বাসস্ট্যান্ডে মানিকের মুখোমুখি হলাম। বিচিত্র ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে সে। অনেক দিন পর দেখা। অস্বাভাবিক মোটা দুটো গোঁফ নিচের দিকে বাঁক নিয়েছে। মুখে অনাবিল স্বতঃস্ফূর্ত হাসি। আমাদের পুরোনো বন্ধু। মাঝখানে কোথায় ফেরারি হয়েছিল কে জানে! আমাদের সাহিত্যচক্রের নিয়মিত মাসিক সংকলন সম্পাদনার দায়িত্ব ওর ওপর ছিল সে মাসে। এরই মাঝে বিনা নোটিশে হঠাৎ করেই সে উধাও! একেবারেই লাপাত্তা! অনেক খোঁজ করেও আমরা তখন কোনো হদিস মেলাতে পারিনি মানিকের।
আমি কেবল ওর দুর্বোধ্য গোঁফের দিকে তাকিয়ে আমাদের বিগত দিনের মানিকের চরিত্র বিশ্লেষণ করছি। মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি ওর নিজের প্রতি অবহেলার সাক্ষ্য দিচ্ছে। ক্লিন শেভ করা কচি ডাবের মতো মানিকের সে সবুজ মুখ কোথায় হারিয়ে গেল? জাঁদরেল এক শকুন যেন তথাকথিত পক্ষ বিস্তারপূর্বক আমাদের মানিকের সুকোমল সেই চরিত্রকে গ্রাস করে নিয়েছে!
আমি বললাম, ‘আরিচা মহাসড়কে গায়েব হয়ে গিয়েছে আমাদের কবিবন্ধু মানিক। এখন দেখছি; তুই সাধারণ গোঁফঅলা একটা পুরুষ মাত্র। নিজের চরিত্র পাল্টে চেহারায় ভিন্ন লেবাস জড়িয়েছিস। এ গোঁফ তুই কোথায় পেলি?’
হো হো শব্দে হেসে ওঠে মানিক, ‘কিরে বড় যে সংসারী শব্দ ছাড়ছিস!’
-সংসারী আর হলাম কখন? হতেই-বা পারলাম কোথায়?
আমি ঘাড় দুলিয়ে বলি, ‘সামান্য টিউশনির পয়সায় এখানে তোর মতো সংও সাজা যায় না রে মানিক।’
আবার তার হাসি। হাসি থামিয়ে আমার হাত টেনে ওর বুকের কাছে ধরে বলে, ‘আমার কবিতার বই বেরোচ্ছে। খবর তো রাখিস না।’
আমি বললাম, ‘রাখব কী করে? তা ছাড়া এ সময় আমার জন্য ওসব একেবারেই বাজে কথা। এখন কিছু খিলাইবি কি না তাই বল।’
মানিক যেন ধসে পড়ল মাটিতে। ওর বিস্ময়ভরা কণ্ঠ, ‘সত্যি? তাহলে কিছু খাবি তুই? চেয়ে খাসনি তো কোনো দিন, তাই বিশ্বাস করতে পারছি না। তা, পেটসর্বস্ব হয়ে গেলি নাকি আজকাল? এই বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আমার মতো কেউকেটার কাছে হাঁক মেরে দিন কাভার করে দিস বুঝি? বাঃ দোস! চমৎকার!’
-খাওয়াইবি কি না তাই বল না রে বাবা! এত ঘন কথা ভালো লাগে না!
-বেশ তো। তা চল না খাইয়ে দিই এক পেট!
ইদানীংকার ঢাকার সুপ্রসিদ্ধ সুইটসের প্লেট আমার সামনে। এত দিন যা দেখে কেবল ‘অর্ধ ভোজনং’ কর্মটা লোভাতুর চোখেই সেরেছি। আজ সেই মহার্ঘ্য আমার রসনাতৃপ্তির জন্য প্রস্তুত। ব্যাপারটা সত্যি ঘোলাটে মনে হচ্ছে না? কায়দামতো চাকরি একখানা বাগিয়েছে নিশ্চয়! নয় শালা, হাসানের মতো চোরাকারবার শুরু করে দিয়েছে কি না ওই জানে। কিন্তু মুহূর্তে আবার নিজেকে অপরাধী মনে হলো। আমার মুক্তিযোদ্ধা বন্ধু মানিক তো স্মাগলিং করবে না মরে গেলেও। ও শুধু আমার মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুই নয়Ñএকজন স্বনামধন্য গল্পকার বন্ধুও বটে।
-কিরে? তোদের দিনকাল কেমন চলছে? মানিকের প্রশ্ন আমাকে বাস্তবে টেনে আনল।
-ধুর, সুবিধার নয়। ও শালি কোন সময় ‘না’ বলে বসে সেই চিন্তায় আছি!
-কেন কেন?
-জানি না। মতিগতি কেমন যেন ঘোলাটে মনে হচ্ছে। ওর বাবা নাকি মিডল ইস্টের পাত্র জোগাড় করেছে। বুঝিস না, আমার তো পকেটে পয়সা নাই। তাই প্রেম-ভালোবাসাও ওর কাছে পানসে ও অর্থহীন হয়ে পড়েছে।
-শালা! তোর প্রেমের ‘খেতা’ পুড়ি। খা, মিষ্টি খা। দই আরেক প্লেট নে।
মানিক দই-মিষ্টি খাচ্ছে। আমি তাকিয়ে ওকে দেখি। গোঁফটা ওর কেমন ছন্দোবদ্ধ ভঙ্গিতে নাচানাচি করছে। আমার প্রেমের ‘খেতায়’ মানিকের আগুন লাগানো উচিত। তা উচিত কর্মই বটে। মানিক মুখ তুলে বলল, ‘দোস্ত, একটা জিনিস চাইব তোর কাছে। দিবি কি না তাই বল আগে।’
আমি বললাম, ‘বারে! আমার কাছে থাকলে দেব না কেন, তুই বল? তা বলেই ফেল না! থাকলে অবশ্যই পাইবি।’ সে আমার ডান কানের কাছে এগিয়ে এসে বলল, ‘তোর সেই চকচকে জমকালো পিস্তলটা ...। তা না হলে স্টেনগান ...। একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং দায়বদ্ধ কবির কাছে অবৈধ পিস্তল অথবা স্টেনগান থাকা কোনোমতেই উচিত নয়, বন্ধু।’ আমি বললাম, ‘ওসব ফালতু কথা। আমার কাছে পিস্তল নাই! স্টেনগানও! এ মুহূর্তে আমি দুলুর ব্যাপারে মানসিকভাবে খুবই ব্যস্ত আছি। পিস্তল, স্টেনগান, রাইফেল, গ্রেনেড ওসব তো একাত্তরের ব্যাপার! কবিতা লেখা হয় না আমার অনেক দিন যাবৎ। গল্প লেখা তো ভুলেই গিয়েছি। তা তোর লেখালেখির কথা বল।’
-ধেৎ শালা! কবিতার বইটা আমার জীবৎকালে আর বের হবে না দেখছি!
আমি তো হতবাক! পিস্তল, স্টেনগান এবং কবিতার বই! বললাম, ‘কিরে। তোর কথার মাথামুণ্ডু কিছুই তো বুঝতে পারছি না! তুই কবে আবার কবিতা লেখার “মধুসূদন” হয়ে উঠেছিস? তা লাপাত্তা হয়ে ইতিমধেই মহাকাব্য-টাব্য লিখে ফেলেছিস মনে হয়!’
-বুঝছ না শালা তুমি? চল উঠি এবার।
দুজনে ফুটপাতে এসে দাঁড়াই।
-কিরে? তোর মহাকাব্যের নাম কী?
আমি জিজ্ঞেস করলাম।
-পিস্তলের জন্য একধরনের ভালোবাসা।
মানিকের সাবলীল উত্তর।
-কিন্তু ওটা তো আমার কাছে নেই!
-আছে।
-নেই। বিশ্বাস কর।
-এবং আছে। তুই দিবি না তাই বল।
মানিকের চোখের তারায় কি পিস্তলের বারুদ জ্বলে উঠছে না? আমি ওর পিঠ চাপড়ে বললাম, ‘তুই ভালো করেই জানিস, মুক্তিযুদ্ধের পর ওসব আমার কাছে কোনো দিন ছিল না। যা ছিল তোদের সাথেই তো জমা দিয়েছিলাম। তো মিলনের কাছে একটা ছিল জানতাম। তাই এক দিনের জন্য ওটা চেয়েছিলাম। শুধু একবার।’
-পেয়েছিলি?
-ওটা পেলে কি আর আজকে আমার সাথে তোর সাক্ষাৎ হতো?
-মানে?
-আত্মহত্যা।
-কী!
-হ্যাঁ!
-তা আমি বুঝি না। ওটা আমার চাই। বড্ড প্রয়োজন। তুই বুঝছিস না দোস্ত।
-তুই কি পিস্তল টিপে কবিতার বই বের করতে চাস? নাকি আমার মতো আত্মহত্যা? তাহলে শালা আমিও তোমার তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধার এই শরীরটা কুশপুত্তলিকার মতো প্রকাশ্য দিবালোকে এবং জনারণ্যে আগুন লাগিয়ে ভস্ম বানিয়ে ছাড়ব। হ্যাঁ, ঠিকই বলছি।
-তুই জানিস না আজ কেন তোকে মিষ্টি খাওয়ালাম।
-বোধ হয় তোর মহাকাব্য নাকি কবিতার বই বের হবে তাই।
-না। ঠিক তা নয়।
-তো। তবে কি পিস্তল?
-ঠিক।
-তবে তোমার সে আশার গুড়ে বালিই দেখবে কেবল। তোমার কবিতার বই পাঠকের উষ্ণ স্পর্শ আর পাবে না ইহ জনমে, বাছাধন। যাও। অন্য উপায়ে কামিয়ে নাওগে। আচ্ছা মানিক বল তো, তুই এত দিন কোথায় ছিলি? আমাদের খোঁজ পর্যন্ত নিলি না।
-অভিসারে। খোঁজ নিইনি বললে ভুল বলা হবে। আরে তুমি শালা শহরের কাজটা ছেড়ে গ্রামে চলে গিয়েছিলে কার ওপর রাগ করে, সে খবরও রাখি। পয়সার অভাবে কবিতার বই বেরোয়নি তোমার। টাকার জন্য হেস্তনেস্ত হয়েছ ইত্যাদিও জানি। ‘তরঙ্গ’ সম্পাদকের সাথে পিন্টুর মন-কষাকষি এবং পরিণামে তার চাকরি খতম; তাও জানি। তবে শোন। মাঝেমধ্যে এ রকম লাপাত্তা হওয়ার মাঝেও বেশ মজা আছে।
-মজা!
-রিয়েলি। এই যে শালা, তুমি গ্রামে গিয়ে কাটিয়েছ বেশ কটা দিন। তা বুঝলে কেমন?
-কেমন মানে?
-এই যেমন তোর দুলুর কাছে ...। শোন, আমাদের সকলের জন্য একটা জরুরি আলাপ আছে। পিন্টু, মিলন, শ্যামল, ভুলুদা, ডানি, কেলু ওদের সবাইকে খবরটা জানিয়ে দিস, দোস্ত। আগামী শুক্রবার পিন্টুর মেসে। বিকাল চারটায়। আর তুইও আসবি অবশ্যই। না এলে দারুণ জিনিস মিস করবি। হ্যাঁ বলে দিলাম।
ছুটে গেল মানিক রাস্তার মোড়ে, বাসের ঝুলন্ত হ্যান্ডেলের পেছনে। আমি হাঁটতে থাকি উল্টো দিকে।
রাতে ভালো ঘুম হলো না। মানিকের কথা বারবার কানে বাজছে। ও আমার কাছে পিস্তল অথবা স্টেনগান চায়। সে কবিতার বই প্রকাশ করবে। এদিকে দুলুর সাথে আমারও জরুরি কিছু কথা আছে। এলোমেলো যত্ত সব চিন্তা। তার পরও মানিকই সারাক্ষণ মনটা আচ্ছন্ন করে রেখেছে। অতন্দ্র চোখে বিছানায় কিছুক্ষণ গড়াগড়ি করে শেলফ থেকে একখানা ‘তরঙ্গ’ সংখ্যা টেনে বের করি। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টাই। হ্যাঁ। এই তো মানিকের গল্প। মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন থেকে লব্ধ অভিজ্ঞতা ও স্মৃতি দিয়ে মোড়ানো গল্প। দারুণ লিখেছে!
বেচারা মানিক! লিকলিকে ফরসা চেহারা। মায়ের বেশি আদুরে ছেলে বলে বরাবরই তার পেট খারাপ থাকত। বড় হয়ে এখনো তার ধকল কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তাই নারীদের কেউ নাকি তার প্রেমে পড়তে চায় না। এই তার ‘প্রেম প্রেম’ করে একাত্তরের প্রতিটি বারুদগন্ধ দিনকে, রাতকে সে নিজের প্রেমিকা বলে জড়িয়ে ধরতে চাইত। অ্যাম্বুশ করে, মেশিনগানের, রাইফেলের ট্রিগার চেপে, হাতের মুঠোয় গ্রেনেড চেপে দুরন্ত কিশোর আমাদের সাথে ছুটে যেত রণাঙ্গনে হানাদার পাকসেনাদের মুখোমুখি। আহা সেই একাত্তর! সেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ! স্বাধীনতা! কী রক্তাক্ত অক্ষরে লেখা অম্লান স্মৃতি আমাদের! অথচ আমাদেরই একজন সেই আমাদের পিচ্চি মানিক মাত্রাতিরিক্ত গোঁফ নিয়ে দুর্বিনীতের মতো আমার সামানে এসে দাঁড়ায়! ‘শালা’ ছাড়া কথা বলে না। একটা বেআইনি অস্ত্রের জন্য একান্ত কাছের বন্ধুকে উত্ত্যক্ত করে কবিতার বই প্রকাশ করবে বলে। একটা পিস্তল অথবা স্টেনগানের জন্য ও এমন হন্যে হয়ে ছুটছে কেন? মানিক বরাবর গল্প লিখে। কবিতা ওর কাছে নাকি ‘আকাক্সিক্ষত নারীর অনাস্বাদিত স্পর্শের অনুভূতি’র মতো। আমি বলি, ‘কবিতায় নারী, পোশাকে অলংকারে সুসজ্জিতা উপমা এক।’ আর মানিক বলে, ‘আমি অনাবৃতা, অন্তর্বাসবিহীন নারী দেখতে চাই কবিতায়। সেই আমার স্বপ্নের কবিতা! তাই আমিও তোদের মতো কবিতা লিখতে চাই।’ সেই আমাদের মানিকই এখন রাস্তাঘাটে ভবঘুরের মতো ছুটে বেড়ায়। বলে, তাতেই মজা!
রাতে ঘুমিয়েও বিক্ষিপ্ত অনেক স্বপ্ন দেখলাম। ঘুম ও জাগরণের মাঝে, অস্থির মনে টুকরো টুকরো স্বপ্নের স্মৃতিময় স্ফটিক গেঁথে থাকা কেবল। দেখলাম সেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ! হানাদার পাকসেনাদের জলপাই রঙের জমকালো বহরের সেই পৈশাচিক উল্লাস! আর আমরা গুটি কতক মুক্তিযোদ্ধা! ভাঙাচোরা মাটির ঘরে নির্মিত আমাদের সেই একটি ক্যাম্প। রাইফেল, স্টেনগান, গ্রেনেড, কিছু প্রয়োজনীয় কাপড়চোপর। এক ব্যান্ডের একটি রেডিও সেট। আমার সাথে রাখা রবিঠাকুরের ‘গীতাঞ্জলি’। আর আমাদের সকলের বিনীতা রায়! আমাদের সকলের মাঝে সে ছিল একমাত্র নারী মুক্তিযোদ্ধা। লম্বা শ্যামল-কান্তি ছিমছাম সাবলীল চরিত্রের ওই মানুষটিকে কখনো নিরেট ‘নারী’ বলে মনে হতো না সে সময়। শুধু ভাবতাম, সেও আমাদের মতো মুক্তিপাগল অমিততেজী একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমাদের ওই বিনীতাকে শৈল্পিক দৃষ্টিতে খুঁটিয়ে দেখার কিংবা নিজেদেরকে প্রাগৈতিহাসিক চরিত্রের ‘জীব’ ভাবার সেই সুযোগ ও সময় আমাদের ছিল না। তবু আমাদের সকলের সেই বন্ধু বিনীতাকে দেখলাম, অত্যন্ত বিদ্ঘুটে বীভৎসতার মাঝে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে যেতে! দেখলাম উন্মত্ত পাকসেনাদের ধারাবাহিক পৈশাচিকতার নিচে; চিত হয়ে পড়ে রয়েছে সে। তার নগ্ন মসৃণ মাংসল অবয়বের উপরকার উপচে পড়া যৌবন, অস্ফুট আর্তনাদের প্রচণ্ডতায় খসে খসে যাচ্ছে! আবার দেখলাম আমাদের বিনীতা, সে শুধু একা নয়। এক বিনীতার প্রচ্ছায়ায় বাংলাদেশের নির্যাতিতা দুই লক্ষ মা-বোন ধারাবাহিক নিষ্পেষণে মূর্ছা যাচ্ছে কেবল! আহা! কী বীভৎস সেই দৃশ্য! এ পৈশাচিকতা আমাদের কারও সহ্য হলো না। এবং কী আশ্চর্য! আমরা সবাই তখন বয়সে যুবক মুক্তিযোদ্ধারাও সকলে একবাক্যে একযোগে পেছনে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে যাই। এবং একযোগে সব কটা পাকসেনাকে উল্টো চরিত্রের উন্মত্ততায়, প্রতিশোধ নিতে শুরু করি! এ সময় প্রতিহিংসার আগুনে ক্ষিপ্ত হয়ে আমরা হয়ে উঠেছি যেন এক একটা জ্বলন্ত ভিসুভিয়াস!
সকালে উঠে কিছুক্ষণ ভাবলাম, একটি মুক্তিযুদ্ধ, একজন বিনীতা রায় ও আমরা কতিপয় তার সহযোদ্ধা। তবে কি পাকসেনামুক্ত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ, ধর্ষণের মহামারিতে ছেয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই? পরে এই বিনীতাকে আমি কি আমার নিজস্ব প্রয়োজনে ব্যবহার করেছি কখনো? মিলন? পিন্টু? শ্যামল? আর অন্যরা? আমাদের এই মানিকও? জানি না। আমার দুলুর দিব্যি, সত্যি আমি জানি না! না! মানিক অন্তত এত সবের জঞ্জালে নিজেকে জড়ায়নি। এ কথা বলছি, কারণ ও আমাদের সকলের চেয়েও একটু বেশি নির্মল চরিত্রের একজন যুবক। শুনেছি বিনীতা রায় আমাদের সব কটাকেই ভালোবাসে। সকলকেই? বাসতেই পারে। আরও শুনেছি, বিয়েও করতে চায়! তবে শেষ পর্যন্ত কাকে? বিনীতার সাথে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গিয়েছে; দুলু আমার চেতনায় আসার সাথে সাথেই। অথচ আগে কী শারীরিক ও মানসিক ব্যতিব্যস্ততা নিয়ে ছুটে যেতাম আমার একমাত্র আরাধ্য এই বিনীতার কাছে। আমাদের দলে বিনীতা কি আসবে না, সেই মুক্তিযুদ্ধের ‘বিনীতা রায়’ হয়ে আগামী শুক্রবার পিন্টুর মেসে? এখন নিশ্চয়; আমার ভাবার সময়। বিনীতা না দুলু? নাহ্। বিনীতাকে কাছে পেলে সকলের সামনে কবিতার ভঙ্গিতে আমি সাবলীল উচ্চারণ করব, ‘বিনীতা সত্যি বলছি; তুমি শুধুই আমার! একমাত্র তুমিই আমার স্বপ্নের কাব্যপ্রতিমা। আমি অত্যন্ত স্বার্থপর। তাই তুমি ওদের কারও নও আর। শুধুই আমার!’
দুলুর ভালোবাসা আমার কাছে কাচের আয়নার মতো খান খান হয়ে ভেঙে গিয়েছে! টুকরো শত টুকরো হয়ে গিয়েছে আমার স্বপ্নের পঙ্্ক্তিমালা! এরই মাঝে দেখি ধূমকেতু মানিক আবির্ভূত হয়েছে তার কাব্যপ্রতিভা নিয়ে! সে আমাদের সবাইকে সিরিয়াসলি তলব করেছে। কিছু বলতে চায়। মনে হয়, পুরোনো দেনা-পাওনার ও সুদকষার হালখাতা নিয়ে বসবে। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের কী স্বপ্ন ছিল এবং স্বাধীনতার পর আমরা কী পেয়েছি ইত্যাদি ইত্যাদি। নইলে সে পিস্তল অথবা স্টেনগান চাইবে কেন? সে কি আবার আরেকটি ‘মুক্তিযুদ্ধ’ চাইছে? আবার সেই রণাঙ্গন? সেই ক্যাম্পে সবাই মিলে একযোগে আবার বিপুল স্বপ্নের চাষাবাদ?
কেন জানি না নিজেকে আজ বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে। একাত্তরে আমরা সকলেই একসাথে এক আত্মায় মিলেমিশে যুদ্ধ করেছি। আমাদের বাবলু, আগস্টিন, সুরেশ, হাসান রক্ত ও জীবন দিয়ে নির্বিশেষে শহীদ হয়েছে। তাদের দেশপ্রেম ও চূড়ান্ত ত্যাগের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। অথচ একাত্তরের পরপরই আমাদের সেই সম্মিলিত স্বপ্নের অবয়ব, অল্প সময়ের ব্যবধানেই স্যাঁতসেঁতে রংচটা পলেস্তরার মতো খসে গিয়েছে! দেখতে দেখতেই আমরা পরস্পর, আমাদের অস্তিত্ব থেকে একে একে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছি! আর কী অবাক কাণ্ড! সবাই আশ্চর্য রকম স্বার্থপর হয়ে পড়েছি! আমরা একসঙ্গে লিখছি। লেখা ছাপাচ্ছি। বাহবা কুড়চ্ছি। কেউ কেউ চাকরি করছি। ব্যবসায় নেমেছি। আবার কেউ কেউ বেকার ঘুরছি। অথচ কী আশ্চর্য! কেউ কারও খবর রাখছি না! খোঁজও নিচ্ছি না! হ্যাঁ আমাদের স্বাধীনতা! তোমাকে আবার পাওয়ার জন্য মানিক পুনরায় পিস্তল, স্টেনগান চেয়ে চেয়ে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আমাদের কাছে! বোধ করি, সে আরেকটি মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবেই অনুভব করছে। সে আমাদের সকলের দুই লক্ষ বিনীতাকে ওই পশু পাকসেনাদের নারকীয় খাকি হামাগুড়ির নিচ থেকে উদ্ধার করতে চায়...!
কী এক দুর্বোধ্য তাড়না নিয়ে শুক্রবার বিকাল চারটার আগেই পিন্টুর মেসে গিয়ে হাজির হলাম। দেখলাম আমাদের শিবিরের উপস্থিত অনেকেই, একধরনের ব্যাকুলতা নিয়ে কারও অপেক্ষা করছে। অনেক দিন পর আবার আমরা একত্রিত হচ্ছি! এটা আমার কাছে বিরাট কিছু! হ্যাঁ! কিন্তু কেন? এটা কি শুধু মানিকের, নাকি সময়ের দাবি? অনুভব করলাম, আমাদের সকলেই উৎকণ্ঠিত ব্যাকুলতা নিয়ে, দুর্লঙ্ঘ্য অপেক্ষার গভীরতা মাপছে আর তার পাঁচিল টপকাতে চাইছে আপ্রাণ। সাথে বুঝতে পারলাম, সকলের ভেতর সমুচ্চারিত ব্যাপক তাণ্ডবের ঝড় বইছে। আমার মনে হলো, অনেক দিন পর আবার আমরা একসাথে আরেকটি মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে যাচ্ছি। এই লম্বা অপেক্ষার পঙ্্ক্তিমালা আমরা কবিতার উদ্্গ্রীব শরীরে ঠেসে ঠেসে শব্দ বুনি মনে মনে। আমরা আবার আরেকটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ রচনা করতে ও তাতে সমর্পিত হতে চাই এক মনে, এক শরীরে একই রণাঙ্গনে। এ সময় ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’ আমার মস্তিষ্কে উচ্চারিত হতে হতে দেহমনে আবার একাত্তরের শিহরণ জাগায়। আমি অস্থির হয়ে পড়ি!
আবার ভাবি, আমাদের আজকের এই সম্মিলনের একমাত্র কারণ মানিক। আমাদের সকলের চোখ সকলের মুখের ওপর। তাতে যেন বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে। আর আমরা ঝলসে উঠছি বারবার। লক্ষ করলাম, সকলের একই জিজ্ঞাসা, মানিক কোথায়? আমাদের আজকের এই পুনর্মিলনের আহ্বায়ক তো একমাত্র মানিক!
-মানিক আসেনি। আসবে কি না জানি না।
আমাদের সকলের সচকিত দৃষ্টি পিন্টুর ওপর আছড়ে পড়ে। তার হাতে এক টুকরো সাদা কাগজ। ‘মানিক আসবে কি না জানি না’ কথাটি শুনে বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল আমার! এখনকার আমাদের কতকের উপস্থিতি আমরা প্রায়ই পিন্টুর পত্রিকার অফিসে, প্রেসে কিংবা সাহিত্যের আড্ডায় দেখি এবং বরাবর দেখতে পাই। কিন্তু মানিককে ইদানীং আমরা কোথাও পাচ্ছি না! হ্যাঁ! সে এখন আমাদের সকলের জন্য এক অনিয়মিত সুহৃদ। আমি দেখি, উপস্থিত সকলেই কিছু না কিছু বলতে চাইছে। তাদের কণ্ঠ উদাত্ত হতে চাইছে। তবে কি এখন আমরা মানিক-বিষয়ক কবিতা আবৃত্তি করতে চাইছি? অথচ আমাদের সকলেরই খুব ভালো করেই জানা আছে, এই মানিক বরাবর ভালো কবিতা রচনা করেনি। সে গল্প লিখে বেশ কয়েকটি পুরস্কার ছিনিয়ে এনে একটা ঈর্ষণীয় পর্যায়ে জায়গা করে নিয়েছে। বড়জোর আজকে ওর অবর্তমানে একটি ‘স্মরণসভা’ করা যেতে পারে এখানে। তার আগে মানিক-বিষয়ক একটি ‘শোক প্রস্তাব’ উপস্থাপন করা দরকার। তাই আমি প্রথম মুখ খুলি। আমি সকলের সামনে, আমার নিজস্ব গ্রন্থিত শব্দমালা দিয়ে গত কয়েক দিন আগে দেখা মানিকের দৃশ্যমান এক চারিত্রিক অবয়ব রচনা করি। প্রসঙ্গত, সে রাতে আমার দেখা স্বপ্নের গল্পটি, সকলের সামনে সাবলীল গতিতে আবৃত্তি করে শোনাই। আর সকলেই অবাক হওয়ার প্রবণতায় চঞ্চল হয়ে ওঠে। আমাদের দুই লক্ষ বিনীতাকে নির্যাতনের মর্মন্তুদ চিত্রটি আমি অত্যন্ত আবেগমথিত কণ্ঠে সকলের সামনে উপস্থাপন করি। আমি ঠিকই অনুভব করতে পারছি, সকলেই এ সময় একাত্তরে ব্যবহৃত এবং হাতছাড়া হয়ে যাওয়া সেই আগ্নেয়াস্ত্রের অভাব উপলব্ধি করছে। মানবিক কারণেই আমরা সবাই একযোগে আবার সশস্ত্র হতে চাইছি।
আমি বললাম, ‘তোমাদের আর কারও সাথে কি আমাদের মানিকের সাক্ষাৎ হয়েছে?’
-আমার হয়েছে।
শ্যামল বলল, ‘সে জোর করে আমাকে গরম জিলেপি খাইয়েছে। কারণ জিলেপির ভক্ত আমি।’
পিন্টু বলল, ‘আমারও হয়েছে। সে আমাকে মৃতসঞ্জীবনীতে ডুবিয়ে রেখেছিল। তোমরা জানো, ওটা আমার কত প্রিয়।’
-আমারও হয়েছে।
মিলন বলল, ‘ট্রিপল ফাইভে একেবারে বুঁদ বানিয়ে ছেড়েছে! আহ্্, স্বপ্নের ট্রিপল ফাইভ আমার!’
টিপু বলল, ‘আমারও হয়েছে। গরম গরম শিঙাড়ায় একেবারে উদরপূর্তি! দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার পর এই এতগুলো শিঙাড়া একসাথে! আগেও নিজের পয়সায় কোনো দিন কিনে খাইনি! তোমরা জানো, আমি পয়সা কম খরচা করি!’
-হুম।
পিন্টু বলল, ‘মানিক তোমাদের কাছে কিছু চেয়েছে?’
শ্যামল বলল, ‘হ্যাঁ। পিস্তল অথবা স্টেনগান।’
মিলন বলল, ‘হ্যাঁ। হ্যাঁ। পিস্তল অথবা স্টেনগান।’
টিপু বলল, ‘হ্যাঁ। হ্যাঁ। সেই পিস্তল অথবা স্টেনগান।’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ। আমার কাছেও। একই বিষয়। পিস্তল অথবা স্টেনগান।’
পিন্টু বলল, ‘আমার কাছেও ঠিক তা-ই। তবে তোমরা শোনো। মানিক আমাদের সকলের জন্য কিছু লিখে রেখে গিয়েছে।’
-লিখে রেখে গিয়েছে! ভুলুদার প্রশ্ন। তিনি আমাদের সবার চেয়ে কথা বলেন কম। ‘কী লিখে রেখে গিয়েছে?’
-আচ্ছা, ওর হয়েছেটা কী বল তো? আমাদের সকলের ভেতরের প্রশ্ন শ্যামলের উচ্চারণে মূর্ত হয়ে ওঠে।
আমরা সকলেই এবার নড়েচড়ে বসি।
-আচ্ছা, এবার আমি পড়ছি। পিন্টু মানিকের বিবৃতি পড়া শুরু করে :
‘সংগ্রামী সহযোদ্ধা বন্ধুগণ,
‘তোমাদের কয়েকজনের সাথে আমার সাক্ষাৎ হইয়াছে। সকলের সাথে হইলে খুশি হইতাম। প্রায় সকলেই তোমরা আমাকে “ধূমকেতু” নামে আখ্যায়িত করিয়াছ। বিষয়টি আমি স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করিতে পারি নাই। আমি তোমাদের কোনো দিনই পরিতৃপ্ত করিতে পারি নাই। তাই আমি দুঃখিত। আমি জানি; তোমরা আমার বন্ধু ও পরম হিতৈষী। এবং ইহাও জানি, তোমাদের বিচারে আমি ইতোমধ্যে নষ্ট হইয়া গিয়াছি। যদি তাহাই হয়, তবে জানিয়া রাখো, তাহা কেবল তোমাদের কারণেই। আমি বলি, বন্ধুরা তোমরা তৈরি হও আবার। সামনেই আরেকটা মুক্তিযুদ্ধ। কী বলিব। দুর্ভাগ্য আমার, সবাই তোমরা স্বার্থপর! তোমাদের সবাইকেই আমি চিনিয়াছি এবং জানিয়াছি। তাই তোমাদের সকলের অজ্ঞাতসারেই আমি তথাকথিত “শুভকর্ম”টা সারিয়া ফেলিয়াছি। দুঃখিত, তোমাদের জানার ভাগ্য হইল না। তোমরা সবাই ওকে চেনো।
‘কিন্তু বন্ধুগণ! আমি নারীকে দেখিয়াছি কাব্যিক দৃষ্টিতে। সেই নারী আমাকে এইভাবে হেনস্থা করিবে, তাহা আমার ধারণার অতীত। তাহা কোনো দিন আমি প্রত্যাশাও করি নাই। আমাদের শুভ পরিণয়ের স্বল্প সময়ের মধ্যেই; তাহার অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার বিষয়টা আমি জানিতে পারি। আমি পুরোপুরি বিশ্বাসও করিতে পারিতেছি না। কিন্তু ঘটনা সত্য। তাই তোমাদের কাছে পিস্তল অথবা স্টেনগান চাহিয়াছিলাম। হ্যাঁ, পিস্তল অথবা স্টেনগান! ওই আগ্নেয়াস্ত্র দিয়া আমার নিজের হাতেই, আমি ওই জারজ বীজটাকে সমূলে উপড়াইয়া ফেলিতে চাই। কিন্তু তোমাদের কেহই তাহা দাও নাই। আমি জানি, তোমাদের কাছে পিস্তল আছে। এমনকি স্টেনগান, রাইফেল, গ্রেনেডও আছে।’
পিন্টু থামে। নচ্ছার মানিকটা বলে কী! উপস্থিত আমাদের সকলেরই মুখাবয়ব রক্তহীন, একেবারেই শুকনো কাঠ হয়ে যায়! কে সেই নারী, যাকে আমরা সকলেই চিনি?
ঠিক এমনই বিপ্রতীপ সময়ে ভেজানো দরজা ঠেলে দুজন আগন্তুক আমাদের সকলের মাঝখানে এসে দাঁড়ায়। এ কে? আশ্চর্য! এ যে আমাদের সকলের; প্রার্থিত মানুষ মানিক! তার সঙ্গে ছাইরঙা বোরকা পরিহিতা নারীটি কে? সকলেরই চমকে ওঠার পালা!
-তোমার সাথে বোরকা পরা এ কে মানিক! উপস্থিত আমাদের; সকলের প্রায় সমুচ্চারিত ঠোঁট ঘন ঘন কেঁপে ওঠে।
-সত্য করে বল, তোমাদের মধ্যে কোন শালা ক্রিমিনাল?
বোরকার ঢাকনা খুলে ধরে গর্জে ওঠে ‘ধূমকেতু’ মানিক।
এ কী! এ যে আমাদের রণাঙ্গনের প্রতীক সকলের বিনীতা রায়! হায় বিনীতা! মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্পে একসাথে সকলের কত বিনিদ্র রাত আমরা কাটিয়েছি! বিনীতা এখন, এখানকার একটি নার্সিং হোমে সেবিকার কাজ করে।
-সত্য করে বল, কোন শালা ক্রিমিনাল? গর্জে ওঠে মানিক।
আমি বলি, তা বিনীতা নিজেই বলুক এবং একসাথে সকলে বলে ওঠে, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। বিনীতা নিজেই বলুক।’
আমার স্বগত প্রার্থনা, ‘বিনীতা, তুমি এবার সকলের সামনে তোমার ভেতরের সত্যটুকু প্রকাশ করে দাও। আমার কতিপয় বন্ধু, আমার সামনে তোমাকে আর কামনা করবে না। তুমি মানিকের বিবাহিতা স্ত্রী কিনা, এ মুহূর্তে আমার কাছে তা বিচার্য বিষয় নয়। আমার কাছে বড় হলো, একমাত্র তোমার একক ভালোবাসা। সত্যি বলছি বিনীতা, আমার একক ভালোবাসা, দুলুকে নয়, একমাত্র তোমাকেই ঘিরে। কিন্তু তুমি এ সময় অন্তঃসত্তা হলে কেন বিনীতা? আমার জন্য একটু অপেক্ষা কেন করলে না? এ কী করলে তুমি? হায় বিনীতা! শেষ পর্যন্ত তুমিও পর হয়ে গেলে!’
বিনীতা আমাদের সকলের মাঝখানে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ক্ষিপ্র হাতে তার মাথার আব্রু সে সরিয়ে ফেলে। এবার পলকবিহীন দিঘল চাহনিতে আমাদের সবাইকে দেখে নেয়। ওর জমাট লজ্জার সবটুকুই এতক্ষণে যেন কর্পূরের মতো উবে গিয়েছে। দৃপ্ত কণ্ঠে সে বলে, ‘তোমাদের সকলেই!’
আমরা কেউ প্রতিবাদ করি না। কারণ এ মুহূর্তে সকলেই, আমাদের সকলের কাছে ধরা পড়ে গিয়েছি। মানিকের কণ্ঠ এবার কবিতার মতো শব্দময় ভঙ্গিতে মূর্ত হয়ে ওঠে।
Ñতোমরা বন্ধুরা আবার আরেকটি যুদ্ধ চাও। দেখো, স্বার্থপরের মতো ইতোমধ্যে আমাদেরই কেউ কেউ শোষক হই। কেউ কেউ আবার শোষিতও হই। বন্ধুগণ! আমি হতভাগা শোষিতদের দলে! তাই চাই অস্ত্র! একাত্তরে ব্যবহৃত সেই আগ্নেয়াস্ত্র! দাও তোমরা পিস্তল, স্টেনগান, গ্রেনেড...! ত্বরিতে যত আছে জারজ ভ্রƒণ, সমূলে উৎপাটিত করি সমস্তই।
সশব্দে দরজা ঠেলে উ™£ান্ত মানিক আমাদের পদদলিত করে বেরিয়ে যায়। আমরাও ফিরে তার গন্তব্যে গমন করতে উদ্যত হই। কিন্তু আমাদের সকলের দরজা বন্ধ এখন। তাই সকলেই স্থবির বিস্ময়কে সম্বল করে বিনীতার সামনে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে থাকি। একরাশ অনুতাপের লেলিহান শিখা যেন আমাদের সবাইকেই দগ্ধ করেছে! আমাদের সকলের সামনে বিনীতা রায় হাঁটু ভেঙে আশ্রয়বিহীন লতার মতো এবার নেতিয়ে পড়ে। তার অপ্রতিরোধ্য অশ্রুর ধারা ক্রমত্বরিতে টসটস করে গড়িয়ে পড়ছে আমাদের পায়ের কাছে। এই প্রথম আমরা বিনীতাকে কাঁদতে দেখি!
এ মুহূর্তে আমার মনে হলো, আমরা সকলেই যেন একাত্তরের মঞ্চে পাকি হানাদার হয়ে একসঙ্গে বিনীতাকে ‘নির্যাতন’ করছি। যেন আরেকটি প্রলম্বিত ও যুদ্ধময় রক্তাক্ত একাত্তরের গর্ভের ভেতর দিয়ে আমরা একটি ক্রান্তিকাল অতিবাহিত করছি! যেন মুক্তিযোদ্ধা বীরাঙ্গনা বিনীতারা একসাথে অগণিত ‘যুদ্ধশিশু’ প্রসব করছে! হায়! অশ্রু, বেদনা ও রক্তে স্নাত নবজাত একটি বাংলাদেশের অভ্যুদয়কাল এই মহাকাল একাত্তর!
এবার আমরা সকলেই আমাদের বাহু বাড়িয়ে একযোগে ক্রন্দসী ও বিধ্বস্ত বিনীতাকে উদ্ধার করতে উদ্যত হই। আমরা ক্রমশ কেন্দ্রের দিকে এগিয়ে যাই এবং এক পা দু’ পা করে বিনীতার দিকেই এগিয়ে যাই।
আমি কেবল ওর দুর্বোধ্য গোঁফের দিকে তাকিয়ে আমাদের বিগত দিনের মানিকের চরিত্র বিশ্লেষণ করছি। মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি ওর নিজের প্রতি অবহেলার সাক্ষ্য দিচ্ছে। ক্লিন শেভ করা কচি ডাবের মতো মানিকের সে সবুজ মুখ কোথায় হারিয়ে গেল? জাঁদরেল এক শকুন যেন তথাকথিত পক্ষ বিস্তারপূর্বক আমাদের মানিকের সুকোমল সেই চরিত্রকে গ্রাস করে নিয়েছে!
আমি বললাম, ‘আরিচা মহাসড়কে গায়েব হয়ে গিয়েছে আমাদের কবিবন্ধু মানিক। এখন দেখছি; তুই সাধারণ গোঁফঅলা একটা পুরুষ মাত্র। নিজের চরিত্র পাল্টে চেহারায় ভিন্ন লেবাস জড়িয়েছিস। এ গোঁফ তুই কোথায় পেলি?’
হো হো শব্দে হেসে ওঠে মানিক, ‘কিরে বড় যে সংসারী শব্দ ছাড়ছিস!’
-সংসারী আর হলাম কখন? হতেই-বা পারলাম কোথায়?
আমি ঘাড় দুলিয়ে বলি, ‘সামান্য টিউশনির পয়সায় এখানে তোর মতো সংও সাজা যায় না রে মানিক।’
আবার তার হাসি। হাসি থামিয়ে আমার হাত টেনে ওর বুকের কাছে ধরে বলে, ‘আমার কবিতার বই বেরোচ্ছে। খবর তো রাখিস না।’
আমি বললাম, ‘রাখব কী করে? তা ছাড়া এ সময় আমার জন্য ওসব একেবারেই বাজে কথা। এখন কিছু খিলাইবি কি না তাই বল।’
মানিক যেন ধসে পড়ল মাটিতে। ওর বিস্ময়ভরা কণ্ঠ, ‘সত্যি? তাহলে কিছু খাবি তুই? চেয়ে খাসনি তো কোনো দিন, তাই বিশ্বাস করতে পারছি না। তা, পেটসর্বস্ব হয়ে গেলি নাকি আজকাল? এই বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আমার মতো কেউকেটার কাছে হাঁক মেরে দিন কাভার করে দিস বুঝি? বাঃ দোস! চমৎকার!’
-খাওয়াইবি কি না তাই বল না রে বাবা! এত ঘন কথা ভালো লাগে না!
-বেশ তো। তা চল না খাইয়ে দিই এক পেট!
ইদানীংকার ঢাকার সুপ্রসিদ্ধ সুইটসের প্লেট আমার সামনে। এত দিন যা দেখে কেবল ‘অর্ধ ভোজনং’ কর্মটা লোভাতুর চোখেই সেরেছি। আজ সেই মহার্ঘ্য আমার রসনাতৃপ্তির জন্য প্রস্তুত। ব্যাপারটা সত্যি ঘোলাটে মনে হচ্ছে না? কায়দামতো চাকরি একখানা বাগিয়েছে নিশ্চয়! নয় শালা, হাসানের মতো চোরাকারবার শুরু করে দিয়েছে কি না ওই জানে। কিন্তু মুহূর্তে আবার নিজেকে অপরাধী মনে হলো। আমার মুক্তিযোদ্ধা বন্ধু মানিক তো স্মাগলিং করবে না মরে গেলেও। ও শুধু আমার মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুই নয়Ñএকজন স্বনামধন্য গল্পকার বন্ধুও বটে।
-কিরে? তোদের দিনকাল কেমন চলছে? মানিকের প্রশ্ন আমাকে বাস্তবে টেনে আনল।
-ধুর, সুবিধার নয়। ও শালি কোন সময় ‘না’ বলে বসে সেই চিন্তায় আছি!
-কেন কেন?
-জানি না। মতিগতি কেমন যেন ঘোলাটে মনে হচ্ছে। ওর বাবা নাকি মিডল ইস্টের পাত্র জোগাড় করেছে। বুঝিস না, আমার তো পকেটে পয়সা নাই। তাই প্রেম-ভালোবাসাও ওর কাছে পানসে ও অর্থহীন হয়ে পড়েছে।
-শালা! তোর প্রেমের ‘খেতা’ পুড়ি। খা, মিষ্টি খা। দই আরেক প্লেট নে।
মানিক দই-মিষ্টি খাচ্ছে। আমি তাকিয়ে ওকে দেখি। গোঁফটা ওর কেমন ছন্দোবদ্ধ ভঙ্গিতে নাচানাচি করছে। আমার প্রেমের ‘খেতায়’ মানিকের আগুন লাগানো উচিত। তা উচিত কর্মই বটে। মানিক মুখ তুলে বলল, ‘দোস্ত, একটা জিনিস চাইব তোর কাছে। দিবি কি না তাই বল আগে।’
আমি বললাম, ‘বারে! আমার কাছে থাকলে দেব না কেন, তুই বল? তা বলেই ফেল না! থাকলে অবশ্যই পাইবি।’ সে আমার ডান কানের কাছে এগিয়ে এসে বলল, ‘তোর সেই চকচকে জমকালো পিস্তলটা ...। তা না হলে স্টেনগান ...। একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং দায়বদ্ধ কবির কাছে অবৈধ পিস্তল অথবা স্টেনগান থাকা কোনোমতেই উচিত নয়, বন্ধু।’ আমি বললাম, ‘ওসব ফালতু কথা। আমার কাছে পিস্তল নাই! স্টেনগানও! এ মুহূর্তে আমি দুলুর ব্যাপারে মানসিকভাবে খুবই ব্যস্ত আছি। পিস্তল, স্টেনগান, রাইফেল, গ্রেনেড ওসব তো একাত্তরের ব্যাপার! কবিতা লেখা হয় না আমার অনেক দিন যাবৎ। গল্প লেখা তো ভুলেই গিয়েছি। তা তোর লেখালেখির কথা বল।’
-ধেৎ শালা! কবিতার বইটা আমার জীবৎকালে আর বের হবে না দেখছি!
আমি তো হতবাক! পিস্তল, স্টেনগান এবং কবিতার বই! বললাম, ‘কিরে। তোর কথার মাথামুণ্ডু কিছুই তো বুঝতে পারছি না! তুই কবে আবার কবিতা লেখার “মধুসূদন” হয়ে উঠেছিস? তা লাপাত্তা হয়ে ইতিমধেই মহাকাব্য-টাব্য লিখে ফেলেছিস মনে হয়!’
-বুঝছ না শালা তুমি? চল উঠি এবার।
দুজনে ফুটপাতে এসে দাঁড়াই।
-কিরে? তোর মহাকাব্যের নাম কী?
আমি জিজ্ঞেস করলাম।
-পিস্তলের জন্য একধরনের ভালোবাসা।
মানিকের সাবলীল উত্তর।
-কিন্তু ওটা তো আমার কাছে নেই!
-আছে।
-নেই। বিশ্বাস কর।
-এবং আছে। তুই দিবি না তাই বল।
মানিকের চোখের তারায় কি পিস্তলের বারুদ জ্বলে উঠছে না? আমি ওর পিঠ চাপড়ে বললাম, ‘তুই ভালো করেই জানিস, মুক্তিযুদ্ধের পর ওসব আমার কাছে কোনো দিন ছিল না। যা ছিল তোদের সাথেই তো জমা দিয়েছিলাম। তো মিলনের কাছে একটা ছিল জানতাম। তাই এক দিনের জন্য ওটা চেয়েছিলাম। শুধু একবার।’
-পেয়েছিলি?
-ওটা পেলে কি আর আজকে আমার সাথে তোর সাক্ষাৎ হতো?
-মানে?
-আত্মহত্যা।
-কী!
-হ্যাঁ!
-তা আমি বুঝি না। ওটা আমার চাই। বড্ড প্রয়োজন। তুই বুঝছিস না দোস্ত।
-তুই কি পিস্তল টিপে কবিতার বই বের করতে চাস? নাকি আমার মতো আত্মহত্যা? তাহলে শালা আমিও তোমার তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধার এই শরীরটা কুশপুত্তলিকার মতো প্রকাশ্য দিবালোকে এবং জনারণ্যে আগুন লাগিয়ে ভস্ম বানিয়ে ছাড়ব। হ্যাঁ, ঠিকই বলছি।
-তুই জানিস না আজ কেন তোকে মিষ্টি খাওয়ালাম।
-বোধ হয় তোর মহাকাব্য নাকি কবিতার বই বের হবে তাই।
-না। ঠিক তা নয়।
-তো। তবে কি পিস্তল?
-ঠিক।
-তবে তোমার সে আশার গুড়ে বালিই দেখবে কেবল। তোমার কবিতার বই পাঠকের উষ্ণ স্পর্শ আর পাবে না ইহ জনমে, বাছাধন। যাও। অন্য উপায়ে কামিয়ে নাওগে। আচ্ছা মানিক বল তো, তুই এত দিন কোথায় ছিলি? আমাদের খোঁজ পর্যন্ত নিলি না।
-অভিসারে। খোঁজ নিইনি বললে ভুল বলা হবে। আরে তুমি শালা শহরের কাজটা ছেড়ে গ্রামে চলে গিয়েছিলে কার ওপর রাগ করে, সে খবরও রাখি। পয়সার অভাবে কবিতার বই বেরোয়নি তোমার। টাকার জন্য হেস্তনেস্ত হয়েছ ইত্যাদিও জানি। ‘তরঙ্গ’ সম্পাদকের সাথে পিন্টুর মন-কষাকষি এবং পরিণামে তার চাকরি খতম; তাও জানি। তবে শোন। মাঝেমধ্যে এ রকম লাপাত্তা হওয়ার মাঝেও বেশ মজা আছে।
-মজা!
-রিয়েলি। এই যে শালা, তুমি গ্রামে গিয়ে কাটিয়েছ বেশ কটা দিন। তা বুঝলে কেমন?
-কেমন মানে?
-এই যেমন তোর দুলুর কাছে ...। শোন, আমাদের সকলের জন্য একটা জরুরি আলাপ আছে। পিন্টু, মিলন, শ্যামল, ভুলুদা, ডানি, কেলু ওদের সবাইকে খবরটা জানিয়ে দিস, দোস্ত। আগামী শুক্রবার পিন্টুর মেসে। বিকাল চারটায়। আর তুইও আসবি অবশ্যই। না এলে দারুণ জিনিস মিস করবি। হ্যাঁ বলে দিলাম।
ছুটে গেল মানিক রাস্তার মোড়ে, বাসের ঝুলন্ত হ্যান্ডেলের পেছনে। আমি হাঁটতে থাকি উল্টো দিকে।
রাতে ভালো ঘুম হলো না। মানিকের কথা বারবার কানে বাজছে। ও আমার কাছে পিস্তল অথবা স্টেনগান চায়। সে কবিতার বই প্রকাশ করবে। এদিকে দুলুর সাথে আমারও জরুরি কিছু কথা আছে। এলোমেলো যত্ত সব চিন্তা। তার পরও মানিকই সারাক্ষণ মনটা আচ্ছন্ন করে রেখেছে। অতন্দ্র চোখে বিছানায় কিছুক্ষণ গড়াগড়ি করে শেলফ থেকে একখানা ‘তরঙ্গ’ সংখ্যা টেনে বের করি। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টাই। হ্যাঁ। এই তো মানিকের গল্প। মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন থেকে লব্ধ অভিজ্ঞতা ও স্মৃতি দিয়ে মোড়ানো গল্প। দারুণ লিখেছে!
বেচারা মানিক! লিকলিকে ফরসা চেহারা। মায়ের বেশি আদুরে ছেলে বলে বরাবরই তার পেট খারাপ থাকত। বড় হয়ে এখনো তার ধকল কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তাই নারীদের কেউ নাকি তার প্রেমে পড়তে চায় না। এই তার ‘প্রেম প্রেম’ করে একাত্তরের প্রতিটি বারুদগন্ধ দিনকে, রাতকে সে নিজের প্রেমিকা বলে জড়িয়ে ধরতে চাইত। অ্যাম্বুশ করে, মেশিনগানের, রাইফেলের ট্রিগার চেপে, হাতের মুঠোয় গ্রেনেড চেপে দুরন্ত কিশোর আমাদের সাথে ছুটে যেত রণাঙ্গনে হানাদার পাকসেনাদের মুখোমুখি। আহা সেই একাত্তর! সেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ! স্বাধীনতা! কী রক্তাক্ত অক্ষরে লেখা অম্লান স্মৃতি আমাদের! অথচ আমাদেরই একজন সেই আমাদের পিচ্চি মানিক মাত্রাতিরিক্ত গোঁফ নিয়ে দুর্বিনীতের মতো আমার সামানে এসে দাঁড়ায়! ‘শালা’ ছাড়া কথা বলে না। একটা বেআইনি অস্ত্রের জন্য একান্ত কাছের বন্ধুকে উত্ত্যক্ত করে কবিতার বই প্রকাশ করবে বলে। একটা পিস্তল অথবা স্টেনগানের জন্য ও এমন হন্যে হয়ে ছুটছে কেন? মানিক বরাবর গল্প লিখে। কবিতা ওর কাছে নাকি ‘আকাক্সিক্ষত নারীর অনাস্বাদিত স্পর্শের অনুভূতি’র মতো। আমি বলি, ‘কবিতায় নারী, পোশাকে অলংকারে সুসজ্জিতা উপমা এক।’ আর মানিক বলে, ‘আমি অনাবৃতা, অন্তর্বাসবিহীন নারী দেখতে চাই কবিতায়। সেই আমার স্বপ্নের কবিতা! তাই আমিও তোদের মতো কবিতা লিখতে চাই।’ সেই আমাদের মানিকই এখন রাস্তাঘাটে ভবঘুরের মতো ছুটে বেড়ায়। বলে, তাতেই মজা!
রাতে ঘুমিয়েও বিক্ষিপ্ত অনেক স্বপ্ন দেখলাম। ঘুম ও জাগরণের মাঝে, অস্থির মনে টুকরো টুকরো স্বপ্নের স্মৃতিময় স্ফটিক গেঁথে থাকা কেবল। দেখলাম সেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ! হানাদার পাকসেনাদের জলপাই রঙের জমকালো বহরের সেই পৈশাচিক উল্লাস! আর আমরা গুটি কতক মুক্তিযোদ্ধা! ভাঙাচোরা মাটির ঘরে নির্মিত আমাদের সেই একটি ক্যাম্প। রাইফেল, স্টেনগান, গ্রেনেড, কিছু প্রয়োজনীয় কাপড়চোপর। এক ব্যান্ডের একটি রেডিও সেট। আমার সাথে রাখা রবিঠাকুরের ‘গীতাঞ্জলি’। আর আমাদের সকলের বিনীতা রায়! আমাদের সকলের মাঝে সে ছিল একমাত্র নারী মুক্তিযোদ্ধা। লম্বা শ্যামল-কান্তি ছিমছাম সাবলীল চরিত্রের ওই মানুষটিকে কখনো নিরেট ‘নারী’ বলে মনে হতো না সে সময়। শুধু ভাবতাম, সেও আমাদের মতো মুক্তিপাগল অমিততেজী একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমাদের ওই বিনীতাকে শৈল্পিক দৃষ্টিতে খুঁটিয়ে দেখার কিংবা নিজেদেরকে প্রাগৈতিহাসিক চরিত্রের ‘জীব’ ভাবার সেই সুযোগ ও সময় আমাদের ছিল না। তবু আমাদের সকলের সেই বন্ধু বিনীতাকে দেখলাম, অত্যন্ত বিদ্ঘুটে বীভৎসতার মাঝে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে যেতে! দেখলাম উন্মত্ত পাকসেনাদের ধারাবাহিক পৈশাচিকতার নিচে; চিত হয়ে পড়ে রয়েছে সে। তার নগ্ন মসৃণ মাংসল অবয়বের উপরকার উপচে পড়া যৌবন, অস্ফুট আর্তনাদের প্রচণ্ডতায় খসে খসে যাচ্ছে! আবার দেখলাম আমাদের বিনীতা, সে শুধু একা নয়। এক বিনীতার প্রচ্ছায়ায় বাংলাদেশের নির্যাতিতা দুই লক্ষ মা-বোন ধারাবাহিক নিষ্পেষণে মূর্ছা যাচ্ছে কেবল! আহা! কী বীভৎস সেই দৃশ্য! এ পৈশাচিকতা আমাদের কারও সহ্য হলো না। এবং কী আশ্চর্য! আমরা সবাই তখন বয়সে যুবক মুক্তিযোদ্ধারাও সকলে একবাক্যে একযোগে পেছনে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে যাই। এবং একযোগে সব কটা পাকসেনাকে উল্টো চরিত্রের উন্মত্ততায়, প্রতিশোধ নিতে শুরু করি! এ সময় প্রতিহিংসার আগুনে ক্ষিপ্ত হয়ে আমরা হয়ে উঠেছি যেন এক একটা জ্বলন্ত ভিসুভিয়াস!
সকালে উঠে কিছুক্ষণ ভাবলাম, একটি মুক্তিযুদ্ধ, একজন বিনীতা রায় ও আমরা কতিপয় তার সহযোদ্ধা। তবে কি পাকসেনামুক্ত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ, ধর্ষণের মহামারিতে ছেয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই? পরে এই বিনীতাকে আমি কি আমার নিজস্ব প্রয়োজনে ব্যবহার করেছি কখনো? মিলন? পিন্টু? শ্যামল? আর অন্যরা? আমাদের এই মানিকও? জানি না। আমার দুলুর দিব্যি, সত্যি আমি জানি না! না! মানিক অন্তত এত সবের জঞ্জালে নিজেকে জড়ায়নি। এ কথা বলছি, কারণ ও আমাদের সকলের চেয়েও একটু বেশি নির্মল চরিত্রের একজন যুবক। শুনেছি বিনীতা রায় আমাদের সব কটাকেই ভালোবাসে। সকলকেই? বাসতেই পারে। আরও শুনেছি, বিয়েও করতে চায়! তবে শেষ পর্যন্ত কাকে? বিনীতার সাথে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গিয়েছে; দুলু আমার চেতনায় আসার সাথে সাথেই। অথচ আগে কী শারীরিক ও মানসিক ব্যতিব্যস্ততা নিয়ে ছুটে যেতাম আমার একমাত্র আরাধ্য এই বিনীতার কাছে। আমাদের দলে বিনীতা কি আসবে না, সেই মুক্তিযুদ্ধের ‘বিনীতা রায়’ হয়ে আগামী শুক্রবার পিন্টুর মেসে? এখন নিশ্চয়; আমার ভাবার সময়। বিনীতা না দুলু? নাহ্। বিনীতাকে কাছে পেলে সকলের সামনে কবিতার ভঙ্গিতে আমি সাবলীল উচ্চারণ করব, ‘বিনীতা সত্যি বলছি; তুমি শুধুই আমার! একমাত্র তুমিই আমার স্বপ্নের কাব্যপ্রতিমা। আমি অত্যন্ত স্বার্থপর। তাই তুমি ওদের কারও নও আর। শুধুই আমার!’
দুলুর ভালোবাসা আমার কাছে কাচের আয়নার মতো খান খান হয়ে ভেঙে গিয়েছে! টুকরো শত টুকরো হয়ে গিয়েছে আমার স্বপ্নের পঙ্্ক্তিমালা! এরই মাঝে দেখি ধূমকেতু মানিক আবির্ভূত হয়েছে তার কাব্যপ্রতিভা নিয়ে! সে আমাদের সবাইকে সিরিয়াসলি তলব করেছে। কিছু বলতে চায়। মনে হয়, পুরোনো দেনা-পাওনার ও সুদকষার হালখাতা নিয়ে বসবে। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের কী স্বপ্ন ছিল এবং স্বাধীনতার পর আমরা কী পেয়েছি ইত্যাদি ইত্যাদি। নইলে সে পিস্তল অথবা স্টেনগান চাইবে কেন? সে কি আবার আরেকটি ‘মুক্তিযুদ্ধ’ চাইছে? আবার সেই রণাঙ্গন? সেই ক্যাম্পে সবাই মিলে একযোগে আবার বিপুল স্বপ্নের চাষাবাদ?
কেন জানি না নিজেকে আজ বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে। একাত্তরে আমরা সকলেই একসাথে এক আত্মায় মিলেমিশে যুদ্ধ করেছি। আমাদের বাবলু, আগস্টিন, সুরেশ, হাসান রক্ত ও জীবন দিয়ে নির্বিশেষে শহীদ হয়েছে। তাদের দেশপ্রেম ও চূড়ান্ত ত্যাগের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। অথচ একাত্তরের পরপরই আমাদের সেই সম্মিলিত স্বপ্নের অবয়ব, অল্প সময়ের ব্যবধানেই স্যাঁতসেঁতে রংচটা পলেস্তরার মতো খসে গিয়েছে! দেখতে দেখতেই আমরা পরস্পর, আমাদের অস্তিত্ব থেকে একে একে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছি! আর কী অবাক কাণ্ড! সবাই আশ্চর্য রকম স্বার্থপর হয়ে পড়েছি! আমরা একসঙ্গে লিখছি। লেখা ছাপাচ্ছি। বাহবা কুড়চ্ছি। কেউ কেউ চাকরি করছি। ব্যবসায় নেমেছি। আবার কেউ কেউ বেকার ঘুরছি। অথচ কী আশ্চর্য! কেউ কারও খবর রাখছি না! খোঁজও নিচ্ছি না! হ্যাঁ আমাদের স্বাধীনতা! তোমাকে আবার পাওয়ার জন্য মানিক পুনরায় পিস্তল, স্টেনগান চেয়ে চেয়ে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আমাদের কাছে! বোধ করি, সে আরেকটি মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবেই অনুভব করছে। সে আমাদের সকলের দুই লক্ষ বিনীতাকে ওই পশু পাকসেনাদের নারকীয় খাকি হামাগুড়ির নিচ থেকে উদ্ধার করতে চায়...!
কী এক দুর্বোধ্য তাড়না নিয়ে শুক্রবার বিকাল চারটার আগেই পিন্টুর মেসে গিয়ে হাজির হলাম। দেখলাম আমাদের শিবিরের উপস্থিত অনেকেই, একধরনের ব্যাকুলতা নিয়ে কারও অপেক্ষা করছে। অনেক দিন পর আবার আমরা একত্রিত হচ্ছি! এটা আমার কাছে বিরাট কিছু! হ্যাঁ! কিন্তু কেন? এটা কি শুধু মানিকের, নাকি সময়ের দাবি? অনুভব করলাম, আমাদের সকলেই উৎকণ্ঠিত ব্যাকুলতা নিয়ে, দুর্লঙ্ঘ্য অপেক্ষার গভীরতা মাপছে আর তার পাঁচিল টপকাতে চাইছে আপ্রাণ। সাথে বুঝতে পারলাম, সকলের ভেতর সমুচ্চারিত ব্যাপক তাণ্ডবের ঝড় বইছে। আমার মনে হলো, অনেক দিন পর আবার আমরা একসাথে আরেকটি মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে যাচ্ছি। এই লম্বা অপেক্ষার পঙ্্ক্তিমালা আমরা কবিতার উদ্্গ্রীব শরীরে ঠেসে ঠেসে শব্দ বুনি মনে মনে। আমরা আবার আরেকটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ রচনা করতে ও তাতে সমর্পিত হতে চাই এক মনে, এক শরীরে একই রণাঙ্গনে। এ সময় ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’ আমার মস্তিষ্কে উচ্চারিত হতে হতে দেহমনে আবার একাত্তরের শিহরণ জাগায়। আমি অস্থির হয়ে পড়ি!
আবার ভাবি, আমাদের আজকের এই সম্মিলনের একমাত্র কারণ মানিক। আমাদের সকলের চোখ সকলের মুখের ওপর। তাতে যেন বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে। আর আমরা ঝলসে উঠছি বারবার। লক্ষ করলাম, সকলের একই জিজ্ঞাসা, মানিক কোথায়? আমাদের আজকের এই পুনর্মিলনের আহ্বায়ক তো একমাত্র মানিক!
-মানিক আসেনি। আসবে কি না জানি না।
আমাদের সকলের সচকিত দৃষ্টি পিন্টুর ওপর আছড়ে পড়ে। তার হাতে এক টুকরো সাদা কাগজ। ‘মানিক আসবে কি না জানি না’ কথাটি শুনে বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল আমার! এখনকার আমাদের কতকের উপস্থিতি আমরা প্রায়ই পিন্টুর পত্রিকার অফিসে, প্রেসে কিংবা সাহিত্যের আড্ডায় দেখি এবং বরাবর দেখতে পাই। কিন্তু মানিককে ইদানীং আমরা কোথাও পাচ্ছি না! হ্যাঁ! সে এখন আমাদের সকলের জন্য এক অনিয়মিত সুহৃদ। আমি দেখি, উপস্থিত সকলেই কিছু না কিছু বলতে চাইছে। তাদের কণ্ঠ উদাত্ত হতে চাইছে। তবে কি এখন আমরা মানিক-বিষয়ক কবিতা আবৃত্তি করতে চাইছি? অথচ আমাদের সকলেরই খুব ভালো করেই জানা আছে, এই মানিক বরাবর ভালো কবিতা রচনা করেনি। সে গল্প লিখে বেশ কয়েকটি পুরস্কার ছিনিয়ে এনে একটা ঈর্ষণীয় পর্যায়ে জায়গা করে নিয়েছে। বড়জোর আজকে ওর অবর্তমানে একটি ‘স্মরণসভা’ করা যেতে পারে এখানে। তার আগে মানিক-বিষয়ক একটি ‘শোক প্রস্তাব’ উপস্থাপন করা দরকার। তাই আমি প্রথম মুখ খুলি। আমি সকলের সামনে, আমার নিজস্ব গ্রন্থিত শব্দমালা দিয়ে গত কয়েক দিন আগে দেখা মানিকের দৃশ্যমান এক চারিত্রিক অবয়ব রচনা করি। প্রসঙ্গত, সে রাতে আমার দেখা স্বপ্নের গল্পটি, সকলের সামনে সাবলীল গতিতে আবৃত্তি করে শোনাই। আর সকলেই অবাক হওয়ার প্রবণতায় চঞ্চল হয়ে ওঠে। আমাদের দুই লক্ষ বিনীতাকে নির্যাতনের মর্মন্তুদ চিত্রটি আমি অত্যন্ত আবেগমথিত কণ্ঠে সকলের সামনে উপস্থাপন করি। আমি ঠিকই অনুভব করতে পারছি, সকলেই এ সময় একাত্তরে ব্যবহৃত এবং হাতছাড়া হয়ে যাওয়া সেই আগ্নেয়াস্ত্রের অভাব উপলব্ধি করছে। মানবিক কারণেই আমরা সবাই একযোগে আবার সশস্ত্র হতে চাইছি।
আমি বললাম, ‘তোমাদের আর কারও সাথে কি আমাদের মানিকের সাক্ষাৎ হয়েছে?’
-আমার হয়েছে।
শ্যামল বলল, ‘সে জোর করে আমাকে গরম জিলেপি খাইয়েছে। কারণ জিলেপির ভক্ত আমি।’
পিন্টু বলল, ‘আমারও হয়েছে। সে আমাকে মৃতসঞ্জীবনীতে ডুবিয়ে রেখেছিল। তোমরা জানো, ওটা আমার কত প্রিয়।’
-আমারও হয়েছে।
মিলন বলল, ‘ট্রিপল ফাইভে একেবারে বুঁদ বানিয়ে ছেড়েছে! আহ্্, স্বপ্নের ট্রিপল ফাইভ আমার!’
টিপু বলল, ‘আমারও হয়েছে। গরম গরম শিঙাড়ায় একেবারে উদরপূর্তি! দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার পর এই এতগুলো শিঙাড়া একসাথে! আগেও নিজের পয়সায় কোনো দিন কিনে খাইনি! তোমরা জানো, আমি পয়সা কম খরচা করি!’
-হুম।
পিন্টু বলল, ‘মানিক তোমাদের কাছে কিছু চেয়েছে?’
শ্যামল বলল, ‘হ্যাঁ। পিস্তল অথবা স্টেনগান।’
মিলন বলল, ‘হ্যাঁ। হ্যাঁ। পিস্তল অথবা স্টেনগান।’
টিপু বলল, ‘হ্যাঁ। হ্যাঁ। সেই পিস্তল অথবা স্টেনগান।’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ। আমার কাছেও। একই বিষয়। পিস্তল অথবা স্টেনগান।’
পিন্টু বলল, ‘আমার কাছেও ঠিক তা-ই। তবে তোমরা শোনো। মানিক আমাদের সকলের জন্য কিছু লিখে রেখে গিয়েছে।’
-লিখে রেখে গিয়েছে! ভুলুদার প্রশ্ন। তিনি আমাদের সবার চেয়ে কথা বলেন কম। ‘কী লিখে রেখে গিয়েছে?’
-আচ্ছা, ওর হয়েছেটা কী বল তো? আমাদের সকলের ভেতরের প্রশ্ন শ্যামলের উচ্চারণে মূর্ত হয়ে ওঠে।
আমরা সকলেই এবার নড়েচড়ে বসি।
-আচ্ছা, এবার আমি পড়ছি। পিন্টু মানিকের বিবৃতি পড়া শুরু করে :
‘সংগ্রামী সহযোদ্ধা বন্ধুগণ,
‘তোমাদের কয়েকজনের সাথে আমার সাক্ষাৎ হইয়াছে। সকলের সাথে হইলে খুশি হইতাম। প্রায় সকলেই তোমরা আমাকে “ধূমকেতু” নামে আখ্যায়িত করিয়াছ। বিষয়টি আমি স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করিতে পারি নাই। আমি তোমাদের কোনো দিনই পরিতৃপ্ত করিতে পারি নাই। তাই আমি দুঃখিত। আমি জানি; তোমরা আমার বন্ধু ও পরম হিতৈষী। এবং ইহাও জানি, তোমাদের বিচারে আমি ইতোমধ্যে নষ্ট হইয়া গিয়াছি। যদি তাহাই হয়, তবে জানিয়া রাখো, তাহা কেবল তোমাদের কারণেই। আমি বলি, বন্ধুরা তোমরা তৈরি হও আবার। সামনেই আরেকটা মুক্তিযুদ্ধ। কী বলিব। দুর্ভাগ্য আমার, সবাই তোমরা স্বার্থপর! তোমাদের সবাইকেই আমি চিনিয়াছি এবং জানিয়াছি। তাই তোমাদের সকলের অজ্ঞাতসারেই আমি তথাকথিত “শুভকর্ম”টা সারিয়া ফেলিয়াছি। দুঃখিত, তোমাদের জানার ভাগ্য হইল না। তোমরা সবাই ওকে চেনো।
‘কিন্তু বন্ধুগণ! আমি নারীকে দেখিয়াছি কাব্যিক দৃষ্টিতে। সেই নারী আমাকে এইভাবে হেনস্থা করিবে, তাহা আমার ধারণার অতীত। তাহা কোনো দিন আমি প্রত্যাশাও করি নাই। আমাদের শুভ পরিণয়ের স্বল্প সময়ের মধ্যেই; তাহার অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার বিষয়টা আমি জানিতে পারি। আমি পুরোপুরি বিশ্বাসও করিতে পারিতেছি না। কিন্তু ঘটনা সত্য। তাই তোমাদের কাছে পিস্তল অথবা স্টেনগান চাহিয়াছিলাম। হ্যাঁ, পিস্তল অথবা স্টেনগান! ওই আগ্নেয়াস্ত্র দিয়া আমার নিজের হাতেই, আমি ওই জারজ বীজটাকে সমূলে উপড়াইয়া ফেলিতে চাই। কিন্তু তোমাদের কেহই তাহা দাও নাই। আমি জানি, তোমাদের কাছে পিস্তল আছে। এমনকি স্টেনগান, রাইফেল, গ্রেনেডও আছে।’
পিন্টু থামে। নচ্ছার মানিকটা বলে কী! উপস্থিত আমাদের সকলেরই মুখাবয়ব রক্তহীন, একেবারেই শুকনো কাঠ হয়ে যায়! কে সেই নারী, যাকে আমরা সকলেই চিনি?
ঠিক এমনই বিপ্রতীপ সময়ে ভেজানো দরজা ঠেলে দুজন আগন্তুক আমাদের সকলের মাঝখানে এসে দাঁড়ায়। এ কে? আশ্চর্য! এ যে আমাদের সকলের; প্রার্থিত মানুষ মানিক! তার সঙ্গে ছাইরঙা বোরকা পরিহিতা নারীটি কে? সকলেরই চমকে ওঠার পালা!
-তোমার সাথে বোরকা পরা এ কে মানিক! উপস্থিত আমাদের; সকলের প্রায় সমুচ্চারিত ঠোঁট ঘন ঘন কেঁপে ওঠে।
-সত্য করে বল, তোমাদের মধ্যে কোন শালা ক্রিমিনাল?
বোরকার ঢাকনা খুলে ধরে গর্জে ওঠে ‘ধূমকেতু’ মানিক।
এ কী! এ যে আমাদের রণাঙ্গনের প্রতীক সকলের বিনীতা রায়! হায় বিনীতা! মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্পে একসাথে সকলের কত বিনিদ্র রাত আমরা কাটিয়েছি! বিনীতা এখন, এখানকার একটি নার্সিং হোমে সেবিকার কাজ করে।
-সত্য করে বল, কোন শালা ক্রিমিনাল? গর্জে ওঠে মানিক।
আমি বলি, তা বিনীতা নিজেই বলুক এবং একসাথে সকলে বলে ওঠে, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। বিনীতা নিজেই বলুক।’
আমার স্বগত প্রার্থনা, ‘বিনীতা, তুমি এবার সকলের সামনে তোমার ভেতরের সত্যটুকু প্রকাশ করে দাও। আমার কতিপয় বন্ধু, আমার সামনে তোমাকে আর কামনা করবে না। তুমি মানিকের বিবাহিতা স্ত্রী কিনা, এ মুহূর্তে আমার কাছে তা বিচার্য বিষয় নয়। আমার কাছে বড় হলো, একমাত্র তোমার একক ভালোবাসা। সত্যি বলছি বিনীতা, আমার একক ভালোবাসা, দুলুকে নয়, একমাত্র তোমাকেই ঘিরে। কিন্তু তুমি এ সময় অন্তঃসত্তা হলে কেন বিনীতা? আমার জন্য একটু অপেক্ষা কেন করলে না? এ কী করলে তুমি? হায় বিনীতা! শেষ পর্যন্ত তুমিও পর হয়ে গেলে!’
বিনীতা আমাদের সকলের মাঝখানে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ক্ষিপ্র হাতে তার মাথার আব্রু সে সরিয়ে ফেলে। এবার পলকবিহীন দিঘল চাহনিতে আমাদের সবাইকে দেখে নেয়। ওর জমাট লজ্জার সবটুকুই এতক্ষণে যেন কর্পূরের মতো উবে গিয়েছে। দৃপ্ত কণ্ঠে সে বলে, ‘তোমাদের সকলেই!’
আমরা কেউ প্রতিবাদ করি না। কারণ এ মুহূর্তে সকলেই, আমাদের সকলের কাছে ধরা পড়ে গিয়েছি। মানিকের কণ্ঠ এবার কবিতার মতো শব্দময় ভঙ্গিতে মূর্ত হয়ে ওঠে।
Ñতোমরা বন্ধুরা আবার আরেকটি যুদ্ধ চাও। দেখো, স্বার্থপরের মতো ইতোমধ্যে আমাদেরই কেউ কেউ শোষক হই। কেউ কেউ আবার শোষিতও হই। বন্ধুগণ! আমি হতভাগা শোষিতদের দলে! তাই চাই অস্ত্র! একাত্তরে ব্যবহৃত সেই আগ্নেয়াস্ত্র! দাও তোমরা পিস্তল, স্টেনগান, গ্রেনেড...! ত্বরিতে যত আছে জারজ ভ্রƒণ, সমূলে উৎপাটিত করি সমস্তই।
সশব্দে দরজা ঠেলে উ™£ান্ত মানিক আমাদের পদদলিত করে বেরিয়ে যায়। আমরাও ফিরে তার গন্তব্যে গমন করতে উদ্যত হই। কিন্তু আমাদের সকলের দরজা বন্ধ এখন। তাই সকলেই স্থবির বিস্ময়কে সম্বল করে বিনীতার সামনে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে থাকি। একরাশ অনুতাপের লেলিহান শিখা যেন আমাদের সবাইকেই দগ্ধ করেছে! আমাদের সকলের সামনে বিনীতা রায় হাঁটু ভেঙে আশ্রয়বিহীন লতার মতো এবার নেতিয়ে পড়ে। তার অপ্রতিরোধ্য অশ্রুর ধারা ক্রমত্বরিতে টসটস করে গড়িয়ে পড়ছে আমাদের পায়ের কাছে। এই প্রথম আমরা বিনীতাকে কাঁদতে দেখি!
এ মুহূর্তে আমার মনে হলো, আমরা সকলেই যেন একাত্তরের মঞ্চে পাকি হানাদার হয়ে একসঙ্গে বিনীতাকে ‘নির্যাতন’ করছি। যেন আরেকটি প্রলম্বিত ও যুদ্ধময় রক্তাক্ত একাত্তরের গর্ভের ভেতর দিয়ে আমরা একটি ক্রান্তিকাল অতিবাহিত করছি! যেন মুক্তিযোদ্ধা বীরাঙ্গনা বিনীতারা একসাথে অগণিত ‘যুদ্ধশিশু’ প্রসব করছে! হায়! অশ্রু, বেদনা ও রক্তে স্নাত নবজাত একটি বাংলাদেশের অভ্যুদয়কাল এই মহাকাল একাত্তর!
এবার আমরা সকলেই আমাদের বাহু বাড়িয়ে একযোগে ক্রন্দসী ও বিধ্বস্ত বিনীতাকে উদ্ধার করতে উদ্যত হই। আমরা ক্রমশ কেন্দ্রের দিকে এগিয়ে যাই এবং এক পা দু’ পা করে বিনীতার দিকেই এগিয়ে যাই।