আই লাইক টু টেক মাই দাদা হোম

প্রকাশ : ০২ জানুয়ারী ২০২৫, ১১:৪২ , অনলাইন ভার্সন
জীবনপথে চলতে চলতে কিছু দৃশ্য চোখে পড়ে, যা কখনো জীবনপাতা থেকে আর মুছে যায় না। তেমনি আমার ডাক্তারি জীবনের একটি স্মৃতির কথা বলছি :
নার্সিং হোমে ঢোকার মুখে রিসেপশনিস্ট ডেরেক নিজের ডেস্ক থেকে উঠে দৌড়ে এসে বলল :
-ডাক্তার, তোমাকে লং টার্ম কেয়ার থেকে বারবার ওভার হেড পেজ করছে। তাড়াতাড়ি যাও। মনে হয় কোনো ইমার্জেন্সি।
অন্যদিনের তুলনায় আজ একটু তাড়াতাড়ি এসেছি। কারণ জন খুব মুমূর্ষু অবস্থায় যেকোনো সময় মারা যেতে পারে। যেতে যেতে চোখ পড়ল গেটের অদূরে পড়ে থাকা খালি হুইলচেয়ারটা, যেখানে বসে জন প্রতিদিন অপেক্ষা করত কারও জন্য।
শর্ট টার্ম, ইন্টারমিডিয়েট টার্ম পার হয়ে নার্সিং হোমের শেষ মাথায় লং টার্ম কেয়ারে ইউনিট, যেখানে বয়স্ক রোগীরা থাকে আমৃত্যু। কেউ দশ, কেউ বিশ বছর ধরে। এটাই তাদের ঘরবাড়ি। জন তাদেরই একজন।
খুব দ্রুত সেখানে পৌঁছে গেলাম। জনের রুম নং ৩০৪। তার রুমের সামনে জটলা। রুমে ঢুকে যে দৃশ্য দেখলাম, তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। জনের ডেডবডিটি ধরে বসে আছে জ্যানেট আর তার দু’গাল বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়ছে। জ্যানেট এই ইউনিটের স্টাফ নার্স। সাধারণত এমন দৃশ্য দেখা যায় না। বরং উল্টো। কোনো মৃত্যুর পর সে সবাইকে তাড়া করতে থাকে। যাকে যা করার কথা তা যেন তাড়াতাড়ি ও ঠিকমতো করে।
জন একজন ভারতীয়। সে গোয়ার অধিবাসী। ক্রিশ্চিয়ান। একজন রিটায়ার্ড কলেজশিক্ষক। স্ট্যাটিসটিকস পড়াত এখানে এক কলেজে প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর ধরে। এ দেশে এসেছিল আশির দশকের প্রথম দিকে। জনের একটাই ছেলে। নাম রবীন। সে আইটি ইঞ্জিনিয়ার, খুব ভালো চাকরি করে। এই শহরেই থাকে।
জনও এই শহরেই অন্য প্রান্তে স্ত্রীর সঙ্গে বসবাস করত। বছর পাঁচেক আগে জনের স্ট্রোক করে। কোমর থেকে নিচের দিকে প্যারালাইসিস। সে হাত দিয়ে খেতে পারে কিন্তু টয়লেট, গোসল, ড্রেসআপ ক্লিনিংÑএসব কিছুই করতে পারে না। তার স্ত্রী তার থেকে বছর সাতেকের ছোট। সেই তাকে দেখাশোনা করে। কিন্তু হঠাৎ কোভিড এসে তার স্ত্রীকে নিয়ে গেল বছরখানেক আগে। জন কোনো অবস্থায় নার্সিং হোমে যাবে না। তাই বাধ্য হয়ে ছেলে রবীন তাকে তার কাছে নিয়ে আসে। ছেলে রবিনের দুই সন্তান। বড়টা ইউনিভার্সিটি অব মিশিগানে ফ্রেশম্যান। ছোটটা তিন থেকে চারে পড়ল। নাম বান্টি। বান্টির মা সাদা। এখানে এক ছোট কোম্পানিতে ম্যানেজারিয়াল জব করে। সাদা আর ব্রাউনের মিশ্রণে অপূর্ব রং বান্টির। ফোলা ফোলা গাল। কোঁকড়ানো বাদামি চুল। মিষ্টি হাসি। দেখলেই মনে হয় একটু কোলে নিয়ে আদর করি। যখন থেকে সে হাঁটতে শিখেছে, তখন থেকে দাদার কাছেই তার সময় কাটে। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠতেই থপথপ করে হেঁটে দাদার কাছে চলে আসে। দাদা তাকে A-তে apple, B-তে Ball, আবার কখনো রাইমস শোনায়। টুইংকেল টুইংকেল লিটল স্টার...। কিছু হলেই কিংবা কিছু দেখলেই ভাঙা ভাঙা কথায় দাদাকে এসে শুনতে হবে সেটা। দাদা তার বেস্ট ফ্রেন্ড।
বান্টি হচ্ছে তার দাদার প্রাণ। ছোটবেলায় রূপকথায় পড়েছিলাম, ওই দৈত্যের জীবন থাকে ওই প্রাণভোমরার ভেতরে। ঠিক তেমনি দাদার প্রাণভোমরা হচ্ছে বান্টি। তাকে ছাড়া দাদা কিছু চিন্তা করতে পারে না।
এর মাঝে হয়ে গেল দ্বিতীয় বিপত্তি। জনের দ্বিতীয় স্ট্রোক হলো। প্রথম স্ট্রোকে যেটুকু বাকি ছিল, তাও চলে গেল। এখন সে কিছুই করতে পারে না। বাধ্য হয়ে তাকে এই নার্সিং হোম দিতে হলো। তাকে বলা হলো এটা খুবই সাময়িক-এক-দুই সপ্তাহে ইমপ্রুভ করলেই সে বাসায় চলে আসবে। কিন্তু তা আর হলো না।
এদিকে দাদার অভাবে বান্টি বারবার অসুস্থ হতে লাগল।
তার পেডট্রিশিয়ান কোনো অসুখ খুঁজে পায় না। বান্টির বাবা কিছুটা আঁচ করতে পারে। তাই সে বান্টিকে বারবার নার্সিং হোমে আনতে থাকে দাদার কাছে। তাতে হিতে বিপরীত হয়। যতক্ষণ দুজনে একসঙ্গে থাকে খুব ভালো থাকে। চলে গেলে দুজনে আরও অসুস্থ হয়ে যায়। জনের কোনো কিছুর প্রতি কোনো আগ্রহ নেই। সে নিজের রুমে থাকতে চায় না। সে নার্সিং হোমের মেইন এন্ট্রান্সের পাশে হুইলচেয়ারে বসে অপেক্ষা করতে থাকে সারা দিন। বান্টি আসবে।
দিনকে দিন জন কঙ্কালসার হয়ে গেল। প্রায় প্রতি মাসেই হসপিটালে যেতে হয়। একটার পর একটা প্রবলেম আসতে থাকল। কখনো হার্ট, কখনো লাংস, কখনো কিডনি আর কখনো-বা সুগার। তার ওপর সে ছিল DNR (Do not recicitate)। আমেরিকায় এটা পেশেন্টের একটা উইল। অর্থাৎ যখন আমার মৃত্যু আসবে, আমাকে যেতে দাও। আমাকে নিয়ে টানাটানি করো না। অন্যদিকে আমেরিকার আইনে কেউ খেতে না চাইলে জোর করা যাবে না। এদিকে ফিডিং টিউব দেওয়া যাবে না, কারণ তার উইল আছে ওসব না করার। তা করা বেআইনি। মনে হয় সে না খেয়ে মারা যাবে। এর মাঝে হঠাৎ একদিন দেখি স্টাফ নার্স জ্যানেট খুব খুশি, কারণ তার খাবার যা সে বাসা থেকে নিয়ে আসে নিজের জন্য, সে ট্রাই করেছে এবং জন পেটভরে খেয়েছে। আসলে ব্যাপারটা অন্য রকম। জ্যানেটের বাবা-মা নেই। ছয় বছর বয়সে মায়ের সঙ্গে এখানে চলে আসে ইমিগ্র্যান্ট হয়ে মেক্সিকো থেকে। তারপর স্টেপ ফাদারের কাছে বড় হয়েছে। এখানে আসার পর নিজের বাবাকে আর কোনো দিন দেখেনি। কিন্তু বাবার একটা পুরোনো ছবি ও কিছু স্মৃতি মনে আছে। জনের চেহারা নাকি তার বাবার মতো। তাই জনের ভেতরে সে তার বাবাকে দেখতে পায়। তাই জনের প্রতি তার এত মায়া। সে নার্সিং স্টেশনের সামনে একটা জেরি চেয়ারে তাকে বসিয়ে রাখে, যাতে তাকে চোখে চোখে রাখতে পারে সারা দিন। পরে জেনেছি জ্যানেট জনকে বলত বাবা। আর জন তাকে বলত মা। তার পর থেকেই জ্যানেটের খাবারই খেত। এমনকি সে অফ থাকলেও বাসা থেকে খাবার নিয়ে আসত। এত কিছুর পরও ওয়েট লস বন্ধ করা গেল না। বিপত্তিটা বাজল থাঙ্কসগিভিংয়ের সময়।
আজ প্রায় ছয়-সাত দিন হলো জন কিছুই খাচ্ছে না। এমনকি ওষুধপত্রও নয়। তার প্রচণ্ড অভিমান সবার প্রতি। অভিমান মানুষের প্রতি, অভিমান এই পৃথিবীর প্রতি, অভিমান সৃষ্টিকর্তার প্রতি। সে বসে থাকে হুইলচেয়ারে জড় পদার্থের মতো। কে এল, কে গেল। দিন না রাত। কী হচ্ছে চারপাশে কোনো খেয়াল নাই। কমপ্লিটলি উইথড্রোন। গত দুদিন সেই হুইলচেয়ারেও বসতে পারেনি। কারণ এত দুর্বল যে বিছানা থেকেই উঠতে পারে না।
রবীন বাসায় বসে সব খবর পাচ্ছিল। জ্যানেট তাকে প্রতি ঘণ্টায় আপডেট করছিল। সে জানে, তার বাবার সময় ঘনিয়ে এসেছে। কিন্তু তার চিন্তা সে বান্টিকে সামাল দেবে কীভাবে। এসব চিন্তা করতে করতেই আজকে বান্টিকে নিয়ে সে তার দাদার কাছে এসেছে। হয়তো হতে পারে এটাই তার শেষ দেখা। বান্টি এসে দেখে, দাদা ঘুমাচ্ছে। অন্য দিনের মতোই দাদার বুকের ওপর লাফিয়ে পড়ল। দাদা কিন্তু নড়ছে না। চোখ মেলে একটু তাকাল। তারপর আবার ঘুমিয়ে গেল। নিশ্চয় দাদা দুষ্টুমি করছে। এবার গলা জড়িয়ে ধরল। আবার দাদা চোখ মেলে একটু তাকাল। আবার ঘুমিয়ে গেল। না, এ তো তার দাদা নয়। এদিকে জন প্রচণ্ড চেষ্টা করছে তার চোখ দুটো খুলতে। কিন্তু পৃথিবীর সব ঘুম যেন তার চোখের পাতায়। কোনোভাবেই চোখের পাতা মেলতে পারছে না। রবীন আর বান্টি আসতেই জ্যানেট রবীনকে নিয়ে তার অফিসে গেল এবং তাকে পুরোপুরিভাবে পরিস্থিতিটা বুঝিয়ে বলল। বলতে বলতেই জ্যানেট হুঁ হুঁ কেঁদে ফেলল। রবীন বুঝতে পারল, এই অবস্থায় বান্টিকে এখানে রাখা ঠিক হবে না। এটা তার জন্য খুব ট্রমাটিক হবে। তাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে নিয়ে যাওয়া দরকার। রবীন দেরি না করে জনের রুমে গেল। বাবাকে দেখে বুক ফেটে কান্না আসছিল। কিন্তু না, তা করা যাবে না। সে বান্টিকে কোলে নিয়ে ৩০৪ নং রুম থেকে বেরিয়ে এল।
কিন্তু বান্টি তার দাদা ছাড়া কিছুতেই যাবে না। কারণ এর আগেও তার বাবা প্রমিস করেছিল, দাদাকে বাসায় নিয়ে যাবে। কিন্তু সে তা রক্ষা করেনি। তাই আজ সে তার দাদাকে ছাড়া কিছুতেই যাবে না। বান্টি কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে ফ্লোরে শুয়ে পড়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। রবীন তার ছেলেকে বুকের মাঝে প্রাণপণে জাপটে ধরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আর বান্টি তার সর্বশক্তি দিয়ে হাত-পা ছুড়ে চিৎকার করে কাঁদছে। সে এক বেদনাবিধুর পরিবেশ চারদিকে। রবীন একটু বিরতি দিয়ে আবার জোর করে বান্টিকে নিয়ে যাচ্ছে আর ছোট্ট শিশুটি চিৎকার করে কাঁদছে আর বলছে, ‘আই লাইক টু টেক মাই দাদা হোম।’ নার্সিং হোমের ডিমেন্টেড পেশেন্টগুলো শিশুর মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখছে নার্স, নার্স অ্যাসিস্ট্যান্ট সবাই কাঁদছে। আর আস্তে আস্তে শিশুটির কান্না দূরে চলে যাচ্ছে। কিন্তু তখনো দূর থেকে ভেসে আসছিল বান্টির কান্নামাখা আকুতি, ‘আই লাইক টু টেক মাই দাদা হোম।’
 
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: 01711238078