প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের অবসানে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা অর্জন করল ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি পৃথক রাষ্ট্রের সৃষ্টির মাধ্যমে। ভারতীয় রাজনীতিবিদ গান্ধী-প্যাটেল-নেহরু ও সহযোগী এমএ জিন্নাহর জাতি ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের একীভূত দ্বিজাতিতত্ত্বের মনগড়া সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে। পাকিস্তান সৃষ্টি হলো উপমহাদেশের মুসলমানদের স্বাধীন আবাসভূমি হিসেবে। পাকিস্তান ছিল দুটি অংশে-পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। পূর্ব বাংলা গঠিত হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে। অন্যদিকে কয়েকটি অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তান। জনসংখ্যার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও শুরু থেকেই পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা থেকে গেল সংখ্যালঘিষ্ঠ পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে। সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব পাকিস্তানিরা শুরু থেকেই সংখ্যালঘিষ্ঠ পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিমাতাসুলভ আচরণে অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিকসহ সর্বক্ষেত্রে বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হতে লাগল। বঞ্চনা ও বৈষম্য অব্যাহত গতিতে চলতে থাকল এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের মৌলিক ও বৈধ অধিকার মাতৃভাষা বাংলাকে ন্যায্য মর্যাদা না দিয়ে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বাঙালিরা মাতৃভাষা সুরক্ষার আন্দোলন শুরু করলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে অসংখ্য বাঙালিকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। আন্দোলনের তীব্রতার মুখে শাসকগোষ্ঠী বাধ্য হয়ে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার স্বীকৃতি দেয়। মাতৃভাষা বাংলার সুরক্ষা ও প্রতিষ্ঠার এই অর্জন অগণিত ভাষাসংগ্রামীদের নির্যাতন ও ভাষাশহীদদের রক্তের বিনিময়ে। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়লাভ সত্ত্বেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে নৃশংসভাবে বাঙালিদের নিধন ও হত্যাযজ্ঞ শুরু করে।
এ অবস্থায় বাঙালিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার আন্দোলন ও স্বাধিকার আন্দোলন ছাড়া গত্যন্তর ছিল না এবং শেখ মুজিবুর রহমানের ’৭১-এর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের মহামন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে ও ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে গ্রেফতারের পূর্বে আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা, যা প্রথমে ইপিআর ওয়্যারলেসে প্রচার ও পরে রাজনীতিক আব্দুল হান্নান কর্তৃক মাইকে প্রচার, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সম্প্রচার এবং ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে এই ঘোষণা পুনঃপ্রচার তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান কর্তৃক পঠনক্রমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালি। তারপর দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও স্বাধীনতাযুদ্ধ তথা মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর শোচনীয় পরাজয় স্বীকার ও আত্মসমর্পণের মাধ্যমে ৩০ লাখ শহীদ এবং ২ লাখের অধিক মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন তথা কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা লাভ। এভাবেই মাতৃভাষার আন্দোলনের সূত্র ধরে স্বাধীনতার চেতনার মধ্যে ভাষা আন্দোলনের চেতনা একাকার হয়ে বাঙালির বিজয় অর্জন ও স্বাধীন মাতৃভূমির প্রতিষ্ঠা তথা এ দেশের নির্যাতিত মানুষের গণ-আন্দোলনের চেতনায় ও মরণজয়ী সংগ্রামের ফলে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ও অভ্যুদয়।
ভাষা আন্দোলনের চেতনা ছিল মাতৃভাষা বাংলার সুরক্ষা ও সর্বস্তরে মায়ের ভাষার প্রচলন ও বাস্তবায়ন এবং সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষার মধ্য দিয়ে জাতীয় আত্মপরিচয় ও স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনা ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদাবোধ ও সামাজিক ন্যায়বিচার রক্ষা করে শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার। স্বাধীনতার চেতনার মধ্যে ভাষা আন্দোলনের চেতনা মিলেমিশে একাকার। এই চেতনার সারকথা জাতীয় স্বাতন্ত্র্য রক্ষা, স্বাধীন জাতিসত্তার প্রতিষ্ঠা এবং সেই রাষ্ট্রে গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক সমতা, বৈষম্যহীনতা, মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণ। প্রকৃত গণতন্ত্রের প্রধান শর্তগুলো হচ্ছে মৌলিক অধিকারসমূহের স্বীকৃতি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং নাগরিকদের পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সহনশীলতা।
১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের তৃতীয় অনুচ্ছেদেও স্বাধীনতার চেতনা অবলম্বনে অঙ্গীকার করা হয় আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা, যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিতকরণ অর্থাৎ বাংলাদেশের যেখানে অর্থনৈতিক উন্নতি যতটুকু হবে সেটার ক্ষেত্রে সাম্য, বৈষম্যহীনতা, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হবে। বাস্তবে এমন অনুসরণ করা হয়নি। স্বাধীনতার ৫৩ বছরে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পূর্ব পর্যন্ত যত রাজনৈতিক দল বা সরকারই ক্ষমতায় এসেছিল, সব সরকারই এককেন্দ্রিক এবং জবাবদিহির বাইরে। কেউই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে মুক্তিযুদ্ধে লাখ লাখ প্রাণ উৎসর্গ, আত্মবিসর্জন, আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার চেতনা অনুসরণে দেশ শাসন করেননি। দেশের সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে ছিল প্রতিহিংসার রাজনীতি, নীতিহীন রাজনীতি। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ৫৩ বছরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, বিএনপি পালাক্রমে দেশ শাসন করেছে। ২০০৮, ২০১৩, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনে পরপর প্রশ্নবিদ্ধ জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার টানা ১৫ বছরেরও অধিককাল ক্ষমতায় থাকে। শেখ হাসিনার শাসনামলে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করে স্বৈরতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং দুর্নীতি দমনের নামে মুখে শুদ্ধি অভিযানের কথা বলে বাস্তবে স্বজনপ্রীতি ও নিজে দুর্নীতি করে এবং প্রভাবশালীরাও এতে দুর্নীতির সুযোগ পায়।
শেখ হাসিনার আমলে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়ে নিজের এবং প্রভাবশালীদের জন্য দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি করে যেসব প্রকল্প নিয়েছিলেন, এর মধ্যে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্প অন্যতম। এসব প্রকল্পের জন্য ভারত, চীন, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও দেশের কাছ থেকে কঠিন শর্তের ঋণ নিয়েছিল শেখ হাসিনা সরকার। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে যখন শেখ হাসিনা ক্ষমতা নেন, তখন দেশি-বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ৭৭ হাজার কোটি টাকার মতো। এরপর সাড়ে ১৫ বছর টানা তার ক্ষমতায় থেকে ঋণ ফুলে-ফেঁপে গিয়ে ঠেকে ৬ গুণে। ক্ষমতা ছেড়ে যাওয়ার সময় তিনি ঋণের বোঝা রেখে গেছেন ১৮ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার মতো। সুদসহ এ ঋণের কিস্তি শোধ করতে হবে বর্তমানে যারা ক্ষমতায় থাকেন তাদেরকে আগামী বছর থেকেই।
শেখ হাসিনার সময়ে তথাকথিত উন্নয়ন হচ্ছিল স্বীকার করেই বলতে হয়Ñএকদিকে উন্নয়ন, অন্যদিকে অবনমন, একদিকে উন্নতি-অগ্রগতি, অন্যদিকে দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন, স্বজনপ্রীতি, নৈতিক অবনতি ছিল। এককথায় সাফল্যের পাশাপাশি ব্যর্থতাও ছিল সমধিক। দেশের উন্নয়ন হচ্ছিল দুর্নীতি করে, অতি ব্যয়ের মাধ্যমে। একটি প্রকল্প অনুমোদনের সঙ্গে সঙ্গে একশ্রেণির দুর্নীতিপরায়ণ লোক উল্লসিত হয়। উল্লসিত হয় এ কারণে যে, অবৈধ উপায়ে দুর্নীতি করে অর্থ উপার্জনের সুযোগ সৃষ্টি হলো। জিডিপি বৃদ্ধি উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে কী লাভ, যদি একশ্রেণির প্রভাবশালী ও দুর্নীতিবাজের হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়, সকল শ্রেণির মানুষের অবস্থার গুণগত পরিবর্তন না হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে উন্নয়ন ও উন্নতি এক কথা নয়। কারণ বাংলাদেশে উন্নয়নের সঙ্গে দুর্নীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে উন্নয়ন হয়ে যায় অবনমন আর উন্নতি হয়ে যায় অবনতি। দুর্নীতি, অবনমন, অবনতি ও স্বজনপ্রীতির সমান্তরাল অবস্থানের কারণে শেখ হাসিনার শাসনামলে আপামর জনসাধারণ বৈষম্যহীনভাবে উন্নয়ন, উন্নতি ও সাফল্যের ফল ভোগ করতে পারেনি। সুফল ভোগ করেছে শেখ হাসিনার ছত্রচ্ছায়ায় প্রভাবশালী ও প্রতিপত্তিশালীরা। উন্নয়ন যদি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে স্বস্তি, সুখ ও শান্তি দিতে না পারে, তাকে মানুষ উন্নয়ন বলতে পারে না, তা দুর্নীতির উৎস।
উপরিউক্ত আলোচনায় এটা বুঝতে অসুবিধা হবে না যে একদিকে উন্নতি, অন্যদিকে অবনতি স্বাধীনতার চেতনা-বিরুদ্ধ। স্বাধীনতা মানে শুধু পরাধীনতা থেকে দেশকে মুক্ত করা নয়। স্বাধীনতা মানে যথেচ্ছাচারের ছাড়পত্র নয় যে আমরা যেমন খুশি তেমন ব্যবহার করব, যেমন খুশি তেমনভাবে চলবÑঅন্যের স্বার্থ পদদলিত করে। স্বাধীন দেশের রাজনীতি মানে যা ইচ্ছা তা করা নয়। স্বাধীনতা হলো সব নাগরিকের সমান অধিকার, সৌহার্দ্যপূর্ণ ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করা। স্বাধীনতা মানে দেশের সার্বিক উন্নতি, অগ্রগতি সমুন্নত রেখে জনগণকে বৈষম্যহীনভাবে অর্থনৈতিক মুক্তি দেওয়া। অতীতে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার আমলে দেশ অর্থনৈতিকভাবে বৈষম্যমুক্ত, সমৃদ্ধ হতে দুর্নীতি ছিল বড় বাধা। দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়াও স্বাধীনতা অর্জনের মতো গুরুত্বপূর্ণ। শেখ হাসিনার আমলে সরকারিভাবে বলা হতো উন্নয়নের স্রোতে দেশে জনজীবনে অনেক উন্নতি হয়েছে। কথাটা সঠিক ছিল প্রভাবশালী-প্রতিপত্তিশালী ধনিক শ্রেণিদের ক্ষেত্রে, যারা দুর্নীতি করে অবৈধভাবে সম্পদের পাহাড় গড়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে বিলাসী জীবনযাপন করেছে সাধারণ মানুষকে চরম দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় নিপতিত করে। সাধারণ মানুষ, গরিব শ্রেণির মানুষের ক্ষেত্রে ওই কথাটা প্রযোজ্য ছিল না। তা যদি হতো, অভাব ও অসচ্ছল অবস্থা নিয়ে দেশের বড় এক জনগোষ্ঠীকে বস্তিতে-ফুটপাতে দিনাতিপাত করতে হতো না।
তারপর বেকারত্বের প্রশ্ন। শেখ হাসিনার আমলে দেশে উন্নয়ন হচ্ছিল, প্রজেক্ট হচ্ছিল, কল-কারখানা বাড়ে। সুতরাং কর্মসংস্থান বাড়ার কথা। কিন্তু তা হয়নি। বেকারত্ব বেড়েই চলে। বেকারত্ব নিরসন হয়নি। শিক্ষার হার বাড়লেও কর্মসংস্থানের অভাবে বেশির ভাগ শিক্ষিত তরুণ বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে দিন কাটায়। উন্নয়নে লাভবান হয় ধনিক শ্রেণি, প্রভাবশালী, দুর্নীতিবাজরা। সাধারণ মানুষ বৈষম্যের শিকার হয়। বাংলাদেশে ধন-সম্পদগত বৈষম্য ক্রমশ বেড়ে চলে। ধনী-গরিবের মধ্যে পার্থক্য কঠিন পর্যায়ে চলে যায়। বাংলাদেশে ধনী আরও ধনী হয়, গরিব তুলনামূলকভাবে প্রত্যাশিত সচ্ছল হতে পারেনি।
শেখ হাসিনার দুঃশাসনের সময়ে ধনিক শ্রেণির মানুষ নিজের বিলাসী জীবন নিয়ে ব্যস্ত থাকে। দুর্নীতিবাজ প্রতিপত্তিশালীরা অসমর্থ, সুবিধাবঞ্চিত, শ্রমিক শ্রেণির কারও জন্য চিন্তা করার মানসিকতা পোষণ করেনি। অথচ এই শ্রমিক শ্রেণির হাড়ভাঙা খাটুনিতে গড়ে ওঠে ধনিক শ্রেণির অট্টালিকা, যেখানে তারা এসি ছেড়ে খেতে পারে, আরামে ঘুমাতে পারে। অনেক কথাই বলতে হয়Ñসব কথা বলতে গেলে কলেবর বৃদ্ধি পাবে। তবে আরেকটা বিষয় রেখাপাত না করলেই নয়। সেটা হলো শেখ হাসিনা সরকারের প্রশাসনিকভাবে, মন্ত্রী-এমপিদের পর্যায়ে অতিব্যয় ও অপব্যয়। মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও উপদেষ্টাদের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। তদুপরি তাদের বেতন-ভাতার আধিক্য। সরকারি খরচে তথা জনগণের অর্থে মন্ত্রী-এমপিদের বিলাসী জীবনযাপন। যদিও তাদের মুখে জনগণের কল্যাণের জন্য অনেক বড় বড় কথা শোনা গেছে। ধনীদের আরও ধনী হওয়ার নেশা এই সমাজে ধনী-গরিবের বৈষম্যকে প্রকট করতে দায়ী। গরিবের পিঠে পা রেখে ধনী শ্রেণি গাড়ি-বাড়ি, ব্যাংক ব্যালেন্স করে অর্থনীতিকে যেমন নিয়ন্ত্রণ করেছে, তেমনি সমাজনীতি রাজনীতিতে তাদের অর্থের কুপ্রভাব দুঃশাসনের সুযোগ করে দিয়েছে।
শেখ হাসিনা, তার গোষ্ঠী এবং তার দল আওয়ামী লীগ মনে করত, দেশের মালিকানা তাদেরই। তার পিতার ও স্বাধীনতার পূর্বের সংগ্রামী শেখ মুজিবের এবং স্বাধীনতার পরে শাসক শেখ মুজিবের মধ্যে তফাত ছিল। দেশের মানুষ মনে করে, তিনি বাকশাল গঠন করেছিলেন একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। তবু স্বাধীনতাসংগ্রামে জনগণের সহযোগিতায় তার অবিসংবাদিত ভূমিকার জন্য তিনি যে স্বাধীনতার স্থপতি, তা অনস্বীকার্য। বাকশাল গঠনের উদ্দেশ্য রহস্যাবৃত। শেখ মুজিব নিহত না হয়ে যদি জীবিত থাকতেন, বাকশাল বাস্তবায়িত হলে উদ্দেশ্য পরিষ্কার হতো।
আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শক্তির মূল উৎপাটন করার জন্য এগিয়ে এলেন বৈষম্যের শিকার নতুন প্রজন্মের ছাত্ররা। শেখ হাসিনার শাসনামলে তার প্রধানমন্ত্রিত্বে এক ব্যক্তি তার আত্মীয়স্বজন, জ্ঞাতিগোষ্ঠী, মোসাহেব ও লাঠিয়ালদের নিয়েই দেশের শাসনকাজ পরিচালিত হয়েছে। এর বিরুদ্ধে মানুষ ক্ষুব্ধ ছিল, কিন্তু তা প্রকাশের সাহস পাচ্ছিল না। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে চাকরিতে কোটা বৈষম্যের আন্দোলনে সোচ্চার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সাধারণ জনগণ ক্ষোভ প্রকাশের সুযোগ পায় এবং আন্দোলন জোরদার করে। পূর্বেকার সরকারি সিদ্ধান্তে চাকরিতে ৩০ শতাংশে মুক্তিযোদ্ধা ও উত্তরসূরিদের জন্য কোটা সংরক্ষিত থাকায় চাকরিপ্রার্থী যুবসমাজ বৈষম্যের শিকার হয় এবং শিক্ষা শেষে অনেক মেধাবীও চাকরিবঞ্চিত হয়। আপিল বিভাগের সংশোধিত আদেশে চাকরির কোটায় শিক্ষার্থীদের কিছুটা সুবিধা দেওয়া হলেও তা কার্যকর করতে শেখ হাসিনার সরকারের গড়িমসিতে এবং দমননীতির আশ্রয় নিয়ে নৃশংসভাবে অসংখ্য ছাত্র হত্যায় শিক্ষার্থীরা কোটা বৈষম্যের আন্দোলনে ফেটে পড়ে এবং শেষ অবধি স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতন, পদত্যাগ ও দেশত্যাগ। তারপর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয় নির্বাচন কমিশনসহ সর্বক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকারের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর সাপেক্ষে।
গরিব জনসাধারণের স্বার্থ উপেক্ষা করে সমাজে ধনীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ স্বার্থরক্ষা করে দুঃশাসন আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণে বড় অন্তরায় বিবেচিত। তাই অর্থনৈতিক অবৈধ উপায়, ঘুষ, লুটতরাজ, দুর্নীতিসহ রাজনৈতিক অপশক্তিকে কাজে লাগিয়ে যারা রাতারাতি ধনী ও বড়লোক হয়, তাদের লাগাম টেনে ধরার সময় এসেছে। তাদের কারণেই দেশের অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটে, দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়। এভাবে দেশ চলাতে অপশাসন শুরু হয়, ক্ষমতা ও অর্থের অপব্যবহার হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী শাসনব্যবস্থা স্বৈরাচারী স্বেচ্ছাচারিতায় রূপ নিয়ে দেশের গণতন্ত্রের ভিত ভেঙে পড়ে। এ অবস্থায় শ্রেণিবৈষম্য দূর করার মানসে গরিবের মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে আনতে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার দিকে গুরুত্ব আরোপ করে দেশকে দুর্নীতিমুক্ত এবং দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত করতে দেশপ্রেমিক সৎ, গুণী ও ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তিদের এবং সুশীল সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের আপামর জনসাধারণ চায় ধনী-গরিব বৈষম্যহীন, দুর্নীতিমুক্ত একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে উঠুক। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনা অনুসরণে দেশ পরিচালিত হোক। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এবং নির্বাচনের পর আকাক্সিক্ষত পরিশুদ্ধ রাজনৈতিক দলের সরকারের নিকট জনগণের এই প্রত্যাশা। লাঞ্ছিত, বঞ্চিত ও অধিকারহারা মানুষ এখন একটি স্বাধীন, নিরাপদ ও মর্যাদাকর জীবনের প্রত্যাশায় উন্মুখ। এ অবস্থায় যে গণতান্ত্রিক সরকার এখন ক্ষমতায় আসে, তাদেরকে জনপ্রত্যাশা পূরণের জন্য একটি নিরাপদ ও মানবিক বাংলাদেশ গড়ার উদ্যোগ নিতে হবে।
বিশেষভাবে লক্ষণীয়, পতিত স্বৈরশাসক পেছন থেকে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। পদত্যাগী, দেশত্যাগী ও তাদের নতজানু সরকারকে, শেখ হাসিনাকে ভারত রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে বৈরী আচরণ শুরু করেছে এবং আধিপত্য বিস্তার ও বাংলাদেশের অগ্রগতিতে বাধা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। ভারতীয় গণমাধ্যমসহ চীন ও রাশিয়ার গণমাধ্যমও বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে।
এ অবস্থায় দেশে জাতীয় ঐক্য বিশেষ জরুরি। দলবল-নির্বিশেষে মতভেদ ভুলে গিয়ে সকলকে একতাবদ্ধ হয়ে ভারতের বা অন্য কোনো মহলের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত প্রতিহত করতে হবে এবং দেশকে এগিয়ে নিতে হবে।
লেখক : ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, রাষ্ট্রীয় সম্মাননা একুশে পদকপ্রাপ্ত ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদকপ্রাপ্ত। রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ও কলামিস্ট
এ অবস্থায় বাঙালিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার আন্দোলন ও স্বাধিকার আন্দোলন ছাড়া গত্যন্তর ছিল না এবং শেখ মুজিবুর রহমানের ’৭১-এর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের মহামন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে ও ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে গ্রেফতারের পূর্বে আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা, যা প্রথমে ইপিআর ওয়্যারলেসে প্রচার ও পরে রাজনীতিক আব্দুল হান্নান কর্তৃক মাইকে প্রচার, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সম্প্রচার এবং ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে এই ঘোষণা পুনঃপ্রচার তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান কর্তৃক পঠনক্রমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালি। তারপর দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও স্বাধীনতাযুদ্ধ তথা মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর শোচনীয় পরাজয় স্বীকার ও আত্মসমর্পণের মাধ্যমে ৩০ লাখ শহীদ এবং ২ লাখের অধিক মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন তথা কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা লাভ। এভাবেই মাতৃভাষার আন্দোলনের সূত্র ধরে স্বাধীনতার চেতনার মধ্যে ভাষা আন্দোলনের চেতনা একাকার হয়ে বাঙালির বিজয় অর্জন ও স্বাধীন মাতৃভূমির প্রতিষ্ঠা তথা এ দেশের নির্যাতিত মানুষের গণ-আন্দোলনের চেতনায় ও মরণজয়ী সংগ্রামের ফলে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ও অভ্যুদয়।
ভাষা আন্দোলনের চেতনা ছিল মাতৃভাষা বাংলার সুরক্ষা ও সর্বস্তরে মায়ের ভাষার প্রচলন ও বাস্তবায়ন এবং সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষার মধ্য দিয়ে জাতীয় আত্মপরিচয় ও স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনা ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদাবোধ ও সামাজিক ন্যায়বিচার রক্ষা করে শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার। স্বাধীনতার চেতনার মধ্যে ভাষা আন্দোলনের চেতনা মিলেমিশে একাকার। এই চেতনার সারকথা জাতীয় স্বাতন্ত্র্য রক্ষা, স্বাধীন জাতিসত্তার প্রতিষ্ঠা এবং সেই রাষ্ট্রে গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক সমতা, বৈষম্যহীনতা, মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণ। প্রকৃত গণতন্ত্রের প্রধান শর্তগুলো হচ্ছে মৌলিক অধিকারসমূহের স্বীকৃতি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং নাগরিকদের পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সহনশীলতা।
১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের তৃতীয় অনুচ্ছেদেও স্বাধীনতার চেতনা অবলম্বনে অঙ্গীকার করা হয় আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা, যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিতকরণ অর্থাৎ বাংলাদেশের যেখানে অর্থনৈতিক উন্নতি যতটুকু হবে সেটার ক্ষেত্রে সাম্য, বৈষম্যহীনতা, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হবে। বাস্তবে এমন অনুসরণ করা হয়নি। স্বাধীনতার ৫৩ বছরে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পূর্ব পর্যন্ত যত রাজনৈতিক দল বা সরকারই ক্ষমতায় এসেছিল, সব সরকারই এককেন্দ্রিক এবং জবাবদিহির বাইরে। কেউই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে মুক্তিযুদ্ধে লাখ লাখ প্রাণ উৎসর্গ, আত্মবিসর্জন, আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার চেতনা অনুসরণে দেশ শাসন করেননি। দেশের সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে ছিল প্রতিহিংসার রাজনীতি, নীতিহীন রাজনীতি। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ৫৩ বছরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, বিএনপি পালাক্রমে দেশ শাসন করেছে। ২০০৮, ২০১৩, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনে পরপর প্রশ্নবিদ্ধ জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার টানা ১৫ বছরেরও অধিককাল ক্ষমতায় থাকে। শেখ হাসিনার শাসনামলে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করে স্বৈরতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং দুর্নীতি দমনের নামে মুখে শুদ্ধি অভিযানের কথা বলে বাস্তবে স্বজনপ্রীতি ও নিজে দুর্নীতি করে এবং প্রভাবশালীরাও এতে দুর্নীতির সুযোগ পায়।
শেখ হাসিনার আমলে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়ে নিজের এবং প্রভাবশালীদের জন্য দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি করে যেসব প্রকল্প নিয়েছিলেন, এর মধ্যে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্প অন্যতম। এসব প্রকল্পের জন্য ভারত, চীন, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও দেশের কাছ থেকে কঠিন শর্তের ঋণ নিয়েছিল শেখ হাসিনা সরকার। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে যখন শেখ হাসিনা ক্ষমতা নেন, তখন দেশি-বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ৭৭ হাজার কোটি টাকার মতো। এরপর সাড়ে ১৫ বছর টানা তার ক্ষমতায় থেকে ঋণ ফুলে-ফেঁপে গিয়ে ঠেকে ৬ গুণে। ক্ষমতা ছেড়ে যাওয়ার সময় তিনি ঋণের বোঝা রেখে গেছেন ১৮ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার মতো। সুদসহ এ ঋণের কিস্তি শোধ করতে হবে বর্তমানে যারা ক্ষমতায় থাকেন তাদেরকে আগামী বছর থেকেই।
শেখ হাসিনার সময়ে তথাকথিত উন্নয়ন হচ্ছিল স্বীকার করেই বলতে হয়Ñএকদিকে উন্নয়ন, অন্যদিকে অবনমন, একদিকে উন্নতি-অগ্রগতি, অন্যদিকে দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন, স্বজনপ্রীতি, নৈতিক অবনতি ছিল। এককথায় সাফল্যের পাশাপাশি ব্যর্থতাও ছিল সমধিক। দেশের উন্নয়ন হচ্ছিল দুর্নীতি করে, অতি ব্যয়ের মাধ্যমে। একটি প্রকল্প অনুমোদনের সঙ্গে সঙ্গে একশ্রেণির দুর্নীতিপরায়ণ লোক উল্লসিত হয়। উল্লসিত হয় এ কারণে যে, অবৈধ উপায়ে দুর্নীতি করে অর্থ উপার্জনের সুযোগ সৃষ্টি হলো। জিডিপি বৃদ্ধি উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে কী লাভ, যদি একশ্রেণির প্রভাবশালী ও দুর্নীতিবাজের হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়, সকল শ্রেণির মানুষের অবস্থার গুণগত পরিবর্তন না হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে উন্নয়ন ও উন্নতি এক কথা নয়। কারণ বাংলাদেশে উন্নয়নের সঙ্গে দুর্নীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে উন্নয়ন হয়ে যায় অবনমন আর উন্নতি হয়ে যায় অবনতি। দুর্নীতি, অবনমন, অবনতি ও স্বজনপ্রীতির সমান্তরাল অবস্থানের কারণে শেখ হাসিনার শাসনামলে আপামর জনসাধারণ বৈষম্যহীনভাবে উন্নয়ন, উন্নতি ও সাফল্যের ফল ভোগ করতে পারেনি। সুফল ভোগ করেছে শেখ হাসিনার ছত্রচ্ছায়ায় প্রভাবশালী ও প্রতিপত্তিশালীরা। উন্নয়ন যদি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে স্বস্তি, সুখ ও শান্তি দিতে না পারে, তাকে মানুষ উন্নয়ন বলতে পারে না, তা দুর্নীতির উৎস।
উপরিউক্ত আলোচনায় এটা বুঝতে অসুবিধা হবে না যে একদিকে উন্নতি, অন্যদিকে অবনতি স্বাধীনতার চেতনা-বিরুদ্ধ। স্বাধীনতা মানে শুধু পরাধীনতা থেকে দেশকে মুক্ত করা নয়। স্বাধীনতা মানে যথেচ্ছাচারের ছাড়পত্র নয় যে আমরা যেমন খুশি তেমন ব্যবহার করব, যেমন খুশি তেমনভাবে চলবÑঅন্যের স্বার্থ পদদলিত করে। স্বাধীন দেশের রাজনীতি মানে যা ইচ্ছা তা করা নয়। স্বাধীনতা হলো সব নাগরিকের সমান অধিকার, সৌহার্দ্যপূর্ণ ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করা। স্বাধীনতা মানে দেশের সার্বিক উন্নতি, অগ্রগতি সমুন্নত রেখে জনগণকে বৈষম্যহীনভাবে অর্থনৈতিক মুক্তি দেওয়া। অতীতে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার আমলে দেশ অর্থনৈতিকভাবে বৈষম্যমুক্ত, সমৃদ্ধ হতে দুর্নীতি ছিল বড় বাধা। দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়াও স্বাধীনতা অর্জনের মতো গুরুত্বপূর্ণ। শেখ হাসিনার আমলে সরকারিভাবে বলা হতো উন্নয়নের স্রোতে দেশে জনজীবনে অনেক উন্নতি হয়েছে। কথাটা সঠিক ছিল প্রভাবশালী-প্রতিপত্তিশালী ধনিক শ্রেণিদের ক্ষেত্রে, যারা দুর্নীতি করে অবৈধভাবে সম্পদের পাহাড় গড়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে বিলাসী জীবনযাপন করেছে সাধারণ মানুষকে চরম দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় নিপতিত করে। সাধারণ মানুষ, গরিব শ্রেণির মানুষের ক্ষেত্রে ওই কথাটা প্রযোজ্য ছিল না। তা যদি হতো, অভাব ও অসচ্ছল অবস্থা নিয়ে দেশের বড় এক জনগোষ্ঠীকে বস্তিতে-ফুটপাতে দিনাতিপাত করতে হতো না।
তারপর বেকারত্বের প্রশ্ন। শেখ হাসিনার আমলে দেশে উন্নয়ন হচ্ছিল, প্রজেক্ট হচ্ছিল, কল-কারখানা বাড়ে। সুতরাং কর্মসংস্থান বাড়ার কথা। কিন্তু তা হয়নি। বেকারত্ব বেড়েই চলে। বেকারত্ব নিরসন হয়নি। শিক্ষার হার বাড়লেও কর্মসংস্থানের অভাবে বেশির ভাগ শিক্ষিত তরুণ বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে দিন কাটায়। উন্নয়নে লাভবান হয় ধনিক শ্রেণি, প্রভাবশালী, দুর্নীতিবাজরা। সাধারণ মানুষ বৈষম্যের শিকার হয়। বাংলাদেশে ধন-সম্পদগত বৈষম্য ক্রমশ বেড়ে চলে। ধনী-গরিবের মধ্যে পার্থক্য কঠিন পর্যায়ে চলে যায়। বাংলাদেশে ধনী আরও ধনী হয়, গরিব তুলনামূলকভাবে প্রত্যাশিত সচ্ছল হতে পারেনি।
শেখ হাসিনার দুঃশাসনের সময়ে ধনিক শ্রেণির মানুষ নিজের বিলাসী জীবন নিয়ে ব্যস্ত থাকে। দুর্নীতিবাজ প্রতিপত্তিশালীরা অসমর্থ, সুবিধাবঞ্চিত, শ্রমিক শ্রেণির কারও জন্য চিন্তা করার মানসিকতা পোষণ করেনি। অথচ এই শ্রমিক শ্রেণির হাড়ভাঙা খাটুনিতে গড়ে ওঠে ধনিক শ্রেণির অট্টালিকা, যেখানে তারা এসি ছেড়ে খেতে পারে, আরামে ঘুমাতে পারে। অনেক কথাই বলতে হয়Ñসব কথা বলতে গেলে কলেবর বৃদ্ধি পাবে। তবে আরেকটা বিষয় রেখাপাত না করলেই নয়। সেটা হলো শেখ হাসিনা সরকারের প্রশাসনিকভাবে, মন্ত্রী-এমপিদের পর্যায়ে অতিব্যয় ও অপব্যয়। মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও উপদেষ্টাদের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। তদুপরি তাদের বেতন-ভাতার আধিক্য। সরকারি খরচে তথা জনগণের অর্থে মন্ত্রী-এমপিদের বিলাসী জীবনযাপন। যদিও তাদের মুখে জনগণের কল্যাণের জন্য অনেক বড় বড় কথা শোনা গেছে। ধনীদের আরও ধনী হওয়ার নেশা এই সমাজে ধনী-গরিবের বৈষম্যকে প্রকট করতে দায়ী। গরিবের পিঠে পা রেখে ধনী শ্রেণি গাড়ি-বাড়ি, ব্যাংক ব্যালেন্স করে অর্থনীতিকে যেমন নিয়ন্ত্রণ করেছে, তেমনি সমাজনীতি রাজনীতিতে তাদের অর্থের কুপ্রভাব দুঃশাসনের সুযোগ করে দিয়েছে।
শেখ হাসিনা, তার গোষ্ঠী এবং তার দল আওয়ামী লীগ মনে করত, দেশের মালিকানা তাদেরই। তার পিতার ও স্বাধীনতার পূর্বের সংগ্রামী শেখ মুজিবের এবং স্বাধীনতার পরে শাসক শেখ মুজিবের মধ্যে তফাত ছিল। দেশের মানুষ মনে করে, তিনি বাকশাল গঠন করেছিলেন একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। তবু স্বাধীনতাসংগ্রামে জনগণের সহযোগিতায় তার অবিসংবাদিত ভূমিকার জন্য তিনি যে স্বাধীনতার স্থপতি, তা অনস্বীকার্য। বাকশাল গঠনের উদ্দেশ্য রহস্যাবৃত। শেখ মুজিব নিহত না হয়ে যদি জীবিত থাকতেন, বাকশাল বাস্তবায়িত হলে উদ্দেশ্য পরিষ্কার হতো।
আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শক্তির মূল উৎপাটন করার জন্য এগিয়ে এলেন বৈষম্যের শিকার নতুন প্রজন্মের ছাত্ররা। শেখ হাসিনার শাসনামলে তার প্রধানমন্ত্রিত্বে এক ব্যক্তি তার আত্মীয়স্বজন, জ্ঞাতিগোষ্ঠী, মোসাহেব ও লাঠিয়ালদের নিয়েই দেশের শাসনকাজ পরিচালিত হয়েছে। এর বিরুদ্ধে মানুষ ক্ষুব্ধ ছিল, কিন্তু তা প্রকাশের সাহস পাচ্ছিল না। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে চাকরিতে কোটা বৈষম্যের আন্দোলনে সোচ্চার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সাধারণ জনগণ ক্ষোভ প্রকাশের সুযোগ পায় এবং আন্দোলন জোরদার করে। পূর্বেকার সরকারি সিদ্ধান্তে চাকরিতে ৩০ শতাংশে মুক্তিযোদ্ধা ও উত্তরসূরিদের জন্য কোটা সংরক্ষিত থাকায় চাকরিপ্রার্থী যুবসমাজ বৈষম্যের শিকার হয় এবং শিক্ষা শেষে অনেক মেধাবীও চাকরিবঞ্চিত হয়। আপিল বিভাগের সংশোধিত আদেশে চাকরির কোটায় শিক্ষার্থীদের কিছুটা সুবিধা দেওয়া হলেও তা কার্যকর করতে শেখ হাসিনার সরকারের গড়িমসিতে এবং দমননীতির আশ্রয় নিয়ে নৃশংসভাবে অসংখ্য ছাত্র হত্যায় শিক্ষার্থীরা কোটা বৈষম্যের আন্দোলনে ফেটে পড়ে এবং শেষ অবধি স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতন, পদত্যাগ ও দেশত্যাগ। তারপর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয় নির্বাচন কমিশনসহ সর্বক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকারের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর সাপেক্ষে।
গরিব জনসাধারণের স্বার্থ উপেক্ষা করে সমাজে ধনীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ স্বার্থরক্ষা করে দুঃশাসন আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণে বড় অন্তরায় বিবেচিত। তাই অর্থনৈতিক অবৈধ উপায়, ঘুষ, লুটতরাজ, দুর্নীতিসহ রাজনৈতিক অপশক্তিকে কাজে লাগিয়ে যারা রাতারাতি ধনী ও বড়লোক হয়, তাদের লাগাম টেনে ধরার সময় এসেছে। তাদের কারণেই দেশের অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটে, দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়। এভাবে দেশ চলাতে অপশাসন শুরু হয়, ক্ষমতা ও অর্থের অপব্যবহার হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী শাসনব্যবস্থা স্বৈরাচারী স্বেচ্ছাচারিতায় রূপ নিয়ে দেশের গণতন্ত্রের ভিত ভেঙে পড়ে। এ অবস্থায় শ্রেণিবৈষম্য দূর করার মানসে গরিবের মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে আনতে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার দিকে গুরুত্ব আরোপ করে দেশকে দুর্নীতিমুক্ত এবং দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত করতে দেশপ্রেমিক সৎ, গুণী ও ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তিদের এবং সুশীল সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের আপামর জনসাধারণ চায় ধনী-গরিব বৈষম্যহীন, দুর্নীতিমুক্ত একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে উঠুক। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনা অনুসরণে দেশ পরিচালিত হোক। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এবং নির্বাচনের পর আকাক্সিক্ষত পরিশুদ্ধ রাজনৈতিক দলের সরকারের নিকট জনগণের এই প্রত্যাশা। লাঞ্ছিত, বঞ্চিত ও অধিকারহারা মানুষ এখন একটি স্বাধীন, নিরাপদ ও মর্যাদাকর জীবনের প্রত্যাশায় উন্মুখ। এ অবস্থায় যে গণতান্ত্রিক সরকার এখন ক্ষমতায় আসে, তাদেরকে জনপ্রত্যাশা পূরণের জন্য একটি নিরাপদ ও মানবিক বাংলাদেশ গড়ার উদ্যোগ নিতে হবে।
বিশেষভাবে লক্ষণীয়, পতিত স্বৈরশাসক পেছন থেকে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। পদত্যাগী, দেশত্যাগী ও তাদের নতজানু সরকারকে, শেখ হাসিনাকে ভারত রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে বৈরী আচরণ শুরু করেছে এবং আধিপত্য বিস্তার ও বাংলাদেশের অগ্রগতিতে বাধা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। ভারতীয় গণমাধ্যমসহ চীন ও রাশিয়ার গণমাধ্যমও বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে।
এ অবস্থায় দেশে জাতীয় ঐক্য বিশেষ জরুরি। দলবল-নির্বিশেষে মতভেদ ভুলে গিয়ে সকলকে একতাবদ্ধ হয়ে ভারতের বা অন্য কোনো মহলের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত প্রতিহত করতে হবে এবং দেশকে এগিয়ে নিতে হবে।
লেখক : ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, রাষ্ট্রীয় সম্মাননা একুশে পদকপ্রাপ্ত ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদকপ্রাপ্ত। রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ও কলামিস্ট