‘কিচ্ছা নয় সইত্য ঘটনা
মানুষে করইন মাতামাতি,
পাহাড় পর্বত ছাড়িয়া বাড়িতে আইলো
সোনাবানের হাতি।’
এই বলে দাদি শুরু করলেন তার গফ (গল্প)। সে তো ব্রিটিশ আমলের কথা! পার্টিশনের টাইম। সবকিছু কি আর ইয়াদ আছে? সোনাবান! কী সুন্দর সোনারঙা চেহারা ছিল! চকচক করত।
‘সোনার বরণ রূপের বাহার,
নাম যে তাহার সোনাবান
ঠোঁট লাল করিয়া খাইত সে
খাসিয়া পুঞ্জির পান।’
সোনাবানের বাপ চান সওদাগর আর মা গোলাপবান। এই চান আর গোলাপের ঘরে খাঁটি সোনা না জন্মাইয়া কি তামা জন্মাইবে! চান আর গোলাপের একমাত্র কইন্যা সোনাবান। ফুলতলা বাজারে চানের বিরাট আড়ত। দু-দুজন লোক খাটে তার আড়তে। জুড়ী গাঙ পার হইয়া বিষ্ণুপুর, কদমতলা বাজার আর ত্রিপুরা থেকে কম দামে মাল এনে ফুলতলা বাজারে বিক্রি করে চান। ওই পারের ব্যবসায়ীরা চানকে অনেক খাতির করে। তারাই চানরে সওদাগর নামে ডাকা শুরু করে। এখন ফুলতলা বাজারেও সবাই তারে চান সওদাগর নামে চেনে।
ফুলতলা বাজার থেকে ২০ মিনিট দক্ষিণে হাঁটলেই বিরইনতলা গ্রাম। চা-বাগানের পাশ দিয়েই কাঁচা রাস্তা। চান সওদাগরের বাড়ি এই বিরইনতলায়।
বিরইনতলার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া জুড়ী গাঙের পানি উজানে বইছে। সোনাবানের শৈশব থেকে যৌবনÑএই গাঙের উজান-ভাটির সঙ্গেই কেটেছে। চা-বাগানের সঙ্গে পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে স্কুল আর মক্তবে যাতায়াত, শ্রমিকদের চা-পাতা তোলা, বিশাল চাকার ট্রাক্টরের বাগানের কাদা রাস্তায় আসা-যাওয়া, এসবই ছিল সোনাবানের নিত্যদিনের সঙ্গী। কতবার বাগানের রাস্তা দিয়ে হাতি যেতে দেখেছে। কতবার তার ইচ্ছে হয়েছে হাতির পিঠে চড়ে হাতিরা কোথায় যায় তা দেখার। সে ইচ্ছে তার মনেই রয়ে গেছে।
‘হাতির পিঠে ও মাহুত বন্ধু
আমার দিকে চাও,
সোনাবানরে তোমার সঙ্গে লও
যেই বা দেশে যাও।’
ফুলতলা চা-বাগানের টিলাবাবু শাহনেওয়াজ খান। দুই বছর ধরে আছে এই বাগানে। তার বাড়ি মুলতানে। তার এক চাচা একসময় ম্যানেজার ছিলেন বাগানের। চাকরি শেষে তিনি ফেরত চলে যান মুলতানে। ভাতিজা শাহনেওয়াজকে এখানে চাকরিতে লাগিয়ে দেন।
শাহনেওয়াজ দেখতে সুন্দর ও অতি মিষ্ট ব্যবহার। চান সওদাগরের দোকানে সদাই করতে আসে। চানের শাহনেওয়াজরে বড়ই ভালো লাগে। মনে মনে চিন্তা করে, সোনাবানের সঙ্গে যদি শাহনেওয়াজের বিবাহ দেওয়া যাইত!
ফুলতলা বাগানের ম্যানেজারসমেত শাহনেওয়াজের সঙ্গে কথা বলে চান। শাহনেওয়াজ রাজি হয় এবং বলে মুলতানে গিয়ে তার মা-বাবাকে নিয়ে এসে তারপর বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করবে। শাহনেওয়াজ ছুটি নিয়ে তার মা-বাবাকে আনতে মুলতানে চলে যায়। সেই সময় ১৯৪৭ এর আগস্ট মাস। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন আর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় পুরো ভারতবর্ষ বিপর্যস্ত। ঠিক এই সময় ব্রিটিশরা রেখা টেনে ভারতকে টুকরো টুকরো করে ফেলে। আর সেই রেখা ডিঙিয়ে শাহনেওয়াজের আর ফেরত আসা হয় না ফুলতলায়।
‘পার্টিশনে ভাঙল ভারত
হইলো টুকরা টুকরা
আর জাত ধরম বিদ্বেষে
হইলো আরো কুকড়া!’
পার্টিশনের পর জুড়ী গাঙ বরাবর রেখা পড়ে যাওয়ায় চান পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দা হয়ে গেল। গাঙ পাড়ি দিয়ে আর আগের মতো আড়তের মাল কিনতে যাওয়া কঠিন হয়ে গেল। এ সময় ময়না ঘটক বিবাহের সম্বন্ধ নিয়ে এল সোনাবানের জন্য। ঘটকালিতে ময়না ঘটকের নাম মুখে মুখে। দুই শর ওপরে বিবাহের উকিল সে। এখন পর্যন্ত কোনো বিবাহ তার ফেল মারে নাই।
‘ঘটক কইলে ময়না উকিল
আর বাকি সব আবাদি
সত্তুরের বুড়ারেও ময়নায়
করাইছে শাদি।’
: ও দাদি! এতক্ষণ হলো তুমি সোনাবানের হাতির কথা তো কিছুই বলছ না! হাতির কী হলো!
: আরে দাদুভাই, বলব বলব। আমরা সোনাবানের হাতির খোঁজেই তো আগাচ্ছি। একটু সবুর করো। আমি একটু দম নিয়ে নিই।
‘তাড়াহুড়ো করে না দাদাভাই
নিতে দাও মোরে শ্বাস
সোনাবানের হাতির কথা
এক বিরাট ইতিহাস।’
কুলাউড়ার আমতৈল গ্রামের আশন শাহর ছেলে রুশন শাহর জন্য সম্বন্ধ আনল ময়না ঘটক। রুশনের বাবা আশন শাহর আবার পীরালিতে নামডাক। রুশন ম্যাট্রিক পাস। বিরাট গৃহস্থ পরিবার। বাড়ির সামনে গোয়ালজোর হাওরে তাদের এক শ বিঘার ওপরে খেত আছে। রুশনের আবার কুলাউড়া বাজারে ভাতের হোটেলও আছে। ছেলের চেহারাছবিও ভালো।
কথাবার্তার এক মাসের মাথায় সোনাবান আর রুশনের বিবাহ হয়ে গেল।
গোয়ালজোর হাওরে পানি বেড়েছে। কলাগাছের ভেলায় চড়ে সোনাবানকে নিয়ে রুশন হাওর ঘুরতে গেল। হাওরের পানির ঢেউয়ের কলকল শব্দে সোনাবান আর রুশনের হাসি-তামাশা মিশে গেল। সেই শব্দে হাওরের কচুরিপানা নাচতে লাগল, মাছেরা উজানে সাঁতার কাটল, বক আর হাঁসেরা উড়তে লাগল বাতাসের তালে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আকাশের চাঁদ ঝিলমিল করতে লাগল হাওরের জলে। ভেলার সঙ্গে সোনাবানের শাড়ির আঁচলখানা ভিজে চলল এক আপামর ভবিষ্যতের পানে।
তিন মাস পর চান সওদাগর এসে সোনাবানকে নাইওর নিয়ে গেল। বাগানের রাস্তা দিয়ে হাতি দেখতে দেখতে বিরইনতলায় পৌঁছাল সোনাবান। হাতি দেখে তার হাতির পিঠে চড়ার পুরোনো ইচ্ছা নাড়া দিয়ে গেল। কিন্তু বাপের বাড়ি এসে সোনাবানের মন পড়ে রইল গোয়ালজোর হাওরে।
দুই সপ্তাহ পর রুশন সোনাবানকে নিতে আসে। আসার পর সোনাবান রুশনকে একটা খুশির সংবাদ দেয়।
‘শুনেন স্বামী একটা সুখের কথা
আমার মুখে রাখেন আপনার কান
আমাদের ঘরে আসিতেছে
এক নতুন মেহমান।’
খুশির খবর শুনে রুশন সোনাবানের মুখখানি দু’হাতে জড়িয়ে ধরল। বলল, তুমি কী চাও আমার কাছে? যা চাইবে তা-ই দেব। জবাবে সোনাবান বললÑ
‘ছোট্ট একটা চাওয়া আছে
মনের ভিতর আমার,
একবার যদি হইতে পারতাম
হাতির পিঠে সওয়ার।’
রুশন বলল, হাতি কি আর চাইলেই পাওয়া যায়? আচ্ছা দেখি কী করা যায়। আমি হাতির খোঁজখবর নেব। এখন চলো আমরা বাড়ি ফিরে যাই। কিন্তু সোনাবান বেঁকে বসল। সে হাতির পিঠে করেই শ্বশুরবাড়ি ফেরত যাবে। আর তা না হলে যাবে না। রুশন বলল, হাতি জোগাড় করা তো মুখের কথা না। আমি কিচ্ছু জানি না, সোনাবান বলল। হাতি জোগাড় করে নিয়ে আসবেন, তার পরেই আমি আপনার বাড়িতে ফিরব।
রুশন হাতি খুঁজতে বেরিয়ে যায়। পাহাড়-জঙ্গল মাড়িয়ে যেখানেই হাতির খোঁজ পায় সেখানেই যায়। কিন্তু লাভ হয় না। কেউ হাতি দিতে রাজি হয় না। এভাবে কয়েক মাস কেটে যায়। শেষমেশ রুশন গেল পৃথিমপাশা নবাববাড়ি। নবাববাড়িতে অনেকগুলো হাতি আছে। সেখানে সে মাহুতের চাকরি নিল। তখন পৃথিমপাশার নবাব ছিলেন নবাব আলী হায়দার খান। নবাবের কাছে রুশন আর্জি রাখলÑ
‘নবাবের কাছে আর্জি আমার, হব হাতির রাখাল
বেতন চাই না পয়সা চাই না করব সবই দেখভাল।
বিনিময়ে হাতিটা ধারে দিবেন সপ্তাহের তরে
হাতিতে চড়িয়ে সোনাবানরে ফিরিয়ে আনব ঘরে।
নবাব আলী হায়দার খান রাজি হলেন। তবে শর্ত দিয়ে বললেন, হাতি তুমি নিতে পারবে মহররমের পরে আশুরার শোক মিছিল শেষ হওয়ার পর। আর হাতি যত দিন তোমার কাছে থাকবে, তার দেখভাল আর খাওয়াদাওয়ার দায়িত্ব তোমার। রাজি?
রুশন রাজি হলো। এদিকে আশুরার এখনো চার-পাঁচ মাস বাকি।
অপেক্ষায় মাসের পর মাস কেটে গেল সোনাবানের। কোলজুড়ে নতুন অতিথি এল। তাদের ছেলেসন্তান।
আশুরা শেষে হাতি নিয়ে সোনাবানকে আনতে গেল রুশন। সোনাবানের হাতি দেখার পর দুই চোখে আনন্দধারা বয়ে যায়। আর সোনাবানের কোলে শিশুসন্তানকে দেখে রুশনেরও চোখ গড়িয়ে জল পড়ে। তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে রইল। সোনাবান বলল, অবশেষে তুমি হাতি নিয়ে এলে!
‘মাস শেষে বছর গেল
সোনাবানের হাতি এল
হাতির পিঠে সোনাবান
পেছনে ছুটে মানুষের বান।’
সারা দিন হাতির পিঠে চড়ে সন্ধ্যার আগে সোনাবানরা পৌঁছাল আমতৈল। হাতি দেখতে সারা গ্রামের মানুষ জড়ো হলো রুশন শাহর বাড়িতে। সবাই জিজ্ঞেস করছে, এটা কার হাতি? রুশন জবাব দেয়, এটা সোনাবানের হাতি! রাতভর গ্রামের মানুষ হাতির কাছেই বসে রইল। কেউ কলাগাছ, কেউ গাছের ডাল আর কেউবা ফলমূল নিয়ে এল হাতির জন্য। হাতিকে খাওয়াতে রুশনের আর কোনো চিন্তাই করতে হলো না।
নবাববাড়ির বদৌলতে হাতি জোগাড় হওয়ায় রুশন তার ছেলের নাম রাখল নবাব শাহ। ছোট নবাবকে নিয়ে সোনাবান আর রুশন ঘুরতে গেল গোয়ালজোর হাওরে।
‘ছোট্ট নবাব হাওর ঘুরে সোনাবানের কোলে
দখিনা বাতাসের সুরে কলার ভেলা দোলে।
হাওরের পানি ঝিলিক মারে রবির কিরণে
সুখের অশ্রু গড়িয়ে পড়ে সোনাবানের নয়নে।’
দুই দিন পর রুশন নবাববাড়িতে হাতি ফেরত দিয়ে আসে। এরপর কেটে যায় কয়েক বছর। ছোট্ট নবাবের বোন আসে সোনাবানের সংসারে। নবাব শাহ স্কুলে ভর্তি হয়। সোনাবান রেডিওতে ভাষা আন্দোলনের খবর শোনে। জানতে পারে, ঢাকায় ভাষার জন্য অনেকেই প্রাণ হারিয়েছে। এর প্রতিবাদে কুলাউড়া শহরে প্রতিবাদ মিছিল হয়। কুলাউড়ার সৈয়দ আকমল হোসেনসহ অনেকেই সম্মিলিতভাবে এই প্রতিবাদ মিছিলের আয়োজন করেন। সেই মিছিলে রুশনও যোগ দেয়। রুশন বাড়িতে এসে জানায়, কুলাউড়ার মেয়ে রওশন আরা বাচ্চু ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে। শুনে সোনাবান গর্বিত বোধ করে। মনে মনে ভাবে, ইশ্্, আমিও যদি আন্দোলন করতে পারতাম!
খবর আসে নবাববাড়িতে সোনাবানের সেই হাতিটি পাগল হয়ে গিয়েছে। মাহুতসহ গ্রামবাসীকে হাতি আক্রমণ করেছে। নবাববাড়ির লোকেরা হাতিটিকে কালা পাহাড়ের ওপাশে ইন্ডিয়ার জঙ্গলে নিয়ে ছেড়ে দিয়ে আসে। সপ্তাহখানেক পর একদিন রাতে হাতিটি রুশনের বাড়িতে এসে উপস্থিত। গ্রামবাসীসহ সবাই ভয় পেয়ে গেল। কিন্তু হাতিটি কাউকেই আক্রমণ করল না। হাতিটি সোনাবানের দিকে এগিয়ে এল। সোনাবান হাতিটিকে আদর করে কলাগাছ খাওয়াল। আবার সেই রাতেই হাতিটি উধাও হয়ে গেল। এভাবে কিছুদিন পরপর হাতিটি সোনাবানের বাড়িতে আসে এবং ভোর হবার আগেই চলে যায়। খবর পেয়ে একদিন নবাববাড়ির লোকেরা আসে রুশনদের বাড়িতে হাতি নিয়ে যেতে। কিন্তু তখন হাতিটি পাগলের মতো আক্রমণ করে সবাইকে তাড়িয়ে দেয়। এলাকা আর দূরদূরান্তের সবাই জানে, এই হাতি সোনাবানের পোষ মেনেছে। সোনাবানের হাতি নামেই মানুষের মুখে মুখে রটে গেল।
‘লাখ টাকার হাতি এখন পোষে সোনাবান
সেই হাতিরে পাহারা দেয় আসমানের চান
সোনাবানের হাতির কথা রটে মুখে মুখে
দূরদূরান্তর মানুষ এসে হাতিটারে দেখে।’
কেটে যায় অনেক বছর। সোনাবান আর রুশনের মা-বাবা গত হয়েছেন। নবাব শাহ বিয়ে পাস করে। নবাবের ছোট বোনের বিয়ে হয়ে যায়। দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। নবাব মুক্তিবাহিনীতে নাম লেখায়। সোনাবান ছেলেকে দোয়া করে দেয়। সোনাবানের মনে পড়ে যায় কুলাউড়ার মেয়ে ভাষাসৈনিক রওশন আরা বাচ্চুর কথা, যে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল। সোনাবানের বয়স থাকলে সেও মুক্তিযুদ্ধে যেত। তার ছেলে নবাব মুক্তিযুদ্ধে গেলে সোনাবানের আর সে আফসোস থাকে না।
সোনাবানের হাতিটিরও বয়স হয়েছে। এখনো হাতিটি কদিন পরপর সোনাবানের বাড়িতে আসে।
তুমুল যুদ্ধ চলছে সারা দেশে। গোয়ালজোর হাওর পানিতে ডুবে আছে। হাওরের মাঝখানে একটি পরিত্যক্ত নৌকার মধ্যে কিছু মুক্তিযোদ্ধা ঘাঁটি করে। মুক্তিযোদ্ধা মোহন লাল সোমের নেতৃত্বে কুলাউড়া শহরের পাশে অপারেশনের জন্য তারা জড়ো হয় এই হাওরে। সোনাবান ও রুশন মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করে। রাতের অন্ধকারে ভেলায় চড়ে সোনাবান মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার ও পানীয় দিয়ে আসে।
এই যোদ্ধাদের দেখে সোনাবানের তার ছেলে নবাব শাহর কথা মনে পড়ে যায়। ছেলেটি কোথায় আছে, কেমন আছে, বেঁচে আছে না মারা গেছে-সেই ভাবনায় সোনাবানের মন উতলা হয়। কিন্তু এই মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করে সে ছেলের কথা ভুলে থাকে।
সোনাবানের ছেলের মুক্তিযুদ্ধে যোগদান এবং সোনাবানের মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার জন্য পাকিস্তানি সেনাদের দোসর সোনাবানকে টার্গেট করে।
কুলাউড়া এনসি হাইস্কুলে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প ছিল, যার দায়িত্বে ছিল মেজর ওয়াহিদ মোগল। ওই ক্যাম্প থেকে শান্তি কমিটির সদস্য মাহতাব উদ্দিন চৌধুরীর লোকেরা সেনাদের নিয়ে এসে সোনাবানের বাড়িতে হামলা করে। ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। কিন্তু বাড়ির উঠানে সোনাবানের হাতিকে দেখে সবাই পিছু হটে। আগুন থেকে বাঁচতে সোনাবান ঘর থেকে বেরিয়ে হাতির কাছে যায়। হাতি সোনাবানকে শুঁড় দিয়ে টেনে তার পিঠে তোলে নেয়। সোনাবানকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হতেই দূর হতে গুলি করে পাকিস্তান আর্মি। সোনাবান হাতির পিঠে লুটিয়ে পড়ে। সোনাবানের রক্তে কালো হাতি লাল হয়ে যায়।
‘হাতির পিঠে ঘুমিয়ে আছে নীরব সোনাবান
গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে তার লাল রক্তের বান।
হাতির চোখে জলের ধারা কাঁদে আসমান
হাওরের পানি শান্ত আজ বাতাসও গায় না গান।
দেশ স্বাধীন হয়। হাওরের পানি নেমে শুকিয়ে গেছে। যুদ্ধ শেষে সোনাবানের ছেলে নবাব শাহ স্বাধীন পতাকা হাতে ফিরে আসে। নবাব জানে না সে এক মাকে শত্রুর হাত থেকে ছিনিয়ে এনেছে ঠিকই কিন্তু আরেক মা তার হারিয়ে গেছে।
সোনাবানের মৃত্যুর পর সোনাবানের লাল রক্তের দাগ নিয়ে হাতিটি রাতের আঁধারে মিলিয়ে যায়। আর কোনো দিন ফেরত আসেনি। হাতিটি কোথায় গিয়েছে কেউ জানে না।
সোনাবানের হাতির কথা মানুষ মনে রাখলেও ইতিহাসের কোথাও সোনাবানের নাম লিখে রাখেনি কেউ।
-লন্ডন, যুক্তরাজ্য
মানুষে করইন মাতামাতি,
পাহাড় পর্বত ছাড়িয়া বাড়িতে আইলো
সোনাবানের হাতি।’
এই বলে দাদি শুরু করলেন তার গফ (গল্প)। সে তো ব্রিটিশ আমলের কথা! পার্টিশনের টাইম। সবকিছু কি আর ইয়াদ আছে? সোনাবান! কী সুন্দর সোনারঙা চেহারা ছিল! চকচক করত।
‘সোনার বরণ রূপের বাহার,
নাম যে তাহার সোনাবান
ঠোঁট লাল করিয়া খাইত সে
খাসিয়া পুঞ্জির পান।’
সোনাবানের বাপ চান সওদাগর আর মা গোলাপবান। এই চান আর গোলাপের ঘরে খাঁটি সোনা না জন্মাইয়া কি তামা জন্মাইবে! চান আর গোলাপের একমাত্র কইন্যা সোনাবান। ফুলতলা বাজারে চানের বিরাট আড়ত। দু-দুজন লোক খাটে তার আড়তে। জুড়ী গাঙ পার হইয়া বিষ্ণুপুর, কদমতলা বাজার আর ত্রিপুরা থেকে কম দামে মাল এনে ফুলতলা বাজারে বিক্রি করে চান। ওই পারের ব্যবসায়ীরা চানকে অনেক খাতির করে। তারাই চানরে সওদাগর নামে ডাকা শুরু করে। এখন ফুলতলা বাজারেও সবাই তারে চান সওদাগর নামে চেনে।
ফুলতলা বাজার থেকে ২০ মিনিট দক্ষিণে হাঁটলেই বিরইনতলা গ্রাম। চা-বাগানের পাশ দিয়েই কাঁচা রাস্তা। চান সওদাগরের বাড়ি এই বিরইনতলায়।
বিরইনতলার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া জুড়ী গাঙের পানি উজানে বইছে। সোনাবানের শৈশব থেকে যৌবনÑএই গাঙের উজান-ভাটির সঙ্গেই কেটেছে। চা-বাগানের সঙ্গে পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে স্কুল আর মক্তবে যাতায়াত, শ্রমিকদের চা-পাতা তোলা, বিশাল চাকার ট্রাক্টরের বাগানের কাদা রাস্তায় আসা-যাওয়া, এসবই ছিল সোনাবানের নিত্যদিনের সঙ্গী। কতবার বাগানের রাস্তা দিয়ে হাতি যেতে দেখেছে। কতবার তার ইচ্ছে হয়েছে হাতির পিঠে চড়ে হাতিরা কোথায় যায় তা দেখার। সে ইচ্ছে তার মনেই রয়ে গেছে।
‘হাতির পিঠে ও মাহুত বন্ধু
আমার দিকে চাও,
সোনাবানরে তোমার সঙ্গে লও
যেই বা দেশে যাও।’
ফুলতলা চা-বাগানের টিলাবাবু শাহনেওয়াজ খান। দুই বছর ধরে আছে এই বাগানে। তার বাড়ি মুলতানে। তার এক চাচা একসময় ম্যানেজার ছিলেন বাগানের। চাকরি শেষে তিনি ফেরত চলে যান মুলতানে। ভাতিজা শাহনেওয়াজকে এখানে চাকরিতে লাগিয়ে দেন।
শাহনেওয়াজ দেখতে সুন্দর ও অতি মিষ্ট ব্যবহার। চান সওদাগরের দোকানে সদাই করতে আসে। চানের শাহনেওয়াজরে বড়ই ভালো লাগে। মনে মনে চিন্তা করে, সোনাবানের সঙ্গে যদি শাহনেওয়াজের বিবাহ দেওয়া যাইত!
ফুলতলা বাগানের ম্যানেজারসমেত শাহনেওয়াজের সঙ্গে কথা বলে চান। শাহনেওয়াজ রাজি হয় এবং বলে মুলতানে গিয়ে তার মা-বাবাকে নিয়ে এসে তারপর বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করবে। শাহনেওয়াজ ছুটি নিয়ে তার মা-বাবাকে আনতে মুলতানে চলে যায়। সেই সময় ১৯৪৭ এর আগস্ট মাস। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন আর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় পুরো ভারতবর্ষ বিপর্যস্ত। ঠিক এই সময় ব্রিটিশরা রেখা টেনে ভারতকে টুকরো টুকরো করে ফেলে। আর সেই রেখা ডিঙিয়ে শাহনেওয়াজের আর ফেরত আসা হয় না ফুলতলায়।
‘পার্টিশনে ভাঙল ভারত
হইলো টুকরা টুকরা
আর জাত ধরম বিদ্বেষে
হইলো আরো কুকড়া!’
পার্টিশনের পর জুড়ী গাঙ বরাবর রেখা পড়ে যাওয়ায় চান পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দা হয়ে গেল। গাঙ পাড়ি দিয়ে আর আগের মতো আড়তের মাল কিনতে যাওয়া কঠিন হয়ে গেল। এ সময় ময়না ঘটক বিবাহের সম্বন্ধ নিয়ে এল সোনাবানের জন্য। ঘটকালিতে ময়না ঘটকের নাম মুখে মুখে। দুই শর ওপরে বিবাহের উকিল সে। এখন পর্যন্ত কোনো বিবাহ তার ফেল মারে নাই।
‘ঘটক কইলে ময়না উকিল
আর বাকি সব আবাদি
সত্তুরের বুড়ারেও ময়নায়
করাইছে শাদি।’
: ও দাদি! এতক্ষণ হলো তুমি সোনাবানের হাতির কথা তো কিছুই বলছ না! হাতির কী হলো!
: আরে দাদুভাই, বলব বলব। আমরা সোনাবানের হাতির খোঁজেই তো আগাচ্ছি। একটু সবুর করো। আমি একটু দম নিয়ে নিই।
‘তাড়াহুড়ো করে না দাদাভাই
নিতে দাও মোরে শ্বাস
সোনাবানের হাতির কথা
এক বিরাট ইতিহাস।’
কুলাউড়ার আমতৈল গ্রামের আশন শাহর ছেলে রুশন শাহর জন্য সম্বন্ধ আনল ময়না ঘটক। রুশনের বাবা আশন শাহর আবার পীরালিতে নামডাক। রুশন ম্যাট্রিক পাস। বিরাট গৃহস্থ পরিবার। বাড়ির সামনে গোয়ালজোর হাওরে তাদের এক শ বিঘার ওপরে খেত আছে। রুশনের আবার কুলাউড়া বাজারে ভাতের হোটেলও আছে। ছেলের চেহারাছবিও ভালো।
কথাবার্তার এক মাসের মাথায় সোনাবান আর রুশনের বিবাহ হয়ে গেল।
গোয়ালজোর হাওরে পানি বেড়েছে। কলাগাছের ভেলায় চড়ে সোনাবানকে নিয়ে রুশন হাওর ঘুরতে গেল। হাওরের পানির ঢেউয়ের কলকল শব্দে সোনাবান আর রুশনের হাসি-তামাশা মিশে গেল। সেই শব্দে হাওরের কচুরিপানা নাচতে লাগল, মাছেরা উজানে সাঁতার কাটল, বক আর হাঁসেরা উড়তে লাগল বাতাসের তালে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আকাশের চাঁদ ঝিলমিল করতে লাগল হাওরের জলে। ভেলার সঙ্গে সোনাবানের শাড়ির আঁচলখানা ভিজে চলল এক আপামর ভবিষ্যতের পানে।
তিন মাস পর চান সওদাগর এসে সোনাবানকে নাইওর নিয়ে গেল। বাগানের রাস্তা দিয়ে হাতি দেখতে দেখতে বিরইনতলায় পৌঁছাল সোনাবান। হাতি দেখে তার হাতির পিঠে চড়ার পুরোনো ইচ্ছা নাড়া দিয়ে গেল। কিন্তু বাপের বাড়ি এসে সোনাবানের মন পড়ে রইল গোয়ালজোর হাওরে।
দুই সপ্তাহ পর রুশন সোনাবানকে নিতে আসে। আসার পর সোনাবান রুশনকে একটা খুশির সংবাদ দেয়।
‘শুনেন স্বামী একটা সুখের কথা
আমার মুখে রাখেন আপনার কান
আমাদের ঘরে আসিতেছে
এক নতুন মেহমান।’
খুশির খবর শুনে রুশন সোনাবানের মুখখানি দু’হাতে জড়িয়ে ধরল। বলল, তুমি কী চাও আমার কাছে? যা চাইবে তা-ই দেব। জবাবে সোনাবান বললÑ
‘ছোট্ট একটা চাওয়া আছে
মনের ভিতর আমার,
একবার যদি হইতে পারতাম
হাতির পিঠে সওয়ার।’
রুশন বলল, হাতি কি আর চাইলেই পাওয়া যায়? আচ্ছা দেখি কী করা যায়। আমি হাতির খোঁজখবর নেব। এখন চলো আমরা বাড়ি ফিরে যাই। কিন্তু সোনাবান বেঁকে বসল। সে হাতির পিঠে করেই শ্বশুরবাড়ি ফেরত যাবে। আর তা না হলে যাবে না। রুশন বলল, হাতি জোগাড় করা তো মুখের কথা না। আমি কিচ্ছু জানি না, সোনাবান বলল। হাতি জোগাড় করে নিয়ে আসবেন, তার পরেই আমি আপনার বাড়িতে ফিরব।
রুশন হাতি খুঁজতে বেরিয়ে যায়। পাহাড়-জঙ্গল মাড়িয়ে যেখানেই হাতির খোঁজ পায় সেখানেই যায়। কিন্তু লাভ হয় না। কেউ হাতি দিতে রাজি হয় না। এভাবে কয়েক মাস কেটে যায়। শেষমেশ রুশন গেল পৃথিমপাশা নবাববাড়ি। নবাববাড়িতে অনেকগুলো হাতি আছে। সেখানে সে মাহুতের চাকরি নিল। তখন পৃথিমপাশার নবাব ছিলেন নবাব আলী হায়দার খান। নবাবের কাছে রুশন আর্জি রাখলÑ
‘নবাবের কাছে আর্জি আমার, হব হাতির রাখাল
বেতন চাই না পয়সা চাই না করব সবই দেখভাল।
বিনিময়ে হাতিটা ধারে দিবেন সপ্তাহের তরে
হাতিতে চড়িয়ে সোনাবানরে ফিরিয়ে আনব ঘরে।
নবাব আলী হায়দার খান রাজি হলেন। তবে শর্ত দিয়ে বললেন, হাতি তুমি নিতে পারবে মহররমের পরে আশুরার শোক মিছিল শেষ হওয়ার পর। আর হাতি যত দিন তোমার কাছে থাকবে, তার দেখভাল আর খাওয়াদাওয়ার দায়িত্ব তোমার। রাজি?
রুশন রাজি হলো। এদিকে আশুরার এখনো চার-পাঁচ মাস বাকি।
অপেক্ষায় মাসের পর মাস কেটে গেল সোনাবানের। কোলজুড়ে নতুন অতিথি এল। তাদের ছেলেসন্তান।
আশুরা শেষে হাতি নিয়ে সোনাবানকে আনতে গেল রুশন। সোনাবানের হাতি দেখার পর দুই চোখে আনন্দধারা বয়ে যায়। আর সোনাবানের কোলে শিশুসন্তানকে দেখে রুশনেরও চোখ গড়িয়ে জল পড়ে। তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে রইল। সোনাবান বলল, অবশেষে তুমি হাতি নিয়ে এলে!
‘মাস শেষে বছর গেল
সোনাবানের হাতি এল
হাতির পিঠে সোনাবান
পেছনে ছুটে মানুষের বান।’
সারা দিন হাতির পিঠে চড়ে সন্ধ্যার আগে সোনাবানরা পৌঁছাল আমতৈল। হাতি দেখতে সারা গ্রামের মানুষ জড়ো হলো রুশন শাহর বাড়িতে। সবাই জিজ্ঞেস করছে, এটা কার হাতি? রুশন জবাব দেয়, এটা সোনাবানের হাতি! রাতভর গ্রামের মানুষ হাতির কাছেই বসে রইল। কেউ কলাগাছ, কেউ গাছের ডাল আর কেউবা ফলমূল নিয়ে এল হাতির জন্য। হাতিকে খাওয়াতে রুশনের আর কোনো চিন্তাই করতে হলো না।
নবাববাড়ির বদৌলতে হাতি জোগাড় হওয়ায় রুশন তার ছেলের নাম রাখল নবাব শাহ। ছোট নবাবকে নিয়ে সোনাবান আর রুশন ঘুরতে গেল গোয়ালজোর হাওরে।
‘ছোট্ট নবাব হাওর ঘুরে সোনাবানের কোলে
দখিনা বাতাসের সুরে কলার ভেলা দোলে।
হাওরের পানি ঝিলিক মারে রবির কিরণে
সুখের অশ্রু গড়িয়ে পড়ে সোনাবানের নয়নে।’
দুই দিন পর রুশন নবাববাড়িতে হাতি ফেরত দিয়ে আসে। এরপর কেটে যায় কয়েক বছর। ছোট্ট নবাবের বোন আসে সোনাবানের সংসারে। নবাব শাহ স্কুলে ভর্তি হয়। সোনাবান রেডিওতে ভাষা আন্দোলনের খবর শোনে। জানতে পারে, ঢাকায় ভাষার জন্য অনেকেই প্রাণ হারিয়েছে। এর প্রতিবাদে কুলাউড়া শহরে প্রতিবাদ মিছিল হয়। কুলাউড়ার সৈয়দ আকমল হোসেনসহ অনেকেই সম্মিলিতভাবে এই প্রতিবাদ মিছিলের আয়োজন করেন। সেই মিছিলে রুশনও যোগ দেয়। রুশন বাড়িতে এসে জানায়, কুলাউড়ার মেয়ে রওশন আরা বাচ্চু ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে। শুনে সোনাবান গর্বিত বোধ করে। মনে মনে ভাবে, ইশ্্, আমিও যদি আন্দোলন করতে পারতাম!
খবর আসে নবাববাড়িতে সোনাবানের সেই হাতিটি পাগল হয়ে গিয়েছে। মাহুতসহ গ্রামবাসীকে হাতি আক্রমণ করেছে। নবাববাড়ির লোকেরা হাতিটিকে কালা পাহাড়ের ওপাশে ইন্ডিয়ার জঙ্গলে নিয়ে ছেড়ে দিয়ে আসে। সপ্তাহখানেক পর একদিন রাতে হাতিটি রুশনের বাড়িতে এসে উপস্থিত। গ্রামবাসীসহ সবাই ভয় পেয়ে গেল। কিন্তু হাতিটি কাউকেই আক্রমণ করল না। হাতিটি সোনাবানের দিকে এগিয়ে এল। সোনাবান হাতিটিকে আদর করে কলাগাছ খাওয়াল। আবার সেই রাতেই হাতিটি উধাও হয়ে গেল। এভাবে কিছুদিন পরপর হাতিটি সোনাবানের বাড়িতে আসে এবং ভোর হবার আগেই চলে যায়। খবর পেয়ে একদিন নবাববাড়ির লোকেরা আসে রুশনদের বাড়িতে হাতি নিয়ে যেতে। কিন্তু তখন হাতিটি পাগলের মতো আক্রমণ করে সবাইকে তাড়িয়ে দেয়। এলাকা আর দূরদূরান্তের সবাই জানে, এই হাতি সোনাবানের পোষ মেনেছে। সোনাবানের হাতি নামেই মানুষের মুখে মুখে রটে গেল।
‘লাখ টাকার হাতি এখন পোষে সোনাবান
সেই হাতিরে পাহারা দেয় আসমানের চান
সোনাবানের হাতির কথা রটে মুখে মুখে
দূরদূরান্তর মানুষ এসে হাতিটারে দেখে।’
কেটে যায় অনেক বছর। সোনাবান আর রুশনের মা-বাবা গত হয়েছেন। নবাব শাহ বিয়ে পাস করে। নবাবের ছোট বোনের বিয়ে হয়ে যায়। দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। নবাব মুক্তিবাহিনীতে নাম লেখায়। সোনাবান ছেলেকে দোয়া করে দেয়। সোনাবানের মনে পড়ে যায় কুলাউড়ার মেয়ে ভাষাসৈনিক রওশন আরা বাচ্চুর কথা, যে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল। সোনাবানের বয়স থাকলে সেও মুক্তিযুদ্ধে যেত। তার ছেলে নবাব মুক্তিযুদ্ধে গেলে সোনাবানের আর সে আফসোস থাকে না।
সোনাবানের হাতিটিরও বয়স হয়েছে। এখনো হাতিটি কদিন পরপর সোনাবানের বাড়িতে আসে।
তুমুল যুদ্ধ চলছে সারা দেশে। গোয়ালজোর হাওর পানিতে ডুবে আছে। হাওরের মাঝখানে একটি পরিত্যক্ত নৌকার মধ্যে কিছু মুক্তিযোদ্ধা ঘাঁটি করে। মুক্তিযোদ্ধা মোহন লাল সোমের নেতৃত্বে কুলাউড়া শহরের পাশে অপারেশনের জন্য তারা জড়ো হয় এই হাওরে। সোনাবান ও রুশন মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করে। রাতের অন্ধকারে ভেলায় চড়ে সোনাবান মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার ও পানীয় দিয়ে আসে।
এই যোদ্ধাদের দেখে সোনাবানের তার ছেলে নবাব শাহর কথা মনে পড়ে যায়। ছেলেটি কোথায় আছে, কেমন আছে, বেঁচে আছে না মারা গেছে-সেই ভাবনায় সোনাবানের মন উতলা হয়। কিন্তু এই মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করে সে ছেলের কথা ভুলে থাকে।
সোনাবানের ছেলের মুক্তিযুদ্ধে যোগদান এবং সোনাবানের মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার জন্য পাকিস্তানি সেনাদের দোসর সোনাবানকে টার্গেট করে।
কুলাউড়া এনসি হাইস্কুলে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প ছিল, যার দায়িত্বে ছিল মেজর ওয়াহিদ মোগল। ওই ক্যাম্প থেকে শান্তি কমিটির সদস্য মাহতাব উদ্দিন চৌধুরীর লোকেরা সেনাদের নিয়ে এসে সোনাবানের বাড়িতে হামলা করে। ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। কিন্তু বাড়ির উঠানে সোনাবানের হাতিকে দেখে সবাই পিছু হটে। আগুন থেকে বাঁচতে সোনাবান ঘর থেকে বেরিয়ে হাতির কাছে যায়। হাতি সোনাবানকে শুঁড় দিয়ে টেনে তার পিঠে তোলে নেয়। সোনাবানকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হতেই দূর হতে গুলি করে পাকিস্তান আর্মি। সোনাবান হাতির পিঠে লুটিয়ে পড়ে। সোনাবানের রক্তে কালো হাতি লাল হয়ে যায়।
‘হাতির পিঠে ঘুমিয়ে আছে নীরব সোনাবান
গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে তার লাল রক্তের বান।
হাতির চোখে জলের ধারা কাঁদে আসমান
হাওরের পানি শান্ত আজ বাতাসও গায় না গান।
দেশ স্বাধীন হয়। হাওরের পানি নেমে শুকিয়ে গেছে। যুদ্ধ শেষে সোনাবানের ছেলে নবাব শাহ স্বাধীন পতাকা হাতে ফিরে আসে। নবাব জানে না সে এক মাকে শত্রুর হাত থেকে ছিনিয়ে এনেছে ঠিকই কিন্তু আরেক মা তার হারিয়ে গেছে।
সোনাবানের মৃত্যুর পর সোনাবানের লাল রক্তের দাগ নিয়ে হাতিটি রাতের আঁধারে মিলিয়ে যায়। আর কোনো দিন ফেরত আসেনি। হাতিটি কোথায় গিয়েছে কেউ জানে না।
সোনাবানের হাতির কথা মানুষ মনে রাখলেও ইতিহাসের কোথাও সোনাবানের নাম লিখে রাখেনি কেউ।
-লন্ডন, যুক্তরাজ্য