সুবীর পাল
সুদূরপ্রসারী সেই সালটা যে ২০২৯। নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদীর যেন সেটাই অর্জুনের পাখির চোখ। নয়াদিল্লির সাউথ ব্লকের পিএমও যেন জানতে চাইছে, ‘স্যার কি দেখছেন?’ প্রধানমন্ত্রীর শান্ত অথচ সপ্রতিভ প্রত্যাশিত স্বগতোক্তি, ‘এক দেশ, এক ভোট। এটা আমাদের প্রতিশ্রুতি। জাতির প্রতি। ২০২৯ সালটাই সম্ভবত হতে চলেছে লক্ষ্য পূরণের সেই মাইলফলক। আমি স্পষ্ট অনুভব করছি, আমার ভারত অগ্রগতির পথে আরও এক কদম এগিয়ে যেতে প্রস্তুত।’
ভারতীয় আইন কমিশন ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে একটি খসড়া রিপোর্টে সারা ভারতজুড়ে ‘এক দেশ, এক ভোট’ করার বিষয়ে সরাসরি সওয়াল করে। আর এই খসড়া রিপোর্টকে সন্তর্পনে নিখুঁত মুন্সীয়ানায় হাইজ্যাক করে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনী প্রচারের পাদপ্রদীপে এই স্লোগানটি পরিকল্পিতভাবে ভাসিয়ে দেয় দেশবাসীর জনমানসে। এরপর বারানসীর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। প্রাসঙ্গিক নানা ঘটনাবলীর পথ অতিক্রম করে ২০২৫ সালের একেবারে দ্বারপ্রান্তে এসে এই স্লোগান আজ সংবিধানের পাতায় লিপিবদ্ধ হওয়ার প্রহর গুনতে ব্যস্ত।
আক্ষরিক অর্থেই বর্তমানে সারাদেশ যখন শীতের আমেজে কিছুটা হলেও জুবুথুবু, তখন ভারতের নানা প্রান্তে উষ্ণতার ঝড় বইতে শুরু করেছে এই ‘এক দেশ, এক ভোট’ সম্পর্কিত আলোচনার রকে ও সমালোচনার ঠেকে। প্রচারণাটা এমনই চতুর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যেন কেন্দ্রীয় শাসক দল এই নব্য ধারাটির নয়া প্রবর্তক। আপাতত কিছু কিছু মহলে এমন ধারণাটা প্রতিষ্ঠিতও হয়েছে বেশ সফলভাবে। কিন্তু বাস্তবে কি তাই? সত্যিই কি ভারতে ‘এক দেশ, এক ভোট’ নীতির প্রথম উদ্ভাবক মোদী সরকার? ঠারেঠোরে ঘুরপথে বিজেপি এখনও তো এমনই ছায়া প্রচারে ব্যস্ত নানা প্রান্তিক এলাকার অলিতে গলিতে।
কিন্তু ইতিহাস তো অন্য কথা বলে। তাছাড়া এই ছায়া প্রচারের হাটে হাঁড়িটা ভেঙে দিয়েছেন দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। এক ইলেকট্রনিক্স গণমাধ্যমে সম্প্রতি তিনি বলেন, ‘এই যে সারা দেশজুড়ে ইদানীং একটা আওয়াজ ক্রমশঃ জোড়ালো হচ্ছে, এক দেশ, এক ভোট, এটা কিন্তু এর আগেও লাগু ছিল আমাদের দেশে। টানা পনেরো বছর ধরে। এই তথ্যটা আমরা কোথাও গুলিয়ে ফেলছি আজকাল। তবে এই নীতি প্রণয়নটা একটা গণতান্ত্রিক দেশে সুষ্ঠু প্রশাসন পরিচালনার জন্য খুব সহায়ক।’ আসলে সাম্প্রতিকতম ‘এক দেশ, এক ভোট’ ব্র্যান্ড হলো প্রকৃতপক্ষে ‘পুরোনো বোতলে নতুন মদ’ ন্যায় দেশব্যাপী এক ককটেলীয় নির্বাচনী এজেন্ডা।
স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরবর্তী ক্ষেত্রে আমাদের দেশে এই এক দেশ এক ভোট ইস্যু নিয়ে প্রথম ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছিল ১৯৫০ সালে। তবে এই ইস্যুটি নির্দিষ্ট কোনও ব্যক্তিবিশেষের মস্তিষ্ক প্রসূত নয় বলেই একাংশ ইতিহাসবিদদের ধারণা। বরং তাঁদের মতে, সাম্প্রতিক কালের মতো তদানীন্তন সময়ে এই ইস্যুর কোনও বিকল্প ব্যবস্থা প্রণয়ন করার মতো ভিন্ন ভাবনার অবকাশও ছিল না। ফলে এক দেশ এক ভোট তখন আপনা-আপনিই অবধারিত হয়ে ওঠে দেশব্যাপী নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার তাড়নায়। ফলে প্রত্যাশিত স্বাভাবিক নিয়মেই দেশবরেণ্য চিন্তাবিদ ডা. বীর সাভারকার ও ভারতের সংবিধান প্রণেতা ডা. ডব আর আম্বেদকরসহ দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই নীতি ভারতে সর্বপ্রথম লাগু হয়েছিল ১৯৫২ সালে। টানা পনেরো বছর, অর্থাৎ ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত এই নির্বাচনী বিধির কোনও প্রকার অন্যথা ঘটেনি। ইন্দিরা গান্ধীর প্রধানমন্ত্রীত্বের সময়ে ১৯৬৮ সাল থেকে সারা দেশের সঙ্গে বিভিন্ন রাজ্যজুড়ে রাজনৈতিক ডামাডোল আরম্ভ হয়। একাধিক রাজ্যে বিধানসভা ভেঙে দিয়ে লাগু করা হয় রাষ্ট্রপতি শাসন। পাশাপাশি রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ১৯৭০ সালে লোকসভাও ভেঙে দেন ইন্দিরা গান্ধী। তারই ফলস্বরূপ ১৯৭১ সালে লোকসভা নির্বাচনের মুখোমুখি হতে হয় ভারতবাসীকে। সুতরাং পিতা জওহরলাল নেহেরুর আমলে ১৯৫২ সালে এক দেশ এক ভোট নীতি ভারতের সংবিধানে প্রথমবারের মতো দিনের আলো দেখলেও কন্যা ইন্দিরা গান্ধী হাত ধরে সেই বিধির কফিনে তখনকার মতো পেরেকটি গেঁথে দেওয়া হয়েছিল ১৯৬৭ সালে।
কি অদ্ভুত সমাপতন। যখন ভারতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এক দেশ এক ভোট নীতিকে কার্যত হিমঘরে পাঠিয়ে দিলেন, তখন তাঁকে গণতন্ত্র বিরোধী বলে অ্যাখ্যা দিয়েছিলেন সেই সময়কার ভারতীয় বিরোধী শিবির। পুনরায় বর্তমান কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী অর্জুনরাম মেঘওয়াল সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে এক দেশ এক ভোট বিলটি পেশ করলে তাতে গত ১৭ ডিসেম্বর ২৬৯ জন সাংসদ স্বপক্ষে ও বিপক্ষে ১৯৮ জন সংসদ সদস্য ভোটাভুটিতে অংশ নেন। আর তখনই গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধকারীর তকমা সেঁটে দিয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উদ্দেশ্যে তীব্র সমালোচনায় ব্যস্ত থাকলেন কংগ্রেসী শীর্ষ নেতৃত্ব সমেত প্রায় সমস্ত বিরোধীরা। সত্যি সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ! এক দেশ এক ভোট, গুম হবার মুহূর্তেও বিরোধীরা চীৎকার করতে পিছপা হননি সেদিন। আবার এর পুনঃ অক্সিজেন দানেও বিরোধীরা গলা ফাটাতে ‘সবে মিলি করি কাজ’ এ চরম তৎপর এদিনও। আর বিরোধিতার স্লোগানও কিন্তু অদ্ভুত রকমের এক। তা হলো ‘গণতন্ত্রের হত্যাকারী প্রধানমন্ত্রী, নিপাত যাক।’ অর্থাৎ নীতিটা যখন এক দেশ এক ভোট, তখন তার বিলীনেও গণতন্ত্র বিমুখতা দেখেন ভারতের বিরোধী নেতারা। আবার তার ফিরতি প্রতিষ্ঠাতেও গণতন্ত্রের শত্রুতা উপলব্ধি করেন দেশীয় বিরোধী দলগুলো।
ভারতের এই এক দেশ এক ভোট কিসসার পাশাপাশি সমগ্র বিশ্বের নিরিখে বহু গণতান্ত্রিক দেশে এই নীতি কিন্তু আজও যথেষ্ট জনপ্রিয়। পৃথিবীর ইতিহাস ঘাটলে, গণতান্ত্রিক এই বিধিবদ্ধ ব্যবস্থার প্রথম প্রবক্তা হলেন ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ ব্যক্তিত্ব চার্লস ফক্স। আঠারোশো শতকের প্রায় শেষদিকে এক দেশ এক ভোট করার ব্যাপারে তিনিই বিশ্বে প্রথম মতামত প্রকাশ করেন। তাঁর এই মতামত অনুসরণ করে ১৮৬০-১৮৭০ সময়কালের মধ্যে ইংল্যান্ডে ও আমেরিকার এহেন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সর্বপ্রথম।
অতুলপ্রসাদ সেনের সেই কালজয়ী রচিত গান, ‘বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান’ আজও কি আশ্চর্য রকমের প্রাসঙ্গিক। আসলে এটাই যে প্রকৃত ভারতবর্ষের চালচিত্র। গণতান্ত্রিক ও প্রজাতান্ত্রিক ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের চিরন্তনী ঐতিহ্য। আমাদের দেশের মধ্যে ২৮টি রাজ্য ও ৮টি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল রয়েছে। এখানে ১২২টি প্রধান ভাষাসহ ১,৫৯৯টি অন্যান্য ভাষা বিদ্যমান। বর্ণ রয়েছে ৬,৪০০টি। ৬টি ধর্ম। জাতি-গোষ্ঠীর সংখ্যাও ৬টি। এখানে ৫১টি উৎসব পালন করা হয় মহাসমারোহে। যার মধ্যে ১৭টি জাতীয় স্তরে, আর ৩৪টি আঞ্চলিক পর্যায়ে উদযাপন করা হয়। তাই তো প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী একদা আওয়াজ তুলেছিলেন, ‘মেরা ভারত মহান’। এই দেশ বহুত্ববাদের তন্ত্রে একাত্মতার মন্ত্রে দীক্ষিত। এই ভারত একাত্মতার সাধনে বহুত্ববাদের পালনেও শিক্ষিত। হয়তো দেশজ এই আত্মস্থ পরম্পরা ভাবনাকে আরও বলিষ্ঠ বুনিয়াদী করার প্রয়াসে কেন্দ্রীয় সরকার সম্প্রতি এক দেশ এক ভোট পুনরায় ভারতে লাগু করার ক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধনের রাস্তায় হাঁটতে পুরোপুরি বদ্ধপরিকর। অবশ্যই রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সাম্প্রতিক এই সরকারী পদক্ষেপের স্বপক্ষে ও বিপক্ষে বিস্তর আলোচনার এবং প্রবল সমালোচনার তুফান বইছে দেশজুড়ে। সেই কারণেই হয়তো সংশ্লিষ্ট বিলটি লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠের অনুমোদন পেলেও তা ঐক্যমত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটির কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে অতি সম্প্রতি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের নেতৃত্বে ২০২৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর নরেন্দ্র মোদী সরকার এক দেশ এক ভোট বিষয়ক একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করেছিল। অবশ্য সেই কমিটির তরফে গত বছরের ১৪ মার্চ রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর হাতে একটি পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট তুলে দেওয়া হয়। ১৮,০০০ পাতা সমৃদ্ধ মোট ৮ খন্ডের ওই রিপোর্টে দেশের সামগ্রিক লোকসভা ভোটের সঙ্গে সমস্ত প্রদেশের ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচনসহ সবগুলো রাজ্যের বিধানসভা ভোটও একত্রে সম্পন্ন করার বিস্তারিত পরামর্শ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। অন্যদিকে, ওই রিপোর্টটি গত ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা প্রয়োজনীয় অনুমোদন পেয়ে যায় তৎপরতার সঙ্গে।
সুতরাং বিরোধী জোট গণতান্ত্রিক পরিসরে যতই বিরোধিতার সুর চড়া করুক না কেন, এই মুহূর্তে এই ইস্যুতে সংসদের ট্রেজারি বেঞ্চ কিন্তু যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী। এখন শুধু অপেক্ষার প্রহর গোনার কামডাউন শুরু, জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটির অন্দরমহলে মোদী ম্যাজিক কতটা দ্রুত আর কতটা কার্যকরী ভূমিকা পালন করে, তা পরখ করার! কারণ ভারতের ১৪তম প্রধানমন্ত্রীর শ্যেনদৃষ্টি কিন্তু ঘুরেফিরে সেই সেই সেই ২০২৯...!
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামিস্ট, কলকাতা, পশ্চিম বঙ্গ, ভারত।
সুদূরপ্রসারী সেই সালটা যে ২০২৯। নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদীর যেন সেটাই অর্জুনের পাখির চোখ। নয়াদিল্লির সাউথ ব্লকের পিএমও যেন জানতে চাইছে, ‘স্যার কি দেখছেন?’ প্রধানমন্ত্রীর শান্ত অথচ সপ্রতিভ প্রত্যাশিত স্বগতোক্তি, ‘এক দেশ, এক ভোট। এটা আমাদের প্রতিশ্রুতি। জাতির প্রতি। ২০২৯ সালটাই সম্ভবত হতে চলেছে লক্ষ্য পূরণের সেই মাইলফলক। আমি স্পষ্ট অনুভব করছি, আমার ভারত অগ্রগতির পথে আরও এক কদম এগিয়ে যেতে প্রস্তুত।’
ভারতীয় আইন কমিশন ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে একটি খসড়া রিপোর্টে সারা ভারতজুড়ে ‘এক দেশ, এক ভোট’ করার বিষয়ে সরাসরি সওয়াল করে। আর এই খসড়া রিপোর্টকে সন্তর্পনে নিখুঁত মুন্সীয়ানায় হাইজ্যাক করে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনী প্রচারের পাদপ্রদীপে এই স্লোগানটি পরিকল্পিতভাবে ভাসিয়ে দেয় দেশবাসীর জনমানসে। এরপর বারানসীর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। প্রাসঙ্গিক নানা ঘটনাবলীর পথ অতিক্রম করে ২০২৫ সালের একেবারে দ্বারপ্রান্তে এসে এই স্লোগান আজ সংবিধানের পাতায় লিপিবদ্ধ হওয়ার প্রহর গুনতে ব্যস্ত।
আক্ষরিক অর্থেই বর্তমানে সারাদেশ যখন শীতের আমেজে কিছুটা হলেও জুবুথুবু, তখন ভারতের নানা প্রান্তে উষ্ণতার ঝড় বইতে শুরু করেছে এই ‘এক দেশ, এক ভোট’ সম্পর্কিত আলোচনার রকে ও সমালোচনার ঠেকে। প্রচারণাটা এমনই চতুর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যেন কেন্দ্রীয় শাসক দল এই নব্য ধারাটির নয়া প্রবর্তক। আপাতত কিছু কিছু মহলে এমন ধারণাটা প্রতিষ্ঠিতও হয়েছে বেশ সফলভাবে। কিন্তু বাস্তবে কি তাই? সত্যিই কি ভারতে ‘এক দেশ, এক ভোট’ নীতির প্রথম উদ্ভাবক মোদী সরকার? ঠারেঠোরে ঘুরপথে বিজেপি এখনও তো এমনই ছায়া প্রচারে ব্যস্ত নানা প্রান্তিক এলাকার অলিতে গলিতে।
কিন্তু ইতিহাস তো অন্য কথা বলে। তাছাড়া এই ছায়া প্রচারের হাটে হাঁড়িটা ভেঙে দিয়েছেন দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। এক ইলেকট্রনিক্স গণমাধ্যমে সম্প্রতি তিনি বলেন, ‘এই যে সারা দেশজুড়ে ইদানীং একটা আওয়াজ ক্রমশঃ জোড়ালো হচ্ছে, এক দেশ, এক ভোট, এটা কিন্তু এর আগেও লাগু ছিল আমাদের দেশে। টানা পনেরো বছর ধরে। এই তথ্যটা আমরা কোথাও গুলিয়ে ফেলছি আজকাল। তবে এই নীতি প্রণয়নটা একটা গণতান্ত্রিক দেশে সুষ্ঠু প্রশাসন পরিচালনার জন্য খুব সহায়ক।’ আসলে সাম্প্রতিকতম ‘এক দেশ, এক ভোট’ ব্র্যান্ড হলো প্রকৃতপক্ষে ‘পুরোনো বোতলে নতুন মদ’ ন্যায় দেশব্যাপী এক ককটেলীয় নির্বাচনী এজেন্ডা।
স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরবর্তী ক্ষেত্রে আমাদের দেশে এই এক দেশ এক ভোট ইস্যু নিয়ে প্রথম ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছিল ১৯৫০ সালে। তবে এই ইস্যুটি নির্দিষ্ট কোনও ব্যক্তিবিশেষের মস্তিষ্ক প্রসূত নয় বলেই একাংশ ইতিহাসবিদদের ধারণা। বরং তাঁদের মতে, সাম্প্রতিক কালের মতো তদানীন্তন সময়ে এই ইস্যুর কোনও বিকল্প ব্যবস্থা প্রণয়ন করার মতো ভিন্ন ভাবনার অবকাশও ছিল না। ফলে এক দেশ এক ভোট তখন আপনা-আপনিই অবধারিত হয়ে ওঠে দেশব্যাপী নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার তাড়নায়। ফলে প্রত্যাশিত স্বাভাবিক নিয়মেই দেশবরেণ্য চিন্তাবিদ ডা. বীর সাভারকার ও ভারতের সংবিধান প্রণেতা ডা. ডব আর আম্বেদকরসহ দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই নীতি ভারতে সর্বপ্রথম লাগু হয়েছিল ১৯৫২ সালে। টানা পনেরো বছর, অর্থাৎ ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত এই নির্বাচনী বিধির কোনও প্রকার অন্যথা ঘটেনি। ইন্দিরা গান্ধীর প্রধানমন্ত্রীত্বের সময়ে ১৯৬৮ সাল থেকে সারা দেশের সঙ্গে বিভিন্ন রাজ্যজুড়ে রাজনৈতিক ডামাডোল আরম্ভ হয়। একাধিক রাজ্যে বিধানসভা ভেঙে দিয়ে লাগু করা হয় রাষ্ট্রপতি শাসন। পাশাপাশি রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ১৯৭০ সালে লোকসভাও ভেঙে দেন ইন্দিরা গান্ধী। তারই ফলস্বরূপ ১৯৭১ সালে লোকসভা নির্বাচনের মুখোমুখি হতে হয় ভারতবাসীকে। সুতরাং পিতা জওহরলাল নেহেরুর আমলে ১৯৫২ সালে এক দেশ এক ভোট নীতি ভারতের সংবিধানে প্রথমবারের মতো দিনের আলো দেখলেও কন্যা ইন্দিরা গান্ধী হাত ধরে সেই বিধির কফিনে তখনকার মতো পেরেকটি গেঁথে দেওয়া হয়েছিল ১৯৬৭ সালে।
কি অদ্ভুত সমাপতন। যখন ভারতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এক দেশ এক ভোট নীতিকে কার্যত হিমঘরে পাঠিয়ে দিলেন, তখন তাঁকে গণতন্ত্র বিরোধী বলে অ্যাখ্যা দিয়েছিলেন সেই সময়কার ভারতীয় বিরোধী শিবির। পুনরায় বর্তমান কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী অর্জুনরাম মেঘওয়াল সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে এক দেশ এক ভোট বিলটি পেশ করলে তাতে গত ১৭ ডিসেম্বর ২৬৯ জন সাংসদ স্বপক্ষে ও বিপক্ষে ১৯৮ জন সংসদ সদস্য ভোটাভুটিতে অংশ নেন। আর তখনই গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধকারীর তকমা সেঁটে দিয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উদ্দেশ্যে তীব্র সমালোচনায় ব্যস্ত থাকলেন কংগ্রেসী শীর্ষ নেতৃত্ব সমেত প্রায় সমস্ত বিরোধীরা। সত্যি সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ! এক দেশ এক ভোট, গুম হবার মুহূর্তেও বিরোধীরা চীৎকার করতে পিছপা হননি সেদিন। আবার এর পুনঃ অক্সিজেন দানেও বিরোধীরা গলা ফাটাতে ‘সবে মিলি করি কাজ’ এ চরম তৎপর এদিনও। আর বিরোধিতার স্লোগানও কিন্তু অদ্ভুত রকমের এক। তা হলো ‘গণতন্ত্রের হত্যাকারী প্রধানমন্ত্রী, নিপাত যাক।’ অর্থাৎ নীতিটা যখন এক দেশ এক ভোট, তখন তার বিলীনেও গণতন্ত্র বিমুখতা দেখেন ভারতের বিরোধী নেতারা। আবার তার ফিরতি প্রতিষ্ঠাতেও গণতন্ত্রের শত্রুতা উপলব্ধি করেন দেশীয় বিরোধী দলগুলো।
ভারতের এই এক দেশ এক ভোট কিসসার পাশাপাশি সমগ্র বিশ্বের নিরিখে বহু গণতান্ত্রিক দেশে এই নীতি কিন্তু আজও যথেষ্ট জনপ্রিয়। পৃথিবীর ইতিহাস ঘাটলে, গণতান্ত্রিক এই বিধিবদ্ধ ব্যবস্থার প্রথম প্রবক্তা হলেন ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ ব্যক্তিত্ব চার্লস ফক্স। আঠারোশো শতকের প্রায় শেষদিকে এক দেশ এক ভোট করার ব্যাপারে তিনিই বিশ্বে প্রথম মতামত প্রকাশ করেন। তাঁর এই মতামত অনুসরণ করে ১৮৬০-১৮৭০ সময়কালের মধ্যে ইংল্যান্ডে ও আমেরিকার এহেন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সর্বপ্রথম।
অতুলপ্রসাদ সেনের সেই কালজয়ী রচিত গান, ‘বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান’ আজও কি আশ্চর্য রকমের প্রাসঙ্গিক। আসলে এটাই যে প্রকৃত ভারতবর্ষের চালচিত্র। গণতান্ত্রিক ও প্রজাতান্ত্রিক ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের চিরন্তনী ঐতিহ্য। আমাদের দেশের মধ্যে ২৮টি রাজ্য ও ৮টি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল রয়েছে। এখানে ১২২টি প্রধান ভাষাসহ ১,৫৯৯টি অন্যান্য ভাষা বিদ্যমান। বর্ণ রয়েছে ৬,৪০০টি। ৬টি ধর্ম। জাতি-গোষ্ঠীর সংখ্যাও ৬টি। এখানে ৫১টি উৎসব পালন করা হয় মহাসমারোহে। যার মধ্যে ১৭টি জাতীয় স্তরে, আর ৩৪টি আঞ্চলিক পর্যায়ে উদযাপন করা হয়। তাই তো প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী একদা আওয়াজ তুলেছিলেন, ‘মেরা ভারত মহান’। এই দেশ বহুত্ববাদের তন্ত্রে একাত্মতার মন্ত্রে দীক্ষিত। এই ভারত একাত্মতার সাধনে বহুত্ববাদের পালনেও শিক্ষিত। হয়তো দেশজ এই আত্মস্থ পরম্পরা ভাবনাকে আরও বলিষ্ঠ বুনিয়াদী করার প্রয়াসে কেন্দ্রীয় সরকার সম্প্রতি এক দেশ এক ভোট পুনরায় ভারতে লাগু করার ক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধনের রাস্তায় হাঁটতে পুরোপুরি বদ্ধপরিকর। অবশ্যই রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সাম্প্রতিক এই সরকারী পদক্ষেপের স্বপক্ষে ও বিপক্ষে বিস্তর আলোচনার এবং প্রবল সমালোচনার তুফান বইছে দেশজুড়ে। সেই কারণেই হয়তো সংশ্লিষ্ট বিলটি লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠের অনুমোদন পেলেও তা ঐক্যমত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটির কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে অতি সম্প্রতি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের নেতৃত্বে ২০২৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর নরেন্দ্র মোদী সরকার এক দেশ এক ভোট বিষয়ক একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করেছিল। অবশ্য সেই কমিটির তরফে গত বছরের ১৪ মার্চ রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর হাতে একটি পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট তুলে দেওয়া হয়। ১৮,০০০ পাতা সমৃদ্ধ মোট ৮ খন্ডের ওই রিপোর্টে দেশের সামগ্রিক লোকসভা ভোটের সঙ্গে সমস্ত প্রদেশের ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচনসহ সবগুলো রাজ্যের বিধানসভা ভোটও একত্রে সম্পন্ন করার বিস্তারিত পরামর্শ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। অন্যদিকে, ওই রিপোর্টটি গত ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা প্রয়োজনীয় অনুমোদন পেয়ে যায় তৎপরতার সঙ্গে।
সুতরাং বিরোধী জোট গণতান্ত্রিক পরিসরে যতই বিরোধিতার সুর চড়া করুক না কেন, এই মুহূর্তে এই ইস্যুতে সংসদের ট্রেজারি বেঞ্চ কিন্তু যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী। এখন শুধু অপেক্ষার প্রহর গোনার কামডাউন শুরু, জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটির অন্দরমহলে মোদী ম্যাজিক কতটা দ্রুত আর কতটা কার্যকরী ভূমিকা পালন করে, তা পরখ করার! কারণ ভারতের ১৪তম প্রধানমন্ত্রীর শ্যেনদৃষ্টি কিন্তু ঘুরেফিরে সেই সেই সেই ২০২৯...!
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামিস্ট, কলকাতা, পশ্চিম বঙ্গ, ভারত।