বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিউনিসিয়ার ধোঁয়া

প্রকাশ : ০২ জানুয়ারী ২০২৫, ২০:২৪ , অনলাইন ভার্সন
দিনভর উত্তেজনা, রাতভর নাটকীয়তা শেষে অন্তর্বর্তী সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ প্রকাশ না করে গত ৩১ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’তে আসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। দীর্ঘ বৈঠক শেষে গত ৩০ ডিসেম্বর মধ্যরাতে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বিপ্লবে যুক্ত সব দল ও মতের ঐক্যের ভিত্তিতেই জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র দেবে অন্তর্বর্তী সরকার। আগের মতো সংগঠিত হয়ে কর্মসূচিতে সকলকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণের আহ্বানও জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বৈঠক চলার মধ্যেই তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে চলতে থাকে উত্তেজনাকর মিছিল।
দফায় দফায় দীর্ঘ বৈঠক শেষে রাত পৌনে দুইটায় সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র দেওয়া হচ্ছে না। সমাবেশও স্থগিত হচ্ছে না। এর আগে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানান প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা জনগণের ঐক্য, ফ্যাসিবাদবিরোধী চেতনা ও রাষ্ট্র সংস্কারের আকাক্সক্ষাকে সুসংহত রাখার জন্য ঘোষণাপত্রটি গৃহীত হবে। রাতে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার সামনে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান তিনি। অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগকে স্বাগত জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম। কর্মসূচি নিয়ে সমন্বয়কদের মধ্যে কোনো মতানৈক্য নেই বলে দাবি করেন ব্যাপক আলোচিত সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ।
গোটা বিষয়টি আসলে এত সিম্পল নয়। ভেতরে-বাইরে পানি গড়িয়েছে অনেক। এখন পর্যন্ত দেশ যে সংবিধানে পরিচালিত হচ্ছে, সেটি বাতিল করে কবর দেওয়ার কথা চাউর হয়েছে কয়েক দিন ধরে। বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়ার কথাও এসেছে। এ নিয়ে আয়োজকদের চেয়ে মিডিয়ায় আব্দুল জলিলের বহুল আলোচিত ট্রাম্প কার্ড নিয়ে আলো-আঁধারির অবস্থা তৈরি হয়। এ উন্মাদনায় দেশের অন্যান্য জরুরি সব সমস্যা চাপা পড়ে যায়।  বৈষম্যবিরোধীরা সংবিধান বিষয়ে তাদের  প্রস্তাবগুলো সংবিধান সংশোধন কমিটির কাছে তুলে না ধরে এত দিন পর বিপ্লবী সরকার গঠনের তোড়জোড় সন্দেহ আরও বাড়িয়ে দেয়। আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধ ব্যবসার কারণে মুক্তিযুদ্ধ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে না গেলেও একটা চক্র পরিকল্পিতভাবে আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জন অস্বীকার করতে চায়। তারুণ্যের উন্মাদনায় ভর করে ফায়দা নেওয়ার বিপরীতে আতঙ্কজনক অবস্থায় পড়ে বিএনপি। তারা এর মাঝে ফরহাদ মজহারসহ কারও কারও কারসাজি দেখছে।
ফরহাদ মজহার আরও আগেই বলে রেখেছেন, আওয়ামী লীগ সংঘবদ্ধ দুর্বৃত্তের দল। আর বিএনপি সংস্কৃতিবিহীন মূর্খের দল। সেই কথার রেফারেন্সে এখনো অনেকেই বিএনপির সমালোচনা করে। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের মুজিবনগরে যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল এবং বাংলাদেশের নতুন সংবিধান প্রণীত হওয়ার আগ পর্যন্ত যে ঘোষণায় দেশ চলেছে, অনেকটা তার মতো এর মাধ্যমে বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধান ৩১ ডিসেম্বর খারিজ করার ছকের গন্ধ পাচ্ছিল। এটা সরকারিভাবে হলে সরকারের বৈধতার বিষয় আসে। কারণ সংবিধান মেনে সরকার শপথ নিয়েছে, এ জন্য সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেছেন, এটার সাথে সরকার নেই। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন আগের মতো গ্রহণযোগ্যতার জায়গায় নেই। গত মাস কয়েকে তাদের কিছু কর্মকাণ্ড যথেষ্ট বিতর্ক তৈরি করেছে।
৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের রাজনীতির গতি পরিবর্তন হয়েছে। নতুন চাহিদাদৃষ্টে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়নি। বিএনপির একাংশ এত দিন ঘোরে থাকলেও বাকিরা সতর্ক। ওয়ান ইলেভেনের মতো এবারও টার্গেট অনুভব করছে। তাদের রাজনীতি সংকুচিত করার চেষ্টা টপ টু বটম অনুধাবন করছে বিএনপি। ৩১ ডিসেম্বরের ধাক্কায় বেঁচে গেলেও ছাত্ররা এখনো রাজনীতিতে ফ্যাক্টর, তা বিবেচনায় নিয়ে এগোচ্ছে বিএনপি। তাদের সহায়ক হিসেবে আছে নাগরিক কমিটি। প্রক্লেমেশন তাদের সম্মিলিত অ্যাজেন্ডা। কেবল আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি বা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী জোটে থাকা দলগুলো নয়; বিএনপিকেও তারা একতরফা আমল দিতে নারাজ। যার মাঝে আগামী দিনের রাজনৈতিক গতিপথ বদলে যাওয়ার বার্তা মিলছে।
বিপ্লবের পর আর্থসামাজিক পরিবর্তনের আকাঙ্খাগুলোর তীব্রতায় বাড়তি ভাবনায় যাচ্ছে তারা। সেই ভাবনার করিডোরে তিউনিসিয়া, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশ। এর মধ্যে তিউনিসিয়ার শাসক পালিয়ে যান ২০১১ সালে। জেসমিন বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশটি ত্যাগ করেন জাইন আল আবেদিন বেন আলি। ব্যাপক গণবিক্ষোভের মুখে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ ছেড়ে শ্রীলঙ্কা থেকে পালিয়েছিলেন রাজাপাকশে ভাইদের মধ্যে ‘স্ট্রংম্যান’ হিসেবে পরিচিত গোতাবায়া রাজাপাকশে। সর্বশেষ গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন দেড় দশক ধরে বাংলাদেশ শাসন করা শেখ হাসিনা। তিনটি অভ্যুত্থানের মধ্যেই মিল হলো পতিত এ তিন সরকারই ছিল ফ্যাসিস্ট চরিত্রের। নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দল নয়, তরুণদের দ্রোহের মধ্যে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে এলে এসব স্বৈরশাসক দেশ ছেড়ে পালান। তিউনিসিয়ায় অভ্যুত্থানের সময় পেরিয়েছে এক যুগেরও বেশি। এখনো অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ের অস্থিরতা থেকে বের হতে পারেনি দেশটি।
অন্যদিকে শ্রীলঙ্কায় ২০২২ সালে ঘটা অভ্যুত্থানের দুই বছরের মধ্যেই শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে স্থিতিশীল জায়গায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পাঁচ মাসেও জনজীবনে স্বস্তি আনার মতো কোনো পরিবর্তন আসেনি। উন্নতি হয়নি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও। অর্থনৈতিক অবস্থা পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় সাফল্যের লক্ষণ নেই। গোতাবায়া রাজাপাকশে সরকারের পতনের সময় শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতির হার ছিল প্রায় ৬৭ শতাংশ। ডলার সংকটে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করা দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপদেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও তখন ৩ বিলিয়ন ডলারের নিচে। দুই বছরের মধ্যেই তীব্র প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে সফলতার সঙ্গে ঘুরে দাঁড়ানোর নজির হয়ে দাঁড়িয়েছে শ্রীলঙ্কা। মূল্যস্ফীতি নয়, বরং চলতি বছরের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত টানা তিন মাস মূল্য সংকোচনের দেখা পেয়েছে দেশটি। রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ৬ বিলিয়ন ডলারে। অর্থনীতির পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবেও শ্রীলঙ্কা এখন বেশ স্থিতিশীল।
এরই মধ্যে দেশটির পার্লামেন্ট নির্বাচনে আনুরা কুমারা দিশানায়েকের বামপন্থী জোট ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ারÑএনপিপি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। নির্বাচনের পর সব রাজনৈতিক দলই এখন দেশ গড়ার কাজে যুক্ত হয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণ প্রজন্মও নিজ নিজ কাজে ফিরে গেছে। অথচ এক যুগেও ব্যর্থতার বৃত্ত থেকে বেরোতে পারেনি তিউনিসিয়া। বিপুল গণবিক্ষোভের মুখে ২০১১ সালের ১৪ জানুয়ারি দেশটির স্বৈরশাসক জাইন আল আবেদিন বেন আলির পতন ঘটে। ২৩ বছর ধরে ক্ষমতা আটকে রাখা এ শাসকও দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। তরুণদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এ আন্দোলন পরিচিতি পেয়েছিল জেসমিন রেভল্যুশন বা জেসমিন বিপ্লব নামে। আরব বসন্তের সূচনাকারী সফল এ অভ্যুত্থানের এক দশকের বেশি সময় পেরোলেও তিউনিসিয়া এখনো দিশা খুঁজে পায়নি। অর্থনীতির পাশাপাশি রাজনীতিতেও স্থিতিশীলতা ফেরেনি। অর্থনৈতিক সংকোচন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগ খরা, বেকারত্ব, দুর্বল রিজার্ভসহ নানামুখী চাপের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে তিউনিসিয়া। বেন আলির পতনের পর এখন পর্যন্ত দেশটির শাসনক্ষমতায় পরিবর্তন এসেছে চারবার। কোনো সরকারই জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। এ কারণে জেসমিন বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়া তিউনিসিয়ান তরুণেরা দলে দলে দেশ ছেড়েছেন। বাংলাদেশের শ্রীলঙ্কার মতো ঘুরে দাঁড়ানোর চেয়ে তিউনিসিয়ার মতো বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হওয়ার লক্ষণ দিন দিন দৃশ্যমান।
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: +880  1338-950041