আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত সময়কাল হচ্ছে মোট নয় মাস। মার্চ থেকে ডিসেম্বর। এই নয় মাসে তৎকালীন পাকিস্তানের ইয়াহিয়া সরকার সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের বিদ্রোহী মানুষকে শায়েস্তা করতে এবং স্বাধীনতাকামী বাঙালির বিদ্রোহ দমন করতে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে হাজার হাজার সৈন্য নিয়ে আসত। তারপর তাদেরকে ছড়িয়ে দিত পূর্ব বাংলার (বর্তমানের বাংলাদেশ) প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এভাবে সারা দেশে সৈন্য ছড়িয়ে দেওয়ার কারণে তখন তাদের আরও অধিক সৈন্যের দরকার হয়ে পড়ে। এমনিতেই মুক্তিবাহিনীর হাতে তাদের সৈন্যরা প্রতিদিন যে হারে মারা যাচ্ছিল, তার কারণেও তখন বাড়তি সৈন্যের দরকার ছিল। কিন্তু রাতারাতি তো আর সৈন্য বানানো যায় না। তাই সেই প্রয়োজন মেটানোর অজুহাতে সে দেশের তরুণ সম্প্রদায়কে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করিয়ে তাদেরকে পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ে এসে চালান করে দেওয়া হতো দেশের আনাচে-কানাচে। তাদেরকে তখন বলে দেওয়া হতো পূর্ব পাকিস্তানের সব মানুষই কাফের। অতএব, এদেরকে খতম করতে হবে। আর আছে ‘মুক্তি’ নামের কিছু বিচ্ছু, যেভাবেই হোক খুন করতে হবে সেই বিচ্ছুদেরও। তো সেই সৈন্যরা পূর্ব বাংলায় এসে নতুন এক ভৌগোলিক পরিবেশে নিজেদের ঠিকভাবে খাপ খাওয়াতে পারত না। তারপর বলা নেই কওয়া নেই, মুক্তি নামের সেই বিচ্ছুগুলো কখন যে কোন দিক দিয়ে আক্রমণ করে বসে, এই ভয়ে সারাক্ষণ তাদেরকে তটস্থ থাকতে হয়। তার পরও সেই নয় মাসে ওই পাকিস্তানি হানাদাররা বাঙালিদের ওপর যে নারকীয় তাণ্ডব চালিয়েছিল, তার নজির বোধ হয় হিটলারকেও হার মানিয়ে দেওয়ার মতো ছিল। সেই সময়ে তারা কিছু কিছু কিচ্ছা-কাহিনিরও জন্ম দিয়েছিল, যা নিয়ে সেই সময়ে কেউ কিছু বলেনি বা হাসাহাসিও করেনি। কিন্তু একাত্তর-পরবর্তী সময়ে এ নিয়ে মানুষ খুব হাসাহাসি করেছিল। তারই কিছু নমুনা নিচের লেখাগুলো।
১. শহরের একটি বাসায় কিছু পাকিস্তানি সৈন্য ঢুকেছে। ঢুকেই আঁতিপাঁতি করে কাফের খুঁজছে। কিন্তু এ কী দেখছে তারাÑদেয়ালজুড়ে যে বিশাল একখানা ছবি ঝুলছে, সেই ছবিতে শরিফ চেহারার একজন মানুষ। একমুখ লম্বা দাড়ি একেবারে বুকের ওপর নেমে এসেছে। আর কী বিশাল আলখেল্লা দিয়ে তার লম্বা শরীরটা আগাগোড়া মোড়া। তাকালেই শ্রদ্ধায় যেন মাথাটা আপনা-আপনিই নিচু হয়ে আসে। সৈন্যটি একদৃষ্টিতে ছবির মানুষটির দিকে তাকিয়ে থাকে। এখানে কাফের কোথায়? তার তাকিয়ে থাকার ধরন দেখে গৃহস্বামীর বুক ভয়ে তড়পাতে শুরু করেছে। এই বুঝি ধরা পড়ে গেলেন। একসময় সৈন্যটির তন্ময়তায় ছেদ পড়ে। জানতে চায়-কৌন হ্যায়? বিমূঢ় গৃহস্বামী। কিন্তু তাও মুহূর্ত মাত্র। চেতনা ফিরে এসেছে তার যথা সময়েইÑসৈন্যটি ছবির মানুষকে চিনতে পারেনি, এতএব ভয়ের কিছু নেই। জবাব দিলেন ‘সেরা দাদা’। সঙ্গে সঙ্গে সৈন্যটি মাথা নাড়ল, ‘শরিফ আদমি’। একসময় ছবির দিকে তাকিয়ে স্যালুটও একটা দিয়ে বসল জোড়া পা এক করে আর ডান হাতটা কপালে ঠেকিয়ে। তার অঙ্গভঙ্গি দেখে গৃহস্বামী বুকভরে শ্বাস নিলেনÑফাঁড়া কেটে গেছে তার। আর ছবির ফ্রেমে বন্দী অবস্থায় থেকেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কী বিশাল মমতা নিয়ে গৃহস্বামীর দিকে তাকিয়ে যেন হেসে বললেন, ‘কেমন বাঁচিয়ে দিলেম, দেখলে তো!
২. পাকিস্তান আর্মির কিছু কিছু সৈন্য এমন অশিক্ষিত ছিল যে তারা লেখাপড়া প্রায় জানতই না। এটা অবশ্য যুদ্ধকালীন যারা নতুন করে সেনাবাহিনীতে নাম লিখিয়েছিল, তাদের অধিকাংশই এমন ধরনের গোঁয়ার ছিল। আসলে তখন অধিক সৈন্যের প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে তারা গ্রাম্য যুবকদের ধরে ধরে সেনাবাহিনীতে ঢোকায়। তো যুদ্ধের সেই নয় মাসের শেষ দিকে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র-জনতা এবং সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী সবার প্রতি নির্দেশ দিল, তারা সবাই যেন পথ চলাচলের সময় নিজেদের পরিচয়পত্র (আইডেন্টিটি কার্ড) সঙ্গে রাখে। মুশকিল হলো সেই ভরা যুদ্ধের সময় এত পরিচয়পত্র জোগাড় করা কীভাবে সম্ভব। তারপর মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা এ ধরনের পরিচয়পত্র জোগাড় করবেই-বা কী করে। তাও আবার সাধারণ মানুষের মতোই জনারণ্যে চলাফেরা করে। তো একদিন এক পথচারী বেরিয়েছিলেন নিজের প্রয়োজনে। পকেটে তার রেশন কার্ড। ইচ্ছা ছিল ফাঁক বুঝে সংসারের জন্য কিছু নুন, চিনি কিনবেন। শেষ পর্যন্ত সেই মানুষটিকে আটকাল রাস্তায় টহলরত উর্দুভাষী সৈন্যটি। দেখতে চাইল পরিচয়পত্র। দুষ্ট বুদ্ধি খেলে গেল মানুষটির মাথায়। পকেট থেকে রেশন কার্ড বের করে তুলে দিলেন সৈন্যটির হাতে। সৈন্যটি কার্ডটি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখল কিছু সময়। তারপর বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়লÑডান্ডি কার্ড? ইয়ে ডি ঠিক হ্যায়Ñঅভি চল যাও। তারা আবার আইডেন্টিটি কার্ড বলতে পারত না। বলত ‘ডান্ডি কার্ড’। এরপর আর বাঙালিকে পায় কে? রাতারাতি ভূরি ভূরি ডান্ডি কার্ড তৈরি হয়ে গেল ৫৬ হাজার বর্গমাইলজুড়ে।
৩. একটি সৈন্য টহলরত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে একটি রাস্তার মাথায়। তার সামনে দিয়ে বাইসাইকেল এবং মোটরসাইকেলে করে লোক আসা-যাওয়া করছে। সৈন্যটি বাইসাইকেলকে ঠিকই চিনতে পারছে। তাদের দেশে আবার ওই বাইসাইকেলকে বলে ‘শয়তানের ঘোড়া’। আমাদের সৈয়দ মুজতবা আলী তার ‘দেশে-বিদেশে’ নামক ভ্রমণকাহিনিতে লিখেছিলেন, ‘সেই দেশের লোকেরা সাইকেল চড়াকে বড়ই ঘৃণা করে। শয়তানের মতো হুটহাট করে চলে আর এভাবে সময় পার করে দেওয়া একটা কথা হলো নাকি। তাই তারা করে কী, কিছু পথ সাইকেলে চেপে আবার নেমে পড়ে। তারপর সাইকেলের চাকায় পেরেক ঢুকিয়ে ছিদ্র করে পথের ধারে বসা মুচিকে দিয়ে সেই ছিদ্র মেরামত করায়। এই করতে করতে যতটা সময় পাওয়া যায়, ততটা সময় এরা মুচির সঙ্গে মন খুলে সুখ-দুঃখের কথা কয়। তো সেদিনের মরুর দেশের সেই সৈন্যটি বাইসাইকেলকে ঠিক ঠিক চিনতে পারলেও মোটরসাইকেলকে ঠিক চিনতে পারছিল না। তার ভাষায়, ‘এ তো আরও বড় শয়তানের ঘোড়া, এত জোরে চলে যে শয়তানেরও সাধ্য নাই সে তাকে ধরে।’ তো শয়তানের সাধ্যে না কুলাক, শয়তানের বাপ বুঝবে তার বিষয়। সে ভাবছিল আরও একটা বিষয়Ñসাইকেল তো চালায় একজন মানুষ কিন্তু এই মোটরসাইকেল যে চালায় দুই থেকে তিনজন মিলে। এই বিষয়টা তার মাথায় কুলাচ্ছিল না। তো সে একদিন এক মোটরসাইকেল আরোহীকে থামাল হাত তুলে। মোটরসাইকেল আরোহী মানুষ দুজনের কাছে জানতে চাইল সৈন্যটি, ‘এটা কি ঠিক হলো? এই যে দুজন মিলে চালাচ্ছ সাইকেলটা।’ প্রশ্নটা শুনে থতমত খেল আরোহীরাÑএবার নির্ঘাত প্রাণ যাবে। তারপর ইতস্তত করে উত্তর দিল, এটা তো মোটর দিয়ে চলে, তাই এই সাইকেলে দুজন চলতে পারে।’ উত্তরটা ঠিক মাথায় ঢুকল না তার। এবার হাতে ধরা লাঠি উঁচিয়ে ধরল আরোহীদের দিকে। তাই দেখে শেষ পর্যন্ত মোটরসাইকেলের চালক ভাঙা বাংলা আর ভাঙা উর্দু মিশিয়ে জবাব দিল, ‘ইয়ে সাইকেল ভি তেল যে চলতে হ্যায় তো, দু’আদমি চড়তে হ্যায় ইয়ে ভি।’ উর্দুটা ঠিকমতো বলতে পারছিল কি তারা? কেমন একটা ভয় পেয়ে গিয়েছিল আরোহীরাÑযদি উত্তরটা ঠিকমতো দিতে না পারে, তবে সৈন্যটি গুলি চালিয়ে বসতে পারে, এই ভয়ে জড়সড়ো হয়ে পড়েছিল মানুষগুলো। কিন্তু দেখা গেল, বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ছিল সৈন্যটি, ‘ঠিক হ্যায় আভি চল যাও।’ ঠিক সেই সময়ে তাদের সামনে দিয়ে চলে গেল আরেকটি মোটরসাইকেল। এবার সৈন্যটি হাত তুলে থামাল সাইকেলকে। এই মোটরসাইকেলে আরোহী মাত্র একজন। সেই আরোহীর কাছে সৈন্যটি জানতে চাইল, সাইকেলে সে একা কেন? প্রশ্নটি শুনে চালকের আত্মারাম খাঁচা ছাড়ার জোগাড়! কী জবাব দেবে সে? ততক্ষণে সৈন্যটি করল কি! রাস্তা থেকে একজন মানুষকে ধরে এনে সেই মোটরসাইকেলের চালকের পেছনে বসিয়ে দিয়ে বলল, ‘এই সাইকেল তেলনে চলতে হ্যায়, তো এই সাইকেলে একজন বসে না।’ ৪. কয়েকজন সৈন্য এক ঘড়ির দোকান লুট করল একদিন। পকেটভর্তি তাদের লুটের মাল। দোকান থেকে রাস্তায় বেরিয়েই দেখল এক মুরগিওয়ালা মুরগি নিয়ে যাচ্ছে। তাকে আটকে সৈন্যগুলো জানতে চাইল দাম কত? মুরগিগুলো পুষ্ট ছিল, তাই তাদের পছন্দ হয়েছিল। সৈন্যদের দেখে মুরগিওয়ালার মেজাজটা বিগড়ে গেছে। মনে মনে গালি শুরু করেছে সে, ‘ব্যাটা চশমখোরের জাত। পয়সা তো দেবেই না, চাই কি গুলিও চালিয়ে বসতে পারে।’ সৈন্যদের মধ্য থেকে একজন একটা মুরগি খাঁচা থেকে উঠিয়ে দাম জানতে চাইল, ‘কিয়া কিম্মত হ্যায়?’ লোকটি আর কী জবাব দেবেÑমনে মনে নিজের ভাগ্যকেই গালি দিচ্ছিল। তার পরও বলল, আপনাদের যা ইচ্ছা তা-ই দিন। সৈন্যটির পকেট ভর্তি লুটের ঘড়িতে। পকেটে টাকা নেই একটিও। সে তখন পকেট থেকে দুটো ঘড়ি খুলে তুলে দিল মুরগিওয়ালার হাতে। বলল, ইয়ে লও। কিন্তু মুরগিওয়ালা ঘড়ি দেখে ভয় পেয়ে গেছে। সে জবাব দিল, নেহি সাব, ইয়ে নেহি। সৈন্যটি ভাবল, দুটো ঘড়ি বুঝি দাম হিসেবে কম হয়ে গেল। সে আরও দুটি ঘড়ি তুলে দিল তার হাতে। মুরগিওয়ালা চারটি ঘড়ি হাতে নিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দিল এক দৌড়। তার দৌড় দেখে পাশের সৈন্যটির দিকে তাকিয়ে অপর সৈন্যটি জানতে চাইল, লোকটা দৌড়াল কেন? সৈনিকটি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, ‘জরুর মুক্তি লোগকে বোলানে গিয়া।’ মুক্তিযোদ্ধা! ওরে বাপরে। এবার তাদের প্রাণটা যায় আরকি। ভাগো, ভাগো, জলদি ভাগো হিয়াসে। হাতের মুরগিটা রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে যেদিকে পারল প্রাণ নিয়ে পালাতে মরণপণ দৌড় শুরু করল সৈন্যরা। (সংগৃহীত)
১. শহরের একটি বাসায় কিছু পাকিস্তানি সৈন্য ঢুকেছে। ঢুকেই আঁতিপাঁতি করে কাফের খুঁজছে। কিন্তু এ কী দেখছে তারাÑদেয়ালজুড়ে যে বিশাল একখানা ছবি ঝুলছে, সেই ছবিতে শরিফ চেহারার একজন মানুষ। একমুখ লম্বা দাড়ি একেবারে বুকের ওপর নেমে এসেছে। আর কী বিশাল আলখেল্লা দিয়ে তার লম্বা শরীরটা আগাগোড়া মোড়া। তাকালেই শ্রদ্ধায় যেন মাথাটা আপনা-আপনিই নিচু হয়ে আসে। সৈন্যটি একদৃষ্টিতে ছবির মানুষটির দিকে তাকিয়ে থাকে। এখানে কাফের কোথায়? তার তাকিয়ে থাকার ধরন দেখে গৃহস্বামীর বুক ভয়ে তড়পাতে শুরু করেছে। এই বুঝি ধরা পড়ে গেলেন। একসময় সৈন্যটির তন্ময়তায় ছেদ পড়ে। জানতে চায়-কৌন হ্যায়? বিমূঢ় গৃহস্বামী। কিন্তু তাও মুহূর্ত মাত্র। চেতনা ফিরে এসেছে তার যথা সময়েইÑসৈন্যটি ছবির মানুষকে চিনতে পারেনি, এতএব ভয়ের কিছু নেই। জবাব দিলেন ‘সেরা দাদা’। সঙ্গে সঙ্গে সৈন্যটি মাথা নাড়ল, ‘শরিফ আদমি’। একসময় ছবির দিকে তাকিয়ে স্যালুটও একটা দিয়ে বসল জোড়া পা এক করে আর ডান হাতটা কপালে ঠেকিয়ে। তার অঙ্গভঙ্গি দেখে গৃহস্বামী বুকভরে শ্বাস নিলেনÑফাঁড়া কেটে গেছে তার। আর ছবির ফ্রেমে বন্দী অবস্থায় থেকেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কী বিশাল মমতা নিয়ে গৃহস্বামীর দিকে তাকিয়ে যেন হেসে বললেন, ‘কেমন বাঁচিয়ে দিলেম, দেখলে তো!
২. পাকিস্তান আর্মির কিছু কিছু সৈন্য এমন অশিক্ষিত ছিল যে তারা লেখাপড়া প্রায় জানতই না। এটা অবশ্য যুদ্ধকালীন যারা নতুন করে সেনাবাহিনীতে নাম লিখিয়েছিল, তাদের অধিকাংশই এমন ধরনের গোঁয়ার ছিল। আসলে তখন অধিক সৈন্যের প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে তারা গ্রাম্য যুবকদের ধরে ধরে সেনাবাহিনীতে ঢোকায়। তো যুদ্ধের সেই নয় মাসের শেষ দিকে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র-জনতা এবং সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী সবার প্রতি নির্দেশ দিল, তারা সবাই যেন পথ চলাচলের সময় নিজেদের পরিচয়পত্র (আইডেন্টিটি কার্ড) সঙ্গে রাখে। মুশকিল হলো সেই ভরা যুদ্ধের সময় এত পরিচয়পত্র জোগাড় করা কীভাবে সম্ভব। তারপর মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা এ ধরনের পরিচয়পত্র জোগাড় করবেই-বা কী করে। তাও আবার সাধারণ মানুষের মতোই জনারণ্যে চলাফেরা করে। তো একদিন এক পথচারী বেরিয়েছিলেন নিজের প্রয়োজনে। পকেটে তার রেশন কার্ড। ইচ্ছা ছিল ফাঁক বুঝে সংসারের জন্য কিছু নুন, চিনি কিনবেন। শেষ পর্যন্ত সেই মানুষটিকে আটকাল রাস্তায় টহলরত উর্দুভাষী সৈন্যটি। দেখতে চাইল পরিচয়পত্র। দুষ্ট বুদ্ধি খেলে গেল মানুষটির মাথায়। পকেট থেকে রেশন কার্ড বের করে তুলে দিলেন সৈন্যটির হাতে। সৈন্যটি কার্ডটি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখল কিছু সময়। তারপর বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়লÑডান্ডি কার্ড? ইয়ে ডি ঠিক হ্যায়Ñঅভি চল যাও। তারা আবার আইডেন্টিটি কার্ড বলতে পারত না। বলত ‘ডান্ডি কার্ড’। এরপর আর বাঙালিকে পায় কে? রাতারাতি ভূরি ভূরি ডান্ডি কার্ড তৈরি হয়ে গেল ৫৬ হাজার বর্গমাইলজুড়ে।
৩. একটি সৈন্য টহলরত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে একটি রাস্তার মাথায়। তার সামনে দিয়ে বাইসাইকেল এবং মোটরসাইকেলে করে লোক আসা-যাওয়া করছে। সৈন্যটি বাইসাইকেলকে ঠিকই চিনতে পারছে। তাদের দেশে আবার ওই বাইসাইকেলকে বলে ‘শয়তানের ঘোড়া’। আমাদের সৈয়দ মুজতবা আলী তার ‘দেশে-বিদেশে’ নামক ভ্রমণকাহিনিতে লিখেছিলেন, ‘সেই দেশের লোকেরা সাইকেল চড়াকে বড়ই ঘৃণা করে। শয়তানের মতো হুটহাট করে চলে আর এভাবে সময় পার করে দেওয়া একটা কথা হলো নাকি। তাই তারা করে কী, কিছু পথ সাইকেলে চেপে আবার নেমে পড়ে। তারপর সাইকেলের চাকায় পেরেক ঢুকিয়ে ছিদ্র করে পথের ধারে বসা মুচিকে দিয়ে সেই ছিদ্র মেরামত করায়। এই করতে করতে যতটা সময় পাওয়া যায়, ততটা সময় এরা মুচির সঙ্গে মন খুলে সুখ-দুঃখের কথা কয়। তো সেদিনের মরুর দেশের সেই সৈন্যটি বাইসাইকেলকে ঠিক ঠিক চিনতে পারলেও মোটরসাইকেলকে ঠিক চিনতে পারছিল না। তার ভাষায়, ‘এ তো আরও বড় শয়তানের ঘোড়া, এত জোরে চলে যে শয়তানেরও সাধ্য নাই সে তাকে ধরে।’ তো শয়তানের সাধ্যে না কুলাক, শয়তানের বাপ বুঝবে তার বিষয়। সে ভাবছিল আরও একটা বিষয়Ñসাইকেল তো চালায় একজন মানুষ কিন্তু এই মোটরসাইকেল যে চালায় দুই থেকে তিনজন মিলে। এই বিষয়টা তার মাথায় কুলাচ্ছিল না। তো সে একদিন এক মোটরসাইকেল আরোহীকে থামাল হাত তুলে। মোটরসাইকেল আরোহী মানুষ দুজনের কাছে জানতে চাইল সৈন্যটি, ‘এটা কি ঠিক হলো? এই যে দুজন মিলে চালাচ্ছ সাইকেলটা।’ প্রশ্নটা শুনে থতমত খেল আরোহীরাÑএবার নির্ঘাত প্রাণ যাবে। তারপর ইতস্তত করে উত্তর দিল, এটা তো মোটর দিয়ে চলে, তাই এই সাইকেলে দুজন চলতে পারে।’ উত্তরটা ঠিক মাথায় ঢুকল না তার। এবার হাতে ধরা লাঠি উঁচিয়ে ধরল আরোহীদের দিকে। তাই দেখে শেষ পর্যন্ত মোটরসাইকেলের চালক ভাঙা বাংলা আর ভাঙা উর্দু মিশিয়ে জবাব দিল, ‘ইয়ে সাইকেল ভি তেল যে চলতে হ্যায় তো, দু’আদমি চড়তে হ্যায় ইয়ে ভি।’ উর্দুটা ঠিকমতো বলতে পারছিল কি তারা? কেমন একটা ভয় পেয়ে গিয়েছিল আরোহীরাÑযদি উত্তরটা ঠিকমতো দিতে না পারে, তবে সৈন্যটি গুলি চালিয়ে বসতে পারে, এই ভয়ে জড়সড়ো হয়ে পড়েছিল মানুষগুলো। কিন্তু দেখা গেল, বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ছিল সৈন্যটি, ‘ঠিক হ্যায় আভি চল যাও।’ ঠিক সেই সময়ে তাদের সামনে দিয়ে চলে গেল আরেকটি মোটরসাইকেল। এবার সৈন্যটি হাত তুলে থামাল সাইকেলকে। এই মোটরসাইকেলে আরোহী মাত্র একজন। সেই আরোহীর কাছে সৈন্যটি জানতে চাইল, সাইকেলে সে একা কেন? প্রশ্নটি শুনে চালকের আত্মারাম খাঁচা ছাড়ার জোগাড়! কী জবাব দেবে সে? ততক্ষণে সৈন্যটি করল কি! রাস্তা থেকে একজন মানুষকে ধরে এনে সেই মোটরসাইকেলের চালকের পেছনে বসিয়ে দিয়ে বলল, ‘এই সাইকেল তেলনে চলতে হ্যায়, তো এই সাইকেলে একজন বসে না।’ ৪. কয়েকজন সৈন্য এক ঘড়ির দোকান লুট করল একদিন। পকেটভর্তি তাদের লুটের মাল। দোকান থেকে রাস্তায় বেরিয়েই দেখল এক মুরগিওয়ালা মুরগি নিয়ে যাচ্ছে। তাকে আটকে সৈন্যগুলো জানতে চাইল দাম কত? মুরগিগুলো পুষ্ট ছিল, তাই তাদের পছন্দ হয়েছিল। সৈন্যদের দেখে মুরগিওয়ালার মেজাজটা বিগড়ে গেছে। মনে মনে গালি শুরু করেছে সে, ‘ব্যাটা চশমখোরের জাত। পয়সা তো দেবেই না, চাই কি গুলিও চালিয়ে বসতে পারে।’ সৈন্যদের মধ্য থেকে একজন একটা মুরগি খাঁচা থেকে উঠিয়ে দাম জানতে চাইল, ‘কিয়া কিম্মত হ্যায়?’ লোকটি আর কী জবাব দেবেÑমনে মনে নিজের ভাগ্যকেই গালি দিচ্ছিল। তার পরও বলল, আপনাদের যা ইচ্ছা তা-ই দিন। সৈন্যটির পকেট ভর্তি লুটের ঘড়িতে। পকেটে টাকা নেই একটিও। সে তখন পকেট থেকে দুটো ঘড়ি খুলে তুলে দিল মুরগিওয়ালার হাতে। বলল, ইয়ে লও। কিন্তু মুরগিওয়ালা ঘড়ি দেখে ভয় পেয়ে গেছে। সে জবাব দিল, নেহি সাব, ইয়ে নেহি। সৈন্যটি ভাবল, দুটো ঘড়ি বুঝি দাম হিসেবে কম হয়ে গেল। সে আরও দুটি ঘড়ি তুলে দিল তার হাতে। মুরগিওয়ালা চারটি ঘড়ি হাতে নিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দিল এক দৌড়। তার দৌড় দেখে পাশের সৈন্যটির দিকে তাকিয়ে অপর সৈন্যটি জানতে চাইল, লোকটা দৌড়াল কেন? সৈনিকটি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, ‘জরুর মুক্তি লোগকে বোলানে গিয়া।’ মুক্তিযোদ্ধা! ওরে বাপরে। এবার তাদের প্রাণটা যায় আরকি। ভাগো, ভাগো, জলদি ভাগো হিয়াসে। হাতের মুরগিটা রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে যেদিকে পারল প্রাণ নিয়ে পালাতে মরণপণ দৌড় শুরু করল সৈন্যরা। (সংগৃহীত)