দেয়া টাকা ছুড়ে ফেলে দেয় এবং মহেশের গলা জড়িয়ে ধরে অশ্রুবিসর্জন করে।
‘জ্যৈষ্ঠ প্রায় শেষ। জ্বর থামার ৪/৫ দিনের মাথায় গফুর কাজের সন্ধানে বের হয়। কাঠফাটা রোদের মাঝে দুর্বল শরীরে অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করার পর ব্যর্থ-পিপাসার্ত ও ক্লান্ত গফুর বাড়ি ফিরে এবং প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়েই আমিনার কাছে ভাত চায়। রান্না না হওয়ায় গফুর রাগত স্বরে জল চায়। কিন্তু গৃহে তৃষ্ণার জল পর্যন্ত না থাকায় গফুর আত্মসংবরণে ব্যর্থ হয়ে আমিনার গালে একটি চড় কষিয়ে দেয়। আমিনা টুঁ শব্দও করে না। মাটির শূন্য কলসিটি তুলে নিয়ে সেই প্রচণ্ড রোদের মাঝেই চোখ মুছতে মুছতে মুছতে নিঃশব্দে বেরিয়ে যায়। আমিনা চোখের আড়াল হতেই গফুরের বুকে শেল বিঁধে। গ্রামের পুকুরগুলো একেবারেই শুষ্ক। কোনো কোনো জলাশয়ের মাঝখানে দু-একটা গর্ত খুঁড়ে যা কিছু জল সঞ্চিত হয় তাতে যেমন কাড়াকাড়ি, তেমনি ভিড়। বিশেষত মুসলমান বলে এই ছোট মেয়েটা তো কাছেই ঘেঁষতে পারে না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দূরে দাঁড়িয়ে বহু অনুনয়-বিনয়ে কেউ দয়া করে যদি তার পাত্রে একটু জল ঢেলে দেয় সেইটুকুই ঘরে আনে। এই বাস্তবতা উপলব্ধি করে গফুরের নিজের চোখও জলে ভরে আসে। ঠিক সেই মুহূর্তে জমিদারের পিয়াদা যমদূতের মতো এসে প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ডাকেÑগফুর ঘরে আছিস। ক্ষুধা-তৃষ্ণা জর্জরিত গফুর তিক্ত কণ্ঠে বলে, আছি, কেন? বাবু মশায় ডাকছেন, আয়। গফুর বলে, আমার খাওয়া-দাওয়া হয়নি, পরে যাব। পিয়াদা বলল, বাবুর হুকুম, মারতে মারতে টেনে নিয়ে যেতে। আত্মবিস্মৃত গফুর অকস্মাৎ রাগের মাথায় বলে, মহারাণীর রাজত্বে কেউ কারও গোলাম নয়। খাজনা দিয়ে বাস করি, আমি যাব না। মহারাণীর দোহাই নিঃস্ব গফুরের ক্ষেত্রে শুধু বিফল নয়, বিপদেরও কারণ হয়। পিয়াদা গফুরকে অর্ধচন্দ্র দিতে দিতে জমিদারের বাড়ি নিয়ে যায় এবং লোকজন অসহায় গফুরকে রীতিমতো সাপমারা করে ছাড়ে। নির্বিবাদে অসহায় গফুর প্রহার এবং লাঞ্ছনা সহ্য করে। বাড়ি ফিরে চোখ-মুখ ফোলা গফুর ঘরে গিয়ে নিঃশব্দে শুয়ে পড়ে। কিন্তু তার বুকের ভেতরটা কাঠফাটা জ্যৈষ্ঠের মধ্যাহ্ন আকাশের মতোই জ্বলতে থাকে। উল্লেখ্য, দড়ি ছিঁড়ে মহেশ জমিদার শিবচরণবাবুর প্রাঙ্গণে ঢুকে ফুলগাছ খেয়েছে, শুকোতে দেয়া ধান ছড়িয়ে নষ্ট করেছে এবং বাবুর ছোট মেয়েকে ফেলে পলায়ন করেছে বিধায় গফুরকে এই অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়। এদিকে অকস্মাৎ প্রাঙ্গণ থেকে মেয়ের আর্তকণ্ঠ শোনামাত্রই গফুর সবেগে উঠে দাঁড়ায় এবং ছুটে বাইরে এসে দেখে , আমিনা মাটিতে পড়ে আছে এবং তার বিক্ষিপ্ত ভাঙা ঘট থেকে জল ঝরছে। আর মহেশ মাটিতে মুখ দিয়ে সেই জল মরুভূমির মতো যেন শুষে খাচ্ছে। চোখের পলক পড়ে না, গফুর দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে যায়। মেরামত করার জন্য সে আগের দিন লাঙ্গলের মাথাটা খুলে রেখেছিল। তা দিয়ে মহেশের অবনত মাথার ওপর সজোরে আঘাত করে গফুর। মাত্র একটিবার অস্থিচর্মসার মহেশ মাথা তোলার চেষ্টা করে, তারপর এর অনাহারক্লিষ্ট শীর্ণদেহ ভূমিতলে লুটিয়ে পড়ে। চোখের কোণ বেয়ে কয়েক বিন্দু অশ্রু এবং কান বয়ে কয়েক ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়ে। বার দুয়েক তার সমস্ত শরীরটা থরথর করে কেঁপে ওঠে, তারপর সম্মুখ ও পশ্চাতে পা দুটি তার যতদূর যায় প্রসারিত করে দিয়ে মহেশ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে। আমিনা হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলল, কী করলে বাবা, আমাদের মহেশ যে মরে গেল। গফুর নড়ল না, জবাবও দিল না। শুধু নিমেষে চক্ষে আর একজোড়া নিমেষহীন গভীর কালো চক্ষের পানে চেয়ে পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে রয়। সংবাদ পেয়ে ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে গ্রামান্তের মুচির দল আসে এবং বাঁশে বেঁধে মহেশকে ভাগাড়ে নিয়ে যায়। গফুর সারাক্ষণ হাঁটুর উপর মুখ রেখে ঠায় বসে থাকে। ‘অনেক রাতে গফুর মেয়েকে তুলে বলে, আমিনা চল আমরা যাই। সে দাওয়ায় ঘুমিয়ে পড়েছিল। চোখ মুছে উঠে বসে বলে, কোথায় যাব? গফুর বলে, ফুলবেড়ের চটকলে কাজ করতে। মেয়ে আশ্চর্য হয়ে চেয়ে রয়। ইতোপূর্বে অনেক দুঃখেও তার পিতা কলে কাজ করতে রাজি হয়নি। সেখানে ধর্ম থাকে না, এ কথা সে বহুবার শুনেছে। গফুর বলে, দেরি করিস নে মা, অনেক পথ হাঁটতে হবে। আমিনা জল খাওয়ার ঘটি ও পিতার ভাত খাওয়ার পিতলের থালাটি সঙ্গে নিতে চায়। গফুর নিষেধ করে, ও সব থাক মা; ওতে আমার মহেশের প্রায়শ্চিত্ত হবে। অন্ধকার গভীর নিশীথে গফুর মেয়ের হাত ধরে বের হয়। এ গ্রামে তার আত্মীয় কেউ ছিল না। কাকেও বলার কিছুই নেই। আঙিনা পেরিয়ে পথের ধারে সেই বাবলাতলায় এসে গফুর থমকে দাঁড়িয়ে সহসা হু হু করে কেঁদে উঠে। নক্ষত্রখচিত কালো আকাশে মুখ তুলে বলে, আল্লাহ! আমাকে যত খুশি সাজা দিও। কিন্তু মহেশ আমার তেষ্টা নিয়ে মরেছে। তার চরে খাবার এতটুকু জমি কেউ রাখেনি। যে তোমার দেয়া মাঠের ঘাস, তোমার দেয়া তেষ্টার জল তাকে খেতে দেয়নি, তার কসুর তুমি যেন কখনও মাফ করো না।’
ব্রিটিশশাসিত ভারতবর্ষে গফুরের মতো প্রান্তিক চাষি সম্প্রদায়ের প্রতি তৎকালীন আঠারনিষ্ঠ হিন্দু ব্রাহ্মণ, জমিদার এবং শাসকদের নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতার কাহিনি গল্পে নিপুণ শিল্পীর তুলিতে চিত্রিত করেছেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। স্বাধীন ভারতবর্ষ এবং বাংলাদেশে গফুর জাতীয় প্রান্তিক চাষি এবং সর্বহারা জনগোষ্ঠীর ভাগ্যের কী ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে, তাও মূল্যায়নের দাাবি রাখে।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, ঠিকানা, নিউইয়র্ক।
১৯১৬ সালে সাড়াজাগানো কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং সাহিত্য সাধনায় আকণ্ঠ নিমগ্ন হয়ে পড়েন। গল্প-উপন্যাস রচনার পাশাপাশি মননশীল প্রবন্ধকার হিসেবেও সর্বমহলে শরৎচন্দ্রের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। বাংলা কথাসাহিত্যে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রীতিমতো অপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেন এবং তার গগনচুম্বী জনপ্রিয়তার কাছে অনেক নামী-দামি গল্পকার-সাহিত্যিকের সুখ্যাতি ম্লান হয়ে যায়। ব্রিটিশ বেনিয়াদের পাশবিক প্রবৃত্তি ও নিষ্ঠুরতার পাশাপাশি নিপুণ শিল্পীর তুলির আঁচড়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আচারনিষ্ঠ হিন্দুসমাজে পুরোহিতদের দৌরাত্ম্য ও জমিদারদের বর্বরতার নিখুঁত ভাষাচিত্রও অঙ্কিত করেছেন বিভিন্ন গল্প-উপন্যাসে। হিন্দু পুরোহিত সম্প্রদায় এবং জমিদারগোষ্ঠী চরম প্রতিবাদী শরৎচন্দ্রকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল বলেও জানা যায়। শরৎচন্দ্রের অমর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯২৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে জগত্তারিণী পদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৩৬ সালে তাকে ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে। শরৎচন্দ্রের বড়দিদি, মেজদিদি, বিরাজ বৌ, বিন্দুর ছেলে, সধবার একাদশী, পণ্ডিতমশাই, পরিণীতা, পল্লীসমাজ, বৈকুণ্ঠের উইল, চরিত্রহীন, শ্রীকান্ত, বিপ্রদাস, গৃহদাহ, দত্তা, শেষ প্রশ্ন, ছবি, পথের দাবী, দেনা-পাওনা ইত্যাদি কালোত্তীর্ণ গ্রন্থে তৎকালীন সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সংগতি-অসংগতির দৃষ্টিগ্রাহ্য ভাষাাচিত্র অঙ্কিত হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের অন্যতম প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জীবনভর ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে উচ্চবর্ণের আচারনিষ্ঠ হিন্দু ও পুরোহিত সম্প্রদায়ের অমানবিক আচরণ, ধর্মের ছদ্মাবরণে অধর্মীয় পাপাচার, কুসংস্কার, ভণ্ডামি ও দৌরাত্ম্যের নিখুঁত ও বস্তুনিষ্ঠ ভাষাচিত্র অঙ্কনের পর অবশেষে ১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি মৃত্যুর হিমশীতল স্পর্শে অনন্তলোকে পাড়ি জমান। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের রমরমা বাজার, চরম উৎকর্ষ ও সমৃদ্ধির সাম্রাজ্যে উনিশ ও বিশ শতকের অমর কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বহুলাংশে বিস্মৃতপ্রায়। তাই বিবেকের তাড়নায় এই অপ্রতিদ্বন্দ্বী কথাসাহিত্যিকের ৮৭তম মহাপ্রয়াণ দিবস উপলক্ষে তারই ‘হরিলক্ষ্মী’ নামক গল্পগ্রন্থ থেকে ‘গফুর’ ছোটগল্পের অংশবিশেষ উদ্ধৃত করে কৈয়ের তেলে কৈ ভাজার আদলে প্রয়াত শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হলো :
‘গ্রামের নাম কাশীপুর। বৈশাখের শেষ পর্যায়ে অনাবৃষ্টির আকাশ থেকে যেন আগুন ঝরে পড়ছে। সম্মুখের দিগন্তজোড়া মাঠখানা জ্বলে-পুড়ে ফুটিফাটা হয়ে আছে, আর সেই লক্ষ ফাটল দিয়ে ধরিত্রীর বুকের রক্ত নিরন্তর ধুঁয়া হয়ে উড়ে যাচ্ছে। এরই সীমানায় পথের ধারে গফুর মিঞার বাড়ি। তার মাটির প্রাচীর পড়ে গিয়ে প্রাঙ্গণে এসে পথে মিশেছে এবং অন্তঃপুরের লজ্জা সম্ভ্রম পথিকের করুণায় আত্মসমর্পণ করে নিশ্চিত হয়েছে। গফুরের নিত্য অনটনের সংসারে আছে বছর-দশেকের মা-মরা মেয়ে আমিনা এবং বলদ মহেশ। বিঘে চারেক জমি গফুর ভাগে চাষ করে। উপর্যুপরি দু সন অজন্মা-মাঠের ধান মাঠে শুকিয়ে যাওয়ায়, বাপ-বেটিতে দুবেলা দুটো পেটভরে খেতে পর্যন্ত পায় না। কাহনখানেক খড় এবার গফুর ভাগে পেয়েছিল, কিন্তু গেল সনের বকেয়া বাবত কর্তামশায় সবে ধরে রাখায় বৃষ্টি-বাদলে খড়বিহীন চালের নিচে বাপ-বেটি ঘরের কোণে বসে রাত কাটায়। তদুপরি কয়েক দিন অনবরত জ্বরে গফুর শয্যাশায়ী হয়ে পড়ায় মহেশকে খেতে দিতে পারে না। আবার জমিদার শিবচরণ বাবু শ্মশানধারে গাঁয়ের যে গোচরটুকু ছিল তাও পয়সার লোভে জমা-বিলি করে দিয়েছেন। তাই চরে বেড়ানো এবং ঘাসের অভাবে দিনে দিনে মহেশ অস্থিচর্মসার হয়ে উঠে। একদা ক্ষুধার তাড়নায় মহেশ দড়ি ছিঁড়ে নিখোঁজ হয়ে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর পীড়িত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত গফুরকে কন্যা আমিনা জানায় যে গো-ব্রাহ্মণে ভক্ত মাণিক ঘোষের বাগানে ঢুকে মহেশ গাছ-পালা নষ্ট করায় মহেশকে দরিয়াপুরের খোঁয়াড়ে দেয়া হয়েছে। বিচলিত গফুরের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। অনন্যোপায় গফুর রাতের অন্ধকারে নিজের পিতলের থালাটি বংশীর নিকট বন্ধক রেখে একটি টাকা ধার করে এবং মহেশকে বসত বাড়িতে ফিরিয়ে আনে। পরদিন ২ জন কসাই নগদ ১২ টাকা গফুরের হাতে গুঁজে দেয় মহেশের মূল্য বাবত। অপত্য স্নেহবশে গফুর মহেশকে কসাইর হাতে তুলে দিতে পারে না এবং কসাইর দেয়া টাকা ছুড়ে ফেলে দেয় এবং মহেশের গলা জড়িয়ে ধরে অশ্রুবিসর্জন করে।
‘জ্যৈষ্ঠ প্রায় শেষ। জ্বর থামার ৪/৫ দিনের মাথায় গফুর কাজের সন্ধানে বের হয়। কাঠফাটা রোদের মাঝে দুর্বল শরীরে অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করার পর ব্যর্থ-পিপাসার্ত ও ক্লান্ত গফুর বাড়ি ফিরে এবং প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়েই আমিনার কাছে ভাত চায়। রান্না না হওয়ায় গফুর রাগত স্বরে জল চায়। কিন্তু গৃহে তৃষ্ণার জল পর্যন্ত না থাকায় গফুর আত্মসংবরণে ব্যর্থ হয়ে আমিনার গালে একটি চড় কষিয়ে দেয়। আমিনা টুঁ শব্দও করে না। মাটির শূন্য কলসিটি তুলে নিয়ে সেই প্রচণ্ড রোদের মাঝেই চোখ মুছতে মুছতে মুছতে নিঃশব্দে বেরিয়ে যায়। আমিনা চোখের আড়াল হতেই গফুরের বুকে শেল বিঁধে। গ্রামের পুকুরগুলো একেবারেই শুষ্ক। কোনো কোনো জলাশয়ের মাঝখানে দু-একটা গর্ত খুঁড়ে যা কিছু জল সঞ্চিত হয় তাতে যেমন কাড়াকাড়ি, তেমনি ভিড়। বিশেষত মুসলমান বলে এই ছোট মেয়েটা তো কাছেই ঘেঁষতে পারে না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দূরে দাঁড়িয়ে বহু অনুনয়-বিনয়ে কেউ দয়া করে যদি তার পাত্রে একটু জল ঢেলে দেয় সেইটুকুই ঘরে আনে। এই বাস্তবতা উপলব্ধি করে গফুরের নিজের চোখও জলে ভরে আসে। ঠিক সেই মুহূর্তে জমিদারের পিয়াদা যমদূতের মতো এসে প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ডাকেÑগফুর ঘরে আছিস। ক্ষুধা-তৃষ্ণা জর্জরিত গফুর তিক্ত কণ্ঠে বলে, আছি, কেন? বাবু মশায় ডাকছেন, আয়। গফুর বলে, আমার খাওয়া-দাওয়া হয়নি, পরে যাব। পিয়াদা বলল, বাবুর হুকুম, মারতে মারতে টেনে নিয়ে যেতে। আত্মবিস্মৃত গফুর অকস্মাৎ রাগের মাথায় বলে, মহারাণীর রাজত্বে কেউ কারও গোলাম নয়। খাজনা দিয়ে বাস করি, আমি যাব না। মহারাণীর দোহাই নিঃস্ব গফুরের ক্ষেত্রে শুধু বিফল নয়, বিপদেরও কারণ হয়। পিয়াদা গফুরকে অর্ধচন্দ্র দিতে দিতে জমিদারের বাড়ি নিয়ে যায় এবং লোকজন অসহায় গফুরকে রীতিমতো সাপমারা করে ছাড়ে। নির্বিবাদে অসহায় গফুর প্রহার এবং লাঞ্ছনা সহ্য করে। বাড়ি ফিরে চোখ-মুখ ফোলা গফুর ঘরে গিয়ে নিঃশব্দে শুয়ে পড়ে। কিন্তু তার বুকের ভেতরটা কাঠফাটা জ্যৈষ্ঠের মধ্যাহ্ন আকাশের মতোই জ্বলতে থাকে। উল্লেখ্য, দড়ি ছিঁড়ে মহেশ জমিদার শিবচরণবাবুর প্রাঙ্গণে ঢুকে ফুলগাছ খেয়েছে, শুকোতে দেয়া ধান ছড়িয়ে নষ্ট করেছে এবং বাবুর ছোট মেয়েকে ফেলে পলায়ন করেছে বিধায় গফুরকে এই অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়। এদিকে অকস্মাৎ প্রাঙ্গণ থেকে মেয়ের আর্তকণ্ঠ শোনামাত্রই গফুর সবেগে উঠে দাঁড়ায় এবং ছুটে বাইরে এসে দেখে , আমিনা মাটিতে পড়ে আছে এবং তার বিক্ষিপ্ত ভাঙা ঘট থেকে জল ঝরছে। আর মহেশ মাটিতে মুখ দিয়ে সেই জল মরুভূমির মতো যেন শুষে খাচ্ছে। চোখের পলক পড়ে না, গফুর দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে যায়। মেরামত করার জন্য সে আগের দিন লাঙ্গলের মাথাটা খুলে রেখেছিল। তা দিয়ে মহেশের অবনত মাথার ওপর সজোরে আঘাত করে গফুর। মাত্র একটিবার অস্থিচর্মসার মহেশ মাথা তোলার চেষ্টা করে, তারপর এর অনাহারক্লিষ্ট শীর্ণদেহ ভূমিতলে লুটিয়ে পড়ে। চোখের কোণ বেয়ে কয়েক বিন্দু অশ্রু এবং কান বয়ে কয়েক ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়ে। বার দুয়েক তার সমস্ত শরীরটা থরথর করে কেঁপে ওঠে, তারপর সম্মুখ ও পশ্চাতে পা দুটি তার যতদূর যায় প্রসারিত করে দিয়ে মহেশ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে। আমিনা হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলল, কী করলে বাবা, আমাদের মহেশ যে মরে গেল। গফুর নড়ল না, জবাবও দিল না। শুধু নিমেষে চক্ষে আর একজোড়া নিমেষহীন গভীর কালো চক্ষের পানে চেয়ে পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে রয়। সংবাদ পেয়ে ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে গ্রামান্তের মুচির দল আসে এবং বাঁশে বেঁধে মহেশকে ভাগাড়ে নিয়ে যায়। গফুর সারাক্ষণ হাঁটুর উপর মুখ রেখে ঠায় বসে থাকে। ‘অনেক রাতে গফুর মেয়েকে তুলে বলে, আমিনা চল আমরা যাই। সে দাওয়ায় ঘুমিয়ে পড়েছিল। চোখ মুছে উঠে বসে বলে, কোথায় যাব? গফুর বলে, ফুলবেড়ের চটকলে কাজ করতে। মেয়ে আশ্চর্য হয়ে চেয়ে রয়। ইতোপূর্বে অনেক দুঃখেও তার পিতা কলে কাজ করতে রাজি হয়নি। সেখানে ধর্ম থাকে না, এ কথা সে বহুবার শুনেছে। গফুর বলে, দেরি করিস নে মা, অনেক পথ হাঁটতে হবে। আমিনা জল খাওয়ার ঘটি ও পিতার ভাত খাওয়ার পিতলের থালাটি সঙ্গে নিতে চায়। গফুর নিষেধ করে, ও সব থাক মা; ওতে আমার মহেশের প্রায়শ্চিত্ত হবে। অন্ধকার গভীর নিশীথে গফুর মেয়ের হাত ধরে বের হয়। এ গ্রামে তার আত্মীয় কেউ ছিল না। কাকেও বলার কিছুই নেই। আঙিনা পেরিয়ে পথের ধারে সেই বাবলাতলায় এসে গফুর থমকে দাঁড়িয়ে সহসা হু হু করে কেঁদে উঠে। নক্ষত্রখচিত কালো আকাশে মুখ তুলে বলে, আল্লাহ! আমাকে যত খুশি সাজা দিও। কিন্তু মহেশ আমার তেষ্টা নিয়ে মরেছে। তার চরে খাবার এতটুকু জমি কেউ রাখেনি। যে তোমার দেয়া মাঠের ঘাস, তোমার দেয়া তেষ্টার জল তাকে খেতে দেয়নি, তার কসুর তুমি যেন কখনও মাফ করো না।’
ব্রিটিশশাসিত ভারতবর্ষে গফুরের মতো প্রান্তিক চাষি সম্প্রদায়ের প্রতি তৎকালীন আঠারনিষ্ঠ হিন্দু ব্রাহ্মণ, জমিদার এবং শাসকদের নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতার কাহিনি গল্পে নিপুণ শিল্পীর তুলিতে চিত্রিত করেছেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। স্বাধীন ভারতবর্ষ এবং বাংলাদেশে গফুর জাতীয় প্রান্তিক চাষি এবং সর্বহারা জনগোষ্ঠীর ভাগ্যের কী ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে, তাও মূল্যায়নের দাাবি রাখে।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, ঠিকানা, নিউইয়র্ক।